Saturday, January 30, 2021

হায়দ্রাবাদী আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এবং ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা টিএমসি ও বাম-কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে

 

আমাদের দেশে, বিশেষ করে রাজ্যে, মুসলিমদের ভোটার ছাড়া কেউ অন্য কিছু ভাবে না। এই কেউ-এর দলে যেমন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতারা আছেন, তেমনি আছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-বর্গ এবং প্রচার মাধ্যমও। মুসলিমরা কি তাদের সম্পর্কে অন্য রকম ভাবেন, কিংবা ভাবতে চান? না। একদমই না। কেন “না” ? এর উত্তর সবিস্তারে যদি কখনও সুযোগ আসে তবে পরে দেব। মুসলিমরা যেহেতু নিজেরাই নিজেদের মূলত ভোটার বলে ভাবে এবং তার দাম পেতে দর কষাকষি করে, অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও তেমনটাই ভাবে এবং দাম দিয়ে তাদের কিনতে চায়, তাই নির্বাচনের সময় সব রাজনৈতিক দলই মুসলিম ভোট-ব্যাংকের বখরা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। রাজনীতির কারবারির সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্কে আসলে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক। মুসলিমরা বিক্রি হতে চায় এবং রাজনীতির কারবারিরা তাদের কিনতে চায় কুরবানির ঈদে কুরবানির পশুর বখরা কেনার মতন। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা মুসলিম ভোটের বখরা পেতে বা নিতে এবার দুটো নতুন বখরাদার বা ক্রেতা ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। একটা ভিন রাজ্য থেকে এসেছে, আর একটা এ রাজ্যেরই। ভিন রাজ্য থেকে আসা ক্রেতা হলেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল এআইমিম (অল ইন্ডিয়া মুসলিম-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুমেনিন) এবং আর একজন হলেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী।

 আসন্ন নির্বাচনে ওয়াইসি ও আব্বাস সিদ্দিকীকে কেউই উপেক্ষা করতে পারছে না

আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রে জয়যুক্ত হয়েছে যা রাজনৈতিক দলগুলোকে চমকে দেওয়ার মতন ঘটনা। সেই ফলে উল্লসিত হয়ে ওয়াইসি ঘোষণা দেন যে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল অংশ গ্রহণ করবে এবং ৭০টি আসনে প্রার্থী দেবে। তখন থেকেই এ রাজ্যের শাসকদল বিরোধী অবিজেপি দলগুলি প্রমাদ গুণতে শুরু করে। এদিকে বেশ কিছুদিন থেকে আবার একটার পর একটা প্রকাশ্য সভা করে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ঘোষণা দিচ্ছেন যে তিনি নতুন দল তৈরি করে আসন্ন বিধানসভা প্রার্থী দেবেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে আগামী ২১শে জানুয়ারী তাঁর নতুন দলের নাম ঘোষণা করবেন। 

                                  

এর ফলে শাসক দল এবং অবিজেপি বিরোধী দলগুলোর চিন্তার ভাঁজ আরও বেড়েছে। কারণ তাঁরা যত ভোট পাবেন ততটাই বিজেপির জয়ের রাস্তা প্রশস্ত হবে। শাসকদল ও অবিজেপি বিরোধী দলগুলি আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এবং আব্বাস সিদ্দিকীকে যে ভয় পাচ্ছে তা তারা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনা ও প্রতারণার যে অভিযোগ করছেন তার জবাব রাজনৈতিকভাবে দিতে না পেরে ওয়াইসিকে বহিরাগত, তাঁর দলকে ভোট কাটুয়া এবং বিজেপির বি-টিম বলে আক্রমণ করা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে আব্বাসের জনসভায় ব্যাপক ভিড় হচ্ছে যা দেখে ভয় পেয়ে শাসকদল এবং কংগ্রেস ও সিপিএম দল ফুরফুরা শরীফে গিয়ে প্রায় হত্যে দিয়ে পড়েছে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকীর কাছে। যখন দেখা যাচ্ছে যে আব্বাস সিদ্দিকীকে ভোটে অংশ নেওয়া থেকে নিরস্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না তখন কংগ্রেস ও সিপিএম তাঁকে প্রস্তাবিত বাম-কংগ্রেস জোটে ভেড়ানোর জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। একদিকে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি যেমন শাসকদলের অরাজনৈতিক আক্রমণকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন, অপরদিকে আব্বাসও তেমনি মুসলিম এবং আদিবাসী, বনবাসী ও দলিতদের নিয়ে একটি ফ্রণ্ট তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই আসাদুদ্দিন ওয়াইসি হায়দ্রাবাদ থেকে উড়ে এসে ফুরফুরা শরীফে গিয়ে আব্বাসের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং আব্বাসের নেতৃত্বেই তাঁর দল ভোটে লড়বে বলে জানিয়েছেন যা তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিএম-কংগ্রেসের দুশ্চিন্তা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।  

     

ত্রিমুখী নয়, পশ্চিমবঙ্গে এবার চতুর্মুখী লড়াই হতে যাচ্ছে  

২১০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের ১৮টিতে জয় পায়। ২০১৪-য় ছিলো দু’জন সাংসদ, একলাফে সেটা ন’গুণ (৯০০ শতাংশ) বেড়ে হয় আঠারো। শুধু সাংসদ সংখ্যার নিরিখেই নয়, বিজেপি শাসকদলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে সমর্থ হয় প্রাপ্ত ভোট-শতাংশের দিক থেকেও। ২১০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৪৩.৬৯%, বিজেপি সেখানে পায় ৪০.৬৪%। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিলো মাত্র ১০.১৬%, মাত্র তিন বছরে বৃদ্ধি হয় চারগুণ (৪০০%)। ২১০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির এই প্রায় অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ সাফল্য তাদের মধ্যে একটা প্রত্যয়ের জন্ম দিতে শুরু করে যে, পশ্চিমবঙ্গে সরকার তৈরি করা শুধু একটা শ্লোগান বা স্বপ্ন নয়, তা সম্ভবও। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে নবান্ন দখল করার জন্যে পায়ের নীচে যে জমি প্রয়োজন সেটা তারা পেয়ে গেছে। সেই মাটির উপর দাঁড়িয়ে তারা হুঙ্কার ছাড়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে উদ্দেশ্য করে যে, ২০১৯-এ হাফ, ২০২১-এ সাফ।

২০১৯-এর নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসও উপলব্ধি করে যে পশ্চিমবঙ্গে তারা আর অপ্রতিদ্বন্দী নয় এবং বিজেপি সত্যিই তাদের বিকল্প হিসাবে দ্রুত উঠে আসছে। লোকসভার সেই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ১২টি আসন কম (৫৫%) পেলেও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার বিশেষ কমেনি। ২০১৬ সালে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৪৪.৯১%, আর ২০১৯ সালে ৪৩.৬৯%, হ্রাস মাত্র ১.২২%। অপরদিকে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে পেয়েছিলো ১০.১৬% ভোট, সেটা ২০১৯-শের লোকসভার নির্বাচনে বেড়ে হয় ৪০.৬৪%, অর্থাৎ বৃদ্ধি হয় ৩০.৪৮%, পাটিগণিতের হিসাবে চারগুণ তথা ৪০০ শতাংশ। বিজেপির এই বিশাল ভোট বৃদ্ধি হয়েছে মূলত বামদলগুলি এবং কংগ্রেসের ব্যাপক রক্তক্ষরণের জন্যে। বামেদের (এসইউসি বাদে) ভোট কমেছে ২৩.৪১% এবং কংগ্রেসের ভোট কমেছে ৩.১৫%। অর্থাৎ বাম ও কংগ্রেসের ২৬.৫৫% ভোট বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল শুধু কোনো দলের জয়-পরাজয়ই সূচিত করেনি, অন্য একটি বিশেষ দিকের প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ কি দ্বিদলীয় রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে? জনগণ তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে কি তৃতীয় কোনো দল বা জোটকে চায় না? সে রকমই একটা ঝোঁক যেন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে সেই ছবিটাই তো সামনে আসছে। ২০১৬-য় তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সম্মিলিত ভোটের অংশ ছিল যেখানে ৫৫.০৭%, ২০১৯-এ সেটা একলাফে ২৯.২৬% বেড়ে হয়েছে ৮৪.৩৩%। সংসদীয় রাজনীতিতে বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন শুধু বাম-কংগ্রেস দলের পক্ষেই অশুভ নয়, অশুভ গণতন্ত্রের পক্ষেও। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি মনে হচ্ছে এখানে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থাটাই মনে প্রাণে চাইছে। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে বলা শুরু করেছেন যে সিপিএম ও কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে আঁতাত করেছে তাদের বিরুদ্ধে। মমতা ব্যানার্জী বলছেন বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস হলো আসলে নিমাই, জগাই ও মাধাই। একথা বলে তিনি বিজেপি তথা হিন্দু মৌলবাদবিরোধী সব ভোট তাঁর পক্ষে একত্রিত করতে চাইছেন। অপরদিকে বলা বাহুল্য যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা তো বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির জন্যে আদর্শ ব্যবস্থা। তাই তাদের শ্লোগান হলো - তৃণমূল কংগ্রেসের স্বৈরশাসন ও অপশাসন থেকে বাংলাকে বাঁচাতে পারে একমাত্র বিজেপিই, বাম ও কংগ্রেস নয়।

পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করেছে কংগ্রেস ও বামেরাও। তাই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির বিরুদ্ধে জোট বেঁধে লড়াই করার। একদা বাম ও কংগ্রেস ছিলো দুই যুযুধান পক্ষ, ফলে তাদের জোট বাঁধাটা মোটেই সহজ নয়। তবু যেহেতু দেওয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেছে তাই দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থা ঠেকাতে যে কোনো উপায়েই হোক তারা জোট বাঁধতে মরিয়া। তাদের প্রয়াস সার্থক হলে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার কথা। কিন্তু পরিস্থিতিটা সেখানেও আটকে নেই এখন। পরিস্থিতিটা এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ যেন চতুর্মুখী লড়াইয়ের দিকে।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ, ভোটের ময়দানে নামার জন্যে ইতিমধ্যেই পুরোদমে গা ঘামাতে শুরু করেছে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এবং পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী যে কথা ইতিমধ্যেই ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। যদি আব্বাসের প্রস্তাবিত ছোট ছোট দশটি দলের ফ্রণ্ট গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় এবং ওয়াইসির সঙ্গে আব্বাসের যদি জোট বা বোঝাপাড়া তৈরি হয় তবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে নিশ্চিতভাবেই চতুর্মুখী লড়াই হবে তা বলাই যায়।   

এখন সব দলেরই সর্বাধিক মাথাব্যাথা মুসলিম ভোটারদের নিয়েই, মায় বিজেপির পর্যন্ত

মুসলিম ভোট নিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই মাথাব্যাথা হওয়ার বা থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। অবিজেপি সব দলই চায় যে কোনো মূল্যে মুসলিম ভোট-ব্যাংককে কব্জা করতে। হ্যাঁ, ‘যে কোনো মূল্যেই’ কথাটা বলছি সম্পূর্ণ সচেতনভাবাবেই। ‘মুসলিম ভোট-ব্যাংক অটুট রাখার জন্যে নীতি ও আদর্শের সঙ্গে যতটা আপোষ করতে হয় করো, - এই হলো অবিজেপি দলগুলির এখন একটা অন্যতম প্রধান মন্ত্র। আগে দলের নীতি ও আদর্শ, পরে ভোট বা ক্ষমতা – এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন সম্পূর্ণ অতীত। এক্ষেত্রে এ রাজ্যে, হয়তো সমগ্র দেশেও, তৃণমূল কংগ্রেস অতুলনীয়।

                                                                      West Bengal Muslims: How Owaisi & Furfura Sharif's Abbas Siddiqui Are Where  Siddiqullah Chowdhury Once Was

নীতি ও আদর্শ পদদলিত করে রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্ক কব্জা করতে, কিংবা মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে মরিয়া প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, মুসলিমরা নিজেদের আজও কেবলই ভোটার করেই রেখেছে, তারা তাদের এখনও নিজেদের দেশের নাগরিক হিসাবে ভাবে না, বলা ভালো ভাবতে চায় না। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, শুধু মুসলমানরা বোঝে না। নিজেদের শুধু ভোটার বা ভোটের পণ্য করে রাখার ফলে তারা যে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে তা বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও নেই। রাজনৈতিক দলগুলিও তাদেরকে শুধু ভোটার হিসাবেই দেখতে চায়, নাগরিক হিসেবে নয়। দ্বিতীয়ত, মুসলিমদের জনসংখ্যা। মুসলিমদের জনসংখ্যা এখন প্রায় ৩০% (তিরিশ শতাংশ) এবং তিনটি জেলায় (মুর্শিদাবাদ, মালদা ও রায়গঞ্জ) তারা সংখ্যাগুরু। এই তিনটি জেলায় বিধানসভা সিটের সংখ্যা যথাক্রমে  বাইশ, বারো এবং নয়, মোট তেতাল্লিশ। তাছাড়া আরও আটটি জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা কুড়ি শতাংশের ওপর যার মধ্যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও বীরভূমে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ শতাংশ। এর ফলে রাজ্যের ১২৫টি বিধানসভা আসনে তাদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি তথ্য বলছে যে, ২০০৬ সালে বামফ্রণ্ট যে বিশাল জয় পেয়েছিলো (২৯৪ সিটের মধ্যে ২৩৫টি) তার কারণ ওই ১২৫টি আসনের মধ্যে তারা পেয়েছিলো ১০২টি আসন। আবার মমতা ব্যানার্জী ২০১৬ সালের বিশাল জয়ের (২১১টি আসনে জয়) কারণ হলো, ওই ১২৫টি আসনের মধ্যে তিন ৯০টি আসনে বিজয় প্রাপ্তি। স্বভাবতই ভোটের ময়দানে ওয়াইসি ও আব্বাসের আবির্ভাবে শাসক দল এবং কংগ্রেস ও বামেরা ভীষণ চিন্তিত, উদ্বিগ্নও বটে। ওয়াইসি ও আব্বাসরা যদি মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে পারে তবে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে তৃতীয় বারের মতন সরকার তৈরি করা যেমন কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি অনুরূপভাবে কংগ্রেস ও বামেদেরও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকাও শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। আর এসবের অর্থ হলো নবান্নে বিজেপি রাজের সূচনা হওয়া। 

ওয়াইসি ও আব্বাসদের ভূমিকা ও তৎপরতায় শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ধর্মীয় নেতারাও সমান চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বিজেপি ক্ষমতায় আসলে তাঁরা সব রকমের সরকারি দাক্ষিণ্য ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই তাঁরা নিজেদের স্বার্থেই মমতা ব্যানার্জীকে ক্ষমতায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে ওয়াইসি ও আব্বাসদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আসরে নেমে পড়েছে। যাঁরা আসরে নেমে পড়েছে তাঁদের মধ্যে যেমন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী ও সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী রয়েছেন, তেমনি রয়েছে ইমামদের সংগঠনও। অন্যদিকে কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারাও পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীকে তাদের জোটে টানতে তৎপরতা শুরু করেছেন।

অন্যদিকে মুসলিম ভোট নিয়ে বিজেপিকেও বেশ সতর্ক দেখাচ্ছে। ৩০% মুসলিমদের বাদ দিয়ে এ রাজ্যে সরকার তৈরি করা যে অসম্ভব তা বিজেপি বোঝে। সেজন্যে মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে বিজেপিও সমানে সচেষ্ট। এ কাজে বিজেপি কিছুটা সাফল্যও পেয়েছে এবং সংখ্যায় কম হলেও বিজেপিতে মুসলিমদের যোগদান অব্যাহত রয়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে বিজেপি একটি বিশেষ রণকৌশল গ্রহণ করেছে। সেটা হলো প্রধান ইস্যুগুলিকে (অনুপ্রবেশ, মাদ্রাসা, অভিন্ন দেওয়ানি আইন, লাভ জিহাদ, গোরক্ষা ইত্যাদি) আপাতত ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া। এমনকি অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে যে দুটি কঠোর ও বিতর্কিত আইন(এনআরসি ও সিএএ) প্রণয়ন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার সেগুলি কার্যকরী করাও আপাতত স্থগিত রেখে দেওয়া হয়েছে, যদিও বিজেপির মতুয়া প্রতিনিধিদের সিএএ কার্যকরী করার জন্যে নেতৃত্বের ওপর প্রবল চাপ রয়েছে।   ১২.০১.২০২১

 

 পুনশ্চঃ ২১শে জানুয়ারী পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী তাঁর রাজনৈতিক দলের নাম – Indian Secular Front - ঘোষণা করেছেন।

 

 

Saturday, December 26, 2020

পুরুষতন্ত্রের বৈষম্য ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের বলি হয়েছেন সুজাতা খাঁন

 

Sujata Mondal khan - Photos | Facebook

সুজাতা খাঁ যেমনই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলেন তেমনই তাঁর জীবনসঙ্গী সৌমিত্র খাঁন বৈদ্যুতিন চ্যানেলে বসে ঘোষণা দিলেন যে, তিনি অতি শীঘ্রয় সুজাতার সঙ্গে বৈবাহিক ছিন্ন করার আইনি পদক্ষেপ করবেন। তাঁরা দুজনেই একদা তৃণমূল কংগ্রেস করতেন এবং দুজনেই একসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তখন দল বদল করার সিদ্ধান্তটি ছিলো সৌমিত্রর, সুজাতা তাঁর অনুগামী হয়ে সহধর্মিণীর পবিত্র (!) কর্তব্য পালন করেছিলেন মাত্র। এবার সুজাতা যখন দল বদল করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন সৌমিত্র তাঁকে শোনালেন চরম শাস্তি প্রদানের ঘোষণা। ওঁরা ঘর বেঁধেছিলেন ভালবেসে। স্বভাবতই তাঁদের দাম্পত্য জীবনে সাত পাকের বন্ধনের জোর যতোটা ছিলো তার চেয়ে জোর বেশী ছিলো ভালবাসার বন্ধনের। তাঁদের দুজনের কথাতেই সেটা স্পষ্ট হয়েছে। সৌমিত্র চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোষণা যখন দেন। অর্থাৎ ভালবাসার বন্ধন ছিন্ন করতে তাঁর মন চায় নি তাঁর, যা করেছেন চাপে করেছেন – এমনটা দাবি করেছেন সুজাতা। সৌমিত্র ও সুজাতা যখন তৃণমূল  কংগ্রেস ছাড়েন, তখন তার খেসারত দিতে হয়েছিলো মূলত সুজাতাকেই। সুজাতা অবশ্য এখন যে শাস্তি পেলেন সৌমিত্রের কাছ থেকে তার তুলনায় আগের শাস্তিটা ছিলো নগণ্য।   

সুজাতাকে ডিভোর্স দেবার ঘটনাটি আমাদের অচেনা কিছু নয়

অদূরেই বিধানসভা নির্বাচন, তারপর দুজনই দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, তাই বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলির নিকট এই ঘটনাটি তাদের টিআরপি বাড়ানোর জন্যে অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। তাই স্থানীয় থেকে সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলি হামলে পড়েছে সুজাতা ও সৌমিত্রর উপর। ফলে ঘটনাটা একটা বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। যেন চিত্রনাট্যের একটা মুচমুচে গল্প কিংবা নতুন কোনো উপাখ্যান, বাস্তব জীবনের কোনো ঘটনাই যেন নয়। না, মোটেই তা নয়, মোটেই অচেনা বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সুপ্রাচীন কালের আমল থেকে হাল আমলের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এই ঘটনাগুলি হরদমই ঘটে যার কিছু খবর হয়, বেশীরভাগেরই খবর হয় না। এক লহমায় সুজাতাকে তাঁর স্বামীর ত্যাগ করার ঘটনাটি পুরুষতন্ত্রের বহু প্রাচীন সংস্কৃতি এবং আধুনিক যুগের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির অংশ ও অঙ্গ মাত্র, এর বেশী কিছু নয়।         

রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলি  

আমাদের দেশের গণতন্ত্র নাকি খুব বিকশিত হয়েছে, এবং এখন বেশ পরিণত। এমন দাবির বাস্তবতা আমার চোখে পড়ে না। বরং যতদিন যাচ্ছে আমাদের গণতন্ত্র হিংসা ও অসহিষ্ণুতার খঞ্জরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। গণতন্ত্রের গা বেয়ে অবিরাম রক্ত ঝড়ছে। হিংসার কথা থাক, ওটা এ নিবন্ধের বিষয় নয়। আমাদের স্বাধীনতার অব্যবহিত কাল থেকেই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আমাদের গণতন্ত্রকে বিদ্ধ করে চলেছে। ভিন্ন মত ও বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব পরিলক্ষিত হয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর আমল থেকেই। দেশ স্বাধীন হতে না হতেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে নেহেরু সরকার। সেই কমিউনিস্ট পার্টিকেই ১৯৫৭ সালে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন কেরালার জনগণ। সেটা কংগ্রেস সয়তে পারে নি, সরকারটা ভেঙে দিয়েছিলো। একই কারণে, ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগ করে একের পর রাজ্য সরকার ভেঙেছে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার।      

ভিন্ন মত, বিরোধী কণ্ঠস্বর তো একেবারেই সয় না বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসে দলের সরকারেরও। মোদিজির সহিষ্ণুতার এত অভাব যে প্রধান বিরোধী দলকে পর্যন্ত ও সয়তে পারে না, কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সমালোচনা করলেই দেশবিরোধী, পাকিস্তানের দালাল, মাওবাদী, শহুরে নক্সাল বলে দেগে দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মমতা ব্যানার্জীও অনুরূপ কাজই করছেন।  

কম্যুনিস্ট পার্টিতেও ভিন্ন মত, মতাদর্শগত সয় না। মতাদর্শগত কারণে সিপিআই (এম) থেকে বেরিয়ে গিয়ে যখন নক্সাল দল তৈরি হয় দেখা গেছে দুটি দলের মধ্যেই ভয়ঙ্কর রকমের অসহিষ্ণুতা। এক দশক জুড়ে চলেছিলো দুই দলের মধ্যে প্রবল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সিপিআই থেকে বেরিয়ে গিয়ে যখন সিপিআই (এম) তৈরি হয়েছিলো তখনও দেখা গিয়েছিলো দুই দলের নেতাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে স্বামী-স্ত্রীর বাড়ির মধ্যে পাঁচিল ঊঠে গিয়েছিলো। ঘটনাটি ঘটেছিলো কেরালায়।    কে.আর.গৌরী ও টিভি টমাস ছিলেন কেরালার শীর্ষস্থানীয় দুই কম্যুনিস্ট নেতা এবং পরষ্পরের জীবনসঙ্গীও। ১৯৬৪ সালে সিপিআই মতাদর্শগত কারণে দুটুকরো হয়ে যায়। গৌরী আম্মা সিপিআই (এম)-এ চলে যান, টমাস থেকে যান সিপিআই-এ। গৌরী আম্মা পার্টি থেকে ছুটি নেন, টমাস তাঁর দলের কাজ চালিয়ে যান। তাঁরা ঠিক করেন যে, কেউই দলের লোককে বাড়িতে আনবেন না যাতে দাম্পত্যে জীবনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব না পড়ে। এভাবে কিছুদিন চললেও শেষ রক্ষা হয় নি। মন্ত্রীসভার সদস্য হবার কারণে তাঁদের দুজনকেই সরকারের বরাদ্দ করা আলাদা আলাদা বাড়িতে ঊঠে যেতে হয় এক সময়। বাড়ি দুটো ছিলো পাশাপাশি। তাঁরা দুটি বাড়ির মধ্যেকার পাঁচিল ভেঙে একটা দরজা বসিয়েছিলেন। কিন্তু সেই দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো পার্টির নির্দেশে। সেটা নাকি সিপিআই দলের সিদ্ধান্ত ছিলো।

রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার বলি হচ্ছে অসংখ্য পরিবার, নষ্ট হচ্ছে আত্মীয়তার সুন্দর সম্পর্কগুলি। কত পরিবার যে প্রতিনিয়ত ভেঙে তছনছ হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। দ্বন্দ হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাই-বোনে, পিতা-পুত্রে্ ও পতি-পত্নীতে। দ্বন্দ গড়াচ্ছে থানা ও আদালত পর্যন্ত। অসহিষ্ণুতা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার চেহারা নিচ্ছে। জান যাচ্ছে, ধন যাচ্ছে, মানও যাচ্ছে। অসহিষ্ণুতার কারণে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে এ রাজ্য। সুজাতা যাঁকে নিয়ে এই নিবন্ধের অবতারণার তিনিই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গেলে তাঁর পরিবারের উপর নেমে এসেছিলো ভয়ঙ্কর অত্যাচার, এমনকি তাঁর চাকরিটাও চলে গিয়েছিলো। সেই সুজাতা বিজেপি ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ায়  আবারও বলি হয়েছেন অসহিষ্ণু রাজনীতির। তাঁর স্বামী তাঁকে ডিভোর্স করবেন জানিয়ে দিয়েছেন।      

সুজাতার উপর ডিভোর্সের যে খাঁড়া নেমে এসেছে তা পুরুষতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি

কেবল দলের অসহিষ্ণুতাজনিত চাপ নয়, স্ত্রীকে ত্যাগ করার মতন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সৌমিত্র আর একটা কারণে। সেটা তার স্বামীত্বের অহংবোধ। সুজাতা খাঁন তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁর অনুমতি ব্যতীতই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন, এটা সৌমিত্রর স্বামীত্বের অহংবোধকে প্রবল আঘাত করেছে। স্ত্রী তাঁর দলকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় তাঁর সামনে একটা কঠিন প্রশ্ন এসে উপস্থিত হয়। সেটা হলো তাঁর কাছে কে বড়ো – দল না স্ত্রী? সুজাতা বিজেপির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলে বিজেপিকে ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ায় বিজেপির মুখ যে পুড়েছে, তা বুঝতে সৌমিত্রর বিলম্ব করে নি। বুঝতে তার বিলম্ব হয় নি এটাও যে সুজাতাকে মুখের উপর জুতসই জবাব দিয়ে বিজেপির মুখ রক্ষা করতে হবে তাকেই সেটাও। সেই জুতসই জবাবটা হলো স্ত্রীকে ত্যাগ করা। এছাড়া আর কীইবা ছিলো যা বিজেপিকে সন্তুষ্ট করতে পারতো? এটা তো একটা দিক, রাজনৈতিক দিক। এ ছাড়াও আর একটি দিক রয়েছে যা সৌমিত্রকে ঐ কঠোর পদক্ষেপ করতে প্ররোচিত করেছে। সেটা হলো তাঁর স্বামীত্বের অহংকার। দলে এবং ঘরে ও বাইরে সৌমিত্র কী জবাব দিতেন এ খোঁটার – কীরে কি রকম স্বামী তুই যে তোর বৌ তোর দল ছেড়ে পালিয়ে গেলো? আর গেল তো গেল তোদের প্রধান শত্রুর শিবিরে ? স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া এ প্রশ্নটার অন্য কোনো জবাব ছিলো না সৌমিত্রর কাছে। পুরুষতন্ত্র পুরুষজাতিক একটাই জবাব শিখিয়েছে, সেটা হলো - অবাধ্য স্ত্রীকে ত্যাগ করা। তাই বিজেপির কাছে বিশ্বাসযোগ্য থাকা এবং স্বামীত্ব ও পুরুষত্বের অহংবোধকে অটুট রাখার জন্যে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া সৌমিত্রর সামনে আর কোনো উপায় ছিলো না।

সৌমিত্র যা করেছেন তা ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেনেই করেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে বিজেপি বোঝে হিন্দু সংস্কৃতি যা দাঁড়িয়ে আছে প্রধান দুটি স্তম্ভের উপর - পুরুষতন্ত্র এবং বর্ণবৈষম্য তথা জাতিভেদ প্রথা। আর পুরুষতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ হলো লিঙ্গবৈষম্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব পুরুষজাতির, স্ত্রীজাতি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সেখানে মানুষ হিসাবে কোনো মর্যাদা নেই, নেই কোনো স্বাধীনতা ও অধিকারও। পুরুষজাতির ইচ্ছাই স্ত্রীজাতির কর্ম। পুরুষতন্ত্রের দুটো শাখা – পিতৃতন্ত্র ও স্বামীতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র মানে সন্তানদের উপর পিতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। পিতা হলো পরিবারের একমাত্র কর্তা ও শাসক। সন্তানরা কী পরবে, কী খাবে, কোন স্কুলে/কলেজে পড়বে, কোন শাখায় পড়বে, কাকে ও কোথায় বিয়ে করবে সব ঠিক করবে পিতা, সেখানে সন্তানের মায়ের মতামত মূল্যহীন। স্বামীতন্ত্র মানে অনুরূপভাবে স্বামীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক হলো আসলে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের মতন। স্বামী যা নির্দেশ করবে স্ত্রী তা অম্লান বদনে পালন করবে। পুরুষতন্ত্রের এই সামাজিক বিধানই হিন্দু সমাজের বিধান, হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গও। বিজেপির বিরুদ্ধে তাই সৌমিত্রকে তাঁর স্ত্রীকে ইস্তফা দেবার জন্যে চাপ দেবার যে অভিযোগ উঠেছে তাকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই। 

পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুযায়ী হিন্দু নারী হবে সীতা ও বেহুলার মতন সতীস্বাধ্বী পতিব্রতা নারী। সীতার মতন বিনা প্রতিবাদে স্বামীর কথায় আগুনে ঝাঁপ দেবে, পাতালে প্রবেশ করবে। বেহুলার মতন মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের নাচ দেখিয়ে মন গলাবে। হিন্দু সংস্কৃতি মতে বিয়ে হলো জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন। স্বামী অজস্র বিয়ে করতে পারবে, স্ত্রীকে ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারবে, কিন্তু উল্টোদিকে স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হোক বা না হোক, স্ত্রীকে খেতে দিক বা না দিক, স্ত্রী তাকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। কারণ,  স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বন্ধন যে ইহকাল ও পরকালেরও। হিন্দু রমণী বিধবা হলে তাই হয় চিতায় উঠবে, না হয় আজীবন বিধবাই থাকবে। মূল কথা হলো হিন্দু নারী কোনো পরিস্থিতিতেই স্বামীকে ছেড়ে যাবে না সে জীবিতই হোক কিংবা মৃতই হোক। কোনো হিন্দু নারী এসব বিধি-বিধান লঙ্ঘন করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সুজাতার একান্ত নিজস্ব – এটাতো স্পষ্টত পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু কোডের লঙ্ঘন এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সৌমিত্র সেই কোড ও বিজেপির অনুশাসন মেনেই সুজাতাকে কঠোরতম শাস্তির ঘোষণা শুনিয়েছেন।                         

সুজাতা যদি সুজাতা খাঁন না হয়ে শাহনাজ পারভীন হতেন তা হলেও তাঁর জন্যে ওই একই শাস্তি বরাদ্দ ছিলো। কারণ, কারণ, ইসলামও পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী একটি ধর্ম যেথানে রয়েছে  নারীর উপর পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। ইসলামি সংবিধানের পোশাকি নাম শরিয়ত। শরিয়ত অনুযায়ী সেই নারীই আদর্শ মুসলিম নারী যে স্বামীকে প্রভু মেনে তার ভৃত্যগিরি করবে, সদাই স্বামীর নির্দেশ তামিল করবে, কোনো পরিস্থিতিতেই স্বামীর অবাধ্য হবে না, স্বামী অসন্তুষ্ট হয় এমন কাজ করবে না, স্বামীকে ত্যাগ করার কথা মনেও ঠাঁই দেবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলিম নারী যদি স্বামীর অবাধ্য হয় তবে শরিয়তে তার জন্যেও রয়েছে চরম শাস্তি তথা তালাকের বিধান। (দ্রঃ কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াত)              

সুজাতার দলত্যাগে নীতি-নৈতিকতা নেই, আছে শুধুই সুবিধাবাদ

ভারতীয় রাজনীতি থেকে দ্রুত গতিতে অপসৃত হচ্ছে নীতি ও আদর্শ এবং ত্যাগ, শৃঙ্খলা, মানবতা, উদারতা, নিঃস্বার্থপরতা, দল ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠা ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি। ফলে ভারতীয় রাজনীতির জগৎটা পরিণত হয়েছে পশুহাটের মতন নেতা-নেত্রী এবং জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার হাটে। যতদূর মনে পড়ে, কংগ্রেসী জামানায় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও-এর আমলে এর সূত্রপাত হয়েছিলো। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পর জনপ্রতিনিধি কেনাবেচাটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। জনগণের রায় তিনি মানতে চাইছেন না। জনগণ তাঁর দলকে মোটা অর্থ ও মন্ত্রীত্বের বিনিময়ে ঘোড়া কেনার মতন বিধায়ক ও সাংসদ কেনার খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছেন। বিধায়ক কিনেই তিনি ব্যাঙ্গালোর ও মধ্যপ্রদেশের মতন দুটি বড় রাজ্য দখল করেছেন। গোয়া, মণিপুরও ও হরিয়ানাও দখল করেছেন অনৈতিকভাবে। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ব্যাপকহারে জনপ্রতিনিধি কেনা শুরু হয়ে আরও আগে, ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার পর থেকে। সেই কেনাবেচার রাজনীতিতে শুধু বিরোধী দলের বিধায়ক ও সাংসদ বিক্রী হয় নি, বিক্রি হয়ে গেছে আস্ত দুটো জেলা পরিষদ (মুর্শিবাদ ও মালদহ জেলা পরিষদ) এবং অনেকগুলি পৌরসাভাও। বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যে বিধায়ক কেনাবেচা হয়েছে তা ফাঁস করে দিয়ে গেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যাবার আগে। ক্যামেরার সামনে বলেছেন যে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম বিধানসভার কংগ্রেসের বিধায়ককে কেনা হয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকায় এবং একই জেলার নবগ্রাম বিধানসভার সিপিআই (এম)-এর বিধায়ককে কেনা হয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ও একটা স্করপিয় গাড়ির বিনিময়ে।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার বাজারে ক্রেতা ছিল একজনই। কিছুদিন হলো বাজারে নেমেছেন আর একজন যিনি আরও বড় ক্রেতা। ফলে বিধায়ক কেনাবেচার বাজার এখন আরও জমজমাট। বাজারটা আরও বেশী জমে উঠেছে শুভেন্দু মালিক বিজেপিতে যাওয়ায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গে শাসকদলে এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বিধায়ক ও সাংসদ এবং অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের দল বদলানোটা ব্যাপক চেহারা নিয়েছে। সকালে বিকালে দল বদল হচ্ছে। দল বদলের খবরে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি সুজাতা খাঁনের দল বদলেও।    

সুজাতার দল বদলের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। তবুও তাঁর দল বদলে অনৈতিকতা ও সুবিধাবাদের ছাপ ভীষণভাবেই স্পষ্ট। তিনি তো নিজেই জানিয়েছেন যে তার দল বদলের পেছনে রয়েছে তাঁর আশা ও মোহভঙ্গের ক্ষোভ। তিনি অভিযোগ করেছেন যে তার যা প্রাপ্য (নেতৃস্থানীয় পদ) বিজেপি তা দেয় নি। বিজেপি তাঁর প্রতি অবিচার করেছে, তাঁকে ঠকিয়েছে যে ক্ষোভে তিনি বিজেপি ত্যাগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত হলে তিনি দলে থেকেই প্রতিবাদ করতে পারতেন, কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারতেন। তা হলে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে পারতো না। তাঁর দিকে আঙুল উঠছে আর একটা কারণে। তা হলো, দল বদল করে প্রত্যাবর্তন করেছেন সেই দলেই যে দল তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন, যে দল প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তাঁর উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছে, তাঁকে চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তাঁর দল বদলে নীতি-নৈতিকতা নেই, যা আছে তা অনৈতিকতা ও সুবিধাবাদ।         

তবুও সুজাতার পদক্ষেপকে স্বাগত

সুজাতা খাঁনের দলত্যাগ ও অন্য দলে যোগদানের দুটো দিক আছে। একটা দিক কেবলই  নীতিহীনতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। আর একটি দিক হলো, একজন নারীর নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার দুঃসাহসিক চেষ্টা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ও সমাজব্যবস্থায় নারী শিশু ভূমিষ্ঠ হয় একজন মানব সন্তান হিসেবে। কিন্তু তাকে ধীরে ধীরে মানব সন্তান থেকে নারী করে গড়ে তোলা হয়। তার মানসিক গড়ন, চিন্তন ও দর্শন এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যে, সে এটা মেনে নেয় যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আকাঙ্খা ও ব্যক্তিগত মতামত থাকতে নেই, থাকাটা অন্যায় ও অনৈতিক; তার নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ও অধিকার থাকতে নেই, তা চাওয়াটা তার এক্তিয়ার বহির্ভূত; সেই হলো আদর্শ নারী যে বিয়ের আগে থাকবে পিতার বাধ্য ও অনুগত এবং বিয়ের পর থাকবে স্বামীর অনুগত ও বাধ্য; সেই হলো আদর্শ স্ত্রী যে হবে সীতা ও বেহুলার মতন পতিভক্ত এবং পুরুষের এঁকে দেওয়া লক্ষণ রেখা অতিক্রম করবে না; সেই নারীই প্রকৃত অর্থে আদর্শ নারী যার নিজস্ব সত্ত্বা ও পরিচয় থাকবে না; একজন আদর্শ স্ত্রী হবে সেই নারী যে আক্ষরিক অর্থেই হবে সহধর্মিণী ও সহগামিণী ইত্যাদি ইত্যাদি। নারীর মস্তিষ্ক ধোলাই করার জন্যে পুরুষ অনেক নির্মাণ করেছে নারীর জন্যে। সহধর্মিণী ও সহগামিণী হলো সে রকম দুটো শব্দ যা লেপটে দেওয়া হয়েছে নারীর উপর। সহধর্মিণী মানে নারীর নিজের কোনো ধর্ম থাকতে নেই, স্বামীর ধর্মই তার ধর্ম এবং সহগামিণী মানে নারীর নিজস্ব কোনো গমন থাকতে নেই, স্বামীর অনুগামিণী হওয়াই তার একমাত্র ধর্ম।  

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষজাতি নারীর হাতে পায়ে মনে মননে ও মস্তিষ্কে অজস্র বেড়ি পরিয়ে রেখেছে, নারী আপাদমস্তক পুরুষের তৈরি নিয়ম-কানুনের লৌহশৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খল যে নারী ভাঙার একটু চেষ্টা করেছে তখনই তার উপর নেমে এসেছে কঠোর শাস্তি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেজাত, ব্যভিচারী, পতিতা, ইত্যাদি কুৎসিত তকমা দিয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে অচ্ছুত করে তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। তা দেখে অন্য নারীদের হৃদয় কম্পন শুরু হয়ে যায়, ফলে যে নারী প্রতিবাদী হতে চায় সেও ভয়ে সেঁটিয়ে যায়। এই বাস্তবতার কথা একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী বোঝে একজন নারী। সুজাতা খাঁনের পদক্ষেপকে বিচার করা দরকার এই বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে। তিনি শুধু একটা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নি, বিদ্রোহ করেছেন হাজার হাজার বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতন পুরুষতান্ত্রিক যে ব্যবস্থা সমাজের বুকে চেপে বসে রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বামীর পরিচয়ের ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন নিজস্ব সত্ত্বা ও পরিচয় অর্জনের জন্যে। সহধর্মিণী ও সহগামিনীর তকমা ছিন্ন করে নিজের পছন্দের রাস্তায় পদক্ষেপ করেছেন। স্বামীর স্বার্থ ও ইচ্ছার বেড়া ভেঙে নিজের ইচ্ছা ও স্বার্থকে রূপায়িত করার জন্যে পদক্ষেপ করেছেন। সেই পদক্ষেপকে আমি আন্তরিকভাবেই কুর্ণিশ জানাই, স্বাগত জানাই।        

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...