Saturday, July 23, 2016

স্বাধীন মত প্রকাশের কণ্ঠরোধে আমার উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া



এটা ‘রমযান’ মাস। মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র মাস। তাদের বিশ্বাস এ মাসে ‘কোরান’ অবতীর্ণ হয়েছিলো মুহাম্মদের ওপর। শুধু কোরান নয়, অন্য আসমানি গ্রন্থও (আল্লাহর কেতাব) অন্যান্য নবিদের উপর এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছিল। মুসা নবির ওপর ‘তাওরাত’, দাউদ নবির ওপর ‘যবুর’ আর ঈশা নবির ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ‘ইনজিল’প্রত্যেক কেতাবেই নাকি রোযা রাখার নির্দেশ রয়েছে। ‘রোযা’ ফারসি  শব্দ। ‘তাওরাত’ গ্রন্থে রোযাকে বলা হয়েছে ‘হাত্ব’। ‘হাত্ব’ শব্দের অর্থ পাপ ধ্বংস করা। ‘যবুর’-এ রোযাকে অভিহিত করা হয়েছে ‘একারবত’ শব্দে যার অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা। ‘ইনজিল’ নামক ধর্মগ্রন্থে রোযার উল্লেখ আছে ‘ত্বাব’ শব্দে। ‘ত্বাব’-এর অর্থ পবিত্র হওয়া বা কলুষমুক্ত হওয়া। সর্বশেষ আল্লাহর কেতাব ‘কোরানে’ রোযাকে বলা হয়েছে সিয়াম। আরবি ‘সাওম’ শব্দ থেকে এসেছে সিয়াম। সাওমের অর্থ বিরত থাকা । আর রমযান এসেছে ‘রময’ শব্দ থেকে। ‘রময’ মানে দগ্ধ করা, পুড়িয়ে দেওয়া। কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ এসব পুড়িয়ে আত্মশুদ্ধ করাই হল সিয়াম সাধনা। রমযান মাসের কোন এক রাত্রি নাকি হাজার রাত্রির চেয়ে উত্তম। এ মাসের প্রথম ভাগে আল্লাহ রহমত দান করে, দ্বিতীয় ভাগে গুনাহ (পাপ) মাফ করে এবং শেষে ও তৃতীয় ভাগে মুসলমানদের দোযখের (নরক) আগুন মুক্ত করে। এমনই বিশাল গুরুত্ব রমযান মাসের।
আমি এসব বিশ্বাস করি না। তবু রমযান ও রোযা সম্পর্কে এত কথা উল্লেখ করলাম এজন্য যে, যে মাস সকল পাপ কার্য থেকে বিরত থাকার মাস, সে মাসেই আমার এখানে মৌলানা সম্প্রদায় একজন ‘মুরতাদ’কে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছে। সে মুরতাদ অন্য কেউ নয়, সে হল এই অধম,  গিয়াসুদ্দিন। তা কী আমার অপরাধ? আমার প্রথম অপরাধ, আমি নাস্তিক, ধর্মে-টর্মে আমার বিশ্বাস নেই, কোনরূপ ধর্মাচারণ আমি করি না। ধর্মকে কার্লমার্ক্স বলেছেন আফিঙ, বাংলাদেশের কবি রুদ্র মহম্মদ বলেছেন ‘হেমলক বিষ’, আমি মনে করি ধর্ম তার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু। ধর্মের কারণে পৃথিবীতে  যত যুদ্ধ ও প্রাণহানি হয়েছে অন্য কারণে বোধ হয় তত হয়নি। গরীব মানুষের, বিশেষ করে নারীজাতির সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে ধর্ম। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না ঠিকই, কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতি কারও চেয়ে ভালবাসা আমার কম নেই। আমি সব ধর্মের মানুষকে ভালবাসি। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে একটু অধিক ভালবাসি মুসলমানদেরই। কারণ তারা সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাদপদ। আরও একটা কারণ হল, জন্মেছি মুসলমান পরিবারে, মুসলিম সমাজের মানুষের আদর-স্নেহ-ভালবাসা নিয়ে বড় হয়েছি। মানুষকে ভালবাসলে কী হবে,  আমি যে নাস্তিক,  তাই  বহুদিন থেকেই আমি মোল্লা সমাজের চোখের  বালি। আমার সম্পর্কে তাদের অন্তরে ক্রোধ ও জ্বালা  বহুদিন থেকেই।  
তিন দশকেরও বেশী রাজনীতি করেছি। বুকে ছিল সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন। বুকভরা সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে রাজনীতিকে (দলীয় রাজনীতিকে) বিদায় জানিয়েছি। মাইক্রোফোন ছেড়ে হাতে কলম তুলেছি। লেখনি শক্তি সামান্যই, নেই বলাই ভাল, তবু লিখি ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সকল ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। মুসলমানদের ভালবাসি বলেই লিখি। মোল্লা সমাজের খপ্পরে পড়ে মুসলিম সমাজ একশ’ বছর আধুনিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। এর ফলে মুসলিম সমাজে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনওভাবেই পূরণ হবে না। এখন জাকাত-ফেতরা-কোরবানির চামড়ার কোটি কোটি টাকা খারিজি মাদ্রাসায় খরচ করা হয়। প্রশ্ন তুলেছি কেন সেই টাকার একটা অংশ মুসলিম গরীব ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে না। মুসলিম সমাজে নারিজাতির কোন মর্যাদা ও অধিকার নেই। তাদের স্বাধীনতার জন্য, তাদের অধিকারের পক্ষে লিখি। প্রশ্ন তুলেছি কেন মুসলিম পুরুষেরা চারটি স্ত্রী রাখার অধিকার, অকারণে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার ভোগ করবে? কেন স্বামী নির্যাতন-নিপীড়ন চালালেও স্ত্রী তালাক দিতে পারবে না? নারীকে পুরুষের সমান অধিকার কেন দেওয়া হবে না? কেন নারী বোরখা না পরলে খারাপ মেয়ে বলে অপমান করা হবে? পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রে বিবাহ ও তালাকের শরিয়ত আইন বাতিল করে আধুনিক আইন চালু করা হয়েছে। কেন ভারতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন চালু থাকবে?  মুসলিম নারী কেন হিন্দু নারী বা অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের নারীর সমান অধিকার পাবে না? পান থেকে চুন খসার মত তুচ্ছ ঘটনাতেও কেন মুসলিম নারীর ওপর মধ্যযুগীয় ফতোয়ার চাবুক চলবে? স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর পুনরায় সহমতের ভিত্তিতে বিয়ে করতে চাইলে  স্ত্রীকে  কেন অন্য পুরুষের হাত ঘুরে আসতে হবে?  এই অসভ্য আইন এখনও এই সভ্য সমাজ কেন মানবে? কেন নারী সে অপমান সহ্য করবে? এ সব কথা লেখার জন্য আমার ওপর মুফতি-মোল্লা সমাজের পুরানো চাপা ক্রোধ ও জ্বালা  ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে।  
তাঁদের সেই আক্রোশ ও অন্ধক্রোধের বিষ্ফোরণ ঘটল  গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে।   সে সময়  এক সপ্তাহের ব্যবধানে আমার দু’টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় দু’টি কাগজে। যার একটি বেরিয়েছিল ৬ই অক্টোবর  ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় (কলকাতার একটি দৈনিক  কাগজ) এবং  আর একটি বেরিয়েছিল  স্থানীয় একটি  সাপ্তাহিক সংবাদ ম্যাগাজিনে (জঙ্গিপুরের চিঠি)। প্রথম প্রবন্ধটি (বুদ্ধদেববাবু কলকাতাকে কলংকিত করেছিলেন, কলকাতা উচ্চ আদালত সে কলঙ্ক মুছে দিল) ছিল তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’ গ্রন্থের সমর্থনে লেখা। প্রবন্ধ দু’টিতে প্রাসঙ্গিকভাবেই মুহাম্মদের ব্যক্তিজীবনের কিছু কথার উল্লেখ রয়েছে। যেমন মুহাম্মদের বহুবিবাহ, পুত্রবধুকে বিয়ে করা এবং ছ’বছরের শিশুকন্যাকে বিয়ে করা প্রভৃতি বিষয়গুলির উল্লেখ রয়েছে।   লিখেছি যে কোরান অপৌরুষেয় কোনো গ্রন্থ নয়, কোরানের কথাগুলো  আসলে মুহাম্মদেরই কথা।  তিনি আল্লাহর মুখে বসিয়েছিলেন মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্যমুফতি-মৌলানাদের এসব কথা হজম হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি । আমি যা লিখেছি তা যে মিথ্যে নয় তা ওঁরা ভালভাবেই জানেন।   কিন্তু মুসলমান সমাজকে তো ক্ষ্যাপাতে হব, তাই আমার বিরুদ্ধে ওরা অপপ্রচার শুরু করে দেনবলছেন আমি নাকি সব মিথ্যা কথা লিখেছি আল্লাহর নবীকে অসম্মান ও অপমান করার জন্যে।  এসব লেখার জন্যে বিজেপি আমাকে  পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছে  অপপ্রচারে স্বভাবতই বহু মানুষ আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষুব্ধ এই মানুষগুলো অধিকাংশই লেখাপড়া জানেন না,  যাঁরা জানেন তাদের অধিকাংশই  আমার লেখাটা আদৌ পড়েন নি। ক্ষুব্ধ ও অশান্ত মানুষদের  জড়ো করে গত ১১ই অক্টোবর ঐ ধর্মগুরুরা প্রকাশ্য জনসভা  করে আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি  করেআমাকে মুরতাদ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।  বলে যে,  গিয়াসুদ্দিন আজ থেকে মুসলমানদের শত্রু এবং  তাকে  শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলফতোয়ার পক্ষে অনেকেই বক্তৃতা দেন। তাঁদের মধ্যে  সাঈদ হাজী নামে একজন হাজীসাহেব যার তিনজন স্ত্রী রয়েছে  তিনি বলেন,  “কাউকে লাগবে না, আমরা বাপ-ব্যাটায় কাফি, আমরাই গিয়ে গিয়াসের গর্দান নেব। আর আপনারা যদি গিয়াসের গর্দান নিতে পারেন তবে দু’লাখ, পাঁচ লাখ যত টাকা লাগে আমি দেব। গিয়াসকে হত্যা যে করবে তার জন্যে মামলা লড়তে যা টাকা লাগবে  এবং তার পরিবারের ভরণপোষণের ভারও আমি একাই বহন করবো।” কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল সভায়।  মুফতি-মাওলানাদের ভাষণ শুনে, বিশেষ করে  ওই হাজীসাহবের ভাষোণ শুনে সভা তখন উত্তেজনায় ফুটতে শুরু করে সভায় যিনি সভাপতিত্ব করেন তিনি একজন  নাম করা মুফতি  তিনি আবার তাঁর স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিনা দোষে  তালাক দিতে চেয়েছিলেন আমি তাঁর স্ত্রীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম এবং  তাঁকে বাধ্য করেছিলাম স্ত্রীকে তাঁর সংসারে  ফিরিয়ে নিতে। এখন  সেই মুফতি সাহেব  স্বভাবতই  আমার বিরুদ্ধে বেশী উত্তেজিত করেছেন মানুষের ধর্মীয় সুড়সুড়িতে আঘাত দিয়ে।
স্বাভাবিকভাবেই এলাকা জুড়ে আমার বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরী হয়েছে। জায়গায় জায়গায় উত্তেজিত মানুষদের জটলা দেখা যাচ্ছে। উত্তেজিত মানুষদের আমার বাড়িতে হামলা করার উস্কানি দেওয়াও চলছে অনবরত।  পরিস্থিতি এমনই বিরাজ করছে যে এই সময়ের মধ্যে ওদের নাগালের মধ্যে পেলে আমার উপর নিশ্চিতভাবেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তো যখন এই প্রবন্ধ লিখছি তখনও পরিস্থিতি সমান অগ্নিগর্ভ রয়েছে। এই মুহূর্তে আমাকে ওরা হাতের কাছে  পেলে তার পরিণতি কী হতে পারে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। 
প্রসঙ্গতঃ এটা উল্লেখ  করা সমীচীন হবে যে,   আমার   এলাকার ছবিটা  ধীরে ধীরে হলেও একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। কিছু যুবক আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। উত্তেজিত ধর্মান্ধ মানুষগুলো আমাকে যখন মারব কাটব বলে প্রকাশ্যে  আস্ফালন করছে, হুমকি দিচ্ছে এবং সঙ্কল্প ব্যক্ত করছে তখন ওরা প্রতিবাদ করছে। ওদের অধিকাংশই আমার গ্রামের অধিবাসী, বাকিরা মিঠিপুর গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার বিভিন্ন গ্রামের  শুধু যুবকরাই নয়, আমার পাশে দাঁড়িয়েছে চল্লিশোর্ধ ও পঞ্চাশোর্ধ কিছু মানুষও।  ওই প্রতিবাদী  মানুষদের ভূমিকা আমাকে যার পর নাই বিষ্মিত ও অভিভূত করেছে। যাঁরা আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছে তাঁর আমার লেখার পক্ষে দাঁড়িয়েছে এমন নয়। তাঁরা যে সবাই আমার প্রবন্ধ দু’টি পড়েছে তাও মনে হয় না। তবু ওঁরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেনএর  প্রধান কারণ হলো আমি মিথ্যে কথা লিখতে পারি তা ওঁরা বিশ্বাস করেন না। ওঁরা মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়ার বিরোধিতা করতে গিয়ে বলছেন,  আগে প্রমাণ করতে হবে গিয়াসুদ্দিন কোনটা মিথ্যা লিখেছেন। প্রমাণ ছাড়াই গিয়াসুদ্দিনের গায়ে  হাত দিলে  আমরা তা মেনে নেব না। কেউ কেওু এমনও বলেছেন যে, গিয়াসুদ্দিনের  মাথায় লাঠি মারার আগে আমাদের মাথায় মারতে হবেএভাবে ধীরে ধীরে হলেও কিছু আমুষ আমার পক্ষে মুখ খুলছেন। এদিকে ইতিমধ্যেই আমার গ্রামের সমাজও আমাকে সমাজচ্যুত করার ফতোয়া জারি করেছে । মসজিদে বসে একদিন ফতোয়া জারি করে গ্রামের মানুষদেরকে উদ্দেশ্যে করে ঘোষণা দিল  যে,  গিয়াসুদ্দিনের সঙ্গে কেউ চলাফেরা করতে পারবে না, তার সঙ্গে এমনকি কথাও বলতে পারবে না। যারা  এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাইবে  তাদেরও একঘরে (সমাজচ্যুত)  করা হবে। গিয়াসের বাড়িতে হামলা হলে (তখন আমার বাড়ী এসে আমার উপর হামলা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল)   কেউ যেন তাকে বাঁচাতে না যায়, যে যাবে তার উপর বিচার বসবে। মসজিদে বসে যখন এই ফতোয়া ও তৎসংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয় তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একদল হৈ হৈ করে ফতোয়াকে সমর্থন জানায়। তার মধ্যেই অবশ্য পঞ্চাশোর্ধ বয়সের একজন মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন 
পরিস্থিতি একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে বটে,  একটু একটু করে প্রতিবাদ হচ্ছে আমার পক্ষে। কিন্তু প্রতিবাদের কণ্ঠগুলি এখনও ভীষণ ক্ষীণ শোনাচ্ছে ওদের তুলনায়।  অর্থাৎ এটাই বাস্তব পরিস্থিতি যে আমি যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারি, এবং আমি খুনও হয়ে যেতে পারি।  নিরাপত্তা চেয়ে  তাই প্রশাসনের কাছে একটি আবেদন পাঠিয়েছি। কিন্তু আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া তো পরের কথা, থানার ওসি আমার আবেদনপত্রটাই গ্রহণ করেন নি। পরিস্থিতির এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও  আমি এ ঘোষণা দিতে চাই যে, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি কিছুতেই কলম  তুলে রাখব না। ধর্মান্ধতা, মুসলিম  মৌলবাদ, মুসলিম সমাজের গোঁড়ামি এবং যাবতীয় ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমার লড়াই আমৃত্যু জারি থাকবে, আমার কলম  খোলা থাকবে
পরিশেষে আর একটা কথা বলতে চাই যে, আমার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই সে কথা বলব না,  কিন্তু সে দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে গেছে আমার প্রাপ্তির আনন্দ। সে প্রাপ্তিটা হল, আমি বুঝেছি যে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমি একা নই। এখনই পাশে  কিছু মানুষকে পেয়েছি, আশা করি ভবিষ্যতেও আরও বেশী মানুষকে পাশে পাব।  সব শেষে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থানের কথা উল্লেখ করতে চাই। স্থানীয় কংগ্রেস  দলের নেতা ও কর্মীরা অধিকাংশই আমার বিরুদ্ধে দেওয়া ফতোয়াকে সমর্থন করছে এবং আমার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছে। তাদের দলের এখানকার  বিধায়ক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে গিয়াসুদ্দিনের বিরুদ্ধে যে  ফতোয়া দেওয়া হয়েছে তাকে তিনি সমর্থন করেনআমার আশঙ্কা ছিল যে, সিপিএম হয় প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের মদত দেবে, না হয় নীরব থাকবে। কারণ,  ৬ই অক্টোবরের নিবন্ধে আমি তীব্র সমালোচনা করেছি বামফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রীর। তাছাড়া, মাত্র  বছর চারেক আগে আমি সিপিএম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি নীতি ও আদর্শের কারণে।  কিন্তু না, স্থানীয়ভাবে সিপিএম আমার বিরুদ্ধে যায় নি। বরং মৃদুস্বরে এবং অপ্রকাশ্যে হলেও ফতোয়ার  প্রতিবাদ করেছেন  এই দলের নেতা-কর্মীরা।  ফতোয়ার বিষয়ে সিপিএমের একজন জেলা কমিটির নেতার (জঙ্গীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান)  কাছে  সাংবাদিকরা প্রতিক্রিয়া চাইলে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেন নি। তবে  পিডিএস দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আমার পাশেই দাঁড়িয়েছেন বলিষ্ঠভাবে।     
[বিঃদ্রঃ প্রবন্ধটি ২০০৫ সালের ২১শে অক্টোবর কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক স্টেস্টসম্যান’ পত্রিকায়  ছাপা হয়েছিলো। তার কয়েকদিন আগে আমার উপর জারি হয়েছিলো মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া।  কার্যতঃ ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থায় ভয়ানক চাপের মধ্যে  প্রবন্ধটা লিখেছিলাম।  আমার প্রথম প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে [মুসলিম সমাজ বনাম ফতোয়া সন্ত্রাস] প্রবন্ধটি রয়েছে। কিছুটা পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপে  প্রবন্ধটি আমার ব্লগের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলাম।]
  


Wednesday, July 6, 2016

ঈদের উৎসবে নেই রমাজানের শুদ্ধাচার, আছে যেন এক অন্য সুর



এবারেও সাড়ম্বরে, মহা ধূমধামের সঙ্গে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয়ে গেল। ঈদের অন্তর্নিহিত অর্থ যাই থাক না কেন, আমরা বুঝে গেছি ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব। কলকাতার মুসলিম অঞ্চলগুলি –পার্কসার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনিরিচ, চিৎপুর, রাজাবাজার, খিদিরপুর কী সাজে সেজেছিল, কতটা সেজেছিল, এই চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জার পেছনে কত বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে কার সাধ্য তার বর্ণনা দেয়, হিসেব দেয়। তখন এসব অঞ্চলগুলি ঘুরলে মনে হয় না যে এ পোড়ার দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাস্তুহীন লক্ষ লক্ষ মানবেতর জীবনযাপন করে। এই অপরূপ সাজসজ্জা কেবল কলকাতাতেই নয়, শহর, গঞ্জ সর্বত্রই, সবখানেই যে যার সাধ্যমত করেছে। হোর্ডিং, ব্যানার, আলোর বর্ণচ্ছটায় সর্বত্রই ঈদেওর ঘোষণা, ঈদের মেজাজ ও পরিবেশ। বুঝতে অসুবিধা হয় না ঈদ উপলক্ষ্যে এই যে খুশির ফোয়ারা, উৎসবের চেহারা – এসব কোনও কোনও অঞ্চলের কিছু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও খেয়ালের বিষয় নয়।  এর পেছনে আছে অবশ্যই ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কেন্দ্রিয় স্তর থেকে সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং আদেশ। অন্যান্য আর সব ধর্মীয় উৎসবে, বিশেষ করে হিন্দুদের দূর্গা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন হয় থিক তেমনি করেই ঈদ উদযাপন করতে হবে – এমন পরিকল্পনা বা আদেশ উপর থেকেই আসে। আমি কিন্তু আমার সাধারণ বুদ্ধিতে ঈদ উপলক্ষ্যে কেন এত খুশি, কেন এই উৎসব তার অর্থ খুঁজে পাই না।
         ঈদ-উল-ফিতর আসে রমজান মাসান্তে। আর এই রমজান মাসের উপবাস পর্ব শেষ হয় মাত্র দু-রেকাত নামাজের মধ্য দিয়ে। রমজান মাসের দুটো দিক আছে। একটা হলো কঠোর সংযম তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ, আর একটা দিক কৃচ্ছ্সাধন। এর পেছনে না কি বিশেষ তাৎপর্য আছে। এটা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করার অবকাশ নেই এ প্রবন্ধে। তবুও প্রাসঙ্গিকতা – হেতু একটু আলোচনা না করলেই নয়। সংযম মানে বলা হয় চরিতে গঠন করা, অর্থাৎ মানুষের কুপ্রবৃত্তিগুলিকে শাসন করা ও দমন করা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ মিথ্যে বলা যাবে না, চুরি-দুর্নীতি করা যাবে না, পরনিন্দা-পরচর্চা করা যাবে না, দুর্বলের উপর অত্যাচার করা যাবে না। লোক ঠকানো যাবে না, শোষণ করা যাবে না, পরনারীর দিকে কুনজরে দৃষ্টিপাত করা যাবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সৎভাবে সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হবে। শুধু তাই নয় বছরের পরবর্তী এগারো মাস সেইভাবে জীবন-বোধ রক্ষা করার অঙ্গীকারও গ্রহণ করতে হবে এই রমজান মাসে। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি? কেউ কি দাবি করতে পারেন, যাঁরা রোজা রাখেন কিংবা রাখতে পারেন না কিন্তু রোজা রাখায় বিশ্বাসী তাঁরা ইসলামের নির্দেশগুলি পালন করেন? বা অন্তত পালন করার চেষ্টা করেন? এর উত্তরে বলা যায়, না। যে কঠিন ব্রত পালন করার জন্যে একমাস ধরে উপবাস করে থাকা, প্রতি পদে উপবাস মুখে সেই ব্রতকে লঙ্ঘন করার হাজারো দৃষ্টান্ত দেখা যায় রমজান মাসে। এই যখন অবস্থা তখন ঈদের দিন খুশীতে মেতে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে? ব্রত পালনে ব্যর্থতার যন্ত্রণা, কম সে কম অনুতাপ তো থাকা উচিৎ মুসলমানদের চোখে মুখে।
        কৃচ্ছ্বতাসাধন কী কেবল সারাদিনের উপবাস? যারা হয় খেতে পায় না কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান করে তাদের যন্ত্রণা কত তীব্র তা বোঝার জন্য নাকি উপবাসের বিধি। উপবাস থেকে উপবাসক্লিষ্ট গরীব-গুর্বা মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য সকল মুসলমানদের উপর এই এক মাস নাকি উপবাসে থাকার নির্দেশ। কিন্তু রমজানের ত্রিশ দিনের ছবিটা আমরা কী রকম দেখতে পাই? কৃচ্ছ্বতা সাধনের লেশমাত্র কোথাও দেখা যায় না। বরং দেখা যায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত। সূর্য অস্তমিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিগোচর হয় উপবাস ভাঙার বিশাল আয়োজন। হরকিসিমের ফলমূল, উপাদেয় নানারকম তেলের খাবার ও মিষ্টান্ন সহযোগে রোজা ভাঙা হয়, আর রাত্রে থাকে ভুরিভোজের বিপুল ব্যবস্থা। যারা বারোমাস অরধাহারে, অনাহারে থাকে তাদের অনাহারক্লিষ্ট মুখগুলো কি একবারও মনে পড়ে? রোজা এফতারের নামে বড় বড় পার্টি হয়। সেখানে আমন্ত্রিত হয় রোজা রাখা, না রাখা মুসলমান, হিন্দু সব ধর্মের অর্থবান আর ক্ষমতাবানরা। গরীব-গুর্বাগুলো অবাঞ্ছিত থেকে যায়। অসম্মানে, অবহেলায়, অনাদরে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু খাবার যা কেবল তাদের জন্যই, তাদের শ্রেণীর মত করেই তৈরী করা হয়। গরীব-গুর্বাদের কথা ভেবে যে মাসটা আসে তাদের কথা ভাবলে রমজান মাসের শেষে উৎসবের প্রশ্ন আসে কি করে? তবু উৎসব ও আনন্দ হয়।  মহা ধূমধাম করেই হয়। এবার আরো বেশী ধূমধাম হলো। সামনে বছর আরো বেশী হবে তা হলফ করে বলা যায়। ধর্মের রীতি-নীতিগুলো আজ গৌণ। সেগুলো বাতিলের খাতায়।  ধর্ম হয়ে উঠেছে অনুষ্ঠান সর্বস্ব। সব ধর্মই। ইসলামও। কিন্তু কেন? এই কেনর উত্তর হলো – (এক) আর সব ধর্মের মত ইসলাম ধর্মেরও রীতি-নীতি, আইন-কানুন ও নির্দেশিকাগুলো আধুনিক সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। দেড় হাজার বছর  ইসলামী আইন ও রীতি-নীতিগুলো সেই সময়কালেই কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বর্তমান সমাজে তো সেগুলি মানা মোটেই সম্ভব নয়। মানুষ সুদ দেবেনা-নেবেনা, মেয়েরা বোরখা পরিধান করবে, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে না, এই সভ্য যুগেও মানুষ চার-চারটে স্ত্রী রাখবে, কথায় কথায় পদাঘাত করে স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেবে-এসব এ যুগে চলে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দাবীতে যখন শোষণের ক্ষেত্রে সুযোগ আরও অবাধ হয়েছে, এবং উদারনীতির প্রভাবে এই পোড়ার দেশেও যখন চুরি ও দুর্নীতির বাজার হাট হয়ে খুলে গেছে, মন্ত্রী-সান্ত্রীরাও যখন বেপরোয়াভাবে চুরি দুর্নীতিতে মগ্ন তখন মুসলমানরা বেহেস্তের লোভে বা দোযখের (নরক) সবাই চরিত্রবান হয়ে উঠবে-এতো অলীক কল্পনা। উপদেশ দিয়ে বা পরলোকের ভয় দেখিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করা যায় না। শোষণের বিরুদ্ধে, দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, গরীব মানুষেওর দাবি দাওয়া নিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কেবল সৎ মানুষ তৈরী হতে পারে। ইসলাম ধর্মে সেই কর্মসূচী কোথায়? কোন ধর্মে আছে? তাই সব ধর্মই আজ অনুষ্ঠান সর্বস্ব। দুই) ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসে রমজানের ইতি-কর্তব্য পালিত হচ্ছে না। তা নিয়ে কিন্তু এমাম, মুফতি, মৌলনা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মাথা-ব্যথা দেখছিনা। বরং আনন্দ ও উৎসবে মেতে ওঠাতেই তাঁদের আগ্রহ বেশী। তাঁরাও এতে আনন্দিত, পুলকিত। এদের অন্তরের ভাবনাতা এরূপঃ ওদের (হিন্দুদের) দেখিয়ে দাও, মুসলমানদেরও বিত্ত আছে, বিত্তের প্রাচুর্য আছে। ধর্মের নামে, ধর্মের জন্য তোমাদের মত মুসলমানরাও পারে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নিজের নিজের অঞ্চলকে সাজিয়ে তুলতে। সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে। তোমরা দেখ ধর্মের আহ্বানে মুসলমানরাও এক হতে পারে, সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, সব দিক দিয়ে তোমাদের টেক্কা দিতে পারে। ঈদের খুশী, ঈদের উৎসব – এসবের পেছনে এই দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কাজ করে, অবশ্যই সুপ্তভাবে, যা উপর থেকে দেখা যায় না সব সময়। সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত বয়ে যায় ঈদোৎসবে। অন্য সব ধর্মীয় উৎসবেও। ঈদের এ খুশী ও উৎসবে মুসলমানদের কোনও মঙ্গল আমি দেখতে পাই না। দেখতে পাই না সমাজের মঙ্গল। ঈদের উৎসব ‘আমরা-ওরা’ বিভেদটাকে আরো প্রকট করে তোলে। বিপদ বাড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ও জাতীয় সংহতির। (তিন) তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ঈদোৎসবের পেছনে আর একটি অন্যতম কারণ। মুসলিম ধর্মের নেতাদের দাবি ইসলাম ধর্মই শ্রেষ্ঠ। শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, একমাত্র সঠিক ধর্ম। আর সবই ভুল, বেঠিক। হজরত মহম্মদ ঈশ্বরের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ দূত, শেষ নবী। সারা বছর ধরে চলে এই সদম্ভ প্রচার এবং প্ররোচনামূলক বাণী বিতরণ। স্ব-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুধু মাত্র বাণী প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা হতে পারে না। তাই দুই ঈদ, মহরম, নবীর জন্মদিন, প্রভৃতি পরবকে ঘিরে চলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার লড়াই। এ এক অশুভ প্রতিযোগীতা ব্যতীত ভালো কিছু বলে মনে হয় না।  
(বিঃদ্রঃ- আজ থেকে তেরো বছর আগে আজকের মতোই  কোনো এক দিনে অনুষ্ঠিত ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এ লেখাটা লিখেছিলাম। লেখাটা ছাপা হয়েছিলো স্থানীয় সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা  ‘জঙ্গীপুরের চিঠি’তে সে বছরের ঈদের পরের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে। সেটা ছিলো ২০০৩ সাল। । লেখাটি ঐ পত্রিকায় যে ভাবে ছাপা হয়েছিলো এ লেখাটি অবিকল সেটাই রাখা হয়েছে।   কোথাও কোনোরূপ সংশোধন বা পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করা হয় নি। এমনকি ছাপার ভুলগুলিও কিছু জায়গায় যেমন ছিলো তেমনই  রাখা হয়েছে।  তেরো বছর আগে যখন এ লেখাটি লিখি তখন  ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান ও ধারণা ছিলো তা  অনেক ক্ষেত্রেই  নির্ভুল ছিলো না। ফলে এ লেখাটির মধ্যে  অল্প কিছু জায়গায় তখন যা বলেছিলাম তার সঙ্গে আমি নিজেই এখন একমত নই। তবুও সে সব জায়গায়  কোনোরূপ সংশোধন করি নি এবং কিছু কিছু জায়গায় হাল-নাগাদ (আপডেট) করার প্রয়োজন থাকলেও তা করি নি। সেটা প্রধানতঃ নিজেকে ফিরে দেখার জন্যে।)   

Thursday, June 16, 2016

হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের পেছনে রয়েছে গভীর হিন্দুত্ববাদী ঘৃণ্য রাজনীতি




অবশেষ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। অবসান ঘটালেন আরএসএস-এর পোস্টার বয় মোদিজি। হ্যাঁ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু রিফিউজিদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানের কথা বলছি। ১৯৭১ সালের পর যারা ভারতে এসেছেন ইসলামি ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বলি হয়ে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার পথে যে কাঁটা ছিলো সেটা মোদিজি সরিয়ে দিলেন তারা এবার ভারতের নাগরিকত্ব পাবেনএই সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ ছিলো না, যদিও বিজেপি বরাবরই হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবীকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। অটল বিহারী বাজপেয়ীজি দু’ দু’বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেনতবুও পারেন নি। অবশ্য তাঁর সরকারে বিজেপির একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না। থাকলেই যে পারতেন তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ  তিনি ছিলেন নরম হিন্দুত্ববাদী নেতা। মোদিজি পারলেন শুধু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নয়, পারলেন একজন কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা বলে। মোদিজির সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি সমর্থন জানাই। কেনো তা বলছি পরে। তার পূর্বে  দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে নিতে চাই যে মোদিজির নেওয়া এই সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন জানালেও  তাঁর প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করতে পারছি না। কারণ কোনো মানবতাবোধ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদারতা দেখান নি। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন তা খুবই সংকীর্ণ, নিকৃষ্ট ও মানবতাবিরোধী যার জন্যে তাঁর প্রতি তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার  বর্ষণ করা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কী সেই বদ উদ্দেশ্য তা নিয়ে আলোচনা করবো পরে, তার আগে কেনো হিন্দু স্মরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি সেটা আগে বলে নিই।   
আমি নিশ্চিত যে হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যে ভারতের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেকটাই বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।  এবং মোদিজি যে একটি ভয়ঙ্কর কুমতলব দ্বারা চালিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে বিষয়েও আমি সম্পূর্ণ সচেতন। এতদসত্ত্বেও সিদ্ধান্তটিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন জানাচ্ছি।  জানাচ্ছি  কারণ,  প্রথমতঃ আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের দেশে যে বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা সমবেত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব।  দ্বিতীয়তঃ দেশ ভাগের  কারণে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে(?) যে লক্ষ লক্ষ মানুষগুলো  কয়েক দশক ধরে উদ্বাতু হয়ে এদেশে পরগাছার মতো বসবাস করছেন তাঁরা নিজের একটা দেশ, নিজের একটু  মাটি পাবেন, বৈধ নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার পাবেন এই অধিকার পাওয়া তো ছিন্নমূল ও উদ্বাস্ত মানুষদের জীবনে সর্ব্বোচ্চ  পাওয়া। তাঁদের এই সর্ব্বোচ্চ প্রাপ্তিকে  সমর্থন জানাতে যদি আমি কুণ্ঠিত হই তবে নিজেকে কোন মুখে মানুষ বলে দাবি করবো? এক টুকরো পরিচয় পত্র, একটা রেশন কার্ড, একটু পানীয় জল, একটু বিদ্যুতের আলো, আপন সন্তানসন্ততির জন্মের শংসাপত্র, তাদের স্কুলে ভর্তি-সহ আরো কতো প্রকার দৈনন্দিন প্রয়োজনে  লক্ষ লক্ষ এই স্মরণার্থীরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের দ্বারে দ্বারে  ধর্ণা  দিয়ে আসছেন। নেতানেত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিরন্তর একটু করুণা ভিক্ষা করে চলেছেন। এ কি শুধু তাদের লজ্জা? এ তো মানবতার লজ্জা! এই লজ্জার হাত থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি  পেতে চলেছেন।  তাঁদের এই মহাপ্রাপ্তিকে যদি সরবে স্বাগত জানাতে না পারি তাহলে  আমার মানুষ পরিচয়টাই বৃথা।
এই অসহায় মানুষগুলো ইসলামী সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচতে নিজের দেশ, নিজের ভিটে-মাটি, জমি-জায়গা, ব্যবস্যাবাণিজ্য সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে নিঃস্ব হাতে ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কী তাদের অপরাধ ছিলো? একটাই অপরাধ তাদের, তারা হিন্দুতাই তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে চিরতরে, এবং তাদের নিজের দেশে, নিজের ভিটেয় ফেরার রাস্তা তাঁদের চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।ঘরে ফেরার রাস্তা চিরদিনের জন্যে বন্ধ বলেই তারা ভারতের নাগরিকত্বের দাবিতে  আন্দোলন করে আসছেন বহুদিন ধরেহ্যাঁ, তাদের এ দাবি করার অধিকার আছে বৈকিতাদের পূর্বপুরুষরা তো ভারতেরই নাগরিক ছিলেন। নিজেদের দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দেশটাকে দু’টুকরো করেছিলো বলেই তো তাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছেএতে তাদের অপরাধ কোথায়? তারা পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিলো সেটা কি তাদের অপরাধ? কিন্তু তারা তো ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলেই মেনে নিয়েছিল।  তারা তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবং কাতারে কাতারে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল কিন্তু মুশকিল হলো  কী পাকিস্তান,  কী বাংলাদেশ, কোনো একটি রাষ্ট্রও তাদের দেশের নাগরিক  হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি, আজো পারছে না। ফলে মুসলিম মৌলবাদীরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, এবং বলছে যে, এটা মুসলিমদের দেশ, এ দেশে থাকতে হলে মুসলমান হতে হবে, নইলে এ দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। যখন তারা এ কথা বলে  তখন কোনো  রাষ্ট্রই  তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে তৎপর হয় নাফলতঃ মুসলিম মৌলবাদীরা সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিকভাবে বীভৎস অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে সাহস পায়। আর সে কী অত্যাচার ও নিপীড়ন! অত্যাচার মানে বাড়িঘর এবং মন্দির-গীর্জা-বৌদ্ধমঠ জ্বালিয়ে দেওয়া, জমিজায়গা ও দোকানপাট দখল করে নেওয়া, নারীদের ধর্ষণ করা, পুরুষদের হত্যা করা, ইত্যাদি। অর্থাৎ অত্যাচারের মাধ্যমে  সংখ্যালঘুদের  প্রতি একটা বার্তা দেওয়া যে, হয় দেশ ছাড়ো, না হয় মুসলমান হও। এহেন পরিস্থিতিতে তারা কী করবে? তাই দলে দলে তারা ভারতে চলে আসছে। কী বিপুল সংখ্যায় হিন্দুরা এ দেশে পালিয়ে আসছে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান দেওয়া হলো নীচের সারণীতে যা দেখলে সকলের গায়ে কাঁটা দেবে, অবশ্য যদি তাদের মানবিক বোধ থাকে এই তথ্য থেকে খানিকটা আমরা খানিকটা অনুমান করতে পারি যে সংখ্যালঘুদের উপর কীরূপ অত্যাচার করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, তারা ভারত ছাড়া কোথায় যাবে? ভারত ছাড়া তাদের আশ্রয়স্থল আর কোথায় আছে? ভারত যে তাদের বাপ-ঠাকুর্দার দেশ। আর নিজের ভিটেয় ফেরার রাস্তা যেহেতু চিরতরে বন্ধ হয়ে রয়েছে, এ অবস্থায় তারা ভারতের নাগরিকত্ব চাইবে না তো কী শুধু রিলিফ চাইবে? তারা তো নাগরিকত্বই চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক। তাইতো এই ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোর নাগরিকত্বের দাবীকে আমার কখনো অযৌক্তিক ও অন্যায্য বলে মনে হয় না। 
১৯৫১ সাল থেকে হিন্দুরা কী হারে দেশ ছেড়ে ভারতে এসেছে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান নিম্নরূপ:                                         
                                    
                                                                    সারণী
জনগণনার রিপোর্ট শতাংশে
সম্প্রদায় ----১৯৫১ -  ১৯৬১  -  ১৯৭৪  -  ১৯৮১  -  ১৯৯১   -  ২০০১  -  ২০১১
মুসলিম  -    ৭৬.৯ –   ৮০.৪ -   ৮৫.৪  -   ৮৬.৭  -  ৮৮.৩  -   ৮৯.৭  -  ৯০.৪
 হিন্দু     -     ২২.০  -   ১৮.৫ -  ১৩.৫  -   ১২.১   -  ১০.৫  -    ৯.২   -   ৮.৫
সূত্রঃ প্রথম আলো, ২২.০৯.২০১২ (বিঃদ্রঃ বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় কাগজ হলো এই পত্রিকাটি)
সূত্রটি বলেছে দশ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখি যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, বাংলাদেশের সর্বত্রই কিন্তু সমহারে হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে না। জনগণনার রিপোর্ট থেকে এই তথ্যটি উঠে এসেছে।  রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, দশ বছরে (২০০১ থেকে ২০১১) ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে, সব জেলায় নয়সে কথা থাক, এখন প্রশ্ন হলো হলো, দশ বছরে যে ৯ লক্ষা হিন্দু কমে গেলো, তারা কোথায় গেছে? সরকার ‘মিসিং পপুলেশন’ আখ্যা দিয়ে বলছে যে, দেশের মধ্যে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু প্রথম আলো বলছে, “হিন্দুরা দেশের অন্য কোথাও চলে গেছে সে কথা কিন্তু য়পরিসংখ্যান বলছে না।” পত্রিকাটি সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছে যে, “অন্য জেলায়ও হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ে নি।” আসল কথা হলো সরকার খুব ভালো করেই জানে যে ‘মিসিং পপুলেশন’ ভারতে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ সরকারের সংখ্যালঘুদের  নিরাপত্তা  দেওয়ার সদিচ্ছার কতো অভাব।
যে দেশে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে চাই না, এবং বিশেষ করে সে দেশটি যদি মুসলিম দেশ হয় তবে সে দেশ সংখ্যালঘুদের  বাসযোগ্য থাকতে পারে না। এই নির্মম বাস্তব পরিস্থিতি এ দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি বুঝতে চাই না।  চাই না বলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্বের দাবীকে বারবার অন্যায্য ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের দুঃসহ যন্ত্রণা ও কষ্টগুলি সাধারণ পররাষ্ট্রনীতির মানদণ্ডে যান্ত্রিকভাবে বিচার-বিবেচনা  করেছেন, মানবিক দৃষ্টিতে কখনই বিচার করেন নি আমাদের পূর্ব পুরুষরা দেশ ভাগ করে যে অন্যায় করে গেছেন যার ফলে আজ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে আজ চরম বিপন্ন,  তাদের রক্ষা করার দায় যে আমাদের এই প্রজন্মের উপরেই বর্তেছে সে কথা কষ্মিনকালেও তাঁদের মস্তিষ্কে উদয় হয় নি। বরং এই ভাবনাটাকেই তাঁরা বড়ো করে দেখেছেন যে, নাগরিকত্ব দিলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে (যেনো এখন খুব ভালো সম্পর্ক আছে!), ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরা রুষ্ট হবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে  সংখ্যালঘুরা হু হু করে চলে  আসবে এবং তার ফলে সরকারের উপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপবে। রাষ্ট্রনায়কদের এই ভাবনা কতোখানি বাস্তব সম্মত তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ বাংলাদেশের তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে যে, সেদেশে সর্বত্র সংখ্যালঘুদের উপর সমান অত্যাচার হয় না, ফলে সব জেলাতেই হিন্দু জনসংখ্যা  হ্রাস পায় নি। সে বিতর্ক থাক হিন্দুরা সবাই হু হু করে  চলে  আসবে বলে যে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় নি তাতে কি এ দেশে হিন্দুদের আসার স্রোত বন্ধ হয়েছে?  উপরের তথ্যটি বলছে, হয় নি। এবং যারা চলে এসেছে তারা ফিরে যায় নি, এতে কি সরকারকে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ বইতে হচ্ছে না? আসলে দূরদর্শিতা ও মানবিক বোধের অভাবে লাগামহীন সন্ত্রাস থেকে মানপ্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা বিপন্ন মানুষগুলোকে রক্ষা করার  দায়িত্বই নিতে চাই নি  কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসী সরকারগুলি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। এই ইস্যুটি নিয়ে বিজেপি একটু একটু করে  জমি তৈরী করেছে। সেই জমিতে মোদিজি এসে সপাটে হিন্দুত্বের ব্যাট চালাতে দ্বিধা করেন নি মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার  ধ্বজাধারীরা তখন চেয়ে চেয়ে শুধু দেখলেন। পাছে হিন্দুভোট আরো ক্ষয় হয় সেই ভয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে সাহস করলেন না। 
হিন্দু স্মরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন ও স্বাগত জানালেও কেনো মোদিজির প্রতি আমি নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি  সে প্রসঙ্গে আসি।  কথাগুলি বরং মোদিজিকেই সরাসরি বলি।
শ্রদ্ধেয় মোদিজি, 
আপনি ভালো করেই জানেন যে আপনি ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ  রাষ্ট্রের  প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে, সেই পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে শুধু হিন্দুদের জন্যে কোনো কাজ  করতে পারেন না, আপনাকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যেই কাজ করতে হবে  যদি শুধু হিন্দুদের জন্যেই করেন তা অবশ্যই গণ্য হবে একটি গুরুতর ত্রুটি ও অন্যায় হিসেবে। অথচ সেই ত্রুটি ও অন্যায় কাজটিই  আপনি করে বসলেন প্রধানত হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। মুসলিম বাদে অন্য সংখ্যালঘুরা যেমন বৌদ্ধ, খৃষ্টান, প্রভৃতি যারা ভারতে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাদেরও  নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেটা কোনো মানবিক মূল্যবোধ থেকে নয়, সেটা বিজেপির ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্য। আমরা জানি  আপনি একজন কট্টর ও গোঁড়া হিন্দু।  সে আপনি হতেই পারেন, কিন্তু আপনি যেটা পারেন না তা হলো, একজন হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতবর্ষকে পরিচালনা করতে, কারণ ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, হিন্দুরাষ্ট্র নয় এ বিষয়ে আপনি যথেষ্ট বিজ্ঞ মানুষ, তথাপি  হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেশটা চালাবার চেষ্টা করছেন যেমন করেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। মনে পড়ে মোদিজি সেদিনকার কথা যেদিন আপনার নেতা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়েজি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজধর্ম পালন করতে, হিন্দুনেতার ধর্ম পালন না করতে।  আপনি তখন তাঁর পরামর্শ  মেনে মুসলিম নিধন যজ্ঞ থেকে অসহায় মুসলিমদের  বাঁচাবার চেষ্টা করেন নি,  উল্টে মদতই দিয়েছিলেনসেই আপনি মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন,  তবু  একটুও পাল্টান নি, যেমন ছিলেন তেমনই  রয়ে গেছেন, ছিলেন হিন্দু মুখুমন্ত্রী এখন হয়েছেন হিন্দু প্রধানমন্ত্রীপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বলেছিলেন, হিন্দুত্বের রথে বসবেন না, বিকাশের রথে বসতে চান। কিন্তু  সে সব যে ভাঁওতা ছিলো  তা স্পষ্ট করে দিলেন শুধু বাছাই করে স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। আপনি তো যথেষ্ট ওয়াকিবহল এ বিষয়ে যে, বাংলাদেশ ও  পাকিস্তানে শুধু হিন্দুরাই ইসলামি সন্ত্রাসে অত্যাচারে লুণ্ঠিত, ধর্ষিত, আহত-নিহত ও  নির্বাসিত হচ্ছেন না। অন্য সংখ্যালঘুরাও হচ্ছেন, এবং  যারা  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের দাবীতে সরব  সেই মুক্তমনা লেখক ও ব্লগাররাও অত্যাচারিত হচ্ছেন, খুনও হচ্ছেন তাই শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যেই নয়, মুক্তমনা লেখক ও নাস্তিক ব্লগারদের জন্যেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বধ্যভূমি। ফলে তাঁরা দেশ ছেড়েছেন অনেকেই, এবং আরো অনেকেই দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।  তাঁদের মধ্যে যাঁদের সুদূর ইউরোপের কোনো দেশে বা আমেরিকায় যাওয়ার সামর্থ নেই তাঁরা তো  ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে চান। তাঁদের কথা তো ভাবলেন না?  তাঁদের পূর্বপুরুষরাও তো ভারতে নাগরিক ছিলেন। স্বভাবতই তাঁদেরো তো ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ও পাওয়ার সমান অধিকার আছে।  এ দেশটা তো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কেবল আপনাদের মতো  গোঁড়া হিন্দুদের দেশ নয়তা হলে শুধু বিপন্ন হিন্দুরাই এখানে স্বাগত, বিপন্ন  অন্য মানুষরা নয় কেনো মোদিজি?  কেনো মোদিজি এক যাত্রায় পৃথক ফল?  মোদিজি, না, এখানেই আপনার সমালোচনায় দাঁড়ি টানতে পারছি না। এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ আছে আপনার বিরুদ্ধে। সেটা এবার অনুগ্রহ করে শুনুন।
মোদিজি, আপনি যদি  হিন্দুদের প্রতি দরদ থেকে এটা করতেন তাহলে  সেটাও অন্যায় হতো ঠিকই, কিন্তু  ইতিহাস হয়তো সেটা আপনার একটা লঘু ত্রুটি ও  অন্যায় বলে  ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো। লক্ষ লক্ষ বিপন্ন  মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে আপনার সংকীর্ণ মানবতাবোধকে  আমরাও হয়তো আমাদের  উদারতা দিয়ে আপনাকে  ক্ষমা করে দিতে পারতাম। কিন্তু আপনি তো তা করেন নি।  আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার আরসএস-এর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্যে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে  পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করলেন মাত্র যাতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর কর্মসূচীকে আরো তীব্র করা যায়। আপনি যেদিন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন সেদিন থেকেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘপরিবারের বিদ্বেষ ও বৈরীতামূলক বিষাক্ত প্রচার তীব্র হতে শুরু করেছে এবং সে সঙ্গে  তাদের উপর এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের উপর আক্রমণের মাত্রাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বলপূর্বক অথবা প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তকরণের (ঘর ওয়াপসি কর্মসূচী) ঘটনাও। মোদিজি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ধ্বংস করে যারা ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করতে এসব করছে তাদের আপনি এক ফোঁটা নিন্দাও করেন নি। এতে তো এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আপনি তাদের পেছনে আছেন। এবং আপনি যে ওদের সঙ্গে আছেন সেটা স্পষ্ট করে দিলেন শুধু হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। এবার আপনিই বলুন মোদিজি, হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানকে মানবিক কারণে সমর্থন জানালেও আপনার প্রশংসা করি কোন আক্কেলে?  যে মতলবে আপনি এই কাজটা করলেন সেটা যে অমার্জনীয় অপরাধ। তারজন্যে মোদিজি আপনাকে নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর জন্যে কোনো ভাষাই যে যথেষ্ট নয়।   


 

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...