মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে
মানুষের ভীষণ কৌতূহল । কিন্তু এ
বিষয়ে লেখা বা আলোচনা খুব বেশী চোখে পড়ে না । যে কোনো বিষয়েই হোক না কেনো
মানুষের কৌতূহল যতো বেশী প্রলম্বিত হয় সে বিষয়টি সম্পর্কে জানার কৌতূহলের মাত্রাও
ততো বাড়ে । মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন কেমন ছিলো তা জানার
ক্ষেত্রেও অন্যথা হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি । বরং তাঁর ক্ষেত্রে কৌতূহল অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটা বেশীই, কারণ তিনি নিজেকে তথাকথিত
আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে দাবি করেছিলেন
এবং অনেকগুলি বিয়েও করেছিলেন যার নজির খুব কমই আছে । তাই এ বিষয়টি
আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে । শুধু মানুষের কৌতূহল নিরসনের জন্যেই নয়, নারীর প্রতি মুহাম্মদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী কীরূপ ছিলো তা
অবহিত হওয়ার জন্যেও তাঁর
দাম্পত্যজীবনের উপর আলোকপাত করা আবশ্যক । কিন্তু সমস্যা হলো, মুহাম্মদের জীবনীকারগণ এ বিষয়টিতে কার্যতঃ নীরব, ফলতঃ এ বিষয়ে আলোচনা করা বা এর উপর আলোকপাত করার
জন্যে আমাদের সম্পূর্ণই নির্ভর করতে হবে কোরান, হাদিস এবং কোরানের তফসিরের উপর । ইসলামের
ইতিহাস থেকেও কিছু সূত্র পাওয়া সম্ভব । এসব সূত্র প্রাপ্ত তথ্য ও ইঙ্গিতের সাহায্যে মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনের একটি
বিশ্বাসযোগ্য ছবি অঙ্কন করা সম্ভবও ।
সাধারণভাবে মুসলিমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে মুহাম্মদের
দাম্পত্যজীবনে ছিলো অপার সুখ, শান্তি এবং আনন্দে ভরপুর । কোনো প্রকার দুঃখ-কষ্ট,
ঝগড়া-বিবাদ, ও অশান্তি ছিলো না তাঁর
দাম্পত্যজীবনে । তাঁর স্ত্রীরা সবাই ছিলেন খুশী, সুখী ও আনন্দমুখর; তাঁদের
পরষ্পরের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ ও হিংসা ছিলো না; তাঁরা সবাই সবাইকে গভীরভাবে ভালবাসতেন, সকলেই মুহাম্মদকে হৃদয় উজার করে ভালবাসতেন;
তাঁদের মুহাম্মদের প্রতি কারো কোনো প্রকার
রাগ,দুঃখ, অভিযোগ ও অভিমান ছিলো না
। অন্যদিকে মুহাম্মদও সকল স্ত্রীকে সর্বদা প্রাণঢালা
ভালবাসা দিয়ে সকলকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন,
সকলকে সমানভাবে ভালবাসতেন ও সকলের প্রতি সমান নজর রাখতেন, তিইজ নিজেও
স্ত্রীদের আচার-ব্যবহারে, ভালোবাসায়, সেবা-যত্নে যার পর নাই
খুশি ও তৃপ্ত ছিলেন; তাঁর অন্তরে স্ত্রীদের প্রতি
তাঁরও কোনোরূপ রাগ, দুঃখ, অনুযোগ ও অভিযোগ তিলমাত্র ছিলো না । বলা বাহুল্য যে, মুসলিমরা এরূপ বিশ্বাস করে
অন্ধভাবে যেখানে কোনো যুক্তি, বুদ্ধি ও প্রমাণের লেশ মাত্র নেই । অথচ তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই কেবল যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে
ভাবলেই এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে মুসলিমরা যা বিশ্বাস করে তা হওয়া অসম্ভব । মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন দুঃখ-কষ্ট, ঝগড়া-বিবাদ, অভিযোগ-অনুযোগ ছাড়াই সম্পূর্ণরূপেই সুখ, শান্তি ও আনন্দে ভরপুর ছিলো -
এ রকম
হওয়া মোটেই সম্ভবপর ছিলো না, কারণ তাঁর হারেমে ছিলেন একসঙ্গে সর্বনিম্ন
ন’জন স্ত্রী । শিয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করেন যে মুহাম্মদ
যখন মারা যায় তখন পনেরো জন স্ত্রী জীবিত ছিলেন ।
যাঁর হারেমে ন’জন থেকে পনেরো জন স্ত্রী
থাকে তাঁর সংসারে ঝগড়া-বিবাদ, অভাব-অভিযোগ, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তি থাকবে
না তা হতেই পারে না । এবং বস্তুতঃ, এটাই সত্যি ঘটনা যে, মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনেও
ছিলো সুখ-দুঃখ, হর্ষ-বিষাদ, অভিযোগ-অভিমান, ঝগড়া-বিবাদ ও তীব্র
অশান্তি । হ্যাঁ, কোরান, হাদিস ও মুহাম্মদের জীবনী থেকে পাওয়া তথ্য ও ইঙ্গিতগুলো সে সাক্ষ্যই বহন করে চলেছে ।
কোরানের তফসির এবং হাদিস বলছে
যে মুহাম্মদ তাঁর দু’জন স্ত্রীকে (সওদা ও হাফসাকে) তালাক (divorce) দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য স্ত্রীদের বারবার তালাকের ভয়
দেখিয়েছিলেন । স্বামী-স্ত্রীর
সাংসারিক জীবন যখন দুঃসহ হয়ে
ওঠে তখন সেই দুঃসহ জীবনের অবসান হতে পারে
কেবল তালাক বা পাকাপাকি বিচ্ছেদের মাধ্যমে
। অর্থাৎ তালাক হলো একটা চরম পদক্ষেপ যা কেবল অশান্তির চরম মুহূর্তেই নেওয়া
হয় । সুতরাং মুহাম্মদের এই তালাক দেওয়ার মতো চরম পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনা এবং তালাক
প্রদানের ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা প্রমাণ করে
যে মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনে চরম অশান্তি বিরাজ করতো । অবশ্য এ কথাও সত্যি যে সওদা ও হাফসাকে দেওয়া তালাক মুহাম্মদ পরে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন । মুহাম্মদ তাঁদের কেনো তালাক দিয়েছিলেন এবং
কেনোই বা তালাক প্রত্যাহার করে
নিয়েছিলেন তার কারণগুলি মোটেই অজ্ঞাত নয়,
এগুলি জানা যায় কোরানের তফসির ও হাদিস থেকে । এ বিষয় দু’টি এখানে
আলোচনা করবো না, কেননা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এই অধ্যায়েরই শেষে ‘হাফসাকে তালাক’ ((http://giasuddinonline.blogspot.in/2015/01/blog-post_17.html) এবং ‘সওদাকে তালাক’ (http://giasuddinonline.blogspot.in/2015/02/blog-post_20.html) শিরোনাম দিয়ে ।
প্রসঙ্গতঃ জানাতে চাই যে, যদিও মুহাম্মদের অনুরাগী জীবনীকারগণ তাঁর
দাম্পত্যজীবনের অশান্তির ছবিটি আড়াল করার প্রাণান্তকর প্রয়াস করেছেন, কিন্তু তাঁদের সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে । মুহাম্মদের গুণগান করার প্রয়োজনেই
কখনও কখনও নিজেদের অজান্তেই তাঁর
দাম্পত্যজীবনের অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার বর্ণনা তাঁরা করে ফেলেছেন । এসব বর্ণনা
থেকে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে
মুহাম্মদের স্ত্রীদের পরষ্পরের
মধ্যে সদ্ভাবের ভীষণ অভাব ছিলো, তাঁরা অনেকেই একে অপরকে হিংসা করতেন, এবং এমনকি কারো
কারো মধ্যে শ্ত্রুতার
মনোভাবও বিদ্যমান ছিলো । মুহাম্মদের
স্ত্রীদের মধ্যে কীরূপ হিংসা, বিদ্বেষ ও মনোমালিন্য ছিলো তা বোঝার জন্যে কয়েকটা দৃষ্টান্ত
দেওয়া যাক । এক).
“রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একদা হযরত সাফিয়ার (রাঃ) গৃহে গিয়ে দেখলেন, তিনি
কাঁদছেন । কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন – আয়েশা এবং জয়নাব বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহর স্ত্রী
এবং গৌরবের দিক হতে একই রক্তধারার অধিকারিণী । সুতরাং আমরাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার
। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তুমি কেন বললে না যে, আমি আল্লাহর নবী হযরত হারুণের বংশধর ও হযরত মুসার ভ্রাতুষ্পুত্রী
এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমার স্বামী । অতএব তোমরা কোন দিক হতে আমার চাইতে
শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পার ?” (দ্রঃ মহানবী (সঃ) এঁর বিবাহ, মহম্মদ সাদাত আলী,
পৃ - ১১২) দুই). “একদা কোনো এক সফরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর
সাথে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণও সফর সঙ্গী ছিলেন । প্রত্যেকের জন্যই ভিন্ন ভিন্ন উটের
ব্যবস্থা করা হয়েছিল । চলার পথে হঠাৎ সাফিয়ার (রাঃ) উট অসুস্থ হয়ে পড়ে । হযরত
জয়নাবের (রাঃ) নিকট একটি অতিরিক্ত উট ছিল
। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জয়না বকে তাঁর অতিরিক্ত উটটি
হযরত সাফিয়ার (রাঃ) সাহায্যের জন্য দিতে বললেন । জয়নাব বললেন – এই ইহুদী মেয়েকে আমি উট দেব না ।
জয়নাবের কথায় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) খুবই মর্মাহত ও অসন্তুষ্ট হলেন । ফলে দীর্ঘ দুই
মাস জয়নাবের সাথে তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন ।” (সূত্রঃ – ঐ, পৃ –
১১২) তিন). সাফিয়াকে সহ্য করতে পারতেন না
মুহাম্মদের আর এক পত্নী হাফসাও – এ কথা হাদিস থেকেও পাওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে মহম্মদ
সাদাত আলী তাঁর ঐ গ্রন্থেই হাদিস
তিরমিজী শরীফকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন
– “একদা উম্মুল মু’মেনীন হযরত সাফিয়া (রাঃ) কাঁদছিলেন । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর
কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন । তিনি উত্তরে বললেন,’আমাকে হাফসা বলেছে যে, আমি
ইহুদীর মেয়ে ।’ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দিয়ে বললেন, ‘তুমি নবী বংশের মেয়ে । তোমার বংশে
নবী আবির্ভূত হয়েছেন । বর্তমানে তুমি নবীর স্ত্রী । সুতরাং হাফসা তোমার উপর কোন
বিষয়ে গর্ব করতে পারে ?’ (পৃ – ৫৭) চার). মারিয়াকে নিয়ে মুহাম্মদের সংসারে তীব্র কলহ হতো
। মারিয়া ছিলেন একজন খৃস্টান দাসী যাঁকে
মুহাম্মদ মিশরের সম্রাটের কাছ থেকে
উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন । মারিয়া ছিলেন অতীব সুন্দরী কম বয়সী বালিকা ।
মুহাম্মদ তাঁকে উপপত্নী করে রেখেছিলেন । মারিয়াকে কেন্দ্র করে মুহাম্মদের
দাম্পত্যজীবন চরম বিষময় হয়ে উঠেছিলো । এর ইঙ্গিতও পাওয়া যায় মহম্মদ
সাদাত আলীর উক্ত বইটিতে । তিনি লিখেছেন –
“সম্রাটের উপহারকৃত দু’জন রমণী আপন বোন এবং দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলেন । মহানবী
(সাঃ) মারিয়াকে [বিবাহ পূর্বক] হযরত সাফিয়ার বাসস্থান সংলগ্ন অপর একটি বাসায়
রাখলেন। মার্টিন লিংগস অপর এক বর্ণনায়
মারিয়াকে ক্রীতদাসী (bondmaid) রূপে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু
তিনি তাও বলেছেন, মারিয়া যখন রাসূলের (সাঃ) সন্তানে গৌরবান্বিতা, তখন তিনিই হলেন
সকল আলোচনা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ।” (পৃ – ১০৩) মুহাম্মদ তাঁর সকল স্ত্রীদের পৃথক পৃথক ঘর তৈরী
করে দিয়েছিলেন তাঁর গৃহের সীমানার মধ্যেই
। তাহলে সাফিয়া ও মারিয়াকে কেনো তাঁর গৃহ
থেকে দূরে অন্যস্থানে ঘর দিয়েছিলেন ? কারণটি যে তীব্র দাম্পত্যকলহ তা সহজেই অনুমেয়
। এই দাম্পত্যকলহের স্পষ্ট ইঙ্গিত
কোরানেও পাওয়া যায় । সে কথা একটু পরে আলোচনা করবো । তাছাড়া মারিয়াকে কেন্দ্র করে দাম্পত্যকলহ কী ভয়ঙ্কর
রূপ নিয়েছিলো তা বিস্তৃতভাবে ‘মুহাম্মদের
হারেম সংবাদ’ অধ্যায়ে ও এই অধ্যায়ের শেষ দিকে আলোচনা করা হয়েছে । মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে এই যে তীব্র কলহ
হতো তা তো মোটেই অস্বাভাবিক ছিলো না ।
যার বহু পত্নী আছে তার পক্ষে সমস্ত স্ত্রীকে যেমন সমভাবে ভালোবাসা দেওয়া
সম্ভব নয়, তেমনই সকল স্ত্রীর প্রতি সমভাবে খেয়াল রাখাও সম্ভব নয় এবং সকল স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা মেটানোও সম্ভব নয়
। সুতরাং স্ত্রীদের মধ্যে অনিবার্যভাবেই
পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাস, ঈর্ষা, ও
বিদ্বেষ জন্মলাভ করে । মুহাম্মদও তাঁর স্ত্রীদের সকলের প্রতি ন্যায় বিচার ও সমান
ব্যবহার করেন নি । এর ভুরি ভুরি প্রমাণ কোরানেই পাওয়া যায়। এরই ফলশ্রুতিতে তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে সদ্ভাবের পরিবর্তে মারাত্মক অসদ্ভাব এবং তীব্র
হিংসা ও রেষারেষির জন্ম হয়েছিলো যা মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনকে দুঃসহ করে তুলেছিলো ।
আগেই বলেছি যে মুহাম্মদের
দাম্পত্যজীবনে যে তীব্র অশান্তি ছিলো তার
প্রমাণ কোরানেই রয়েছে । কোরানে বেশ কিছু আয়াত (তথাকথিত ঐশী বাণী বা আদেশ) আছে যেগুলি
সম্পূর্ণই তাঁর দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ।
সেই আয়াতগুলি থেকে তাঁর দাম্পত্য
জীবনের নানা টানাপোড়েন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনেক ইঙ্গিত ও সূত্র পাওয়া যায় । সেই ইঙ্গিত ও সূত্রগুলি কোন কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
তার স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে
কোরানের তফসিরে এবং হাদিসে । কোরানের তফসির মানে কোরানের আয়াতের
উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট বাখ্যা করা । অনেক
হাদিস ও তফসিরের বর্ণনায় মুহাম্মদের
দাম্পত্যজীবন কেমন ছিলো তার ছবিটা স্পষ্টরূপে
ফুটে উঠেছে । মুহাম্মদ যে তাঁর স্ত্রীদের তালাকের ভয় দেখাতেন এবং দু’জন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে পরে তা প্রত্যাহার
করে নিয়েছিলেন তার
প্রমাণ রয়েছে কোরানের তফসিরে । তফসিরের বাখ্যা ও বরণনা থেকেই আমরা জানতে পারি যে মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন মোটেই সুখের বা আনন্দের ছিলো না, তিনি তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে মোটেই
খুশী ও সুখী ছিলেন না, এবং তাঁর স্ত্রীরাও মুহাম্মদের ব্যবহারে মোটেই তুষ্ট ও তৃপ্ত ছিলেন না । কোরানে অনেক আয়াওতই আছে যেগুলি
মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনকে উন্মোচিত করে ।
তার মধ্যে কয়েকটি আয়াতের প্রতি এবার আলোকপাত করা যাক । সেই আয়াতগুলি হলো
- “হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ
করেছি তোমার স্ত্রীগণকে যাদের তুমি দেনমোহর দান করেছ, এবং বৈধ করেছি – তোমার
অধিকারভুক্ত দাসীগণকে, যাদের আমি দান করেছি, এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি তোমার
চাচাতো ভগ্নি ও ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি ও খালাতো ভগ্নি যারা তোমার সঙ্গে দেশ ত্যাগ করেছে, এবং কোনো
বিশ্বাসী নারী নবীর নিকট নিবেদন করলে এবং নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে – সেও বৈধ, এটা
বিশেষ করে তোমার জন্য, অন্য বিশ্বাসীদের জন্য নয়, যাতে তোমার কোনো অসুবিধা না হয় ।” (৩৩/৫০) “তুমি ওদের
মধ্যে যাকে ইচ্ছা তোমার নিকট থেকে দূরে
রাখতে পারো এবং যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারো, এবং তুমি যাকে দূরে রেখেছো তাকে কামনা
করলে তোমার কোন অপরাধ নেই । এই বিধান এই জন্য যে, এতে ওদের তুষ্টি সহজতর হবে
এবং ওরা দুঃখ পাবে না, এবং ওদের তুমি যা দেবে, তাতে ওরা প্রত্যেকেই খুশী থাকবে ।” (৩৩/৫১) “এর পর তোমার জন্যে কোন নারী বৈধ নয় এবং
তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী
গ্রহণও বৈধ নয় যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে মোহিত করে, তবে তাদের অধিকারভুক্ত
দাসীদের ব্যাপারে এ বিধান প্রযোজ্য নয় ।” (৩৩/৫২) “হে নবী ! তুমি তোমাদের স্ত্রীদের বলো, তোমরা যদি পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসের কামনা করো, তবে এসো, আমি তোমাদের ভোগ বিলাসের ব্যবস্থা করে দিই, এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদাই দিই ।” (সুরা আহজাব, ৩৩/২৮, আদি সুরা নং - ৯০ ) “হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তোমাদের স্ত্রীদের খুশী করার জন্য তা অবৈধ করছো কেন ? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময় ।”(সুরা তাহরিম, ৬৬/১ ) “যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল, পরে তার সেই স্ত্রী তা অন্যকে বলে দিয়েছিল, এবং আল্লাহ্ নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন । নবী এই বিষয়ে তার স্ত্রীকে কিছু বললো এবং কিছু বললো না, নবী যখন তা তাকে জানালো, তখন সে বললো, কে আপনাকে এ কথা জানিয়েছে ? নবী বললো, আমাকে জানিয়েছেন তিনি যিনি সর্বজ্ঞানী, সবই অবগত ।” (সুরা তাহরিম, ৬৬/৩ ) “তোমাদের দু জনের হৃদয় অন্যায়-প্রবণ হয়েছে, এখন যদি তোমরা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন করো আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করবেন । কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরের পোষকতা করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ ও জিব্রাইল এবং সৎকর্মশীল বিশ্বাসীগণ তার সাহায্যকারী ; উপরন্তু ফেরেস্তাগণও তার সাহায্যকারী হবে ।” ( সুরা তাহরিম, ৬৬/৪) “যদি নবী তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করে, তবে তার প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে সম্ভবত তাকে তোমাদের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্ত্রী দেবে, যারা হবে আত্মসমর্পণকারী, বিশ্বাসী, তওবাকারী, ইবাদতকারী, রোজা পালনকারী এবং বিধবা ও কুমারী ।” ( সুরা তাহরিম, ৬৬/৫) ।
কোরানে অসংখ্য আয়াত আছে যেগুলি কেবল মুহাম্মদের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে ।
তিনি এমন বহু কাজ করেছেন যার ফলে ঘরে বাইরে তাঁর তীব্র সমালোচনা হয়েছে । তখন সে সব
সমালোচনা বন্ধ করার জন্যে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ওহি (আয়াত) নিয়ে এসেছেন । কখনও
আবার তিনি এমন কিছু অর্জন করতে চেয়েছেন যা
তৎকালীন সমাজের প্রথাবিরুদ্ধ । তখন তিনি আল্লাহকে দিয়ে বলিয়েছেন যে, ঐ
প্রথাটি আল্লাহ পছন্দ করে না । একটা
উদাহরণ দেওয়া যাক । পালিত পুত্রকে আরবে
আপন পুত্রের মত মর্যাদা দেওয়া হতো এবং পালক পালক পিতার উত্তরাধিকার দেওয়া হতো ।
পালক পুত্র তার স্ত্রীকে তালাক দিলে সেই তালাক প্রাপ্তা নারীর সঙ্গে পালক পিতার
বিয়ে অবৈধ ছিলো । মুহাম্মদ এই দু’টো সুপ্রথাকে কুপ্রথা বলে বাতিল করেছিলেন
আল্লাহর কাছ থেকে ওহি এনে । এটা করেছিলেন তিনি তাঁর পালক পুত্রের তালাক প্রাপ্তা
স্ত্রীকে বিয়ে করার জন্যে । এরূপ অনেক ওহি
বা আয়াত আছে যা সম্পূর্ণ রূপেই
মুহাম্মদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ
করেছে । ৩৩/৫০-৫২ নং আয়াত তিনটিও হলো সে
রকম আয়াত যা কেবল মুহাম্মদের স্বার্থ
রক্ষা করেছে । মুহাম্মদ মক্কা থেকে মদিনা
গিয়ে তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরে একের পর এক বিয়ে করতে শুরু করেন । তিনি বিয়ে করেছিলেন কয়েকজন ইহুদি নারীকেও যাঁরা
ছিলেন যুদ্ধ লব্ধ দাসী । মুহাম্মদের বহু বিবাহের
এই বে নজির কর্মকাণ্ডের ফলে ঘরে বাইরে চারিদিকে সমালচনার ঝড় ওঠে । তাঁর
স্ত্রীদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয় । এতগুলি বিয়ে, এবং যুদ্ধ লব্ধ দাসিদের
জোরপূর্বক বিয়ে করার ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারছিলো না । সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং স্ত্রীদের
অসন্তোষ চাপা দিতে মুহাম্মদের দরকার ছিলো এটা প্রমাণ করার যে তিনি নিজের ইচ্ছায়
কিছু করেন নি, কোনো অবৈধ ও অন্যায় কাজও
করেন নি এবং যা করেছেন তা আল্লাহর ইচ্ছা ও
হুকুমেই করেছেন । ৩৩/৫০ নং আয়াত এনে
মুহাম্মদ সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা
করেছেন । মুসলিমরা দাবি করে যে মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের সকলের প্রতি ন্যায় ও সমান আচরণ করতেন । এ দাবি যে অবাস্তব এ
ভিত্তিহীন তার প্রমাণ রয়েছে কোরানের ৩৩/৫১ নং আয়াতেই যেখানে তথাকথিত আল্লহ বলছে
মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে যাকে খুশী কাছে রাখতে পারেন, যাকে খুশী দূরে
রাখতে পারেন, তাতে তাঁর অপরাধ হবে না ।
কাকে কাকে মুহাম্মদ নিজের কাছে রেখেছিলেন
আর কাকে কাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তার
উল্লেখ রয়েছে তফসিরে । ‘সওদাকে তালাক’ প্রসঙ্গে আলোচনায় সেই তফসিরটি
উল্লেখ করা হয়েছে । মুহাম্মদের এরূপ তীব্র বৈষম্যমূলক আচরণে তাঁর
স্ত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা ও
অসন্তোষ তৈরী হয়েছিলো । মুহাম্মদ সেটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এই ওহিটি
আয়াতটি (৩৩/৫১) এনে । ৩৩/৫২ নং আয়াতটি
প্রমাণ করে যে সুন্দরী নারীদের দেখলেই মুহাম্মদ তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হতেন ।
যাঁদের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন
তাঁদের যে কোনো উপায়েই হোক বিয়ে করেছেন ।
তিনি যতো বিয়ে করেছেন ততোই তাঁর দাম্পত্যজীবনে কলহ বেড়েছে, ফলে এক সময় তাঁকে
অন্য নারীদের বিয়ে করায় ইতি টানতে
হয়েছে যার উল্লেখ রয়েছে ৩৩/৫২ নং আয়াতটিতে । অন্য নারীদের বিয়ে করায় ক্ষান্তি
দিলেও, ক্ষান্তি দেন নি দাসিদের বিয়ে করায় এবং তাঁর স্ত্রীদের তীব্র অশান্তি থাকা
সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত তিনি মারিয়াকে বিয়ে করেছিলেন ।
এবার আহজাব সুরার ৩৩/২৮ নং আয়াত প্রসঙ্গে আসা যাক । এ
আয়াতটি কেনো এবং কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন তা নিয়ে ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ
আছে । প্রসঙ্গতঃ একটি কথা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়, তাহলো, কোরানের তফসিরকারদের মধ্যেও মতপার্থক্য ও মতবিরোধ দেখা যায় । কোনো কোনো তফসিরকার কোনো কোনো আয়াতের তফসির লিখতে গিয়ে নিজের
মনগড়া বাখ্যা দিয়েছেন । সেটা করেছেন মুহাম্মদের ভাবমূর্তি যাতে মলিন না হয় সেজন্যে
। কোনগুলি মনগড়া বাখ্যা তা অবশ্যই সহজেই
চেনা যায় । এবার দেখা যাক ৩৩/২৮ নং আয়াতের তফসির কী বলছে । গিরিশচন্দ্র সেন লিখেছেন, “মদীনা প্রস্থানের নবম বৎসরে হযরত স্বীয় পত্নীগণ হইতে
বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন ও শপথ করিয়াছিলেন যে, এক মাস কাল তাদের সঙ্গ করিবেন না, কারণ,
এই যে, তাঁহারা তাঁহার সাধ্যাতীত বস্ত্রাদি প্রার্থনা করিতেছিলেন । এয়মনের
বিচিত্র বসন ও মেসরের পট্ট-বস্ত্র, এবং এইরূপ সামগ্রীর প্রতি তাঁহাদের লোভ হইয়াছিল । এই সকল হজরতের হস্তায়ত্ত ছিল না । তিনি তাঁহাদের কতৃক
উত্যক্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গ ত্যাগ করেন, এবং এক মসজ্বেদে যাইয়া বসিয়া থাকেন, ঊনত্রিশ দিবসের
পর তিনি এই আয়াত প্রাপ্ত হন ।” (দ্রঃ কোরআন শারীফ, হরফ প্রকাশনী, কলেজ
স্ট্রীট, কলকাতা) গিরিসচন্দ্রের তফসিরটির
যথার্থতা সংশয়াতীত নয় । অবশ্য তিনি বলেছেন যে, তিনি নিজে তফসির লেখেন নি, পারস্য ভাষ্য পুস্তকে লেখা তফসিরের তিনি অনুবাদ করেছেন মাত্র
। সে যাই হোক, তিনি লিখেছেন যে ঘটনাটি ঘটেছিলো মদিনা প্রস্থানের নবম বৎসরে, অর্থাৎ ৬৩১ খৃষ্টাব্দে । ৬২২ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ যখন মদিনা যান তখন তিনি
নিশ্চয় তীব্র আর্থিক সংকটে ছিলেন এ কথা ঠিক । কিন্তু মদিনা যাওয়ার ন’বছর পর তাঁর সে
সংকট মোটেই ছিলো না, তখন তিনি রীতিমতো মদিনার একজন ধনবান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন । সেই ক’বছরে জিহাদের
নামে তিনি অনেকগুলি সশস্ত্র সফল অভিযান
সংগঠিত করেছিলেন । যার মধ্যে বদর যুদ্ধ রয়েছে, রয়েছে মদিনার ইহুদিদের বানু কানুইকা
(৬২৪ খৃঃ), বানু নাজির (৬২৫খৃঃ) ও বানু কুরাইজা (৬২৬ খৃঃ) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান
এবং ৬২৭ খৃষ্টাব্দে খায়বার অভিযান । বদর যুদ্ধে ৭০
জন মক্কার কোরেশকে বন্দি করে এনেছিলেন এবং তৎসহ
ছিলো অনেক উট, ঘোড়া ও অন্যান্য সামগ্রী । মুহাম্মদ বন্দিদের
আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করেছিলেন । মদিনার তিনটি ইহুদি গোষ্ঠীকে
মদিনা থেকে বিতাড়িত করে তাঁদের সমস্ত
স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিও লুঠ করেছিলেন । খায়বার ছিলো খুবই সমৃদ্ধ একটি উর্বর কৃষি অঞ্চল এবং সমৃদ্ধশালী
ইহুদিদের বাসভূমি । সেখান থেকে অঢেল সম্পদ
লুঠ করে এনেছিলেন এবং এনেছিলেন অনেক ইহুদি
শিশু, নারী ও পুরুষদের বন্দি করে । সেই
বন্দিদের বিক্রি করে প্রচুর অর্থোপার্জন করেছিলেন । এ সমস্ত অভিযান থেকে লুঠ করে তিনি যা পাওয়া
যেতো তার ১/৫ অংশ মুহাম্মদ নিজে নিতেন । কোনো অভিযানে
বিনা যুদ্ধে শত্রুরা সমর্পণ করলে শত্রুদের সমস্ত সম্পত্তি তিনি একাই নিতেন । এভাবে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মুহাম্মদ কয়েক বছরের মধ্যেই প্রচণ্ড ধনী হয়ে উঠেছিলেন । সুতরাং এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের
ভোগ-বিলাসের সামগ্রী দিতে অক্ষম ছিলেন এবং
সে জন্যে তাঁর স্ত্রীরা তাঁকে উত্যক্ত করে
তুলেছিলেন বিধায় আল্লাহ তাঁকে তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেবার ভয় দেখাতে বলেছিলো । তাছাড়া আর
একটা বিষয় ভেবে দেখা প্রয়োজন । তাহলো, মুহাম্মদের স্ত্রীরা সত্যি সত্যিই যদি পার্থিব
ভোগ-বিলাসের জন্যে মুহাম্মদের সাথে কলহ করতেন তাহলে তার অর্থ এটা দাঁড়ায় যে তাঁরা ছিলেন
নীচ, স্বার্থপর, সংকীর্ণমনা, হীনমনা এবং দুষ্টুবুদ্ধি সম্পন্ন মহিলা । কিন্তু তা কী করে সম্ভব ? মুহাম্মদ তো
স্বয়ং তাঁদের এক অনন্য সম্মানে ভূষিত করেছিলেন ‘উম্মুল মুমেনীন’ (
মুমিনের মাতা) উপাধি দিয়ে । সুতরাং যে প্রশ্নটির উদ্রেক হয় তাহলো, উক্ত আয়াতটি কোন ঘটনা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ
আবৃত্তি করেছিলেন ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে
এই আয়াতটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
অন্যান্য যে আয়াতগুলি আছে
সেগুলিকে একই সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে । এখন আসা যাক ৩৩/২৮ নং আয়াতটিতে
। এটা লক্ষ্যণীয় যে এই আয়াতটির মধ্যে দু’টি
বিশেষ বার্তা নিহিত রয়েছে । বার্তা
দু’টি হলো, এক). মুহাম্মদের স্ত্রীরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং
তাঁরা মুহাম্মদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিলেন
তাতে তিনি উত্যক্ত ও উৎপীড়িত বোধ করেছিলেন ।
দুই). মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর
স্ত্রীদের মধ্যে কলহ ও
অশান্তি এতো চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে
তাঁদের তালাক দেবার ভীতি প্রদর্শন করতে হয়েছিলো তাঁকে । এবার আমি চোখ রাখবো সুরা তাহরিমের ৬৬/৪ নং আয়াতের প্রতি ।
আয়াতটি বলছে, “তোমাদের দু জনের হৃদয় অন্যায়-প্রবণ হয়েছে, এখন যদি তোমরা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন করো আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করবেন । কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরের পোষকতা করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ ও জিব্রাইল এবং সৎকর্মশীল বিশ্বাসীগণ তার সাহায্যকারী ; উপরন্তু ফেরেস্তাগণও তার সাহায্যকারী হবে ।” প্রশ্ন হলো, কারা ছিলেন এই দু’জন স্ত্রী ? এই দু’জন স্ত্রী ছিলেন আয়েষা ও হাফসা । এঁরা যে
আয়েষা ও হাফসাই ছিলেন কোরানের
তফসিরে তার উল্লেখ রয়েছে । প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাথির
লিখেছেন – “তাফসীরে ইবনে জারীরে রয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত উমার
(রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেনঃ ‘এ দুজন স্ত্রী
কে ছিলেন ?’ উত্তরে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ ‘তাঁরা হলেন হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত
হাফসা (রাঃ) ।” [দ্রঃ ইবনে কাথিরের তফসীর, ১৭শ’ খন্ড, পৃ – ৫৫৮] আয়েষা ও হাফসা
দু’জনেই ছিলেন মুহাম্মদের কাছে খুবই প্রিয়, বিশেষ করে আয়েষা সম্পর্কে বলা
হয় যে তিনি ছিলেন মুহাম্মদের প্রিয়তম
স্ত্রী । তাহলে এহেন
দু’জন প্রিয়তম স্ত্রীর বিরুদ্ধেই মুহাম্মদ ‘হৃদয় অন্যায়-প্রবণ হয়েছে’ বলে গুরুতর অভিযোগ
এনেছিলেন কেনো ? এই কেনোর উত্তর পেতে চোখ রাখতে হবে তহরিম
সুরার ৬৬/৩ নং আয়াতে ।
আয়াতটি বলছে, “যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল, পরে তার সেই স্ত্রী তা অন্যকে বলে দিয়েছিল, এবং আল্লাহ্ নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন । নবী এই বিষয়ে তার স্ত্রীকে কিছু বললো এবং কিছু বললো না, নবী যখন তা তাকে জানালো, তখন সে বললো – কে আপনাকে এ কথা জানিয়েছে ? নবী বললো – আমাকে জানিয়েছেন তিনি – যিনি সর্বজ্ঞানী, সবই অবগত ।” কোরানের এই আয়াতটির ভাষ্যে বেশ কয়েকটি
প্রশ্ন নিহিত আছে । মুহাম্মদ তাঁর কোন স্ত্রীকে গোপনে একটা বিশেষ কথা বলেছিলেন ? কোন
কথাটা গোপনে বলেছিলেন? কেনো গোপনে
বলেছিলেন ? সেই স্ত্রী অন্য কোন স্ত্রীকে
সেই গোপন কথাটা বলেছিলেন ? এই প্রশ্নগুলির কয়েকটির উত্তর রয়েছে গিরিশচন্দ্রের তফসিরে । তিনি
লিখেছেন, “অর্থাৎ হে বিশ্বাসীগণ, স্মরণ কর, যখন হজরত মারিয়াকে গ্রহণ করার অবৈধতা
বিষয়ে অথবা মধুপান সম্বন্ধে হাফসা নাম্নী আপন পত্নীকে গোপনে বলেন, পরে হাফসা তাহা
স্বাধ্বী আয়শাকে জ্ঞাপন করেন, হাফসা যা আয়শাকে বলেন ঈশ্বর হজরতের নিকট তাহা প্রকাশ
করেন। হজরত তাহার কতক হাফসাকে জানাইলেন, অর্থাৎ তোমাকে এই কথা বলিয়াছিলাম তুমি
ইহার মধ্যে এই কথা প্রকাশ করিয়াছ এবং কোন কথা তিনি হাফসাকে বলিলেন না ।” এই তফসির থেকে দু’টি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না । মুহাম্মদ কোন অংশটা হাফসাকে ব্যক্ত করেছিলেন, কোন
অংশটি ব্যক্ত করেন নি, এবং কেন করেন নি ? আর যে কথাটা উল্লেখিত হলেও স্পষ্ট হয় নি সেটা
হলো, মুহাম্মদের বলা গোপন কথাটা কী ছিলো ?
এর উত্তর অবশ্য পাওয়া যায় গিরিশচন্দ্র প্রদত্ত তাহরিম সুরার ৬৬/১ নং আয়াতের তফসিরে । সুতরাং এবার চোখ রাখা যাক ৬৬/১ নং আয়াতে । এই আয়াতে আল্লাহ মুহাম্মদকে
মৃদুস্বরে ধমক
দিয়ে বলেছে, – “হে নবী ! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তোমাদের স্ত্রীদের খুশী করার জন্য তা অবৈধ করছো কেন ? ” এই আয়াতটি যে যে
প্রশ্নের উদ্রেক করে তা হলো, কী এমন বস্তু
যা আল্লাহ মুহাম্মদের জন্যে বৈধ করা সত্ত্বেও তিনি তা তাঁর স্ত্রীদের খুশী করতে
অবৈধ করেছিলেন ? এবং
মুহাম্মদই কেন বস্তুটিকে অবৈধ করেছিলেন ? আর সেই বস্তুটিতে তাঁর স্ত্রীরা কেনো আপত্তি
জানিয়েছিলেন ?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর নিহিত রয়েছে
মুহাম্মদ কৃত একটি ঘটনার মধ্যে যে ঘটনাটি একজন ধর্মপ্রবর্তকের কাছে আশা করা
যায় না । উক্ত ঘটনাটির স্পষ্ট ইঙ্গিত
রয়েছে ৬৬/৩ নং আয়াতের তফসিরে । গিরিশচন্দ্র লিখিত উক্ত তফসিরটি বলছে, “অর্থাৎ হে বিশ্বাসীগণ, স্মরণ কর, যখন হজরত মারিয়াকে গ্রহণ করার অবৈধতা বিষয়ে অথবা মধুপান সম্বন্ধে হাফসা নাম্নী আপন
পত্নীকে গোপনে বলেন, পরে হফসা তাহা সাধ্বী আয়শাকে জ্ঞাপন করেন, হফসা যে আয়শাকে
বলেন ঈশ্বর হজরতের নিকট তাহা প্রকাশ করে । ... ”
মুহাম্মদ হাফসাকে গোপনে কী বলেছিলেন ? না, ব্যাপারটা এ রকম নয় যে তিনি হাফসাকে কিছু
গোপন কথা বলেছিলেন । ব্যাপারটা হলো, মুহাম্মদ হাফসার
কাছে একটি অঙ্গিকার করেছিলেন যেটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন । অঙ্গিকারটি হলো
এই যে, তিনি
মারিয়াকে তাঁর জন্যে চিরদিনের জন্যে অবৈধ করে দিলেন, অর্থাৎ তাঁকে আর কোনোদিন
স্পর্শ করবেন না । আর তাতেই আল্লাহ মুহাম্মদকে হালকা ধমকের সুরে তিরস্কার করে বলে যে, সে (আল্লাহ) মারিয়াকে তাঁর (মুহাম্মদের) জন্যে
বৈধ করা সত্ত্বেও কেনো তিনি অবৈধ করেছেন ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুহাম্মদ ও হাফসার মধ্যে কী ঘটেছে না ঘটেছে তাতে আল্লাহ
হস্তক্ষেপ করবে কেনো ? কিংবা মুহাম্মদ যদি তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে শান্তিতে বাস করার
জন্যে মারিয়া নাম্নী উপপত্নীকে অবৈধ করেন তাতে আল্লাহর মাথা ব্যাথা হতে যাবে কেনো
? আসলে মুহাম্মদের পক্ষে মারিয়াকে ছেড়ে থাকা ক্রমশঃ অসম্ভব হয়ে উঠছিলো । তিনি তাই
আল্লাহর দোহাই দিয়ে হাফসার নিকট করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে উক্ত ওহি নিয়ে
আসেন । থাক সে কথা । হাফসার নিকট মুহাম্মদ কৃত অঙ্গীকারের
প্রসঙ্গে ফিরে আসি । এই অঙ্গীকার নিয়ে অন্য গল্পও শোনা যায়
। মুহাম্মদ নাকি অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি আর কখনো মধু খাবেন না । আর তাতেই আল্লাহ তাঁকে ঐ মৃদু ধমকটা দেয় । এবার দেখা যাক উক্ত অঙ্গিকার প্রসঙ্গে কোরানের
তফসির কী বলছে । তফসিরে দু’টি ঘটনারই উল্লেখ রয়েছে । কোনটা ঠিক তা নিশ্চিত করে
তফসিরকারগণ বলেন নি । তাঁরা বলেছেন মারিয়াকে স্পর্শ না করা কিংবা কোনদিন মধুকে না খাওয়া এই দু’টি অঙ্গীকারের মধ্যে একটি হবে । এ
প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্র ৬৬/১ নং আয়াতের তফসিরে যা
লিখেছেন - “হজরত মধুর শরবত ভালবাসিতেন । একদা তাঁহার অন্যতম ভার্যা জয়নব কিঞ্চিত মধু সংগ্রহ
করিয়া রাখিয়াছিলেন, হজরত যখন তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইতেন তখন তিনি মধুপানা প্রস্তুত
করিয়া দিতেন, তদনুরোধে তাঁহার আলয়ে হজরতকে
কিছু অধিক বিলম্ব করিতে হইত । ইহা তাঁহার কোন কোন পত্নীর পক্ষে কষ্টকর হয় । তাঁহার
সহধর্মিণী আয়শা ও হফসা পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, হজরত যখন জয়নবের গৃহে মধুর
শরবত পান করিয়া আমাদের কাহার নিকটে আগমন
করিবেন তখন বলিব যে, তোমার মুখ হইতে মগফুরের গন্ধ নির্গত হইতেছে । মগফুর অরকত নামক
বৃক্ষ বিশেষের নির্যাস, তাহা অতিশয় দুর্গন্ধ । হজরত সুগন্ধ ভালবাসিতেন, দুর্গন্ধকে
অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন । একদিন তিনি মধু পান করিয়া তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকটে
উপস্থিত হন। প্রত্যেকেই বলেন, “হজরত, আপনার মুখ দিয়া মগফুরের গন্ধ
আসিতেছে ।” তিনি উত্তর করেন, “আমি মগফুর খাই নাই, জয়নবের
আলয়ে মধুর শরবত পান করিয়াছি” । তাঁহারা বলিলেন, “হয় তো মধুমক্ষিকা অরকত কুসুম হইতে
মধু সংগ্রহ করিয়াছিল” । ইহা পুনঃ পুনঃ বলা হইলে হজরত কহিলেন, “ঈশ্বরের শাপথ, আর কখনও উহা পান করিব না” । তাহাতে এই আয়াত অবতীর্ণ হয় ।” মুহাম্মদের
‘মধু পান না করার’ শপথটির নেপথ্যে যে ঘটনাটির কথা বলা হয়েছে
তার সত্যতা মোটেই সংশয়াতীত নয় । এটা
বানানো গল্প বলেই মনে হয় । কেননা, মুহাম্মদের পত্নীগণ মুহাম্মদের মুখে মগফুরের
দুর্গন্ধ পেলেন, অথচ জয়নব যখন মধুর শরবত প্রস্তত করেন তখন তিনি সে সেই দুর্গন্ধ
পেলেন না, এবং মুহাম্মদও
সেই সরবত পান করার সময় সেই দুর্গন্ধ
পেলেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন । এ ছাড়া আর একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয় । এই
অবিশ্বাস্য ঘটনাটিকে সত্যি বলে যদি স্বীকার করতে হয়, তবে এটাও স্বীকার করতে হয় যে, মুহাম্মদের স্ত্রীগণ ছিলেন অসৎ, মিথ্যেবাদী ও প্রতারক, এবং তাঁরা
সকলে মিলে ষড়যন্ত্র করে মুহাম্মদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন । মুহাম্মদ স্বয়ং যাঁদের
‘উম্মুল মুমেনিন’ উপাধি দিয়ে নারী জাতির
সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছিলেন তাঁরা কি
তাঁর (মুহাম্মদের) সঙ্গে এতো বড়ো একটা হীন প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে পারেন ? এটা
বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন । মুহাম্মদ মধু খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন এ কথাটা
অবিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ার আরও একটি কারণ আছে । অসামাজিক ও অন্যায় কাজ কিংবা অপরাধমূলক কাজ
মানুষ গোপন করে । মধু খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার
অঙ্গীকার করা তো কোনো খারাপ কাজ নয় ।
তাহলে এই অঙ্গীকারটি গোপন রাখতে হবে কেনো ? সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয় যে, মধু খাওয়াকে অবৈধ করার অঙ্গীকার নয়, মুহাম্মদ অন্য কিছু অবৈধ করার অঙ্গীকার করেছিলেন । আর সেটা হলো মারিয়াকে তাঁর নিজের জন্যে অবৈধ করার অঙ্গীকার । কেনো এবং কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুহাম্মদ হাফসার নিকট
মারিয়াকে বর্জন করা বা অবৈধ করার অঙ্গীকার করেছিলেন ? এই ঘটনাটি বিস্তারিত আলোচনা করেছি এই অধ্যায়েই ‘হাফসাকে
তালাক’ প্রসঙ্গে লেখায় । এখানে তাই এ বিষয়টি শুধু ছুঁয়ে যেতে চাই । মারিয়া ছিলেন মিশরের
সম্রাটের একজন দাসি । তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সুন্দরী
বালিকা । সম্রাট
তাঁকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মদকে । মুহাম্মদ তাঁর রূপলাবণ্য দেখে
মুগ্ধ হয়ে তাঁর নিজের দাসী করে রাখেন এবং পরে তাঁর স্ত্রী হাফসার সেবায় নিযুক্ত
করেন । অবশ্য এই বিষয়ে অন্য মত হলো মুহাম্মদ তাঁকে উপপত্নী করে তাঁর হেফাজতে রেখে দেন । মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে পালা করে থাকতেন । প্রত্যেক স্ত্রীর জন্যে তিনি
আলাদা আলাদা ঘর তৈরী করে দিয়েছিলেন । হাফসার পালার দিনে একদিন সন্ধ্যা নাগাদ তিনি হাফসার
ঘরে যান । গিয়ে দেখেন ঘরে হাফসা নেই, তিনি তাঁর পিতৃগৃহে বিশেষ কাজে গেছেন । হাফসার
অনুপস্থিতিতে তাঁর ঘরে তিনি মারিয়াকে ডেকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে যান
। ইত্যবসরে হাফসা তাঁর ঘরে ফিরে আসেন ।
তখনও মুহাম্মদ ও মারিয়া রতিক্রিয়ায় মগ্ন
ছিলেন । সে সময়েই হাফসা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং তাঁদের দেখে ফেলেন । নিজের ঘরে
নিজের বিছানায় নিজের পালার দিনেই মুহাম্মদ ও মারিয়াকে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে তীব্র ভর্ৎসনা করতে শুরু করেন । মুহাম্মদ তখন তাঁর ভুল হয়েছে বলে হাফসার কাছে ক্ষমা মার্জনা
করেন এবং জীবনে আর কোনদিন মারিয়াকে স্পর্শ
না করার অঙ্গীকার করেন । হাফসার তখন ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং শান্ত হয় । মুহাম্মদ তখন হাফসার নিকট থেকে
প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন যে সে এই ঘটনাটি গোপন রাখবে এবং কারো কাছে কোনদিন ব্যক্ত
করবে না । ৬৬/৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে মুহাম্মদ তাঁর একজন স্ত্রীকে একটা কথা গোপনে
বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই স্ত্রী কথাটা অন্য স্ত্রীকে বলে দিয়েছিলেন । সেই গোপন কথাটা
হলো মারিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করতে গিয়ে
ধরা পড়ে যাওয়া এবং তারই শাস্তি স্বরূপ হাফসার নিকট মারিয়াকে আর কোনদিন স্পর্শ না
করার অঙ্গিকার করার কথা । মুহাম্মদের এই কুৎসিত মারিয়াকাণ্ডটি গোপন
করার জন্যে জয়নবের ঘরে মধুর শরবত খাওয়ার গল্পটি বানানো হয়েছে । তবে কোরানের
তফসিরকাররা মারিয়াকাণ্ডটি সম্পূর্ণ
নস্যাতও করেন নি । আগেই বলেছি যে, তাঁরা দুটো ঘটনাকেই তফসিরে উল্লেখ করেছেন
এবং এটাও স্বীকার করেছেন যে মারিয়াকাণ্ডটাই অধিক প্রসিদ্ধ । গিরিশচন্দ্র তাঁর গ্রন্থে উক্ত তফসিরেই দ্বিতীয়
অংশে এ কথাটা লিখেছেন । তিনি লিখেছেন, “পরন্তু এরূপ
প্রসিধ যে, হজরত হফসার বারের দিন তাঁর গৃহে যাইতেন, একদা তিনি হজরতের আজ্ঞাক্রমে
পিত্রালয়ে গিয়েছিলেন, হজরত কেবত কুলোদ্ভবা দাসীপত্নী মারিয়াকে ডাকাইয়া নিজ সেবায়
নিযুক্ত করেন । হফসা তাহা অবগত হইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন । হজরত বলেন, ‘হে হফসা, যদি আমি তাহাকে নিজেকে তাহার সম্বন্ধে অবৈধ করি
তাহাতে তুমি কি সম্মত নও ?’ । তিনি বলিলেন, ‘হ্যাঁ,
সম্মত’ । হজরত কহিলেন, ‘এ কথা কাহারও নিকট ব্যক্ত করিবে না,
তোমার নিকটে গুপ্ত রহিল’ । হফসা সম্মত হইলেন । কিন্তু হজরত যখন তাঁহার গৃহ হইতে চলিয় গেলেন, তৎক্ষনাৎ হফসা আয়শাকে যাইয়া এই সুসংবাদ দান করিয়া বলিলেন, ‘আমরা
কেবতনারীর [মারিয়া] হস্ত হইতে মুক্তি পাইয়াছি’। পরে হজরত আয়শার গৃহে আগমন করিলে তখন আয়শা ইঙ্গিতে এই বৃত্তান্ত বলেন । এতদুপলক্ষে
এই সূরা অবতীর্ণ হয় । অর্থাৎ মারিয়াকে পরমেশ্বর তোমার প্রতি বৈধ করিয়াছেন, তাহাকে
কেন আপনার সম্বন্ধে অবৈধ করিয়া তুলিলে ও শপথ করিলে ?” শুধু গিরিশচন্দ্রের তফসিরেই নয়, এই ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে
প্রখ্যাত তফসিরকার ইবন কাথিরের তফসিরেও । [দ্রঃ-ইবনে
কাথিরের
তফসীর,
১৭শ’
খন্ড,
পৃ
– ৫৫৮] ইবনে
কাথিরের তফসিরটি উদ্ধৃত করেছি ‘হাফসাকে তালাক’ প্রসঙ্গে আলোচনায় বিধায় এখানে
উদ্ধৃত করলাম না ।
৬৫/১ নং ওহিটি যে আশায় মুহাম্মদ শুনিয়েছিলেন তাঁর
স্ত্রীদের সে আশা তাঁর পূর্ণ হয় নি । বরং তাঁর স্ত্রীরা সেটা শুনে মুহাম্মদের প্রতি আরো বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ
হয়েছিলেন । তাঁরা মুহাম্মদকে দৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, মারিয়ার সঙ্গে মেলামেশা না করার অঙ্গীকার আপনি
ভঙ্গ করতে পারেন না । যদি
ভঙ্গ করেন তবে ওকে নিয়েই থাকবেন, আমাদের কাছে আসবেন না । মুহাম্মদের স্ত্রীরা মুখের উপর এভাবে আল্লাহর
ওহিকে অমান্য করবেন তাঁ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিলো । কিন্তু স্ত্রীদের কাছে তো হার স্বীকার করা যায়
না । তাই তিনি মারিয়ার প্রশ্নে আরো মরিয়া
হয়ে উঠলেন । বললেন, ঠিক আছে, আমি তোমাদেরকে এক মাসের জন্যে ত্যাগ করলাম, এই একমাস
মারিয়ার সঙ্গেই কাটাবো । তারপর ঊনত্রিশ
দিন মারিয়ার সঙ্গে কাটিয়ে যখন মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের নিকট ফিরে আসেন, তখন আয়েশা
মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি যে একমাস
আমাদের ছেড়ে থাকার সঙ্কল্প করেছিলেন ? মুহাম্মদ তার উত্তরে বলেছিলেন বলেছিলেন,
ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয় । মুহাম্মদ যে
ঊন্ত্রিশ দিন স্ত্রীদের থেকে দূরে ছিলেন
সে কথার উল্লেখ রয়েছে গিরিশচন্দ্র ৩৩/২৮ নং আয়াতের তফসিরে । কিন্তু উক্ত তফসিরে বলা হয়েছে যে মুহাম্মদ এই
দীর্ঘ সময়টা মসজিদে কাটিয়েছিলেন । মুহাম্মদ তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরে পেয়ায় দু’ডজন বিয়ে করেছিলেন । এটা প্রমাণ করে যে
তাঁর কীরূপ যৌন কামনা ছিলো । মুহাম্মদের এই অস্বাভাবিক যৌন কামনার কথা ইসলামি
পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছেন, এবং এর স্বীকোরক্তি রয়েছে হাদিসেও । ইবন
ওয়ারাক এ প্রসঙ্গে লিখছেন, “The Prophet enjoyed the embraces of nine wives
and, according to al-Ghazali, Muhammad was able to perform his conjugal duties
to all his nine wives in one morning.”
(Vide: Why I am not a Muslim, page – 303)
মুহাম্মদ এক রাত্রে পরপর ন’জন স্ত্রীর সঙ্গে
সহবাস করতেন সে কথা হাদিস থেকেও জানা যায় । হাদিসটি হলো – “হযরত কাতাদা (রাঃ)
কত্তৃক বর্ণিত, আনাস ইবন মালেক (রাঃ) তাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, নবী করিম
সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই রাতে তার সকল স্ত্রীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতেন
এবং এ সময় তার ন’জন স্ত্রী ছিল । (বোখারী শরীফ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক
ব্রাদার্স, হাঃ নং ২১৬৭) অন্য নারিদের
দেখলেও মুহাম্মদের যৌন কামনা জেগে উঠতো এবং তা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না,
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের কাছে ছুটে যেতেন । মুহাম্মদ এ কথা নিজেই তাঁর
সাহাবীদের অকপটে ব্যক্ত করেছেন । সে হাদিসটি হলো - “আমর ইবনে আলী (রাঃ) রেওয়াত করেছেন, জাবের (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূলে পাক
(সাঃ) কোন মহিলাকে দেখলেন । তখন তাঁর স্ত্রী যয়নব (রাঃ) – এর নিকট চলে এলেন । তিনি তখন তার একটা চামড়া পাকা করার কাজে লিপ্ত
ছিলেন । রাসূলে পাক (সাঃ) নিজের প্রয়োজন
পূরণ করতঃ ছাহাবীদের নিকট এলেন এবং বললেন, ... তোমাদের কেহ কোন স্ত্রীলোককে দেখতে
পেলে সে যেন তার স্ত্রীর নিকট চলে আসে । কেননা এ তার মনের ভিতর যা রয়েছে তা
নিবৃত্ত করে ।” (মুসলিম হাদিস, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং ৩২৭৫) এ হেন মুহাম্মদ নারী সঙ্গ ব্যতীত এক মাস একাকী
মসজিদে কাটিয়েছিলেন এ কথা অবিশ্বাসযোগ্য । সুতরাং এটা প্রতীয়পমান হয় যে, মুহাম্মদ
তাঁর স্ত্রীদের ছেড়ে ঊনত্রিশ দিন মারিয়ার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন । টানা ঊনত্রিশ দিন
মারিয়ার সঙ্গে অতিবাহিত করার পর মুহাম্মদ আশা করেছিলেন যে তাঁর স্ত্রীদের
অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে, তাঁরা ভয়ে নিরীহ
হয়ে অতিশয় নরম আচরণ করবে এবং তাঁর রাগ মানাতে তাঁকে যার পর নাই আদর-সোহাগ করবে ।
কিন্তু মুহাম্মদের আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছিলো । তাঁর স্ত্রীগণ আগের অবস্থানেই অনড়
ছিলেন এবং মারিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে এক শয্যায় শোবেন
না বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন । স্ত্রীগণ
এরূপ বলিষ্ঠ প্রতিবাদ
ও আচরণের মাধ্যমে তাঁকে এভাবে
অপমান করবেন তা তাঁর কাছে ছিলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত । তিনি তখন
তাঁর স্ত্রীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্যে আল্লাহর কাছ থেকে ৬৬/৫ নং
আয়াতটি বা ওহিটি নিয়ে আসেন যেখানে বলা আছে যে, আত্মসমর্পণ করো, না হলে তোমাদের
তালাক দেবো । তোমাদের তালাক দিলে আল্লাহ আমার জন্যে তোমাদের চেয়েও সুন্দরী ও
উৎকৃষ্ট কুমারী বা যুবতী বিধবা স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দেবে আমার কাছে অনুগত ও আত্মসমর্পোণকারী । এই ওহি বা এ কথা শোনার পর তাঁর
স্ত্রীরা পিছিয়ে গিয়েছিলেন এবং পাছে সত্যি সত্যিই তালাক দিয়ে দেন এ ভয়ে তাঁরা মুহাম্মদের কাছে মাথা
নত করেন ।
মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনে কলহ ও অশান্তির জন্যে
তাঁর স্ত্রীদের দোষ দেওয়া যায় না । এর জন্যে দায়ী মুহাম্মদ স্বয়ং । অথচ সেই কলহ ও
অশান্তি দমনে যখন কোনো ভাবেই সফলতা পান নি, তখন তিনি তালাককে অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করেছেন । তাঁর স্ত্রীরা বিশ্বাস করতেন যে তাঁরা যদি তাঁর (মুহাম্মদের)
স্ত্রী হিসেবে মৃত্যুলাভ করেন তা হলে তাঁরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচবেন এবং
বেহেস্তে লাভ করবেন । তাই তাঁরা
মুহাম্মদের কাছে নয়, তালাকের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন । যখন মুখে তালাকের ভয় দেখিয়ে
কাজ হয় নি, তখন সত্যি সত্যিই তালাক দিয়েছেন যদিও পরে তা ফিরিয়ে নিয়েছেন । এ রকম
ঘটনা ঘটেছে সওদা ও হাফসার বেলায় । সেই ঘটনাটির লিংক উপরে দেওয়া হয়েছে ।