Sunday, February 2, 2014

সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি যেন ভারতীয় উপনিবেশ


যাঁরা আমাদের রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস করেন তাদে কতটা মানবেতর জীবন যাপন করতে হয় তা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারবো না । তাঁদের মানবাধিকারগুলি লঙ্ঘিত হয় প্রতি পদ পদে    তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা নেই তিল পরিমাণও পদে পদে লঙ্ঘিত হয় নারীর শ্লীলতা ধর্ষণের শিকার  হতে হয় নারীকে প্রায়শঃই বালিকা কিংবা স্কুলছাত্রী হলেও রেহাই নেই,  স্কুলছাত্রী  হলে বরং শ্লীলতা হানি হওয়ার বিপদটা অধিকই থাকে । আর পাঁচটা মানুষের মতো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের রুজি-রোজগার করার স্বাভাবিক, আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলি তাদের একেবারেই নেইকখন এসে ধরে নিয়ে যাবে, কিংবা কখন  রাইফেলের গুলি এসে বুক ঝাঁঝরা করে দেবে সে ভয়ে সকলেই আতঙ্কে থাকে, গুটিয়ে থাকে । এ ভয় শুধু বড় মানুষদেরই নয়, ভয়ে অস্থির ছোটরা এমনকি স্কুল ছাত্ররা খেলাধূলা করবে বা আনন্দে হৈ  হৈ করতে বনভোজন করবে নিশ্চিন্তে তারও জো নেই, তাদেরও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয় গ্রেপ্তারের ভয় - কখন এসে যে ধরে লাঠি বা রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাবে সেই ভয়, ভয় রাইফেলের গুলিরওযদি ধরে,  নির্দয়ভাবে প্রহার করে হাত-পা ভেঙে ছেড়ে দেবে তা নাও হতে পারে, ভয় থাকে পিটিয়ে পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যা করে নদীর জলে ফেলে দেওয়ার । ওরা সব পারে । করেও । এভাবে কতজনকে ওরা হত্যা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই । ওরা অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দেবে, ওটা ওদের অধিকার; ওরা যাকে তাকে গ্রেপ্তার করে নির্দভাবে পেটাবে, ওটা ওদের অধিকার; ওরা মনের আনন্দে গুলি করে বনের পাখি শিকার করার মতো মানুষ শিকার করবে, ওটা ওদের অধিকার; ওরা নারীর শ্লীলতা হানি করবে, ওটা ওদের অধিকার; ওরা আনন্দ করার জন্যে নারী ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে ধর্ষণ করবে, ওটা ওদের অধিকার । ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা চলে না, কেউ শোনেও না, কারণ ওগুলি যে ওদের অধিকার ! তাই ওদের কোনো অপরাধের বিচার হয় না, ফলে শাস্তি হয় না  ওরা কারা ? ওরা সীমান্ত অঞ্চলের অঘোষিত সম্রাট ।  ওরা আমাদের দেশের মহান সন্তান (!),  কারণ ওরা আমাদের দেশের সীমান্ত রক্ষার মহান কাজে ও ব্রতে (!) অতন্দ্র প্রহরীওদের গালভরা নাম  সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (BSF)
  না, একটুও অতিরঞ্জিত নয় । সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের জীবিন-যাপনের রোজনামচা র চেয়েও ভয়ঙ্করদুঃসহ । কি রকম সেই যন্ত্রনা তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন অনেকেই । তাঁদেরই একজন সুলতা মন্ডল মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর  থানার সীমান্ত অঞ্চলের চর দুর্গাপুর গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের এক রমণী । তাঁর জীবনের সর্বস্ব লুঠ হওয়ার বর্ননা দিতে  গিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না,  বারবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন । আমি যে অচেনা অজানা একজন পুরুষ মানুষ সেটা তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো তাঁর ভিতরের জমাট বাঁধা পুত্র হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা । কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে ফেললেন, তারপর আমার জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা দিয়ে কাঁদতে থাকলেনকান্না  থামে না অনেকক্ষণ আমি, আমরা সবাই  বোবা ও বিহ্বল হয়ে গেছি, সান্ত্বনা দেবার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি  সুলতা মন্ডল জানালেন, ওঁর ছেলে রাজু মন্ডল, দশম শ্রেণীতে পড়তো, গিয়েছিল চারজন বন্ধু মিলে বনভোজন করতে  ওরা এত গরীব যে ওদের মধ্যেকার একজন অর্থাভাবে পড়া ছেড়ে দিয়েছিলোঐ চার জনের মধ্যে একজন ছিলো আরো ছোট, সপ্তম শ্রেণীতে পড়তো ২০১২ সালের ১লা জানুয়ারীর ঘটনা  বনভোজন করতে গিয়ে ওরা আর ফিরে আসে নি । বি.এস.এফ ওদের তুলে নিয়ে গিয়ে  নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ক্যাম্পের পাশের নদীতে ডুবিয়ে দেয় । ওদের পরিবারের লোকজন কেউ প্রথমে সে খবর টেরও পা নি । পরে জানতে পারেন যে ওদেরকে বি.এস.এফের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছে । খবর পেয়ে  ক্যাম্পে  গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে বি.এস.এফের লোকেরা  ওদের সঙ্গে হাসি-মস্করা করে ।  সেই অভিশপ্ত নদীতে তল্লাশীর জন্যে অনুমতি চায় নিখোঁজ ছেলেগুলির পরিবারের লোকজন । তখন ওরা হাসতে হাসতে মজা করে বলে হিন্দিতে, যাও যাও, দেখো, দু-চারটা মাছ হয়তা পেয়েও যাবে । হ্যাঁ, সত্যি পাওয়া গিয়েছিল । তবে মাছ  নয়, পাওয়া গিয়েছিল নিখোজ ঐ চারজন নাবালক ছাত্রের মৃত নিথর দেহ । কার দেহ পাওয়া গিয়েছিল দু দিন প,  কারও তিনদিন পর, কারও বা চারদিন পর । রাজু ছাড়া আর যারা ছিলো তাদের নাম  সুনীল মন্ডল (চর দুর্গাপুর), সুকুমার মন্ডল (হারুডাঙ্গা) এবং বাবু সেখ (চর বাঁশগাড়া) । গ্রামগুলি সব পাশাপাশি । পুত্রশোকে কাতর সুনীল মন্ডলের মা ব্রাহ্মণী মন্ডল এবং সুকুমার মন্ডলের মা ভানুমতি মন্ডলও সুলতা মন্ডলের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলেন অনেকক্ষণ । কি হৃদয় বিদারক দৃশ্য ! সে দৃশ্য দেখে  হলভর্তি মানুষ (সবাই সীমান্ত অঞ্চলের  বি.এস.এফের অত্যচার ও নির্যাতনের শিকার ) সবাই নিস্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন ।  গোটা পরিবেশ হয়ে উঠেছিল এত ভারী ও শোকাবহ যা ভাষায় বর্ণনার অতীত বাবু সেখের কথা বলতে এসেছিলেন তার বাবা মুসিদল সেখ । তাঁকে দেখে বুঝেছি যে তিনি পুত্র হারানোর প্রবল সেই শোক ও যন্ত্রণায় এখনও কত কাতর
 এত বড় নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ! তবু হত্যাকারীদের  বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে  বা আদালতে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয় নি । হয় নি দুটি কারণে – এক) ভয়, আরও অত্যাচার ও নির্যাতনের ভয় এবং  দুই) অজ্ঞতা ,  বি.এস.এফের বিরুদ্ধে কেস করা যায় এবং  তাদেরকেও বিচারের আওতায় এনে  শাস্তি দেওয়া  সম্ভব – এটা তাদের জানাই ছিল না ।  জিজ্ঞাসা করি – এখানে কেন এসেছেন ? এখন কী চান ?  বললেন – আমরা বিচার  চাই, ওদের কঠিন শাস্তি চাই, ক্ষতিপূরণ চাই । এতদিনে ভয় অনেকটাই  ভেঙেছে, বললেন -   বি.এস.এফ যা করে করুক আমরা ওদের বিরুদ্ধে কেস করতে চাই আপনারা যদি আমাদের পাশে এগিয়ে আসেন ও সাহায্য করেন
এসেছিলেন রাণীনগর থানার হারুডাঙ্গা চরের মজেম সেখ ও তাঁর স্ত্রী । একদা সুস্থ সবল মজেম এখন পঙ্গু প্রায় । ১৬/১৭ বছরের অসুস্থ মেয়ের জন্যে ঔষধ কিনতে গিয়েছিলেন । বিএসএফের লোকেরা পাচারকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে তাঁর উপর । আঘাত এত গুরুতর হয় যে তাঁকে থানায় নিয়ে গেলে পুলিশ নিতে অস্বীকার করে । বিএসএফ তখন হাসপাতালে ভর্তি করে ।    একটু সুস্থ হলে দু দিন পর আবার থানায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে গরু পাচারের কেসে দেয় । মজেম কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ফিরে আসেনতারপর চিকিৎসা করিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেন নি ।  মজেম ঘটনার কয়েকদিন পর সংস্লিষ্ট বিএসএফের ফোর্সের  বিরুদ্ধে মাসুম (একটি মানবাধিকার সংগঠন)- এর সাহায্য নিয়ে থানায় কেস করতে গেলে পুলিশ নিতে অস্বীকার করে । পরে বাধ্য হয়ে তিনি কোর্টে কেস ফাইল করেন ।  
এদিকে  অসুস্থ মেয়েটি ঔষধের অভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বাবাকে ঐ ভয়ঙ্কর রকম আহত অবস্থায় দেখে তার তার মনে যে চাপ পড়ে তা সহ্য করতে পারে না । কয়েকদিন পরেই সে পেরে মারা যায় । হ্যাঁ, মেয়েটি বাবার কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই মারা গেছে বলে মেয়েটির বাবা ও মায়ের ধারণা বলে তাঁরা আমাদের জানালেন । মজেম সেখ শুধু শারিরীকভাবেই পঙ্গু হন নি,  বিএসএফের নৃশংস অত্যচারের  সেই বিভিষীকা, শরীর অকেজো হয়ে যাওয়া এবং চোখের সামনে প্রাণাধিক মেয়ের অকালে চলে যাওয়া – এসব আঘাতে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন । এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে মানসিক রোগের চিকিৎসকের চিকিৎসা ছাড়া তাঁর পক্ষে সুস্থ হওয়া অসম্ভব । কিন্তু কীভাবে চিকিৎসা করাবেন ? সে সাধ্য তাঁদের নাই ।
অনুপমা মন্ডল, পুত্র শোকে কাতর এক মা, এসেছিলেন তাঁর গভীর যন্ত্রণার কথা শোনাতে আমাদেরকে । রাণিনগর থানার বর্ডার পাড়ার বাসীন্দা অনুপমা জানালেন যে তাঁর ১৭ বছরের পুত্র সুমন্ত মন্ডল ওঁদের নিজের জমিতে তিল (এক প্রকার শষ্য) গাছ কাটছিল সকাল ৯ টার সময় ।  BSFএর লোকেরা এসে   তাকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় । তার উপর প্রচন্ড অত্যাচার করে । ফলে সে মারা যায় । তার শরীরে ছুরির কতকগুলি আঘাত ছিলোBSF কিন্তু সুমন্ত এনকাউন্টারে মারা গেছে বলে জানায় পোস্ট মর্টেম করার আগে বহরম জেনেরাল হাসপাতালে (জেলা সরকারী হাসপাতাল ) গিয়ে BSF চাপ দেয় যে রিপর্টে উল্লেখ করতে হবে যে গুলির আঘাতে সুমন্তর মৃত্যু হয়েছে ।  দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার বাবু মৃতদেহের শরীরে গুলির ক্ষত না দেখতে পেয়ে পোস্ট মর্টেম করতে অস্বীকার করেন বহরম হাসপাতাল মৃতদেহে ফেরত  দিলে বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পোস্ট মর্টেম করানো হয় । সুমন্তর মৃতদেহটি রাণীনগর থানা থেকে বহরমপুর, বহরমপুর থেকে বর্ধমান এবং  বর্ধমান থেকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে এ্যআম্বুলেন্সের যাবতীয় খরচ বহন করতে হয় অনুপমা মন্ডলের পরিবারকে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সুমন্ত যখন মারা যায় তখন সে নবম শ্রেণীতে পড়তো । 
জলঙ্গী থানার খাসমহল গ্রামের খেটে খাওয়া একেবারেই দরিদ্র একটা মানুষ নৃসিংহ মণ্ডল । তিনি ছিলেন সুস্থ-সবল মানুষ, এখন পঙ্গু । পঙ্গু করে দিয়েছে BSF –এর জওয়ানরা ।  নৃসিংহ মন্ডল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন জ্বালানীর কাঠ সংগ্রহ করতে, রাস্তা থেকেই ঐ জওয়ানরা পাচারকারী সন্দেহে ধরে নিয়ে যায় । ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে কড়ি কাঠে ঝুলিয়ে নির্মম ও নৃশংসভাবে প্রহার করেপ্রহারের ফলে নৃসিংহ মণ্ডল অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে পাশের একটা বাগানে নিয়ে গিয়ে ফেলে চলে যায় । জওয়ানরা এত প্রহার করেছিলো যে পা দুটোই অকেজো হয়ে গেছেঘটনাটি ঘটেছে প্রায় তিন বছর আগে । ঘটনার ১৫/১৬ দিন পর মাসুমের সহায়তা পেলে  সংস্লিষ্ট জওয়ানদের বিরুদ্ধে জলঙ্গী থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন, কিন্তু পুলিশ কোনো পদক্ষেপ করে না ।  শারিরীকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ফলে নৃসিংহ মন্ডল একেবারে ভেঙে পড়েছেন মানসিকভাবেও, এতটাই বিধ্বস্ত যে প্রায় বোবার মত শুধু চুপচাপ বসে থাকেন সব সময় । তাঁর জীবনের এই ঘটনাগুলি আমাদের শোনালেন তাঁর পত্নী, তিনি সর্বক্ষণ প্রায় নীরবই থাকলেন ।  
রাণীনগর থানার চর রাজাপুর গ্রামের একজন তরুণ, স্মরজিত মন্ডল সন্ধ্যা ৭ টায় তাদের নিজেদের গরু নিয়ে ঘরে ফিরছিল । সে সময় একদল পাচারকারী মোষ পাচার করছিল । BSF –এর জওয়ানরা ওদের ধাওয়া করলে ওরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । জওয়ানরা ওদেরকে ধরতে না পেরে স্মরজিতকে ধরে নিয়ে যায় । ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে গুলি করে । পাঁচটি গুলির ক্ষত ছিল দেহে । বছর চার পূর্বের ঘটনা । বাবা সুধীর মন্ডল যখন শোনাচ্ছিলেন সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা তখন তাঁর গলা ধরে আসছিল, ভিতরের দলা পাকিয়ে থাকা পুত্র শোকের যন্ত্রণা বোধ হয় ঠেলে উপরে আসতে চাইছিলো ।
রাণীনগর থানার কাহার পাড়া বাজার সংলগ্ন একটা গ্রাম থেকে এসেছিলেন একটি অল্প বয়সী মেয়ে, ওর নাম বানুয়ারা । এই বয়সেই BSF –এর কল্যাণে মেয়েটি বিধবা, ওর নাম এখন এখন বানুয়ারা বেওয়াওর স্বামী, বাবুকে কাহার পাড়া বাজার থেকে BSF –এর জওয়ানরা ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিকভাবে প্রহার করে । প্রহারের ফলে মারা গেলে পাচারকারী বলে কেস সাজাবার জন্যে মৃতদেহে গুলি চালায় ।
রাণিনগর থানার পুরাতন দীঘি গ্রামের ইউনুস সেখও এসেছিলেন তাঁর পুত্র হারানোর শোক ও ব্যাথার কথা শোনাতে । তাঁর কুড়ি বছরের প্রাণ-চঞ্চল ছেলে ইয়াদুল সেখকে চিরদিনের মতো কেড়ে নিয়েছে  BSF –এর জওয়ানরা । অভাবের সংসার, সিংসার চালানোর মতো কাজ জোটেনা, ছেলে তাই জড়িয়ে পড়েছিলো পাচারের কাজে – স্বীকার করলেন লজ্জা ও দ্বিধা মিশ্রিত গলায় । রাত তখন তিনটা, ভোরের আলো ফোটার আগেই চেয়েছিলো কটা গরু পাচার করে দুটো পয়সা রোজগার করতে, BSF –এর গুলিতে লুটিয়ে পড়ে, ভোরের আলো ওর আর দেখা হয় নি । ধরা ও কাঁপা গলায় ইউনুস আমাদের জানালেন যে ইয়াদুল হাইস্কুলে পড়তো,  অভাবের তাড়নায় ওর পড়া বন্ধ হয়ে গেলে পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়ে ।
সুলতা মন্ডল, অনুপমা মন্ডল, নৃসিংহ মন্ডল, সুধীর মন্ডল, বানুয়ারা বেওয়া, মুসিদুল সেখ, ইউনুস সেখ প্রমুখ প্রান্তিক মানুষগুলো সংখ্যায় হাজার হাজার হলে কি হবে, ওরা অসহায় । ওদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই । অথচ অত্যাচারী, নিষ্ঠুর ও বর্বর প্রকৃতির BSF জওয়ানগুলোর পাশে সবাই আছে । ওদের হাতে একদিকে আছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, আছে তা যথেচ্ছ ব্যবহার করার অপরিসীম ক্ষমতা, অপরদিকে ওদের পাশে আছে প্রধান মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, সংসদ ও বিধানসভা সহ গোটা রাষ্ট্র যন্ত্রটাই । তাই ওরা যাকে খুশী যখন খুশী গ্রেপ্তার করতে পারে, নিগ্রহ করতে পারে,  নির্বচারে গুলি চালাতে পারে এবং তারপরেও দেশ রক্ষার মহান (!) কাজে স্বপদে বহাল থাকতে পারে । আর যাঁরা মার খান, গাল খান, গুলি খান রোজ, তারপরেও নিরুপায় পড়ে থাকেন ঐ সীমান্ত অঞ্চলেতাঁরা পড়ে থাকেন অসহায় অবস্থায়, তাঁদের পাশে  থাকে না কেউ । ভোটের সময় সব দলের লোকেরা আসে, নানা প্রতিশ্রুতি দেয়, ভোট ফুরিয়ে গেলে কেউ আর আসে না । শুধুই কি  BSF –এর সীমাহীন অত্যাচার ? না, তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরো হাজারো সমস্যা । রাস্তাঘাট নাই, রেশন কার্ড নাই, রেশন দোকান নাই, বিপিএল নাই, বার্ধক্য-ভাতা নাই, বিধবা ভাতা নাই, বেকার-ভাতা নাই, ১০০ দিনের কাজ নাই, স্বাস্থ কেন্দ্র নাই, পর্যাপ্ত স্কুল নাই – শুধু নাই আর নাই । নাই বেঁচে থাকার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাও । সীমান্ত অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষেরা সবাই যেন ভয়ঙ্কর এক নেই রাষ্ট্রের বাসীন্দা । ওঁদের কিছু না থাকলেও একটা জিনিষ কিন্তু সকলেরই আছে , তা হলো ‘ভোটার কার্ড’এটা তো ওদের কাছে থাকতেই হবে । কারণ ওটায় ওদের যা স্বার্থ আছে তার থেকে অধিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর, নেতা-নেত্রীদেররাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ওরা তো মানুষ নয়, ওরা তো স্রেফ ভোটার, ওরা ভোট-ব্যাঙ্ক । সুতরাং অন্য জিনিষগুলো  না থাকলেও চলবে, কিন্তু ভোটার কার্ড না থাকলে তো চলে না । তাই রাজনৈতিক দলের দাদা-দিদিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সকলের ভোটার কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছে
       সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলো ও সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিরা কেউই ওঁদের সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবিত নয়, কেউই তাঁদের পাশে দাঁড়ায় না ।  ওঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলার একটি মানবাধিকার সংগঠন যার নাম ‘মাসুম’ ( মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ) মাসুম একদিকে BSFপুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যে তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছে,  প্রতিকারের জন্যে আইনী পরামর্শ দিচ্ছে, তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করছে ও আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে উৎসাহ দিচ্ছে, সাহস যোগাচ্ছে, অপরদিকে তেমনি রেশন কার্ড, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, মিড ডে মিল, কম পয়সায় বা বিনা পয়সায় প্রাপ্য খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি যা তাঁদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সেগুলি যাতে তাঁরা অর্জন করতে পারে তার জন্যে কাজ করছে ।  মাসুম আর একটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ করছে তা হলো, সীমান্তবর্তী প্রান্তিক মানুষগুলোর উপর প্রতিনিয়ত যে সব অত্যাচার-অনাচার সংগঠিত হয় সেগুলি প্রশাসন, প্রচার মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংগঠন সংস্থাগুলির কাছে তুলে ধরছে অবিরাম । তারজন্য ঠিক কী ধরণের ও কী মাত্রায় BSFপুলিশের অত্যাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে এবং সরকারী স্তরে সীমান্তের মানুষগুলো কিরূপ প্রবঞ্চনার শিকার তার সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে মাসুম সীমান্তাঞ্চলে নিবিড় সমীক্ষা ও তথ্যানুসন্ধানের কাজ করে থাকে ।  সেই উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি, গত ৭ই ও ৮ই ডিসেম্বর একটি বিশেষ তথ্যানুসন্ধান অভিযান (Fact findings mission) সংগঠিত করে । প্রাক্তন বিচারপতি, সমাজকর্মী, লেখক, ডাক্তার(সাইক্রিয়াটিস্ট),  মানবাধিকার কর্মী প্রভৃতি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল একট তথ্যানুসন্ধান দল । মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা সদর বহরমপুরে তথ্যানুসন্ধানের এই বিশেষ অভিযানটি সংগঠিত করা হয় যেখানে সীমান্তবর্তী এলাকার বিভিন থানা থেকে হাজির হয়েছিলেন নানাভাবে অত্যাচারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত ১৮০০ মানুষ যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যায় ছিলো ব্যাপক সংখ্যায় । এই বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ৫৮জন ক্ষতিগ্রস্থ পুরুষ ও নারী তাঁদের ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন তথ্যানুসন্ধান দলের কাছে । তাঁদের সেই ভয়ঙ্কর এবং মর্মস্পর্শী বিবরণ থেকে মাত্র কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে উপরে ।
শুধু BSF জওয়ানদের লাঠিগুলি, খিস্তিখেউরই নয়, রাজ্য পুলিশের লাঠিগুলি ও খিস্তিখেউরও কম খেতে হয় না সীমান্তের হতভাগ্য মানুষগুলকে । পুলিশের অত্যাচারের ভয়াল কাহিনী বর্ণনা করেছেন লালগোলা থানার  নাটাতলা গ্রামের অল্প বয়সী এক নারী মারুফা বেওয়া । মারুফার পতি কেতাবুল একজন সামান্য ট্রাক ড্রাইভার ছিলেন লালগোলা বাজারে তাঁকে চোর সন্দেহে লোকজন মারধর করে, তারপর পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে তার উপর অকথ্য ও অমানবিক অত্যাচার চালায় । একদিন পর তাকে কোর্টে তোলা হলে বিচারক কেতাবুলের শারিরীক করুণ অবস্থা দেখে হাসপাতালে ভর্তির আদেশ দেন কেতাবুলের অবস্থা পুলিশী নির্যাতনে এতই সঙ্গীন হয়ে পড়েছিল যে বহরম পুর জেলা সদর হাসপাতাল তৎক্ষণাৎ কলকাতা পাঠিয়ে দেয় । কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করলে তিনি সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন । ফলে মারুফা অকালে বিধবা হয়ে একটি নাবালক সন্তান নিয়ে অকূল পাথারে ভাসতে থাকেন
 BSF ও পুলিশের লাঠিগুলির বীভৎস অত্যাচার ছাড়াও আরও নানাবিধ জুলুমের শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত সীমান্তের খেটেখাওয়া মানুষদের । এ সব জুলুমের ফলে তাঁরা নিজের জমিতেও  স্বাধীনভাবে চাষবাস করতে পারেন না, ফলে তাঁদের জীবন-যাপন ও জীবন-জীবীকাকে প্রতি পদে পদে ব্যহত হয় BSF ক্যাম্প করে বসে আছে সীমান্তাঞ্চল থেকে ভারত-ভূখণ্ডের ৮/১০ কিলোমিটার ভিতরে । সীমান্তাঞ্চল থেকে BSF ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তীর্ণাঞ্চলে যে আবাদি জমিগুলি রয়েছে সেখানে জারি রয়েছে স্থায়ীভাবে ১৪৪ ধারা । সেই জমিতে চাষাবাদ করতে BSF – এর অনুমতি লাগে । চাষাবাদের জন্যে BSF সারাদিনে মাত্র ৬ ঘন্টা সময় বরাদ্দ করেছে অনুগ্রহ করে – সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত । যেদিন আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে সেদিন চাষবাস সহ সকল কাজকর্মে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয় । BSF ক্যাম্পে ৮টায় পরিচয় পত্র (ভোটের আই কার্ড) হাতে নিয়ে লাইন করে দাঁড়াতে হয়, স্বভাবতই লাইন দীর্ঘ হয় যার ফলে প্রচুর সময় নষ্ট হয় এবং যেহেতু দুপুর ২টার মধ্যেই ক্যাম্পে ফিরতে হবে তাই দুপুর একটা-দেড়টার মধ্যেই কাজ গুটিয়ে চলে আসতে হয় । ফলশ্রুতিতে তাঁরা সারাদিনে কাজ করার সময় পান গড়ে পাঁচ ঘন্টা । এর ফলে চাষী ও ক্ষেতমজুরদের রুজি-রোজগার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
উক্ত নিয়মের কারণে আর্থিক ক্ষতিই শুধু হয় না; নানারকম হয়রানি, খিস্তিখেউর এবং এমনকি নারীদের শ্লীলতা হানিরও শিকার হতে হয় । ক্যাম্পে ভোটার আই কার্ড জমা দিয়ে যেতে হয় ভিতরে যাবার সময় । চাষবাস ও অন্যান্য কাজকর্ম সেরে ফেরার পথে সেই কার্ডটা ফেরৎ পাওয়ার কথা । কিন্তু মাঝেমধ্যে এরূপ অবাঞ্ছিত ঘটনাও ঘটে যে অনেকেই কেউ কেউ তাঁর ঐ কার্ডটা ফেরৎ পেলেন না । এঁর কার্ড ওঁকে ওঁর কার্ড এঁকে দিয়ে দেওয়া হয়, ফলে যে যাঁর নির্দিষ্ট কার্ড ফেরত পায় না । ভোটার আই কার্ড পুনরায় বের করা অত্যন্ত কঠিন কাজ তা বলা বাহুল্য এবং কার্ড না থাকলে কাউকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না । তাই কার্ড হারিয়ে যাওয়া সীমান্তের মানুষদের কাছে শুধু একটা কঠিন সমস্যাই নয়, তাঁদের জীবন-জীবীকাও বিপন্ন হয়ে ওঠে । তবুও  BSF জওয়ানরা এ কাজটি করার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেন না । বরং হারিয়ে যাওয়া কার্ডটি উদ্ধারের জন্যে একবারের বেশী দুবার অনুরোধ করলে বিরক্ত হয়, ক্রুদ্ধ হয় এবং খিস্তিখেউর করে ।
কার্ড জমা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার সময় জানাতে হয় কি কাজে যাওয়া হবে । সেটা BSF জওয়ানরা তাঁদের খাতায় লিপিবদ্ধ করেন । পরের দিন কেউ যদি অন্য কাজে যাবেন বলে তবে তাঁকে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয় না । অথচ মানুষকে নানা কাজে যেতে হয়, সে কথা BSF মানতে চায় না যাঁরা মৎস্যজীবী তাঁদের সমস্যা সর্বাধিক । মাছ ধরার কাজে সাধারণতঃ হয় রাত্রি বেলায় । কিন্তু যেহেতু কাজের সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তাই মৎসজীবীদের জীবীকা বিপন্ন হয়ে ওঠছে প্রায় ।
মেয়েদের মধ্যেও অনেককেই মাঠে যেতে হয় জীবীকা অর্জনের জন্যে । তাঁরা যখন কাজ সেরে ফিরে আসেন তখন দেহ তল্লাশীর নামে তাঁদের গায়ে হাত দেওয়া হয় । এভাবে নারীদের শ্লীলতা হানির কাজ চলে অবাধে, প্রতিবাদ করলে জোটে প্রহার ও খিস্তিখেউর ।
সীমান্তের মানুষরা আমাদের শুনিয়েছেন সরকারী ও পঞ্চায়েতের স্তরে নানারূপ প্রবঞ্চনার কথা । রাস্তাঘাট ও পানীয়জলের ব্যবস্থা খুবই অপর্যাপ্ত । নেই কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র । বিস্তীর্ণ চর এলাকা ও পদ্মা নদী পেরিয়ে তারপর আরও ৭/৮ কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করে তবে সরকারী হাসপাতালে যেতে হয় । ফলে গুরুতর কোনো পীড়া বা গর্ভবতী নারীদের প্রসব সঙ্ক্রান্ত কোনো পীড়া হলে হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বে পথমধ্যেই রুগীকে অকাল মৃত্যুর  কবলে পড়তে হয় । শিক্ষার অধিকার আইন’২০০৯ চালু হয়েছে, কিন্তু সীমান্তের মানুষগুলো যেন ভারতের নাগরিক নয় । বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চলে কলেজ তো দূরের কথা, নেই হাই স্কুলও । সম্প্রতি কয়েকটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (MSK) স্থাপিত হয়েছে যা অতিশয় অপর্যাপ্ত । প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যাও ভীষণ কম । নেই পর্যাপ্ত ‘শিশু শিক্ষা কেন্দ্র’ ও ‘অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র’ । এর ফলে সীমান্তের মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে ব্যাপক মাত্রায় বঞ্চিত বাকি ভারতের মানুষের তুলনায় ।  কয়েকটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র  সম্প্রতি স্থাপিত হলেও তার সুযোগ মেয়েরা নিতে পারে না । কারণ সে সব শিক্ষা কেন্দ্রে যেতে হলে অনেকটা পথ যেতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এবং সে ক্ষেত্রে ভয় থাকে  BSF জওয়ানদের সামনে পড়ার । ঐ জওয়ানরা নানা অজুহাতে স্কুল ছাত্রীদের হয়রানি করে থাকে এবং শ্লীলতা হানিরও ভয় থাকে । এবং এমনকি  ধর্ষিতা যে হতে হবে না তার নিশ্চয়তা থাকে না ।  
সীমান্তের বহু মানুষের রেশন কার্ড পর্যন্ত নেই । অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা মানুষ , কিন্তু BPL কার্ড তাঁদের নেই । স্বভাবতই অন্তোদয় সহ অন্যান্য সমাজকল্যাণ মূলক কর্মসূচীর অন্তর্গত সুযোগ-সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত । বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা থেকেও তাঁরা কার্যত বঞ্চিত । একশ’ দিনের কাজ থেকেও প্রায় বঞ্চিত । এভাবেই সকল দিক থেকেই তাঁরা এত বঞ্চিত যা বলে শেষ করা যাবে না , যেমন বলে শেষ করা যাবে না তাঁদের উপর BSF ও পুলিশের অকথ্য নৃশংশ, নিষ্ঠুর ও অমানবিক অত্যাচারের কাহিনী ।
দেখেশুনে যা বুঝেছি (Observation) ঃ-
নিরাপত্তা
এক) সীমান্তের মানুষদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই ।  BSF ও পুলিশের  রাইফেল মাঝেমধ্যেই  ঝলসে ওঠে এবং তার ফলে অকারণে বহু তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে । এ ক্ষেত্রে BSF - এর গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশী এবং BSF  মানেই আতঙ্ক
দুই) শুধু চোরাচালানকারীরাই নয়, নিরাপরাধ মানুষদেরও BSF - এর গুলিতে প্রাণ গিয়েছে এমন নজিরের অভাব নেই ।
তিন)  চোরাচালানকারী-নিরপরাধ নির্বিশেষে অনেকেরই মৃত্যু ঘটেছে BSF ও পুলিশের  হেফাজতে ।
চার)  BSF এ পর্যন্ত যত গুলি চালিয়েছে তার সবই বিনা প্রয়োজনে ও কারণেচোরাচালান প্রতিহত করা কিংবা চোরাচালানকারীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে গুলি চালাতে হয়েছে এমন কোনো ঘটনার নজির পাওয়া যায় নি ।
পাঁচ)   লাঠির প্রহারে বা বন্দুক-রাইফেলের গুলিতে আহত মানুষদের চিকৎসা দেওয়া হয় না । ফলে এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছে যে ঐরূপ আহত মানুষগুলোকে চিকিৎসা না দিয়ে দিনভর ফেলে রেখে মৃত্যুর দিকে নির্মমভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং যন্ত্রণায় কাতর মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ BSF ও পুলিশের  লোকেরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে ।
ছয়)   BSF এর বল্গাহীন অত্যচার দেখেশুনে মনে হয় মানুষকে প্রহার করা ও হত্যা করাটাকে যেন ওরা   মজার একটা খেলা মনে করে ।  খেলার ছলে যেন ওরা মানুষকে নির্মমভাবে পেটায় ও গুলি করে এবং প্রাণভরে উপভোগ করে ।
সাত)   মানুষ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতে পারে  চোরাচালানকারী, হত্যা করে কোথাও ওদের জবাবদিহি করতে হয় না এবং বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না । বিনা কারণে মানুষ হত্যা করে কিংবা নারী ধর্ষণ করেও স্বপদে বহাল তবিয়তে চাকরি করে এবং তারপরেও হত্যালীলা ও নারী ধর্ষণের মতো অপরাধ করে যেতে থাকে ।
নারীর মর্যাদা ভুলুন্ঠিত
এক)  BSF -এর হাতে নারীর মান-সম্মান সুরক্ষিত নয় । নারীর দেহ তল্লাশীর নাম করে অবলীলায় তাঁদের শ্লীলতা হানি করা হয় ।
দুই)  রাস্তাঘাটে চলার পথে BSF -এর হাতে নারীদের টিজ করার ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে । ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নারী ধর্ষণের ঘটনাও খুব বিরল নয় ।
তিন)  স্কুলের ছাত্রীরাও এরূপ অবমাননাকরআও ন্যক্করজনক ঘটনা থেকে রেহাই পায় না ।
চার)   BSF -এর হাতে উত্যক্ত হওয়ার ভয়ে প্রাইমারি বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হলে মেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে দেয় ।
পাঁচ)  পাচারকারী ও পাচারদ্রব্য খোঁজার নাম করে বাড়ি গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা ও তাঁদের গায়ে হাত দেওয়া ও খিস্তি করার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা ।
BSF পুলিশ আইনের উর্দ্ধে
এক)   BSFএর অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে চায় না পুলিশ । পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে তো চায়ই না ।
দুই)   অভিযোগ তো নেওয়য়া হয়ই না , উল্টে অভিযোগ জানাতে গেলে অভিযোগকারীর উপর  অত্যাচার বেড়ে যায়অভিযোগ যদি কোনোভাবে থানায় দায়ের করা সম্ভব হয় কিংবা আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হলে অভিযোগকারী বা অভিযোগকারিনীদের নানাভাবে ভয় দেখিয়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্যে BSF ও পুলিশের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয় 

তিন)  শুধু পুলিশ থানায় নয়, BSF ও পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে উভয় প্রশাসনের উপরতলায় অভিযোগ জানিয়েও ফল পাওয়া যায় না ।
চার)  অত্যাচারিত মানুষগুলোর পাশে জনপ্রতিনিধিরাও এসে দাঁড়ায় না । বরং কোনো ক্ষেত্রে তারা অত্যাচারীদের হয়েই কথা বলে এবং বরং অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে চাপ দেয় ।
বিপন্ন জীবিকা
এক)  BSF জওয়ানরা সমগ্র সীমান্তাঞ্চলে কার্যত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে । মানুষ স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজকর্ম করতে পারেন না ।
দুই)   সীমান্ত রেখা থেকে ৮/১০ কি.মি. ভিতরে অবস্থিত BSF ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তীর্ণ আঞ্চলে চাষবাস  করার জন্যে সারাদিনে সময় বরাদ্দ গড়ে মাত্র পাঁচ ঘন্টা । ফলে চাষী ও ক্ষেতমজুরদের জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ।  
তিন)  সীমান্ত রেখা থেকে ৮/১০ কি.মি. ভিতরে অবস্থিত BSF ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তীর্ণ আঞ্চলে বাংলাদেশের দুষ্কৃতিরা জমির ফসল লুঠ করে নিয়ে চলে যায় । সে ক্ষেত্রে BSF দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে ও কৃষকের ফসল রক্ষার্থে কোনো ভূমিকা নেয় না ।
চার)   মৎসজীবিরা রাত্রে নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারেন না । তাঁদের জীবিকা ভীষণভাবেই বিপন্ন ।
পাঁচ)   ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নানা হয়রানির শিকার হয় BSF –এর হাতে ফলে তাঁদের জীবিকাও বাধাপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রতিনিয়ত ।
 মাত্রাহীন প্রবঞ্চনা
প্রান্তিক মানুষদের জন্যে সরকারি সহায়তামূলক নানা প্রকল্প চালু আছে সারা দেশে । কিন্তু সীমান্তাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত । কারণ সে সব সুযোগ পেতে হলে যা যা পরিচয় পত্র ও প্রাসঙ্গিক কাগজ পত্র থাকা দরকার সেগুলো তাঁদের নেই । তাঁদের নেই-এর তালিকা অবিশ্বাস্য রকমের দীর্ঘ ।
এক)  বহু মানুষের রেশন কার্ড নেই । এই নেই-এর তালিকায় রয়েছে বহু বৃদ্ধ ও  বৃদ্ধাও । ফলে রেশনের সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পায় না ।
দুই)  BPL তালিকায় নাম নেই  অধিকাংশ দরিদ্র মানুষেরী । প্রায় সক মানুষই APL তালিকাভুক্ত । ফলে   অন্তোদয় যোজনা সহ অন্যান্য প্রকল্পের অনেক কম মূল্যের খাদ্যশস্য থেকে তাঁরা বঞ্চিত ।
তিন)   খাবার বিশুদ্ধ জলের কোনো ব্যবস্থা তো নেইই, এমনকি পর্যাপ্ত নলকূপও নেই ।
চার)   রাস্তাঘাট প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম । যা আছে তাও প্রায় চলার অযোগ্য
পাঁচ)  বেকার ভাতা, বিধবা ভাতা ও বার্ধক্য ভাতা থেকে কার্যত তাঁরা বঞ্চিত ।
ছয়) পরিবারের  উপার্জনশীল কারও অস্বভাবিক মৃত্যু হলে সেই পরিবারের প্রাপ্য সরকারি আর্থিক সাহায্য তাঁরা পায় না । এটা যে তাঁদের প্রাপ্য সেটাই তাঁরা জানেন না ।
সাত)  একশ’ দিনের কাজ থেকে তাঁরা বঞ্চিত ।

শিক্ষা ও স্বস্স্ববাস্থ্য
এক)   সীমান্তে বাস করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, তবু নেই একটাও কলেজ । ৪/৫ কি.মি. প্রশস্ত বিশাল চর, তারপর পদ্মা নদী,  তারপর  আরও ৭/৮ কি.মি. দুরত্ব পেরিয়ে তবে কলেজ । কলেজ যেতে এত বাধা যা কল্পনার অতীত । তবুও কোনো সরকার কলেজ স্থাপন করার কথা ভাবনাতেই আনে নি । ফলে সীমান্তবর্তী চরের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ।
দুই)   কলেজ তো দূরের কথা নেই একটা হাই স্কুলও । সম্প্রতি দু/একটা MSK তথা মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় এতই অপ্রতুল যা কহতব্য নয় । ফলে সীমান্তের ছেলে মেয়েদের প্রাইমারি শিক্ষার পরই পড়া ছেড়ে দিতে হয় ।
তিন)  প্রাইমারি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম । ফলে বহু শিশু প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগটুকুও পায় না ।
চার)  শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও অঙ্গনওয়ারি  কেন্দ্রের সংখ্যা এত কম যা প্রায় না থাকার মতই । ফলে সেখানকার শিশুরাও মিড ডে মিল ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত । 
পাঁচ)   স্বাস্থকেন্দ্র নেই । ফলে সরকারী ব্যয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে তাঁরা বঞ্চিত ।
অভিবাসনের সমস্যা (Migration)
এক)  সীমান্তবর্তী অঞ্চলের একটি বড়ো সমস্যা হলো মাইগ্রেসনের সমস্যা । আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার জন্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট বেশী ।  উল্টোদিকে পদ্মাভাঙনের ফলে চাষের জমি ক্রমহ্রাসমান । তার উপর BSF –এর অত্যাচার, হয়রানি ও নানা প্রকার বিধিনিষেধের ফলে স্বাভাবিক কাজের ক্ষেত্রগুলি ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হচ্ছে । মানুষ তাই কাজের সন্ধানে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন । মুর্শিদাবাদ জেলার বাইরে, রাজ্যের বাইরে গোটা ভারতে তাঁরা ছড়িয়ে পড়ছেন ।
দুই)   মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলমান অধ্যুষিত, স্বভাবতঃই সীমান্তেও তাঁরাই সংখ্যাধিক্য । তাঁদের অনেকেরই রেশন কার্ড নেই যার ফলে তাঁদের অনেক চড়া মাশুল গুনতে হয় । তাঁদেরকে বাংলাদেশি বলে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ।
তিন)  বাংলাদেশি সন্দেহে সীমান্তের মানুষদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে জেল খাটা শেষ হলে জোর করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
চার)   নারী পাচার একটা বড়ো সমস্যা এ দেশে । মুর্শিদাবাদ জেলায় এ সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট । মুর্শিদাবাদের মধ্যে আবার সীমান্ত অঞ্চলে এ সমস্যাটি আরও অধিক প্রকট । কি তার কারণ তার বর্ণনা রয়েছে উপরের আলোচনায় । কাজের সন্ধানে নারীকেও বাইরে যেতে হয় নিরুপায় হয়ে । সেই সুযোগ নেয় নারী পাচারকারীর দল । তারা ভালো কাজ ও ভালো অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের নিয়ে গিয়ে পাচার করে দেয় ।
মানুষ চোরাচালানকে জীবিকা করে নিতে বাধ্য হচ্ছে
এটা ঠিক যে যাঁরা BSF বা পুলিশের প্রহারে ও গুলিতে মারা গেছে বা পঙ্গু হয়েছে তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়তো চোরাচালানের সাথে যুক্ত ছিলেন । কিন্তু তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে চোরাচালানের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন ভাবলে ভুল হবে । যাঁদের সামনে সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্যে সৎ ও আইনসঙ্গত কাজের ব্যবস্থা নেই তাঁরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জীবিকার্জ্জনের জন্যে বেছে নিতে বাধ্য হয় চোরাচালানের কাজ মনে রাখতে হবে যে কথা তা হলো – কেউ চোরাচালানকারী হয়ে জন্মায় না, আমাদের দেশের ভুল অর্থনীতি,  পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গী মানুষকে অসৎ, চোর,ডাকাত ও চোরাচালানকারী বানায় ।

মানবাধিকার কর্মীদের কাজে বাধা
সীমান্তবর্তী মানুষদের সমস্যা নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে মাসুম (বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ) । স্বভাবতই এই সংগঠনটি BSF ও পুলিশের অত্যাচার ও মানবাধিকারবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব । এর ফলে BSF ও পুলিশ উভয়েই এই সংগঠনের কর্মীদের উপর খড়গহস্ত । নানাভাবে তাঁদের ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করতে চেষ্টা করে । শুধু ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকে না । পুলিশ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কেস দিতেও দ্বিধা করে না । এ ব্যাপারে মাসুমের কর্মী গোপেন শর্মা তাঁর কঠিন ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন তথ্যানুসন্ধান দলের কাছে । তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো হয়েছে একটা ধর্ষণের অভিযোগ এবং সে কেসে তাঁকে ইতিমধ্যেই হাজত বাস করতে হয়েছে বলে তিনি জানান । এখন তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত আছেন ।
সুপারিশ (Recommendation)
  দৃষ্টিভঙ্গী ও আইনের পরিবর্তন জরুরী  
সীমান্তবর্তী থানাগুলিতে নৃশংস ও নির্মম প্রহারে এবং রাইফেলের গুলিতে মানুষের মৃত্যু ও গুরুতর জখম হয়ে শারিরীক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার যে সব ঘটনাগুলি ঘটে সেগুলি মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উপেক্ষণীয় নয় । একইভাবে বলা যাবে না নারী-নিগ্রহ ও বলাৎকারের ঘটনাগুলিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা । এসব ঘটনাগুলি যেন সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের স্বাভাবিক নিয়তি ও ভবিতব্য । এসব দেখেশুনে বিস্তীর্ণ সীমান্তাঞ্চলগুলিকে কখনও স্বাধীন দেশের স্বাধীন ভূখন্ড বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন ভারতের উপনিবেশ । সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের এবং পুলিশের আচরণ দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে মানবতা, মনুষত্ব্যবোধ, দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালোবাসা এসব মুল্যবোধগুলির ভীষণ অভাব । নারীও মানুষ এবং তাঁদের  প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য – এ বোধ ঐ বাহিনীর মধ্যে আদৌ অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না । তাই ওদের পক্ষে মানুষকে অমানবিকভাবে প্রহার করা বা গুলি করে হত্যা করে এবং নারীকে অসম্মান করা বা ভোগ করার মতো নিষ্ঠুর ও জঘন্য ঘটনা ঘটাতে হাত, পা, বুক ও মন কিছুই কাঁপে না । এসব বন্ধ করার জন্যে তাই দৃষ্টিভঙ্গী ও আইনে বদল  আনা একান্ত জরুরী ।  যে বদলগুলি দরকারঃ
আইনের ক্ষেত্রে
এক)  এমন কোনো ঘটনা আমরা পাইনি যেখানে BSF বা পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছে । অকারণে ও বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানোর ফলে যে সব ক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে সে সব ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত জওয়ান বা পুলিশ কর্মীকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয় নি বা শাস্তি পেতে হয় নি বর্তমান আইনগুলি এমনই যে BSF ও পুলিশকে গুলি চালিয়ে মানুষকে হত্যা করলে জবাবদিহি করতে হয় না । তাই আইনে কার্যকরী পরিবর্তন আনা দরকার যাতে অনিবার্য কারণ ছাড়া গুলি চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয় ।
দুই)   পুলিশ পুলিশের বিচার করবে না এবং  BSF  বিচার করবে না - BSF এর, তাই ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ও বিচার করার ভার ভিন্ন সংস্থার উপর অর্পণ করতে হবে । এ কাজের ভার দেওয়া যেতে পারে মানবাধিকার কমিশনকে অথবা অন্য কোনো সংস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে ।
তিন)   জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, রাজ্য মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় মহিলা কমিশন ও রাজ্য মহিলা কমিশন প্রভৃতি সংস্থাগুলি নখদন্তহীন । এ সংস্থাগুলিকে কোনো ক্ষমতা প্রদান করা হয় নি বলে এ গুলি শোভাবর্ধনকারী সংস্থা বৈ কিছু নয় ।  প্রত্যেকটি মানুষের, বিশেষ করে হতদরিদ্র খেটেখাওয়া নিরীহ মানুষদের মানবাধিকারগুলি রক্ষার্থে ঐ সংস্থাগুলিকে আইনী ক্ষমতা প্রদান করতে হবে যাতে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারে ।
চার) মানবাধিকার কমিশনগুলিকেও জবাবদিহি মূলক সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যাতে কর্তব্যে অবহেলা বা পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা নিলে তাদেরও জবাবদিহি করতে হয় ।
পাঁচ)   মানবাধিকার কমিশনগুলিকে আরও তৃণমূল স্তরে আনা আবশ্যক । অন্ততঃ জেলাস্তর পর্যন্ত মানবাধিকার কমিশন গঠন করতে হবে যাতে বেশী সংখ্যক ও অধিক দ্রুত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলিতে হস্তক্ষেপ করে কার্যকরী ভূমিকা নিতে সক্ষম হয় ।
ছয়)      প্রত্যেকটি BSF ক্যাম্পে মহিলা জওয়ান নিয়োগ করতে হবে ।
সাত)   যে কোনো কারণেই হোক না কেন পুরুষ জওয়ানদের নারীর দেহ তল্লাশী করাকে বেআইনী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে । 

দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে আমূল বদল জরুরী
এক)   সীমান্তে বসবনাসকারী মানুষরা সকলেই চোরাচালানকারী এমন মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে জওয়ানদের মধ্যে ।
দুই)   সীমান্তের মানুষগুলোও মানুষ, তাঁদের মর্যাদা আছে এবং মর্যাদায় আঘাত লাগলে তাঁরাও অপমানিত ও অসম্মানিত বোধ করে – এ বোধ সৃষ্টি করতে হবে ঐ জওয়ানদের মধ্যে ।
তিন)   সীমান্তের মানুষগুলোও মানুষ, প্রিয়জন আহত হলে বা মারা গেলে তাঁরাও শোকে কাতর হয় ; উপার্জনশীল কেউ মারা গেলে তাঁদের ছেলেমেয়েরা অভাবে-অনাহারে কষ্ট পায় – এ বোধ জওয়ানদের মধ্যে সঞ্চার করতে হবে ।
চার)  নারী মাত্রই ভোগ্যপণ্য নয়, তাঁরাও মানুষ, তাঁদেরও মান-মর্যাদা আছে এবং তাঁদেরকেও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে – এ শিক্ষা ও বোধ দিতে হবে ।
 প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় আমূল বদল আনতে হবে
  উপরে উল্লেখিত সকল শিক্ষা ও বোধ দেওয়ার জন্যে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাতেই আমূল বদল আনতে হবে । এখন প্রশিক্ষণ শিবিরে জোর প্রদান করা হয় দুটো জনিষের উপর – ক) কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জওয়ানদের শারিরীক দক্ষতা, যোগ্যতা, পটুতা ও ক্ষিপ্রতার উচ্চতম মানে পৌঁছে দেওয়া । খ)  কঠোরভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ করে তোলা যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো জওয়ানদের মধ্যে প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ আমলাবর্গ ও শাসক দলের মন্ত্রীদের প্রতি সীমাহীন ও অন্ধ আনুগত্যশীল করে গড়ে তোলা ।  প্রশিক্ষণ শিবিরের এই শিক্ষণ ব্যবস্থায় আমূল বদল আনতে হবে । যেখানে শুধু শারিরীকভাবে ও শৃঙ্খলার দিক থেকে উপযুক্ত করে তুললে হবে না, জওয়ানদের শুধু জওয়ান হিসাবে গড়ে তুললে হবে না ।  তাদের মানসিক গঠনটাও আমূল বদলে দিতে হবে -  শুধু জওয়ান নয়, তাদের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলাটাই  অধিক জরুরী যাতে তারা দরিদ্র মানুষগুলোকে মানুষ বলে ভাবতে শেখে, সম্মান করতে শেখে এবং সকল নারীকে নিজেদের মা-বোনদের মতো সম্মান-শ্রদ্ধা ও স্নেহ করতে শেখে ।

দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে হবে সরকারী স্তরেও এবং সীমান্তের মানুষদের যা যা প্রাপ্য ও অধিকার তা পৌঁছে দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে ।
এক)   বহু মানুষের রেশন কার্ড নেই । প্রত্যেক মানুষের হাতে কার্ড পৌঁছে দেওয়ার জন্যে বিশেষ অভিযান ও শিবির স্থাপন করতে হবে ।
দুই)   অনুরূপ অভিযান ও শিবির স্থাপন করে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষদের হাতে BPL কার্ড তুলে দিতে হবে ।
তিন)   সীমান্ত এলাকার মানুষদের জন্যে পর্যাপ্ত সংখ্যায় রেশন দোকান খুলতে হবে ।
চার)   প্রতিটি মহল্লায় প্রাথমিক বিদ্যালয়, পর্যাপ্ত হাইস্কুল এবং সীমান্তের মানুষদের জন্যে কলেজ স্থাপন করতে হবে ।
পাঁচ )   সীমান্তের মানুষদের জন্যে স্বস্থ্য পরিষেবা নেই । এই পরিষেবা দিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হাসপাতাল খুলতে হবে ।
ছয় )    বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে ।
সাত)    জল নিকাশী ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত করতে হবে ।
আট)    পদ্মা ও নদী ভাঙন রোধের ব্যবস্থা করতে হবে ।
নয়)    সীমান্তবর্তী সমগ্র চর এলাকায় বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই । কেন নেই ? বলা হয়, বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে পথ আগলে রয়েছে বিশাল ও বিধ্বংসী পদ্মা নদী ও তার সর্বনাশা ভাঙনের কথা । কিন্তু এ কথা বলে হাজার হাজার মানুষকে আধুনিক সমাজ জীবনের অতি প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো থেকে বঞ্চিত করা চরম অন্যায়, কারণ চর এলাকাকে বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে । তা হলো, সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প । এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবিলম্বে সমগ্র এলাকাকে বিদ্যুতায়িত করতে হবে ।
দশ)   একশ’ দিনের কাজ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের জন্যে সুনিশ্চিত করার জন্যে ব্লক স্তরে বিশেষ সেল গঠন করতে হবে এবং এ কাজে অবহেলা বা দুর্নীতি হলে সংস্লিষ্ট ব্যক্তি বা অফিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আইনী বিধান রাখতে হবে ।
এগারো)   সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের তাঁদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারগুলি সম্পর্কে  অজ্ঞতা দূর করার জন্যে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা শিবির স্থাপন করতে হবে যাতে তাঁরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ এ সচেতন হতে পারে । এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে –
ক) সরকারি স্তরে এ রকম শিবির বস্থাপন করতে হবে যেখানে BSF ও পুলিশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি আবশ্যিক করতে হবে ।
খ)   বেসরকারি স্তরেও এরূপ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারের উপর মানুষের আস্থা যে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে বেসরকারি সংস্থাগুলির প্রতি, বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলির দিকেই মানুষ চেয়ে থাকে বেশী ।
গ)    বেসরকারি সংগঠনগুলিকে অবশ্য তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এরূপ শিবির স্থাপন করা অধিক আবশ্যক । কারণ, মানুষ যত অধিক নিজেদের অধিকার এবং  দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে অবগত হবেন ততো তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে ।
উপসংহার
BSF এর জওয়ানদের আগ্নেয়াস্ত্র কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই এবং তারজন্যে কাউকে কোনো ঘটনাতেই শাস্তি পেতে হয় নি । ঐ জওয়ানদের কাছে কত নারীর সম্মান ভুলুন্ঠিত হয়েছে তারও ইয়ত্তা নেই এবং তারজন্যেও কাউকে শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা, জবাবদিহিও করতে হয় নি । নিজের জমিতে চাষ করতে বা ফসল তুলতে গেলে BSF এর অনুমতি লাগে, আবার সে অনুমতি যে সর্বদা মেলে তাও নয় । নিজের জমিতে, এমনকি বাড়িতেও দোকান খুলে ব্যবসা করার স্বাধীনতা নেই, ঐ জওয়ানদের অনুমতি পেলে তবে করা যায় ।   নিজের গ্রামে নিজের মহল্লাতে ঘুরতে হলেও বুক পকেটে ভোটার আই কার্ড রাখতে হয় । এ ভাবেই জীবন-যাপন করতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের । স্বাধীন দেশের ভূখন্ড, তবু স্বাধীন ভূখন্ড নয় । স্বাধীন দেশের নাগরিক তবু কেউ স্বাধীন নয় । এ যেন খন্ড খন্ড উপনিবেশ, ভারতীয় উপনিবেশ ।
এটা মানা যায় না । বৃটিশ উপনিবেশ ভারত স্বাধীন হয়েছে ৬৬ বছর আগে । কিন্তু ভারত দ্বিখন্ডিত হওয়ার ফলে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ সেই পরাধীন থেকে গেছে আগের মতোই । পাল্টেছে এটুকুই – আগে শাসন করতো বৃটিশরা, এখন করে ভারতীয়রা । এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে । সীমান্তে বসবাস করা কোনো অপরাধ হতে পারে না, সেখানকার মানুষদের  উপনিবেশবাদী শাসন ব্যবস্থার হাত থেকে মুক্ত করতে হবে, তাঁদেরকেও ফিরিয়ে দিতে হবে স্বস্বাধীন ভূখন্ড ও স্স্ববাধীন জীবন-যাপন ।
সমাপ্ত





      

Sunday, January 26, 2014

২৬ শে জানুয়ারী দিনটিকে আমার প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না


আজ আমাদের দেশ ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করছে সাড়ম্বরে, মহাসমারোহে। কিন্তু ১২০ কোটি মানুষের ১০০ কোটিই জানে না এটা আবার কেমন দিবস। মানুষ নবি দিবস জানে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস জানে, রাম নবমী জানে, গুরু নানকের জন্ম দিবস জানে, গুরুর জন্ম দিবস জানে, একাদশী জানে, কবে কোন দিন কোন তিথিতে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে উপবাস থাকতে হয় জানে, কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবস কী তারা জানে না।  তবু সাড়ম্বরে, ধূমধাম করে বছর বছর দিবসটি উদযাপন করা হয়, জলের মত খরচ করা হয় দেদার টাকা। যারা উদযাপন করে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা সবাই ভালো করেই জানে যে দেশের অধিকাংশ মানুষ  প্রজাতন্ত্র  কী সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবু তারা মহা উৎসাহে ২৬ শে জানুয়ারীর দিন সকাল বেলা পতাকা তোলে, প্রজাতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করে, প্রজাতন্ত্রের অহঙ্কার করে, দেশ কত এগোলো তার  লম্বা লম্বা ফিরিস্তি দেয়, হাসপাতালে যারা সারা বছর অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে অবহেলায় তাদের কাছে গিয়ে দু-একটা ফল তুলে দেয়, আর ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়, অর্ধমৃত মানুষগুলো হঠাৎ এসব দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে এ ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাই, বাবুরা ঝড়ের বেগে আসে আর কিছু ফল বিতরণ করে আবার ঝড়ের বেগে চলে যায়। এভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে শাসকশ্রেণী মানুষকে ঠকায়, বিশ্ববাসীকেও ঠকায়।
আসলে শাসক শ্রেণী চায় না যে দেশের মানুষ জানুক প্রজাতন্ত্র দিবস কী, কেন এই দিবস? মানুষ প্রজাতন্ত্রের মানে জানলে তাদের অনেক অসুবিধা - শ্রমিকের শ্রম সস্তা দরে কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো যাবে না, সহজ হবে না চাষির কাছে বেশী দামে সার, বীজ, বিষ ইত্যাদি বিক্রি করা ও তাদের ফসল সস্তায় ক্রয় করা, বনবাসীকে উচ্ছেদ করে বনের দখল নেওয়া সহজ হবে না, খাল-বিল-নদী-সমুদ্র থেকে মৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ করে সেগুলো কব্জায় রেখে অনায়াসে ভোগ করা সহজ হবে না, পাহাড়বাসীকে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করে পাহাড়ের সম্পদ লুঠ করা সহজ হবে না, মানুষের রুজি-রোজগারের প্রতিদিনের সংগ্রামকে আইনশৃঙ্খলার দোহায় দিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে দমন করা সহজ হবে না, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে মারামারি-কাটাকাটি লাগিয়ে রাখা সহজ হবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে ধর্মের গাঁজা-চরস খাইয়ে মসজিদে-মন্দিরে-গীর্জায় বুঁদ করে রাখা সহজ হবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে-বেকারত্বে থাকা মানুষকে ভাগ্যের দোহায় দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা সহজ হবে না, দেশের তথা দেশের মানুষের  সকল সম্পদ যেমন  বন-জঙ্গল, পাহাড়, নদ-নদী, ইত্যাদি আত্মসাৎ করা সহজ হবে না, এ রকম হাজারো অসুবিধা রয়েছে শাসক শ্রেণির। 
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর মর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা, জেনে নিন  তিরঙ্গার অজানা কাহিনী | Independence Day 2020 Interesting Facts About  Indian Tricolour Flag You Should ...

তাই প্রজাতন্ত্র দিবস কী তা মানুষ জানুক – এটা শাসক শ্রেণী একদমই চায় না। চায় না কারণ, জানলে তাদের সমস্ত অধিকার বুঝে নিতে চায়বে তারা, তাদের বেঁচে থাকার জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- স্বাস্থ্য ন্যূনতম এই পাঁচটি জিনিষ ন্যূনতম পরিমাণে সরকারের কাছে দাবী করবে, দাবী করবে এটা জেনে যে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবী করবে তাদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, আওয়াজ তুলবে জাতপাত ও বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে, দাবি করবে সমান অধিকার ও ক্ষমতা পাবার, দাবীতে দাবীতে পাগল করে দেবে রাষ্ট্রকে তথা শাসক দল ও শোষক শ্রেণীকে। প্রাজাতন্ত্রের মানে জানলে গতর খাটানো মানুষেরা বুঝে যাবে যে রাষ্ট্রের চোখে সব মানুষই সমান নয়, রাষ্ট্র সকলের সঙ্গে সুবিচার করে না, রাষ্ট্রটা মোটেই নিরপেক্ষ নয় এবং রাষ্ট্রটা আর যাদেরই হোক তাদের নয়। প্রজাতন্ত্র কী জিনিষ জানতে পারলে মানুষ তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে চাইবে, একা যেতে না পারলে অন্ততঃপক্ষে ক্ষমতার ভাগ নিতে চাইবে। যেদিন মানুষ এ সব বুঝবে সেদিন তাদেরকে ঠেকানো যাবে না কোনোভাবেই। হয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। শাসক শ্রেণী তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলির অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞ করে রাখতে। শাসক শ্রেণী তাই  মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে। এভাবেই ৬৪ বছর ধরে তারা ভারতবাসীকে ঠকিয়ে আসছে।
আজ ২৬ শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে, আকাশে কত যুদ্ধ বিমান উড়ছে, কত বাদ্যি বাজছে, এ সব বসে বসে দেখছি টিভির পর্দায়। পাশাপাশি শুনছি কত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, শুরু হয়ছে এই ফুলঝুরি ছোটানো গতকাল থেকে অথচ চারিদিকে রোজরোজ নারীরা ধর্ষিতা হয়, রাষ্ট্র কিছুই করে না তা প্রতিরোধ করার, তারপরেও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির ছোটে নেতাদের কন্ঠে, আজও ছুটছে সমানে, আর এদিকে ২০ বছরের সাঁওতাল সমাজের মেয়েটিকে তার সমাজেরই মোড়ল-মাতব্বর যারা গণধর্ষণ করতে উস্কানি দিল, শাসক দলের সেই নেতাকর্মীরা বহাল তবিয়তে জেলের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্লাবে ক্লাবে, অফিসে, স্কুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা তুলছে, আর ঐ ধর্ষিতা মেয়েটা হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শারিরীক ও মানসিক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটট করছে, সে জানে না কী অপরাধে তার সব শেষ হয়ে গেলো, সে এও জানে না হাসপাতাল থেকে ফিরে গিয়ে সে কোথায় ঊঠবে, কারণ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে শুধু গণধর্ষণই করেনি, সমাজ থেকেও বহিষ্কার করেছে শুধু সাঁওতাল সমাজের ঐ একটি মেয়েরই নয়, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে নারীর অবস্থাও তদ্রূপ।   
আজ ২৬ শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে দিল্লীতে, রাজ্যে রাজ্যে সমস্ত রাজধানী শহরে, ভাষণ বিলানো হচ্ছে দেদার, বড়ো বড়ো ভাষণ যে ভাষণে বলা হচ্ছে – ভারত প্রজাতান্ত্রিক দেশ, এখানে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্ব স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ধর্ম না পালনের স্বাধীনতা, সসম্মানে ও স্বমর্যাদায় বেঁচে থাকার স্বাধীনতা-সহ সমস্ত স্বাধীনতা সুরক্ষিত। রাষ্ট্র নেতাদের এ সব ভাষণ যে শুধুই ভাষণ এবং বিলকুল মিথ্যা ভাষণ সে কথা দুনিয়া শুদ্ধ লোক জানে। কোথায় আমাদের বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক তসলিমা নাসরিন আজ দিল্লীতে নির্বাসিত। ভারত সরকার তাঁকে এ দেশে থাকার অনুমতি দিয়েছে, সেই বৈধ অনুমতির জোরে ভারতের যে কোনো স্থানে থাকার স্বাধীনতা তাঁর আছেরাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাঁর এ অধিকার যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে তা দেখা ও সুনিশ্চিত করা। অথচ রাষ্ট্রই তাঁকে কলকাতায় আসতে দিচ্ছে না। গত বছর কলকাতা বই মেলায় তাঁর লেখা একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন আটকে দিল সরকার। ঐ একই সময়ে বিশ্বখ্যাত লেখক সলমান রুশদি কলকাতা বই মেলায় আসতে পারলেন না সরকার আসতে দিল না বলে। কেন তসলিমা ও সলমন রুশদির অধিকার হরণ করলো সরকার? কারণ, তাঁরা মুসলিম ধর্মাবেগে আঘাত করেছেন। কে বলেছে? মুসলিম ধর্মের নেতারা। তাই ওঁদের কলকাতায় পা ফেলার অধিকার নেই। এই হলো এ দেশে মানুষের বাক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত থাকার নমুনা। এ দেশে লেখকের বাক স্বাধীনতা নেই, কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের সে অধিকার আছে। তারা যা কিছু বলতে পারে, মুন্ডু কাটার ফতোয়া দিতে পারে, এ ফতোয়া বেআইনী তবুও তাদের অধিকার আছে তা দেওয়ার। একই ফতোয়া দিয়েছিলো দঃ চব্বিশ পরগণা আক্রা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লার উপরে একটা নিরীহ প্রবন্ধ লেখার অপরাধেতাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা। মোরসালিনকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেয় নি, ঘুরিয়ে বলেছিলো ফতোয়াবাজ মোল্লাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে। মোরসালিন অগত্যা তাই করেছিলেন, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন এবং আর কোনোদিন ঐ রকম লেখা লিখবেন না বলে থানায় বসে মোল্লা ও পুলিশের কাছে মুচলেকাও লিখে দিয়েছিলেন। একই অবস্থা হয়েছিলো পত্রিকা সম্পাদকের যাঁর পত্রিকায় লেখাটা বেরিয়েছিলো। এ ঘটনা বাম সরকারর আমলের। প্রায় একই সময়ে ঐ একই কারণে আমারও মুন্ডুচ্ছেদ করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো। আমাকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, যারা আমাকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে আমার লিখিত অভিযোগও নেয় নি। এই হচ্ছে আমার দেশ, আমাদের প্রজাতন্ত্র, আমাদের যাবতীয় অধিকার সুরক্ষিত থাকার নমুনা! আসল কথা হলো, এ দেশে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা আছে শাসক শ্রেণীর, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের, শাসক দল আশ্রিত চোর-গুন্ডা-বদমায়েশদের, ধাপ্পাবাজ ও প্রতারক ধর্মীয় নেতাদের ও পুলিশের, স্বাধীনতা নেই সাধারণ মানুষের, লেখকের ও নারীদের।
তাই প্রজাতন্ত্র দিবসের আসল মানে যাই থাক, আমার কাছে এ দিনটি প্রতারণা দিবস ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এ দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না, বরং প্রজা-নিয়ন্ত্রণ, প্রজা-নিষ্পেষণ ও প্রজা-হরণ দিবস বলেই মনে হয়।
   
       

Wednesday, January 22, 2014

রাজ্যসভার জন্যে তৃণমূল প্রার্থী আহমদ হাসান মুসলিম মৌলবাদীদের প্রতিনিধি, তিনি জিতলে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত শক্ত হবে


মমতা ব্যনার্জী তাঁর দলের রাজ্যসভার পাঁচটি শুন্যপদে নির্বাচনের জন্যে চারজনের একটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছেন। চতুর্থ জনের নাম আহমাদ হাসান ইমরান। মমতার দল আপন শক্তির জোরে তিনজন প্রার্থীকে কে নির্বাচনে জেতাতে সক্ষম। চতুর্থ আসনে জয়লাভ করবে বামফ্রন্টের প্রার্থী। পঞ্চম আসনে জেতার জন্যে প্রয়োজনীয় বিধায়ক কোনো দল বা জোটের নেই। সেই আসনের জন্যে মমতা আহমাদ হাসান ইমরানকে চতুর্থ প্রার্থী মনোনীত করেছেন। স্বভাবতই তাঁর এই চতুর্থ প্রার্থীর জেতা একেবারেই অনিশ্চিত। একটি নিম্নরুচি ও নোংরা রাজনীতির অঙ্ক কষেই মমতা ইমরানকে চতুর্থ প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে অনিশ্চিত আসনে আহমদ হাসানকে প্রার্থী করে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সংখ্যালঘু তাসটিই আরো একবার খেলে  খেলে দিলেন তাঁর আশা তিনি এ রকম একটি অপকৌশলের সাহায্যে এক ঢিলে দুটো পাখি মেরে বাজিমাত করতে সক্ষম হবেন। আহমাদ হাসানকে যদি জেতানো যায় তবে তিনি হবেন একদিকে মমতার একজন পুতুল-সাংসদ, অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদীরাও বেজায় তুষ্ট হবে। ইমরান কেনো সাংসদ হলে মমতার ইশারায় পুতুলবৎ নাচবেন তা বুঝে নেওয়া যাক।  
ইমরান একজন সাংবাদিক বেশ কয়েক বছর ধরে ‘কলম’ নামের একটি বাংলা সাপ্তাহিক তিনি বের করেছেন। তাঁর খুব সখ  ছিলো, সাপ্তাহিক ‘কলম’কে দৈনিক কলম’ করবেন। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছিলেন না। তাঁর সে সাধ ইতিমধ্যেই পূরণ হয়েছে মমতা এবং তাঁর আশীর্বাদ পুষ্ট ‘শারদা’র কর্ণধার সুদীপ্তর সৌজন্যে। জনগণের আত্মসাৎ করা টাকায় সুদীপ্ত কিছু দৈনিক কাগজ এবং বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম কেনেন বলে শোনা যায়। শোনা যায় ইমরানের সাপ্তাহিক ‘কলম’টি  শারদা কোম্পানীর মালিক সুদীপ্ত সেনের অর্থায়নে ‘দৈনিক কলমে’ উন্নীত হয়অবশ্য তার জন্যে দুর্মুখরা বলে থাকেন যে, ইমরানকে একটা মুচলেকা লিখে দিতে হয়েছিলোসেটা এ রকম -‘দৈনিক কলম’ তৃণমূল সরকারের পক্ষে প্রশ্নহীন ভূমিকা পালন করবে এবং একই সঙ্গে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা করে যাবে।  এহেন ইমরান রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়ে গেলে তিনি যে মমতার একজন পুতুল-সাংসদ হিসেবে কাজ করবেন তা বলা বাহুল্য
আর এ কথাও সর্বজন বিদিত যে মমতা সাংসদ হিসেবে অধিক পছন্দ করেন সেই মানুষদেরই  যাঁরা তাঁর প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শনে কোনো প্রকার দ্বিধা করেন না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা যে প্রথম তিন প্রার্থী – মিঠুন চক্রবর্তী, যোগেন চৌধুরী ও কে ডি সিং – অপেক্ষা ইমরান অনেক বেশী পরীক্ষিত, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য।  
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে কেনো মমতা ইমরানের মতো এত অধিক অনুগত, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য একজন সাংবাদিক-সৈনিককে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বাছাইয়ের প্রার্থী হিসেবে ভাবতে পারলেন না? তাছাড়া মমতার পছন্দের তৃতীয় প্রার্থীটি হলেন ঝাড়খন্ডের মানুষ এবং একটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার মালিক হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক কেলেঙ্কারিতে আপাদ-মস্তক ডুবে থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ভিন রাজ্যের মানুষের প্রতি মমতা যতটা আস্থা রাখতে পারলেন ইমরানের প্রতি তিনি ততটা আস্থা কেনো  রাখতে পারলেন না? কেনো ইমরানকে তিনি ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার পর্যায়ে নামিয়ে আনলেন? এর ফলে ইমরানকে তো এখন সেই কংগ্রেস ও সিপিএমের অনুগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে যাদের বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসা করেই তিনি মমতার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন এই কেনো গুলির পেছনে নিশ্চয় যথেষ্ট কারণ নিহিত আছে। প্রথম কারণটা কি এই যে মমতা ইমরানকে রাজ্যসভার জন্যে যথেষ্ট উপযুক্ত প্রার্থী বলে মনে করেন নি, তাই নিশ্চিত জেতা কোনো আসন তাঁর জন্যে বররাদ্দ করেন নি? দ্বিতীয় কারণটি এমন হতে পারে যে, ইমরান সাংসদ পদে অনুপযুক্ত হলেও ঐ পদের জন্যে সংখ্যালঘু তাসটি(আসলে সাম্প্রদায়িক তাস) খেলার ক্ষেত্রে তিনিই বেশী উপযুক্ত ও নির্ভরযোগ্য। কারণ, তিনি একদিকে যেমন মমতার অতি অনুগত ও বিশ্বস্ত সাংবাদিক, অপরদিকে তেমনি মুসলিম মৌলবাদীদের একজন জবরদস্ত প্রতিনিধিও বটে। তাই তাঁকে যে আসনেই প্রার্থী করা হোক (হোক না অনিশ্চিত আসন, হোক না অকৃতকার্য) মুসলিম মৌলবাদীরা তাতেই ভীষণ তুষ্ট হবে এবং মমতাকে মুসলিম দরদি বলে গলা ফাটানোর মাত্রাটা  আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে মুসলিম মোল্লাদের পদলেহনে এ দেশে যে জঘন্য প্রতিযোগিতা চলে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনদের মধ্যে তার তুলনা সারা পৃথিবীতে মেলা ভার। সেই কারণে মমতার আশা যে মুসলিম মৌলবাদীরা পাছে অসন্তুষ্ট বা ক্ষুব্ধ হয় এ ভয়ে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত আহমাদ হাসান ইমরানকেই সমর্থন দিতে বাধ্য হবে। আর যদি তা না হয়, তাহলেও  তাঁর লাভ হবে। তখন কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকে মুসলিমবিরোধী বলে প্রচার করার একটি নতুন সাম্প্রদায়িক  অস্ত্র  তাঁর হস্তগত হবে
আহমদ হাসান ইমরানকে  মমতা সাংসদ পদের জন্যে যথেষ্ট উপযুক্ত প্রার্থী ভাবতে পারলেন না, বরং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তথা মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ভাবলেন ও ব্যবহার করলেন, এটা ইমরানের পক্ষে সম্মানের না অসম্মানের, মানের না অপমানের, মর্যাদার না অমর্যাদার তা একজন নির্বোধ মানুষও বোঝেন। আর এ অসম্মান ও অপমান শুধু ইমরানকেই নয়, মমতা আসলে অপমান করলেন ইমরান যাদের প্রতিনিধি সেই মৌলবাদীদেরওকিন্তু তবুও ইমরান ও তাঁর শিবির খুশীতে গদগদ, ডগমগ। যারা ক্ষমতালোভী এবং অর্থ, যশ ও খ্যাতির কাঙাল তাদের অবশ্য আত্মমর্যাদার কথা ভাবলে চলে না।   
মমতার এহেন সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চালে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট যে অনেকটাই কাবু হয়ে পড়বে তার কিছু লক্ষণ ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে। সিপিএমের দুই নেতা - বিধায়ক আনিসুর রহমান ও বিধায়ক রেজ্জাক আলি মোল্লা – ইতিমধ্যেই ইমরানকে প্রার্থী করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দল হিসেবে সিপিএম ও ফ্রন্টের অন্যান্য শরিক দল, এস.ইউ.সি ও কংগ্রেস কী সিদ্ধান্ত নিবে তা জানার জন্যে আমাদের আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিরোধী দলগুলি যদি মমতার পাতা ফাঁদে পা দেয় এবং মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ভুল অঙ্কের বশবর্তী হয়ে ইমরানকে রাজ্যসভায় যাওয়ার ছাড়পত্র দেয় তবে তা ভয়ঙ্কর ক্ষতি ডেকে আনবে এ রাজ্যের তথা এ দেশের। কারণ, ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করছি যে অতীতের কংগ্রেস ও বাম সরকারে তুলনায় মমতার অধিক মাত্রায় মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করার ফলে তাদের ঔদ্ধত্য অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মমতার আস্কারা পেয়ে অনেক সময় তারা এত দাপাদাপি করছে যা গণতন্ত্রের কাছে ক্রমশঃ হুমকি হয়ে উঠছে। এর ফলে আমরা একটা জিনিষ লক্ষ্য করছি, তাহলো,  হিন্দু সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলিরও শক্তি ও সক্রিয়তা বাড়ছে। এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে আহমদ হাসান ইমরান এ রাজ্য থেকে সাংসদ নির্বাচিত হলেকারণ এর ফলে তৃণমূলের শুধু শক্তি বৃদ্ধি ঘটবেনা, একই সঙ্গে শক্তি বৃদ্ধি ঘটবে মুসলিম মৌলবাদীদেরও। আর মুসলিম মৌলবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটলে তার সাথে সাথে যে হিন্দু মৌলোবাদিদেরও শক্তি বাড়বে তা বলাই বাহুল্য।
আহমদ হাসান ইমরানকে একজন সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি ভাবলে তা হবে একটা প্রকাণ্ড রকমের ভুল। মুসলিমরা এ রাজ্যে জনসংখ্যার ২৫%, সুতরাং এ রাজ্য থেকে যখন পাঁচ জন সদস্য রাজ্যসভায় নির্বাচিত হবেন তাঁদের মধ্যে আহমদ হাসান ইমরান হবেন একজন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি – এতো ভালোই, এতে মন্দের কি আছে? ব্যাপারটাকে এতো সহজভাবে দেখলে ভুল হবে। কারণ, ইমরান মুসলিম সমাজের একজন সাধারণ প্রতিনিধি মাত্র নন। আগেই বলেছি যে তিনি মুসলিম মৌলবাদীদের একজন জবরদস্ত প্রতিনিধি। আমি তাঁর চিন্তাধারা ও মতাদর্শ সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই অবগত। এক দশকেরও বেশী সময় আমি তাঁর সাপ্তাহিক ‘কলমে’র নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম এবং সেই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি যেদিন থেকে দৈনিক পত্রিকায় উন্নীত হয়েছে সেদিন থেকেই আমি তার গ্রাহক হয়েছি। ‘কলমে’র একজন নিয়মিত গ্রাহক ও পাঠক হওয়ার সুবাদে আহমদ হাসান ইমরান কোন চিন্তাধারা ও মতাদর্শে বিশ্বাসী তা আমি খুব ভালো করেই জানি। ইমরান সাহেব যে মুসলিম মৌলবাদীদেরই একজন প্রতিনিধি ও মুখপাত্র তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁরা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। তসলিমার বই ‘দ্বিখন্ডিত’ নিষিদ্ধ করার জন্যে মুসলিম মৌলবাদীরা কত দাপাদাপি করেছিলো তা আমরা জানি। ইমরান ছিলেন তাঁদেরই একজন মুখপাত্র। তাঁদের সন্তুষ্ট করার জন্যে তৎকালীন তথাকথিত বাম সরকার বইটি নিষিদ্ধও  করেছিলো। কিন্তু সেটা যে বাক-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উপর প্রবল আক্রমণ ও আঘাত ছিলো তা কলকাতা  হাইকোর্টের রায়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে। কিন্তু ইমরান সাহেবরা যেহেতু বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না, তাই তাঁরা সেই রায়কে মেনে নিতে পারেন নি, তাঁরা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলো সুপ্রীম কোর্টে ঐ রায়কে আটকানোর জন্যে। তসলিমার উপর হায়দ্রাবাদ শহরে যখন মুসলিম  মৌলবাদীরা হামলা করেছিলো তখন সেই হামলার ঘটনাকেও সমর্থন জানিয়েছিলেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, এ রাজ্যের মুসলিম মৌলবাদীরা কলকাতা শহরে ফতোয়া দিয়েছিলো যে তসলিমার শিরচ্ছেদ করবে তাকে অপরিমিত টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। ঐ ফতোয়াবাজদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইমরানও ইমরান সাহেবরা এতোটাই গণতন্ত্রবিরোধী যে তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর দাবীতে তাঁরা কলকাতা অবরোধ করে এমন তান্ডব চালিয়েছিলো যে সামলাতে সরকারকে মিলিটারি পর্যন্ত নামাতে হয়েছিলো। সম্প্রতি মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করতে মমতার সরকারের পুলিশ বাংলা বৈদ্যুতিক চ্যানেল ‘আকাশ আট’কে ভয় দেখিয়ে তসলিমার লেখা মেগা সিরিয়াল ‘দুঃসহবাস’- এর প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে। যারা এই মেগা সিরিয়ালটি বন্ধ করার দাবী জানিয়ে ছিলো তাদের একজন অন্যতম ছিলেন এই আহমাদ হাসান ইমরান। সলমান রুশদিও কলকাতায় আসতে পারেন নি তাঁদের বাধাতেইসলমান রুশদি ও তসলিমার অপরাধ তাঁরা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না এবং ইসলামের সমালোচনা করেন। সলমান রুশদিকে যখন  ‘কোতল’ করার ফতোয়া দিয়েছিল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি তখন সেই ফতোয়াকেও  তাঁরা সমর্থন করেছিলেন। আজ থেকে ৭/৮ বছর আগে দঃ চব্বিশ পরগণার আক্রা হাই মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লাকে হত্যা করার জন্যে তাঁর বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছিলো মুসলিম মৌলবাদীরা। তাঁর অপরাধ ছিলো তিনি একটি প্রবন্ধে কিছু যুক্তিপূর্ণ কথা লিখেছিলেন। সেই কথাগুলির মধ্যে একটিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, কোনো বিষয়ে যদি কোরান ও বিজ্ঞানে দুরকম কথা লেখা থাকে তবে কোনটাকে সত্য বলে ধরতে হবে? অর্থাৎ তিনি কোরানের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন মাত্রশুধু এই অপরাধে তাঁকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে হত্যা করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো। ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো যে পত্রিকায় মোরসেলিন লিখেছিলেন সেই পত্রিকা ‘প্রগতি’র সম্পাদকের (যিনি একজন মুসলিম) উপরেও এবং তাঁর বাড়িতেও আগুন লাগিয়ে তাঁকেও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। ঐ একই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে আমার উপরেও ২০০৫ সালেবামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকি করণের যতবার চেষ্টা করেছে ততবার বাধা দিয়েছে মুসলিম মৌলবাদীরা যাদের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন ও কলম ধরেছেন এই ইমরান সাহেব। এর ফলে বামফ্রন্ট সরকার মুসলিমদের ভালোর জন্যে অন্তত এই যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে চেয়েছিল তা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিলোইমরান সাহেবরা মুখে আধুনিক শিক্ষার কথা বললেও আসলে তাঁরা পশ্চাদপদ মাদ্রাসা শিক্ষার ধারক ও বাহক তাঁরা এরূপ চিন্তাধারায় বিশ্বাস করেন যে আধুনিক শিক্ষা মানুষকে বিপথগামী করে, আর মাদ্রাসা শিক্ষা তথা কোরান-হাদিসের শিক্ষা মানুষকে সুপথগামী করে। এত পশ্চাদপদ ধারণা পোষণ করেন এই ইমরান সাহেবরা। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন না, বিশ্বাস করেন না আধুনিক ও প্রগতিশীল আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থায়। তাঁরা শরিয়ত আদালতকে বেশী মান্যতা দেন দেশের সাংবিধানিক আদালতগুলি অপেক্ষা। তাঁরা নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন না, তাই মধ্যযুগীয় বহু বিবাহ ও তালাক প্রথা বাতিল করার ন্যায়সঙ্গত দাবী উঠলেই হৈ হৈ করে মারতে আসেন। সকল ধর্মীয় সমাজেই সংস্কার হয়েছে, এবং তার সুফল সে সব সমাজের মানুষ ভোগ করছেন। ভারতে বাইরে ২/৪টি দেশ ব্যতীত সকল মুসলিম দেশেই মুসলিম সমাজে সংস্কার হয়েছে, সংস্কার হয়েছে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেওকিন্তু এদেশে  মুসলিম মৌলবাদীরা আজও অনড়, তাঁরা কিছুতেই সংস্কার হতে দিবেন না। আমাদের মতো কতিপয় মানুষ সংস্কারের কথা বললে আমাদেরকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে আমাদের শিরচ্ছেদ করার ফতোয়া দেয়। আর এই সময়ে আহমদ হাসান ইমরানরা কলম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঐ ফতোয়াকে যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যে। এই হলো অল্প কথায় আহমদ হাসানের পরিচয়। এই ইমরানকে তাঁর আসল পরিচয় আড়াল করে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। মুসলিম মৌলবাদীরাও তাঁকে  মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরছে। এবং স্বয়ং ইমরানও নিজেকে মুসলিম সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই পরিচয় হলো এক মস্তবড় ধোঁকা ও প্রতারণা। তৃণমূল কংগ্রেস ও মুসলিম মৌলবাদীরা একযোগে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে তাদের কার্য সিদ্ধি করতে চাইছে। যদি তারা কার্য সিদ্ধি করতে পারে তা হলে পশ্চিমবঙ্গের আরো অনেক বড়ো ক্ষতি  ও সর্বনাশ হবে।
সেই ক্ষতি  ও সর্বনাশকে ঠেকাতে পারে একমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) দল। বামফ্রন্ট তাদের একজন প্রার্থীকে জেতানোর পর তাদের হাতে যত সংখ্যক ভোট থাকবে এবং কংগ্রেসের হাতে যত ভোট আছে তা  একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রদান করলে সে প্রার্থী জয়ী হতে পারেন। তাই তাদের উচিত হলো ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির প্রতিনিধির জয়কে প্রতিহত করতে একজন অরাজনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ গুণীজনকে প্রার্থী করা এবং তাঁকে এ রাজ্য থেকে সাংসদ করে পাঠানো।

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...