ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা এবং
পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে । এ দাবী মুসলিম ধর্মগুরু ও মুসলিম
বুদ্ধিজীবীদের ভিত্তিহীন দাবি । হাস্যকরও
বটে । এই হাস্যকর দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে
তাঁরা নারীর উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গটি
তুলে ধরেন । বলেন যে,
কোনো ধর্মই নারীকে উত্তরাধিকার দেয় নি, দিয়েছে শুধু ইসলাম । এ কথা ঠিক যে অন্যান্য
ধর্মগুলো নারীকে উত্তরাধিকার দেয় নি, এবং ইসলাম সত্যিই নারীকে সে অধিকার ও মর্যাদা
দিয়েছে । কিন্তু তাই বলে এটা আদৌ সঠিক নয় যে, ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান অধিকার
দিয়েছে । মুসলিমদের পক্ষ থেকে এও দাবি করা
হয় যে, ইসলামের আবির্ভাবের আগে কোথাও নারীকে উত্তরাধিকার দেওয়া হতো না, এবং নারী
পিতামাতার ধন-সম্পত্তির অংশ পেতো না ।
এ দাবিটিও ভিত্তিহীন । প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারী উত্তরাধিকার হিসেবে
পিতামাতার অংশ যে পেতো তার সব চেয়ে বড়ো প্রমাণ
মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা যাঁর
সাহায্য ব্যতীত মুহাম্মদ কোনোভাবেই নবী বা রসুল হয়ে উঠতে পারতেন না । তিনি
ছিলেন আরবের সব চেয়ে বড়ো বণিক । তাঁর বিপুল অর্থ ও সম্পদ তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পিতা ও পূর্বতন প্রয়াত স্বামীদের কাছ থেকে । শুধু তাই নয়,
তাঁর পিতা তো তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর পুত্র সন্তানের পরিবর্তে খাদিজার
কাঁধেই বাণিজ্য ও সংসারের ভার অর্পণ করেছিলেন । এ ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রাক ইসলাম
যুগে নারীকেও পিতামাতা ও স্বামীর
উত্তরাধিকারী করা হতো এবং তারাও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার স্বাধীনতা ভোগ করতো । তাই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে নারীর
উত্তরাধিকারের ধারা অনুসরণ করেই ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকার দিয়েছে । পূর্ব
ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করে ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকার দিলেও পূর্ণ অধিকার দেয় নি,
দিয়েছে পুরুষের অর্ধেক, কোনো কোনো
ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম ।
ইসলামি উত্তরাধিকারের বিধানটি রয়েছে কোরানের সুরা
নিসার দু’টি আয়াতে । আয়াত দু’টি হলো –
“তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে ঈশ্বর নির্ধারণ করিতেছে যে, দুই জন কন্যার অংশের
অনুরূপ একজন পুত্রের (অংশ) হইবে, পরন্তু যদি দুইয়ের অধিক কন্যামাত্র হয় তবে যাহা
(মৃত ব্যক্তি) পরিত্যাগ করিয়াছে তাহার দুই তৃতীয়াংশ তাহাদের জন্য হইবে, এবং যদি এক
কন্যা হয় তবে তাহার জন্য অর্ধাংশ; যদি তাহার সন্তান থাকে তবে সে যাহা পরিত্যাগ
করিয়াছে তাহার ষষ্ঠাংশ তাহার পিতা-মাতা উভয়ের জন্য হইবে, পরন্তু যদি তাহার সন্তান
না থাকে তবে তাহার পিতা তাহার উত্তরাধিকারী, কিন্তু তাহার মাতার জন্য, তৃতীয় ভাগ
পরন্তু যদি তাহার কয়েক ভ্রাতা থাকে তবে তাহার মাতার জন্য ষষ্ঠ ভাগ, (মৃত ব্যক্তি
কর্তৃক) এ বিষয়ে যে নির্ধারণ করা হয় সেই নির্ধারিত পূর্ণ হওয়ার পর, (ইহা হইবে,)
অথবা তোমাদের পিতা ও তোমাদের সন্তানগণের ঋণ পরিশোধ হওয়ার পর হইবে, তোমরা জ্ঞাত নও
যে কল্যাণ সাধনে তাহাদের মধ্যে কে তোমাদের অধিক নিকটবর্তী, (ইহা) ঈশ্বর কর্তৃক
নিরূপিত, নিশ্চয় ওশ্বর জ্ঞাতা ও নিপুণ ।” (৪/১১) “এবং যাহা তোমাদের স্ত্রীগণ পরিত্যাগ করিয়াছে
তাহাদের সন্তান না থাকিলে তোমাদের নিমিত্ত তাহার অর্ধাংশ, পরন্তু যদি তাহাদের
সন্তান থাকে তবে তাহারা যাহা পরিত্যাগ করিয়াছে তোমাদের জন্য তাহার চতুর্থাংশ, এ
বিষয়ে যাহা নির্ধারণ করা হয়(ইহা) তাহা পূর্ণ হওয়ার পর অথবা ঋণ পরিশোধ হইবার পর
হইবে, এবং তোমরা যাহা পরিত্যাগ করিয়াছ যদি তোমাদের সন্তান না থাকে তবে তাহাদিগের
জন্য তাহার চতুর্থাংশ, পরন্তু যদি তোমাদের সন্তাহ থাকে তবে তোমরা যাহা পরিত্যাগ
করিয়াছ তাহাদের জন্য তাহার অষ্টমাংশ হইবে, তোমরা এ সম্বন্ধে যে নির্ধারণ কর সে
নির্ধারণ পূর্ণ ও ঋণ শোধ হওয়ার পর (ইহা) হইবে, এবং যাহা হইতে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত
হওয়া যায় সে যদি নিঃসন্তান ও পিতৃহীন পুরুষ হয়, অথবা (তদ্রুপ) নারী হয় এবং তাহার
এক ভ্রাতা ও এক ভগিনী থাকে তবে উভয়ের প্রত্যেকের জন্য ষষ্ঠাংশ, পরন্তু যদি
এতদপেক্ষা অধিক হয় তবে তাহার তৃতীয় অংশের মধ্যে অংশী হইবে, এ সম্বন্ধে যে নির্ধারণ
করা হয় সে নির্ধারণ পূর্ণ হওয়ার পর বা ক্ষতিবিহীন ঋণ পরিশোধ হওয়ার পর (ইহা) হইবে,
পরমেশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত, ঈশ্বর জ্ঞাতা ও প্রশান্ত ।” (৪/১২) মুসলমানগণ খুব সম্ভবতঃ মুহাম্মদের এই বিধানে
অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং সম্মতি জ্ঞাপন করতে চান নি । তাই মুহাম্মদকে তাঁর শিষ্যদের
সম্মতি আদায়ের জন্যে আরো দু’টি আয়াত আবৃত্তি করতে হয়েছিলো যার একটিতে বেহেস্তের
(স্বর্গের) প্রলোভন দেখানো হয়েছে, আর একটিতে দেখানো হয়েছে জাহান্নামের (নরকের) ভয়
। সেই আয়াত দু’টি হলো - “এ সকল ঈশ্বরের নির্ধারিত, এবং যে ব্যক্তি
ঈশ্বরের ও তাঁহার প্রেরিত পুরুষের অনুগত হইবে সে স্বর্গে তথায় সর্বদায়
অবস্থানকারীরূপে হইবে, যাহার (বৃক্ষের) নিম্নে পয়ঃপ্রাণালী সকল প্রবাহিত , এবং
ইহাই মহা চরিতার্থতা ।” (৪/১৩) “এবং যে
ব্যক্তি ঈশ্বরের ও তাহার প্রেরিত পুরুষের অবাধ্য হয় ও তাঁহার নির্ধারিত সীমা
উল্লঙ্ঘন করে সে নরকাগ্নিতে তথায় সর্বদা অবস্থানকারীরূপে নীত হইবে, এবং তাহার জন্য
গ্লানিজনক শাস্তি আছে ।” (৪/১৪)
মুসলিম ধর্মগুরুগণ ও কোরান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তিরা দাবি করেন যে কোরানের
মতো সুলিখিত গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই এবং এরূপ গ্রন্থ রচনা করা মানুষের সাধ্যের
অতীত । এ দাবি বাস্তব সম্মত না ভিত্তিহীন তা আলোচনা করার স্থান এটা নয় । তবু
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে বাধ্য হলাম উপরে উক্ত দু’টি আয়াতের (৪/১১ ও ৪/১২)
পরিপ্রেক্ষিতে । এই দু’টি আয়াত অতিশয় গুরুত্ত্বপূর্ণ, কেননা ইসলামি উত্তরাধিকারী
আইনের মূল ভিত্তিই হলো আয়াত দু’টি । সুতরাং আয়াতদ্বয় অতি সহজ ও সরল এবং সুস্পষ্ট ভাষায় লেখা আবশ্যক ছিলো । কিন্তু
বলা বাহুল্য যে, আয়াতদ্বয় সেভাবে লেখা হয় নি বা বর্ণনা করা হয় নি । বর্ণনার
মধ্যে রয়েছে অনেক ফাঁক, ধোঁয়াশা,
অস্পষ্টতা ও জটিলতা । ফলে বারবার আয়াতগুলি পাঠ করলেও উদ্ধার করা খুবই মুশকিল হয় মৃত ব্যক্তির
উত্তরাধিকার ঠিক কার কার ওপর বর্তায় এবং স্পষ্টরূপে বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় মৃত ব্যক্তির ছেড়ে যাওয়া ধন-সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারীদের
মধ্যে কার প্রাপ্য অংশ ঠিক কতো ? পাঠকদের কাছে ইসলামের উত্তরাধিকার আইনটির স্পষ্টিকরণের
প্রয়োজনে তাই শরিয়তি উত্তরাধিকারী আইন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলি তুলে দিচ্ছি ।
এই আইনটিকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘ফারাজ’ আইন । ফারাজ আইনে মোট ১৯টি (৪০৮ নং ধারা থেকে ৪২৬ নং
ধারা) ধারা আছে যাদের আবার বহু উপধারাও আছে । সাম্যের
(!) ধর্ম ইসলামের ফারাজ আইনের এই ধারা-উপধারাগুলির পরতে পরতে আমরা দেখতে পাই নারীর
প্রতি সীমাহীন বৈষম্য । ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউণ্ডেশন’-এর ‘বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন’ গ্রন্থের ফারাজ আইনের ধারাগুলির প্রতি এবার কিছুটা আলোকপাত করা যাক । ৪১৫ নং ধারায় স্বামীর
প্রাপ্য অংশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকিলে স্বামী তাহার
পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক পাইবে; এবং স্ত্রীর
সন্তান থাকিলে এক-চতুর্থাংশ পাইবে ।” ৪১৬ নং ধারায়
স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মৃত স্বামীর কোন সন্তান না থাকিলে
স্ত্রী বা স্ত্রীগণ তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ
পাইবে; এবং স্বামীর সন্তান থাকিলে এক-অষ্টমাংশ
পাইবে ।” এখানে স্পষ্টতই স্বামীর প্রাপ্য
অংশ হলো স্ত্রীর
দ্বিগুণ । আর যদি মৃত স্বামীর
চারজন স্ত্রী থাকে তবে স্ত্রীদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ বা এক-অষ্টমাংশ যেটা প্রযোজ্য
সমান করে ভাগ করে দেওয়া হবে । অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে স্ত্রী পাবে একের ষোলো অংশ বা একের বত্রিশ অংশ যা স্বামীর চেয়ে আটগুণ কম । তাহলে স্বামি ও স্ত্রীর প্রাপ্য
অংশ যা দাঁড়ালো তা হলো এ রকম,
স্ত্রী যা পাবে স্বামী তার চেয়ে দ্বিগুণ থেকে আটগুণ বেশী পাবে । ৪১৯
নং ধারার গ উপধারায় অর্থাৎ ৪১৯(গ) নং ধারায় পুত্র ও কন্যার অংশের কথা বলা হয়েছে ।
তা এ রকম – “মৃতের পুত্র ও কন্যা বিদ্যমান থাকিলে ‘পুরুষ নারীর দ্বিগুণ অংশ’
পাওয়ার নীতি অনুযায়ী তাহাদের মধ্যে ত্যক্ত সম্পত্তি বন্টিত হবে ।” এখানে
স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে ইসলামের নীতিই হলো ‘পুরুষ নারীর
দ্বিগুণ অংশ’ পাবে, সুতরাং ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে
এমন দাবী করার অবকাশই নেই । পিতা ও মাতার প্রাপ্য অংশের কথা ৪১৭ ও ৪১৮ নং ধারাতেও
বলা হয়েছে । নীচে সারণিতে সেটা উল্লেখ করা হলোঃ
ধারা – ৪১৭
ধারা ৪১৮
পিতার প্রাপ্য অংশ
মাতার প্রাপ্য অংশ
(ক) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র ও তদনিম্নবর্তীগণের (ক) মৃতের সন্তান বা দৌহিত্র (যত
নিম্নগামী হউক)
বর্তমানে পিতা তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক- থাকিলে অথবা দুই বা ততোধিক
ভাই-বোন
ষষ্ঠাংশ পাইবে; (সহদর,বৈপিত্রেয়,
বৈমাত্রেয়) বর্তমান থাকিলে
(খ) মৃতের কন্যার অথবা দৌহিত্রির (যত নিম্নগামী তাহার মা তাহার পরিত্যক্ত
সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ পাইবে;
হউক) বর্তমানে পিতা এক-ষষ্ঠাংশ পাইবে এবং উপরোক্ত (খ) মৃতের স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকিলে
তাহাদের অংশ
ওয়ারিশদের অংশ দেওয়ার পর আসাবা হিসাবে অবশিষ্ট দেওয়ার পর মাতা অবশিষ্ট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাইবে;
অংশ লাভ করিবে; (গ) ধারা (ক)-এ উল্লেখিত
ওয়ারিশগণের অবর্তমানে এবং
(গ) মৃতের পুত্র বা দোহিত্র (যত নিম্নগামী হউক) না পিতার স্থলে দাদা বিদ্যমান থাকিলে
মাতা পরিত্যক্ত (মোট)
থাকিলে পিতা আসাবা হিসাবে সমস্ত সম্পত্তি
লাভ করিবে। সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ
পাইবে ।
৪১৭-এর খ ও গ উপধারায় পিতার প্রাপ্য হলো অবশিষ্ট সম্পত্তির সম্পূর্ণটাই ।
অবশিষ্ট সম্পূর্ণ অংশ পিতাকে দেওয়া হচ্ছে ‘আসাবা’
হিসেবে । কিন্তু ৪১৮ নং ধারার ‘খ’ ও ‘গ’ উপধারায় মাতার প্রাপ্য হলো শুধু অবশিষ্ট
সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ, সম্পূর্ণ অবশিষ্ট অংশ নয় । এবং একটি বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয়
হলো এই যে, পিতাকে ‘আসাবা’ বলে গণ্য করা হয়েছে কিন্তু মাতা’কে ‘আসাবা’ হিসেবে গণ্য
করা হয়নি । এখানে ‘আসাবা’ শব্দটি কী তা স্পষ্ট করা যাক । ‘আসাবা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘অসব’ শব্দ
থেকে । ‘অসব’ মানে হচ্ছে মূল উত্তরাধিকারী যা সম্পত্তির
উত্তরাধিকারীদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বিষয়টা এভাবে আরো
অধিক স্পষ্ট করা যেতে পারে - মৃত
ব্যক্তি যদি রাজা হন তবে তার উত্তরাধিকারী তো হবে একজনই, কিংবা মৃত ব্যক্তি যদি
বণিক হন তবে তাঁরও স্থলাভিষিক্ত হবে একজনই, এরূপ
উত্তরাধিকারীকে ইসলামের পরিভাষায় ‘আসাবা’ বলে । যিনি ‘আসাবা’ তিনি আবার মৃত ব্যক্তির ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তিরও
একটা অতিরিক্ত অংশ পাবেন । তারই ফলশ্রুতি হলো ৪১৭-এর ‘খ’ ও ‘গ’ উপধারা যেখানে যথাক্রমে বলা
হয়েছে যে ওয়ারিশদের অংশ দেওয়ার পর পিতা
পাবে অবশিষ্ট অংশ এবং ওয়ারিশ না থাকলে পাবে
সমস্ত সম্পত্তিটাই । কোরানের আইনে ‘আসাবা’ হওয়ার অধিকারী কেবল পুরুষগণই, নারী সে অধিকার থেকে
বঞ্চিত । সেজন্যেই ৪১৮ নং ধারার ‘খ’ ও ‘গ’ উপধারায় মাতার প্রাপ্য অংশ যথাক্রমে অবশিষ্ট
সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ এবং মোট সম্পত্তির
এক-তৃতীয়াংশ যা পিতার প্রাপ্য অংশ থেকে দৃষ্টিকটুভাবে কম ।
‘ইসলামি বিধিবদ্ধ আইন’ গ্রন্থে পিতাকে ‘আসাবা’
হিসেবে গণ্য করে মাতা অপেক্ষা যে অতিরিক্ত অংশ দেওয়া হয়েছে তা মোল্লা-মুফতিদের মস্তিষ্ক
প্রসূত কোনো আইন ভাবলে ভুল হবে । ফারাজ আইনটির এই
ধারাটিও কোরানের নির্দেশ মেনেই করা হয়েছে । ‘আসাবা’ কথাটি পাওয়া যায় ৪/১১ এবং ৪/১২ নং আয়াতের তফসিরে । ৪/১২-এর তফসিরে
গিরিশচন্দ্র লিখেছেন, “ ... এই যে পাঁচ প্রকার উত্তরাধিকারীত্ব উক্ত হইল ইহা সম্পত্তির অংশীদিগের জন্য, এতদ্ভিন্ন আর
এক প্রকার উত্তরাধিকারী আছে তাহাকে মূলোত্তরাধিকারী বলা যায় । উহাকে আরব্য ভাষায়
‘অসব’ বলে তাহার অংশ হয় না । প্রকৃত মূলোত্তরাধিকারী পুরুষ হইয়া থাকে,
স্ত্রীলোক নয় । ইহা চারি শ্রেণীতে বিভক্ত
। প্রথম শ্রেণীতে পুত্র ও পৌত্র,উদ্বিতীয় শ্রেণীতে পিতা ও পিতামহ, তৃতীয় শ্রেণীতে
ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র, চতুর্থ শ্রেণীতে পিতৃব্য ও পিতৃব্যপুত্র এবং পিতৃব্যপৌত্র
। এক এক শ্রেণীতে কতিপয় ব্যক্তি হইলে যাহার সঙ্গে মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সেই
অগ্রগণ্য, যেমন পৌত্র অপেক্ষা পুত্র এবং ভ্রাতুষ্পুত্র অপেক্ষা ভ্রাতা, তৎপর
বৈমাত্রেয় ভ্রাতা অপেক্ষা প্রকৃত ভ্রাতা অগ্রগণ্য । ... ” (দ্রঃ কুরআন শারীফ,
গিরিশচন্দ্র সেন, পৃ-৭৯) প্রখ্যাত
তফসিরকার ইবনে কাথিরের তফসিরেও ‘আসাবা’র উল্লেখ আছে । সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে
যে পিতা ‘আসাবা’ হিসেবে অতিরিক্ত অংশ পাওয়ার কারণে তার প্রাপ্য অংশ মাতা অপেক্ষা
দ্বিগুণ হয় । ইবনে কাথির ৪/১১ নং আয়াতের তফসিরে লিখেছেন – “ ... অতঃপর বাপ-মায়ের
অংশের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে । বাপ-মায়ের অবস্থা বিভিন্নরূপ । প্রথম অবস্থা এই যে, মৃত ব্যক্তির যদি একাধিক মেয়ে থাকে এবং পিতা
মাতাও থাকে তবে পিতা-মাতা উভয়েই এক ষষ্ঠাংশ করে পাবে । অর্থাৎ এক ষষ্ঠাংশ পাবে
পিতা এবং এক ষষ্ঠাংশ পাবে মাতা । আর যদি মৃত ব্যক্তির একটি মাত্র কন্যা থাকে তবে অর্ধেক মাল তো
মেয়েটি পাবে এবং এক ষষ্ঠাংশ মা পাবে ও এক ষষ্টাংশ বাপ পাবে, আর যে এক ষষ্ঠাংশ বাকি
থাকছে সেটাও বাপ ‘আসাবা’ হিসেবে পেয়ে যাবে । তাহলে
পিতা এখানে তার নির্ধারিত এক ষষ্ঠাংশ পেয়ে যাচ্ছে
এবং একই সঙ্গে ‘আসাবা’ হিসেবেও
অবশিষ্ট অংশ পেয়ে যাচ্ছে । দ্বিতীয় অবস্থা এই যে, উত্তরাধিকারী শুধু পিতা
ও মাতা । এ অবস্থায় মাতা পাবে এক তৃতীয়াংশ এবং
অবশিষ্ট সমস্ত মাল ‘আসাবা’ হিসেবে পিতা
পেয়ে যাবে । তাহলে পিতা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রাপ্ত হবে । অর্থাৎ মায়ের তুলনায় বাপ দ্বিগুণ পাবে । এখন যদি মৃতা স্ত্রীর স্বামী বিদ্যমান থাকে কিংবা মৃতা স্বামীর স্ত্রী
থাকে, অর্থাৎ ছেলে মেয়ে নেই, আছে শুধু পিতা- মাতা এবং স্বামী বা স্ত্রী, তবে এ
ব্যাপারে আলেমগণ তো একমত যে, এ অবস্থায় স্বামী পাবে
অর্ধেক এবং স্ত্রী পাবে এক চতুর্থাংশ । ... ” (দ্রঃ ৪র্থ-৭ম খণ্ড, পৃ-৩০২)
ইসলামের চোখে সবাই সমান – এটা বড়ো জোর দিয়ে প্রচার করা হয় । কিন্তু উপরের আলোচনায় যা দেখা গেলো তা হলো ফারাজ আইন তথা ইসলামের
উত্তরাধিকার আইনটি ঠিক তার বিপরীত সাক্ষ্য বহন করছে এবং এই আইনে নারীর প্রতি পদে পদে চরম বৈষম্যের ছবি ফুটে ঊঠেছে ।
ফারাজ আইনের প্রতিটি ধারায় নারীর প্রতি শুধু তীব্র বৈষম্য আছে তাই-ই নয়, এর
বাইরেও আছে আরো দুটি ধারা যা অতিশয় অমানবিক ও দানবীয় । এ দুটি দানবীয় ধারার একটি আইনের
উদ্দেশ্য যদিও নারীকে পুরুষের সম্পূর্ণরূপে অধীনস্থ ও পদানত করা, কিন্তু সেই আইনে
নারী ও পুরুষ উভয়কেই বলির পাঁঠা হতে হয়েছে
। এই আইন দুটির একটি ‘মজনু বিলাস’ আইন নামে
খ্যাত, অন্যটি দত্তক আইন নামে। দত্তক আইনটি মুহাম্মদ সম্পূর্ণই তাঁর ব্যক্তিগত সংকীর্ণ ও চরম অন্যায় স্বার্থ চরিতার্থ করার
জন্যে প্রণয়ন করেছিলেন আল্লাহ্র নামে । সে কথায় পরে আসছি । এখন আইন দুটির উপর আলোকপাত করা
যাক। প্রথমে আসি ‘মজনু বিলাস’ আইনে ।
এই আইনটি প্রযোজ্য হয় যদি একজন বিবাহিত সপত্নীক
পুরুষ তার পিতার জীবদ্দশায় মারা যায় । এই আইন
অনুসারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানরা ঐ
ব্যক্তির (মৃত ব্যক্তির) বাবা-মায়ের
উত্তরাধিকার হতে পারবে না । বিষয়টা উদাহরণ সহকারে স্পষ্ট করা যাক । ধরা যাক আব্দুর রহিম নামের একজন
ব্যক্তি তিনজন নাবালক সন্তান ও একজন স্ত্রী রেখে তার বাবা
আব্দুল জলিলের জীবদ্দশায় মারা গেলো। সেক্ষেত্রে রহিমের স্ত্রী ও তিন নাবালক সন্তান
আব্দুল জলিলের উত্তরাধিকার হতে পারবে না, অর্থাৎ আব্দুল জলিলের ধন-সম্পত্তির উপর তাদের কোনো অধিকার থাকবে না। এ আইনটি
পথে বসিয়েছে বাবার জীবদ্দশায় মৃত পুত্রের স্ত্রী ও সন্তানদের । তাদের কীভাবে চলবে,
কে তাদের ভরণপোষণের ভার নেবে, কে অনাথ ছেলেমেয়েদের বাসস্থান চিকিৎসা, শিক্ষা ও
খেলাধূলার দায়িত্ব নেবে তা এই আইনে ভাবা হয় নি ।
আইন হিসেবে এটা শুধু একটা দুর্বল ও অবাস্তব আইনই নয়, এটা একটা চরম অমানবিক
আইনও বটে । বিচার-বিবেচনাহীন ও অপরিণামদর্শী এই আইনের জন্যে অকাল বৈধব্যদশাপ্রাপ্ত
অসহায় নারীদের তাদের সন্তানসন্ততি নিয়ে আজীবন অপরের অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে হয় । এ
রকম বাঁচা বাড়ির ঝি-চাকরের জীবনের চেয়েও
অধিক গ্লানিকর ও অপমানকর। সেই বিধবাদের ও তাদের সন্তানদের পলে পলে পদে পদে
পরিবারের ছোটো বড়ো অন্যান্য সকল সদস্যদের কাছ থেকে আদেশ, উপদেশ ও কটূক্তি শুনে,
হজম করে, বিনা প্রতিবাদে মাথা নীচু করে দাসসুলভ মানবেতর জীবন যাপন করতে হয় । মুসলিমরা হিন্দু ধর্মের
বিধবা আইন ও সহমরণ প্রথা নিয়ে কটাক্ষ করেন এবং নিজেদের শরিয়তি আইন নিয়ে শ্লাঘা
প্রকাশ করেন । কিন্তু তাদের এই মজনু বিলাস আইনটি আমার মতে হিন্দু ধর্মের ঐ দু’টি
আইনের চেয়ে কম নিষ্ঠুর ও অমানবিক আইন নয় । হিন্দু সমাজে সহমরণ প্রথা ও বিধবা আইন
প্রবর্তন করা হয়েছিলো পরিবারের ধন-সম্পত্তি থেকে বিধবাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্যে । এ
আইন করেছিলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাতব্বর পুরুষরা সবাই মিলে যৌথভাবে তাদের নিজেদের স্বার্থে । কিন্তু
কোরানের আইন তো প্রণয়ন করেছেন মুহাম্মদ একাই আল্লাহ্র দোহায় দিয়ে । তিনি কেনো এ
আইন তৈরী করেছিলেন, এটা লাখ টাকার প্রশ্ন । তাঁর
পুত্র সন্তানরা তো সবাই শিশু অবস্থাতেই মারা গেছেন । সুতরাং তিনি তাঁর মৃত ছেলের পুত্রবধূকে ফাঁকি
দিয়ে বাকি জীবিত পুত্রদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে এ আইনটি তৈরী করেছিলেন সে কথাও বলা
যাবে না । আর এ আইনে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানরা যে আকূল পাথারে পড়বে সে কথা
মুহাম্মদের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন
মানুষ বুঝতে পারেন নি এটাও বিশ্বাসযোগ্য
নয় । তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় যে,
এতো অমানবিক ও দানবীয় আইন মুহাম্মদ কেন তৈরী করেছিলেন ?
প্রায় চোদ্দশ’ বছর পর এ প্রশ্নটির
নিশ্চিতভাবে সঠিক উত্তর পাওয়া খুব কঠিন । কিন্তু প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর থাকতেই
হবে । আর অনুসন্ধিৎসু ও কৌতূহলী মানুষ সে উত্তর সন্ধান করার প্রয়াসও করবে। এ বইয়ে সেটাই করার চেষ্টা করা হয়েছে । মজনু বিলাস আইনটি অনুমান করা
অসঙ্গত হবে না যে নারী-বিদ্বেষী মনোভাব থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক
সমাজের ধ্যান-ধারণা এবং দর্শন পুরুষদের
সাধারণভাবে নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী করে তোলে । শুধু পুরুষরাই নয়,
নারীরাও এই সামাজের রোগের শিকার হয়ে থাকে
। ধীরে ধীরে পুরুষতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা, নীতি-আদর্শ নারীদের গ্রাস করে এবং তারাও
পুরুষতন্ত্রের প্রহরী হয়ে ওঠে । প্রবল
যুক্তিবাদী মন ও মস্তিষ্ক, গভীর জ্ঞান এবং
তীক্ষ্ণ বিবেচনাবোধ ও মানবাদর্শ কেবল পুরুষদের নারীবাদী করে তুলতে পারে । চোদ্দশ’
বছর আগে ক্ষয়িষ্ণু দাস সমাজ ব্যবস্থা ও বর্ধিষ্ণু সামন্ততন্ত্রের যুগে জন্ম নেওয়া
একজন অল্প শিক্ষিত মেষ পালকের কাছে এটা প্রত্যাশা করা যায় না । স্বভাবতই একজন
পুরুষ হিসেবে মুহাম্মদের মধ্যে নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী মনোভাব ধীরে ধীরে গড়ে
উঠেছিল। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে
ওঠা একজন মানুষ যতোটা নারিবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী হয় মুহাম্মদ তার চেয় অনেক বেশীই
নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী ছিলেন ।
নারীবিরোধীতা ও নারিবিদ্বেষের প্রশ্নে তিনি চরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন । নারীর
বিরুদ্ধে তিনি যে চরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন তার প্রকাশ ঘটেছে মজনু বিলাস আইনে । তাঁর এ
মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রণয়ন করা বন্দি বিধর্মী নারীদের যৌনদাসী করা ও বাজারে
অর্থের বিনিময়ে বেচে দেওয়ার ইসলামি বিধানের মধ্যে । মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রেও কিছু
আইন আছে যেখানে প্রায় অনুরূপ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে । যেমন অবাধ্য নারীকে প্রহার
করা, তাতেও কাজ না হলে তাকে বর্জন করার আইন (কোনো
কারণে নারী স্বামীর যৌন আবেদনে সাড়া না দিলে
সে নারী অবাধ্য) । নারীর বিরুদ্ধে মুহাম্মদের বহু উক্তির (এ বিষয়ে
অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে) মধ্যেও প্রকাশিত হয়েছে উক্ত মনোভাব । আমার মনে হয় দু’জন
নারীর কারণে তিনি নারীর প্রতি চরম বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন
হয়ে ওঠেন । তাঁরা হলেন তাঁর জন্মদাত্রী মা (আমিনা) এবং প্রথম স্ত্রী খাদিজা । এ ছাড়া আর একটা বড়ো কারণ
আছে, তা হলো কোরেশদের নারী প্রতিমা পূজা করা । নারী প্রতিমা পূজা করার জন্যে মুহাম্মদ কেনো
চরম নারিবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন সে
প্রসঙ্গে দু’একটি কথা একদম
শেষে বলবো । তার আগে আলোকপাত করে নিতে চাই আমিনা ও খাদিজার
কারণে কেনো মুহাম্মদ নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন ।
মুহাম্মদের জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা যান । আর
জন্মের পর পরই মা আমিনা দুধের শিশু মুহাম্মদকে তুলে দেন ধাত্রী মা হালিমার হাতে । মায়ের বুকের স্তন, কোলের স্পর্শ
ও আদর-স্নেহ থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন । এ
ঘটনা তাঁকে সারা জীবন তাড়া করে
বেরিয়েছিলো বলে মনে হয় । তাঁর
প্রতি জন্মদাত্রী মা আমিনার এরূপ
অবিশ্বাস্য দরদহীনতা ও উদাসীনতা তাঁকে কাছে
চরম পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যা তিনি আজীবন ভুলতে পারেন নি । মুহাম্মদের জীবনীকারগণ ধাত্রী মায়ের কাছে তাঁর প্রতিপালিত হওয়ার ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান
নি, এটাকে আরবের একটা প্রথাজনিত স্বাভাবিক ঘটনা বলে বিবৃত করেছেন । এটা যে
মুহাম্মদের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে সে দিকটা হয় তাঁরা উপেক্ষা করেছেন, না হয়
ভেবে দেখার প্রয়োজনই অনুভব করেন নি । মা যদি সন্তানকে প্রতিপালন করার কষ্ট থেকে রেহাই
পেতে অন্য নারীর হাতে তার সন্তানকে প্রতিপালনের ভার তুলে দেয় তবে সেই সন্তান বড়ো
হলে তার মনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না এমনটা
নিঃশংসয়ে বলা যায় না । তাছাড়া
মুহাম্মদকে প্রতিপালন করার জন্যে ধাত্রী মায়ের কাছে হস্তান্তর করার ঘটনা প্রথাজনিত
স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো না । এই প্রথাটা আরবে সার্বজনীন ছিলো না । সন্তান প্রতিপালন করার জন্যে ধাত্রীকে মোটা অর্থ দিতে
হতো বলে এ প্রথা চালু ছিলো মুষ্টিমেয় কিছু বিত্তবান পরিবারের মধ্যে । তাছাড়া এ প্রথা চালু
ছিলো সধবা স্ত্রীদের জন্যেই যাতে তারে পরের সন্তান ধারণ করার জন্যে তার নিজের
শরীরের যত্ন নিতে পারে । মুহাম্মদের
পিতামহ মোতাল্লেবের সংসারে আর্থিক টানাটানি ছিলো এবং আমিনা ছিলেন বিধবা । স্বভাবতই
ধাত্রী মায়ের দুধ খেয়ে এবং কোলে-পিঠে চেপে নয়, মুহাম্মদের মানুষ হওয়ার কথা ছিলো
আমিনার দুধ খেয়ে এবং কোলে-পিঠে চেপে । এমনটা না হওয়া ছিলো অস্বাভাবিক ঘটনা । তাই
মুহাম্মদকে প্রতিপালনের জন্যে হালিমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার পশ্চাতে অন্য কোনো রসায়ন
ছিলো কী না তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন
। আর এ ঘটনাটি, এমনও শোনা যায় যে, সে সময় আড়ালে আবডালে অনেকের কাছেই চর্চার বিষয়
হয়ে উঠেছিলো । মুহাম্মদ যখন বড়ো হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন তখন সেই চর্চার রেশ তখনও
ছিলো যা তাঁকে যথেষ্ট বিদ্ধ করতো । সব
মিলিয়ে মায়ের প্রতি মুহাম্মদের মনে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির স্থলে ক্ষোভ সৃষ্টি
হয়েছিলো যা তিনি শেষ পর্যন্ত মন থেকে মুছে ফেলতা পারেন নি, এবনং তাঁকে তিনি ক্ষমা
করতে পারেন নি । না, এটা
অনুমান কোনো অনুমান নয় । এটা চরম ও
নির্মম একটি সত্য ঘটনা । একেবারে গোঁড়ার দিকে যে সমস্ত মুসলিম ঐতিহাসিক মুহাম্মদের
জীবনী রচনা করেছেন তাঁদের বই থেকে এসব মহা মূল্যবান তথা পাওয়া
গেছে ।
মক্কার ক্ষমতা দখল করে মুহাম্মদ
তাঁর মায়ের মৃত্যুর প্রায় ৫৫ বছর পর তাঁর কবর পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন কয়েকজন
সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে । তাঁর মা’কে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো মক্কা ও মদিনার মাঝে আবওয়া
নামক স্থানে । মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে
তিন যে কথাগুলি বলেছিলেন তা ছিলো সকলের কাছেই বিষ্ময়কর, অপ্রত্যাশিত ও
হতাশাব্যঞ্জক । তাঁর মুখ নিঃসৃত কথাগুলি
থেকেই এমন ধারণা প্রবল হয় যে তিনি তাঁর মাকে ক্ষমা করতে পারেন নি । তিনি কী বলেছিলেন সে কথা ইবন সা’দ-এর (৭৮৪-৮৪৫)
গ্রন্থ থেকে শোনা যাক । তিনি লিখেছেন -
·
‘This is the grave of my mother; the
Lord has permitted me to visit it. And I sought leave to pray for her, but it
was not granted. So I called my mother to remembrance, and the tender memory of
her overcame me, and I wept.’ (Vide: Understanding Muhammad, Ali Sinha, p-5)
মাকে মুহাম্মদ ক্ষমা করতে পারেন নি, কিন্তু তার দায় চাপিয়েছেন আল্লাহ্র উপর । বলেছেন মায়ের
আত্মার কল্যাণের জন্যে তিন আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু
আল্লাহ্ তাঁকে অনুমতি দেয় নি । আল্লাহ্ অনুমতি দেয় নি এ কথাটার বিশ্বাসযোগ্যতা
মোটেই প্রশ্নাতীত নয় । আল্লাহ্ কেনো বাধা দেবে মুহাম্মদকে তাঁর মায়ের আত্মার
শান্তি ও কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করতে চাইলে ? বরং আল্লাহ্র তো খুশী হওয়ার কথা । কারণ, কোরানের
বর্ণনা অনুযায়ী স্বয়ং আল্লাহই তো তাঁকে (মুহাম্মদকে) দূত করে পৃথিবীতে পাঠানোর
জন্যে আমিনার গর্ভকেই সবচেয়ে বেশী নিরাপদ ও উপযুক্ত মনে করেছিলো । তাই আল্লাহ্ যে নারীকে মুহাম্মদের মাতা নির্বাচন করেছিলো তাঁর প্রতি
মুহাম্মদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখে তো আল্লাহ্র খুশী ও আপ্লুত হওয়ার কথা । সুতরাং আল্লাহ্
তাঁকে তাঁর মায়ের জন্যে প্রার্থনা করা অনুমতি দেয় নি – এটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়
না । যেটা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় তা হলো, মুহাম্মদ নিজেই তাঁর মায়ের জন্যে
প্রার্থনা করতে চান নি । আর সেটা এ জন্যে যে, তিনি ক্ষমা করতে পারেন নি । মা
আমিনার প্রতি মুহাম্মদের এই সহানুভূতিহীনতা, শ্রদ্ধাহীনতা ও তীব্র বিরূপতা হয়তো সমগ্র নারীজাতির প্রতি বিস্তার
লাভ করেছিলো ।
দ্বিতীয় যে নারী মুহাম্মদের জীবনের উপর সর্বাধিক
গভীর ছাপ ফেলেছিলেন তিনি ছিলেন খাদিজা, তাঁর প্রথম স্ত্রী । তাঁর সমর্থন,
সহানুভূতি ও সহযোগীতা ছাড়া মুহাম্মদ ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে পারতেন না
। তিনি
ছিলেন মক্কার সব চাইতে ধনী বণিক, যদিও তিনি ছিলেন
বিধবা মহিলা। মুহাম্মদকে তিনি প্রথমে একজন বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং তারপর তাঁকে বিয়ে করেন । খাদিজার তখন, এ কথা বলা হয় যে, বয়স
ছিলো ৪০ (চল্লিশ) বছর এবং মুহাম্মদের ২৫ (পঁচিশ) । কিন্তু খাদিজার
বয়স অতো বেশী ছিলো না, তবে তিনি
মুহাম্মদের চেয়ে বয়সে যে ঢের বড়ো ছিলেন তা সংশয়াতীত । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে খাদিজার প্রস্তাবক্রমেই
বিয়েটা হয়েছিলো । খাদিজা ছিলেন শুধু ধনী বণিকই ছিলেন না, ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী
নারী । ফলে কী ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, কী দাম্পত্য-জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে
খাদিজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বজায়
ছিলো । স্ত্রীর এই
কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ছিলো মুহাম্মদের কাছে খুবই পীড়াদায়ক । এটা অবশ্য যে কোনো পুরুষের জন্যেই পীড়াদায়ক । তবে মুহাম্মদের
কাছে এটা অনেক অনেক বেশী পীড়াদায়ক ও
যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিলো । কারণ, বার্ধক্যের কারণে শেষের কয়েক বছর খাদিজার পক্ষে
মুহাম্মদের জৈবিক চাহিদা পূরণ করার সাধ্য না থাকা সত্ত্বেও তিনি পঁচিশ বছরের দীর্ঘ
দাম্পত্যজীবনে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা ভাবতে পারেন নি । স্বভাবতই সেই দীর্ঘ সময়টা মুহাম্মদকে তাঁর যৌন
চাহিদা অবদমন করে থাকতে হতো । মুহাম্মদ যে তাঁর
যৌন চাহিদা ও কামনাকে অবদমন করে রেখেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে খাদিজার মৃত্যুর পর ।
খাদিজার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই তিনি বিয়ে করেন একজন বিধবা নারীকে, তারপর কিছুদিন
যেতে না যেতেই বিয়ে করেন ছ’বছরের একজন শিশু কন্যাকে, তারপর একে একে অসংখ্য মুসলিম ও ইহুদী নারীকে । এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে তাঁর উপর খাদিজার প্রাধান্য
ও আধিপত্য এতো প্রবল ছিলো যে তিনি তাঁর অতৃপ্ত যৌন কামনা অবদমন করে রাখতে বাধ্য
হয়েছিলেন । স্ত্রীর এই যে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য এবং তাঁর অবদমিত তীব্র যৌন কামনা তাঁকে
খাদিজার প্রতি এবং সমগ্র নারী জাতির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ করে তুলেছিলো । খাদিজার প্রতি তিনি যে বিদ্বেষী ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর একটি ঘটনায় । তা হলো এ রকম - মুহাম্মদের একজন সাধারণ কর্মচারী থেকে আল্লাহ্র নবী হয়ে ওঠার পশ্চাতে সামগ্রিভাবে
সব চেয়ে বেশী অবদান ছিলো খাদিজার তা বলা বাহুল্য । কিন্তু তাঁর (খাদিজার) মৃত্যুর পর মুহাম্মদ তাঁর সেই অমূল্য অবদানকে কার্যতঃ স্বীকৃতিই দেন নি । কিন্তু অন্যদিকে তিনি তাঁর সাহাবীদের এক্ষেত্রে ছিলেন উদার হস্ত
ও কল্পতরু । তিনি তাঁর অনেক সাহাবীকেই বিরাট বিরাট উপাধি
দিয়ে গেছেন তাঁদের অবদানকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যে । যেমন আবুবকরকে ‘সিদ্দিকি’ (বিশ্বাসী), আলীকে ‘আসাদুল্লাহ’
(আল্লাহর সিংহ) ও ‘জ্ঞানের দরজা’ এবং অন্য একজন সাহাবীকে ‘সাইফুল্লাহ” (আল্লাহ্র
তরবারি) উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর কন্যা
ফতেমার ইসলামের জন্যে তেমন উল্লেখযোগ্য
কিছু অবদান ছিলো না । অথচ তাঁকে তিনি পৃথিবীর
‘শ্রেষ্ঠ নারী’র মর্যাদা এবং ‘খাতুনে জান্নাত’ (স্বর্গের
সম্রাজ্ঞী) উপাধিতে ভূষিত করে গেছেন । ইসলামের প্রসার এ প্রতিষ্ঠার পেছনে কোন নারীর
অবদান কতো তার ন্যায্য বিচার করলে একমাত্র
খাদিজাই ছিলেন পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ নারী’র মর্যাদা এবং ‘খাতুনে
জান্নাত’ উপাধি পাওয়ার যোগ্য ও উপযুক্ত, ফতেমা নয় । কিন্তু খাদিজাকে মুহাম্মদ সেটা দেন নি । এর
কারণ একটাই, খাদিজার প্রতি মুহাম্মদের তীব্র বিদ্বেষপরায়ণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব
।
তৃতীয় যে কারণটি মুহাম্মদকে চরম নারীবিদ্বেষী করে তুলেছিলো তা হলো মক্কার কোরেশগণ
তিন নারী প্রতীমার পূজা করতেন । এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে অন্যত্র । তাই এখানে এ বিষয়ে অল্প কয়েকটি কথা
বলবো । যাদের দেবী জ্ঞানে কোরেশগণ পূজা করতেন তাদের নাম ছিলো আল-লাত, আল- মানাত ও উজ্জা । তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন যে তাঁদের আরাধ্যা দেবী্রাই ছিলো ‘আল্লাহ’-র তিন কন্যা । প্রসঙ্গতঃ
উল্লেখ্য যে আল্লাহ ছিলো আরবদের প্রধান দেবতা ।
আল-লাত, আল- মানাত ও উজ্জা-র কথা কোরানের ৫৩/১৯-২১ নং আয়াতে আছে । নারীদের প্রতি
কোরেশদের এই নিরেট আনুগত্য মুহাম্মদের ধর্মের পথে একটা বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ।
ফলে নারী প্রতিমা শুধু নয়, নারীকেই তাঁর চরম শত্রু মনে হয়েছিলো যা তাঁকে চরম
নারীবিদ্বেষীতার পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো । মানুষের মন থেকে নারীর প্রতি ভক্তি ও
শ্রদ্ধা মুছে দেওয়ার জন্যে তাই তিনি নারীকে শত্রু রূপে চিহ্নিত করেছিলেন । আর তার
জন্যে বলা বাহুল্য যে, তাঁকে আল্লাহ্র
কাছ থেকে আসমানি
বাণী(!)
আমদানি করতে হয়েছিলো ।
সেই বাণীগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে কোরানের ৪/১৭-২১ নং আয়াতগুলিতে । তার মধ্যে প্রথজম আয়াতটি হলো - “তারা তাঁকে পরিত্যাগ করে তৎপরিবর্তে নারী
প্রতিমাপুঞ্জকেই আহ্বান করে এবং তারা বিদ্রোহী শয়তানকে ব্যতীত আহ্বান করে না ।” (অনুবাদ –
ইবনে কাথির)
মূল কথা হলো মাতৃস্নেহ
না পাওয়ার ক্ষোভ, তাঁর নিজের উপর স্ত্রীর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য এবং তিন নারী প্রতিমাকে পূজা দিয়ে
আল্লাহ্ ও মুহাম্মদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করার ঘটনাগুলো মুহাম্মদকে নারীবিরোধী ও নারিবিদ্বেষী করে
তুলেছিলো । সে জন্যেই তিনি সর্বক্ষেত্রে নারীর উপর পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন অত্যন্ত নির্মম ও নগ্নভাবে । আর তারই
ফলশ্রুতিতে তিনি রচনা করে গেছেন ‘মজনু বিলাস’ আইন এবং সমগ্র ‘ফারাজ আইন’ তথা
উত্তরাধিকার আইন ।
এবার আসা যাক দত্তক আইন প্রসঙ্গে । প্রাক ইসলাম
যুগে দত্তক সন্তানরা পালক পিতামাতার উত্তরাধিকার হতো । আমাদের দেশেও ১৯৭৪ সালে
দত্তক আইন প্রণয়ন করে দত্তক পুত্র ও কন্যাকে সেই অধিকার প্রদান করা হয়েছে । আইনটি শরিয়ত বিরোধী বলে মুসলিম মৌলবাদীরা প্রতিবাদ
করলে কংগ্রেস সরকার তাঁদের তুষ্ট করে আইনটি সংশোধন করে এবং মুসলিমদের দত্তক আইন
থেকে অব্যাহতি দেয় । আরবের সমাজে দত্তক সন্তানরা
বাবার ঔরসজাত সন্তানদের মতোই মর্যাদা ও সমান অধিকার ভোগ করতো । বলা বাহুল্য
যে এটা
ছিলো অতি উত্তম সংস্কৃতি ও উচ্চ নৈতিকতা যুক্ত মহৎ প্রথা । মুহাম্মদ নিজেও তা অতি উত্তম জ্ঞানে সমর্থন করতেন
এবং মান্য করতেন । সেই প্রথা মেনেই তিনি একদিন
একজন ক্রীতদাসকে (জায়েদ) মুক্তি দিয়ে দত্তক নিয়েছিলেন । ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মুহাম্মদই একদিন এক ওহির খোঁচায় সেই প্রথা খারিজ করে দিয়েছিলেন । বলেছিলেন দত্তক সন্তান আর নিজের সন্তান এক নয়,
সুতরাং দত্তক সন্তান পালক বাবা-মা’র উত্তরাধিকার হতে পারবে না । সাধারণতঃ জনস্বার্থে
ভীষণ একটি কুৎসিত আইন খারিজ করে তার
পরিবর্তে একটি ভালো আইন প্রবর্তন করা হয় । এর উল্টো হয় না, অন্ততঃ হওয়া
উচিত নয় । মুহাম্মদ কিন্ত উল্টোটাই করেছিলেন । এখন প্রশ্ন হলো, তিনি তা কেনো
করেছিলেন ? এর উত্তরটা হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাবে,
কিন্তু তা সত্যি ও বাস্তব ঘটনা । তিনি সম্পূর্ণ
ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই তা করেছিলেন । এই কদর্য ঘটনাটি মুহাম্মদ ঘটিয়েছিলেন তাঁর পালিত পুত্র জায়েদের
স্ত্রী জয়নাবকে বিয়ে করার সময় । জয়নাব ছিলেন খুবই সুন্দরী । যে কয়টি বিয়ের জন্যে মুহাম্মদের তীব্র বদনাম হয়েছিলো এবং তার তাঁর অনুগামীদের আজো
সমানে বিব্রত হতে হয় তার মধ্যে এটা একটা । এই বিয়েটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা
হয়েছে ‘মুহাম্মদের হারেম সংবাদ’ অধ্যায়ে । এখানে একান্ত প্রয়োজনে মূল ঘটনাটি বলতে
চাই । জয়নাবের (পুত্রবধূর) গায়ে ঠিকমতো
পোশাক ছিলো না এমন অবস্থায় মুহাম্মদ একদিন তাঁকে তাঁদের বাড়িতে দেখে ফেলেন । তাঁর শরীরের রূপ-লাবণ্য দেখে মুগ্ধ
ও অভিভূত হয়ে পড়েন । তা দেখে তিনি বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে রূপের প্রশংসা করেন ।
সে কথাগুলি জয়নাবের কানে প্রবেশ করে । মুহাম্মদ কিন্তু জয়নাবের আতিথ্য গ্রহণ না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান
। জায়েদ (মুহাম্মদের পুত্র) বাড়িতে ফিরলে জয়নাব সব ঘটনাটা তাঁকে বলেন । জায়েদ বুঝে
যান যে মুহাম্মদের জয়নাবকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে । এটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভীতো
হয়ে পড়েন । কারণ, তিনি তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এটা জানতেন যে মুহাম্মদের যাকে পছন্দ
তাকে যে কোনো মূল্যে তিনি করায়ত্ত করে থাকেন । তাই আপন প্রাণের মায়ায় তিনি সুন্দরী
স্ত্রীর মায়া ত্যাগ করেন এবং তাঁকে তালাক (ইস্তফা) দেন । জায়েদ জয়নাবকে তালাক
দিয়েছিলেন, কারণ তিনি জয়নাবকে বিয়ে করার
ক্ষেত্রে মুহাম্মদের পথের কাঁটা হয়ে থাকতে
চান নি । কিন্তু জয়নাবকে বিয়ে করার
ক্ষেত্রে তার পরেও আর একটা কাঁটা থেকে গিয়েছিলো । সেটা আরব সমাজের দীর্ঘ কাল ধরে
চলে আসা প্রথা । প্রথাটা ছিলো, পালক পিতার কাছে পাত্রী হিসেবে দত্তক পুত্রের বিধবা বা তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী
ছিলো অবৈধ । সেজন্যেই মুহাম্মদকে সেই
প্রথা বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে
হয়েছিলো । এবং তা করেছিলেন আল্লাহ্র নামে । সেই আইনে বলা হয়েছে যে দত্তক পুত্রের বিধবা বা তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী
পালক পিতার কাছে বৈধ এবং দত্তক পুত্র বা কন্যা পালক পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হতে
পারবে না । যে আয়াতে আল্লাহ্ মুহাম্মদের সাথে
জয়নাবের বিয়ের
আদেশ (অনুমতি নয় আদেশ) দিয়েছিলেন বলে মুহাম্মদ দাবী করেছিলেন সে আয়াতটি
হলো -
‘ ... অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের
সহিত বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে
মুমিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সহিত
বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে-সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহ্র আদেশ কার্যকর হতে বাধ্য।” (কোরান- ৩৩:৩৭)
যে আয়াতে আল্লাহ্ দত্তক পুত্রের অধিকার হরণ করছেন বলে মুহাম্মদ দাবী করেছিলেন সে আয়াতটি হলো –
“...
এবং তোমাদের পোষ্য-পুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেন নি । এ তোমাদের জন্যে
তোমাদের মৌখিক কথা মাত্র, এবং আল্লাহ সত্য কথাই বলেন, তিনিই সরলপথ প্রদর্শন করেন
।” [৩৩/৪]
No comments:
Post a Comment