মুসলিম ব্যক্তিগত আইন শরিয়া
আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শরিয়া আইন সম্পর্কে মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুরা যা যা
বলেন তা হলো, এ আইন যেহেতু খোদ আল্লাহ
তা’আলার সৃষ্টি, তাই এর মধ্যে কোনো ভুল নেই, ভুল থাকতে পারে না । তাঁরা আরো বলেন, এত ভালো ও সর্বাঙ্গ সুন্দর আইন তৈরী করা মানুষের
সাধ্যের অতীত। কারণ মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে, মানুষের মনের সংকীর্ণতা আছে,
মানুষের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব আছে এবং
সর্বোপরি মানুষ কখনই ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই মানুষের তৈরী আইনে নানা
ভুল-ত্রুটি থাকে। আর
তাইতো মানুষকে তাদের নিজেদের তৈরী করা আইন বারবার সংশোধন করতে হয়, সংযোজন করতে হয়, কিংবা বাতিল করে আবার নতুন আইন প্রণয়ন
করতে হয়। কিন্তু আল্লাহপাক যেহেতু মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ,
মহান ও উদার, মানুষের প্রতি দয়াবান ও সহানুভূতিশীল, এবং যাবতীয় ভুল-ত্রুটির
ঊর্দ্ধে, তাই আল্লাহর তৈরী করা প্রত্যেকটি আইনই সকল মানুষের স্বার্থবাহী হয় এবং
হয় সর্বাঙ্গ সুন্দর, নিখুঁত, নির্ভু্ল,
ত্রুটিমুক্ত ও চিরন্তন। ফলে আল্লাহর আইন বাতিল করার প্রয়োজন হয়
না, এমনকি সংশোধন ও সংযোজনেরও
প্রয়োজন হয় না। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তিগত আইন চিরন্তন।
পৃথিবীতে অধিকাংশ মুসলিম দেশই
শরিয়ত আইন ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে মুসলিম ধর্মগুরুদের উপরে উল্লেখিত
বাখ্যা ও বিশ্লেষণকে বালখিল্য বা পাগলের প্রলাপ বলে মনে করে। অধিকাংশ দেশই বিশ্বাস করে যে শরিয়া আইন পশ্চাদপদ, অগণতান্ত্রিক ও বর্বর আইন এবং আধুনিক যুগ ও সভ্য সমাজের পক্ষে একেবারেই
বেমানান ও অনুপযুক্ত। তাই শরিয়া ফৌজদারী
আইন তো মুষ্টিমেয় কয়েকটি মুসলিম দেশ ছাড়া বাকি মুসলিম বিশ্বই সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছে, এবং তারই পাশাপাশি মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেও ব্যাপক সংশোধন করেছে। যে দেশগুলি মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংশোধন ও
সংযোজন করেছে সেই দেশগুলির কয়েকটি হলো তিউনিসিয়া, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক,
ইরান, তুরস্ক, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মিশর, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি। এখন
প্রশ্ন হলো, ভারতের মুসলিমরা মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? ভারতে এখনও মুসলিম ব্যক্তিগত
আইন সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতই রয়েছে । তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে ভারতের মুসলিম সমাজ মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে উলামার [মুসলিম
সমাজের ধর্মগুরু সমাজ] বাখ্যা ও বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করে । কিন্তু, না, এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
সমগ্র মুসলিম সমাজ এই আইন সম্পর্কে উলামার
সঙ্গে মোটেই সহমত নয়
এবং চিরন্তন বলে মনে করে না।
ভারতের মুসলিম পুরুষদের মধ্যে এই আইন নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে আশার কথা এই যে,
নারীদের মধ্যে কার্যতঃ কোনো মতভেদ নেই। ভারতীয় মুসলিম নারীরা প্রায় একশ’ শতাংশই এই আইনের বিরোধী। তারা মনে করে যে এই আইনটি নারী-বিরোধী এবং তাদের স্বার্থের পক্ষে খুবই হানিকর। তারা
এই আইনটির সংস্কার বা বিলোপ চায়। চায় একটি
নতুন আইন।
হ্যাঁ, সাম্প্রতিক কালের একটি সমীক্ষা
থেকে এই তথ্যটি উঠে এসেছে। ৯২% নারী বলেছেন যে মুখে মুখে তিন তালাক দেওয়ার যে
আইনটি আছে তা তাঁরা সমর্থন করেন না। ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর মাস
পর্যন্ত ভারতের দশটি রাজ্যে ৪৭১০ জন নারীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাঁদের মধ্যে ৯২.১% নারীই বলেছেন যে তাঁরা মৌখিক তালাক
আইনের অবসান চান। পরিবর্তে এমন একটা আইন চান
যাতে পুরুষরা একতরফা খেয়াল খুশীমতো তালাক
দিতে না পারে। তাঁরা চান সালিশির মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমে
তালাকের বিষয়টা নিষ্পত্তি হোক। সমীক্ষায় তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা ভয়ঙ্কর
অমানবিক তথ্য উঠে এসেছে। তা হলো এখন পুরুষরা তালাক দেওয়াকে আরো সহজ করে তুলেছেন। আগে
কোরানীয় পদ্ধতি মেনে স্বামী
স্ত্রীকে সামনা সামনি তালাক দিত। এখন পুরুষরা তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল, টেক্সট
মেসেজ, হোয়াটস আপ, স্কাইপ, ইমেইল, ইত্যাদি মাধ্যমগুলো ব্যাপক হারে ব্যবহার করছেন। মুসলিম সমাজের একাংশ এভাবে তালাক দেওয়া
ইসলাম-সম্মত নয় বললেও ইসলামি
পণ্ডিতরা তাদের আপত্তিকে গ্রাহ্যের মধ্যে
আনছেন না। এতে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ স্বয়ং মুহাম্মদ এবং তাঁর পর
দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক কোরানের জটিল তালাক আইনটিকে ভীষণ সরল ও সহজ করে দিয়ে গেছেন। কোরানে
তালাক দেওয়ার বিধান হলো, স্বামী যদি মনে করে যে স্ত্রীর
আচরণে দাম্পত্যজীবন দুঃসহ হয়ে ওঠেছে তবে তিনি প্রথমে এক তালাক দিবে্ন । তার একমাস পর পরিস্থিতর উন্নতি না হলে অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট না হলে দ্বিতীয় তালাক দিবেন। তার একমাস পরও স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন তবে তৃতীয় ও চূড়ান্ত তালাক দিবে্ন। কোরানের এই পদ্ধতিকে সংশোধন করে যান স্বয়ং
মুহাম্মদ এবং তাঁর প্রিয় সাহাবি ও দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক। তাঁরা
বলেন যে, স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট স্বামী তার স্ত্রীকে একসঙ্গে
পরপর তিন তালাক দিলেও সে তালাক বৈধ ও কার্যকর হবে। তাই মুহাম্মদের জীবদ্দশাতেই এই তিন তালাক আইন শরিয়তি আইন হিসেবে হিসেবে স্বীকৃত পায়। তবে এর
ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় ওমরের খেলাফত কালে। সুতরাং ইন্টারনেটের যুগে তালাক
দেওয়ার পদ্ধতিটি আরো সহজ করে মোল্লা-মুফতিরা কিছুই ভুল করেন নি, বরং তাঁরা ইসলামের
ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে শরিয়তি তালাক আইন সম্পূর্ণ একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক । এই আইনে স্ত্রীদের তালাক দেওয়ার অধিকার নেই, এমনকি নেই
তালাক প্রতিরোধ করার অধিকারও। ইসলামি পণ্ডিতরা অবশ্য বলেন যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে স্ত্রীদেরও তালাক
দেওয়ার বিধান আছে যেটাকে 'খুলা' তালাক বলে। না, এটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়, আংশিক সত্যি। এবং সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মুসলিম নারীরা খুলা
তালাক দিতে চাইলে নানা অজুহাতে তা কার্যকর
করা সম্ভব হয় না। কীভাবে ও কেনো মুসলিম নারীদের 'খুলা' তালাক দেওয়ার বিধানটি
কার্যকর করা যায় না তার বহু তিক্ত
অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন ‘মুসলিম
নারীরা ভারতী মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ – এর সংগঠক নেতৃবৃন্দ। সে সব কথা
এখানে আলচনা করার অবকাশ নেই, পরে অন্য নিবন্ধে তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
মুসলিম নারীরা শুধু তালাক আইনের বিরুদ্ধেই নয়, তাঁরা বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও। ৯১.৭% নারী জানিয়েছেন যে তাঁরা বহুবিবাহ
আইনের অবসান চান। একজন স্ত্রী জীবিত থাকতে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে তাঁরা চান না
। কলেজ-য়ুনিভার্সিটিতে পড়া, বা কলেজ-য়ুনিভার্সিটি
পাশ করা উচ্চ শিক্ষিত এবং স্বাবলম্বী ও
স্বনির্ভর মুসলিম নারীদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে এমনটা নয়। যে নারীদের
মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছে তাদের ৭৩%ই দরিদ্র পরিবারের সদস্য যাদের বাৎসরিক আয়
৫০,০০০ [পঞ্চাশ হাজার] টাকারও কম। তাঁদের
মধ্যে ৪৭% নারীই একটি বা দুটি সন্তানের মা। ৫৫% নারীরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে। তাঁদের ৮২% নারীই গৃহকর্মী, তাঁরা দিনরাত খাটেন
কিন্তু তাঁদের উপার্জন কিছু নেই,
এবং তাঁদের কারো নামে নিজস্ব কোনো সম্পত্তিও নেই। আর
একটি ভয়ঙ্কর অমানবিক তথ্য উঠে এসেছে সমীক্ষায়,
তা হলো - ৫৩% নারীই পারিবারিক হিংসার [domestic
violence] শিকার
। ভারতের মোট দশটি রাজ্যে এই সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে । রাজ্যগুলি হলো মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক,
তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহার ।
লেখাপড়া না জানা বা কম লেখাপড়া জানা মুসলিম নারীরা তাদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝেছেন যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তাঁদের চরম সর্বনাশ করছে। যদিও তাঁদের কানের কাছে নিরন্তর সেই ভাঙা ক্যাসেট বাজানো হয় যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন স্বয়ং আল্লাহপাকের তৈরী, এই আইন সকলের মঙ্গলের জন্যে তৈরী করেছে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ, এবং এর মধ্যেই নারীর কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তবুও তাঁরা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন যে আইনটি
যেই তৈরী করুক না কেনো, সেটি তাঁদের জীবনে যন্ত্রণা
আর দুঃখ-কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু উপহার দেয় নি । তাই তাঁরা অকপটে আইনটির পরিবর্তন বা সংশোধন চান
। একে তো নারীরা বেশী ধর্মপরায়ণ, তারপর মুসলিম সমাজে নারীদের উপর
শরিয়ত ও পুরুষতন্ত্রের কড়া অনুশাসন এখনও বিশেষ শিথিল হয় নি, তাই মুসলিম নারীরা
ব্যক্তিগত আইনের ফাঁস কেটে বেড়িয়ে আসতে চাইছেন এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। আর ধর্মান্ধ ও গোঁড়া মুসলিমরা তো একেবারেই বিশ্বাস করবেন না । ইসলামকে হেয় করার উদ্দেশ্যে তৈরী করা এটা একটা
ভূয়া প্রতিবেদন বলে তারা উড়িয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু না, কোনো মুসলিম-বিদ্বেষী সংস্থা
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে নি এবং এটা কোনো ভূয়া প্রতিবেদনও নয়। সমীক্ষাটি করেছে মুসলিম নারীদেরই একটি সংগঠন
যার নাম বিএমএমএ
(ভারতীয়
মুসলিম মহিলা আন্দোলন)। সংস্থাটি অনেকদিন ধরেই মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য ও অত্যাচারের অবসানের জন্যে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গেও
এ রকম অন্ততঃ দুটি সংগঠন আছে যারা তালাক আইন ও বহুবিবাহ বাতিলের দাবিতে লড়াই করছে
যাদের নেতৃত্ব করছেন মুসলিম নারীরাই।
সংগঠন দু’টির একটি হলো ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’ এবং অন্যটি হলো ‘ফোরাম ফর
এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইণ্ডিয়া’।
প্রথমটি কাজ করছে মূলতঃ মুসলিম
অধ্যুষিত জেলা মুর্শিদাবাদে এবং দ্বিতীয়টি কাজ করছে রাজ্য জুড়ে। সংগঠন
দুটিও মনে করে যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের জন্যেই মুসলিম নারীদের জীবনে দুর্দ্দশার
অন্ত নেই এবং এর ফলে শুধু মুসলিম নারীরাই নয়, পিছিয়ে পড়ছে সমগ্র মুসলিম সমাজই। ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’ জানিয়েছে যে
শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই লক্ষাধিক তালাকপ্রাপ্তা ও স্বামী পরিত্যক্তা মুসলিম নারী রয়েছে যাদের প্রত্যকের ২/৩ টা করে
নাবালক সন্তান আছে। তারা যে কী সীমাহীন
কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন-যাপন করছে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এর জন্যে ‘রোকেয়া
নারী উন্নয়ন সমিতি’ এবং ‘ফোরাম ফর
এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইণ্ডিয়া’ শরিয়তি
তালাক আইনকেই প্রধানতঃ দায়ী বলে মনে করে। তাই এই দুটি সংগঠনও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের দাবিতে
আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে ৯ই ডিসেম্বর এই দু’টি সংগঠন
সহস্রাধিক মুসলিম নারীকে সংগঠিত করে কলকাতার বুকে পদযাত্রা করে মুখ্যমন্ত্রীকে ডেপুটেশন দেয় এবং সে বছরেই ২৮শে
ডিসেম্বর প্রতিনিধিত্বমূলক ডেপুটেশন দেয় রাজ্যপালকে। রাজ্যপালের কাছে ডেপুটেশনে
আমিও ছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের কাছে পাঁচ দফা দাবি পেশ করা হয় যার প্রধান
তিনটি দাবি ছিলো – এক]. তালাক দেওয়ার সম অধিকার (নারী ও পুরুষের) রাখতে হবে এবং
তালাক হবে আদালতের মাধ্যমে। দুই]. একাধিক স্ত্রী (বহুবিবাহ) নিষিদ্ধ করতে হবে ।
তিন]. উত্তরাধিকার সম্পত্তির সম অধিকার [নারী ও পুরুষের] দিতে হবে।
তালাক আইনের একটি বিশেষ ধারা আছে যেটা এখানে আলোচনা করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও আবশ্যক। সেই ধারাটা এ রকম - স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর স্বামী যদি ভুল বুঝতে পেরে তার সেই স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে চায় এবং স্ত্রীরও যদি তাতে
সম্মতি থাকে তবুও তারা সরাসরি বিয়ে করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তালাক আইনের বিধি হলোঃ “অতঃপর যদি সে (স্বামী) তালাক দেয়, সে (স্ত্রী)
তার জন্যে বৈধ হবে না, যে পর্যন্ত অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহিত না হবে । তারপর সে (দ্বিতীয় স্বামী) যদি তাকে তালাক
দেয় এবং আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করতে পারবে বলে ধারণা হয় তবে প্রত্যাবর্তনে পাপ নেই।” (কোরান – ২/২৩০)
আর দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে নাম কা ওয়াস্তে হলে চলবে না, দ্বিতীয় স্বামীর
সঙ্গে সহবাস করতে হবে। স্ত্রীজাতির প্রতি এর থেকে বেশী অপমান ও অবমাননা বোধ হয় আর হয় না। নারীর পক্ষে এর থেকে সহমরণ প্রথাও
বোধ হয় মন্দের ভালো। মূল কথা হলো
সামগ্রিকভাবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিকে
শুধু নারী-বিরোধী ও নারী-বিদ্বেষী
আইন বললেই যথেষ্ট বলা হয় না, এটা একটি
অমানবিক, অসভ্য ও বর্বর আইন। স্বভাবতই এই
আইনটি বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশই বর্জন করেছে এবং ভারতের নারীরাও বর্জন করতে চায়
। তবুও ভারতে এই আইনটি আজো চালু আছে, শুধু
এই কারণে যে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা এই
আইনে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চান না। তাঁদের
অভিমত হলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইন ভোগ করা তাঁদের ধর্মীয় অধিকার। মুসলিম নারীদের
অশেষ দুঃখ, কষ্ট ও নির্যাতনের বিনিময়ে তারা সেই অধিকারে আজো ভোগ করে চলেছেন। হিন্দু
সমাজে ধর্মীয় নেতারাও হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের সংরক্ষণের পক্ষেই অনড় ছিলেন, তবু
নেহেরু সরকার আমলে সেই আইনটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। ফলে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ এবং আদালতের বাইরে বিচ্ছেদ
[তালাক] সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
।
বিজেপি বাদে সমস্ত রাজনৈতিক দলই দাবি করে যে তারা
সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের বন্ধু। মুসলিম
সমাজের সত্যিকারের কল্যাণ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মুসলিম নারীদের মুসলিম
ব্যক্তিগত আইনের অক্টোপাস থেকে মুক্ত করা। প্রয়োজন তাদেরকে পুরুষের সমান মর্যাদা,
সুযোগ, অধিকার ও ক্ষমতা প্রদান করা। আর এর জন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার করা
সব আগে জরুরী । অথচ এ বিষয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই নীরব। তারা নীরব কারণ তারা মুসলিম সমাজের প্রকৃত বন্ধু নয়, তারা তাদের উন্নতি চায় না, চায় কেবল তাদের ভোট।
সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দই আসলে ভোট-ভিক্ষুক ও ক্ষমতার দাস। মুসলিম
ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের কথা বললে
মুসলিম ধর্মগুরু ও মৌলবাদীরা চটে যাবে বলে
তাঁরা সে কথা বলেন না । তবে শুধু ধর্মীয় নেতারাই নয়, মুসলিম সমাজের পুরুষরাও
মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার চায় না । মাওলানা-মুফতি-ইমামই হোন, আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র-উকিল-ব্যারিস্টার-অধ্যাপক-লেখক-শিল্পীই হোন, নারীর উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার
প্রশ্নে সবাই এক । তাঁরাসবাই নারীকে সমান অধিকার,
স্বাধীনতা ও ক্ষমতা দিতে অপরাগ । তাই মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকেও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের দাবি
ওঠেনা। সেজন্যেই মুসলিম নারীরা চাইলেও অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে মুসলিম
ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার হবে এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মুসলিম নারীদের এর জন্যে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, তাদের অনেক
অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।