Thursday, December 14, 2017

শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক নয়, নিষিদ্ধ করতে হবে পুরো শরিয়তি তালাক আইনটাই

তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটি খসড়া আইন তৈরী করেছে। এটা বিল আকারে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে পেশ করা হবে। বিলটির নাম দেওয়া হয়েছে 'মুসলিম  উইমেন প্রটেকশন অব রাইটস অন ম্যারেজ বিল'এটা আইনে উন্নীত হলে কাশ্মীর ছাড়া সমগ্র ভারতে প্রযোজ্য হবেখসড়া বিলটি ইতিমধ্যেই রাজ্যগুলির কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের মতামত দেবার জন্যে। বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদ কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ রাজ্যের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবুও রাজ্যগুলির মত চাওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ দু’টি। (এক). এই বিলের পক্ষে গোটা বিরোধী পক্ষের সহমত আদায় করা। (দুই). বাম দলগুলি এবং কংগ্রেস-সহ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ পেটি বুর্জোয়া দলগুলিকে  বিড়ম্বনায় ফেলা। কারণ, এসব দলের নেতারা মুসলিম মৌলবাদী ধর্মীয় নেতাদের তুষ্ট করতে এতোকাল তাৎক্ষণিক তালাক আইনটিকে সযত্নে রক্ষা করে এসেছেন। সুপ্রীম কোর্ট যেহেতু ইতিমধ্যেই এই আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, তাই তাঁদের এই বিলকে এবার সমর্থন দিতেই হবে এটা জেনেও যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁদের প্রতি বিরূপ  হবে।         
পাঁচ জন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীর আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রীম কোর্ট গত আগস্ট মাসে এক সঙ্গে তিন তালাক প্রদানকে অসাংবিধানিক ও বেআইনী বলে রায় দিয়েছিলো। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটতেই আছে। মুসলিম সমাজের এই অসাংবিধানিক ঔদ্ধত্যমূলক ঘটনা নতুন কিছু নয়। কারণ, মুসলিম সমাজের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো তাদের নিজেদের দেশের সংবিধান ও সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করা এবং শরিয়তি আইন ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে চলা। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে সুপ্রিম কোর্টের উক্ত রায় প্রদানের পর ৬৭ জন মুসলিম নারী সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে যে তাঁদেরকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান করে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে তিন তালাক দেওয়ার ঘটনা নিশ্চয় আরো বেশী হবে, কারণ এরূপ তালাক দেওয়ার সব ঘটনা যে সরকারের গোচরে আসেনি তা বলাই বাহুল্য। আর একটা কথা এখানে বলা দরকার। তা হলো, উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানরাও আদালতে রায়কে অগ্রাহ্য করে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে দ্বিধা করছেন না। তালাকদাতা উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানদের তালিকায় সম্প্রতি নাম নথিভুক্ত করেছেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালিদ বিন ইউসুফ খাঁনও। তিনি তাঁর বৌ ইয়াসমিন খালিদকে প্রথমে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে এবং পরে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে তালাক দিয়েছেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান ও মান্যতা দিয়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজ একসঙ্গে তিন তালাক দেবার কুৎসিত আইনটি বিসর্জন দিতে মোটেই প্রস্তুত নয়। তাই এ বিষয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারে না যে কেন্দ্রীয় সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাককে নিষিদ্ধ ও বেআইনি করতে যে খসড়া আইনটি তৈরী করেছে সেটা অত্যন্ত জরুরী ছিলো।    
প্রস্তাবিত খসড়া বিলে কী কী বিধান রয়েছে তার প্রতি এবার একটু চোখ বোলানো যাক। পুরো খসড়া বিলটি সামনে আসেনি এখনো। যেটুকু খবর পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, বিলটিতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান করাকে অবৈধ, নিষিদ্ধ ও বেআইনী ঘোষণা করার সংস্থান রয়েছে। যদি কেউ তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেয় তবে সেটা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেবে তার তিন বছরের জেল ও জরিমানা হবে। তালাকদাতা যাতে জামিন না পায় তার ব্যবস্থা রয়েছে বিলে। খসড়া বিলে তালাকপ্রাপ্ত নারীকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার সংস্থান রাখা হয়েছে। যেমন, তিন তালাক দেওয়ার পর তালাকপ্রাপ্ত নারীকে যাতে তার বর বা শ্বশুরের বাড়ি থেকে বের করে দিতে না পারে তার আইনী রক্ষাকবচ রয়েছেতালাকপ্রাপ্ত নারী শুধু বর বা শ্বশুরের গৃহে থাকতে পারবে তাই-ই নয়, সে খোরপোষও পাবে। তার যদি সন্তানাদি থাকে তবে তারাও খোরপোষ পাবে।
মুসলিম ধর্মগুরু ও মুসলিম পুরুষ সমাজের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিল ও বেআইনী করার জন্যে যে খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু তবুও যে কথাটা বলা খুবই জরুরী তা হলো, শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইনকে নিষিদ্ধ করলে মুসলিম নারীদের আখেরে কোনো লাভই হবে না। তাদের অবর্ণনীয় দুঃসহ অবস্থা এখন যেমনটি রয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ হলে অবস্থাটা প্রায় তেমনটাই থেকে যাবে। কেননা, ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বিধিটি মূল তালাক আইনের একটি ধারা মাত্র। ২য় খলিফা ওমর ফারুক এই ধারাটি কোরানের মূল তালাক আইনের সঙ্গে যুক্ত করেন মুহাম্মদের মৃত্যুর ২/৩ বছর পর অনেকের ধারণা যে মুহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত কোরানের মূল তালাক আইনটি নারীর পক্ষে কল্যাণকর ও সুখকর। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, মূল তালাক আইনটি ভীষণ অগণতান্ত্রিক, অমানবিক এবং চরম নারীবিরোধী আইন। যতোই অবিশ্বাস্য শোনাক, কিন্তু এটাই বাস্তব যে ইসলামি আইনে নারীকে তালাক দেবার অধিকার দেওয়া হয়নি। একজন পুরুষ কিন্তু কারণে অকারণে যখন তখন খেয়ালখুশী মতো তালাক অধিকারী। এমনকি একজন বিবাহিত পুরুষের যদি অন্য নারীকে পছন্দ হয় তবে তাকে বিয়ে করার জন্যে সে তার আগের বৌদের  তালাক দিতে পারবে। কোরানের ৪/২০ নং আয়াতে পুরুষের এই অধিকারের কথা স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে। কোরানের সেই অবিশ্বাস্য ভাষ্যটি হলোঃ তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির করো, এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবু তার থেকে কিছু গ্রহণ করো না, তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচরণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে। তালাক আইনের এই বিধি থাকার সুযোগ নিয়েছিলেন মুহাম্মদের আপন জৈষ্ঠ নাতি ইমাম হাসানতিনি মোট একশ’টি বিয়ে করেছিলেন। একদিনে চারজন বৌকে তালাক দিয়ে সেদিনই চারজন নারীকে বিয়ে করার কুৎসিত নজিরও রেখে গিয়েছেন তিনিকোরানের তালাক আইনে পুরুষ তার প্রয়োজনে বা ইচ্ছা হলেই যখন খুশী তালাক দিতে পারবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই, বর যতোই মাতাল, লম্পট, চোর-জোচ্চর, বদমাশ, অত্যাচারী ও নির্যাতনকারী হোক, মুসলিম নারী তালাক দিতে পারবে না। এইগুলো হলো কোরানের তালাক আইনের কয়েকটি নমুনা।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে কোরানে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার বিধান নেই।  
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার যে  আইন প্রণয়ন করতে চলেছে তার ফলে  মুসলিম পুরুষদের তালাক দেওয়ার অধিকারটি মোটেই রহিত বা খর্বিত হচ্ছে না। কারণ,  উক্ত আইনে তিন বারে বা তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার তালাক আইনটি রদ হচ্ছে না। ফলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা রদ করা হলে মুসলিম পুরুষরা তাদের তালাক দেওয়ার পদ্ধতি বা কৌশল পরিবর্তন করবে এবং একসনে তিন তালাক না দিয়ে তিন মাসে তিন তালাক দেবে। ফলে  মুসলিম নারীদের দুর্দশার  লাঘব বিশেষ হবে না।
মূল তালাক আইন বহাল থাকলে বহাল থাকবে ‘হিল্লা বিয়ে’ তথা ‘হালালা বিয়ে’ও। কারণ,  ‘হিল্লা/হালালা বিয়ে’ হলো মূল তালাক আইনের অবিচ্ছেদ্য ধারা বা অংশ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ যোগ্য যে, ‘হিল্লা বিয়ে’ নারীর পক্ষে চরম  অবমাননাকর শরিয়তি আইনে ভুলবশতঃ বা  ক্রোধবশতঃ কেউ তালাক দিলেও রক্ষে নেই, তৎক্ষণাৎ তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ কার্যকরী হয়ে যাবে। পরে সে যদি তালাক প্রত্যাহার করে নেয় এবং তারা উভয়েই যদি  দাম্পত্যজীবন পুনরায় শুরু করতে প্রবল ইচ্ছুক থাকে তবু তা করার ছাড়পত্র শরিয়তি বিধানে নেই। এমনকি যদি তারা ইসলামি মতে পরষ্পরকে বিয়ে করতে চাই তারও অনুমতি নেই। সেক্ষেত্রে বিধিটি হলো এ রকমঃ তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করতে হবে অন্য একজন পুরুষকেবিয়ের পর  সেই পুরুষটিকে অবাধে তার সঙ্গে যৌনক্রিয়া (পড়ুন ধর্ষণ) করতে দিতে হবে। এই যৌনক্রিয়াটি কিন্তু বাধ্যতামূলক, ইচ্ছামূলক বা ঐচ্ছিক নয়। তারপর সেই লোকটি যদি অনুগ্রহ করে তাকে তালাক দেয় তবেই সে তার আগের পুরুষকে পুনরায় বিয়ে করার উপযুক্ত হতে পারবে, নচেৎ নয়। এই জঘন্য বিয়েকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘হিল্লা বিয়ে’ বা ‘হালালা বিয়ে’। আল্লাহর  আইন এমনই যে  পুরুষ যদি ভুল করে  তালাক দেয় তবে তারজন্যেন তাকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না, চড়া মাশুল দিতে হবে নারীকে তারে সতীত্ব ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে এই চরম নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য বিধান কোরানের। ২/২৩০ নং আয়াতে রয়েছে এই বিধানটি। কোরান সেখানে বলছে, “তারপর যদি সে তালাক দেয় তবে এরপর সে তার জন্য বৈধ হবে না যে পর্যন্ত না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করে। এখন যদি সেও তালাক দিয়ে দেয় তাহলে তাদের উভয়ের অপরাধ হবে না যদি তারা পরষ্পরের কাছে ফিরে আসে, - যদি তারা বিবেচনা করে যে তারা আল্লাহর গণ্ডির মধ্যে থাকতে পারবে।” নতুন পুরুষটির সঙ্গে যৌনসঙ্গম করার বাধ্যতামূলক নির্দেশটি রয়েছে হাদিসে। সেই হাদিসটি হলো – “একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞাসিত হন, ‘একটি লোক তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছিলো। অতঃপর সে অন্য লোকের সাথে বিবাহিত হলো। এরপর দরজা বন্ধ করে ও পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে যৌন মিলন না করেই দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিল। এখন কি স্ত্রীটি তার পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে?’ রালুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘না, যে পর্যন্ত না মধুর স্বাদ গ্রহণ করে’ (সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম) (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ১ম-৩য় খণ্ড, পৃ-৬৪২, ৬৪৩)     

পরিশেষে তাই আবার বলতে চাই যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা বা আইনটি রদ ও বেআইনি করা নিশ্চয়ই মোদি সরকারের একটি ঐতিহাসিক কাজ। সেটা এজন্যে যে, চরম নারীবিরোধী  বর্বর তালাক আইনটি  সহস্রাধিক বছর ধরে ভারতীয় মুসলিম সমাজের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে রয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাটি বেআইনী হলে সেই জগদ্দল পাথরটাকে অন্ততঃ একটু হলেও নরানো তো যাবে আর এ কাজটাও তো মোটেই সহজ বা তুচ্ছ কাজ নয়। কিন্তু আবার এটাও চরম বাস্তব যে, এই আইনটি  মুসলিম নারীদের নিরাপত্তা প্রদানে এবং শোষণ ও নির্যাতন লাঘব করতে বিশেষ ফলপ্রসু হয়ে উঠতে পারবে না। কোরানের মধ্যযুগীয় তালাক আইনটির দানবীয় নির্যাতন থেকে মুসলিম নারীদের মুক্তি দিতে হলে সমগ্র তালাক আইনটাই বাতিল করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। 

Monday, November 20, 2017

সৌদি রাজার হাদিস সংস্কারের কর্মসূচী একটি ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ



সমগ্র বিশ্বে এই সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি খবরটি হলো, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাদিস সংস্কারের সিদ্ধান্ত সহিহ হাদিসগুলি খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘কিং সলমান কমপ্লেক্স’ নামে  তিনি একটি কমিটি গঠন করেছেন কমিটিকে দেখতে বলেছেন কোন হাদিসগুলি মুহাম্মদের বাণীর সঙ্গে খাপ খায় না, এবং হিংসা ও হত্যাকাণ্ডকে যথার্থ প্রমাণ করতে মুহাম্মদের বাণীকে বিকৃত করেছে। যে সব হাদিস রক্তারক্তি ও হানাহানির কথা বলে, মহম্মদের বার্তাকে বিকৃত করে সেগুলি তিনি হাদিস থেকে বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রায় বিশ্বাস্য সংবাদটির কথা জানিয়েছেন সৌদির আরবের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। হাদিস থেকে হিংসা ও ঘৃণা মুছে ফেলে একটি হিংসামুক্ত মার্জিত হাদিস তৈরী করার এই উদ্যোগকে বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিমরা নিশ্চয় স্বাগত জানাবেন কারণ, এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই সময়ে সারা বিশ্বে শান্তি, সহবস্থান ও গণতন্ত্রের পক্ষে ইসলাম এবং ইসলামি সন্ত্রাসবাদ একটি বিরাট বড়ো হুমকি রূপে আবির্ভূত হয়েছেসৌদি আরবের এই উদ্যোগে বোধ হয় সব চেয়ে বেশী খুশী হবেন মডারেট মুসলিমরা। কারণ, মুসলিম জঙ্গিদের জিহাদি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে অনৈসলামিক বলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশী সোচ্চার। অবশ্য এ যাবৎ তাঁরা তাঁদের দাবির সপক্ষে জোরালো কোন দালিলিক প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। সৌদি রাজার সৌজন্যে এবার তাঁরা তাঁদের সপক্ষে একটি আস্ত হাদিস পেতে চলেছেন যেটা তাঁরা দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন  
হাদিস মুসলমানদের ২য় ধর্মগ্রন্থ। হাদিস গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরানের প্রায় সমতুল্য। কারণ, হাদিস হলো মুহাম্মদের বাণী ও জীবনাচরণ। তারা মনে করে যে কোরানের মতো হাদিসের প্রতিটি কথা নির্ভুল ও সত্য। তাদের কাছে হাদিসের অসম্ভব গুরুত্বের আরো একটি বড়ো কারণ রয়েছে। সেটা এ রকম কোরানে বহু অস্পষ্ট, অসংলগ্ন ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত আছে যার বাখ্যা হাদিস লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ও প্রশ্নের উত্তর কোরানে পাওয়া যায় না, হাদিসে সেগুলির কিছু কিছু পাওয়া যায়। সেজন্যে বলা হয় যে, ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে মূলতঃ দু’টি প্রধান স্তম্ভের উপর যার একটি কোরান, আর অন্যটি হাদিস। সৌদি আরবে যে সংবিধান চালু রয়েছে তারও প্রধান ভিত্তি হলো এই দু’টি ধর্মগ্রন্থ - কোরান ও হাদিস। এর অর্থ হলো, মুসলমানদের কাছে কোরান যতখানি অপরিহার্য, হাদিসও ঠিক ততটাই অপরিহার্য।
মুসলিমদের নিকট হাদিস অপরিহার্য আর একটি কারণে। সেটা হলোঃ মুহাম্মদ কোরান লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু নিষেধ করেছিলেন হাদিস লিপিবদ্ধ করতে। তথাপি মুহাম্মদের অনুগামী খলিফারা হাদিস সংকলন করার অনুমতি দেন। সেটা এজন্যে যে, মুহাম্মদের পরের যুগে খলিফাগণকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে এমন বহু সমস্যার মুখমুখি দাঁড়াতে হয়েছিলো যার সমাধান সূত্র কোরানে উপলব্ধ হয় নি। সাহাবি ও তাবেয়ী পরবর্তী যুগের খলিফাগণের পক্ষে তাই মুহাম্মদের বাণী ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তখন তাঁরা বিশ্বস্ত ও অনুগত ধর্মগুরুদের হাদিস সংগ্রহ ও সংকলিত করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশানুসারে কতিপয় ধর্মগুরু হাদিস সংগ্রহ করে খলিফার নিকট জমা দেন। খলিফাদের কাছে যে সব হাদিস জমা পড়ে তার মধ্যে ছ’জন ধর্মগুরুর সংগৃহীত হাদিসগুলি সহিহ (সত্য, নির্ভুল ও সঠিক) হাদিস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই হাদিস ছ’টি হলো - সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, জামি’আত তিরমিযি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ।   
উক্ত হাদিসগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হাদিসটির নাম বুখারী হাদিস। বুখারী হাদিস যিনি সংগ্রহ করেন তাঁর জন্ম ১৯৪ হিজরীতে (৮১৬ খৃঃ), অর্থাৎ মুহাম্মদের মৃত্যুর (৬৩২ খৃঃ) ১৮৪ বছর পর। এর অর্থ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর কমপক্ষে ২০০ বছর পর হাদিস হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করা হয়েছিলো। স্বভাবতই এমনটা হওয়া স্বাভাবিক যে বহু সঠিক হাদিস যেমন সহিহ হাদিস থেকে বাদ পড়ে গেছে, তেমনি কিছু ভুল ও জাল হাদিসও সহিহ হাদিসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। শিয়া মুসলমানরা তো এই সহিহ হাদিসগুলির একটিকেও সহিহ হাদিস বলে গণ্য করে না। তারা হাদিসগুলিকে খেলাফতি হাদিস (ফরমায়েশি হাদিস) বলে প্রত্যাখান করেছেন। তাদের মূল অভিযোগ হলো, খলিফাদের নির্দেশে বহু সত্য হাদিসকে বাদ দেওয়া হয়েছে, বহু হাদিসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং বহু জাল হাদিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
হাদিস সম্পর্কে উক্ত অভিযোগগুলিকে মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে যেমন এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি সমস্ত অভিযোগই যে সত্যি ও বাস্তব তাও নয়। ইসলামের ইতিহাস, মুহাম্মদের বাণী ও কর্মকাণ্ড এবং কোরান পর্যালোচনা করলে এটা বোঝা যায় যে, সহিহ হাদিসগুলের মধ্যে কিছু অসত্য ও জাল হাদিস থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে হাদিসগুলি সহিহ হাদিসই। মূলতঃ সে কারণেই প্রায় ১২০০ বছর যাবত এই হাদিসগুলিকে সুন্নি মুসলমানগণ সহিহ হাদিস রূপে গণ্য ও সমাদর করে আসছে এবং সৌদি আরবও এতদিন তাইই করেছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার নব্বই শতাংশই হলো সুন্নি মুসলমান, এবং ৪/৫ টি দেশ বাদে মুসলিম বিশ্বের সবগুলি দেশই সুন্নি মুসলমানদের দেশ। আর এই দেশগুলির শরিয়া আইন রচিত হয়েছে কোরান ও হাদিসের ভিত্তিতেই। সৌদি আরবও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সৌদি রাজা তা হলে এতকাল বাদে হাদিস সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? কোনো সন্দেহ নেই যে এটা একটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। হাদিসের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস, আনুগত্য ও আবেগ এতটাই প্রবল যে এর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিও তৈরী হতে পারে।                                  
তা হলে সৌদি রাজা কেন এরূপ ঝুঁকি নিলেন? এর উত্তর সন্ধান করতে গেলে প্রথমেই আইএস এর হুমকির কথা মনে আসতে পারে। কারণ, আইএস একদিকে যখন ঝড়ের গতিতে সিরিয়া ও ইরাকে তার খেলাফত বিস্তার করে চলেছে, শিয়া মুসলিম-সহ সমস্ত অমুসলিমদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে গলা কাটছে, তাদের বন্দি করে  ক্রীতদাস বানাচ্ছে , বিক্রি করছে, সমস্ত প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ধ্বংস করছে, তখন আর একদিকে আইএস খলিফা আবুবকর আল বাগদাদী ঘোষণা করছেন যে ইরাক ও সিরিয়ার পর তাদের পরবর্তী টার্গেট হলো সৌদি আরব। শুধু আইএস নয়, মিশরের জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডেরও  টার্গেট সৌদি আরব। তাছাড়া আরও বহু মুসলিম জঙ্গি সংগঠন আছে যারা সৌদি আরবকে প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র বলে মানে না। তারা সবাই সৌদি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সৌদি আরবে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর 
সৌদি রাজপুত্রের কাছে এই জঙ্গি সংগঠনগুলিই কি প্রবল ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে? জঙ্গিদের মোকাবিলায় তিনি কি আর শুধু রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর আস্থা রাখতে পারছে না? তার জন্যেই  কি তিনি রাষ্ট্রীয় শক্তির পাশাপাশি তত্ত্বগতভাবেও (ideologically) জঙ্গিদের মোকাবিলা করার কথা ভাবছেন? তাই কি হাদিস থেকে তিনি জিহাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চান?      
এমনটা হওয়া অসম্ভব নয়। জিহাদি সংগঠনগুলি সামরিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে উত্তরোত্তর যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে তাতে ওদের ভয় পাওয়ারই কথা। তবে শুধু জঙ্গিদের ভয়েই সৌদি রাজা হাদিস সংস্কার করতে চাইছেন এমনটা ভাবলে তা হবে অতি সরলীকরণ। জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ভয় পাওয়া  হয়তো একটা বড়ো কারণ, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ মোটেই নয়।
অন্য কারণ নিশ্চয়ই য়েছে। কী সে কারণ তা বোঝার জন্যে সৌদি আরব সরকার সাম্প্রতিক কালে সরকারি নীতি ও আইনে যে পরিবর্তিনগুলি এনেছে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সৌদি সরকার কট্টর ইসলামি নীতি ও বিধিগুলি একে একে পরিত্যাগ করে সেগুলির স্থলে প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন করেছে। এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই পরিবর্তনের এই ধারা চোখে পড়ছে। ২০০৮ সালে সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহ বিন আজিজ সৌদ ভ্যাটিকানে গিয়ে পোপ ষোড়শ বেন্ডিক্টটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পোপ বাদশাকে সৌদি আরবে খৃস্টানদের জন্যে গীর্জা স্থাপন ও ধর্মাচরণ করার অনুমতি দেবার অনুরোধ জানালে বাদশা তাতে তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানান। এই সংবাদে মুসলিম বিশ্ব তখন কেঁপে ওঠেছিল। কারণ, বাদশার পোপের কাছে যাওয়া এবং খৃস্টানদের গীর্জা স্থাপন ও ধর্মাচরণ করার অনুমতি দেওয়া দুটোই স্পষ্টতঃই ইসলামি নীতিবিরুদ্ধ কাজ ও গর্হিত অপরাধ। কারণ, ২য় খলিফা ওমর ফারুক মুহাম্মদের মৃত্যুকালীন অছিয়ত অনুসারে আরব থেকে সমস্ত কাফের ও মুশরিকদের বিতাড়িত ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিকে ধ্বংস করেছিলেন। তারপর থেকেই আরবে অমুসলিমদের ধর্মাচারণ করা ও ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করা চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভ্যাটিক্যান থেকে ফেরার মাত্র তিন বছর পর ২০১১ সালে বাদশার আরো তিনটি সিদ্ধান্ত বিশ্বকে ফের চমকে দেয়। তিনি ঘোষণা করেন - সৌদি নারীকে ভোটাধিকার দেওয়া হবে, তারা ভোটে লড়তেও পারবে এবং মজলিসে শুরার সদস্যও হতে পারবে। ২০১৪ সালে আর এক ধাপ এগিয়ে তিনি নারীর খেলাধূলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। বলা বাহুল্য যে এই পদক্ষেপগুলি সম্পূর্ণ ইসলামি মূলনীতির পরিপন্থী। ২০১৪ সালে সৌদি বাদশা বিদেশীদের অনুকূলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। তা হলো এরূপঃ সৌদি আরবের সংবিধানে বিদেশীদের নাগরিকত্ব ও বসবাসের অনুমতি দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে তিনি সীমিত সংখ্যককে বিদেশীকে স্পেশাল রেসিডেন্সি কার্ড ইস্যু করেন।  
বাদশা আবদুল্লাহর এই বৈপ্লবিক কাজগুলি এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান সৌদি রাজা, তাঁরই সৎ ভাই, সালমান বিন আজিজ সৌদ। তিনি আবদুল্লাহর অসমাপ্ত কাজগুলি যেমন সম্পূর্ণ করছেন একে একে, তেমনি সৌদি নারীকে অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রগুলি আরো কিছুটা প্রসারিত করছেন। যেমন, সম্প্রতি নারীকে গাড়ি চালানো এবং স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার অধিকার প্রদান করেছেন। সর্বশেষ খবর হলো, সৌদি রাজা এবার থেকে মুসলিম নারীদের পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই হজ্বে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছেন।
সৌদি রাজা আবদুল্লাহ বিন আজিজ ও সালমান বিন আজিজ যে পরিবর্তনগুলি এনেছেন সেগুলি শুধু আইনি পরিবর্তন ভাবলে ভুল হবে। এগুলি হলো সৌদি রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। এ সংস্কার তাঁরা করছেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও আধুনিক যুগের অপরিহার্য চাহিদাগুলি পূরণ করার বাধ্যবাধ্যকতায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত প্রতিটি পদক্ষেপই ইসলামি আইন ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সৌদি রাজতন্ত্রের সামনে তাই উভয়সংকট। সংস্কার না করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, আবার সংস্কার করতে গিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠছে ইসলামি আইন ও মতাদর্শ লঙ্ঘনের।
সৌদি রাজার কাছে পরিস্থিতির অপরিহার্য দাবি হলো সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে, আবার ইসলাম লঙ্ঘনের অভিযোগও নস্যাৎ করতে হবে। অর্থাৎ যাবতীয় সংস্কার যে ইসলাম সম্মত পথেই হচ্ছে তা প্রমাণ করতে হবে। সেজন্যেই হাদিস সংস্কার করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর এটাই সৌদি রাজার হাদিস সংস্কারের দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পশ্চাতে প্রধান কারণ। তাই অবশেষে সে পথেই পা বাড়ালেন সৌদি রাজা সালমান বিন আজিজ সৌদ। তাঁর পক্ষে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান রাজার অনুগত হাদিস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়ে সে কাজের সূচনা করলেন। হাদিস সংস্কারের এই কাজটিকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্যে যুবরাজ জানিয়েছেন যে, যে সব হাদিসে মহম্মদের বাণী ও কাজকে বিকৃত করা হয়েছে সেগুলি বাতিল করে একটি বিশুদ্ধ হাদিস তৈরী করা হবে। সৌদি রাজতন্ত্রের লক্ষ্য হলো এমন একটি হাদিস রচনা করা যেটা সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে সাহায্য করবে এবং যারা  হিংসার মাধ্যমে সৌদি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে চায় তাদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।         
১২০০ বছর ধরে যে হাদিসগুলি মুসলিমদের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে তাকে সংশোধন করে মার্জিত ও পরিশীলিত করা খুবই কঠিন কাজ। তবুও সৌদি রাজার এ প্রয়াস সফল হবে বলে মনে হয়। কারণ, এ প্রয়াসের পেছনে রয়েছে রাজার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও রাষ্ট্রের পূর্ণশক্তি। আর এ প্রয়াস যদি সফলকাম হয় তবে সমগ্র বিশ্বেই মুসলিম সমাজে সংস্কারের কাজ অনেকটাই সহজ ও সুগম হয়ে উঠবে।
এ নিবন্ধটি শেষ করবো আর একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করে। সেটা এ রকমঃ উপরে উল্লেখ করেছি যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এমন অনেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে সেক্ষেত্রে কী করণীয় তার উত্তর কোরান দিতে পারে নি এবং তার জন্যে খলিফাগণ অনন্যোপায় হয়ে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করতে বাধ্য হন। কিন্তু খেলাফত চালানোর ক্ষেত্রে কোরানের সীমাবদ্ধতাটাই একমাত্র সমস্যা ছিলো না। সাম্রাজ্যের বিস্তার ও তার সুরক্ষার প্রশ্নে কোরান বহু ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ও প্রতিবন্ধকও হয়ে উঠেছিলো। তাই পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা হেতু খলিফাদেরও ইসলামি নীতির সংস্কার করতে হয়। ইসলামি নীতির সংস্কার করার অর্থ হলো কোরানের আদেশ ও উপদেশের পরিপন্থী আইন-কানুন তৈরী করা ও প্রবর্তন করা। ইসলামি নীতির সংস্কার যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে ২য় খলিফা ওমর ফারুক ও ৩য় খলিফা ওসমান গণিও ছিলেন। ওসমান গণির বিরুদ্ধে মুসলিমদের একাংশ বিদ্রোহ করে এবং বিদ্রোহীরা তাঁকে ৪০ দিন রাজপ্রাসাদে বন্দী রেখে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিলো এই যে, তিনি ইসলামি নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ইসলামি নীতির যে সংস্কার করেন তাকেই বিদ্রোহীরা ইসলাম থেকে বিচ্যুতি হিসবে গণ্য করে। ২য় খলিফা ওমর ফারুক কোরানের তালাক আইনের সংস্কার করেছিলেন। কোরানের আইনে তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার আইন রয়েছে। তিনি সেই আইনে সংযোজনী আনেন যাতে বলা হয়েছে, একসঙ্গে তিন তালাক দিলেও তা বৈধ হবে। ৫ম খলিফা মুয়াবিয়া বহু সংস্কার করে গিয়েছেন। তাঁর করা সবচেয়ে বড়ো সংস্কারটি ছিলো ইসলামি রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন করা। তিনি মজলিসে শুরা ও সৈন্যবাহিনীতে বহু অমুসলিমদের নিয়োগ করেন। উমাইয়া বংশের খলিফা ২য় ওমরকেও সৎ খলিফা মানা হয়। তিনিও অনেক সংস্কার করেন ইসলামি নীতিতে। মুয়াবিয়া যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন করেছিলেন তাকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান খলিফা ২য় ওমর। তিনি অমুসলমান বা বিধর্মীদের ধর্মীয়স্থানগুলোকে (ইহুদিদের ‘সিনাগণ’, খ্রিস্টানদের গীর্জা প্রভৃতি) অত্যন্ত যত্ন সহকারে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। মাঝে মাঝে সেগুলির সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য তিনি অর্থ বা অনুদান বরাদ্দ করেন। এমনকি জিহাদি অভিযানে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের যে ধর্মস্থানগুলি তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে এসেছিল সেগুলি তিনি তাদের হাতে প্রত্যর্পণ করেন। সকল অমুসলমানকে যেমন জিজিয়া কর দিতে হত, তেমনি বিনিময়ে সকল মুসলমানের উপর খারাজ (ভূমিকর) আরোপ করেন। ৭১৮-৭১৯ খৃস্টাব্দে তিনি আইন করে অমুসলমানদের নিকট থেকে জমি ক্রয় করা নিষিদ্ধ করেন। এক সময় তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের ইসলামের মূল নীতি পরিত্যাগ করেন এবং পূর্ববর্তী খলিফাদের সমস্ত সামরিক অভিযান বাতিল করে দিয়ে বিদেশে যে সব সেনাপতি রাজ্য বিস্তারে ব্যাপৃত ছিলেন তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ইসলামি রাষ্ট্রে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এক সময় খলিফাদের হাত ধরেই এসেছিলো মুতাজিলা নীতি। মুতাজিলা নীতির মূল কথা ছিলো, মানুষের যুক্তিভিত্তিক চিন্তার ফসলগুলি কোরানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
মূল কথা হলো, মুহাম্মদের মৃত্যুর কয়েক বছর যেতে না যেতেই খলিফাদের হাত ধরেই ইসলামি নীতি ও আইনের সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিলো। এবং রাষ্ট্র ও সমাজের অগ্রগতি ও বিকাশে কোরান যখনই অপ্রাসঙ্গিক ও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে তখনই খলিফাগণ সচেতনভাবেই কোরানের আইনের সংস্কার করেন এবং নতুন নতুন আইনকানুন তৈরী ও প্রবর্তন করেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন চুপিসারে, কোরানে অনেক জাল আয়াত ঢুকে গেছে বা কিছু আয়াতকে বিকৃত করা হয়েছে এমন অভিযোগ তাঁরা কেউ আনেন নি। সৌদি আরবেও ইসলামি নীতি ও আইনের সংস্কারের কাজটি এতদিন চুপিসারে হচ্ছিলো। এবার সৌদি রাজা সালমান বিন আজিজ সৌদ সংস্কারের কাজটি করতে চাইছেন সোচ্চারে।    

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...