Wednesday, July 8, 2020

ঈশ্বরবিশ্বাসীরা বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে বিজ্ঞানের ওপরেই ছড়ি ঘোরাতে চায়


বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে অহিনকুল সম্পর্ক। যেহেতু ধর্মবিশ্বাসের মূল ভিত্তি ঈশ্বরের প্রতি অন্ধবিশ্বাস, তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে অহিনকুল সম্পর্ক ঈশ্বরবিশ্বাসী তথা ধর্মবিশ্বাসীদেরও। এটা সকল ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল ধর্মবিশ্বাসী তথা ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যেমন অহিনকুল সম্পর্ক বিদ্যমান ঠিক তেমনই সম্পর্ক দর্শন ও ধর্মের মধ্যেও। যুক্তিবাদী দার্শনিক সক্রেটিস ও ব্রুনোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো ধর্মবিশ্বাসীরা। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মবিশ্বাসীদের হাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে গ্যালিলিওর নাম উল্লেখযোগ্য। শুধু খৃষ্টধর্মবিশ্বাসীদের হাতেই নয়, বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী দার্শনিকদের ওপর নির্মম ও নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের অনেক খলিফাও। আজও ইসলামে বিশ্বাসীরা সারা বিশ্বে যুক্তিবাদীদের উপর নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। হিন্দুধর্ম সহ অন্যান্য ধর্মের ধর্মবিশ্বাসীরাও একই কুকর্ম করেছে ও করে চলেছে। সে সবের দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখাটির কলেবর অহেতুক বাড়াতে চাই না কারণ সেটা আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নয়। প্রতিপাদ্য লেখাটির শিরনামেই উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটির ভূমিকা করার একান্ত প্রয়োজনে উপরের কয়েকটি কথা বলতে হলো। এবার লেখার মূল প্রতিপাদ্যে যাওয়া যাক।
আমাদের দেশে (ভারতে) বহু ধর্মের মানুষের বসবাস। তবে এখানে প্রধানত  হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মানুষরাই বাস করে। বিজ্ঞানের কাঁধে পা রেখে বিজ্ঞানের ওপরেই লাঠি ঘোরানোর অপকর্মটি করতে হিন্দুধর্মবিশ্বাসিরাও বিশেষ পারদর্শী, তবে আমি এখানে আলোচনা করবো মূলত ইসলামবিশ্বাসিদের নিয়েই। গতকাল (৮ই জুলাই) ফেসবুকে একজন মুসলিম ডাক্তার বাবুর একটা বেশ লম্বা পোস্ট পড়লাম। মূলত সেই পোস্টের ওপরেই এই লেখাটি। লেখাটির মূল বিষয় হলো উপবাস থাকলে ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের কতোটা উপকার হয়। এই নিয়ম অনুসরণ করলে মেদ ও ওজন দুইই কমে, শরীর নীরোগ হয় ও থাকে, মানুষ দীর্ঘজীবি হয় এবং মানুষের যৌবনও দীর্ঘস্থায়ী হয়। ডাক্তার বাবু বলেছেন এটা উপলব্ধ হয়েছে বা পাওয়া গেছে বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের গবেষণায়। পোস্টের তথা ডাক্তার বাবুর মূল বক্তব্য নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়।  উপবাস থাকা নিয়ে। ঠিক কতক্ষণ উপবাস থাকতে হবে সে কথা তিনি উল্লেখ করেন নি তাঁর দীর্ঘ স্টেটাসে। এটা অনুল্লেখ করেছেন বোধ হয় তাঁর পেশাগত স্বার্থে। আমার ধারণা উপবাস শব্দটি বারবার উল্লেখ করেছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেটা স্পষ্ট হয়েছে যেহেতু উপবাসে থাকার আবশ্যকতার কথা বলতে গিয়ে রমজান মাসের রোযার কথাও বার কয়েক বলেছেন। রোযা রাখলে যে মেদ কমে, ওজন কমে ও শরীর রোগমুক্ত হয় ও থাকে সে কথাও তিনি জানিয়েছেন। 
উপবাস কতক্ষণ থাকতে হবে সে কথা তাঁর লেখায় নেই, কিন্তু তাঁর বলা উপবাস থাকার অর্থটা কী তা আমি জেনেছি তাঁর খাদ্যবিধি অনুসরণ করছে এমন একজনের কাছ থেকে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ বা  নির্দেশিকা অনুসারে একজন মানুষ সারা দিনে মাত্র দু’বার খাদ্য গ্রহণ করবে - দুপুর দুটায় ও সন্ধ্যা সাত/সাড়ে সাতটায়, অবশ্য তার সঙ্গে আছে সকালে এক কাপ র’চা। বলা বাহুল্য যে খাদ্য তালিকায় কী কী থাকবে এবং কী কী রাখা যাবে না তাও থাকে সবিস্তারে। এই খাদ্যবিধি অনুযায়ী সকালে (ধরা যাক সকাল ছ’টা) এক কাপ চা খাবার পর আট ঘণ্টা এবং দুপুরে খাবার পর পাঁচ/সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে। এটাকে নিশ্চয় উপবাস বলা যায় না। তবুও তিনি এটাকেই উপবাসে থাকা বা উপবাস করা বুঝিয়েছেন। তবু তিনি এটাকে উপবাস বলেছেন। লম্বা কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকাকে তাঁকে উপবাসই বলতে হয়েছে। কারণ ‘উপবাস’ না বললে তো রোযাকে টেনে এনে যায় না, রোযাকে  মহান করে দেখানোও যায় না আর প্রমাণও করা যায় না যে রোযা রাখা অবশ্যই একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা। কিন্তু সারা দিন উপবাস থেকে রোযা রাখা তো অবৈনাজ্ঞিক প্রথা এবং শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। কেন তা স্পষ্ট হবে এর পরের আলোচনায়। 
হিন্দুধর্মবিশ্বাসীদের উপবাসে থাকার রীতিনীতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ঢুকবো না, আমার আলোচনা সীমাবাদ্ধ রাখবো রোযা রাখার বিষয়েই। কারণ ডাক্তার বাবু তো কেবল ইসলামের রোযা রাখার কথাই বলেছেন, হিন্দুদের উপবাসে থাকার কথা  বলেন নি। মানুষ সাধারণত দিনের মধ্যে বারবার খায় এবং খাদ্যাভাসে ও খাদ্য তলিকায় কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ প্রায় রাখেই না বললেই চলে। এর ফলে অবশ্যই মানুষের মেদ ও ওজন দুইই বাড়ে যা শরীরে নানা অসুখ ডেকে নিয়ে আসে এবং বহু মানুষ অকালেই মারা যায়। এর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে চিকিৎসক ও ডায়েটিসিয়ানরা মানুষের খাদ্যাভাস ও খাদ্য তালিকা দু’টোতেই পরিবর্তন আনতে বলেন এবং নিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে বলেন। চিকিৎসক ও ডায়েটিসিয়ানদের এই পরামর্শও যে বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে সঞ্জাত তা বলা বাহুল্য। ওপরে উল্লেখিত ফেসবুক পোস্টে মুসলিম ডাক্তার বাবু যা বলেছেন তাও বিজ্ঞানের গবেশণালব্ধ জ্ঞান বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য সেটা একটু অন্যভাবে বলেছেন। ডায়েটিসিয়ানগণ যেভাবে খাদ্যবিধির পরামর্শ বা নির্দেশ দেন তা থেকে অনেকটাই আলাদা তাঁর দেওয়া খাদ্যবিধি। পার্থক্যটা কোথায় তা নিয়ে শব্দ খরচ করতে চাই না, কারণ সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এ আলোচনায়। তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে যে রমজানের উপবাসকে মেলানো যায় না আমার আলোচনা মূলত তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
রমজানের রোযা বা উপবাস সম্পর্কে কিছু কথা বলা এখন অত্যন্ত জরুরী। এ বিষয়ে প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে দেওয়া একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, রমজান মাসে রোযা রাখার প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন কালে ইসলামের আগমনের বহুকাল পূর্বেই। ইহুদিরাও রোযা রাখতো। শুধু ইহুদিরাই নয়, রোযা রাখার প্রথা ছিলো আরবে অইহুদি অন্যান্য উপজাতি গোষ্টীর মধ্যেও। মুহাম্মদও নিজেকে নবী বলে দাবী করার পূর্বে রোযা রাখতেন। অর্থাৎ এটা ইসলামের সৃষ্টি করা ধর্মীয় প্রথা নয়। মুহাম্মদ পরে রোযা রাখার প্রাচীন প্রথাটির ইসলামীকরণ করেছেন মাত্র। কিন্তু মুসলিমদের বিশ্বাস (অমুসলিমদের অনেকেরও) যে রমজান মাসে রোযা রাখার স্বর্গীয় বিধান ঈশ্বর সর্বপ্রথম মুহাম্মদের কাছেই পাঠায়। সেজন্যেই সম্ভবতঃ রমজানের রোযা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অপার গর্ব ও অহংকার। উক্ত ডাক্তার বাবু শরীর থেকে মেদ ঝরিয়ে শরীরকে মেদহীন ও রোগমুক্ত করার জন্যে উপবাস করতে তথা রোযা রাখতে (আসলে প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার) যে পরামর্শ দিয়েছেন তার পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটা হলো এই যে, তিনি সম্ভবত প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বিজ্ঞান এখন যে কথা বলছে ইসলাম তা চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। অর্থাৎ ইসলাম প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যে কথা বলেছে বিজ্ঞানীরা এতদিনে সে কথা বলছেন। এ কথা বলে তিনি বোধ হয় এক ঢিলে দু’টো পাখি মারতে চেয়েছেন – এক). একমাস ধরে রোযা রাখা একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা এবং দুই. বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামকে বিজ্ঞানের উপরে স্থাপন করা। কিন্তু নির্মম সত্যিটা হলো এই যে, ডাক্তার বাবু বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত যে খাদ্যাভাস ও খাদ্যরীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তার সঙ্গে রমজানের রোযা রাখার তুলনা টানাই যায় না। কারণ দুটো জিনিষ সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন প্রকৃতির। তা ছাড়া একমাস ধরে একমাস রোযা রাখা একটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথাও বটে। কেন তা বুঝতে হলে রমজান মাসে রোযা রাখার ধর্মীয় বিধিগুলি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। তাই এসব বিষয়ে আমদের অবহিত থাকা একান্তই আবশ্যক।    
প্রথমে বলা যাক রোযার বিধিমালা সংক্রান্ত কিছু কথা। সেই বিধিমালায় রয়েছে বছরের সে সময়েই রোযা আসুক না কেন রোযাদারকে অবস্থায় সূর্যোদয়ের কিছু পূর্ব মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলেও একফোঁটা জল পান করা যাবে না। কেউ ভুল করেও তা করলে তার রোযা ভেঙে যাবে। রোযাব্রত অবস্থায় যৌনতা নিষিদ্ধ। কেউ রাত্রে যৌন সংসর্গ করলে তাকে শেহরি করার (রোযা করার জন্যে খাদ্য গ্রহণ) পূর্বেই গোসল (স্নান) করতে হবে। অর্থাৎ ইসলামী মতে রমজান মাসে যৌনতা একটি অপবিত্র ও ঘৃণ্য কাজ। অথচ ইসলামই স্বর্গবাসীদের জন্যে যৌনতার এলাহি ব্যবস্থা রেখেছে। রোযাব্রত অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা, অধিক মুনাফা করা, চুরি-দুর্নীতি ও ডাকাতি-রাহাজানি করা, নারীর প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করা – এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলির কোনো একটি করলে রোযা ভেঙে যায়। ইসলাম বলেছে রমজান মাসে নারীর ঋতুস্রাব হলে রোযা করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ নারীর ঋতুস্রাব একটি জঘন্য ও চরম অপবিত্র ব্যবস্থা। ইসলামের চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালী বলেছেন ঋতুস্রাব সহ কিছু অবাঞ্ছিত ও অপবিত্র কাজের জন্য আল্লাহ নারীকে নানাবিধ শাস্তি প্রদান করেছে। যেমন, নারীকে বিয়ের পর নিজের সব কিছু পরিত্যাগ করে একটা সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে (স্বামীর বাড়িতে) যেতে হয়, স্বামীর অধীনে থেকে তার সর্বপ্রকার সেবা করতে হয়, গর্ভধারণ ও তীব্র প্রসবযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখা ও নামাজ পড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। যে যে কারণে রোযা ভেঙে যায় তার কোনোটার কারণেই মুসলিম ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞানস্মমত খাদ্যবিধি লঙ্ঘিত হয় না। তাঁর খাদ্যবিধিমালায় তো বারবার জল খেতে এবং দিনে ন্যূনতম দু’বার প্রধান খাদ্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তিনি যে খাদ্যবিধি অনুসরণ করতে বলেন তাকে উপবাস বলা যায় না, রোযা রাখা তো কোনো ভাবেই বলা যায় না। মুসলিমদের রোযা রাখার মূল উদ্দেশ্য কী সেটা এবার দেখা যাক। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা দাবি করেন যে, সততা অনুশীলন করা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা, দরিদ্র মানুষকে দান করা ইত্যাদি কিছু ভালো কাজ করার অভ্যাস করা হলো রমজান মাসে রোযা রাখার উদ্দেশ্য। আর রমজানের রোযা রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নরকের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ ও বেহেস্ত লাভ করা। সুতরাং উদ্দেশ্যের দিক বিবেচনায় রাখলেও ঐ ডাক্তার বাবুর খাদ্যবিধি অনুসরণ করাকে তথা ডায়েটিং করাকে কোনোভাবেই রোযা রাখার সঙ্গে মেলানো যায় মা। এবার আলোচনা করা যাক কেন রোযা রাখা শরীরের পক্ষে হানিকর।
ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে রোযা যে মাসেই পড়ুক না কেন রোযাব্রতকারীকে সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাস করতে হয়। ধরা যাক এই সময়ে অর্থাৎ ইংরাজী ক্যালেণ্ডারের জুলাই মাসে রমজান মাস শুরু হলো। এই সময়ে দিন যতই দীর্ঘ হোক না কেন সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরো দিনটাই উপবাস উদযাপন করতে হবে, একফোঁটা জল পর্যন্ত পান করা যাবে না। এবার পৃথিবীর কয়েকটি দেশের দিকে চোখ রেখে দেখা যাক সে সব দেশের রাজধানীতে জুলাই মাসে দিনের দৈর্ঘ কতটা।দেখা ও বোঝার সুবিধার্থে নীচে একটা সারণী দেওয়া হলো –
দেশ          সূর্যোদয়ের সময়       সূর্যাস্তের সময়      দিনের দৈর্ঘ
সুইডেন         ৩-৪৮ এ.এম        ৯-৫৭ পি.এম      ১৮ ঘ. ০৯ মি. 
নরওয়ে        ৪-১১ এ.এম          ১০-৩২ পি.এম     ১৮ ঘ. ২১ মি. 
নেদারল্যাণ্ড    ৫-৩০ এ.এম       ১০-০১ পি.এম     ১৬ ঘ. ৩১ মি.
জার্মানি        ৪-৫৫ এ.এম          ৯-২৮ পি.এম      ১৭ ঘ. ২৭ মি.
গ্রীনল্যাণ্ড      ৩-২৪ এ.এম          ১১-৪১ পি.এম     ২০ ঘ. ১৭ মি.
ফেয়ারব্যাংক ২-৫৭ এ.এম        ১২-৪৭ এ.এম        ২১ ঘ. ৫০ মি. 
(ফেয়ারব্যাংক  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত) 

ওপরের চিত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে যে জুলাই মাসে রোযা যারা রাখবে তাদের সুইডেনে প্রায় সওয়া আঠারো ঘ., নরওয়েতে সাড়ে আঠারো ঘ., নেদারল্যাণ্ডে সাড়ে ষোলো ঘ., জার্মানিতে সাড়ে সতেরো ঘ. এবং গ্রিনল্যান্ডে প্রায় সাড়ে কুড়ি ঘ. উপবাস করতে হবে। একমাস ধরে দিনের মধ্যে এতো লম্বা সময় নির্জলা উপবাস করলে শরীরে কী পরিমাণ জলের ঘাটতি (কী মারাত্মক ডিহাইড্রেশন) হতে পারে এবং তার ফলে কিডনি কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তাছাড়া একজন মানুষ ১৮/২০ ঘণ্টা কোনো খাদ্য গ্রহণ না করলে সেই সময়ে তার শরীরে শক্তি উৎপাদিত হয়  না একদম।একমাস রোযা রাখলে একজন মানুষের শরীর প্রায় জলশূন্য ও শক্তিশূন্য হয়ে পড়বে। এবার ভাবুন ফেয়ারব্যাক অঞ্চলের মুসলিমদের কথা। তাদের রোযার নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাইশ ঘণ্টা। আমার মনে হয় একমাস তারা রোযা রাখলে তাদের জীবনী শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুতরাং রমজান মাসে রোযাব্রত পালন করা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। মুসলিমদের যারা রমজান মাসের রোযার জন্যে নিজেদের ধন্য ও অপরিসীম গর্বিত মনে করেন তাদের আর একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ফেয়ারব্যাংকের মুসলিমদের রমজান মাসে রোযা এপ্তার (রোযা ভঙ্গ) করার পর রাতের যে খাবার খায় (ধরা যাক রাত্রি সাড়ে দশটা) তারপর  প্রাক প্রত্যুষে (বারোটা ত্রিশ মিনিটে) সূর্যোদয়ের পূর্বে খাদ্য গ্রহণ করার আগে হাতে সময় থাকে মাত্র দু’ঘণ্টা। দু’ঘণ্টায় বড়ো জোর দু’খানা বিস্কুট ও একগ্লাস জল খাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সেয়ারব্যাংকের মুসলমানরা রোযা রাখার সময় চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একবার জল ও খাদ্য খাওয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং রোযা রাখাটা শুধু শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকরই নয়, খাবার সময় বিন্যাসটাও (সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পরে) সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। 
প্রবন্ধের গোঁড়াতেই বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু, বলা ভালো, জাতশত্রু হলো বিজ্ঞান ও দর্শন। হবেই না বা কেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরাই তো সমস্ত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সকল অসত্য, অর্ধসত্য, অসততা ও প্রতারণাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে নির্মমভাবে। ধরা যাক ইসলাম ধর্মেরই কথা। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান বিশ্ব-মহাবিশ্ব, আকাশ-মহাকাশ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি, বৃষ্টি-বন্যা-খরা, আহ্নিক গতি–বার্ষিক গতি,  ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প-সুনামি, প্রাণের সৃষ্টি, ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা যা বলেছে তার সবটাই যে ভিত্তিহীন, আজগুবি ও মিথ্যেই ঠাসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা। কোরান বলেছে বিশ্ব ও মহাবিশ্ব আল্লাহ সৃষ্টি করেছে সাত দিনে। এই সৃষ্টি তত্ত্ব যে একটা মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি তা মানুষ বুঝেছে বিজ্ঞানের দৌলতে। কোরান বলেছে আল্লাহর কুদরতে আমাদের মাথার উপর সাতটা আকাশ রয়েছে বিনা স্তম্ভেই। এই তত্ত্বটি যে ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারকের বুজরুকি সেটা ফাঁস করে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে, মহাকাশ মানে অন্তহীন মহাশূন্য, মহাকাশের পুরোটাই ফাঁকা। কোরান বলে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ হয় আল্লাহর হুকুমে (নির্দেশে)। এর রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। অথচ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ যে হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অকাট্যভাবে এবং বিজ্ঞানের দৌলতেই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখন অনায়াসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক’টার সময়) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে নিঃখুতভাবে যে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক'টার সময়) সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। বৃষ্টি-বন্যা-খরা ও ঝড়-তুফানও হয় নাকি আল্লাহর হুকুমে। কোরান আরও বলেছে ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে আর মানুষের পক্ষে এসবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো সবই যে স্রেফ নির্জলা মিথ্যা দাবি এবং এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ও কীভাবে হয় তা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই আবহাওয়াবিদরা এখন ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের  আগাম পূর্বাভাষ দিতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরানের আজগুবি তত্ত্বকেও নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞান কেন ভূমিকম্প হয় তার রহস্য নিঃখুতভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্রের গভীরে ভূমিকম্প হলে সুনামি হয় সেটাও মানুষ জেনেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকেই। আরও অনেক বিষয় আছে সে সব ক্ষেত্রেও কোরান সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সকল বুজরুকির ধূম্রজাল ছিন্ন করে বিজ্ঞান মানুষের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরে মানবসমাজের সীমাহীন উপকার করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। মানুষের এই সহজ সরল বিশ্বাসকে ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকরা নির্মমভাবে শোষণ করে মানুষকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসী যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার। ধর্মই মানুষের মধ্যে বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ ও লিঙ্গবিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণেই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতে শিখেছে, মানুষ হিংসা করতে এবং হিংস্র ও অমানবিক হতে শিখেছে। যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসের মূলে কঠরভাবে ভাবে আঘাত হেনেছে এবং মানুষকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। যুক্তিবাদী দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান ও যুক্তির শাণিত তরবারি দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাসের ইস্পাতসম শক্ত বর্মকে (আবরণকে)  ফালা ফালা করে কেটে মুক্ত করেছে। কোরান-সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি যদি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তবে একটার সঙ্গে আর একটার অমিল ও বৈপরিত্য থাকে কেমনে – এই বৈধ প্রশ্ন তুলেছে যুক্তিবাদীরা। কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ কেন সরল ও সৎ পথ দেখানোর জন্যে প্রার্থনা করে  (কোরানের ফাতেহা সুরা দেখুন)? আল্লাহ কার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহরও আল্লাহ আছে নাকি? আল্লাহ নাকি নিরাকার। তাহলে মানুষ কীভাবে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল (এটা আজানের মধ্যে রয়েছে)? আল্লাহর হুকুমে যদি ঝড়-বৃষ্টি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি হয় তবে মানুষ এগুলি সম্পর্কে আগাম খবর দেয় কেমন করে – এ প্রশ্নগুলি তুলেছে যুক্তিবাদীরা। আল্লাহর নবীর (দূতের) পক্ষে কি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও দত্তক-পুত্রবধূকে বিবাহ ইত্যাদি অশুভ কাজগুলি সম্পন্ন করা শোভা পায় – এ প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নবীতত্ত্বকে (theory of prophet-কে) প্রশ্নের মুখে খাড়া করে দিয়েছে। এ রকম হাজারো প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বররবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসিদের নাস্তানাবুদ করেছে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বরের দূত (নবী) ও ঈশ্বরের সৃষ্টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বকে অবাস্তব ও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে ও করে যাচ্ছে যুক্তিবাদীরা। তাই তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু ও জাতশত্রু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং দর্শন ও যুক্তিবাদীরা। 
ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবিশ্বাসীরা যেমন মিথ্যাচারিতায় তুলনাহীন, দ্বিচারিতাতেও তাদের তুলনা কেবল তারাই। ধর্মবিশ্বাসীরা অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতাবশে এই অপকর্মগুলি করে। কীরূপ মিথ্যাচারিতা করে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মগুরুরা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গোঁড়া থেকেই খড়্গহস্ত ছিল সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সনস্ত ধর্মের ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এখন দাবি করেন যে তাদের নিজেদের নিজ ধর্মসমূহ ও ধর্মগ্রন্থগুলির ভিত্তিই হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ। যেমন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দাবি করে যে ইসলাম হলো একটি বৈজ্ঞানিক ধর্ম, খোদ আল্লাহ একজন বিজ্ঞানী, আল্লাহর নবী হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরান একটা মহা বিজ্ঞানগ্রন্থ। বিজ্ঞান ও যুক্তবাদের সঙ্গে শত্রুতা করবো, তাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করবো, আবার নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপই প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিও করবো, এগুলো দ্বিচারিতা নয়? এখন প্রশ্ন হলো জীবনভোর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতা করে এসে তারা দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে কেন? এর কারণ হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবর্জনাস্বরূপ বর্জন করেছে। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশেও ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা বাড়ছে ও তা ক্রমবর্ধমান। যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারাও এখন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং ধর্মগুরু অপেক্ষা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিই তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ধর্মগুরু আর ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। শুধু তাইই নয়, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনকে আশ্রয় করেই তাদের ঈশ্বর ও ধর্মকে রক্ষা করতে চায়ছে। তাই তাদের দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
পরিশেষে রমজানের রোযা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। একমাস ধরে রোযা রাখা যে মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক প্রথা তা নিয়ে তথ্য ও যুক্তি সহকারে ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এটা এখন মুসলিমরাও ব্যাপক সংখ্যায় উপলব্ধি করছে। ফলে রোযার প্রতি তাদের আগ্রহ ক্রমশঃ কমছে। ফলশ্রুতিতে রোযা রাখা মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। আমি যেখানে বাস করি সেখানে আমার চোখ যতদূর যায় দেখতে পাই যে পুরুষরা ১০/১৫ শতাংশের বেশী রোযা রাখে না। অনেককেই দেখা যায় যে সোৎসাহে ও স্বতস্ফূর্তভাবে রোযা রাখা শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দেয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের মধ্যে ১২/১৪ ঘণ্টা নির্জলা উপবাস থাকার ফলে শরীরে জলের প্রচণ্ড ঘাটতি ও তীব্র ক্ষুধার ক্লান্তিতে তাদের উৎসাহ ও স্বতস্ফূর্ততা কর্পূরের মতন উবে যায় এবং হাড়ে হাড়ে টের পায় যে রমজান মাসব্যাপী রোযা রাখা একটা চরম অবাস্তব ও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথা। এই উপলব্ধি আগামী দিনেও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাই এখন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে একমাস রোযা রাখা একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার এবং রোযা রাখলে মানুষ নীরোগ হবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। বিজ্ঞানের দোহায় দিয়েই তারা মুসলমানদের কাছে রমজানের রোযাকে জনপ্রিয় করার অপচেষ্টা করছে। ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানসম্মত বলেই তারা থেমে থাকে না। তারা তাদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলিকে বিজ্ঞানের ওপরে স্থাপন করতেও কম কসুর করে না। তারা এ রকম আজগুবি করতেও স্বিধা করে না যে বিজ্ঞানের সকল সূত্র লুকিয়ে রয়েছে ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এবং বিজ্ঞানীরা তাদের সমস্ত আবিষ্কারের সূত্র চুরি করেছে ঐ ধর্মগ্রন্থ থেকেই। মুসলিম  ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এগুলো অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম ডাক্তারদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে যে শরীরকে মেদহীন করে রোগমুক্ত রাখতে খাদ্য গ্রহণ করার ফাঁকে ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার যে পরামর্শ আজ বিজ্ঞান দিচ্ছে সেটা কোরান চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। এতো ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের সমকক্ষ করে তোলার মরিয়া প্রয়াসই শুধু নয়, এতো বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে ছড়ি ঘোরানোর নতো ব্যাপার।
সমাপ্ত
     
               
           
          

Tuesday, May 26, 2020

করোনা ডায়রি - (তিন)ঃ করোনাকে কেনো ভয়

এক 

হিস হিস করে এ পাশ ও পাশ দিয়ে 

ছুটে গেছে কতো বুলেট 

ডানে বামে সামনে সমানে নাগাড়ে 

পড়েছে বোমা, 

বিকট শব্দে ফেটেছে একটার পর একটা 

কেউ কেউ হয়তো থেকেছে পাশে জীবন বাজি রেখে 

বাকিরা সবাই সরে গেছে 

কমরেডরা শুভান্যুধায়ীরা চিৎকার করেছে – 

গিয়াসদা পালান পালান পালান, 

আমি নির্বিকার গুটি গুটি পায়ে পিছিয়ে এসেছি 

কিন্তু পালাইনি কখনো, 

মৃত্যু-ভয় আমাকে ছুঁতে পারেনি কোনোদিন। 

দুই 

না কোনো গল্পকথা নয় তা - 

 তখন আগুন ঝরানো সাতের দশক 

নক্সাল নিধন যজ্ঞ শেষে 

সিদ্ধার্থ মেতেছে সিপিএম নিধন যজ্ঞে 

আর আমরা লাল ঝাণ্ডা হাতে 

মেতেছি তেরঙ্গার দূর্গগুলি ভাঙতে 

দখল নিতে 

জেলা জুড়ে মুর্শিদাবাদে, 

জোতদার-জমিদারদের চোখে চোখ 

রেখেছি আমরা, 

চোখ রাখতে শুরু করেছে 

গ্রামের ক্ষেতমজুর ভাগচাষী প্রান্তিক কৃষকও 

যাদের আজন্ম ঠাঁয় ছিলো জমিদারের পায় 

ভৃত্যরা পদসেবা ছেড়ে লালঝাণ্ডা ধরে 

হুঙ্কার ছেড়ে কয় 

আর বঞ্চনা নয় 

ফসলের ন্যায্য ভাগ চায় 

ক্ষেতের মালিকানাও চায় - 

এ সব চোখ রাঙানি 

সহ্য হবে কেনো ওদের 

যারা সামন্ত প্রভুদের গোলাম আর তাদের সেবাদাস, 

তারা গুণ্ডা আর পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে 

নিরস্ত্র গণ মানুষদের উপর 

মুছে দিতে লাল পার্টি আর তার নিশান 

গোটা বাংলায়। 

তিন 

ঊনিশ শো তিয়াত্তর সাল 

গণতন্ত্রের গভীর সংকট কাল - 

হাতে মারার পাশাপাশি ভাতে মারার অভিযানে 

মেতেছে বুর্জোয়া-জমিদারদের তাঁবেদার 

তেরঙ্গা ঝাণ্ডাওয়ালা সিদ্ধার্থ রায়ের সরকার, 

পাইকারী হারে চাকরিচ্যুত করেছে তাদের যারা 

মাথা নত করেনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাছে -

নির্মমভাবে, 

চাকরিচ্যুতদের দলে একদিন নাম তুলে দিয়েছিলো 

আমারও অকস্মাৎ - 

১ লা ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ তিয়াত্তর 

স্কুলে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম - 

স্কুলের গেট ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা 

একদল চেনা অচেনা যুবকের একজন গম্ভীর কণ্ঠে 

যেন ফাঁসীর রায় ঘোষণা করলো, বললো – 

যান ইনকিলাব জিন্দাবাদ আর ধর্মঘট করুন 

স্কুলে আসতে হবেনা। 

স্কুলে আর ঢুকতে দেয়নি কোনোদিন 

সিদ্ধার্থ জমানায়। 

চার 

পঁচিশে জুন ঊনিশ শ’ পঁচাত্তর ঘোষিত হলো 

অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা - 

গোটা দেশটাকেই মিসা (কালা কানুন) দিয়ে 

জেলখানায় আটক করলেন ইন্দিরা গান্ধী, 

বেকার জীবনে নিত্য সঙ্গী তখন আমার 

অভাব অনটন আর অনিশ্চয়তা - 

ঠিক তখনই আমার সঙ্গীরা অনেকে মিসার ভয়ে 

সই করলো দল বেঁধে একে একে, 

সই করলো ইন্দিরার বিশ দফা আর সঞ্জয়ের পাঁচ দফায় - 

চরম সেই দুর্দিনেও প্রায় নিঃসঙ্গ একা আমি একদিকে 

যুঝেছি প্রাণপণে প্রবল দারিদ্রের সঙ্গে 

আর অন্যদিকে 

হয় জেল না হয় বুলেট আর বোমার ভ্রূকুটি 

তখনও লালঝাণ্ডা ছাড়িনি ভয়ে 

বরং ধরেছি আরো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে 

ভয়ের কাছে আমি নতো হইনি 

ভয়ই নতো হয়েছে আমার কাছে। 

পাঁচ 

দু হাজার পাঁচ কি ছয় - 

তখন হাতে লালঝাণ্ডা আর নেই 

হাতে তুলে নিয়েছি তখন 

একটা কলম। 

জানো করোনা, সেটাও ছিলো বড়ো অপরাধ 

লাল ঝাণ্ডা ধরার চেয়েও বড়ো - 

ইসলাম আর নবী-নিযুক্ত মোল্লারা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলো 

আমার মৃত্যুদণ্ড, 

আমার মাথার দাম ধার্য করলো পাঁচ লাখ। 

জানো করোনা, 

মৃত্যু-ভয়ে মোল্লাদের কাছে তখনও 

মুচলেকা লিখে দিয়ে কলম তুলে রাখিনি। 

 ছয় 

জানো করোনা, 

লজ্জা সরম দূরে সরিয়ে বলি - 

ভয় কিন্তু এখন পাচ্ছি আমি 

ভয় ঢুকেছে বুকে মস্তিষ্কে ও মনে 

ভয় পাচ্ছি দিনে রাতে শয়নে স্বপনে। 

এখন কী মনে হয় জানো - 

ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার বাড়ি 

দু’ হাজার কিমি পথ জুড়ে সর্বত্র 

ওৎ পেতে রয়েছো তুমি, 

যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি যেন 

তুমি পেতে রেখেছো ফাঁদ 

বাড়ির দরজার চৌকাঠ পের হলে 

কোথাও না কোথাও নাগাল পাবে আমার 

খপ করে ধরে তখন গপ 

করে গিলবে আমায়  -

মনে হয় কী জানো – 

করোনা রূপী মৃত্যুটা ছায়ার মত যেন 

ঘুর ঘুর করছে আমাকে ঘিরে 

আমি হাঁটি সেও হাঁটে 

আমি বসি সেও বসে 

আমি উঠি সেও ওঠে 

আমি ঘুমায় সেও ঘুমায় 

ও যেন সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে লেপ্টে রয় 

নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারিনা 

মাঝরাতে যখন ঘুম ভাঙে 

তারও ঘুম ভাঙে 

যখন বাথরুমে যাই সেও যায়। 

সাত 

আগে পাইনি কিন্তু 

এখন ভয় পাচ্ছি কেন জানো করোনা? 

শোনো করোনা তবে অকপটে বলি – 

বুলেট বোমা ছুরিতে ভয় পাইনি কোনোদিন 

কারণ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম তখন 

ভয় পাইনি কারণ জানতাম 

এক গিয়াস মরলে 

হাজার গিয়াস জন্ম নিবে, 

ইসলামের তলোয়ারকেও ভয় পাইনি 

যদিও জানতাম মোরতাদের শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ডই। 

এখন মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি থুড়ি, 

ভয় পাচ্ছি তোমাকে করোনা – 

কেনো পাচ্ছি শোনো তার কারণ, 

এক - বয়স আমার সত্তরের কাছাকাছি 

ডায়াবিটিস উচ্চ রক্তচাপ থায়রডের 

সঙ্গে আমার বাস আজ এক যুগ 

আমরা তো তোমার উপাদেয় খাবার। 

দুই – আমি এখন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত নই 

আমি যে বাঁচতে চাই আরও দশ বছর, 

নিদেন পক্ষে বছর পাঁচ 

আমার যে বাঁচা ভীষণ দরকার 

সে বাঁচা শুধু নিছক বাঁচা নয় 

কিংবা নিছক আমার কারণে নয় 

আমি বাঁচতে চাই কারণ, 

আমি বাঁচলে আমার কলমটা বাঁচবে তাই। 

তিন - ইসলাম, জিহাদ আর নবীর স্বরূপ উন্মোচনে 

এখনও যে অনেক কাজ বাকি 

সে কাজ ফেলে রেখে মরতে চাই না 

একদম, 

তারপরেও করোনা, তোমার থাবায় 

যদি অকালে মৃত্যু ঘনায় 

কলমটা আমার চিরতরে থেমে যায় 

তবে তুমি নিশ্চিত জেনো 

দ্বিতীয় গিয়াস জন্ম নেবে না আর 

ভণ্ড সেক্যুলারদের এ দেশে 

যে আমার কলমটা তুলে নেবে নির্ভয়ে 

আমার বাকি কাজ এগিয়ে নিতে। 

২৭ শে মে ২০২০

Saturday, May 9, 2020

করোনা ডায়রি (দুই) - জান থেকে মান বড়ো

   
        জান থেকে মান বড়ো



    এক 

২৩শে মার্চের ট্রেনে
ঘরে ফেরার টিকিট কাটা ছিলো
কিন্তু ঊনিশ থেকেই
চাইছিলাম মন থেকে যেন
যাত্রীবাহী সব ট্রেন যেন স্তব্ধ হয়ে যায়
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে।
করোনা বাসা বেঁধেছে তখন
বড় জোর দেড় হাজার মানব দেহে
তাতেই দেশজুড়ে কাঁপন ধরেছে মানব মনে
দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট বাতিল করার
ধূম পড়ে গেছে তাই দিকে দিকে।
কাঁপন ধরেছে ভয়ে আমার মনেও -
কিন্তু মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে আছি অনেক দিন
চক্ষু লজ্জায় তাই বলি কী করে
যাবোনা এখন,  
অন্তর থেকে চাইছিলাম তাই
যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো সব স্তব্ধ হয়ে যায়
যেনো তেইশের আগেই। 

           দুই 

রেলভ্রমণ বিমানভ্রমণ মনে হতো  
যেনো একটা মস্ত বড়ো মরণফাঁদ
করোনা ওৎ পেতে রয়েছে যেনো
রেল আর বিমানের প্রকাণ্ড দেহজুড়ে -  
প্রতিটি কামরায় প্রতিটি আসনে শৌচালয়ে
প্রতিটি দরজায় আর কোনায় কোনায়     
ভয়ে তাই কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বক্ষণ
ঠিক মতো ঘুম হয়না রাত্রে
করোনা তো নয় যেনো যমদূত
ফোঁস ফোঁস করে
নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের উপর  
অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত ঘোষণাটি হলো
করোনা ঠেকাতে -
২৩শে মার্চ থেকে বন্ধ থাকবে
যাত্রীবাহী সব প্লেন ও ট্রেন,  
ক’দিন পর রাতে ঘুমালাম সেদিন
পরম স্বস্তিতে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে।

       তিন

লকডাউনের আজ ৪৭তম দিন
তৃতীয় দফার লকডাউন চলছে দেশজুড়ে
আড়াই লক্ষ প্রাণ সংহার করে এ গ্রহের
আক্ষরিক অর্থেই করোনা
আজ প্রকটিত ভয়াল করাল রূপে,
ভীত-সন্ত্রস্ত জবুথবু গোটা বিশ্ব
পরাক্রমশালী ট্রাম্প থেকে মোদি  
সবার কণ্ঠে পরাজিত সেনা নায়কের করুণ আর্তনাদ -  
বাঁচতে হবে আমাদের করোনাকে সঙ্গে নিয়েই।

            চার

ভারতেও করোনা সংহারের বলি ইতিমধ্যেই দুই সহস্রাধিক
সংক্রমণ ছুঁলো বলে লক্ষ শরীর
নিয়ন্ত্রণ শব্দটিকে দলে পিষে মাড়িয়ে
করোনা ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতন
ভারতকেও নিয়ে যেতে মৃত্যুপুরীর দিকে।
ঘরে বাইরে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছে যেনো
করোনা-রূপী মৃত্যুর সাক্ষাৎ যমদূত,
সত্তর ছুঁই ছুঁই আমি বহন
করে চলেছি দেহে তিন তিনটি মারণ রোগ –
বহুমূত্র রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, থায়রয়েড
করোনা তো খুঁজছে হন্যে হয়ে আমাদেরই  
খাঁচাবন্দী পাখির মতন
তাই যাপন করছি বন্দীজীবন
ভয়ে ঘরের চৌকাঠ মাড়াইনি দেড় মাস।

           পাঁচ

সেই আমি দিন রাত জপছি   
ট্রেন প্লেন চলতে শুরু করুক এখনই 
লকডাউন থাকুক
কিন্তু ট্রেন চলুক প্লেন চলুক,  
করোনা তাণ্ডবে কাঁটা ভীত ত্রস্ত আজও
তবু আমার চাই এখনই
একটা ট্রেন কিংবা প্লেনের টিকিট,  
করোনা হানায় যদি জান যায় যাক
কিন্তু মন বড়োই উদগ্রীব উতলা আজ
যেভাবেই হোক ঘরে ফিরতে

        ছয় 

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাওয়া
কি শুধু ঘরে ফেরার তাগিদে?
এমন মরিয়া মনোভাব কি হতোই
মেয়ের বদলে ছেলের কাছে এসে থাকলে,   
কিংবা মেয়ে আমার গৃহবধূ না হয়ে  
উপার্জনশীল স্বাবলম্বী ব্যক্তিত্ব হলে?
মেয়ের কাছে এসেছিলাম মেয়ে-জামায়েরই কাজে
তাদেরই একান্ত অনুরোধে   
কিন্তু সে প্রয়োজন ফুরিইয়েছে অনেক দিন
এখন তাই নিজেকে কেবলই মনে হয়
বোঝা জামাইয়ের সংসারে,  
যত দিন যায়
এ অনুভূতি তত তীক্ষ্ণ হয় -
নিষ্কৃতি চাই তাই এ জীবন থেকে।

         সাত 

জীবন আজ এক নির্মম উপলব্ধির সাক্ষী -
শুধু দিন বদলায় না দ্রুত
দ্রূত বদলায় পরিবেশ পরিস্থিতি
আর বদলায় দ্রুত মানুষের মনও -
জীবন তখন তুচ্ছ ক্ষুদ্র মনে হয় 
আর মনে হয়
আত্মসম্মান আত্মমর্যাদাই সব থেকে বড়ো
তার চেয় কিছু নয়।
আত্মসম্মান তখন বড়ো হয়ে ওঠে জীবনের চেয়েও।

১০ই মার্চ ২০২০ ব্যাঙ্গালোর  









Thursday, May 7, 2020

করোনা ডায়রি (এক)ঃ কখনো কি এতো মৃত্যুভয় পেয়েছি?


কখনো কি এতো মৃত্যুভয় পেয়েছি?

আমি এখন সত্তর ছুঁই ছুইঁ করছি
জীবনের চৌত্রিশটা বসন্ত কেটেছে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে
সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ জীবনটা ছিল না
মসৃণ, ফুল বিছানো
মৃত্যু ছিলো নিত্যসঙ্গী, ছায়াসঙ্গী,
পায়ে পায়ে মৃত্যু যেনো বেড়ি পরিয়ে রাখতো
কানের কাছে হিশহিশ শব্দের ঢেউ তুলতো,
একবার একটা বুলেট তো কানের পাশ দিয়ে হুশ হুশ
শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো,
তার আগেই একদিন প্রতিপক্ষের লোকজন
পেয়ে গেলো একেবারে হাতের মুঠোয়,
অদূরেই ফিসফিস করে ফন্দি আঁটা হচ্ছে
কুচি কুচি করে কেটে বস্তাবন্দি দেহটা
কীভাবে পাচার করা হবে তার,
ফন্দিটা অবশেষ ব্যর্থ করে দিলো একজন কনস্টেবল এসে।
মৃত্যু আমার পায়ে পায়ে হেঁটেছে সদা যখন
তখন কি মৃত্যুর চোখ রাঙানিকে
ভয় পেয়েছিলাম আদৌ?
যখন কানের পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে
বুলেটটা বেরিয়ে যায় লাস্ট ওয়ার্নিংগ দিয়ে
তখন কি ভয় পেয়েছিলাম?
যখন নিশ্চিত মৃত্যর কোলে শুয়ে ছিলাম
প্রতিপক্ষের বেষ্টনীর মধ্যে
তখন কি খুবই ভয় পেয়েছিলাম?
ভয় পেলে তো রাজনীতির প্রাঙ্গণটা আরও
বেশী করে আঁকড়ে পড়ে থাকতাম না,
পারতাম না ডিজির আমার জন্যে বরাদ্দ করা
সিকিউরিটি হেলায় ফিরিয়ে দিতে।
আজ ভাবছি কেউ যদি
একজন সিকিউরিটি দিতো করোনার থাবা থেকে বাঁচতে।

৮ই মার্চ, ২০২০ (১৫৯তম রবীন্দ্র জয়ন্তী), ব্যাঙ্গালোর 





Friday, February 14, 2020

সিএএ শুধু ধর্মীয় বিভেদমূলক আইনই নয়, এটা একটি মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইনও

সিএএ এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অরাজনৈতিক গণআন্দোলন

গোটা দেশে সিএএ, এনআরসি ও এনপিআরের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। যতদিন যাচ্ছে আন্দোলনটি ততো তীব্র হচ্ছে। আন্দোলনটি অতি অল্প সময়েই আক্ষরিক অর্থেই জন-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে ছাত্র-যুব, নারী ও নাগরিক সমাজ, পরে নেমেছে কয়েকটি রাজনৈতক দল। স্বাধীনোত্তর ভারত অনেক বড়ো বড়ো গণআন্দোলন দেখেছে, কিন্তু সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর বিরোধী গণআন্দোলনে যে কয়েকটি বিশেষ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অতীতে কোনো আন্দোলনে পরিলক্ষিত হয় নি। এই গণআন্দোলনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এরকমঃ ১). আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে দলীয় পতাকাকে দূরে সরিয়ে রেখেই। ২). আন্দোলনটি শুরু করে প্রথম জনগণই, পরে নামে রাজনৈতিক দলগুলো। ৩). আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে বিপুল সংখ্যক নারী যাদের মধ্যে চির পর্দানসীন গৃহবন্দি মুসলিম নারীর সংখ্যাই অধিক। তারা শুধু অংশ গ্রহণই করেই নি, আন্দোলনের একেবারে পুরোভাগে রয়েছে। ৪). আন্দোলনে মুসলিম সমাজের  মানুষ অংশ নিয়েছে ব্যাপক সংখায়, কিন্তু তারা তাদের ধর্মীয় পতাকা ও ধর্মীয় নেতাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। ৫). মুসলিম নারীরা গৃহবধূ ও ছাত্রী নির্বিশেষে বিরাট সংখ্যায় গোটা দেশ জুড়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারির হাড় কাঁপানো কনকনে হিমশীতল ঠাণ্ডার মধ্যেও বিভিন্ন রাস্তায় বসে অবস্থান আন্দোলন শুরু করেছে এবং অদ্যাবধি চালিয়ে যাচ্ছে (দিল্লীর শাহিনবাগের অবস্থান বা ধর্ণা ইতিমধ্যেই দু'মাস পূরণ হতে চলেছে)। হাতে রয়েছে তাদের ধর্মীয় পতাকার পরিবর্তে জাতীয় পতাকা ও দেশের সংবিধান এবং মুখে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষা করার মুহুর্মুহু শ্লোগান। অমুসলিম সমাজের ব্যাপক মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে তৈরি করা খাবার, শুকনো খাবার, বাচ্চাদের দুধ, পানীয় জল, ঔষধ, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্র নিয়ে অবস্থানরত এই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে এসেছেন বহু ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টরাও এবং স্থাপন করেছেন অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পও। ৬). সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হোক কিংবা হিংসাত্মক আন্দোলনই হোক সব আন্দোলনই করে থাকে মূলত পুরুষরা, আর নারী তাদের সর্বপ্রকারের সহযোগিতা করে থাকে, এটাই এ দেশের সর্ব কালের দস্তুর। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলন সর্বকালের সেই নিয়ম উল্টে দিয়েছে। এই আন্দোলনে মুসলিম নারী পথে নেমেছে, তারা রয়েছে আন্দোলনের পুরোভাগেই আর পুরুষগণ তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করছে। ৭). গোটা দেশজুড়ে ইতিহাসবিদ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নাট্যব্যক্তিত্ব, শিল্পী, লেখক - অধ্যাপক, গায়ক-গায়িকা রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই শ'য়ে শ'য়ে এই আন্দোলনে পথে নেমেছে। অতীতে নাগরিক সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে কখনো  এভাবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে এত বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনে শামিল হয় নি। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে সিএএ ও এনআরসিকে তারা প্রত্যাখ্যান করছেন এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে সরকারের কাছে কোনো প্রমাণ পত্র জমা দেবে না এবং তার পরিণতিতে ডিটেনশন ক্যাম্প তথা কারাগারে যেতে প্রস্তুত। এবং এটাই হয়ে গেছে এখন সর্বস্তরের আন্দোলনকারীদের মুখের ভাষা।  স্বাধীন ভারতে নাগরিক সমাজকে কোনো সরকারকে এমন সংঘবদ্ধভাবে এ রকম চ্যালেঞ্জ জানাতে দেখা যায় নি। ৮). আন্দোলনের শুরুতে আন্দোলনকারীরা হিংসাত্মক হয়ে উঠলেও পরে তারা  নাগরিক সমাজ ও মুসলিম  সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে হিংসাত্মক পথ পরিহার করে এবং সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ  আন্দোলনে শামিল হয়।
এ কথা বলা বাহুল্য যে,  নাগরিকত্ব হারানোর ভয় ও আতঙ্কই মুসলিম সমাজের তরুণ ও যুবাদের হিংসার পথে নিয়ে গিয়েছিল। হিংসাশ্রয়ী ছেলেরা হিংসার পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ  বিশ্বের ইতিহাসে এমন উদাহরণ থাকলেও তা বিরল। ৯). আন্দোলনটি গোটা দেশ ও দুনিয়ায় এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যার সারা বিশ্বে বোধ হয় বেনজির। এমনকি মোদিজীর বিশেষ বন্ধু ট্রাম্পের দেশ থেকেও সিএএ ও এনআরসি বাতিল করার দাবি উঠেছে। আমেরিকার দুটি নামকরা শহরের (সিটল ও কেমব্রিজ সিটির) স্থানীয় সরকার সিএএ ও এআসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে সেই প্রস্তাবে ভারত সরকারকে সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে। সিএএ ও এনআরসির জন্যেই ভারত সরকার এখন কার্যত আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একঘরে হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে একের এক রাজ্যের বিধানসভা সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছে যার মধ্যে কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, পণ্ডিচেরি প্রভৃতি রাজ্যগুলো রয়েছে।
এক কথায় স্বাধীনোত্তর ভারত এমন আলোড়ন সৃষ্টি করা আন্দোলন কখনো দেখে নি। দেশে বিদেশে সিএএ ও এনআরসি  বিরোধী আন্দোলনের প্রতি এই অভাবনীয় বিপুল সমর্থন দেখে মোদি সরকার ও শাসকদলের সব হিসাবনিকাশ গুলিয়ে যাচ্ছে। সিএএ পাশ করানোর সময় বিজেপি সরকারের দুই স্তম্ভ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাসকদলের নেতৃবৃন্দের শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছিল বহুদিনের ঈপ্সিত লক্ষ্য (হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ) স্পর্শ করার অপার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস। তার সঙ্গে ছিল বেলাগাম অহংকার ও ঔদ্ধত্যও। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সর্বস্তরের জনগণের অংশ গ্রহণ, সমর্থন ও সহানুভূতির ব্যাপকতা ও তীব্রতা দিন দিন যতো বেড়েছে তাদের শরীরি ভাষা ততো ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় অহংকার ও ঔদ্ধত্যৈর আস্ফালন অন্তর্হিত হতে শুরু করেছে। তাদের মুখের বচনও পাল্টাতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী পারিষদ ও শাসকদলের নেতারা মিউ মিউ করে আত্মরক্ষার ঢঙে কথা বলা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, না না, এনআরসি নিয়ে সরকারি স্তরে কোথাও কোনো আলোচনা হয় নি। সিএএ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ বলছেন এই আইন তো নাগরিকত্ব দেবার জন্যে, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার জন্যে নয়। বিরোধী দলগুলো ও আন্দোলনকারীরা অযথা মানুষকে বিভ্রান্ত ও মুসলিমদের ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ যে মিথ্যাচার করছেন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করছেন তা বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না।অবশ্য মাঝে মাঝে হুমকিও শোনা যাচ্ছে তাঁদের কন্ঠে। বলছেন যে আন্দলনের চাপ যতোই হোক না কেন সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করা হবে না।

কারো নাগরিকত্ব যাবে না,  মোদি সরকারেরে এই আশ্বাস বাণী একটা ভয়ংকর মিথ্যাচার

সিএএ-এর গোটা কথাটা হলো সিটিজেনশিপ এ্যামেণ্ডমেন্ট এ্যাক্ট ২০১৯। হ্যাঁ, এই আইনে কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার কথা বলা হয় নি, বলা হয়েছে নাগরিকত্ব দেবারই কথা। আপাতদৃষ্টিতে এ কথা সত্যি বটে, কিন্তু বাস্তবে আদৌ নয়। বাস্তবে এটা অর্ধ সত্য যা মিথ্যা্র চেয়েও ভয়ংকর। এই সত্যটা অবশ্যই অর্ধ সত্য, কারণ এটা স্বয়ং সম্পূর্ণ আইন নয়, এনআরসি-র সঙ্গে এর অবিচ্ছ্বেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আসামে এনআরসি-র ব্যর্থতা ঢাকতে তড়িঘড়ি সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে এনআরসি-র ব্যর্থতার একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। তাহলো, বিজেপি চেয়েছিল এনআরসি-র সাহায্যে ব্যাপক সংখ্যক (লক্ষ্যমাত্রা ছিলো পঞ্চাশ হাজার) মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী প্রমাণ করে  ভারত থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া। কিন্তু তাদের সে সাধ পূরণ হয় নি। কারণ, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। সেই ১২ লক্ষ হিন্দুদের জন্যেই মূলত সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই আইনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি, জৈন ও শিখ ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেবার কথা রয়েছে। সুতরাং এটা  স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক এবং অবিচ্ছেদ্য। কথাটা এভাবেও বলা যায়, সিএএ হলো এনআরসির গর্ভজাত সন্তান। এনআরসির কাজ হলো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া, আর সিএএ-এর কাজ হলো  যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মানুষের মধ্যে  মুসলমান বাদে হিন্দু সহ উপরে উল্লেখিত পাঁচটি ধর্মের মানুষদের তথা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। এর অর্থ হলো, এনআরসি যদি মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তবে তারা ভারতীয় নাগরিক হলেও, নাগরিকত্ব ফিরে পাবে না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, হিন্দু ধর্ম সহ ৬টি ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু মুসলমানদের ফেরত দেবে না। সুতরাং সিএএ-তে কারো নাগরিকত্ব যাবে না এ কথাটা অর্ধ সত্য। যেহেতু সিএএ নাগরিকত্ব দেবার বা ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নে মুসলমানদের জন্যে সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই আসামের এনআরসি তালিকায় যে মুসলিমদের (তিন লক্ষ, মতান্তরে পাঁচ লক্ষ) নাম নেই তাদের দেশ ছাড়া  হতে হবে, না হয় কারাগারে পচে মরতে হবে। এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকলো না।

আসামের এনআরসি ধর্মীয় বিভেদকামী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলো না 


আসামে ১৯৮৫ সালে এনআরসি তৈরী করার জন্যে যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল সেটা মোটেই ধর্মীয় বিভেদমূলক ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট ছিলো না। এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক  পঞ্জী তৈরী করার উদ্দেশ্য ছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করা অভিবাসীদের খুঁজে বার করে তাদের দেশ থেকে বার করে দেওয়া। চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের প্রবল গণআন্দোলনের চাপে। সেই চুক্তির সম্পাদনের মধ্য দিয়েই দীর্ঘ ৬ বছরের আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের গণআন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাদের আন্দোলনের দাবি ছিল অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে হবে। সেই দাবি মেনে নিয়েই রাজীব গান্ধীর কেন্দ্রীয় সরকার ও তৎকালীন কংগ্রেসের আসাম সরকার আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদও। আসু ও আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ তখন ১৯৬৬ সালের ১লা জানুয়ারীর আগে যারা আসামে এসেছে তাদের গ্রহণ করে নিতে এবং নিয়মিতকরণ করতে সম্মত হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে একটি সংশোধনী নিয়ে আসে। সেই সংশোধনীতে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চের মধ্যে যারা আসামে এসেছে তাদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে নিয়মিতকরণ করা হবে। তারপরে যারা ভারতে এসেছে তাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হবে। এই ছিল ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির মূল কথা। অর্থাৎ আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ আসামে অবৈধ উপায়ে প্রবেশকারী অভিবাসীদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করার দাবিতে যে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে তার মধ্যে কোনোরূপ জাতি-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ বা ধর্ম-বিদ্বেষ  ছিল না। বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদের চাপে আসামের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে উঠেছে - এটা ছিল তাদের আন্দোলনের মূল কথা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অভিবাসী কথাটির উপর ধর্মীয় লেবেল সেঁটে দেয়। অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বিভাজন করে একটা জঘন্য সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে। সরাসরি মুসলিম ও অমুসলিম এই দু ভাগে তাদের বিভাজিত করে। যারা মুসলমান তারা অনুপ্রবেশকারী, আর যারা অমুসলমান তারা শরণার্থী। এই হীন মনোভাব থেকেই তারা আসামের এনআরসির অভিমুখটাই ঘুরিয়ে দেয় মুসলমানদের দিকে। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত করে এনআরসিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আসামের রাজ্য সরকার এনআরসির কাজ শুরু করে জোর কদমে। অবশ্য আসামে এন আরসির কাজ শুরু করার নির্দেশও ছিল সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এনআরসি যে তাদের কাছে বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাত করতে পারে সে আন্দাজ তাদের ছিলো না।

বিজেপি সরকারেরে শরণার্থী নীতিটি ধর্মীয়-বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন

এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করায় কোনো আপত্তি নেই। হওয়াটা যে খুব জরুরী তাও নয়।  আর আসামের এনআরসি হোক কিংবা মোদি সরকার সারা ভারতে যে এনআরসি তৈরি করতে চায় সেটাই হোক, এগুলো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ, বিজেপি সরকার যে মতলবে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে তার উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক। সেটা হলো, ভারত থেকে ব্যাপক সংখ্যক মুসলিমদের তাড়ানো। সারা পৃথিবীতেই অনুপ্রবেশ সমস্যা রয়েছে, ভারতেও আছে। বিশ্বে যতদিন ধনী ও গরীবের বৈষম্য থাকবে, ধনী দেশ ও গরীব দেশ থাকবে, রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়ন থাকবে, বর্ণবৈষম্য থাকবে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ থাকবে ততদিন অনুপ্রবেশের সমস্যা থাকবে। যে দেশে যত বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে তাদের অনুপ্রবেশজনিত সমস্যা তত বেশি। যারা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন কিংবা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে কিংবা যুদ্ধের কারণে প্রাণ রক্ষার্থে স্বদেশ পরিত্যাগ করে এবং ভিন্ন দেশে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করে তাদের শরণার্থী বলে। মানবিক কারণেই এই সব শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা সহ প্রয়োজনীয় সব রকমের সাহায্য দেওয়া হয়। এটা একটা সর্বজন গ্রাহ্য আন্তর্জাতিক নীতি। কিন্তু যারা অন্য কারণে, এবং যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত কারণেই, স্বদেশ পরিত্যাগ করে ভিন দেশে যায় বৈধ অনুমিতি ছাড়াই তাদের প্রতি রাষ্ট্রের, দেশের ও  সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী কীরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়? তাদের ক্ষেত্রে কি অমানবিক হওয়াই কি রাষ্ট্রীয় নীতি বা সমাজের নীতি হওয়া বাঞ্ছনীয় ? গোটা বিশ্বেই তো কাজের সন্ধানে মানুষ দেশান্তরী হয়তে হয় নিরুপায় হয়ে। এই নিরুপায় দরিদ্র কর্মচ্যুত মানুষ কিংবা বেকার ছেলেমেয়েরা কি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সহানুভূতি পেতে পারে না? শ্রমিক রপ্তানি করা বহু দেশের একটা বিধি সম্মত বৈদেশিক নীতি। এরূপ ব্যবসা করে যেমন বহু বেসরকারি কোম্পানী, তেমনি করে বহু সরকারও। আমাদের ভারত থেকেও  মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মানুষ যায় বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে কাজের জন্যে। বাংলাদেশ থেকে তো যায় হাজারে হাজারে। ভিন দেশে মানুষ বা শ্রমিক রপ্তানি করার পশ্চাতে কি শুধুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীই থাকে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী একেবারেই থাকে না?  নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু যারা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে ভিন দেশে যেতে পারে না, বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ ভাবে দেশান্তরি হয় তাদের প্রতি কি রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী দেখাতে পারে না? ইউরোপের দেশগুলি ও সেখানকার নাগরিক সমাজ তো সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। ট্রাম্প পূর্ববর্তী  আমেরিকাও তো কখনো করে নি। ইউরোপের দেশগুলো তো সেই সব অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব করে তাদের দেশ থেকে তাড়ানোর কথা বলে না। আমাদের দেশ ভারতের সংস্কৃতিও অনুরূপ। অতীতে সব সরকারই তো অবৈধ অভিবাসীদের উদারনৈতিক দৃষ্টিভিঙ্গী ও মনোভাব প্রদর্শন করেছে চিরদিন, কাউকে তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে নি। এমনকি বিজেপির নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারও তো একই নীতি প্রদর্শন করেছে। গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের মদতে ও প্রশ্রয়ে যে মুসলিম নিধন যজ্ঞ হয়েছিল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। গুজরাটের সেই বীভৎস গণহত্যাকান্ডে বাজপেয়ী মোদিকে তখন যা বলেছিলেন তাতো আমাদের স্মরণে আজও সমান সমুজ্জ্বল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে রাজধর্ম পালন করতে বলেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, মোদি তা করেন নি। মুসলমানদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব প্রধানমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব একই রয়ে গেছে। বরং তিনি মুসলমানদের প্রতি আরও বেশী বিরূপ মনোভাব নিয়ে রাজধর্ম পালন করা বিরত রয়েছেন।
মোদি সরকারের শরণার্থী নীতিটি মুসলমানদের প্রতি তাঁর ঐ মনোভাব থেকেই তৈরি। অবৈধ অভিবাসীদের ধর্মীয় বিভাজনও ঐ মনোভাব থেকেই জাত। একদল অবৈধ অভিবাসী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পারসিক) হলো শরণার্থী, আর একদল অভিবাসী (মুসলমান) হলো অনুপ্রবেশকারী। মোদি সরকার শরণার্থীদের জন্যে অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, ও পার্সিদের জন্যে প্রণয়ন করেছে সিএএ। সুতরাং মোদি সরকার কী সাফাই দিল তাতে কিছু যায় আসে না, সিএএ যে একটি ধর্মীয় বিভেদমূলক এবং মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইন তা দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।
বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই বিজেপি ও আরএসএস দেখে না। তাদের সকলকেই তারা মুসলিম মৌলবাদী ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে মনে করে। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ভারতে প্রবেশ করে এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করে। এমনকি তারা এদেশে কিছু মুসলিম জিহাদি অন্তর্জাল (নেট ওয়ার্ক/Net work) তৈরি করেও ফেলেছে। বলা বাহুল্য যে তাদের বিরুদ্ধে আমি সর্বদা সোচ্চার এ কথা সর্বজন বিদিত। তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা (Zero tolerance) নীতি নিয়ে তাদের মূলোচ্ছেদ করুক আমি সর্বাগ্রে চাই। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী সব মুসলমানই জঙ্গী ও সন্ত্রাসী এ কথা মানা যায় না। মানা যায় না, কারণ, তা একটা অতি নিম্নরুচির জঘন্য মিথ্যাচার যা এসেছে মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে। শুধু ঐ অভিবাসী মুসলমানদের সম্পর্কে নয়, আরএসএস ও বিজেপির কট্টর লোকজন সমস্ত মুসলিমদের সম্পর্কেই ঐ একই ধারণা পোষণ করে। এটা আমার নিছক অনুমান কিংবা অমূলক সন্দেহ নয়, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। একজন অনামী লেখক হলেও হিন্দু সমাজের বহু মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় আছে যাদের অনেকেই আরএসএস ও বিজেপির মতাদর্শে বিস্বাসী। তাদের সঙ্গে আলাপ কালে তাদের সেই অমূলক ভ্রান্ত ধারণার প্রকাশ পেয়েছি। আমার মনে হয় বর্তমান বিজেপি সরকার সেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার এবং তার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
পরিশেষে আর একটা সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ লেখাটি শেষ করতে চাই। তা হলো,  রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে উপরে উল্লেখিত ছ'টি ধর্মাবলম্বী মানুষই শুধু ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে নি, মুসলিম সমাজের অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও ঐ একই কারণে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রতিবেশী তিনটি মুসলিম দেশ থেকেই নির্যাতিত মানুষরা ভারতে আসে নি। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও ধর্মীয় নির্যাতন হাজার হাজার তামিলরাও শ্রীলংকা থেকে ভারতে এসেছে এবং বহুদিন যাবত তারা তামিলনাড়ু সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করছে। সিএএ উক্ত তিনটি দেশ থেকে আসা মুসলিম সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ছিন্নমূল মানুষগুলো ও শ্রীলংকা থেকে আসা ছিন্নমূল তামিল জনগণের প্রতিও চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
                               শেষ

Friday, January 24, 2020

৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের সংবিধানটাই ধ্বংসের মুখে

"আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রুপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠাার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদ, আজ, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।"
আমাদের (ভারতের) সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি। ২৬শে জানুয়ারি তাই ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই ভারতে প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। আগামীকালও হবে। কাল আমাদের ৭১তম প্রজাতন্ত্র  দিবস। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন (ভয়ংকর ও বীভৎস) চেহারা নিয়ে দিনটি আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। তা নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

লেখার শুরুতেই যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা (preamble)। সংবিধানটি গৃহীত হবার পর সত্তরটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সরকারই প্রস্তাবনায় উচ্চারিত শপথ ও অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করে নি। ফলে সকল নাগরিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার পায় নি; চিন্তা, মতপ্রকাশ, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা পায় নি; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা কোথাও হয় নি; সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে নি। বরং তার বিপরীতটাই হয়েছে। ফলে সমাজের সর্বস্তরে স্থান করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে ন্যায়বিচারের বদলে অবিচার, অন্যায় বিচার; দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার; সমতার স্থলে বৈষম্য ও বঞ্চনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বদলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রের সম্প্রসারণের বদলে উত্তরোত্তর সংকোচন ও রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বৃদ্ধি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের কাজের বদলে কর্মহীনতা ও বেকারি বৃদ্ধি, ধনী-গরীবের বৈষম্য কমার বদলে ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণের বদলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, এগুলো আমাদের অঙ্গের ভূষণে পরিণত হয়েছে। এ রকম আরো কতো বৈপরিত্য রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই প্রজাতন্ত্র দিবসটিকে আমার প্রজাতন্ত্র দিবস মনে হয় না। কী মনে হয় তা এর আগে ২০১৫ সালে ব্যক্ত করেছি আমার ব্লগে। তার লিংক হলো www.giasuddinonline.blogspot.in.

এই বৈপরিত্য আমাকে চমকায় না। বুর্জোয়া সরকারগুলোর শাসনে এগুলোই স্বাভাবিক পরিণতি। ওরা মুখে যা বলে এবং সংবিধানে যা লেখে তার বিপরীতেই কাজ করে। এতেও কোনো অস্বাভাবিকতা আমি দেখি না। বুর্জোয়াদের সরকার তো তাদের নিজেদের (বুর্জোয়াদের) জন্যেই কাজ করবে। এমন কোনো যাদু (অর্থনীতি) নেই ওদের কাছে যা দিয়ে ওদের পক্ষে একই সঙ্গে তারা বুর্জোয়া শ্রেণী ও খেটে খাওয়া শ্রেণী তথা শোষিত শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করা সম্ভব। কারণ, এই শ্রেণীদুটি তো পরষ্পর বিপরীত মেরুর। দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্যে কিছু পদক্ষেপ তারা করে বটে, তবে তা তাদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যে, তাদের আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্যে। তাদের এই মিথটা খাওয়ানোর জন্যে যে সরকারের (রাষ্ট্রের) শ্রেণী চরিত্র হয় না। রাষ্ট্র হয় নিরপেক্ষ এবং সবার।  বুর্জোয়া শ্রেণীর দলগুলো তাদের সরকারকে শ্রেণীনিরপেক্ষ দেখানোর জন্যে তাদের পরিচালিত সরকার তথা রাষ্ট্রের নামের আগে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ইত্যাদি গালভরা শব্দগুলো বসিয়ে দেয়। যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ব্যাস! তাতেই কেল্লা ফতে। আমরা বুঝে গিয়েছি যে আমাদের রাষ্ট্র শ্রেণীনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রের চোখে আমরা সবাই সমান, সবার সমান অধিকার, বহু হাজার কোটি টাকার মালিক বৃহত পুঁজিপতি আম্বানির যেমন একটা ভোট আছে তেমনি নি:স্ব একজন ক্ষেতমজুরেরও আছে একটা ভোট। এটা যে স্রেফ ধাপ্পাবাজি, মানুষকে বোকা বানানোর জন্যে বানানো বুলি তা আজও আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। ফলে বুর্জোয়া দলগুলি পাল্টাপাল্টি করে আরামসে তাদের সরকার তথা রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, ধনী-গরীবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, বেড়ে চলেছে দ্রব্যমূল্য, বেকারি, কর্মহীনতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই দেশের অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সংকট, সামাজিক সংকট দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।
বিজেপির সরকারের শাসনে গত ছ'বছরে এগুলো আরো বেড়েছে। সর্বস্তরে দ্বন্দ্ব ও সংকটও সমানে বাড়ছে, ঘনীভূত হচ্ছে, বেসামাল হয়ে উঠছে। এর মধ্যেও অস্বাভাবিকতা অনুসন্ধান করার কিছু নেই। কারণ বিজেপির শ্রেণী চরিত্র অন্য রকম নয়। এই দলটাও বুর্জোয়া শ্রেণীর দাসানুদাস। গণতান্ত্রিক যুগে বুর্জোয়ারা অনেক রাজনৈতিক দলকে লালনপালন করে। তাদের কোনো দলের প্রতি জনগণ যখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তার প্রতি আস্থা হারায় তখন তাদের অন্য একটা দলকে তারা সামনে এগিয়ে দেয়। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে মানুষ ক্রমাগত যখন ক্ষোভ বেড়েছে তখন তারা জনগণের সামনে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপিকে এগিয়ে দিয়েছে। শ্রেণী অসচেতন মানুষ তাকেই ভোট দিয়ে সরকারে বসিয়েছে। ফলে সরকারের বদল হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক নীতির কোনো বদল হয় নি। ফলে কোনো ক্ষেত্রেই সংকট কমে নি, বরং আরও বেড়েছে, তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কারও পেছনে নেমে গেছে। নেমে গেছে গণতন্ত্রের পরিসরের ক্ষেত্রে দশ ধাপ নীচে।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৭২ পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় মোদি সরকারের আগে ৩/৪টি রাজনৈতিক দলের সরকার, তাদের দলীয় জোটের সরকার আমরা দেখেছি। এমনকি বিজেপির নেতৃত্বাধীন দলীয় জোটেরও সরকারও দেখেছি যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। বলা বাহুল্য যে সবগুলো সরকারই ছিল বুর্জোয়া সরকার। বাজপেয়ীর সরকার সহ আগের সেই সরকারগুলোকে আমরা কিন্তু কখনো এখনকার মোদি সরকারের মতন দৈত্য দানবের চেহারায় দেখি নি। আমাদের সংবিধান সম্পর্কে যা কিছুই প্রচার হোক না কেন, সংবিধানটি কিন্তু মোটেই শ্রেণীনিরপেক্ষ নয়, প্রধানত এটা বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংবিধান। তৎসত্ত্বেও এই সংবিধানে অন্যান্য সকল শ্রেণীর জন্যেও কিছু না কিছু সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। পূর্বতন সরকারগুলো মাঝে মাঝেই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ করেছে, কিন্তু তাই বলে তারা কখনোই চরিত্রগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ছিল না, ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার। আমাদের দেশের রাষ্ট্র সম্পর্কে যতই ভালো ভালো কথা শুনি না কেন, রাষ্ট্রটি হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে আমাদের দেশের গণতন্ত্রও বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে গণতন্ত্র সকলের জন্যে উন্মুক্ত নয়। তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণকে দেওয়া হয় খুবই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্র। আমাদের জন্যে অর্থাৎ জনগণের জন্যে আমাদের সংবিধানেও তাই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুই দেওয়া হয়েছে। প্রাক-মোদি জমানায় মাঝে মাঝেই সংবিধান প্রদত্ত সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুকেও খর্ব করা হয়েছে, মতপ্রকাশের খণ্ডিত স্বাধীনতা ও সুযোগকে খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকার কখনও গণতন্ত্রকে হত্যা করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে নি। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারের কাজকর্মে সেটা করার ঝোঁক প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের দেশ বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু জাতি-উপজাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। তাই এ দেশ পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিতে। এই নীতি ও কাঠামো অতীতে শক্তিশালী কেন্দ্র তৈরি করার অজুহাতে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষমতা খর্বিত হয়েছে। কিন্তু কখনও যুুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার প্রবণতা প্রকটিত হয় নি যা পরিলক্ষিত হচ্ছে মোদি সরকাররের মধ্যে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিশেষ ক্ষমতা ও অধিকার প্রাপ্ত অঙ্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করার নজিরবিহীন পদক্ষেপে।
আমাদের দেশটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে পরিচিত। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি 'সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' ('Socialist Secular Democratic Republic')। কিন্তু আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়। সেটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র বা সরকার ধর্ম বিষয়ে সদা নিরপেক্ষ থাকবে এবং সকল ধর্ম থেকে সমান দুরত্ব বজায় রাখবে। সরকার কোনো ধর্মের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব করবে না, এবং কোনো ধর্মের প্রতি বৈষম্যও করবে না। ধর্মবিশ্বাসীদের প্রত্যেকের ধর্মাচরণ করার সমান অধিকার সুনিশ্চিত করবে, কিন্তু ধর্মাচরণের অধিকারের নামে কাউকে সংবিধানের পরিপন্থী যে কোনো কাজ কঠোর হাতে দমন করবে। ধর্মীয় কোনো বিধান বা রীতিনীতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তাকে নিষিদ্ধ করে দেশের নিজস্ব সংবিধানকেই রক্ষা করবে। রাষ্ট্র কারো ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করবে না, তবে কেউ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস রাষ্ট্রের উপর চাপাতে চেষ্টা করলে সেটাও কঠোরভাবে দমন করবে। যারা নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদী, রাষ্ট্র তাদের ধর্ম বিশ্বাস না করা ও ধর্মাচরণ না করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রদান করবে, এবং সমাজ যদি তাদের সেই অধিকার খর্ব বা হরণ করার চেষ্টা করে তবে রাষ্ট্র অধিকার হরণকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবে। আমাদের দেশে কোনো সরকারই এই নীতিমালা অনুসরণ করে না, আমাদের সংবিধানও রাষ্ট্রকে এগুলো অনুসরণ করার নির্দেশ দেয় নি। বরং উল্টে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ বলতে ধর্ম সমন্বয় মনে করেন। সেজন্য আমি এই অনুচ্ছেদর শুরুতেই বলেছি যে আমাদের দেশটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষা, চাকরি, শিল্প, ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে সব ধর্মের মানুষেরই সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। সব ধর্মের মানুষেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা রয়েছে। সংবিধানে সবারই নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করার অধিকার রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখালঘুদের ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করাও বেআইনী করেছে। সংবিধানে নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস না করা কিংবা ধর্ম পালন না করার অধিকারও রয়েছে।
সম্ভবত এজন্যেই আমাদের দেশে বিশ্বের দরবারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের ভিতরেও সেই পরিচিত রয়েছে।  কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো সর্বদা এই নীতিগুলো কখনোই সঠিকভাবে অনুসরণ করে না। কিন্তু তাই বলে কোনো সরকারই (মোদি সরকারের আগে পর্যন্ত) আমাদের সংবিধানে সীমিত আকারে হলেও যেটুকু ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ, নীতি ও বিধান রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে নি বা করতে উদ্যত হয় নি।  আমাদের দেশের এই আবহমান ঐতিহ্য (Tradition) এবার কিন্তু বিপন্নতার মুখে পড়েছে মোদি সরকারের হাতে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি আসার পর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপর, হামলা করা শুরু হয়েছে। পরে অবশ্য কৌশলগত কারণে হামলা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে শুধু মুসলমানদের উপর। এ হামলা কিন্তু শুধু আক্রোশ বশত স্বত:স্ফুর্ত হামলা নয়। এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। তা হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো যেখানে  সংখ্যালঘুরা কেউ থাকবে না, স্বল্প সংখ্যক থাকলেও তারা হিন্দুদের অধীনতা স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। এর প্রতিবাদ করে আমি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি ২০১৫ সালে 'ভারতে ভাগবত-মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে' শিরোনামে। প্রবন্ধটি হালনাগাদ (updated) করি ২০১৮ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2018/05/blog-post_29.html?m=1) প্রবন্ধটি অনেকেই পড়েছেন, তবু লিংকটি দিলাম যারা পড়েন নি তাদের জন্যে। ভারত থেকে মূলত মুসলমানদের তাড়ানোর জন্যে বিজেপি এনআরসিকে (জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে) হাতিয়ার করে। আসামে যখন এনআরসি তৈরি করার জন্যে চুক্তি হয় তার পেছনে কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধি ছিল না। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে আসাম ও ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই এনআরসিকে তাক করে মুসলমানদের দিকে।তারা আসামে বসবাসকারী মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে এ দেশ থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্যে এনআরসিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ লক্ষ (পঞ্চাশ লক্ষ) মুসলমানকে বাংলাদেশী তকমা দিয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত করা। কিন্তু গতবছর ৩১শে আগষ্ট প্রকাশিত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা দেখে তারা ঘাবড়ে যায়। কারণ, তাতে বাদ পড়া ঊনিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৬ (ষোল) লক্ষই অমুসলিম এবং অধিকাংশই হিন্দু, আর মুসলমান মাত্র তিন লক্ষ। তখন আসাামের বিজেপি সরকার ও তাদের দল দুটি দাবি উত্থাপন করে - এক). এনআরসি তালিকাটি বাতিল করতে হবে, কারণ ওটা ভুলে ভর্তি। এবং দুই). পুনরায় একটি নতুন তালিকা তৈরি করতে হবে। সেই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বিজেপির তৎকালীন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দেন যে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নাগরিকহীন হয়ে যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং যতদিন না ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটির সংশোধন হচ্ছে ততদিন কোথাও এনআরসি তৈরি করা হবে না।
তারপর তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় সরকার তার ঘোষণা মত সেই আইনটি সংশোধন করে নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, CAA 2019)। এই আইনের কাজ হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে যে সকল অমুসলমানদের নাম, বিশেষ করে হিন্দুদের নাম, বাদ যাবে তাদের পুনরায় ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা। সুতরাং এনআরসি ও সিএএ-র মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। উদ্দেশ্যটি হল কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়ানো। এই সিএএ ও এনআরসির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আমার একটি লেখা আছে যার লিংকটি হলো  https://giasuddinonline.blogspot.com/2019/12/blog-post.html?m=1

সিএএ ও এনআরসি-র জন্যে স্বভাবতই এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাহীন ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। হবারই তো কথা। কারণ, বিজেপি সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যে মুসলিমরা এই দেশে (ভারতে) স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই বসবাস করছে তাদেরও নির্বাসিত করতে। হ্যাঁ, বিজেপি সরকার যে সেটাই চায় তা সংশয়াতীত। ভারত ভাগের সময় ওদের পূর্বসূরীদের (আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা) দাবি ছিল পাকিস্তান যদি মুসলমানদের জন্যে তৈরি হয় তবে ভারত হবে শুধু হিন্দুদের দেশ। তারই ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর ওরা দাবি করেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের যথাক্রমে ভারতে ও পাকিস্তানে বিনিময় করতে হবে। অর্থাৎ ভারতের ভাগে যে মুসলমানরা পড়েছে তারা যদি পাকিস্তান না যায় তবে তাদের জোর করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে হবে এবং পাকিস্তানের ভাগে পড়া হিন্দুদের ভারতে নিয়ে আসতে হবে। বিজেপি তো আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী। স্বভাবতই তারাও সেই তত্ত্বেরই অনুসারী। আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার দাবি সেদিন প্রত্যাখ্যাত হলেও সেই দাবি বা তত্ত্ব তারা কখনোই ত্যাগ করে নি। সেই তত্ত্ব তো মনে প্রাণে লালনপালন করে বিজেপিও। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার এখন সেই তত্ত্বই বাস্তবায়িত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসেও মুসলিমরা ভয় ও আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারছে না।

আতঙ্ক ঢুকেছে হিন্দুদের মধ্যেও। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র হিন্দুরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আসামের এনআরসি তালিকা থেকে তারা বুঝেছে যে তাদেরও নিস্তার নেই। তাদের নাম যদি ঐ তালিকায় না ওঠে তবে তারা নাগরিকত্ব পুনরায় পাবে কিনা তা নিয়ে তাদের ঘোর সংশয় রয়েছে। আর নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়টা তো পরের কথা, তার আগে তো তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করা হবে।
আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এ দেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মনেও। কারণ, আইনটি তো শুধু সাম্প্রদায়িক আইনই নয়, আইনটি যে সংবিধানবিরুদ্ধও। বিজেপির সরকারের অভিসন্ধি তো স্পষ্ট।  তাদের লক্ষ্য হলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা।
তাই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে আরএসএস, বিজেপি ও সঙ্ঘপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছাড়া আর কেউ স্বস্তিতে নেই, আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে নেই।
              -----      --------        ------- 

(বি:দ্র: ব্লগটি লিখেছি ২৫শে জানুয়ারি। কিন্তু ব্লগের শিরোনামের নীচে দেখাচ্ছে ২৪শে জানুয়ারি। এটা কেন দেখাচ্ছে জানি না)

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...