মাবিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ
কারবালা যুদ্ধের জন্য পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়া তথা
মাবিয়াকে প্রধানত দায়ী করে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি উত্থাপন করা হয়েছে এবং
ইতিহাসে যা যুগ যুগ ধরে মান্যতা বা স্বীকৃতি পেয়ে আসছে সেই অভিযোগগুলির সত্যতা বা
যথার্থতা মোটেই প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীত নয়। মুসলিম ঐতিহাসিকগণের মূল
অভিযোগ হলো, কারবালা যুদ্ধের
ঘটনা ঘটতোই না যদি তৃতীয় খলিফা ওসমানের নিহত হওয়ার পর আলি যখন চতুর্থ খলিফা হন তখন
মাবিয়া যদি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে তাঁর হাতে বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নিতেন। মাবিয়া কেন বয়াত নেন নি আলির হাতে? কারণ, তাঁরা বলেছেন যে মাবিয়ার প্রবল লালসা ছিল খলিফা হওয়ার। সে জন্য তিনি বয়াত না নিয়ে একটা অজুহাত খাড়া
করেছিলেন যে আগে ওসমানের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। মাবিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই গুরুতর অভিযোগটির পক্ষে
যুক্তিগ্রাহ্য কোনো প্রমাণ
কিন্তু ঐতিহাসিকরা উপস্থাপিত করতে পারেন নি। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই গুরুতর অভিযোগটি তোলা হয়েছে মাবিয়ার বিরুদ্ধে তাঁকে স্রেফ কালিমালিপ্ত করার জন্যে। ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ের দিনপঞ্জী ও
ঘটনা প্রবাহ এবং ওসমানের হত্যাকান্ড ও
তারপর আলির খলিফা হওয়ার ঘটনা – এগুলি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার- বিশ্লেষণ
করলে কখনই মনে হয় না যে মাবিয়া আলির নিকট ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির যে দাবী তুলেছিলেন
সেটা তাঁর একটা অজুহাত ছিল মাত্র । এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। সেটা হলো এই যে, উক্ত দাবিটি (সর্বাগ্রে খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের
শাস্তি দিতে হবে) শুধু একা মাবিয়ারই ছিলো না। দাবিটি ছিলো ইসলামি সাম্রাজ্যের সমস্ত মুসলমাদেনই। সে সময় যে সব সাহাবী জীবিত ছিলেন তাঁরাও সেই দাবিতে মুখর হয়েছিলেন। কিন্তু আলি নানা অজুহাতে দাবিটিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। ফলে তাঁরা এতোই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন যে শেষ পর্যন্ত মদিনা শহর ছেড়ে মক্কা
চলে যান। মুহাম্মদের সর্বাধিক প্রিয়তমা
বউ আয়েশা একথা শুনে যার পর নাই ক্ষুব্ধ হয়ে
ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে আলির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সাহাবিগণ মক্কা না গিয়ে মাঝপথে ফিরে এসে আয়েশার
সঙ্গে যোগ দেন। সাড়া দেয় কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ
মুসলমানও।
ফলে আলির বিরুদ্ধে বেধে যায় যুদ্ধ যার নেতৃত্ব করেন আয়েষা। এই যুদ্ধটি ইতিহাসে জামালের যুদ্ধ নামে খ্যাত। জামালের যুদ্ধ থেকে যেটা প্রতীয়মান হয়
তা হলো, আলি খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে অস্বীকার করেছিলেন বলেন আয়েষা
সহ সাহাবিগণ আলির বিরুদ্ধে জিহাদে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাবিয়ার
ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছিল। সুতরাং এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে ওসমানের
হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবী তোলার মধ্যে মাবিয়ার কোনো প্রকার
দুরভিসন্ধি ছিল না, যা ছিল তা হলো
একজন বিবেকবান ও আদর্শবান গভর্ণরের সঠিক, নীতিসম্মত, ন্যায়সঙ্গত ও নির্ভিক পদক্ষেপ। এটা সংশয়াতীত ঘটনা যে, খলিফা হওয়ার পর আলি যদি ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে উদ্যোগী
হতেন তবে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে যেতেন না। তা না করে উল্টে
তিনি হত্যাকারীদের নিয়েই শাসনকার্য
পরিচালনা করতে শুরু করেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু না, অবিশ্বাস করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, ধর্মপ্রাণ মুসলিম
ঐতিহাসিকগণও
যাঁরা আলিকে একজন শিশুর মত নিষ্পাপ বলে
শংসাপত্র দিতে সদা দরাজহস্ত তাঁরাও এ কথা অস্বীকার করেন নি। ড. ওসমান গণিও তাঁর বইয়েও এ কথা স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, “অন্যদিকে, খলিফা আলীর সাথে যাঁরা
ছিলেন, তাঁরা সব সাধু চরিত্রের সাহাবা, কিছু সহজ সরল জনতা এবং কিছু মানুষ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওসমান হত্যার সাথে
জড়িত।” (দ্রঃ হযরত আলী [রাঃ], পৃ-৯৮)
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, মুসলিম ঐতিহাসিকগণ আলীকে নির্দোষ প্রমাণ করার যে প্রয়াস করেছেন তা শুধু হাস্যকরই
নয়, যথেষ্ট লজ্জাকরও বটে। এই লজ্জাকর প্রচেষ্টাকে বিশ্বাসযোগ্য
করার জন্যে মুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকগণ কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে বহু মিথ্যা কথা ঢুকিয়ে
দিয়েছেন। যেমন ড.গণি দাবী করেছেন যে, ‘আলির
সাথে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সব সাধু চরিত্রের সাহাবা, কিছু সহজ সরল জনতা ...’। এই দাবীটি যে সত্যি নয় তার প্রমাণ আমরা
একটু আগেই পেয়েছি। দেখেছি যে, বেশ কিছু প্রবীণ ও প্রথম শ্রেণীর সাহাবী এবং মুহাম্মদের
প্রিয়তমা বউ আয়েশা আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে করেছেন। আলিকে নির্দোষ সাজাতে গিয়ে মুসলিম
ঐতিহাসিকগণ অন্যায় ও অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতেও দ্বিধা করেন নি। সে রকম একটি জঘন্য
কৌশল হলো মাবিয়াকে নিকৃষ্ট করে চিত্রিত করা যাতে আলিকে মহৎ হিসেবে দেখানোর পক্ষে
সুবিধাজনক। এটা একটি হীন কৌশল বৈ নয়। মাবিয়াকে ছাড়াও আরও অনেককে সৎ ও নির্লোভ সাহাবিদের তাঁরা
স্বার্থপর, সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী বলে বদনাম করেছেন। যেমন ড.গণি এক জায়গায় বলেছেন, ‘বলতে যদিও
খারাপ লাগে আমির মুয়াবিয়া স্রেফ লোভে-প্রলোভনে, পদে-পদবীতে, এবং টাকার জোরে আরব
মেধাগুলোকে রাতের আঁধারে ছাগল বাঁধা করে বেঁধে ফেললেন।’ (দ্রঃ – ঐ) আলিকে মহৎ ও নির্দোষ
দেখাতে গিয়ে এইভাবে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ শুধু মাবিয়াকেই নয়, যাঁরাই আলির বিরোধিতা
করেছেন তাঁদেরকেও কুৎসিতভাবে কালিমালিপ্ত
করতে দ্বিধা করেন নি। ইতিহাস রচনায় যাঁরা এরূপ হীনতা, দীনতা ও নীচতার দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছেন তাঁরা ক্ষমার অযোগ্য।
মাবিয়ার বিরুদ্ধে দুটি নৃশংশ হত্যাকান্ড
ঘটানোর অভিযোগ অনেকেই উত্থাপন করেছেন। প্রথমটি হলো আলির হত্যাকান্ড এবং দ্বিতিয়টি আলীর
জেষ্ঠ পুত্র তথা মুহাম্মদের জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হাসানের হত্যাকান্ড। আলিকে হত্যা করা
প্রসঙ্গে বলা হয়েছে
যে, মাবিয়া সম্মুখ সমরে না পেরে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছিলেন খলিফা
হওয়াত পথে প্রধান কাঁটাটা সরিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু এই অভিযোগেরও কোনো ভিত্তি দেখতে
পাওয়া যায় না। এই অভিযোগ করার উদ্দেশ্যও
একই, তা হলো, মাবিয়াকে জনসমক্ষে হেয় করা। যাঁরা অভিযোগ
উত্থাপন করেছেন তাঁরা
কিন্তু তাঁদের অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়ার ন্যুনতম দায়িত্ব পালন করেন নি। অপরদিকে তাঁরাই কিন্তু আবার এ কথাও বলেছেন যে,
আলির অনুগামীদেরই একটা অংশ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করেছিলেন যখন তিনি
সিফফিনের যুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন এবং তাঁরাই আলিকে হত্যা করেছে। আলির এই বিদ্রোহীরা ইতিহাসে খারিজি বলে অভিহিত।
কিছু ঐতিহাসিক এ প্রসঙ্গে অন্য মত পোষণ করেছেন। সে মতটি হলো এই যে আলি জিম্মিদের
হাতে খুন হয়েছেন। ড. ওসমান গণি খারিজিদের আলির হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন এ প্রসঙ্গে, ‘‘এবং খারেজিগণ
হেজাজের মাটিতে মক্কাতে বসে পরিকল্পনা
নিতে থাকলেন কি করে তিনজনকে অর্থাৎ হযরত আলী, আমির মুয়াবিয়া ও আমরকে বধ করা যায়।
হত্যার শপথঃ প্রথম আমর ইবনে বকর শপথ
গ্রহণ করে বলল – “আমি মিশরের শাসনকর্তা আমরকে বধ করার
দায়িত্ব নিলাম”। ... আব্দুর রহমান ... প্রকম্পিত হ্রদয়ে বলে উঠলো -“আমী আলীর দায়িত্ব নিলাম।” ... তিনিটী আরবীয়
তরবারি একসঙ্গে চমকিয়ে,
ঝলসিয়ে ও গর্জিয়ে উঠল শের-ই-খোদার মাথার ওপর। ... শের-ই-খোদা তরবারির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে
পড়লেন।’’’ (দ্রঃ ঐ – ১৬০-১৬৫) কিন্তু এইএই ড.গণিই আবার আলি নিহত হওয়ার ঘটনায় মাবিয়ার ঘাড়ে দোষ
চাপিয়েছে। তিন লিখছেন, ‘সিরিয়ার মাটিতে
বসে মুয়াবিয়া প্রাণপণে চেষ্টা করছেন ...যেমন করেই হোক হযরত আলীকে খেলাফত ছাড়া , প্রয়োজন
হলে দুনিয়া ছাড়া করতেই হবে।’ (সূত্রঃ ঐ, পৃ-১৬১) খারিজি
মুসলমানরাই আলিকে খুন করেছে – এ কথা বলার পরেও পরক্ষণেই তিনি অভিযোগের বর্শামুখ
ঘুরিয়ে দিয়েছেন মাবিয়ার দিকে। এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট বোঝা
যায় মুসলিম ঐতিহাসিকগণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আলিকে মহৎ ও শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে
গিয়ে মাবিয়াকে বলির পাঁঠা করতে চেয়েছেন।
ইমাম হাসানেরও মৃত্যু হয়েছিল ২য় খলিফা ওমর
ফারুক, ৩য় খলিফা ওসমান গণি এবং ৪র্থ খলিফা আলির মতোই ঘাতকের হাতে। তবে হাসানের
ক্ষেত্রে ঘাতক ছিলেন তাঁর একজন বউ যাঁর নাম ছিল যায়েদা। যায়েদা তাঁকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে
দিয়ে হত্যা করেছিলেন। তারজন্যও দোষ চাপানো হয়েছে মাবিয়ার উপরে। অবশ্য অনেকেই এ
বিষয়ে আঙুল তুলেছেন মাবিয়া-পুত্র
ষষ্ঠ খলিফা এজিদের দিকেও। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন মাবিয়া ও তাঁর পুত্র এজিদ উভয়েই ষড়যন্ত্র করে
হাসানকে হত্যা করেন। শেষোক্তদের দলে আছেন ড.ওসমান গণি। তিনি ‘হযরত আলী (রাঃ)’ গ্রন্থে এভাবে চার্জশীট লিখেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে, “অত্যন্ত
পরিতাপের বিষয় ছলে-বলে-কৌশলে-কায়দায় ইসলামের অগত্যা মুসলমান তদানিন্তন আমির
মুয়াবিয়া ও তাঁর চির কুখ্যনত পুত্র
ইয়েজিদের গভীর ষড়যন্ত্রে মহানবীর স্নেহের নাতি, হযরত আলী ও বিবি ফাতেমার চোখের মণি
সমগ্র মুসলিম জগতের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ইমাম হাসান আপন স্ত্রী জায়েদা কতৃক বিষ
প্রয়োগে পরলোক গমন করেন।” (দ্রঃ পৃ – ২২) জায়েদা তাঁর বরকে হত্যা করেছিলেন – এটা নিশ্চয়
অন্যায়, অমানবিক ও ঘৃণ্য একটি কাজ। কিন্তু এই ঘৃণ্য কাজটির জন্যে হাসানও
কোনো অংশে কম দায়ী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নারী-বিলাসী পুরুষ এবং নারীই
ছিল তাঁর জীবনে যেন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। নারীর প্রতি তাঁর
আকর্ষণ এত
তীব্র ও অস্বাভাবিক ছিল যা বর্ণণা করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। তিনি একজন বা
দুজন বা দুচারজন নারীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপনে তৃপ্ত হতে পারেন নি। নিত্য-নতুন নারীর সংস্পর্শ পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে যেতেন। আর তা পেতে একশ’টি বিয়ে করেছিলেন।
বউয়ের হাতে তাঁর অকাল প্রয়াণ না ঘটলে সেই সংখ্যাটা অর্থাৎ তাঁর বিয়ের সংখ্যাটা যে
কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে একদিনে চারজন বউকে তালাক
দিয়ে সেদিনই চারটি বিয়ে সম্পন্ন করেছেন। এরকম একজন
পুরুষের বউদের মানসিক
জ্বালাটা কীরূপ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। জায়েদা তাঁর মনের সেই অসহ্য জ্বালা
নিবারণের জন্যেই শেষ পর্যন্ত ঐ পথ বেছে নিয়েছিলেন। ‘সমগ্র মুসলিম
জগতের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ইমাম হাসানে’র এই মহান(!) চরিত্রটি আড়াল করার জন্যেই যায়েদার সঙ্গে মাবিয়া ও
এজিদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর সাহায্যে তাঁরা এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে চেয়েছেন। হাসানের
চরিত্রকে আড়াল করা গেল এবং একই সঙ্গে মাবীয়াকে একটা নিকৃষ্ট লোক বলে দেখানও গেলো।
মাবিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হলো
তিনি খলিফা মনোনয়নে ব্যাপারে হাসানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন তা লঙ্ঘন করে
এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন যারফলে কারবালা যুদ্ধের ঘটনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই যে চুক্তিটির কথা বলা হচ্ছে সেটা ইতিহাসে
যেমনটা শোনা যায় তা এ রকমঃ মাবিয়া তাঁর
মৃত্যুর পূর্বে ইমাম হাসানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইমাম হোসেনকে (ইমাম হোসাইন) খলিফা
মনোনীত করে তাঁর হাতে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফত অর্পণ করবেন। কথিত এই চুক্তিটি সত্যিই হয়েছিল এমন দাবীর জোরালো
প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে ইমাম হাসানের খেলাফত পরিত্যাগের কথা
স্মরণ করা যেতে পারে। এর কিছু আলোচনা ইতিপূর্বেই
করা হয়েছে। সেখানে আমরা লক্ষ্য করেছি যে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ও অবশ্যই স্বেচ্ছায়
ইমাম হাসান খেলাফতের দয়ীত্ব মাবিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি নারী ও ধন-দৌলত নিয়ে বিলাস-বৈভবে জীবনযাপন করতেই
ভালবাসতেন। খেলাফতের
মত বিশাল গুরুদায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তাঁর সেই শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ও মসৃণ জীবনে
বারবার ছন্দপতন ঘটছিল। আবার আর একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, মাবিয়ার
সাথে যুদ্ধ করে তিনি কোনোভাবেই পেরে উঠবেন না। তাই তিনি খেলাফতের গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে
নামিয়ে দেওয়াই সঠিক কাজ হবে বলে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন। হাসান কর্ত্তৃক
মাবিয়ার হাতে খেলাফত হস্তান্তরকরণের পশ্চাতে এই ছিলো মূল কারণ। এ রকম
পরিস্থিতিতে হাসান তাঁর ভাইকে খলিফা করতেই হবে এমন শর্ত মাবিয়ার
কাছে আরোপ করেছিলেন এবং সেই শর্তে অনড় ছিলেন এমন দাবী বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না।
হাসান তো নিতান্তই নিজের গরজে খেলাফত
ত্যাগ করছেন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায়। সুতরাং এটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে
হয় যে, খেলাফত ত্যাগ বা হস্তান্তর করার পূর্বে
তিনি কোনো শর্তে অনড় থাকার অবস্থায় ছিলেন না। সে সময় তাঁর
পক্ষে যেটা সম্ভব ছিল তা হলো শুধু মাবিয়ার কাছে কিছু চেয়ে
নেওয়া, তাঁকে কিছু অনুরোধ-উপরোধ করা। হ্যাঁ, এটা হলেও হতে পারে যে তিনি যা কিছু চেয়েছিলেন
মাবিয়ার নিকট তার মধ্যে হোসেনকে পরবর্তী খলিফা করার চাওয়াটাও ছিল। মাবিয়া ও হাসানের মধ্যে কী কী আলোচনা
বা দেওয়া-নেওয়ার কথা হয়েছিলো তা এতো দীর্ঘকাল পরে একশ’ শতাংশ নির্ভুলভাবে বলা অসম্ভব। তবে একটা কথা এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই
বলা সম্ভব যে, খেলাফত ত্যাগ ও হস্তান্তর করার প্রাক্কালে যে যে বিষয়ে উভয়েই
(মাবিয়া ও হাসান) একমত হয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা হলো মাবিয়াকে খলিফা
হিসেবে হাসান এবং তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ত্ব নিতে হবে। এরূপ শর্ত বা চুক্তি যে হয়েছিল তার প্রমাণও রয়েছে ইতিহাসে। যেমন ড. ওসমান গণি লিখেছেন, ‘ইমাম
হাসান হযরত আলীর প্রথম সন্তান। অত্যন্ত
শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। পিতার শাহাদাত বরণের পর ছ’মাস খেলাফত পরিচালনা করে আমির
মুয়াবিয়ার সাথে রাতদিন খনোখুনি, ঝগড়া, বিসম্বাদ পরিহার করে এক নির্দিষ্ট ভাতার
পরিবর্তে খেলাফত ত্যাগ করেন। এবং পিতার রাজধানী কুফা ত্যাগ করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।’ (দ্রঃ
- হযরত আলী (রাঃ), পৃ – ২০৪)
মাবিয়ার বিরুদ্ধে চতুর্থ ও সব চায়তে বড়
অভিযোগটি হলো, মাবীয়া পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে ইসলামি-নীতি ও
ইসলামি-গণতন্ত্রকে পদলিত করেন এবং নিজের পুত্রকে খলিফা মনোনীত করে ইসলামি-গণতন্ত্র
তথা খেলাফততন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামি-নীতি ও
ইসলামি- গণতন্ত্রকে হত্যা করা, এবং
খেলাফততন্ত্রক পরিবর্তে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা – এই দুটি অভিযোগ শুধু অবাস্তব
ও ভিত্তিহীনই নয়, হাস্যকরও। কারণ, ‘ইসলামি-গণতন্ত্র’ তত্ত্বটা
সোনার পাথর-বাটি বা কাঁঠালের আমসত্ত সদৃশ অবাস্তব তত্ত্ব। কোনো ধর্মই (religion ) গণতন্ত্রের জন্যে বা পক্ষে সুচ্যগ্র মেদিনীটুকু
পর্যন্ত ত্যাগ করেনি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, উদারতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রভৃতি রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত পরিভাষাগুলির
সঙ্গে সকল ধর্মেরই চির আড়ি। আর ইসলামে তো আল্লাহতন্ত্র এবং মুহাম্মদ-তন্ত্রই শেষ কথা তা বলা বাহুল্য। কোরান-হাদিসের বাইরে কোনো আইন তৈরী বা
প্রণয়ন করা (যা একটি গণতান্ত্রিক কাজ) ইসলামের চরম পরিপন্থী। এবার আসা যাক ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনে ইসলামি নীতির প্রশ্নে। মাবিয়ার বিরুদ্ধে
অভিযোগ হলো তিনি এই নীতি পদদলিত করেন তাঁর পুত্রকে খলিফা করার জন্যে। এই অভিযোগটি আপাত
দৃষ্টিতে সত্য ও যুক্তিগ্রাহ্য মনে হওয়াটা খূব স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে এই অভিযোগটিরও কোনো
ভিত্তি নেই। কারণ ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনের নীতি ও পদ্ধতি বলে কিছু নেই। এ বিষয়ে মুহাম্মদ কোনো নীতি নির্ধারণ
করে যান নি বা করে যাওয়ার সময় পান নি। তিনি আসলে এই বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশই
পান নি, কারণ মাত্র কয়েকদিনের জ্বর ও অসহ্য মাথাব্যাথায় ভুগে তিনি হঠাৎই শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যেহেতু খলিফা নির্বাচন কীভাবে হবে তার কোনো নির্দেশিকা ছিলো না তাই
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা নির্বাচনে তাঁর অনুগামিদের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ
ও কলহ হয়েছিল। সেই কলহ-লাঞ্ছিত পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে কোনো প্রকারে আবু বকর প্রথম খলিফা
নির্বাচিত হলেও সাহাবীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ ও ক্ষোভ থেকে গিয়েছিলো। আলি এবং তাঁর বউ (মুহাম্মদের অতি আদরের কন্যা
ফাতেমা) আবু বকরকে খলিফা হিসাবে মেনে নেন নি এবং তাঁর কাছে বয়াতও নেন নি। ফাতেমা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। এই ঘটনার কথা ইতিপূর্বেই কিছুটা আলোচনা
করা হয়েছে। সেই আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, প্রথম খলিফা আবু বকরও দ্বিতীয় খলিফার মনোনয়ন দেবার পূর্বে খলিফা
নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো নীতি ঠিক করে যান নি। হয়তো তাঁর পক্ষে তা করা সম্ভবপর হয়ে
ওঠেনি।
কারণ খলিফা হওয়ার লোভ ও লালসা ছিল সাহাবিদের মধ্যে কী তীব্র খায়েশ
ছিলো তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। সেজন্যেই খুব সম্ভববতঃ তিনি দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে কোনও ঝুঁকি
নিতে চান নি। সাহাবী
ও অন্যান্যদের নিজ বাসভবনে ডেকে ঘোষণা করে
দেন যে, ওমর ফারুককে তিনি দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত করলেন। অবশ্য এই ঘোষণা দেবার পূর্বে আর সকল সাহাবিদের
সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের অভিমত জেনে
নিয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায়। ওমর ফারুকও সেই
পথ ধরেই তৃতীয় খলিফা মনোনীত করতে উদ্যোগী
হয়েছিলেন। তিনি
তৃতীয় খলিফা মনোনীত করে যেতে চেয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুর রহমানকে। কিন্তু আব্দুর
রহমান সেই দায়িত্ব
নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তখন তিনি একটি ছোট্ট কমিটি গঠন করে তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব সেই
কমিটির হাতে তুলে দেন। সেই কমিটিতে প্রবল তর্কাতর্কি ও মতবিরোধ চলে
কয়েকদিন ধরে এবং অবশেষে ভোটাভুটির মাধ্যমে ওসমান গণি খলিফা নির্বাচিত হন। এই হলো অতি
সংক্ষেপে ইসলামি রাষ্ট্রের
খলিফা মনোনয়নের বা নির্বাচনের পদ্ধতি ও ইতিহাস। এই ইতিহাস
সাক্ষ্য দেয় যে ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনের কোনও নীতি ছিল না। সুতরাং মাবিয়া ইসলামি নীতি লঙ্ঘন করেছিলেন বলে
তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবান্তর ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
মাবিয়া খেলাফতন্ত্রের পরিবর্তে
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে এই অভিযোগেরও যুক্তিগ্রাহ্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ
পাওয়া যায় না। তিনি তাঁর পুত্রকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান – এটা কোনো অকাট্য প্রমাণতে পারে না যে
তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যে খেলাফততন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বরং খলিফা মনোনয়নে তিনি যে তাঁর
পূর্বসূরীদের প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন একথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। পার্থক্য শুধু এক
জায়গায় যে তাঁর পুর্বতন খলিফাগণ তাঁদের পুত্রদের খলিফা মনোনিত করেন নি যেটা তিনি
করেছিলেন। কেন তাঁর পূর্বসূরীরা আপন পুত্রদের খলিফা করেন নি কিংবা
মাবিয়া কেন তাঁর পুত্রকেই খলিফা মনোনীত করেছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ
আছে এবং সে আলোচনা পরে যথাস্থানে করা হবে। এখনকার আলোচনার বিষয় হলো ইসলামি
সাম্রাজ্যে মাবিয়া কর্ত্তৃক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, সেই আলোচনায় আসা যাক। এজিদ যখন খলিফা হলেন তারপরই খলিফার
ছেলে খলিফা হবে এ রকম একটা অধ্যায়ের সুচনা হয়েছিল একথা ঠিক, কিন্তু তাই বলে এমন
ঘটনা ঘটে নি যে, খলিফার পুত্রই খলিফা হবে এমন কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি মাবিয়া কর্তৃক
ঘোষণা করা হয়েছিলো। না, মাবিয়া এ রকম কোনো নীতি যেমন প্রনয়ণ করেন নি, এবং এজিদকেও সেরূপ কোনো নির্দেশ প্রদান করে যান
নি তিনি যেনো তাঁর পুত্রকেই খলিফা মনোনিত করেন। সুতরাং মাবিয়া
ইসলামি সাম্রাজ্যে রাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এমন অভিযোগের কোনো ঐতিহসিক ভিত্তি নেই।
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রসঙ্গটি
বাদ দিলেও এ প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, মাবিয়া কেন তাঁর নিজের পুত্রকেই
খলিফা মনোনীত করেছিলেন? প্রশ্নটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ অন্তত দুটি বিশেষ কারণে। প্রথম কারণ হলো
মাবিয়ার
পূর্বসূরীরা তৃতীয় খেলাফত পর্যন্ত কেউ সে কাজ করেন নি, তাঁরা সকলেই সাহাবীদের
মধ্যে থেকেই একজনকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে গিয়েছেন। মাবিয়া কেন সেই প্রচলিত নিয়ম বা ছক ভেঙে ছিলেন? দ্বিতীয়
কারণটি হলো, এজিদ খলিফা হবার পরই পরিস্থিতি দ্রুত কারবালা যুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে
শুরু করে এবং যুদ্ধটি সংঘটিত হয়ও। এর ফলে সাধারণভাবেই এমন ধারণার জন্ম
হওয়াটা স্বাভাবিক যে মাবিয়া যদি তাঁর পুত্রকে খলিফা মনোনীত না করে যেতেন তবে
কারবালা যুদ্ধ হতো না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এ কথাটাও মনে রাখা একান্ত
আবশ্যক যে, এজিদকে খলিফা মনোনীত করার জন্যেই কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ব্যাপারটি
মোটেই তা নয়। আসলে যুদ্ধ হয়েছে ইমাম
হোসেনকে খলিফা না করার জন্যে। কারণ, হোসেনের ক্ষোভ হয়েছিলো যতোটা না এজিদকে খলিফা
করার জন্যে তার চেয়ে অনেক বেশী তাঁকে খলিফা না করার জন্যে। সুতরাং শুধু এজিদ বলে নয়, হোসেনকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনো
ব্যক্তিকে খলিফা করলেও কারবালা যুদ্ধটি হতোই। যুদ্ধটি হয়তো কারবালা প্রান্তরে এবং
১০ই মহরম হতো না, হতো অন্য সময়ে ও অন্য কোনো প্রান্তরে, কিন্তু হতোই। মাবিয়ার
বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ
একটা সহজ সমিকরণও তৈরী করেছেন। তা হলো – মাবিয়া মনেপ্রাণে মুসলমান ছিলেন না, তিনি
ছিলেন অগত্যা মুসলমান এবং ছিলেন একজন চরম নীতিহীন ও স্বার্থপর ব্যক্তি। তাই নিজের পুত্রকে খলিফার আসনে বসিয়ে বসিয়ে যান। কিন্তু মাবিয়ার
ব্যক্তি জীবন ও নানা উচ্চ পদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা প্রশাসকের জীবনের নানা দিকের
যে ছবি আমরা দেখেছি তাতে তাঁর সম্পর্কে এরূপ সহজ ও সরল একটা সমীকরণ টানা যায় না। বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখে
সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার দাবী রাখে। মাবিয়া কেনো এজিদকে খলিফা মনোনিত করেছিলেন তা
সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আমাদের সর্বাগ্রে তৎকালীন পরিস্থিতির প্রতি অনুসন্ধানী নজর
রাখতে হবে। মাবিয়া এজিদকে খলিফা মনোনিত করেন ৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে, মুহাম্মদের মৃত্যুর
প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর। তখন সাহাবীদের যুগ প্রায় শেষ। কতিপয়
সাহাবী যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন কখন
সেই দিনের কথা ভাবছেন। সুতরাং বাস্তব পরিস্থিতিটা ছিলো এরূপ যে, মাবিয়ার
সামনে তখন এমন একজনও জীবিত ছিলেন না যাঁর খলিফা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্নহীন
গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। তখন মুহাম্মদের সাহাবীদের সান্নিধ্যে থাকা বিশিষ্ট জনেরা যাঁদের
তাবেয়ী বলা হয় তাঁরা অধিকাংশই মদিনায় থাকেন। কিন্তু ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন
দামেস্কে যেটা অধুনা সিরিয়ায় অবস্থিত। আলিই প্রথম রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান কুফা
শহরে, তারপর সেখান থেকে মাবিয়া সরিয়ে নিয়ে যান দামেস্ক শহরে। স্বভাবতই
তাবেয়ীদের সঙ্গে খলিফা ও প্রশাসনের যোগসুত্র ছিলো অত্যন্ত ক্ষীণ। অন্যদিকে খলিফা
পদের জন্য যাঁর
(হোসেনের) কথা ভাবা যেত মুহাম্মদের নাতি বলে তিনি মাবিয়াকে তাঁর কুড়ি বছরের দীর্ঘ
শাসন কালে কোনরূপ সহযোগিতা করেন নি তো বটে, ঘুরিয়ে তিনি মাবিয়াকে তাঁর পিতা ও
দাদার হত্যাকারী বলে সর্বদা তাঁর সমালচনা ও বিরোধিতা করেছেন। এরূপ আচরণ সত্ত্বেও
মাবিয়া কিন্তু তাঁর সঙ্গে খলিফা সুলভ বিন্দুমাত্র খারাপ ও বিরূপ আচরণ করেন নি, ঘুরিয়ে
পাছে আল্লার নবীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শিত হয় এই ভাবনায় হোসেন ও তাঁর পরিবারের
সদস্যদের সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্রতাপূর্ণ ও
সৌজন্যমুলক আচরণ করতেন। মাবিয়া এমন নজিরবিহীন আচরণ প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর হৃদয়ের
আকাশচুম্বী উদারতা এবং হোসেন ও তাঁর পরিবারের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষের মনোভাব না
থাকার কারণের জন্যেই। হৃদয়ে কতো উদারতা থাকলে শত্রুভাবাপন্ন মানুষকেও ক্ষমা করা যায়, যা করে দেখিয়েছিলেন মাবিয়া হোসেনের প্রতি! তবে
ক্ষমা করা এক জিনিষ, আর খলিফা করা তো অন্য জিনিষ। যে লোক ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও
বিদ্বেষ থেকে খলিফার সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করে তাকে আর যাই করা যাক খলিফা করা
যায় না। তাছাড়া লাগাতার খলিফা ও খেলাফতের
বিরোধিতা করে হোসেন সকল উচ্চ পদস্থ আমলা এবং সাধারণ মুসলমানদের কাছেও নিজের
গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলেছিলেন। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে মাবিয়া ও ইমাম হাসানের
মধ্যে ইমাম হোসেনকে খলিফা করার চুক্তি সত্যি সত্যিই হয়েছিল, তথাপি ইসলামি খেলাফতের
প্রতি হোসেন যে শত্রুসুলভ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যে সেই চুক্তি বাস্তবায়িত
করার পরিস্থিতি তখন যে আর বিদ্যমান ছিল না তা সহজেয় অনুমেয়। সে সময় হোসেনের
মাবিয়াবিরোধী আচরণের জন্যে পরিস্থিতি এমনই বিরাজ করছিলো যে, বিভিন্ন প্রদেশের
গভর্ণর এবং মাবিয়ার দরবারে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত অধিষ্ঠিত আমলাদের পক্ষে হোসেনকে খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়া
মোটেই সম্ভব ছিল না। মাবিয়া যে সময়ে তাঁর উত্তরসূরীকে মনোনয়ন দেন সেই
সময়টার এই পরিস্থিতির কথা ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের কৌতূহলী ছাত্র ও পাঠকদের বিচার-বিবেচনার
মধ্যে রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। মাবিয়া দেখেছেন সাহাবীদের যুগেই খলিফা
হওয়ার খায়েশ পূরণ করা জন্যে কী নির্লজ্জ দলাদলি ও রেষারেষি হয়েছে, এমনকি খলিফার
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পর্যন্ত হয়েছে। তাবেয়ীদের যুগে খলিফা হওয়ার জন্যে
দলাদলি, রেষারেষি ও খনোখুনি হওয়ার আশঙ্কা যে আরও বেশী তা অভিজ্ঞ, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ
মাবিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। তাই তাঁকে গভীরভাবে ভাবতে
হয়েছিল এমন একজনকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করা যাতে তিনি
সর্বজনগ্রাহ্য হন এবং আর একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়। ঠিক যে যে কারণে
মাবিয়া তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা পদে মনোনীত করেছিলেন সেগুলি এক হাজার বছরেরও অধিক সময় পর এখন নিশ্চিত
রূপে বলা ভীষণ কঠিন। তবে মানুষ হিসাবে এবং প্রশাসক, গভর্ণর ও খলিফা হিসাবে মাবিয়া যে প্রজ্ঞা,
বিচক্ষণতা, দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা, প্রজাপ্রীতি এবং উদারনৈতিক চরিত্র ও মুল্যবোধের
স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন সর্বক্ষেত্রে তার ফলে এটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য ও
গ্রহণযোগ্য মনে হয় যে নিছক সংকীর্ণ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয়, তিনি ইসলামি
সাম্রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেছিলেন। এবং এজিদকে খলিফা করার কথা তাঁকে খুব
সম্ভবতঃ ভাবতে হয়েছিলো যাতে তাঁর মৃত্যুর পর আর একটা গৃহযুদ্ধের কবলে ইসলামি
সাম্রাজ্য না পড় যেমনটা পড়েছিলো আলির খলিফা হওয়ার পর। অমুসলিম ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ
ঠিক এ কথাটাই বলেছেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক কেনেথ ডব্লিউ মরগান যে কথা বলেছেন তা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, “খেলাফতের
উত্তরাধিকার ও নির্বাচনের ব্যাপারে গৃহ-যুদ্ধ এড়াতে হলে বংশানুক্রমিক নীতি বলবৎ করা
ব্যতীত আর কোন বিকল্প ছিল না।” (সূত্রঃউমাইয়া খেলাফত, ড.ওসমান গণি, পৃ – ৩৯)
মাবিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর
অভিযোগ হলো, তিনি তাঁর ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইসলামের সকল নীতি ও আদর্শ থেকে
বিচ্যুত হয়ে একটি সম্পূর্ণ অনৈসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম
ঐতিহাসিকরা তাই মাবিয়ার খেলাফত কালকে প্রকৃত ইসলামিক খেলাফত বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা মাবিয়া
খলিফা হওয়ার
পূর্ব পর্যন্ত যে খেলাফতগুলি প্রতিষ্ঠিত ছিল কেবল সেগুলিকেই প্রকৃত খেলাফত বলে
মান্যতা দেন। তাঁদের মতে আবু বকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি ও আলি – মাত্র এই চারজনই ছিলেন ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’ অর্থাৎ ‘সৎপথে
পরিচালিত খলিফা’। মাবিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ একদিক থেকে বিচার করলে আংশিকভাবে নিশ্চয় সঠিক,
কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে এটা একপেশে
ও বিদ্বেষ প্রসুত মূল্যায়ন ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, মাবিয়ার পূর্বে যাঁরা খেলাফত
পরিচালনা করেন তাঁরা সকলেই ইসলামি নীতির
কিছু না কিছু সংস্কার করেছিলেন যার অনুমোদন কোরানে ছিলো না বা নেই। কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে মাবিয়া একটা বিরাট
ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বড়ো রকমের সংস্কার করেছিলেন যা স্পষ্টতই কোরান ও ইসলামের
পরিপন্থী। সে আলোচনা অল্প হলেও ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। সেখানে আমরা
লক্ষ্য করেছি যে,
তিনি মুহাম্মদ নির্দেশিত ও প্রদর্শিত নীতি ও পথগুলির ক্ষেত্রে যে সব সংস্কার সাধন করেছিলেন
তার কয়েকটা ছিল নিঃসন্দেহে মৌলিক, যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। এক্ষেত্রে যেটা সব চেয়ে
বেশী উল্লেখযোগ্য সংস্কার সেটা হলো, রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামি এক বগ্গা নীতির
অবসান ঘটানো এবং তার পরিবর্তে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন। যেমন, খোলাফায়ে রাশেদিনের খেলাফত কালে
রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে ও প্রশাসনে মুসলমান ছাড়া অমুসলমানদের কোনো স্থান ছিল না।
বলা বাহুল্য যে সেটাই ইসলামের নীতি। বস্তুতঃ এটাই নির্মম সত্যি যে, অমুসলমানদের বিষয়ে ইসলামের মনোভাব সম্পূর্ণ শত্রুতামূলক ও
প্রতিহিংসামূলক। কোরানে বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের এই কথা বলে যে, অমুসলমানদের একদম বিশ্বাস করবে না, কারণ তারা
মুসলমানদের চরম শত্রু। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় কোরান নির্দেশ রয়েছে যে, মুসলমানরা যেনো কিছুতেই
অমুসলমানদের সঙ্গে বন্ধত্ব স্থাপন না করে। শুধু তাই নয়, কোরান বলেছে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে
সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে এবং তাদের পৃথিবী থেকে মুছে দিতে। মাবিয়া ইসলাম
ধর্মের এই কট্টর নীতিটি বর্জন করেন এবং সেনাবাহিনী ও
প্রশাসনে বহু ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়োগ দেন। ইসলামের মূল নীতি হলো মুসলমানদের পালন ও অমুসলমানদের দমন। মাবিয়ার নীতি ছিল ঠিক তার বিপরীত - দুষ্টের দমন ও
শিষ্টের পালন। ইসলামের দর্শন অনুসারে গীর্জা-মঠ-মন্দির প্রভৃতি অমুসলমানদের ধর্মীয়
উপাসনাগৃহগুলি আল্লাহতন্ত্রের চরম পরিপন্থী। তাই ইসলামিক সাম্রাজ্যে এসব উপাসনাগৃহের
স্থাপনা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সৌদি আরবে আজো এই নীত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। মাবিয়া এই কট্টর
নীতিও পরিত্যাগ করেন। তাঁকে এমনকি প্রাকৃতিক
দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ গীর্জাগুলির রাষ্ট্রীয় খরচে পূনর্নির্মাণ করে দিতেও দেখা গেছে। এই নীতিগুলি
অবশ্যই ইসলামী নীতিতে এক একটা বড়ো মাপের সংস্কার এবং ইসলামি নীতির
পরিপন্থীও। শরিয়তের
বিচারে এগুলো এক একটা ভয়ঙ্কর বিচ্যুতিও। সুতরাং মাবিয়ার ইসলাম থেকে বিচ্যুতির অভিযোগটি মোটেই
ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু যেটা তাঁর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং বড়োই
মনগড়া অভিযোগ সেটা হলো এই যে, তিনি এই সংস্কারগুলি করেছিলেন নিজের ক্ষমতাকে
কুক্ষিগত করার জন্যে। না, নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার তাঁর
কোনো অভিপ্রায় ছিলো বলে মনে হয় না। আসল
কথা হলো, ইসলামি সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো এবং তাকে আরো সংহত ও
সম্প্রাসারিত
করার ক্ষেত্রে উক্ত সংস্কাগুলির বিকল্প তাঁর সামনে খোলা ছিল না। মাবিয়ার পরবর্তী কালের খলিফাগণ অনেকেই তাঁর এই
সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। এমনকি তাঁদের অনেকেই সেই সংস্কার প্রক্রিয়াকে আরো অনেক দূর এগিয়ে
নিয়ে গিয়েছিলেন। আব্বাসীয়
যুগে কয়েকজন খলিফা তো রাষ্ট্র পরিচালনায় কোরানের নীতিকে সম্পূর্ণরূপেই বর্জন করে তার
পরিবর্তে মুত্তাজিলা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। মুত্তাজিলা নীতিতে কোরান ও মুসলমানদের
ধর্মীয়গুরুদের তিলমাত্র স্থান ছিল না। কিন্তু এই সব খলিফাদের
বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা
হয় নি যে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যে ইসলামি নীতি বর্জন করেছিলেন। তাঁদের কথা
থাক, খলিফা দ্বিতীয় ওমরের
কথাই ধরা যাক যিনি ছিলেন উমাইয়া
বংশেরই একজন প্রতিনিধি যে বংশের বিরুদ্ধে আজো মুসলিম
ঐতিহাসিকদের
কলম ও লেখনি সমান খড়গহস্ত। সেই খলিফা ২য় ওমরও মাবিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নস্যাৎ করেন নি। বরং
সেই নীতিটিকে আরো উন্নত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতিগুলি কীভাবে
আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার কিছুটা বর্ণণা শোনা যাক মুসলিম ঐতিহাসিকদের মুখ
থেকেই। ড. ওসমান গণি বর্ণনা করেছেন - ‘...
সাম্রাজ্যবাদী সমরনীতির পরিবর্তে শান্তি সংরক্ষণ ও সহাবস্থান। ... ওমরের রাজ্য
শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল –জাতি-ধর্ম
নির্বিশেষে প্রজাপালন, মানুষের সেবা তথা মানবতার সেবা করা। ... অমুসলমান বা বিধর্মীদের পবিত্র
ধর্মস্থানগুলোকে তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ... রাজ্য বিস্তার নয়, বিজিত রাজ্যে শান্তি
স্থাপন করা ছিল তাঁর নীতি। ... পূর্ববর্তী খলিফাগণের সমস্ত সামরিক অভিযানগুলি বাতিল করে দেন। যে সমস্ত সেনাপতি
রাজ্য বিদেশে বিস্তারে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ... ৭১৮-১৯ খ্রীস্টাব্দে আইন জারী করে অমুসলমানদের
নিকট হতে মুসলমানদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন।’
(দ্রঃ উমাইয়া খেলাফত, ১২৪-১৩১
পৃষ্ঠা) খলিফা দ্বিতীয় ওমরের এই নীতিগুলিও যেমন
একধারে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক, তেমনি অপরদিকে ইসলামি নীতির পরিপন্থীও। তবুও মুসলিম ঐতিহাসিকরা দ্বিতীয় ওমরকে ‘খোলাফায়ে রাশেদিনে’র পঞ্চম খলিফার বিরল সম্মানে ভূষিত করেছেন। অথচ খলিফা
মাবিয়াকে মুসলিম দুনিয়া ঠিক তার বিপরীত তকমা প্রদান করেছে। মানুষ মাবিয়াকে ‘নিকৃষ্ট মুসলমান’ আর খলিফা মাবিয়াকে ‘খোলাফায়ে
জালেমুন’ অর্থাৎ অসৎ ও অত্যাচারী খলিফা বলে ধ্বিকৃত করেছে। এটাকে একটা ভয়ঙ্কর ও নিকৃষ্ট
দ্বিচারিতা বললেও কম বলা হয়। এই দ্বিচারিতার পেছনে কাজ করেছে মাবিয়ার প্রতি ঘৃণা ও
আক্রোশ। মুসলিম দুনিয়া
কেন মাবিয়ার প্রতি এত ঘৃণা
ও আক্রোশ লালন-পালন করে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এই বইয়ের শেষাংশে। এখন মাবিয়া পুত্র
ষষ্ঠ খলিফা
ইয়াজিদ তথা এজিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে মোটা মোটা দাগে
লিপিবদ্ধ করে তাঁকে ইতিহাসের একজন কুখ্যাত খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত ও চিত্রিত করা হয়েছে সেগুলির সত্যতা কতোখানি
যথার্থ তা নিয়ে আলোচোনা করা যাক।
এজিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ
এজিদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তোলা
হয়েছে পাঁচটি। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে গুরুতর সেটা হলো, তিনি নিজের সিংহাসনকে বিপদমুক্ত ও
নিষ্কন্টক রাখার জন্যে ইমাম হোসেনকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়ে ওবাইদুল্লাহকে কুফার গভর্ণর করে
পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু
ইতিহাস এই অভিযোগের কোনো প্রামাণ্য তথ্য দেয় না। মুসলিম
ঐতিহাসিকদের বর্ণিত ইতিহাসে আমরা দেখেছি যে
কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনের
সাথে ওবাইদুল্লাহর সেনাপতি
ওমরের দফায় দফায় আলোচনা
হয়েছে। সেই আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে হোসেন তিন দফা
প্রস্তাব
দিয়েছিলেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্যে। কেউ কেউ কিন্তু অন্য কথা বলেছেন, সেটা হলো হোসেন দ্বৈরথ
যুদ্ধের প্রস্তাব
দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ আবার বলেছেন ২রা মহরম (মহরম
মাসের দু’ তারিখ) কারবালা প্রান্তরে হোসেন তাঁবু খাটিয়ে শিবির স্থাপন করেছিলেন এবং
সাতদিন ধরে কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ রকম বিভিন্ন বয়ান যাঁরা দিয়েছেন
তাঁরা কিন্তু প্রায় সকলেই একটা বিষয়ে একই সুরে কথা বলেছেন। তা হলো, হোসেনের সৈন্য সংখ্যা ছিল খুব বেশী হলে সত্তর
থেকে একশ’ দশ এবং ওবাইদুল্লাহর প্রেরিত
বাহিনীতে ছিল কমপক্ষে চার হাজার থেকে দশ হাজার সৈন্য। এখন প্রশ্ন হলো, হোসেনকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া
হয়ে থাকলে ওবাইদুল্লাহর সেনাপতি ওমর হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাবেন কেন? কিংবা হোসেনের
দ্বৈরথ যুদ্ধের প্রস্তাবেই বা সম্মত হতে যাবেন কেন? কিংবা সত্তর থেকে একশো দশ জনের
একটি অতি ক্ষুদ্র বাহিনীর সঙ্গে দশ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনীর যুদ্ধ শেষ
হতে সাতদিন সময় লাগবে কেন? হোসেনকে হত্যা করার নির্দেশ থাকলে দশ হাজার সৈন্য নিশ্চয়
ঝাঁপিয়ে পড়তো হোসেনের বাহিনীর উপর এবং নিমেষের মধ্যে হোসেন সহ তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীর
সকলকে সাবাড় করে দিতো – এটাই কি বাস্তবসম্মত
ও বিশ্বাসযোগ্য হতো না? সুতরাং মুসলিম ঐতিহাসিকদের দেওয়া বর্ণনা থেকে এটা
প্রতীয়মান হয় যে, ওবাইদুল্লাহর প্রতি হোসেন সম্পর্কে যে নির্দেশই থাক না কেন,
তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ অন্ততঃ ছিল না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, কারবালা
প্রান্তর থেকে দামেস্ক নগর ছিলো সেই যুগে কয়েক দিনের পথ। ফলে এটাও অনুমান করা যায়
যে, কারবালা প্রান্তরে যে হত্যাকান্ড ঘটেছিল সে বিষয়ে সেই মুহুর্তে এজিদের পক্ষে কিছু
জানা সম্ভব ছিলো না। এ প্রসঙ্গে এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে,
এজিদ কুফার গভর্নর ওবাইদুল্লাহকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন এই অভিযোগটি
উত্থাপন করতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকরা প্রচুর পরষ্পরবিরোধী কথা বলেছেন। যেমন, ড.ওসমান গণির কথা ধরা যাক। তিনি
‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থে একদিকে এজিদকে হোসেনের হত্যাকারী সাব্যস্ত করেছেন, আবার
তিনিই বলেছেন যে কারবালা প্রান্তরে হোসেনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এজিদ সম্ভবত যুক্ত
ছিলেন না। গণির সেই পরষ্পরবিরোধী বর্ণনা এরূপঃ ‘‘তবে কারবালা হত্যাকান্ডের সাথে
তিনি সরসরি খুব একটা জড়িয়ে ছিলেন মনে হয় না, কেননা, রাজধানী দামেস্ক কুফা হতে প্রায়
২০০ মাইলের ব্যাবধানে অবস্থিত। অতি অল্প সময়ের ব্যাবধানে কোথায় কি ঘটছে, সেটি
তিনি হয়তো সম্যকভাবে অবগত ছিলেন না। তাই যখন ইমামের ছিন্ন মস্তক দামেস্কে পৌঁছাল, তিনি
কিছুক্ষণের জন্য হতবাক বা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন।’’ (দ্রঃ পৃ - ৫৮) একটু পরেই ড.গণিই আবার লিখছেন, ‘‘যাই হোক,
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাতে কোনরূপেই তাঁকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে না। কেননা, তাঁর মৌন সমর্থন না থাকলে দুরাত্মা
ওবাইদুল্লাহ এ কাজ কখনও করতে সাহস পেতেন না।’’ (দ্রঃ- পৃ -৫৯)
হোসেনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গুরুতর
অভিযোগ হলো, তিনি মদিনা আক্রমণে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মুহাম্মদ ও প্রসিদ্ধ সাহাবীদের
কবর এবং মসজিদে নববীর চরম অপমান ও অসম্মান করেন। এমনকি তিনি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মদিনাকে লুঠ করতেও দ্বিধা করেন নি। এ
প্রসঙ্গে যেটা সত্যিকারের ঘটনা তা হলো এই এরূপঃ এজিদের একদল সৈন্যবাহিনী মদিনা গিয়েছিল তাঁর
নির্দেশে এ কথা ঠিক, কিন্তু তিনি
মদিনা লুঠ করতে কিংবা মুহাম্মদ ও সাহাবিদের কবর ও মসজিদে নববীর অসম্মান করতে সৈনিবাহিনী প্রেরণ করতে
সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এ অভিযোগটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সৈন্যবাহিনী পাঠানোর পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত
করে সেখানকার মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। কারণ হোসেনের
নিহত হওয়ার খবর মদিনায় পৌঁছালে
সেখানে প্রতিক্রিয়া এতো তীব্র আকার ধারণ করে যে হাসেমি বংশের মানুষরা মদিনার গভর্ণর-সহ উমাইয়া বংশের মানুষদের উপরেও চড়াও হয়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে
সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে তিনি একদল সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন। পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে সৈন্যবাহিনীর বাড়াবাড়ি হয়তো কিছুটা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এজিদ মদিনা লুঠ
করতে সেনা পাঠিয়েছিলেন এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
তৃতীয় ভয়ঙ্কর অভিযোগটি হলো এজিদের
বিরুদ্ধে যে, তিনি মক্কাও আক্রমণ করেছিলেন এবং কাবা গৃহে অগ্নি সংযোগের মত ক্ষমার
অযোগ্য অপরাধ সংঘটিত করেছিলেন। এই অভিযোগটিও
পূর্বোক্ত অভিযোগের মতোই সম্পূর্ণ বিকৃত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমরা এর আগের
আলোচনায় লক্ষ্য
করেছি যে, শেষ পর্যন্ত মাত্র দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এজিদের কাছে বয়াত নেন নি। তাঁরা হলেন ইমাম হোসেন ও আব্দুল্লাহ-ইবন-জুবাইর। হোসেনের মৃত্যুর
খবর শোনার পর এই আব্দুল্লাহ নিজেকে মক্কা শহরে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা বলে ঘোষণা করে এজিদের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে একজন খলিফার দায়িত্ব ও
কর্তব্য হলো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ও তার সঙ্গীদের দমনের জন্যে কঠোর পদক্ষেপ
করা। এজিদ ঠিক সেই কাজটি করেছিলেন। এজিদের সৈন্যবাহিনী যখন মক্কায় পৌঁছয়
তখন আবদুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা কাবার অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে এজিদের সৈন্যবাহিনীর
উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। এজিদের সৈন্যবাহিনীকে নিরুপায় হয়ে কাবাগৃহে ঢুকতে
হয়েছিলো বিদ্রোহীদের দমন করার জন্যে। এতে কাবাগৃহের যদি অপমান বা অসম্মান হয়ে থাকে তবে
তার দায় বর্তায় আবদুল্লা ইবনে জুবায়ের –এর উপর, এজিদের উপর নিশ্চয় নয়।
এজিদের বিরুদ্ধে আরও দুটি অভিযোগ হলো –
এক). এজিদ ছিলেন মদ্যপ ও দুশ্চরিত্রের মানুষ, এবং দুই). তিনি ছিলেন খলিফা পদে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত
ব্যক্তিত্ব। এজিদ মদ্যপ ও দুশ্চরিত্রের মানুষ ছিলেন – এই অভিযোগটি সর্বজনগ্রাহ্য মোটেই নয়।
এই অভিযোগটি কেবল শোনা যায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখাতেই। অপরদিকে ইমাম
হাসান (মুহাম্মদের বড়
নাতি) যিনি একশ’টি বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত নিজের বউয়ের দেওয়া বিষ খেয়ে অকালে মারা
যান তিনিই হলেন তাঁদের চোখে ‘মুসলিম জগতের চোখের মণি ও এক মহান চরিত্রের মানুষ। মুসলিমজগত কথিত ‘মদ্যপ ও দুশ্চরিত্র’ এই এজিদই কিন্তু
অবিশ্বাস্য উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দেন
হোসেনের কাটামুণ্ড এবং তাঁর বউ ও পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যদের
প্রতি। ইমাম হোসেন এজিদকে খলিফা হিসাবে স্বীকৃতি তো দেনই নি, উল্টে তাঁকে অসম্মান
ও অবজ্ঞা করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছেন এবং অবশেষে বিদ্রোহ করতে গিয়েই
নিহত হয়েছেন।
সেই শত্রু ও বিদ্রোহী হোসেনের
নিষ্প্রাণ কাটা মুণ্ড ও তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের বন্দী
অবস্থায় নিজের দরবারে হাজির দেখতে পেয়ে এজিদের তো আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা। কেননা, তাঁর খেলাফতের পথের একমাত্র
কাঁটাটা চিরতরে শেষ হয়ে গেছে, খেলাফত এখন সম্পূর্ণ কণ্টকশূন্য এবং তাঁর সামনে একদল অসহায় যুবতী নারী। সেই চিরশত্রুর ছিন্ন মস্তক পদতলে হাজির
যখন, তখন অতীতের সকল অপমান ও উপেক্ষার প্রতিশোধ নিতে সেই মস্তকের প্রতি তাঁর তো পাল্টা
অসম্মান ও অপমান প্রদর্শন করারই কথা, একজন লম্পট রাজা-বাদশার পক্ষে শত্রুর পরিবারের
যুদ্ধবন্দী নারীসদস্যদের সঙ্গে সাধারণতঃ যে
রূপ কুৎসিৎ আচরণ করা হয় তাঁর তো সে রূপ আচরণই করার কথা। কিন্তু না, এজিদ সে রূপ কুৎসিৎ আচরণ করেন
নি।
হোসেনের ছিন্ন মস্তক ও তাঁর পরিবারের মেয়েদের বন্দী অবস্থায় দেখে একটুও আনন্দবোধ
করেন নি, তাঁর চরিত্রের নৈতিক স্খলনও হয় নি। বরং তাঁর
মুখমন্ডলে
নেমে এসেছিল প্রবল বিষাদের ছায়া। এজিদের এই আচরণ ও শরিরী ভাষাকে
সম্মান না জানিয়ে মুসলমান ঐতিহাসিকরা তাঁকে ঘুরিয়ে ‘ভীত ও সন্ত্রস্ত’ বলে কটাক্ষ করেছেন। হোসেনের ছিন্ন মস্তক দেখে এজিদ হর্ষোল্লসিত যে হন নি, বরং বেদনাহত ও
বিমর্ষই হয়েছিলেন সে কথা অস্বীকার করেন নি মুসলিম ঐতিহাসিকরাও। কিন্তু তাঁরা আবার এজিদের বিমর্ষ হওয়ার
এই মহান গুণটিকে স্বীকার সৎসাহসও দেখাতে পারেন নি। সেই সময়ের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ড. গণি উপরে উক্ত বইয়ে লিখেছেন, ‘‘পরে
নরাধম উবাইদুল্লাহ হোসেনের ছিন্ন মস্তক ও অন্যান্য পরিজনবর্গকে রাজধানী দামেস্কে
প্রেরণ করলে ইয়াজিদ ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় অতি সত্বর ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ
করেন, এবং কারবালা প্রান্তরে সকলকে সমাধিস্থ করা হয়। জীবিত শিশু ও
স্ত্রীলোকগণকে ইয়াজিদ
সসম্মানে মদীনায় প্রেরণ করেন।’’ (দ্রঃ পৃ - ৫২) যে ইমাম হোসেন তাঁকে খলিফার সিংহাসন থেকে উৎখাত
করতে চেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের মেয়ে সদস্যদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তাঁদের সঙ্গে বন্দীর
ন্যায় অমানবিক ও কুৎসিত আচরণ করার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন
পূর্বক তিনি তাঁদের মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এমন ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই ঘটনাটি সাক্ষ্য দেয় যে ‘দুশ্চরিত্র’, ‘মদ্যপ’, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ এজিদ কত বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন।
এজিদের বিরুদ্ধে আর একটি অভি্যোগ হলো
যে, তিনি খলিফা পদের অযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যোগ্য ছিলেন, নাকি সত্যি অযোগ্য
ছিলেন তা নিশ্চয় করে বলা সত্যিই খুব কঠিন। কারণ খলিফা হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর
তিনি বেঁচেছিলেন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তবে ব্যক্তি এজিদের মধ্যে যে সব গুণাবলীর কিছু কিছু শোনা
যায় তাতে তিনি একেবারে
অযোগ্য ছিলেন বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া মাবিয়া নিজের পুত্র বলে একজন অযোগ্য মানুষের হাতে সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার
অর্পণ করে যাবেন
এত স্বার্থপর ও নীচু প্রকৃতির মানুষ কখনই ছিলেন না। মুসলিম
ঐতিহাসিকগণ তো এজিকে অযোগ্য বোলে ছাপ মরবেনই, কেননা, তা না হলে তো ইমাম হোসেনই একমাত্র খলিফা পদের উপযুক্ত ও যোগ্য
ব্যক্তি ছিলেন সেটা তো প্রমাণ করা যায় না।
অমুসলিম ঐতিহাসিকদের চোখে কিন্তু এজিদ ছিলেন খলিফা পদের
জন্যে যথেষ্ট যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব। বার্ণাড লুইস
বলেছেন, ‘ইয়াজিদ
রাজোচিত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তিনি সাহিত্যের
পৃষ্ঠপোষকতা করতেন,
এবং তাঁর পুত্র খালিদ গ্রীক বিজ্ঞানের অসংখ্যক পুস্তক সংগ্রহ করেন।’ লুইসের এই উক্তি থেকে দুটি জিনিষ স্পষ্ট বুঝা
যায় , তা হলো - এক) খলিফা মাবিয়া তাঁর পুত্র ও পৌত্রকে ক্ষমতার বৈভবে ও বিলাসে
ভেসে যেতে দেন নি এবং তাঁদেরকে পশ্চাদপদ কোরান ও ইসলামি শিক্ষার কানাগলিতে বন্দী রেখে
বিজ্ঞান ও দর্শনের শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের সমস্ত জানালা-দরজাগুলিও বন্ধ করে দেন নি। বরং তাঁদের মধ্যে
প্রকৃত জ্ঞানের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান,
দর্শন ও সাহিত্যের জ্ঞানের প্রসার ঘটেছিল এবং তাঁরা তাঁদের জ্ঞান ও শিক্ষাকে আরব
সভ্যতার উন্নতি সাধনের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রসঙ্গত একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
কথা এখানে উল্লেখ্যণীয় হলো এই যে, শুধু নিজের সন্তান-সন্ততিদেরকেই নয়, মাবিয়া
সমগ্র সাম্রাজ্যের সকল মানুষের জন্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোরান ও ইসলামি
শিক্ষার বদ্ধ জলাশয় থেকে তুলে নিয়ে এসে তিনিই প্রথম সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি
বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছিলেন এনং এভাবেই গোটা আরব
জাতিকেই বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যের শিক্ষা ও সাধনায় ব্রতী করে তুলতে উদ্যোগী
হয়েছিলেন। দুই) মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেমনটা অনর্গল প্রচার
করে থাকেন যে এজিদ ছিল একেবারেই অনুপযুক্ত ও অযোগ্য ব্যক্তি – এই প্রচারটিও মিথ্যা
বৈ নয়। আসল ঘটনাটা বরং ঠিক তার বিপরীত, অর্থাৎ এজিদ ছিলেন রাজোচিত গুণাবলীর
অধিকারী, বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যের অনুরাগী ও পণ্ডিত মানুষ। সুতরাং আমাদের কাছে
এটাই প্রতীয়মান হয় যে মাবিয়া তাঁর অযোগ্য পুত্রের হাতে ইসলামি খেলাফত তুলে দিয়ে
যান নি।
ইমাম হাসানের মৃত্যুর জন্যেও দোষী
সাব্যস্ত করা হয়েছে এজিদকে। কেউ কেউ তো বলেছেন মাবিয়া নয় এজিদই হাসানকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করান। সাহিত্যিক মীর
মোশারাফ হোসেন এই অভিযোগ করেছেন তাঁর ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে। এক্ষেত্রে অভিযোগটি হলো এ রকম - যয়নাব
নাম্নী একজন অতি সুন্দরী বিধবা নারীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ইমাম হাসান ও এজিদ উভয়েই। যয়নাব বিয়ে
করেছিলেন হাসানকে।
এজিদ এটা মেনে নিতে পারেন নি। যে কোনো মুল্যে তিনি যয়নাবকে তাঁর অঙ্কশায়িনী করতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনিই মাইমুনা
নাম্নী একজন নারীকে নিয়োগ করেছিলেন যয়নাবের মনকে হাসানের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তুলতে এবং পরবর্তীতে
খলিফার বউ করার
প্রলোভন দেখিয়ে হাসানকে হত্যা করার জন্যে। এরই ফলশ্রুতিতে যায়েদার হাতে হাসানের
মৃত্যু হয়। এই অভিযোগটি যে হাস্যাষ্পদ ও একটা স্থূল চিত্রনাট্য বৈ নয় তা বলা বাহুল্য। হাসানকে কেন তাঁর
বউ যায়েদা বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলেন সে আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। সুতরাং সে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। এজিদ সম্পর্কে আরবের একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের একটি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করা হলে তা খুবই
প্রাসঙ্গিক ও বাঞ্ছনীয় হবে এই অধ্যায়টির সমাপ্তি টানার আগে। সেই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন কাতির বলেছেন, ‘ইয়াজিদ
উদারপন্থী ও বাগ্মী ছিলেন।’ এজিদ যে উদার মনোভাবাপন্ন উচ্চ হৃদয়বৃত্তির পুরুষ ছিলেন তার পরিচয় তো আমরা কারবালা যুদ্ধের শেষ অধ্যায়েই পেয়েছি। প্রসংগত উল্লেখ্য
যে বার্ণাড লুইস এবং ইবন
কাতিরের উক্তি দুটো ড. ওসমান গণির ‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। (দ্রঃ পৃষ্ঠা – ৫৯) ড. ওসমান গণি বার্ণাড লুইস এবং ইবন কাতির উক্তি দু’টি কেন উদ্ধৃত
করেছেন যা এজিদের বিরুদ্ধে তোলা তাঁদের অভিযোগগুলিকে খণ্ডন করে। তাহলে এজিদের চরিত্র, শিক্ষাদীক্ষা ও অন্যান্য
গুণাবলী সম্পর্কে অমুসলিম ঐতিহিকগণ যে সব প্রশংসা করেছেন সেগুলি অতিরঞ্জিত বর্ণনা বলে
উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি নন?
No comments:
Post a Comment