করোনা-সংক্রমণ এবং করোনা-মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে
বিশ্বে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা গতকাল (৩১.০৭.২০) পৌঁছে গেছে প্রায় পোনে দু’কোটিতে (১৭৭২৪২৭০), ভারতে প্রায় সতেরো লক্ষ (১৬৯৭০৫৪) এবং পশ্চিমবঙ্গে ছাড়িয়ে গেলো সত্তর হাজারের গণ্ডী (৭০১৮৮)। বিশ্বে সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়েছে গত চব্বিশ ঘণ্টায় প্রায় তিন লক্ষ (২৮৩৬৩৮), ভারতে প্রায় ষাট হাজার (৫৭৭০৪) এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার (২৪৯৬)। ভারতে ইরিমধ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ফলে সংক্রমণ আক্ষরিক অর্থেই লাফিয়ে বাড়ছে। গত মাসের (জুলাই মাসের) প্রথম চারদিনে সংক্রমণ বেড়েছিলো এক লক্ষ। আর মাসের শেষে এক লক্ষ বাড়লো দু’দিনে। গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়েছে আমাদের রাজ্য পশ্চিবঙ্গেও। ফলে এখানেও করোনা রোগীর সংখ্যা অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। গত মাসে প্রথম চারদিনে আড়াই হাআর বেড়েছিল সংক্রমণের সংখ্যা, আর মাসের শেষে একদিনেই বেড়েছে আড়াই হাজার। সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সারা বিশ্বে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মারা গেছে প্রায় সাত লক্ষ মানুষ (৬৮১৮২৪)। ভারতে সংখ্যাটা প্রায় চল্লিশ হাজার (৩৬৫৫১), আর এ রাজ্যে ছাড়িয়ে গেছে দেড় হাজারের গণ্ডী (১৫৮১)। ভারতে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির হার এত বেশী যে, এক সময় করোনা-আক্রান্তের সংখ্যায় ভারত ছিল সব পেছনে, এখন ভারত বহু দেশকে টপকে পৌঁছে গেছে তৃতীয় স্থানে। মৃত্যুর সংখ্যাতেও বহু দেশকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে পঞ্চম স্থানে। কী আক্রান্তের সংখ্যায়, কী মৃত্যুর সংখ্যায় ভারত যেন গোল্ড মেডেলিস্ট হওয়ার দৌড় শুরু করেছে।
মোদ্দা কথায় করোনার থাবা অতি দ্রুত গতিতে চওড়া হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত সতর্ক করছে এই বলে যে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, আরও ভয়াবহ হবে। ভারতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা হবে সব চেয়ে ভয়াবহ। এটা বলেছে ইউরোপের একটি (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না) বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল। তাঁরা বলেছেন যে ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে যদি ভ্যাকসিন না আসে তা হলে করোনা সংক্রমনের নিরিখে বিশ্বে এক নম্বর স্থানে চলে যাবে ভারত এবং ভারতে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় তিন লক্ষ (২৮৭০০০) করে বৃদ্ধি পাবে। এ রকম বেনজির ভয়াবহ আবহের মধ্যে এবার ঈদুজ্জোহার (ঈদ-উল-আযহার) দিন নির্ধারিত ছিলো
করোনা আবহের মধ্যে ঈদ উদযাপনে মুসলিমদের প্রস্তুতি দেখে আমি হতভম্ব
স্বচক্ষে দেখছি মুসলিম সম্প্রদায়ের সাড়ম্বরে ও সোৎসাহে ঈদ উদযাপন। দেখছি আর বিষ্ময়ে হতবাক, রুদ্ধবান হচ্ছি। বিষ্মিত হচ্ছি কারণ, বড়ো দুঃসময় চলছে এই সময় আমাদের প্রিয় গ্রহে। এত দুঃসময় এ বিশ্ব দেখেনি কখনো। তামাম মানব সমাজের বুকে নেমে এসেছে এক মহাবিপর্যয়। করোনা ভাইরাস যেন আজ বাস্তবেই রূপকথার দৈত্য হয়ে ঊঠেছে। তাকে বধ করার জন্যে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দিনরাত অস্ত্রের (ভ্যাকসিন ও ওষুধ) সন্ধানে গবেষণায় মগ্ন রয়েছেন। কিন্তু কখন যে ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরি হয়ে বাজারে আসবে তা এখনো রয়েছে অন্ধকার ও ঘোর অনিশ্চিয়তার গর্ভে। কিন্তু এত বড়ো দুঃসময়, এত বড়ো বিপর্যপয়, এত মৃত্যু (ইতিমধ্যেই প্রায় সাত লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে) কোনো কিছুই মুসলিম সমাজকে এতটুকু ছুঁতে পারলো না। করোনা ভাইরাস, বৈশ্বিক মহামারি, মানুষের মৃত্যু মিছিল, বিশ্বজুড়ে চারিদিকে লক্ষ লক্ষ স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ, এসব যেন কিছুই ঘটেনি ও ঘটছে না, যেন পৃথিবীতে সর্বত্র বসন্তের সুশীতল মধুময় মনমাতানো পরিবেশ বিরাজ করছে এমন একটা ভাব দেখালো মুসলিমরা এই ঈদুজ্জোহায়।
করোনা-মহামারী আবহেও মুসলিমরা যে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গতকাল যেভাবে ঈদ উদযাপন করলো তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। গত ২৫শে মে ঈদ-উল-ফিতরের সময় আচমকা লকডাউন ঘাটে চেপে যাওয়ায় ব্যাঙ্গালোরে আটকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই লক্ষ্য রাখছিলাম ঈদুল ফিতর উদযাপনে মুসলিম সমাজ দৈহিক দুরত্ব রক্ষা করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে নাকি অবহেলা করছে সে বিষয়ের প্রতি। সেবার সরকার, প্রশাসন ও মুসলিম ধর্মগুরুদের পক্ষ থেকে যে ভূমিকা পালন করা হয়েছিলো তাকে ইতিবাচক বলা যেতে পারে। বড়ো বড়ো মসজিদের ইমামগণ ইদগাহ-র বদলে মুসলিমদের নিজ নিজ বাড়িতেই ঈদের নামাজ আদায় করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং এমনকি লকডাউন চলাকালীন সময়ে মুসলিম সমাজকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও নিজ নিজ বাড়িতেই পড়তে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ঈমামগণ বলেছিলেন, আগে মানুষ পরে ধর্ম, মানুষ বাঁচলে তবেই ধর্ম বাঁচবে। মুসলিম ধর্মগুরুদের এই সাহসী ও ইতিবাচক ভূমিকা আমাকে যারপরনাই অবাক করেছিলো। অপরদিকে প্রশাসনও থানা স্তরে ঈদগাহ কিংবা মসজিদের পরিবর্তে বাড়িতেই ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করার জন্যে জোর তৎপরতা দেখিয়েছিলো, মসজিদের ইমামদের নিয়ে আলোচনা সভা সংগঠিত করেছিলো। প্রশাসন ও ধর্মগুরুদের ইতিবাচক ও সাহসি পদক্ষেপ একদম বিফলে যায় নি। কিন্তু এখন যখন করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখন ঈদ-উল-আযহা উদযাপনে প্রশাসনের সেই তৎপরতা চোখে পড়লো না। সরকার কি তবে ২০২১ –এর বিধানসভা নির্বাচনের কথা ভেবে প্রশাসনকে চুপ থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলো? মুসলিমরা যাতে ঈদুল ফিতরের মতন ঈদুজ্জোহার নামাজও নিজের বাড়িতেই পড়ে সে বিষয়ে মুসলিম ধর্মগুরুদেরও কোনো ভূমিকা দেখা গেলো না। তাহলে কি রাজ্য সরকার ও মুসলিম ধর্মগুরুরা পারষ্পরিক বোঝাপাড়ার ভিত্তিতেই একটা ঈদে দৈহিক দুরত্ব রক্ষা করার জন্যে তৎপর হয়েছিলেন এবং আর একটা ঈদে অতৎপর থাকলেন? নাকি এটা একান্তই কাকতলীয়? এ কথা থাক। মোটের ওপর আমার মনে হয়েছিলো যে ঈদুজ্জোহা উদযাপনে দৈহিক দুরত্ব রক্ষার বিষয়টি এবার বোধ হয় অনেকটা অবহেলিতই হবে। তবুও একটা আগ্রহ ছিলো ঈদুজ্জোহা উদযাপনে মুসলিমরা কী ভূমিকা নেয় তা স্বচক্ষে কিছুটা পর্যবেক্ষণ করার।
রোজ ভোর সওয়া পাঁচটায় হাঁটতে যায়। গতকাল (ঈদের দিন) ঠিক করলাম যে হাঁটতে হাঁটতেই মুসলিমদের ঈদের প্রস্তুতিটাও একটুখানি পর্যবেক্ষণ করে নেবো। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পঞ্চাশ গজ খানেক দূরেই প্রথম চোখে পড়লো ইদগাহে নামজ পড়ার প্রস্তুতি সারা। আমাদের গ্রামে ইদের নামাজের জামাত হয়ে সে ইদগাহে তার পাশের রাস্তাটা সাজানো হয়েছে হরেক রকমের রঙের ঝলমলে কাগজের তৈরি অসংখ্য চেন দিয়ে। তার মানে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে এবার আর নিজ নিজ বাড়িতে নয়, ইদুজ্জোহার নামাজ পড়া হবে ইদগাহে একসঙ্গে জামাত করেই। ৬/৭ শো গজ যেতেই কানে ভেসে এলো কোনো এক ইমামের সদম্ভ ঘোষণা। তিনি যে মসজিদে কর্মরত সেই মসজিদের মাইক থেকে আরবীতে বারবার চিৎকার করে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছেন। একই সঙ্গে এও ঘোষণা দিচ্ছেন যে আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো উপাস্য নেই। ঘোষণা দুটি আরবীতে এ রকম – আল্লাহো আকবর, আল্লাহো আকবর। লা এলাহা ইল্লালাহু। ইদের জামাতে নামাজ শুরু করার আগে ইমামগণ বারবার এগুলো উচ্চারণ করে থাকেন। ইমাম সাহেব আরবীতে এই কথাগুলি মাইকে বলে মুসলিমদের ঈদের নামাজ পড়ার জন্যে তাড়াতাড়ি ইদগাহে যেতে বলছেন। আর একটু দূর গিয়ে শোনা গেলো আর একটা মসজিদ থেকে মাইকে সেই কথাগুলিই। এ কণ্ঠটি কিন্তু ইমামের নয়, একটা অল্প বয়সী বালকের। গ্রামের মসজিদগুলিতে নামাজ পড়ার পাশাপাশি আরবী ও ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হয়। তাই মসজিদকে মকতবও (মাদ্রাসাও) বলা হয়। সেই মকতবের কোনো এক তালবিলিমকে (শিক্ষার্থীকে) বালকদের এভাবেই তালিম (শিক্ষা) দিয়ে ভবিষ্যতের ইমাম বা মৌলানা বা মুজাহিদ তৈরি করার পাঠ দেওয়া হয়। আর একটু দূর যেতে দেখলাম আমার পরিচিত দু’ই ব্যক্তি (ওরা দু’ই ভাই) একটা চালার তলে বসে গল্প করছে। হাঁটতে হাঁটতেই ওদের সঙ্গে কথা বললাম। ওদের মুখে শুনলাম যে ঈদের জামাত শুরু হবে সকাল সাতটায় ওদের ইদগাহে। ইতিমধ্যেই রাস্তার ধারে কয়েকটা পশুকে (ঈদে কুরবানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে) গোসল দেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে। সামনে যেতে এগোতে থাকলাম ততই বেশী বেশী করে পশু গোসল দেওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে পড়তে থাকলো। একটা গ্রামের মধ্যে এ রকম আর একটা পশু গোসলের দৃশ্য চোখে পড়লো। এটা দেখে একটু অবাক হলাম। যে একটা ছাগলকে গোসল দেওয়ার পবিত্র(!) কাজটি সম্পন্ন করছে সে আমার ছাত্র। ছেলেটি কিন্তু গোঁড়া নয়, এবং এমনকি খুব একটা যে ধর্মনিষ্ঠ তাও নয়, বরং অনেক উদার। ওকে আমি খুব ভালো করে চিনি। কারণ, সে আমাদের ‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ’-এর সদস্য এবং আমার ছাত্রও। সে উচ্চ শিক্ষিত (ন্যূনতম স্নাতক তো বটেই) এবং ভীষণ মার্জিত। কুরবানি দেওয়ার জন্যে মুসলিমরা অনেকেই বাড়িতেই ছাগল পোষে। এ রকম ছাগলদের বাড়ির সবাই খুবই যত্ন করে প্রতিপালন করে। কথিত আছে যে, ইসমাইলকে কুরবানি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে গোসল দেওয়া হয়েছিলো। সে জন্যেই মুসলিমদের কুরবানির পশুকে কুরবানি করার আগে গোসল করানোর রীতির প্রচলন আছে। অতি যত্নে সন্তান স্নেহে পালন করা ছাগলটিকেই ঈদের নামাজের শেষে শানিত ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ইমামের হাতে তুলে দেওয়া হবে পরমানন্দে কুরবানি তথা হত্যা করার জন্যে। ইমাম সাহেব তারপর পাকা কসাইয়ের মতন নির্মমভাবে একটার পর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পশুগুলিকে জবেহ (হত্যা) করে মালিকের হাতে তুলে দিবেন। তারপর মালিকরা কয়েকজন মিলে সদ্য কুরবানি (খুন) হওয়া ছাগলটির রক্তাক্ত লাশ থেকে চামড়া খালিয়ে (ছাড়িয়ে) হাড় ও মাংস আলাদা করে মাংসের তিন ভাগের এক রেখে দু’ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে মহানন্দে বিলি-বণ্ডনে মেতে উঠবে। তারপর কয়েকদিন ধরে সন্তান স্নেহে পালিত সেই ছাগলটার মাংস পরম তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করবে। ছ’মাস/এক বছর বা তারও বেশী সময় ধরে বাড়ির সবাই মিলে একটা ছাগলটাকে পরম স্নেহে ও আদরে পেতিপালন করে তাকেই হাসতে হাসতে ইমামে ছুরির নীচে দিয়ে দেওয়া এবং তারপর তারই মাংসকে পরম তৃপ্তিতে ভক্ষণ করা যে খুবই বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক, অমানবিল ও বর্বর প্রথা তা বলা বাহুল্য। ধর্মান্ধ ও প্রগাঢ় ধর্মনিষ্ঠ মুসলমাদের কথা স্বতন্ত্র, কারণ তাদের বিবেকবোধ নষ্ট হয়ে গেছে ধর্মের জাঁতাকলে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক মনস্ক ও মার্জিত ছেলেমেয়েরা (মেয়েরাই তো মহানন্দে তাদেরই প্রিয় ও প্রতিপালিত ছাগলের মাংস রান্না করে) যখন এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে মনের সুখে সম্পৃক্ত করে তখন বিস্মিত না হয়ে পারি না। তাই অবাক হয়েছিলাম আমার সেই ছাত্রটিকে যে উচ্চ শিক্ষিত এবং আমার সঙ্গে ‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চে’ সামিল (অন্তর্ভুক্ত) থেকে নারীর উচ্চশিক্ষা ও সমানাধিকারের দাবিতে সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় তাকে তাদের গৃহপালিত ছাগলটিকে কুরবানি (হত্যা) করার নিমিত্ত গোসল করাতে দেখে। পঞ্চাশ মিনিট ধরে কয়েকটা গ্রাম ও পাড়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যখন ঘরে ফিরলাম তখন বুঝে গেলাম যে এবার অন্যান্য বারের মতনই সাড়ম্বরে ঈদ উদযাপন হতে যাচ্ছে।
ঈদ যাপনের প্রস্তুতিতে মুসলিম নারীর ব্যস্ততাও অবাক করার মতন
গতকাল (অর্থাৎ ঈদের দিন) ভোরবেলা হাঁটতে গিয়ে আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম। মুসলিম নারীরা এখন বহুমূত্র ব্যাধির কারণে ভোরবেলা রোজ দলে দলে হাঁটে। কিন্তু কাল একজন মুসলিম নারীকে রাস্তায় দেখলাম না। আসলে ঈদের দিন তাদের ভোরবেলা হাঁটতে যাওয়ার ফুরসত থোরায় থাকে। খুব ভোরে উঠেই ঈদের প্রস্তুতিতে কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, তখন তাদের দম ফেলার যো থাকে না। বাড়ির পুরুষরা সবাই গোসল করে সেজেগুজে চোখে সুরমা দিয়ে গায়ে আতর মেখে এবং আতর লাগানো এক টুকরো তুলো কানে গুঁজে ঈদের নামাজ পড়তে যাবার আগে তাদের সামনে লুচি, পুরি, পায়েস, সিমাই ইত্যদি নানা রকম উপাদেয় খাবারের প্লেট সাজিয়ে দিতে হয়। খুব ভোরে উঠে বাড়ির সব মেয়েদের সেই খাবার তৈরি করার কাজে লেগে পড়তে হয়। পুরুষরা নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেলে বাড়ির মেয়েরা তাড়াহুড়ো করে নিজেদের গোসল ও সাজগোজ সেরে বাড়ির মধ্যেই ঈদের নামাজ পড়ার ইমানি কর্তব্যটা সম্পন্ন করে ফেলে পুরুষরা বাড়ি ফেরার আগেই। তারপর কিছুটা দম ফেলার পরই বাড়ত্র চলে আসে কুরবানির মাংস। সেগুলো তিন ভাগ করে দু’ভাগ পাড়ায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করা। তারপর রানাবান্না কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া। ঈদের দিন মেয়েদের কাজের শেষ থাকে না। মুসলিম নারীদের ঈদের প্রস্তুতি পর্বটা শুরু হয় ঈদের ২/৩ দি আগে থেকেই। বাড়ির সমস্ত ময়লা কাপড় পরিষ্কার করা, গোটা বাড়িটা মুছে-ধুয়ে পরিষ্কার করা, ঈদের মাংস রান্না করার জন্যে নানা রকম মশলা তৈরি করা, ইত্যাদি কত কাজ করতে হয় মেয়েদের। আমি অবাক হয়ে দেখি, ঈদ উপলক্ষে এত সব কাজ মেয়েরা আনন্দের সঙ্গেই সম্পন্ন করে। হায় রে নারী! তার ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাবার অনুমতি ও অধিকার নেই, অধিকার নেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার, নেই অধিকার ইমামতি করার, তবু ঈদের সব কাজই (পশু জবাই বাদে) মেয়েরাই করে, করতে তাদের হয়। এটা যে চরম অবিচার, বৈষম্য ও বঞ্চনা সে কথা মুসলিম মেয়েরা কবে যে বুঝবে?
দৈহিক দুরত্ব বিধি মানা তো পরের কথা, কারও মুখে মাস্ক পর্যন্ত দেখলাম না
সকাল সাতটায় জামাত। কতো মানুষ ঈদগাহ যায় তা দেখার কৌতূহল নিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম পোনে সাতটার কিছুক্ষণ আগে। যা আঁচ করেছিলাম তাই দেখলাম। মানুষ ইদগাহ-র উদ্দেশ্যে দল বেঁধে চলেছে। প্রায় সাতটা পর্যন্ত রাস্তা ধরে মানুষ হেঁটে চলেছে জামাত ধরার জন্যে। মাত্র দু’জনের মুখ মাস্ক ও একজনের মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা দেখলাম। করোনা আর দূরে পারে নেই, আমাদের গ্রামেও ঢুকে পড়েছে। তবুও মানুষ যেন বেপরোয়া। যেন করোনা ভাইরাস এবং সরকারকে ইদগাহ মুখি মুসলিম জনতার চ্যালেঞ্জ জানানোর মেজাজ। তা অবশ্য নিশ্চয়ই নয়। এ হচ্ছে তাদের চরম অজ্ঞতা, আত্মসচেতনতার দৈন্যতা, ও মূর্খতার নিদর্শন। আমি একজন ঘোষিত নাস্তিক। ২০০৫ সালে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং আমার মাথার দাম ধার্য করা পাঁচ লক্ষ টাকা। তখন থেকেই আমি মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কৃতও। এতদসত্বেও আমি আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় নি, এবং আজও মুসলিম সমাজেই বাস করছি। মুসলিম সমাজের উন্নতি, প্রগতি ও বিকাশের জন্যে নানাবিধ সানাজিক কাজ ও আন্দোলনের কাজ আজও করি। সুতরাং কোনো সনশয় নেই যে আমি মুসলিম সমাজেরই একজন। মুসলিম সমাজের লোক হিসাবে গতকাল ১লা আগষ্ট ঈদ-উল-আযহার দিনে মুসলিমদের করোনার বৈশ্বিক মহামারী সম্পর্কে যে চরম ও লজ্জাজনক অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা, অসেচতনতা ও মুর্খতা স্বচক্ষে দেখলাম তা আমাকে শুধু অবাকই করে না, আমাকে লজ্জিতও করে, আমার মাথা হেঁটও করে।
সমাপ্ত। ০২.০৮.২০
আপনার লেখা পড়লাম। এখন যা কুম্ভ মেলায় হচ্ছে তা নিশ্চয়ই অজানা না। নাকি আপনিও hypocrite। অবশ্য নব্য নাস্তিক এবং চাটুকার নাস্তিক সর্বদা একটি বিশেষ দলকে খুশি করার জন্য "নাস্তিক-ব্যবসা" চালায় আশা করি আপনি এমনটি নন।
ReplyDelete