Sunday, May 27, 2018

সৌদি আরবে কি মুত্তাজিলা স্বর্ণযুগ আবার ফিরে আসছে?



নারী-পুরুষ মেলামেশায় আর নানয় – স্পষ্ট জানিয়ে দিলো সৌদি সরকার। এ আদেশ যে শরিয়া আইনের পরিপন্থী তা বলা বাহুল্যশরিয়া আইনে কোনো পরিস্থিতিতেই নারী ও পুরুষের মেলামেশা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কোরানের স্পষ্ট ভাষ্য হলো - নারীর স্থান ঘরের মধ্যে, সাজগোজ করে তারা বাইরে যেতে পারবে না। নির্দেশটি এ রকমঃ “ তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রাচীন জাহিলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না।”  (কোরান, ৩৩/৩৩) যদি বাইরে যাওয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে? ২৪/৩১ এবং ৩৩/৫৯ নং আয়াতে কোরান বলছেঃ  নারীকে হিজাব পরতে হবে যাতে তাদের কেশপাশ, কর্ণমূ্‌ল,  গ্রীবা ও বক্ষোদেশ সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত থাকে। শুধু হিজাব পরলেই হবে?  না, হবে না বাড়ির বাইরে পা রাখতে হলে স্বামী বা পিতার অনুমতি নিতে হবে এবং একজন পুরুষ অভিভাবককে পাহারাদার নিতে হবে। নারীদের সম্পর্কে এরূপ অসংখ্য বিধি-নিষেধ রয়েছে কোরান ও হাদিসে। কোরান ও হাদিসের এই বিধানগুলিই সৌদি সংবিধানের পারিবারিক আইনের মূল ভিত্তি। সেই সংবিধান অনুসারেই সৌদি আরবে এতদিন নারী-পুরুষ মেলামেশা ছিলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সৌদি সরকার অবশেষে সেই বিধানটা বাতিল করলো। 

কিন্তু চার বছর আগেও আমরা অন্য কথা শুনেছি। শুনেছি শরিয়া আইনে অনড় ও অটল থাকার বলিষ্ঠ ঘোষণা। ২০১৪ সালে ওয়াশিংটনে সৌদি বিচার মন্ত্রী আলঈশা  দৃঢ়তার সঙ্গে  জানান যে কোনো পরিস্থিতিতেই সৌদি আরব সরকার আল্লাহ্ কোনো বিধান বাতিল করবে না।  তিনি অবশ্য এই ঘোষণা দেন মুণ্ডুচ্ছেদ বেত্রাঘাত করার মত অমানবিক শরিয়া বিধি প্রসঙ্গে।  একটি ভাষণে তিনি বলেন - “These punishments are based on divine religious texts and we cannot change them,” (আল্লাহ্ তৈরী করা বিধানের এই শাস্তিগুলি আমরা পাল্টাতে পারিনা।)  সৌদি মন্ত্রী যা বলেছেন যথার্থই বলেছেন। কারণ,   আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ এর নেতৃত্বে ১৯২ সালে যে সৌদি  রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা হয় তার রাষ্ট্রধর্ম ছিলো ইসলাম।


সৌদি আরব রাষ্ট্রের প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় কিন্তু তারও দেড়শ’ বছর আগে ১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ বিন সৌদের হাত ধরে তাঁর আমলেই এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব জিহাদের ডাক দেনসেই জিহাদের উদ্দেশ্য ছিলো তাদের দেশ সহ ইরাকমিশরভারতইয়েমেন  সিরিয়াতে থাকা যাবতীয় অনৈসিলামিক উপাদান দূর করা। জিহাদের এই আহ্বান বা ডাককেই ওয়াহাবিরা তাওহিদের বিশ্বাসের পুনপ্রতিষ্ঠা হিসেবে দেখেন। অনেক সালাফির দৃষ্টিতে এটি বৃহৎ পরিসরে সালাফি সংস্কার আন্দোলনের সূচনা। তারপর সৌদি রাষ্ট্র অনেক ভাঙাগড়া হয়েছে। ১ম সৌদি রাষ্ট্রের পতন হয়েছে। আবার তৈরী হয়েছে ২য় সৌদি রাষ্ট্র। তারও পতন হয়েছে। ১৯০২ সালে ফের তৈরী হয়েছে তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রটিই  এখনকার সৌদি আরব রাষ্ট্র যার বাদশা হলেন বর্তমানে সালমান বিন আজিজ সৌদ এবং রাজপুত্র হলেন মুহাম্মদ বিন সালমান যিনি সারা দুনিয়ায় এমবিএস নামেও পরিচিত। সৌদি রাষ্ট্রের বারবার ভাঙাগড়ার কারণে ইসলামি আদর্শেও বিচ্যুতি এসেছে বহু। সেই বিচ্যুতি দূর করতে ১৯৯২ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশা জানিয়ে দেন যে সৌদি আরবে কুরআন সুন্নাহ (হাদিসই) হবে  রাষ্ট্রের সংবিধান, অর্থাৎ সৌদি আরব শরিয়া আইনকেই কঠোরভাবে অনুসরণ করবে।  


নারী-পুরুষের মেলামেশা থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অর্থ হলো কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ  তথা শরিয়া আইন থেকে সরে আসা। ১৭৪৪ সাল থেকে সৌদি রাজবংশ যে শরিয়া আইনকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে এসেছে সেই শরিয়া আইন থেকে সৌদি রাজবংশের বর্তমান উত্তরসূরীরা যে সরে আসতে চায় তার সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে নারী-পুরুষের মেলামেশায় অনুমতি দেওয়ার সরকারী ঘোষণার মধ্যে। শরিয়া আইন থেকে সৌদি আরব যে বেরিয়ে আসতে ব্যাকুল ও বদ্ধপরিকর তা বোঝা যায় ২০১৫ সালেই। শরিয়া আইন মুসলিম নারীকে হাজারো শেকলে বন্দি করে রেখেছে। বস্তুতঃ খাঁচার পাখীর মত সম্পূর্ণ অসহায় ও পরাধীন জীবন হলো নারীর। ফলে সৌদি আরবে নারীর ভোটাধিকার, চাকরি করার অধিকার, গাড়ি চালাবার অধিকার, বাইক বা সাইকেল চালাবার অধিকার, ব্যাংক এ্যাকাউণ্ট খোলার অধিকার, বাণিজ্য করার অধিকার, বাবার সিংহাসনে বসার অধিকার, পুরুষের সঙ্গে মেশার অধিকার, পর্দার আড়ালে থেকেও পুরুষের সঙ্গে কথা বলার অধিকার, একাকী বাইরে যাওয়ার অধিকার, হিজাব না পরার অধিকার, পছন্দের পোশাক পরার অধিকার, মাঠে গিয়ে খেলার অধিকার, পুরুষের খেলা দেখার অধিকার, পছন্দ করে বিয়ে করার অধিকার, বিয়ে না করার অধিকার, বিয়ে ভাঙার অধিকার, তালাক দেবার অধিকার, এ সব কোনও অধিকারই নাই মুসলিম নারীর। তারা পুরুষ যেসব অধিকার ভোগ করে তার সব থেকে মুসলিম নারী বঞ্চিত। সৌদি আরব এসব শরিয়তি বিধান মেনে এসেছে দেড় হাজার বছর ধরে কঠোরভাবে। পান থেকে একটু চুন খসলেই শরিয়তি চাবুক পড়েছে নির্মমভাবে নারীর উপর। সৌদি বাদশা সালমান বিন আজিজ সৌদ ২০১৫ সালে প্রথম নারীর একটা শৃঙ্খল খুলে দেন। তিনি দেন নারীকে ভোট দেবার অধিকার দেন। শুধু ভোটাধিকারই নয়, পৌর নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকারও দেন। নারীকে ভোটাধিকার ও ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার প্রদান দু’টোই নিঃসংশয়ে শরিয়া বিরুদ্ধ। কারণ, ইসলামে নারীর নেতৃত্ব প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে হাদিসে যা রয়েছে তা হলো - “সে জাতি কখনই সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোনো রমণীর হাতে অর্পণ করে। [বুখারী শরীফ, ১ম-৭ম খন্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, হা নং – ৩৩৬৬)   

নারীকে শরিয়তের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার সাহসী ও ঐতিহাসিক সূচনা বাদশা সালমান বিন আজিজ সৌদের হাত ধরে হলেও নারীকে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ শৃঙ্খল মুক্ত করার অভিযান চলছে কিন্তু যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান তথা এমবিএসের নেতৃত্বে। মাত্র তিন বছরেই নারীর উপর থেকে সৌদি সমাজের প্রধান প্রধান শরিয়তি বিধিনিষেধগুলি সরিয়ে নারীকে দেওয়া হয়েছে অনেকগুলি অধিকার যার মধ্যে রয়েছে - গাড়ী চালানোর অধিকার, হিজাব পরিত্যাগ করার অধিকার, একাকী বাড়ির বাইরে যাওয়ার অধিকার, স্টেডিয়ামে পুরুষের সঙ্গে বসে খেলা দেখার অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার, কর্পোরেট সংস্থায় উচ্চ পদে চাকরি করার অধিকার, ওকালতি করার অধিকার, খেলার মাঠে খেলার অধিকার, ইত্যাদি।  

সৌদি আরবে শুধু নারীর ক্ষমতায়নই হচ্ছে না। এর বাইরে বৃহত্তর সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্রেও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে যেগুলি শরিয়তের পরিপন্থী। মূল কথা হলো, সৌদি আরবে একটা পরিকল্পিত সমাজ সংস্কারের অভিযান চালানো হচ্ছে যার লক্ষ্য হলো একটি আধুনিক সৌদি আরব নির্মাণ করা। সৌদি আরবের বৃহত্তর অঙ্গনে কী কী পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তা উল্লেখ করার পূর্বে একটা অত্যন্ত জরুরী কথা বলে নিতে চাই। সেটা হলো এই যে, সৌদি আরবে সমাজ সংস্কারের বীজ প্রথম বপন করেন বাদশা আবদুল্লাহ ইবনে আজিজ সৌদ। তিনিই প্রথম শরিয়তি বিধিনিষেধ ভেঙে ২০০৮ সালে ভ্যাটিকান গিয়ে পোপের সঙ্গে আলাপ করেন এবং সৌদি আরবে গীর্জা স্থাপনে অনুমতি প্রদানে সম্মতি  জানান। ২০১১ সালে ঘোষণা দেন যে নারীকে ভোটাধিকার দেওয়া হবে। ২০১৩ সালে ১৫০ আসন বিশিষ্ট মজলিসে সুরায় (সৌদি বাদশার উপদেষ্টা পর্ষদে) ৩০ জন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১৪ সালে নারীর খেলাধূলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এই পদক্ষেপগুলি নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সৌদি আরবে সমাজ সংস্কারের যে বীজটি তিনি পুঁতেছিলেন সেটা বাদশা সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদের লালন পালনে আজ বৃক্ষে পরিণত হতে চলেছে।   

শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে আমূল  সংস্কারের ছবি চোখে পড়ছে সৌদি আরবে। চলচ্চিত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ শরিয়তে। তবুও সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সৌদি সরকার খুলে দিয়েছে সিনেমা হল। কনসার্টেরও আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে একটি কনসার্টে (সঙ্গীতানুষ্ঠানে) হাজার হাজার নারীর সামনে লেবাননী গায়িকা হিবা তাওয়াজির গান করেন। কমিকসের জনপ্রিয় চরিত্রদের নিয়ে সম্প্রতি কমিক-কন সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এভাবে কখনও গানের অনুষ্ঠানে মহিলা শিল্পী এনে, কখনও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মেয়েদের বাস্কেটবল টুর্নামেণ্টের আয়োজন করে একের পর প্রথা ভেঙে চলেছে সৌদি সরকারজেড্ডায় খোলা হয়েছে শুধু মহিলা ক্রেতাদের জন্যে একটি মোটর গাড়ির শোরুম। সৌদি সরকার বিনোদন শিল্পে সাড়ে ছ’শো কোটি ডলার নিয়োগ করবে বলে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা করেছে। রাজধানী রিয়াধে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের ধাঁচে একটি অত্যাধুনিক অপেরা হাউস নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

ইহুদীরা আল্লাহ্‌র অভিশপ্ত জাতি এবং মুসলমানদের চিরশত্রুকোরানের এই অমোচনীয় বাণীকে অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তাঁর নেতৃত্বে সৌদি সরকার সৌদি আরবে শিল্প স্থাপনের জন্যে ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে। সৌদি আরবের আকাশ পথ ইসরাইলের বিমান ও ইসরাইল গামী বিমানের জন্যে ছিলো এতদিন রুদ্ধ। সে পথ তিনি খুলে  দিয়েছেন হাট করে ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম ইস্যু খুবই বিতর্কিত। দেশটা কার – ইহুদীদের না মুসলিমদের? কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখেই তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে ফিলিস্তিনিদের মতো ইহুদিদেরও তথা ইসরাইলি নাগরিকদেরও আলাদা রাষ্ট্র গড়ার অধিকার আছে। 
সৌদি আরবে ধর্মগুরুরা অসীম ক্ষমতাধর। শরিয়ত লঙ্ঘনকারীদের চাইলেই তারা গ্রেপ্তার করতে পারতেন। তাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। রোজা ও নামাজ প্রভৃতি ধর্মাচার অনুসরণ ও অনুশীলন করার গুরুত্ব শরিয়তি সমাজ ব্যবস্থায় সব কিছুর উপরেসৌদি আরবে তাই দিনে পাঁচ ওয়াক্ত (পাঁচ বার) নামাজের সময় সমস্ত দোকানপাট, ক্যাফে, রেস্তরাঁ, এমনকি ওষুধের দোকান পর্যন্ত খুলে রাখা ছিলো আইনতঃ দণ্ডনীয়। এই শরিয়তি আইনটিও বাতিল করা হয়েছে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, নামাজের সময় এগুলি খোলা রাখা আইনতঃ বৈধ বলে এখন থেকে গণ্য হবে।

এমবিএস সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে আরও দু’টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা উপরে বর্ণিত পদক্ষেপগুলির মতই দুঃসাহসিক ও প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ। তার একটি হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, অন্যটি হলো সামরিক বিভাগের শীর্ষ স্তরে কর্মকর্তাদের অপসারণ। সারা বিশ্বে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির অধিকাংশই মুসলিম দেশ। কারণ মুসলিম দেশগুলিতে মানুষকে ধার্মিক করে গড়ে তোলার জন্য যত জোর দেওয়া হয় তার ক্ষুদ্রাংশ পরিমানও জোর দেওয়া হয় না সৎ ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে। ফলে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির তালিকায় মুসলিম দেশের নাম দেখা যায় না। সৌদি আরবও অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশ। দুর্নীতি হলো একটি ভয়ংকর ও সংক্রামক সামাজিক ব্যাধি। সমাজ সংস্কার ও দুর্নীতি হাত ধরাধরি চলতে পারে না। এমবিএস তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অভিযান পরিচালনা করার জন্যে একটি শক্তিশালী কমিটি তৈরী করেছেন যার নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি স্বয়ং। এই কমিটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অভিযান শুরু করছে একেবারে সমাজ ও প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে। সেই অভিযানে যে সব বড়ো বড়ো চাঁইরা ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে ১১জন রাজপুত্র, চারজন বর্তমান মন্ত্রী এবং প্রায় ডজন খানেক সাবেক মন্ত্রীসংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাধারণতঃ প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে থাকা বাস্তুঘুঘুর দল। বাস্তুঘুঘুদের বাসা ভাঙতে ২৬শে ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে অপারেশন চালিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছে শীর্ষ স্তরের কর্মকর্তাদের যাদের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের সেনাপ্রধানসহ বিমান বাহিনী, পদাতিক বাহিনী এবং বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানরাও। সৌদি ন্যাশনাল গার্ড এবং নৌবাহিনী প্রধানের পদেও করা হয়েছে রদবদল।  

সারা বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এখন সব চেয়ে যে প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা চলছে তা হলো, সৌদি আরবের রাজা ও যুবরাজ হঠাৎ কেন সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার অভিযান পরিচালনা করছেন? কেন আজন্ম লালিত শরিয়তের সড়ক পরিত্যাগ করে বিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তির সড়কে তাঁরা পা রাখছেন? এর জবাব খুঁজছেন বিশ্বের মানুষ নানা অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। যারা ইসলামিক মতাদর্শের অবস্থান থেকে দেখছেন তাদের চোখে এমবিএস হলেন একজন শয়তান যিনি ইসলামের শত্রু আমেরিকা ও ইসরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসলামকে ধ্বংস করার অভিযান শুরু করেছেন। ইসলামকে ধ্বংস করার বাসনা এমবিএসের রয়েছে কী না তা তিনিই জানেন। তবে কোনো সংশয় নেই যে ৩২ বছর বয়সী এমবিএসের সৌদি আরবকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতেই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমুল সংস্কার করার অভিযান পরিচালনা করছেন। তাঁর ভিশন ২০৩০ সালের লক্ষ্য হলো সৌদি আরবকে তেল নির্ভর অর্থনীতির হাত থেকে বের করে শিল্প নির্ভর অর্থনীতির উপর দাঁড় করানো। সৌদি রাজতন্ত্রের শক্তির প্রধান উৎস ছিলো এতদিন দু’টি – অঢেল প্রাকৃতিক তেল সম্পদ ও ইসলাম। কিন্তু যেদিন তেল সম্পদ ফুরিয়ে যাবে সেদিন শুধু ইসলাম কি সৌদি রাজতন্ত্র ও সৌদি আরবকে রক্ষা করতে পারবে? ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথ্যাম হাউসের বিশ্লেষক জেন কিনিনমন্ট লিখেছেন যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যাচ্ছে যে তেলের অর্থ এখন আর সরকারি ব্যয় মেটানো বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে যেদিন তেল ভাণ্ডার শুকিয়ে যাবে সব চেয়ে ভালো বুঝছেন সৌদি রাজা সলমান ও যুবরাজ এমবিএসতাই তাঁদের জন্যে বিকল্প পথের সন্ধান করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছেআর শরিয়তি সমাজের বিকল্প যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তি ভিত্তিক আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা তা বলা বাহুল্য।  

এমবিএসের নেতৃত্বে সৌদি সরকারের নারীর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন, গানবাজনা ও নৃত্যকে আবাহন, ধর্মগুরুদের গুরুত্বহীন করণ, ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ও ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান প্রভৃতি পদক্ষেপগুলি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আরবের স্বর্ণযুগের মুত্তাজিলা নীতির কথা। তখন খেলাফত পরিচালিত হতো এই নীতির দ্বারা যার মূল কথা ছিলো - মানুষের যুক্তিভিত্তিক চিন্তার ফসলগুলি কোরানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবে সমাজ সংস্কারের সামগ্রিক চিত্র দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে – ইসলামের সূতিকাগারে কি মুত্তাজিলা স্বর্ণযুগ আবার ফিরে আসছে?

No comments:

Post a Comment

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...