Wednesday, October 26, 2016

মুসলিম বিয়েঃ চুক্তি বিয়ে (contractual marriage) - (এক)



                                   


কোনো শর্ত নেই, পুরুষরা বহুবিয়ে করতে পারে অবাধে


সুরা আন্নিছা, ৪/৩ – “এতিমের প্রতি সুবিচার করিতে পারিবে না এ প্রকার আশংকা তোমাদের হইলে বিবাহ করিবে নারীদের হইতে যাকে ভাল লাগে দুই-তিন কিংবা চার; আর যদি ভাব সুবিচার করিতে পারিবে না তখন একজনকে কিংবা তোমাদের অধীনস্থ দাসীকে; এতে পক্ষপাতিত্ব না করার নিকট সম্ভাবনা।” (আরবী উচ্চারণ – “ওয়া ইন খিফতুম আল্লা – তিক্কছিত্বূ ফিল ইয়াতা-মা- ফানিকিহূ মা-ত্বা-বা লা কুম্মিনান্নিছা – ইয়া মাস্না – অছুলা-ছা”)   (অনুবাদ – এ কে এম ফজলুর রহমান মুন্সী,  মুন্সী মঞ্জিল, রাজামেহার, কুমিল্লা) 
সুরা আহযাব, ৩৩/৫০ – হে নবী! আমরা তোমার জন্য তোমার স্ত্রীদের বৈধ করেছি যাদের তুমি দেনমোহর আদায় করেছো, আর যাদের তোমার ডান হাতে ধরে রেখেছ, তাদের মধ্য থেকে যাদের আল্লাহ তোমাকে যুদ্ধের দানস্বরূপ দিয়েছেন; আর তোমার চাচার মেয়েদের ও তোমার ফুফুর মেয়েদের, এবং তোমার মামার মেয়েদের ও তোমা মাসীর মেয়েদের – যারা তোমার সঙ্গে হিজরত করেছে, আর কোনো মুমিন নারী যদি সে নিজেকে নবীর নিকট সমর্পণ করে, যদি নবীও তাকে বিবাহ করতে চান – এটি বিশেষ করে তোমার জন্য, মুমিনগণকে বাদ দিয়ে। আমরা অবশ্যই জানি আমরা তাদের জন্য কী বিধান দিয়েছি তাদের স্ত্রীদের সম্বন্ধে আর তাদের ডান হাত যাদের ধরে রেখেছে তাদের সম্বন্ধে, যেন তোমার উপর বাধা না থাকে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরিত্রাণকারী, অফুরন্ত ফলদাতা। (অনুবাদ – ডাঃ জহরুল হক, http://www.QuranToday.com)
সুরা নিসা, ৪/২৪ নং আয়াতঃ আর  স্ত্রী লোকদের মধ্যে সধবা যারা (তারা অবৈধ), তবে তোমাদের ডান হাত ধরে  রেখেছে যাদের তাদের ব্যতীত, তোমাদের প্রতি আল্লাহর বিধান। আর এদের বাইরে তোমাদের জন্য বৈধ করা গেল যদি তোমরা চাও তোমাদের ধনদৌলত দিয়ে বিবাহ-বন্ধনের মাধ্যম, ব্যভিচারের জন্য নয়। অতএব তাদের মধ্যের যাদের থেকে তোমরা সুফল পেতে চাও তাদের নির্ধারিত মহরানা তাদের প্রদান করো। আর তোমাদের জন্য দূষণীয় হবে না নির্ধারিত হবার পরে তোমরা যাতে পরষ্পর সম্মত হও। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা, পরমজ্ঞানী। (অনুবাদ – ডাঃ জহরুল হক)
ইসলাম ধর্মে বিয়ের বিধানটি ঠিক কীরূপ, এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে কার অবস্থান ঠিক কোথায় তার অনেকটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে উপরের তিনটি আয়াতে। বিয়ে নিয়ে অবশ্য কোরানে আরো অনেক আয়াত আছে। তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে  মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবিগণ ইসলামি বিয়ে সম্পর্কে কীরূপ ধারণা পোষণ করেন তার প্রতি একবার চোখ বোলানো যেতে পারে। তাঁরা  গগনচুম্বী যে সব ধারণা পোষণ করেন তা ভাষায় বর্ণনা করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে তাঁদের দাবি হলো - ইসলামি বিয়ের আইন-কানুন  অন্য সকল ধর্মের বিয়ের আইন-কানুন অপেক্ষা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। শুধু শ্রেষ্ঠই নয়, তাঁরা বলেন, এ আইনটি সম্পূর্ণ নিঃখুত, চিরন্তন,  চিরনতুন ও অপরিবর্তনীয় কেনো শ্রেষ্ঠ তার সপক্ষে তাঁদের যুক্তি হলো, এ আইন নারীকে ব্যাপক মর্যাদা,   স্বাধীনতা ও অধিকার দিয়েছে। এমনকি নারীকে  পুরুষের সমান অধিকারও প্রদান করেছে যা নজিরবিহীন। একমাত্র ইসলামই নারীকে  বিয়েতে তার মতামত জানাবার পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছে, এবং নারীর সম্মতি ব্যতীত বিয়ে হলে সে বিয়েকে একেবারেই নাজায়েজ (অবৈধ) বলে বাতিল করে দিয়েছে। পতির মৃত্যু হলে বিধবা নারীকে বিয়ের অধিকারও দিয়েছে যে অধিকার অন্য কোনো ধর্মে নেই  যদি দাম্পত্যজীবন দুঃসহ হয়ে উঠে তবে  নারীকে পুরুষের মতোই বিয়ে-বিচ্ছেদের অধিকারও প্রদান করেছেএক কথাই তাঁদের দাবি হলো, ইসলামের মতো কোনো ধর্মই বিয়ের আইনে নারীকে এরূপ মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতা দেয় নি। মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের ধর্মীয় বিয়ের বিধান নিয়ে এরূপ আষাঢ়ে দাবি করেন। কিন্তু তাঁরা যে তাঁদের স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ আইন নিয়ে স্বস্তিতে আছেন তা নয়। বাস্তব ঘটনাটি হলো এই যে, তাঁদের স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ আইনের জন্যে তাঁদের সর্বদায় বহু অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন ও সমালচনায় বিদ্ধ হতে হয়।
প্রশ্ন ও সমালোচনা শুধু বাহির থেকেই আসে তা নয়, আসে মুসলিম সমাজের ভিতর থেকেও।  প্রশ্ন ও সমালোচনাগুলি ক্রমশঃ এতো তীক্ষ্ণ ও শাণিত হচ্ছে  যে তাঁদের পক্ষে এগুলি এড়িয়ে নির্বিকার থাকা  সম্ভব হচ্ছে না। আলেম সমাজ এবং  মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণকে বোধ হয় বেশী সমালোচনা শুনতে হয় পুরুষের বহুবিয়ে নিয়ে। এর কারণ খুব স্পষ্ট। কারণ, আধুনিক যুগে বহুবিয়ে সবচেয়ে নিন্দিত আইন ও প্রথাগুলির একট।  প্রায় গোটা বিশ্বই তাই বহুবিয়ে নির্মূল করতে বদ্ধ পরিকর।  এমনকি বহু-বিয়ে নির্মূল করার কাজে শামিল মুসলিম বিশ্বও।  মুসলিম বিশ্বের প্রায় অর্ধেক রাষ্ট্রই বহুবিয়ে হয় নিষিদ্ধ করেছে, না হয় বহুবিয়ের ইসলামি বিধিকে সংশোধন করেছে যার লক্ষ্য হলো একে নির্মূল করা এই সব দেশে এখন রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত বহুবিয়ে করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ হেন পরিস্থিতিতে আলেম সমাজ ও  মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণের পক্ষে সরাসরি বহুবিয়ের পক্ষে দাঁড়ানো ও তার প্রশংসা করা ক্রমশঃ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কিন্তু ইসলামি সংবিধান বা শরিয়তি আইনে যেহেতু বহুবিয়ে বৈধ, তাই বহুবিয়ের নিন্দা ও সমালোচনা করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলতঃ তাঁরা পড়েছেন উভয় সংকটে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে  মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে। যেমন তাঁদের দাবি হলো যে, এক). বিশেষ পরিস্থিতিতে বহুবিয়েকে ইসলাম বৈধতা প্রদান করেছিলো বটে, কিন্তু উৎসাহ প্রদান করে নি। দুই). পুরুষের বহুবিয়ের অধিকার মোটেই অবাধ নয়, শর্তসাপেক্ষে তাদের বহুবিয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমনঃ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে যদি ক). প্রথম স্ত্রী চিররুগ্ন হয়, খ). প্রথম স্ত্রী সন্তান ধারণে অক্ষম হয়, এবং গ). স্বামী যদি স্ত্রীদের প্রতি সমান ও ন্যায় ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তিন). প্রাক-ইসলাম যুগে পুরুষরা যতো খুশী বিয়ে করতে পারতো, কোনো ঊর্ধসীমা ছিলো না। বিশেষ  পরিস্থিতিতে ইসলাম বহুবিয়েকে বৈধতা দিলেও তার সংখ্যা সীমায়িত করেছে চারে, একত্রে চারজনের অধিক পত্নী রাখা ইসলামে নাজায়েজ (অবৈধ)। আলেম সমাজ এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই দাবিগুলি বাস্তব না অবাস্তব তা জানার জন্যে ইসলামি বিয়ে নিয়ে বিশদে আলোচনা প্রয়োজন। সে আলোচোনা শুরু করার পূর্বে একটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরী যে ইসলামি বিয়ে চারটি শ্রেণিতে বা ভাগে বিভক্ত। যেমন 'চুক্তি বিয়ে', 'হিল্লা বিয়ে', 'মুতা বিয়ে' এবং 'জোরপূর্বক বিয়ে'।  স্বভাবতই আলোচনা করতে হবে প্রত্যেকটি বিয়ে নিয়ে পৃথক পৃথক ভাবে। এখানে আলোচনা করা হবে শুধু 'চুক্তি বিয়ে' নিয়ে। 

চুক্তি বিয়ে নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সব ধর্মের সমস্ত বিয়ের সমগ্র কর্মকাণ্ডে নারী ও পুরুষের মধ্যে কার জন্যে কী ভূমিকা নির্ধারণ করে রেখেছে সে কথা আগাম বলে নিলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কথাগুলি এ রকম - প্রতিটি বিয়েতেই (সমকামীদের বিয়ে বাদে) পুরুষের ভূমিকাই প্রধান, পুরুষই সর্বেসর্বা। বিয়ে হয় পুরুষ ও নারীর মধ্যে ঠিকই, কিন্তু মূল কথা হলো পুরুষ বিয়ে করে এবং নারীর বিয়ে হয়। বিয়ের আইন, নিয়ম, অনুষ্ঠান প্রভৃতি সবকিছুই একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক। বিয়ের সমগ্র কর্মকাণ্ড সম্পাদনের প্রতিটি ধাপে পুরুষকে বসানো হয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের   সর্বোচ্চ শিখরে, আর নারীকে বসানো হয়েছে পুরুষের পদতলে। বিয়ের সমগ্র প্রক্রিয়া জুড়ে পুরুষই থাকে শুধু সক্রিয়, নারী থাকে কার্যতঃ অক্রিয়; পুরুষের ভূমিকাই প্রধান, নারীর ভূমিকা গৌণ; পুরুষের ইচ্ছাই সব, নারীর ইচ্ছা সম্পূর্ণ গৌণ বিষয়। এখন প্রশ্ন হলো মুসলিমদের ধর্মীয় বিধান কী এর বিপরীত ধর্মী যেমনটা দাবি করেন তাঁদের ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীগণ? তার উত্তর খুঁজতে এবার শুরু করা যাক চুক্তিবিয়ের  আলোচনা।  কোরানের তিনটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে এ আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে আয়াত তিনটির মধ্যেই রয়েছে ইসলামি বিয়েবিধির মূল মূল কথাগুলি। তাই এই আয়াতগুলি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে ইসলামি বিয়ে সম্পর্কে মুসলিম সমাজ যে উঁচু ধারণা পোষণ করে তার যৌক্তিক ও প্রামাণিক ভিত্তি আছে কী না।  
প্রথমেই আলেম সমাজ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রথম দাবিটির প্রতি আলোকপাত করতে চাই যেখানে তাঁরা বলেছেন পুরুষের বহুবিয়ে ইসলামি বিয়ে-বিধিতে বৈধতা প্রাপ্ত বটে কিন্তু তা অবাধ নয়, শর্তসাপেক্ষে একজন পুরুষকে বহুবিয়ের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।  প্রথম শর্তটি হলো প্রথম পত্নী চিররুগ্ন হলে, কিংবা সন্তান ধারণে অক্ষম হলে প্রথম পত্নীর অনুমতি সাপেক্ষে পতি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে।  অনুরূপভাবে দ্বিতীয় পত্নীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে প্রথম ও দ্বিতীয় পত্নীদের অনুমতি সাপেক্ষে পতি তৃতীয় বিয়ে করতে পারবে। এভাবে একজন মুসলিম সর্বাধিক চারটি বিয়ে করতে পারবে। কোনো দাবি পেশ করলে তা তথ্য কিংবা যুক্তি দিয়ে, নিদেন পক্ষে দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রমাণ করা আবশ্যিক কর্তব্য। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু সে কর্তব্য পালন করেন না। তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই দাবি পেশ করা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই নয়, জনগণের সঙ্গে এ এক প্রকার প্রতারণা ও তঞ্চকতাও যা মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা হরবকত করে থাকেনমুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এরূপ প্রতারণা করা ছাড়া অবশ্য গত্যন্তরও নেই। কারণ ঐরূপ কোনো শর্তের লেশমাত্র যোগ নেই ইসলামি বিয়ের বিধানে। কোরান ও হাদিস তন্ন করে খুঁজলেও ঐ শর্তগুলির সন্ধান পাওয়া যায় না।  অপরদিকে পুরুষের বহুবিয়েতে যে কোনো শর্তই নেই, পতি ইচ্ছা হলেই বহুবিয়ে করতে পারে এবং অবাধেই পারে তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায় কোরানে, এবং পাওয়া যায় মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবীদের জীবনচর্চার ইতিহাসেও মুহাম্মদের সাহাবীদের মধ্যে অগ্রগণ্যদের মধ্যে যাঁরা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তাঁরা হলেন যথাক্রমে আবুবকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণী এবং  আলি। এঁরা চারজন মুহাম্মদের মৃত্যুর পর পর্যায়ক্রমে খলিফা (ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান শাসক) হয়েছিলেন এবং শেষোক্ত দু’জন ছিলেন মুহাম্মদের  জামাতা। এঁরা সবাই বহুবিয়ে করেছিলেন এবং  প্রত্যেকের হারেমেই প্রায় সব সময়েই চারজন পত্নী ছিলেন।   তাঁদের পত্নীরা কেউই চিররুগ্ন ও সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলেন না। প্রথম খলিফা আবু বকর ৪টি বিয়ে করেছিলেন।  তাঁর পত্নীদের মধ্যে কুতওয়ালার গর্ভে দু’টি সন্তান (আবদুল্লাহ ও আসমা), দ্বিতীয় পত্নী উম্মে রুমানের গর্ভে দু’টি সন্তান (আব্দুর রহমান ও আয়েশা), তৃতীয় পত্নী আসমার গর্ভে একটি সন্তান (মহম্মদ)  এবং চতুর্থ পত্নী উম্মে হাবিবার গর্ভে একটি সন্তান (উম্মে কুলসুম) জন্মগ্রহণ করেছিলো। প্রথম পত্নী ইসলাম গ্রহণ না করায় আবু বকর তাঁকে ত্যাগ করেন। (দেখুন ওসমান গণির বই  ‘হযরতঃ আবুবকর [রাঃ]’, পৃ – ১০)  দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক  করেছিলেন ৭টি বিয়ে।  তাঁদের মধ্যে দু’জনকে (কারিবা ও মালায়কা) ইসলাম না গ্রহণ করায় তালাক দেন এবং চতুর্থ পত্নী জমিলাকেও তালাক দিয়েছিলেন। ওমর ফারুকের পত্নীদের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলো ছ’জন সন্তান। ওমর ফারুক শুধু নবী বংশের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের উদ্দেশ্যে তাঁর নাতনির বয়সী উম্মে কুসসুমকে (আলির কন্যা) বিয়ে করেছিলেন।  (দেখুন ওসমান গণির বই ‘হযরতঃ ওমর  [রাঃ]’, পৃ – ২১৭)  মুহাম্মদের জামাতা তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি করেছিলেন ৮টি বিয়ে এবং তাঁর সন্তান ছিলো ১৪টি  তাঁর প্রথম পত্নী বিবি রোকাইয়ার ১টি পুত্র, তৃতীয় পত্নী  ফাকতা বিনতে গিসওয়ানের ১টি পুত্র, চতুর্থ পত্নী বিবি উম্মে উমর বিনতে জানদার ১টি কন্যা ও ৪টি পুত্র, পঞ্চম পত্নী ফাতেমা বিনতে ওলিদের  ২টি পুত্র, ষষ্ঠ পত্নী বিবি উম্মুল বিনতে আয়িনীরাহ –এর ১টি পুত্র, সপ্তম পত্নী বিবি রুমেলা বিনতে শায়েব-এর  ১টি কন্যা ও ২টি পুত্র  এবং অষ্টম পত্নী বিবি নায়লা বিনতে আনহার ১ট ছিলো কন্যা।  (দেখুন ওসমান গণির বই ‘হযরতঃ ওসমান গণী [রাঃ]’, পৃ – ৩)  লেখক ওসমান গণি উল্লেখ করতে ভোলেন নি যে তৃতীয় খলিফা ৮টি বিয়ে করলেও তাঁর এক সাথে চারজনের বেশী পত্নী ছিলো না। চতুর্থ খলিফা এবং মুহাম্মদের জামাই আলী করেছিলেন ৯টি বিয়ে  এবং তাঁর মোট সন্তান ছিলো ৩১টি যাঁদের মধ্যে পুত্র ছিলো ১৪জন ও কন্যা ছিলো ১৭জন। তাঁর প্রত্যেকটি পত্নীর গর্ভেই সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। (দেখুনঃ হযরতঃ আলি [রাঃ],ওসমান গণি,  পৃ – ২০৩, ২০৪)  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ জীবিত থাকাকালীন আলিকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেন নি এবং আলি তাঁর প্রথম পত্নী ফাতেমার (মুহাম্মদের কন্যা) জীবদ্দশাতেও দ্বিতীয় বিয়ে করার সাহস দেখাতে পারেন নি। মুহাম্মদ ও ফাতেমার মৃত্যু হলে তিনি পরপর লাইন দিয়ে বিয়ে করেন এবং সব সময়ে তাঁর হারেমে চারজন পত্নী মজুদ ছিলেন। চারজন অগ্রগণ্য সাহাবি ও খলিফাদের পর মুহাম্মদের জৈষ্ঠ নাতি ইমাম হাসানের জীবনচর্চার প্রতি চোখ রাখা যাক। কারণ, এটা এ আলোচনায় আরো অধিক প্রসঙ্গিক। তিনি বহু বিয়ের ব্যাপারে মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবিদের  সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর জীবনকালে ৭০ জন নারীকে বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর পুত্রকন্যার সংখ্যা ছিল ৩১। তিনি কোনও দিনে চারজন পত্নীকেই তালাক দিয়ে নতুন চারজনকে বিবাহ করেছেন এমন নজিরও আছে।  হাসানের পিতা আলী যখন খলিফার আসনে  সমাসীন, তিনি ইরাকবাসীদের আবেদন করেছিলেন ইমাম হাসেনের হাতে কন্যা সমর্পণ না করতে। কুফাবাসীরা জানতেন হাসানের তালাক-প্রীতির কথা। তবু তারা হাসানকে কন্যা দান করে গেছেন যদি হাসানের ঔরষে তাদের কন্যাদের গর্ভে রসুলের বংশধর জন্ম নেন। সকলেই তখন মনে করতেন ফাতেমার গর্ভজাত রসুলের দৌহিত্ররাই শুধু রক্তের উত্তরাধিকার বহন করে। (সূত্রঃ ইসলাম ও নারী, কংকর সিংহ, পৃ – ৫০)   এবার আসা যাক মুহাম্মদের কথায়। তিনি তো তাঁর সাহাবিদের চেয়ে অনেক বেশী বহুবিয়ে করেছিলেন। সাহাবিগণ যদিও কেউই একসঙ্গে চারজনের অধিক পত্নী রাখেন নি বলে কথিত আছে, মুহাম্মদ কিন্তু সে সীমা মানেন নি। তিনি ঠিক কয়টি বিয়ে করেছিলেন এবং তিনি  কতোজন পত্নীকে তাঁর হারেমে একত্রিত করেছিলেন তার সঠিক তথ্য ও সংখ্যা পাওয়া যায় না। সমস্ত মতগুলো মেলালে এ কথা বলা যায় যে তিনি কমপক্ষে ১৪টি এবং সর্বাধিক ২১টি বিয়ে করেছিলেন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আনোয়ার হেকমত লিখেছেন – Regarding the total number of Muhammad’s wives commentators differ in their estimates. The lowest figure given fourteen and the highest is twenty one, but most of the biographers agree on fourteen. (Vide: Woman and Koran, page – 33, 34)   হাদিস থেকে জানা যায় যে মুহাম্মদ ১৫টি বিয়ে করেছিলেন এবং একই সময়ে ১৩জন পত্নীর সাথে সঙ্গম করেছিলেন। সেই হাদিসটি হলো – “হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) পনেরজন স্ত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তেরজনের সাথে তাঁর সহবাস হয়েছিলএকই সময়ে তেরজন স্ত্রী তাঁর নিকট বিদ্যমান ছিলেনরাসূলুল্লাহ (সঃ) নয়জন স্ত্রী রেখে ইন্তেকাল করেন” (সূত্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ৪র্থ-৭ম খন্ড, পৃ- ২৮০)    মুহাম্মদ ও তাঁর প্রিয় সাহাবিদের জীবন-চর্চার এই ছবি থেকে এটা স্পষ্ট যে পুরুষের বহুবিয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো শর্ত আরোপ করে নি।  এবং মুহাম্মদ ও তাঁর প্রিয় সাহাবিদের জীবন-চর্চার এই ছবিগুলি থেকে এটাও স্পষ্ট যে ইসলাম বহুবিয়ের ক্ষেত্রটি পুরুষদের জন্যে করে রেখেছে সম্পূর্ণ অবাধ,  পুরুষরা চাইলেই অনায়াসে বহুবিয়ে করতে পারে, এমনকি যতো খুশীও করতে পারে  
কোনো শর্ত তো নেই-ই, বরং পুরুষের বহুবিয়ে করাটা যে সম্পূর্ণ অবাধ তার প্রমাণ রয়েছে কোরানের অসংখ্য আয়াতেওউপরে উদ্ধৃত তিনটি আয়াতও সে কথাই বলছে। ৪/৩ নং আয়াত বলছে  পুরুষদের উদ্দেশ্য করে যে তারা তাদের অভিরুচি ও পছন্দ  অনুসারে ২টি, ৩টি বা ৪টি বিয়ে করতে পারবে। ৩৩/৫০ নং আয়াতে মুহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে তিনি কয়েকটি ব্যতিক্রম ব্যতীত যতখুশী ও যাকে খুশী বিয়ে করতে পারবেন। ৪/২০ নং আয়াতে মুসলিম পুরুষদের  উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে তারা যে তারা ইচ্ছা হলেই এক পত্নীর স্থলে অন্য পত্নী আনতে পারবে। বলা বাহুল্য যে,  কোরানের এই বিধানগুলিকেই অনুসরণ করে মুহাম্মদের সাহাবিগণ অনায়াসে তাঁদের পছন্দের নারীদের বিয়ে করেছেন। কোরান এবং মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবিদের জীবনীগুলি প্রমাণ করে যে,   ইসলামি আইনে বহুবিয়ের ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে বলে যাঁরা দাবি করেন তাঁরা নিরেট মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড বৈ নয়।  

No comments:

Post a Comment

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...