(ফেয়ারব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত)
প্রবন্ধের গোঁড়াতেই বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু, বলা ভালো, জাতশত্রু হলো বিজ্ঞান ও দর্শন। হবেই না বা কেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরাই তো সমস্ত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সকল অসত্য, অর্ধসত্য, অসততা ও প্রতারণাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে নির্মমভাবে। ধরা যাক ইসলাম ধর্মেরই কথা। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান বিশ্ব-মহাবিশ্ব, আকাশ-মহাকাশ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি, বৃষ্টি-বন্যা-খরা, আহ্নিক গতি–বার্ষিক গতি, ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প-সুনামি, প্রাণের সৃষ্টি, ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা যা বলেছে তার সবটাই যে ভিত্তিহীন, আজগুবি ও মিথ্যেই ঠাসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা। কোরান বলেছে বিশ্ব ও মহাবিশ্ব আল্লাহ সৃষ্টি করেছে সাত দিনে। এই সৃষ্টি তত্ত্ব যে একটা মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি তা মানুষ বুঝেছে বিজ্ঞানের দৌলতে। কোরান বলেছে আল্লাহর কুদরতে আমাদের মাথার উপর সাতটা আকাশ রয়েছে বিনা স্তম্ভেই। এই তত্ত্বটি যে ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারকের বুজরুকি সেটা ফাঁস করে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে, মহাকাশ মানে অন্তহীন মহাশূন্য, মহাকাশের পুরোটাই ফাঁকা। কোরান বলে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ হয় আল্লাহর হুকুমে (নির্দেশে)। এর রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। অথচ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ যে হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অকাট্যভাবে এবং বিজ্ঞানের দৌলতেই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখন অনায়াসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক’টার সময়) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে নিঃখুতভাবে যে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক'টার সময়) সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। বৃষ্টি-বন্যা-খরা ও ঝড়-তুফানও হয় নাকি আল্লাহর হুকুমে। কোরান আরও বলেছে ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে আর মানুষের পক্ষে এসবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো সবই যে স্রেফ নির্জলা মিথ্যা দাবি এবং এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ও কীভাবে হয় তা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই আবহাওয়াবিদরা এখন ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের আগাম পূর্বাভাষ দিতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরানের আজগুবি তত্ত্বকেও নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞান কেন ভূমিকম্প হয় তার রহস্য নিঃখুতভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্রের গভীরে ভূমিকম্প হলে সুনামি হয় সেটাও মানুষ জেনেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকেই। আরও অনেক বিষয় আছে সে সব ক্ষেত্রেও কোরান সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সকল বুজরুকির ধূম্রজাল ছিন্ন করে বিজ্ঞান মানুষের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরে মানবসমাজের সীমাহীন উপকার করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। মানুষের এই সহজ সরল বিশ্বাসকে ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকরা নির্মমভাবে শোষণ করে মানুষকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসী যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার। ধর্মই মানুষের মধ্যে বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ ও লিঙ্গবিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণেই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতে শিখেছে, মানুষ হিংসা করতে এবং হিংস্র ও অমানবিক হতে শিখেছে। যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসের মূলে কঠরভাবে ভাবে আঘাত হেনেছে এবং মানুষকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। যুক্তিবাদী দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান ও যুক্তির শাণিত তরবারি দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাসের ইস্পাতসম শক্ত বর্মকে (আবরণকে) ফালা ফালা করে কেটে মুক্ত করেছে। কোরান-সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি যদি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তবে একটার সঙ্গে আর একটার অমিল ও বৈপরিত্য থাকে কেমনে – এই বৈধ প্রশ্ন তুলেছে যুক্তিবাদীরা। কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ কেন সরল ও সৎ পথ দেখানোর জন্যে প্রার্থনা করে (কোরানের ফাতেহা সুরা দেখুন)? আল্লাহ কার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহরও আল্লাহ আছে নাকি? আল্লাহ নাকি নিরাকার। তাহলে মানুষ কীভাবে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল (এটা আজানের মধ্যে রয়েছে)? আল্লাহর হুকুমে যদি ঝড়-বৃষ্টি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি হয় তবে মানুষ এগুলি সম্পর্কে আগাম খবর দেয় কেমন করে – এ প্রশ্নগুলি তুলেছে যুক্তিবাদীরা। আল্লাহর নবীর (দূতের) পক্ষে কি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও দত্তক-পুত্রবধূকে বিবাহ ইত্যাদি অশুভ কাজগুলি সম্পন্ন করা শোভা পায় – এ প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নবীতত্ত্বকে (theory of prophet-কে) প্রশ্নের মুখে খাড়া করে দিয়েছে। এ রকম হাজারো প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বররবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসিদের নাস্তানাবুদ করেছে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বরের দূত (নবী) ও ঈশ্বরের সৃষ্টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বকে অবাস্তব ও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে ও করে যাচ্ছে যুক্তিবাদীরা। তাই তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু ও জাতশত্রু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং দর্শন ও যুক্তিবাদীরা।
ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবিশ্বাসীরা যেমন মিথ্যাচারিতায় তুলনাহীন, দ্বিচারিতাতেও তাদের তুলনা কেবল তারাই। ধর্মবিশ্বাসীরা অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতাবশে এই অপকর্মগুলি করে। কীরূপ মিথ্যাচারিতা করে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মগুরুরা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গোঁড়া থেকেই খড়্গহস্ত ছিল সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সনস্ত ধর্মের ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এখন দাবি করেন যে তাদের নিজেদের নিজ ধর্মসমূহ ও ধর্মগ্রন্থগুলির ভিত্তিই হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ। যেমন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দাবি করে যে ইসলাম হলো একটি বৈজ্ঞানিক ধর্ম, খোদ আল্লাহ একজন বিজ্ঞানী, আল্লাহর নবী হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরান একটা মহা বিজ্ঞানগ্রন্থ। বিজ্ঞান ও যুক্তবাদের সঙ্গে শত্রুতা করবো, তাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করবো, আবার নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপই প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিও করবো, এগুলো দ্বিচারিতা নয়? এখন প্রশ্ন হলো জীবনভোর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতা করে এসে তারা দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে কেন? এর কারণ হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবর্জনাস্বরূপ বর্জন করেছে। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশেও ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা বাড়ছে ও তা ক্রমবর্ধমান। যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারাও এখন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং ধর্মগুরু অপেক্ষা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিই তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ধর্মগুরু আর ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। শুধু তাইই নয়, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনকে আশ্রয় করেই তাদের ঈশ্বর ও ধর্মকে রক্ষা করতে চায়ছে। তাই তাদের দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই।