Monday, September 28, 2020

রাজিয়া অতীত ভুলতে চাইঃ মুসলিম ধর্মগুরু ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতারা এবার ক্ষমা চান

 

২০১৪ সালে খাগড়াগড় আইইডি বিস্ফোরণে ধৃত রাজিয়া বিবি কিছুদিন হলো জেলবাসের সাজা শেষে মায়ের কাছে ফিরে এসেছে। এদিকে বিগত কয়েকদিন যাবত সংবাদের শিরনাম দখল করে রয়েছে আল-কায়দার ভারতীয় শাখার জঙ্গিরা NIA - এর হাতে ধরা পড়ার পর। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর মুর্শিবাদের ন’জন জঙ্গি ধরা পড়ে। ন’জনের ছ’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বাড়ি থেকে এবং তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কর্মস্থল কেরালা থেকে। স্বভাবতই কয়েকদিন ধরে খবরের প্রধান শিরনামে এই খবরটাই। চাঞ্চল্যকর এমন খবরের মাঝেও রাজিয়া বিবিও খবরের শিরনামের একটু হলেও জায়গা দখল করে নিয়েছে। রাজিয়া বিবির একটা কথা সাংবাদ মাধ্যম উপেক্ষা করতে পারে নি। মহাদামী সে কথাটা হলো, অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই। তার অতীতটা কী, এবং সেটা সে কেন ভুলতে চাই? জানা যাক তার অতীতটা তাহলে।    

করিমপুরের একট নিরীহ ও প্রান্তিক মুসলিম পরিবারের মেয়ে রাজিয়ার বিয়ে হয়েছিলো শাকিল গাজি নামে একজন ফেরিওয়ালার সঙ্গে। রাজিয়ার পরিবার অন্তত সেটাই জানতো শাকিলের সঙ্গে রাজিয়ার বিয়ে দেবার সময়। তারা জানতো না যে শাকিল একজন বাংলাদেশী এবং জেএমবির (জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) একজন সদস্য, বাংলায় এসে ঘাঁটি গেড়েছে সংগঠনের জাল বিস্তারের কাজে এবং এপার বাংলার ধর্মনিষ্ঠা মুসলিমদের সেই জালে ফাঁসিয়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সংগঠিত্ করার উদ্দেশ্যে। বিয়ের পর রাজিয়া যখন তা টের পেয়েছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, সেই ফাঁস থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা তখন তার কাছে পুরো বন্ধ।

২০১৪ সালে ২রা অক্টোম্বর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে একটি বাড়ির ভিতর যে ভয়ঙ্কর আইইডি [ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস] বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। জেএমবির বাংলাদেশী চাঁই শাকিল গাজি বিস্ফোরণে ফলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। শাকিল তখন সেই বাড়িতে তার স্ত্রী রাজিয়াকে নিয়ে থাকত এবং তাদের সঙ্গে থাকত মুর্শিদাবাদের লালগোলার আর এক দম্পতি - আব্দুল হালিমআলিমা বিবি। হালিমের পা বিস্ফোরণে জখম হয়, ফলে সে পালাতে ব্যর্থ হয়। স্বভাবতই পালাতে পারে নি রাজিয়া ও আলিমাও। ফলে ঘটনাস্থল থেকে তাদের তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বিচারে তারা দোষী সাব্যস্ত হলে  তাদের কারাবাসের দণ্ড দেয়া হয়। কারাদণ্ড ভোগের শেষে গত ৮ই আগষ্ট (৮/৮/২০) জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজিয়া ওঠে তার মায়ের পরিবারে। তার বাবা ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। রাজিয়ার দুই মেয়ে ও এক মেয়ে। সে এখন সব কিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই এবং তার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতন মানুষ করতে চাই। সে আর জঙ্গি জীবনে আর ফিরতে চাই না। আর চাই না যে তার সন্তানদের গায়েও জঙ্গিদের ছায়া পড়ে।  তারজন্যে সে তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে প্রকৃত মানুষ করতে  চাই। রাজিয়া কী বলেছে তা তার মুখ থেকেই শোনা যাক –   

 ‘‘এই বছর অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে। এখন সমস্ত ভুলতে চাই।” ... ‘‘অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই। ... ‘‘তিন ছেলেমেয়েকেই লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই।

রাজিয়ার বয়স এখন তিরিশ। সম্বল বলতে বাবার রেখে যাওয়া দুই বিঘা জমি। কিন্তু গায়ে লেপ্টে রয়েছে জেলখাটা কয়েদি ও জঙ্গি তকমা যা সহজে যাবার নয়। এদিকে মায়ের আর্থিক অবস্থাও তো শোচনীয়। তাহলে কিসের জোর রাজিয়া নতুন করে জীবন শুরু এবং সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার ভরসা পাচ্ছে? তার জোরের জায়গাটা কোথায় তা সে নিজেই বলেছে –

সেলাই মেশিনের কাজ জানি। জেলের মধ্যেও সেলাইয়ের কাজ করতাম, অন্যদের সেলাই শেখাতাম। একটা সেলাই মেশিন এখন খুব দরকার।’’

রাজিয়ার আর্তি ও ভরসার কথাগুলো যে সূত্র থেকে পাওয়া -   https://www.anandabazar.com/state/rajia-bibi-accused-in-burdwan-blast-2014-case-wants-a-new-life-1.1205569

জেল থেকে ফিরে এসে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ড মামলায় রাজিয়া ও জেএমবি-র অন্যান্যদের বিরুদ্ধে NIA যে অভিযোগগুলি করেছিলো তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে নি সে। বলে নি যে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো কতিপয় মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার আড়ালে তারা নতুন সদস্যদের জিহাদের পাঠ ও প্রশিক্ষণ দিতো। তখন অন্তত দুটি মাদ্রাসার নাম উঠে এসেছিলো তাদের কাজের সঙ্গে – মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা এবং লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসা। তখন জানা গিয়েছিলো যে জেএমবির সংগঠনে অন্তত ২৫/৩০ জন নারী জঙ্গি ছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন জিহাদের পাঠ ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। সেই জঙ্গি নারী সদস্যদের মধ্যে আয়েষা বিবি ছিলো একটি উল্লেখযোগ্য নাম। আয়েষা ছিলো শিমুলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা জঙ্গি নেতা মাওলানা ইউসুফের স্ত্রী। না, রাজিয়া এসব বিষয়ে মুখ খোলে নি। মুখ খুলতেও চাই না। তার একটাই আর্তি বা আকুতি হলো - গতো কয়েক বছর তাকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে, অতীতের সবকিছু ভুলে সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গড়তে চাই।  

হ্যাঁ, রাজিয়ার তার নিজের অতীতের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ পাবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। অধিকার আছে সমাজ জীবনের মূলস্রোতে পুনরায় ফিরে আসার। আপন সন্তানদের নিয়ে নতুন করে সুস্থ জীবন যাপন করার সুযোগ ও সহযোগিতা পাবার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। এ ব্যাপারে সরকার ও সমাজের দায়িত্ব হলো তার পাশে দাঁড়ানো। আমি তার এই শুভ ও সৎ ইচ্ছাকে আন্তরাকিতার সঙ্গে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সময় NIA – এর তৎপরতাকে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবং মুসলিম সমাজ ও মাদ্রাসার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে যারা বুক ফুলিয়ে রাজিয়া ও অন্যান্য অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো তারা কি এখন রাজিয়ার পাশে দাঁড়াবার সৎসাহস দেখাবেন? সমাজ জীবনের মূল স্রোতে ফেরার যে আকুতি জানিয়েছে রাজিয়া তাকে কি তারা সম্মান জানাবে?

তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার জেএমবি ও জঙ্গিদের আড়াল করার জন্যে তখন নগ্নভাবে অপচেষ্টা চালিয়েছিলো। আইইডি বিস্ফোরণকে বলা হয়েছিলো সিলিণ্ডার বিস্ফোরণ। রজ্যের পুলিশ প্রশাসন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা অক্ষত আইইডিগুলি পরীক্ষা না করেই নষ্ট করে দিয়েছিলো। বিস্ফোরণ কাণ্ডে জড়িত জঙ্গি রেজাউলের বাড়ি তল্লাশি করে রাজ্য পুলিশ কিছু পায় নি, অথচ সেই বাড়ি থেকেই NIA – এর তদন্তকারী দল উদ্ধার করেছিলো ৩৯টি তাজা আইইডি। রাজ্য সরকার NIA – এর তদন্তকারী দলকে কোনো সাহায্য করে নি, বরং NIA-এর তদন্ত আটকাতেই মরিয়া উঠে পড়ে লেগেছিলো। এভাবেই রাজিয়া-সহ জঙ্গিদের আড়াল করতে দেখা গিয়েছিলো রাজ্য সরকারকে। যে রাজ্য সরকার জঙ্গি রাজিয়াদের পাশে দাঁড়াতে সঙ্কোচ ও লজ্জা করে নি, সেই সরকার কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া রাজিয়ার পাশে দাঁড়াবে? রাজ্য সরকার তো অনেক মাওবাদী জঙ্গিকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। সেই রাজ্য সরকার রাজিয়ার পুনর্বাসনের জন্যে কিছু ব্যবস্থা করে কিনা সেদিকে রাজ্যের মানুষ নিশ্চয় খেয়াল রাখবে।

তৃণমূলী বুদ্ধিজীবী ও গায়ক কবীর সুমনও NIA – এর তদন্তের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। বলেছিলেন, ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্য সকারকে ফেলে দেবার জন্যে বিজেপি সরকার এ রাজ্যে NIA-কে পাঠিয়েছে। জেএমবি ও তার জঙ্গিদের আড়াল করার জন্যে খোলাখুলি মাঠে নেমেছিলো তখন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতা এবং মানবাধিকার আন্দোলনের নেতারাও। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী এবং মুসলিম সমাজের স্বনামধন্য ধর্মীয় নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন,   মাদ্রাসায় সন্ত্রাসবাদীদের ঠাঁই নেই। যারা কোরান-হাদিস পড়ে তারা শান্ত। ধর্ম ও মাদ্রাসার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জিহাদকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি এমনকি NIA – এর তদন্তকারীদের তদন্তের কাজে বাধা দেবার জন্যে মুসলিম সমাজের রুখে দাঁড়াবার নির্দেশ দিয়েছিলেন পর্যন্ত। বলেছিলেন, ওদের মাদ্রাসায় ঢুকতে দেবেন না, সঙ্ঘবদ্ধভাবে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াবেন। মুসলিম সমাজের আর এক ধর্মীয় নেতা পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি তো জঙ্গিদের আড়াল করতে গিয়ে মিডিয়াকেও আসামির কাঠগড়ায় খাড়া করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন,  মুসলিম সমাজের  উপর মিডিয়া আক্রমণ শুরু করেছে মুসলিম সমাজের আর এক ধর্মীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান বলেছিলেন,  হঠাৎ আমাদের মাদ্রাসাগুলি সম্পর্কে অপপ্রচার শুরু হয়েছে হঠাৎ সন্ত্রাসবাদের তকমা দেওয়া হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোর উপর

মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সরব হয়েছিলেন মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের নেতারাও। তাঁরা মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসে NIA – এর তদন্তকে মুসলিম সমাজ এবং মাদ্রাসার বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত বলে গুরুতর অভিযোগ করেছিলেন। ধৃত জঙ্গিদের মুক্তির জন্যে আদালতে উকিল দেবার সদর্প (!) ঘোষণা দিতেও তাঁদের আদর্শে বাধে নি। বন্দিমুক্তি কমিটির পক্ষে ছোটন দাস বলেছিলেন যে, মুসলমানদের আমেরিকার চোখে দেখা হচ্ছে, আর তার ফলে যখনই বিষ্ফোরণ কান্ড ঘটছে তখনই মাদ্রাসা ও পুরো মুসলমান সমাজকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এপিডিআরের সুজাত ভদ্র বলেছিলেন, রাজ্যের অনেক জায়গায় রাজনৈতিক কিংবা গ্রাম্য বিবাদে বোমাবাজি চলছে, ‘এনআইএ’ সেদিকে নজর না দিয়ে বর্ধমানের খাগড়াগড় নিয়ে এত ধরপাকড়, চিরুনি তল্লাশি করছে কেবলমাত্র এই কারণে যে অভিযুক্তরা সকলে মুসলমান।  

একথা ঠিক যে কেন্দ্রে তখন বিজেপির সরকার ছিলো বলেই NIA-কে আইইডি বিস্ফোরণের তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। তাই তদন্তের নির্দেশের পেছনে কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো কি ছিলো না তা নিয়ে তর্ক করার অবকাশ থাকতেই পারে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে NIA-কে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার যে প্রয়োজন ছিলো তা নিয়ে তর্ক করার জায়গা আর নেই। কারণ, ধৃত ব্যক্তিরা যে ওই বিস্ফোরণ কাণ্ড এবং জেএমবির সন্ত্রাসবাদী কার্যকলালের সঙ্গে যুক্ত ছিলো আদালতে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডে জঙ্গি-যোগ ও মাদ্রাসা-যোগের প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া গিয়েছিলো। সেই প্রমাণকে রাজিয়া বিবির ‘অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই’ উক্তি আরও দৃঢ় করলো। রাজিয়ার উক্তি আদালতের বিচার ও রায় নিয়েও আর কারও প্রশ্ন তোলার অবকশ রাখলো না।    

রাজিয়া অতীত ভুলতে চাই, নতুন করে বাঁচতে চাই, নতুন জীবন শুরু করতে চাই এবং তার সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতন মানুষ করতে চাই। তার মানে সে তার অতীতকে অস্বীকার করছে না, অকপটে তাকে স্বীকার করে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজিয়া তার অতীতকে ঘৃণাও করছে এবং সে চাই না তার অতীতের ছায়া যেন তার সন্তানদের স্পর্শ করে। এবার আমার জানতে চাওয়া রাজ্য সরকারের কাছে, এপিডিআর ও বন্দিমুক্তি কমিটির নেতাদের কাছে, মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতাদের কাছে এবং তৃণিমূলী বুদ্ধিজীবীদের কাছে, আপনারা তো সব ঝুটা ও চক্রান্ত বলে NIA – এর সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রাজিয়া ও বাকি সব জঙ্গিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন, এখন রাজিয়া বিবির স্বীকোরক্তিতে কি লজ্জা বোধ করছেন? আর একটা প্রশ্ন, রাজিয়া বিবি নতুন করে বাঁচতে ব্যাকুল, কিন্তু তারজন্য মুসলিম সমাজ তাকে কতটা সুযোগ দেবে সন্দেহ আছে, আপনারা কি তার পাশে দাঁড়াবেন? কোনো সন্দেহ নেই যে প্রশ্ন দুটোর কোনোটারই উত্তর আপনাদের কাছে নেই। তাই পরিশেষে বলি, রাজিয়ার কথাগুলো শোনার পর সেদিনের সেই জঘন্য মিথ্যাচারের জন্যে দেশবাসীর কাছে আপনাদের অন্তত ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিৎ। সৎসাহসের অভাবে যদি সেটা হয়তো পারবেন না। যদি না পারেন, তবে অন্তত নিজের বিবেকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী তো হতেই পারেন।  

Saturday, August 15, 2020

হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস বলি কি করে

Coronavirus disease COVID-19 infection medical with typography and copy space. New official name for Coronavirus disease named COVID-19, pandemic risk background vector illustration

আজ ভারতের চুয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। দেশজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে দিবসটি। যাদের উদযাপন করার কথা তারা তো করছেই, যাদের উদযাপন করার কোনো মানে হয় না তারাও করছে। যাদের উদযাপন করার কথা নয় তাদের একদল হুজুগে করছে, কিছু না জেনে বুঝেই করছে, সবাই করছে তাই করছে। একদল না করলে দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তাই করছে।

বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণ আজও অপ্রতিরোধ্য। দেশজুড়ে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে তখন ভারত বিশ্বের করোনা-পীড়িত দেশগুলির উপরের কাতারে উঠে গেছে, একেবারে তৃতীয় স্থানে, আর দৈনিক সংক্রমণের দিক থেকে তো একেবারে প্রথম স্থানে। সংক্রমণের সংখ্যা বিশ্বে ছাড়িয়েছে দু’ কোটি, ভারতে প্রায় পঁচিশ লক্ষ। করোনার মোট বলি সাড়ে সাত লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, তার মধ্যে ভারতেই অর্ধ লক্ষাধিক। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্য কোনো খবর আজ পর্যন্ত নেই। সুতরাং মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের সরকারগুলি নাকি যুদ্ধ করছে। প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন এ যুদ্ধ বিজয় আসবে ২১ দিনেই। সেই যুদ্ধের আজ ১১৩ দিন, যুদ্ধ জয়ের ক্ষীণ আলোর শিখাটুকুও দূরবিন দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।

যুদ্ধ জেতা যাবে কি করে? যুদ্ধ জেতার জন্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যূনতম পরিকাঠামো তো নেই কোথাও।  ফলে করোনা রোগীরা সবাই হাসপাতালের চিকিৎসা পাচ্ছে না, যারা হাসপাতাল পাচ্ছে সুচিকিৎআ পাচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতাল তো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে রোজ। চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত পিপিই কিট পাচ্ছেন না, ফলে তাদেরও মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যচেতনা স্তর তো একেবারেই তলানিতে। বিশ্বে প্রতিদিন দশ হাজার এবং ভারতে এক হাজার লোক মরছে। তবু মানুষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখে মাস্ক পরা ও দুরত্ব-বিধি মানার মানার বালাই নেই। স্বাস্থ্যচেতনা নেই, কিন্তু ধর্ম পালন করার চেতনা ষোল আনায় বিশ আনা। দলবেঁধে ঈদের নামাজ পড়া চাই, কুরবানির নামে পশু হত্যা করা চাই-ই চাই! মন্দিরে পূজো দেওয়া চাই-ই চাই! এই হচ্ছে মানুষের চেতনার স্তরের লজ্জাজনক দৈন্যতা।         

যারা করোনা-যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাঁরা (প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী) তাঁদের চেতনাস্তরের দৈন্যতাও লজ্জাজনক। করোনা-যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী ছুটছেন রাম মন্দিরের শিল্যানাস করতে, ফলে বিজেপির নেতা-কর্মীরা দুরত্ব-বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশজুড়ে মেতে উঠলো সেই আনন্দে। এটাই তো হবার কথা ছিলো যা প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানতেন। জেনেও করলেন দুটো কারণে – নিজের নামকে ইতিহাসে খোদায় করার জন্যে, আর হিন্দু ভোটব্যাংক স্ফীত করার জন্যে। জনগণের স্বার্থকে বলি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাধান্য দিলেন দলীয় স্বার্থকে।    

 COVID-19 Pandemic Coronavirus Woman in city street wearing face mask protective for spreading of disease virus SARS-CoV-2. Girl with protective mask on face against Coronavirus Disease 2019.

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় ভেবেলেন যে তিনি একাই এ যুদ্ধ জিতে যাবেন এবং সেই সাফল্য দিয়েই একুশের ভোটে বাজিমাত করবেন! তাই বিরোধীদের কাউকে ডাকলেন না,  বিরোধিরা পথে নামলেও তাদের পথ আটকে দিলেন পুলিশ দিয়ে। ফলে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে তাঁর সরকারও চূড়ান্ত ব্যর্থ। প্রাথমিক পর্যায়ে একদিনে দু’ চার দশটা সংক্রমণ হতো, সেটা তিন হাজারের গণ্ডি টপকেছে। আগে মরেছে দু’চার দিনে একটা, এখন মরেছে পঞ্চাশ/ষাট জন। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবাও আক্ষরিক অর্থেই বেহাল।  

করোনা সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে মানব সমাজ ও মানব সভ্যতা আজ গভীর এক সংকটে। সংকটে আমাদের দেশ, সংকটে আমাদের রাজ্য, সংকটে মানুষ। প্রতিদিন দশ/বারো হাজার লোক মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিদিন মরছে এক হাজার করে। মৃত্যু, মৃত্যু, আর মৃত্যু, শুধু মৃত্যুর খবর চারিদিকে। প্রিয়জন হারানোর শোকে চারিদিকে শুধুই আর্তনাদ আর হাহাকার। গোটা পৃথিবিটাই যেন একটা মৃত্যু পুরী। এই মৃত্যু পুরীতে বাস কয়রে ১৫ই আগস্টকে আর পাঁচটা দিনের থেকে আলদা বলে আমার একদম মনে হয়ে না। আজ স্বাধীনতা দিবস বলে করোনা আমাদের রেহাই দেয় নি। তাই স্বাধীনতা দিবস বলে আজকের দিনটাতে আমি হ্যাপি হই কি করে? হ্যাপি থাকি কি করে? কি করেই বা বলি হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস? যারা আমাকে “হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস” (Happy Independence Day) জানিয়েছেন তাদের সবিনয়ে জানাই, না, আমি হ্যাপি নই, একদম হ্যাপি নই।

১৫ই আগস্ট’ ২০২০

Friday, August 14, 2020

প্রসঙ্গঃ ব্যাঙ্গালোরে মুসলিম জনতার হিংসাত্মক প্রতিবাদ

 

গত রাত্রে (১২ই আগষ্ট রাত্রে) একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ব্যাপক হিংসা ছড়ায় ব্যাঙ্গালোরে। পোস্টটিতে ইসলামের প্রবর্তকের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু কথা লেখা আছে বলে অভিযোগ। নবীন নামের যার পোস্টকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি ঘটেছে সে কংগ্রেস বিধায়ক আখণ্ড শ্রীনিবাস মূর্তির ভাগ্নে। পোস্টটি প্রচারিত হওয়ার পরেই হাজার খানেক উশৃঙ্খল মুসলিম জনতা কংগ্রেস বিধায়কের বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। তারপর তারা বিধায়কের বাড়ি ভাঙচুর করার লক্ষ্যে ব্যাপক ইট ও পাথর ছোঁড়ে যার ফলে বিধায়কের বাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলাকারীরা বিধায়কের বাড়ির নিরীহ নিরাপত্তা কর্মীকেও তারা বেধড়ক মারধর করে। বিধায়কের বাড়ির আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলি ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। হিংসার খবর পেয়ে ডিজে হাল্লি ও কেজি হাল্লির পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে উশৃঙ্খল জনতা তাদের উপরে চড়াও হয় এবং তাদের লক্ষ্য করে ইট ও পাথর বৃষ্টি শুরু করে। তারপর তারা ডিজে হাল্লি থানায় চড়াও হয় এবং থানায় ব্যাপক ভাঙচুর করে। থানার ভিতর এবং আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলিও ভাঙচুর করে আগুনে ভষ্মিভূত করে দেয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরাও আক্রমণের হাত থেকে রেহায় পায় নি।    

 Bangalore Violence

জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে, তারপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে এবং শূন্যে কয়েক রাউণ্ড গুলি চালায়। তাতেও উন্মত্ত জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জনতা-পুলিশ সংঘর্ষে ষাট জন পুলিশ আহত হয়েছে যার মধ্যে এ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনারও আছেন,   এ কথা জানিয়েছেন ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার কমল পন্ত। খবরে প্রকাশ যে ঘটনাস্থলে থেকে ২০০/২৫০ জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে বলে অভিযোগ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে যে ডিজে হাল্লি ও কেজি হাল্লি অঞ্চলে কারফিউ এবং ব্যাঙ্গালোরের ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। হিংসাত্মক ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গণতন্ত্রের লেবাস পরা মুসলিম রাজনৈতিক দল এসডিপিআইও (Social Democratic Party of India)। এটা স্পষ্ট হয়েছে কারণ ধৃতদের মধ্যে মুজামিল পাশা নামে ওই দলের একজন নেতাও রয়েছেন। এ কথা জানিয়েছেন ঐ দলেরই নেতা মুজাহিদ পাশা।

ফেসবুকে ঠিক কী লেখা হয়েছে সেটা জানা যায় নি। সেটা জানার বিশেষ দরকারও নেই। কারণ, ভারত  একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এ দেশে বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত যদিও তা বহুলাংশেই খণ্ডিত। তাই ফেসবুকে আপত্তিকর কিছু লেখা থাকলেও এখানে কেহই আইন হাতে তুলে নিতে পারে না, সে অধিকার সংবিধান কাউকে দেয় নি। ফেসবুকের কোনো পোস্ট যদি কোনো সম্প্রদায়ের কাছে আপত্তিকর মনে হয় তবে তার প্রতিবাদ করার অধিকার তাদের নিশ্চয়ই আছে যেটা করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে। ফেসবুকের পোস্ট কিংবা অন্য মিডিয়ায় কোনো লেখা বা মন্তব্য যদি দেশের আইন লংঘন করে তবে তার বিচার করার ভার আদালতের, কোনো ব্যক্তির বা সম্প্রদায়ের নয়। এরূপ ক্ষেত্রে সব চেয়ে ভালো হচ্ছে লেখার মাধ্যমেই প্রতিবাদ করা। তাছাড়া মিছিল, মিটিং, ধরনা ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারের কাছে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানানোর রাস্তা খোলা রয়েছে। সরকারের উপর ভরসা না থাকলে আদালত রয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদের নামে আইন হাত

তুলে নেওয়া কিংবা হিংসাত্মক প্রতিবাদ করা সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরণের প্রতিবাদ করা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।   

তাছাড়া আরও দুটো বিষয় খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী। যেমন - এক). কেউ যদি অপরাধ করে তবে তার দায় শুধু তারই, তার কোনো আত্মীয়ের নয়। অথচ উশৃঙ্খল জনতা যে অভিযুক্ত তার মামার বাড়ি ভাঙচুর করলো। মামাকে দায়ী করা কেন? এহেন ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। কর্তব্যরত সাংবাদিকদের উপরেও হামলা হলো। পুলিশ গিয়েছিলো হিংস্র জনতার তাণ্ডবের হাত থেকে বিধায়কের বাড়ি এবং তাঁর পরিবারের লোকজনদের রক্ষা করতে। কিন্তু তাদের ওপরেও হামলা সংগঠিত করা হলো। এটা কি মগের মুলুক নাকি? এসব গুণ্ডামি কি গণতন্ত্রে মানা যায়? দুই). অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বলেছে যে ঐ পোস্টটি সে করে নি। তার ফেসবুক এ্যাকাউণ্ট হ্যাক করে অন্য কেউ ওটা করেছে। সে সত্য না মিথ্যা বলছে তার তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্ত না করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আত্মরক্ষা করার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। সে সুযোগ তারও প্রাপ্য। এটা গণতান্ত্রিক আইন ও রীতি যা সকলকেই মানতে হবে।  

কলমের জবাব কলমে দেওয়া বাঞ্ছনীয়, হিংস্রতা দিয়ে নয়  

সারা বিশ্ব জুড়েই মুসলিমদের মধ্যে একটা বিশেষ প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো – তাদের মধ্যে সহনশীলতার প্রচণ্ড অভাব। এক্ষেত্রে জঙ্গি মুসলমান এবং অজঙ্গি মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। ইসলামের সামান্য সমালোচনাও তারা শুনতে চায় না। বিশ্বের যে প্রান্তেই তা হোক না, মুসলিমরা বিশ্বজুড়েই তার প্রতিবাদে হিংসায় মেতে ওঠে। ভাঙচুর, লুটপাট, ও হত্যা ইত্যাদি হিংসাত্মক কাজের মাধ্যমে তারা প্রতিবাদ জানায়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা স্মরণ করতে পারি ফ্রান্সের শার্লি এব্দু (কার্টুন পত্রিকা) অফিসে মুসলিম জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনাট। ইসলামের নবীর একটা কার্টুন আঁকার জন্যে ঐ পত্রিকার কয়েকজন কার্টুনিস্টকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো। নবীর কার্টুন আঁকার জন্যে আমরা কলকাতার রাস্তাতেও মুসলিমদের দিনভোর তাণ্ডব দেখেছি। সার্টানিক ভার্সেস লেখার জন্যে সলমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়ার কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। ফতোয়া দিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি। সেই ফতোয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো তামাম বিশ্বের মুসলিম সমাজ। তখন তাদের মধ্যে শিয়া-সুন্নির প্রভেদ মুছে গিয়েছিলো। তসলিমা নাসরিনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে আমরা দেখেছি। এ প্রসঙ্গে একটি অতি তুচ্ছ সমালোচনার চরম শাস্তির একটি দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করতে চাই। সালটা সম্ভবত ২০০৫। কলকাতার শহরতলীর আক্রা হাই মাদ্রাসার একজন মুসলিম শিক্ষক একটি ঈদ সংখ্যার ম্যাগাজিনে একটা নিবন্ধে দু’টো প্রশ্ন রেখেছিলেন। তার একটি হলো, একই বিষয়ে বিজ্ঞান ও কোরান ভিন্ন কথা বললে কোনটা গ্রহণ করবো? দ্বিতীয় প্রশ্নটি এরূপ, মুসলমানদের দাবি হলো তাদের নবী হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন ছিল, নবী তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে কি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বলা যায়? এই দু’টি মামুলি প্রশ্ন তোলার জন্যে মুফতিরা তাঁকে মোরতাদ ঘোষণা করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিয়েছিলো। সেই ফতোয়া কার্যকর করার জন্যে মুসলিমরা দল বেঁধে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি।

এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক শুধু মোল্লা-মুফতিরাই নয়, এই সংস্কৃতির বাহক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজও। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কিংবা নবীর সমালোচনা হলে তার প্রতিবাদে যে মুসলিমরা রাস্তায় নেমে যে হিংসাত্মক আচরণ করে তার পুরোভাগে থাকে উচ্চ শিক্ষিত মুসলিমরাও। মুসলিমরা বহুদিন থেকেই মাদ্রাসার শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাকে আদর্শ জ্ঞানে এ শিক্ষা গ্রহণ করে বলে মনে হয় না। আসলে ইসলামের আদর্শকে বুকে আগলে রেখেই মুসলিম অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কেরিয়ারের কথা ভেবে আধুনিক শিক্ষার স্কুলে পাঠায়। কিন্তু বাড়িতে চালু থাকে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা। ফলে মুসলিম সমাজের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষা অর্জন করলেও আধুনিক যুগের উন্নত আদর্শ ও সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করতে পারে না। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়। ইসলামের ধর্মগ্রন্থে ভিন্ন ধর্মের নবী, দেব-দেবী ও মানুষদের বিরুদ্ধে যে কঠিন সমালোচনাগুলি রয়েছে, শিক্ষিত মুসলিমরা মনে করে যে সে সমালোচনাগুলি ন্যায়সঙ্গত এবং তা করার তাদের অধিকার আছে। কিন্তু তারাই আবার এ মনে করে যে, তাদের ধর্ম ও নবীর বিরুদ্ধে কারও সমালোচনা করার অধিকার নেই। সেই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই মুসলিমরা ব্যাঙ্গালোরে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো।  

আমরা সমালোচনা করবো, কিন্তু কারো সমালোচনা আমরা শুনবো না – এটা মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কৃতি। গণতন্ত্রের যুগে সেই সংস্কৃতি আঁকড়ে থাকা চলে না – এ কথা বুঝতে হবে মুসলিম সমাজকে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। ইসলামের সমালোচনার জবাব অস্ত্র ও হিংসা দিয়ে নয়, দিতে হবে কলমের সাহায্যে। এটাই এ যুগের বৈশিষ্ট তা তাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে, সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্যে এই বৈশিষ্টটা সবাইকে মানতে হবে, মানতে হবে মুসলিম সমাজকেও।   

এটা গভীর দুঃখজনক ঘটনা যে মুসলিম সমাজ আজও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে বুঁদ হয়ে রয়েছে। এই জমাট বাঁধা চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যেও আশার একটু ক্ষীণ আলো দেখালেন ব্যাঙ্গালোরের কংগেসের প্রাক্তন মন্ত্রী বি. জেড জামির খান। তিনি ক্রুদ্ধ মুসলিম জনতার হিংসাত্মক কার্যকলাপকে আড়াল করেন নি। এমনকি পুলিশের গুলি চালনারও নিন্দা করেন নি। উল্টে যারা হিংসাত্মক আচরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন এবং মুসলিমদের শান্ত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এটাই তো কাম্য।           

মেকি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতা এবং বিদ্বজনদের নেতিবাচক ভূমিকা  

ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তিয়াত্তর বছর ধরে এ দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলন হচ্ছে (অবশ্য সততার সঙ্গে হচ্ছে এমন বলা যাবে না)। কিন্তু খুবই উদ্বেগের বিষয় হলো মুসলিম সমাজকে সেই চর্চা ও অনুশীলনে আজও সামিল হতে তেমন দেখা যাচ্ছে না। এর জন্যে নিশ্চয়ই প্রধানত মুসলিম সমাজই দায়ী। কিন্তু আমি মনে করি না যে এর দায় শুধু তাদেরই। অনেকখানি দায় বর্তায় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির উপরেও। দায় বর্তায় বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনদেরও যাঁরা  গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। এটা বলছি এ জন্যে যে, মুসলিমরা যখনই তাদের ধর্মের সমালোচনায় কাতর হয়ে উন্মত্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে তখন রাজনৈতিক দলগুলি এবং বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনরা কেউই তাদের নিন্দা ও সমালোচনা করে না। অসাম্প্রদায়িক সরকারগুলি হিংসাশ্রয়ী জনতার বিরুদ্ধে কোনো কড়া পদক্ষেপ করে না। বরং তাদের প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে এবং দুষ্কৃতিদের শাস্তি দেবার বদলে আড়াল করে। প্রশ্রয় দেয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ও বুদ্ধিজীবী সমাজও। হিংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা তো করেই না, ঘুরিয়ে যারা ইসলামের করে তাদের বিরুদ্ধেই কড়া সমালোচনায় মুখর হয়। বলে যে, বাক-স্বাধীনতার নামে মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া মানা যায় না। সরকার, বিরোধী দল ও বুদ্ধিজীবী সমাজের নিরন্তর এরূপ প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও মদতই মুসলিমদের আজও অসহিষ্ণু থেকে যাওয়ার জন্যে বহুলাংশেই দায়ী।   

বিজেপি সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা

হিন্দু ধর্মে ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানোর কথা নেই। হিংসা ও ঘৃণার কথা যা বলা আছে তা হিন্দুদের নিম্ন বর্ণের বিরুদ্ধে। অথচ বিজেপিকে দেখা যাচ্ছে মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা ছড়াতে। মুসলিমরা মুসলিম দেশগুলিতে যা করে তারাও সেরূপ আচরণ করছে।  নিরীহ মুসলিমদের জোর করে জয় শ্রীরাম বলাচ্ছে, না বললে মারধর করছে। গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে, এমনকি হত্যাও করছে। গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে কয়েকটি রাজ্যে। এভাবে তারা তাদের খাদ্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাই অহিন্দুদের উপর। চাপানোর চেষ্টা করছে হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা সহ তাদের হিন্দু সংস্কৃতিও। তারা এক কথায় মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এসবই গণতন্ত্র এ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। বিজেপির সেই ধারাকেই অনুসরণ করতে চেয়ে একটি বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপির সরকার মুসলিমদের গত রাত্রের হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের  ঘটনায় বাইক ও মোটর গাড়ি সহ যে সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে হিংসাত্মক ঘটনার সাথে যারা যুক্ত তাদের কাছ থেকে। এই পদক্ষেপটি বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনিতি থেকে উদ্ভুত। গণতন্ত্রে এরূপ হওয়া অবাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত জানাই যে, হিংসাশ্রয়ী জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালানোর সমালোচনা আমি করছি না।   ১৩.৮.২০   

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...