মসজিদে নববী, ২০১২ সালের ছবি
মুহাম্মদ নিজেই বলেছিলেন তিনিই আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী, আল্লাহ পৃথিবীতে আর কখনও কোনো নবী পাঠাবে না। অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীকেই কিনা মৃত্যুর আগে পনেরো দিন ধরে ভোগ করতে হয়েছিলো সীমাহীন যন্ত্রণা ও কষ্ট যা অন্য কোনো নবীকে ভোগ করতে হয় নি! আল্লাহর শেষ নবীরে মৃত্যু কীভাবে হয়েছিলো তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। শুধু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোনো যুদ্ধে কিংবা গুপ্তঘাতকের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় নি। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু ছিলো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। সুতরাং এটাও সন্দেহাতীত যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো হয় কোনো অসুখে কিংবা অন্য কোনো কারণে। এ বিষয়ে তিনটি মত শোনা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে থেকে। একটি মত হলো বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় মতটি হলো সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। এবং তৃতীয় মতটি হলো ম্যানেনজাইটিস রোগে তিনি মারা যান।
নবীর অশেষ মৃত্যুযন্ত্রণা
প্রথম অভিমতঃ বিষক্রিয়ায়
মৃত্যুর প্রসঙ্গে -
বিষক্রিয়ায় মৃত্যু নিয়ে দু’টি ঘটনার কথা শোনা যায়। প্রথম ঘটনাটি হলো এ রকম – ৬২৮ খৃস্টাব্দে মৃত্যুর চার বছর আগে খায়বার যুদ্ধ শেষে মদিনায় ফিরে আসার আগে সেখানকার একজন সম্ভ্রান্ত ইহুদী নারী, সাললাম বিন মিশকান এর স্ত্রী যয়নাব বিনতে আল-হারিথ, তাঁর বাড়িতে নবীকে খাবার দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) দেন। সেই দাওয়াত তিনি কবুল (স্বীকার) করেন এবং তাঁর বাড়ি যান। তাঁর সঙ্গে ছিলো বিশর বিন আল-বারা নামের জনৈক একজন সাহাবী। সেই নারী তাঁদের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেন। মুহাম্মদ এক গ্রাস খাবার মুখে দিয়েই বুঝতে পারেন যে খাবার বিষ মিশানো আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মুখের খাবারটুকু ফেলে দেন এবং বিশর বিন আল-বারাকে বলেন, থাম, খাওয়া থামাও, খাবারে বিষ আছে। কিন্তু বিশর তৎক্ষণে এক গ্রাস খাবার খেয়ে ফেলেছে। ফলে বিশর তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মুহাম্মদের শরীরেও ততক্ষণে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু খাদ্যটুকু গলাধঃকরণ করেন নি তাই সে যাত্রা তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। মুসলিম ঐতিহাসিকরা অনেকেই বিশ্বাস করে সেই বিষক্রিয়ার জেরেই চার বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ড. ওসমান গণী লিখেছেন,
· “খায়বারে তাঁকে এক ইহুদিনী নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সময় খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেন। খাদ্যবস্তু মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা বুঝে ফেলে দিয়েছিলেন তবুও সামান্য জের তাঁর শরীরে থেকে গিয়েছিল। প্রথমে জ্বর ও মাথাব্যথা আরম্ভ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাজ ঠিক নিয়মমাফিক করে যেতে থাকেন। তিনি আজ নিজেও অনুমান করে নিয়েছেন – তাঁর শেষ সময় আগত-প্রায়।” (মহানবী, পৃঃ-৩৮০)
যদি
ধরে নেওয়া যায় খায়বারে নবীর খাবারে বিষ মেশানোর ঘটনাটা সত্যি তবে, এটাও
সত্যি যে তাঁর শরীরে যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো তা ছিলো অতিশয় নগণ্য। কারণ, সেই বিষক্রিয়ায় তখন
তাঁর মৃত্যু হয় নি। সেই ঘটনাটি ঘটেছিলো ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় ৬৩২
খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ খায়বারে বিষযুক্ত খাবার মুখে দেওয়া এবং মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান
ছিলো চার বছর। বিজ্ঞানের আলোকে মুহাম্মদের মৃত্যুর কারণ বিচার করলে এটা কখনই যুক্তিগ্রাহ্য
ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না যে খায়বারে মুহাম্মদের শরীরে অতিশয় নগণ্য যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো
তাতেই নবীর মৃত্যু হয়েছিলো।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, নবী যখন মৃত্যুর আগে কয়েকদিনের জ্বরে অসুস্থ হয়ে তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য কষ্ট পাচ্ছেন তখন তাঁর স্ত্রী মাইমুনা তাঁকে জ্বর ও মাথা যন্ত্রণার উপশম করার জন্যে একটি ওষুধ তৈরি করে খাওয়ান। ওষুধ তৈরি করা সময় তিনি তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ খেয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই অভিমতটিকে মনগড়া বলে নস্যাৎ করে দেন। তবে ইতিহাসকাররা স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মদের জন্যে মাইমুনার নিজের হাতে ওষুধ তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং সেই ওষুধ মুহাম্মদকে খাওয়ানোও হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসে যে ঘটনার কথা শোনা যায় তা নিম্নরূপঃ
· প্রবল জ্বরে ও অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় মুহাম্মদ খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মাঝে মাঝেই তিনি মাগো বাবাগো, আর সহ্য হচ্ছে না বলে চিৎকার করতেন। মাঝে মাঝেই আবার কখনও মোটা সুতা দিয়ে কখনো কাপড় দিয়ে মাথা কষে বাঁধতেন। মাঝে মাঝেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন, আবার কিছুক্ষণ পরই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসতো। জ্ঞান ফিরলে আবার তীব্র মাথা যন্ত্রণায় চিৎকার ও ছটফট করতেন। মৃত্যুর সময় এ রকম অসহ্য তীব্র কষ্টের মধ্যে তাঁর পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছিলো। সে সময় সাহাবীরা সব সময়েই কেউ না কেউ তাঁর পাশে থাকতেন। একদিন আয়েশার ঘরে (সেখানেই মুহাম্মদের শেষ পনেরো দিন্ অতিবাহিত হয়েছিলো) তাঁর স্ত্রীরা সবাই উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন সাহাবীও যাদের মধ্যে তাঁর চাচা আব্বাস বিন মোত্তালেবও ছিলেন। মুহাম্মদের স্ত্রী মাইমুনা তখন মুহাম্মদের অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বলেন যে তিনি একটি ওষুধ তৈরি করতে জানেন যেটা খাওয়ালে জ্বর ও মাথাব্যথা সেরে যাবে। মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে এটা নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছিল সেটা আব্বাস শুনতে পান। তিনি মাইমুনাকে বলেন ওষুধটা তৈরি করতে। মাইমুনা তখন বলেন যে ওষুধটা খুবই তেতো তাই তিনি খেতে চান না। আব্বাস বলেন তুমি তৈরি করো আমি খাইয়ে দেবো। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করে আব্বাসের হাতে তুলে দেন। সে সময় নবীর জ্ঞান ছিলো না। আব্বাস সহজেই ওষুধটা নবীর মুখে ঢেলে দেন। নবীর জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন যে তাঁকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। তখন ভীষণ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে জানতে চান কে তাঁকে ওষুধ খাইয়েছে। আব্বাস তৎক্ষণাৎ তার দায় নেন। তাতেও তিনি শান্ত হন না। ঐ ওষুধটা আবার তৈরি করে তাঁর স্ত্রীদের তাঁর সামনেই পান করার নির্দেশ দেন। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করেন এবং নবীর স্ত্রীরা নবীর সামনে সেটা পান করেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পর সকল স্ত্রীরাই সুস্থ ছিলেন। মুহাম্মদ বুঝতে পারেন যে তাঁর ওষুধে বিষ মেশানো হয়েছিলো বলে তাঁর যে সন্দেহ হয়েছিলো সেটা অমূলক।
দ্বিতীয় অভিমতঃ সিফিলিস অসুখে মৃত্যু প্রসঙ্গে -
যারা বলে সিফিলিস রোগে নবীর মৃত্যু হয় তাদের যুক্তি হলো এ রকম। এটি ছোঁয়াচে রোগ এবং মূলত যৌন রোগ যেটা মানুষের দেহে বাসা বাঁধে প্রধানত যৌন সংসর্গের কারণে। সিফিলিস রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মুখের ভিতর জিহ্বা সঞ্চালনের মাধ্যমে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলেও রোগটা ছড়িয়ে থাকে। সমকামীদের মধ্যেও তাই রোগটি ছড়াতে পারে। ফলে নারী ও পুরুষ উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
যারা বলেন যে নবী সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বক্তব্য হলো এরূপঃ নবী বহুগামী ছিলেন এবং বিবাহ বহির্ভূত বহু নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতেন। আরবে সেই সময় যতখুশী উপপত্নী ও দাসী রাখা এবং তাদের সঙ্গে অবাধে সঙ্গম করা ছিলো প্রচলিত বৈধ রীতি। নবী নিজেকে আল্লাহর রসুল বলে দাবি করলেও সেই কুৎসিত সংস্কৃতি ও প্রথা বাতিল করেন নি। বরং সেই সেগুলিকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বহাল রেখে তার ভিতকে আরও দৃঢ় করেছিলেন। তাই তাঁর শরীরে সিফিলিস রোগের বাসা বাঁধার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিলো। তখন আরবে সিফিলিস ছিলো একটি দূরারোগ্য ব্যাধি এবং তাই অবশেষে ঐ রোগেই তাঁর জীবনাসান ঘটে। কিন্তু সিফিলিস রোগ হলে শরীরে তার নানা উপসর্গ প্রকাশ পায় যা নবীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি। সিফিলিসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়, শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রতঙ্গ অবশ বা অসাড় হতে থাকে। ফলে একটা সময় সিফিলিস রোগীর কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু নবীর মধ্যে এগুলোর কোনোটারই প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্তও তিনি শারিরীকভাবে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং সিফিলিসে নবীর মৃত্যু হওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
তৃতীয় অভিমতঃ ম্যানেনজাইটিসে মৃত্যু প্রসঙ্গে -
ম্যানেনজাইটিস রোগে নবী মারা যান বলে একদল ঐতিহাসিকের অভিমত। মানব শরীরের নানা অঙ্গে ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়। ইনফেকশন হয় যেমন লিভার, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি শরীরে, তেমনি হয় মস্তিষ্কেও। মস্তিষ্কে ইনফেকশন হলে যে রোগটা হয় সেটা ম্যানেনজাইটিস রোগ যেটা একটা অন্যতম মারণ রোগ। মুহাম্মদের সময়ে আরবে এই রোগের ওষুধ ছিলো না। মৃত্যুর আগে ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গগুলি মুহাম্মদের শরীরে ফুটে উঠেছিল। যেমন তাঁর প্রবল জ্বর হয়েছিলো এবং তার সঙ্গে ছিলো সহ্য মাথা যন্ত্রণা। প্রবল জ্বর ও মাথা যন্ত্রণা হেতু মাঝে মাঝেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছিলেন এবং জ্ঞান ফিরে আসছিলো। তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, মাগো বাবাগো বলে চিৎকার করছিলেন মাঝে মধ্যে, কখনও মাথায় কষে কাপড়ের ফেটি বাঁধছিলেন। মাঝে মধ্যে প্রলাপও বকছিলেন। এগুলো ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গ। আরবে এই রোগটার মাঝে মধ্যেই প্রদুর্ভাবও হয়। আরবে এই রোগের মহামারীও হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সুতরাং ম্যানেনজাইটিস রোগেই মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে বলে যে কথাটি শোনা যায় সেটাই বিজ্ঞান সম্মত ও সঠিক বলে মনে হয়।
নবীর মৃতদেহের অশেষ লাঞ্ছণা ও দুর্ভোগ
শুধু অশেষ শারিরীক মৃত্যুযন্ত্রণাই নয় নবীকে ভোগ করতে হয়েছে তাঁর মৃত্যুশয্যায় অশেষ মানসিক যন্ত্রণাও। নবী যখন বুঝেছিলেন যে মৃত্যু তাঁর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে যাবে তখন তাঁর সাহাবীদের কিছু অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন বা কিছু নির্দেশ দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্যে তাঁর সাহাবিদের কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে এসে বসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর সাহাবিরা তাঁর নির্দেশ অমান্য বা অগ্রাহ্য করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছিলো। তিনি যখন কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে কোনো একজনকে বসার নির্দেশ দেন তখন তাঁর আজ্ঞা পালনের ব্যাপারে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। উপস্থিত সাহাবিদের মধ্যে একদল দ্রুত সেই নির্দেশ পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল আপত্তি করে অন্য একটা দল। দ্বিতীয় পক্ষের নেতা ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে নবী প্রলাপ বকছেন মাঝে মধ্যে, এ রকম পরিস্থিতিতে যা বলবেন তা তাঁর হয়তো মস্তিষ্ক-প্রসূত ও যথেষ্ট বিবেচনা-প্রসূত হবে না। তেমন কোনো অছিয়ত দিয়ে যদি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তবে ইসলাম ও সমগ্র মানবমণ্ডলী দিকভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হবে। আপাতদৃষ্টিতে ওমরের কথাগুলি উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু নবী তখন সজ্ঞানেই ছিলেন এবং প্রলাপ বকছিলেন না। ফলে ওমরের কথার প্রতিবাদ করে প্রথম দল। কিন্তু দুই দলের মধ্যে প্রবল বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায় নবীর সামনেই। নবী তা দেখে যারপরনাই বিরক্তি ও ক্রোধে ফেটে পড়ে সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। নবী যে তখন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন না এবং সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ছিলেন সেটা ওমর বোঝেন নি তা নয়। নবীর তবুও সর্বশেষ অছিয়ত দেওয়া আটকে দেন সচেতনভাবেই যার পশ্চাতে গভীর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নিহিত ছিলো যা স্পষ্ট হয়ে যায় নবীর মৃত্যুর পরের ঘটনাবলীতে।
You Tube
অবশেষে
দিন পনেরো পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুন
সোমবার নবীর অশেষ মৃত্যু যন্ত্রণার অবসান
হয়। সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবিদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের ন্যক্কারজনক রাজনীতি শুরু হয়। এটা নিয়ে
বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। নবীর চাচা ও চাচাতো ভাই তথা জামাতা আলি ও কতিপয়
সাহাবি নবীর শবদেহ আগলে বসে থাকেন একদিকে, অপরদিকে ক্ষমতা দখলের কুৎসিত খেলায় মত্ত
হয়ে ওঠে অন্যান্য সাহাবিরা। নবীর শবদেহ ফেলে রেখে এই কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছিলেন নবীর যে
প্রিয় সাহাবিরা তাদের মধ্যে ছিলেন আবুবকর ও ওমর এবং অপর পক্ষে ছিলেন মদিনার সেই সাহাবিরা
যাঁরা মুহাম্মদকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে নবী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। দুই পক্ষই
বাকবিতণ্ডা ও বচসায় জড়িয়ে পড়েছিলো নবীর উত্তরাধিকারি তথা প্রথম খলিফা হওয়ার জন্যে।
তিন দিন ধরে সাহাবিদের মধ্যে সেই ঝগড়া অব্যাহত চলার পর অবশেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। তারপর নবীকে
সমাধিস্থ করা হয়। সাহাবিদের ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীর মৃতদেহের জানাযা নামাজ পর্যন্ত। ফলে
নবীকে কবরস্থ করা হয় জানাযা নামায ব্যতিরকেই। ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীকে কবর কোথায় হবে তা
নিয়েও। খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো নবীকে সমাধিস্থ করার আগে তাঁর শবদেহে পচন শুরু হয়ে গিয়েছিলো
এবং দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।নবীর মৃতদেহের এহেন অপমান ও লাঞ্ছনা বোধ হয় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন।
উপসংহার
উপসংহারে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, প্রধ্ন ও মন্তব্য এই তিনটি জিনিষ। পর্যবেক্ষণ মূলত ওমর ও আবুবকরের ভূমিকা নিয়ে। আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে তিন দিন ধরে তীব্র কলহ, বাক-বিতণ্ডা ও বচসার শেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আবুবকরের নাম প্রথম খলিফা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন ওমর। আবার আবুবকর খলিফার ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করে ওমরকে দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত করে যান। এই ঘটনার সঙ্গে পরবর্তীকালের দুটি ঘটনার যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনা দুটি হলো - এক) মৃত্যুর আগে নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে যে অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন সেটা ওমরের ভেস্তে দেওয়া। দুই) নবীর মৃতদেহের সৎকার না করেই খলিফা পদটি কব্জা করার জন্যে দৃষ্টিকটূভাবে আবুবকর ও ওমরের অন্যান্য সাহাবিদের সঙ্গে তীব্র কলহে লিপ্ত হয়ে পড়া। প্রথম ঘটনটি প্রমাণ করে যে প্রথম খলিফা হবার জন্যে আবুবকরের তীব্র লালসা ছিলো। আবুবকরের হাত ধরে দ্বিতীয় খলিফা হয়েছিলেন ওমর। দ্বিতীয় এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে খলিফা হবার জন্যে ওমরেরও তীব্র লালসা ছিলো। ওমরের ধারণা ছিলো যে নবী মৃত্যুকালীন অছিয়তে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে নবী যদি তাঁর বংশধর বলে আলিকে উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতেন যার সম্ভাবনা ছিলো প্রবল তবে, আবুবকর ও ওমর দুজনের কারোরই খলিফা হওয়ার লালসা ও সাধ জীবনে পূর্ণ হতো না। কারণ, আলি তাঁদের দুজনের থেকেই ছিলেন অনেক ছোট। তাই তাঁদের নিজেদের খলিফা হওয়ার পথ খোলা রাখার জন্যে নবীর অছিয়ত দেওয়া বাঞ্চাল করে দেওয়াটা তাঁদের কাছে একান্তই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। সেজন্যেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাফিকই অজুহাত খাড়া করে নবীর অছিয়ত দেওয়াটা আটকে দিয়েছিলেন ওমর এবং নীরব থেকে তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন আবুবকর। একই উদ্দেশ্যে নবীর মৃতদেহ সৎকার করার আগেই তাঁরা দু’জন প্রথম খলিফা ঠিক করার জন্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। আগে নবীর মৃতদেহ সৎকার করে পরে যদি আলোচনার মাধ্যমে নবীর উত্তরাধিকার ও প্রথম খলিফা নির্বাচন করা হতো তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের খলিফা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো খুবই ক্ষীণ। সেজন্যেই আবুবকর ও ওমর নবীর মৃতদেহ আয়েশার ঘরে ফেলে রেখেই তড়ি-ঘড়ি প্রথম খলিফা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
মুহাম্মদ নিজেই জানিয়েছেন যে আল্লাহ অগুণতি নবী পাঠিয়েছে যাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শেষ নবী। তিনি আরও জানিয়ে গেছেন যে তিনিই ছিলেন আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং আল্লাহও তাঁর প্রতি ছিলো অতিশয় সহানুভূতিশীল, দয়ালু ও স্নেহশীল। তাঁর এ সব দাবিগুলি আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না। কারণ, কোরানে এরূপ বহু ঘটনা দেখতে পাওয়য়া যায় যে নবী যখন যা চেয়েছেন বা কামনা করেছেন আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তা পূরণ করে দিয়েছে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। নবী তাঁর পালক পুত্র জায়েদের স্ত্রী অসামান্য সুন্দরী জয়নবকে কামনা করেছিলেন। আল্লাহ সেটা বুঝতে পেরে জয়নবের সঙ্গে তাঁর (নবীর) বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন বেহেশতে। নবী আবুবকরের ছ’বছরের শিশু কন্যা আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আবুবকর তাতে সঙ্গত কারণেই রাজী হন নি। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহুই উদ্যোগী হয়ে আয়েশার সঙ্গে নবীর বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কোরানে এ রকম আরও বহু উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যা বিশ্বাসীদেরকেও যুগপৎ বিষ্মিত করে ও ভাবিয়ে তোলে। তারা মন থেকে মেনে নিতে পারে না তাদের নবীর এই হীন কাজগুলি। এবং তাদের বিশ্বাস হয় না যে নবীর এহেন অন্যায় কামনাগুলি আল্লাহর ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়েছে। তাদের এই অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় নবীর মৃত্যুশয্যায় অসহ্য যন্ত্রণা ও কষ্টের কথা জানার পর। তাদের সন্দেহ ও সংশয় তাই দানা বাঁধতে শুরু করে নবীর নবীত্ব নিয়েও। কারণ তারা বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ তার কোনো নবীকে এতো যন্ত্রণাময় মৃত্যু উপহার দিতে পারে যা একটা অত্যন্ত কঠিন শাস্তির সমতুল্য। আর তারা এটাও বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ নীরব থাকতে পারে কোনো নবীর লাশ তিন দিন ধরে অপমানিত ও লাঞ্চিত হচ্ছে দেখেও। তাই তাদের মনে এই ধারণাও প্রবল হয় যে হয় নবী বোধ হয় আল্লাহর দোহাই দিয়ে আবুবকর ও জায়েদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
তথ্য সূত্রঃ ড. ওসমান গণীর মুহাম্মদের জীবনী - মহানবী, মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবের রাজনীতি - ১, আলোচনায় অমিয় হাসান, মুফতি আল-মাসুদ ও রিক্তা, সঞ্চালক - রুমি, ইউ টিউব, নবী জীবনের শেষ দু'সপ্তাহের গল্প, নিসিক্ত, ইউ টিউব