মাদ্রাসা বোর্ডের ২০১৫ – এর বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল
হাই মাদ্রাসার ফলাফল
পশ্চিমবঙ্গের হাই মাদ্রাসাগুলি থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের
অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিলো ৪০৬৪২ জন
ছাত্রছাত্রী যাদের মধ্যে ছাত্র ছিলো ১২৭২৯ জন [ ৩১.৩২% ] এবং ছাত্রী ছিলো ২৭৯১৩ জন
[ ৬৮.৬৮% ] । ছাত্রদের পাশের
হার ৮৫.৭৩%, ছাত্রীদের পাশের হার ৭৪.৬৬ % এবং গড় পাশের হার ৮০% ।
সিনিয়র মাদ্রাসার ফলাফল
আলিম [মাধ্যমিকের সমতুল্য] পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা
ছিলো এ বছর [গত বছরের অনুত্তীর্ণদের বাদ
দিয়ে] ৬৪৩৩ জন যাদের মধ্যে ৩১৩৭ জন [৪৮.৭৬%] ছাত্র এবং ছাত্রী
ছিলো ৩২৯৬ জন [৫১.২৪] । গড় পাশের
হার ৭৮.০৬% , ছাত্রদের পাশের হার ৮৮.৭৪%, ছাত্রীদের পাশের হার ৬৮.২০% ।
ফাজিল [উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য] পরীক্ষায় বসেছিলো ৩৪৪৬ জন
যাদের মধ্যে ছাত্রসংখ্যা ছিলো ২১৮৯ জন [৬৩.৫২%],
এবং ছাত্রীসংখ্যা ছিলো ১২৯৭ জন [৩৭.৬৪%]
। ছাত্রদের পাশের হার ৮৭.১১%,
ছাত্রীদের পাশের হার ৬৪.২২%] এবং গড় পাশের হার ৭৮.০৬%] ।
হাই মাদ্রাসা সিলেবাসের ব্যাপক
আধুনিকীকরণ করা হয়েছে বাম সরকারের আমলে । ফলে
সিনিয়র মাদ্রাসার তুলনায় হাই মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত ও আধুনিক
। তবুও হাই মাদ্রাসার সিলেবাস মধ্যশিক্ষা
পর্ষদের সিলেবাসের চেয়ে এখনও কিছুটা পশ্চাদপদ ।
হাই মাদ্রাসার মাধ্যমিকের
ছাত্রছাত্রীদের আরবি ভাষার জন্যে অতিরিক্ত একশ’ নম্বরের বোঝা বহন করতে হয় ।
আর পরিবেশগত ও পরিকাঠামোগতভাবে তো হাই মাদ্রাসাগুলি মধ্যধিক্ষা পর্ষদের অধীন হাইস্কুলগুলি থেকে
অনেক এতো বেশী পশ্চাদপদ যা ভাবাই যায় না
। হাই মাদ্রাসাগুলি পশ্চাদপদ
ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব ও পরিবেশ থেকে
বেরিয়ে আসতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হয়েছে । আসলে সে চেষ্টাটাই নেই । সে রকম প্রয়াস করলে সেক্ষেত্রে
প্রবল বাধা আসে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ থেকেই । কাজী মাসুম আক্তার সেই প্রয়াসটা করছিলেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে
তাঁর মাদ্রাসায় । তা করতে গিয়ে এখন তাঁর জীবন ও চাকরি দুটোই বিপন্ন । অপরদিকে সিনিয়র মাদ্রাসায়
মূলতঃ ধর্মীয় শিক্ষাই দেওয়া হয়, সেখানে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত । সিনিয়র মাদ্রাসাগুলি যদিও সরকার
অনুমোদিত এবং সরকারই যাবতীয় খরচ বহন করে তবুও সিনিয়র মাদ্রাসার সিলেবাসে
ইসলামি শিক্ষার যা প্রাধান্য
রয়েছে তা অবাক করার মতো । মুসলিম সমাজের আলেমগণ তাই হাই মাদ্রাসার পরিবর্তে সরকারের কাছে সিনিয়র
মাদ্রাসা স্থাপন করার দাবিই করেন । তবে সিনিয়র মাদ্রাসাও তাঁদের প্রথম পছন্দ নয়, তাঁদের প্রধান পছন্দ ও দাবি হলো রাজ্যের সমস্ত খারিজি
মাদ্রাসাগুলির অনুমোদন দিতে হবে । সিনিয়র মাদ্রাসা তাঁদের দ্বিতীয় প্রধান
পছন্দ ।
খারিজি মাদ্রাসার সিলেবাস বলা বাহুল্য সম্পূর্ণই শরিয়ত ভিত্তিক ।
কিছু পর্যবেক্ষণ
উপরে প্রদত্ত তথ্যগুলি থেকে যে
ছবিটা পাওয়া যায় তা হলো - এক]. সিনিয়র মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার পরীক্ষার্থীর
সংখ্যা [৬৪৩৩ জন] অপেক্ষা হাই মাদ্রাসার মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীর
[৪০৬৪২ জন] সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছ’গুণ । এই পরিসংখ্যানটি বলছে যে সিনিয়র
মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষা দেওয়া হলেও
মুসলিমরা হাই মাদ্রাসাকেই বেশী পছন্দ করেন । দুই]. হাই মাদ্রাসার মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্রী [ ৬৮.৬৮% ] ছাত্র [ ৩১.৩২% ] অপেক্ষা দ্বিগুণেরও বেশী । এটা প্রমাণ করে যে মুসলিম পরিবারগুলি তাদের
পুত্র সন্তানদের হাই মাদ্রাসা অপেক্ষা হাই স্কুলে পড়ানোতেই বেশী আগ্রহী । তিন]. ফাজিল [উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য]
পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে ৩৪৪৬, আলিম পরীক্ষায় পরিক্ষার্থী সংখ্যা সেখানে ৬৪৩৩ জন । আলিম পরীক্ষায় যেহেতু পাশের হার প্রায়
৮০%, সেহেতু ফাজিলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হওয়ার কথা ছিলো পাঁচ হাজারেরও বেশী । তাহলে আলিম পরীক্ষায় পাশ করা প্রায় দু’হাজার
ছেলেমেয়েরা কোথায় গেলো ? নিশ্চয় তাদের একটা অংশ পড়া ছেড়ে দিয়েছে এবং একটা অংশ
সিনিয়র মাদ্রাসা ছেড়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো । এই ঘটনা থেকে দুটো জিনিষ প্রতীয়মান হয় যে, সিনিয়র মাদ্রাসায় ড্রপ আউটের
সংখ্যা বেশী এবং সিনিয়র মাদ্রাসার মুসলিম
ছেলেমেয়েদের বিরাট একটা অংশ ফাজিল পড়তে
চাই না । চার]. এ বছর যে ৪০৪৬২ জন পড়ুয়া
হাই মাদ্রাসার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিলো তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিলো ২৭৯১৩ জন [৬৮.৬৮%
], অর্থাৎ ছাত্রদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশী । সেটা কি এজন্যে যে মুসলিমরা তাদের মেয়েদের হাই মাদ্রাসাতেই পড়াতে বেশী আগ্রহী ? তা কিন্তু নয় । এ রাজ্যে বহু অঞ্চলে যেখানে হাই মাদ্রাসা আছে কিন্তু হাই স্কুল নেই । নিরাপত্তার কথা ভেবে সে সব অঞ্চলে মুসলিমরা তাদের মেয়েদের মাদ্রাসায় ভর্তি করেন । অপরদিকে অসংখ্য অভিভাবক বাড়ির কাছে হাই মাদ্রাসা ছেড়ে দূরবর্তী হাই
স্কুলেই তাদের সন্তানদের পড়াতে পাঠান । যার ফলে হাই মাদ্রাসা মাধ্যমিক
পরীক্ষায় ছাত্র সংখ্যার চেয়ে ছাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশী ।
এই পর্যবেক্ষণগুলি থেকে স্পষ্টভাবেই এটা প্রমাণিত হয় যে মুসলিমরা
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না । তাঁদের এটা উপলব্ধির মধ্যে
এসেছে যে সন্তানদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ও উন্নতির ক্ষেত্রে, এবং আলোকোজ্জ্বল
ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা
শিক্ষাব্যবস্থা তথা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না । মুসলিমদের মধ্যে সেই সংখ্যাটা ভীষণ কম যাঁরা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখেন এবং
তাদের সংখ্যাটা ক্রমশঃ হ্রাসমান । তথাপি দুঃখজনক
ঘটনা হলো এই যে, যখন মুসলিম ধর্মীয়
নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের সাম্প্রদায়িক
সংগঠনগুলি খারিজি মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসার দাবিতে সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে , তখন মুসলিম
বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনরা তার প্রতিবাদ করেন না এবং সরকারের কাছে মাদ্রাসা শিক্ষার
অপকারিতার কথা বাখ্যা করে আধুনিক শিক্ষার জন্যে হাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের
দাবিতে সোচ্চার হন না ।
ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সমগ্র মুসলিম সমাজকে যখন প্রাণপণে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন তখন কলেজ-ইয়ুনিভার্সিটির ডিগ্রীধারী
উচ্চ শিক্ষিত এই মানুষগুলো পুতুলবৎ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন ।
মাদ্রাসা বোর্ডের ‘মাদ্রাস ফাইনাল’ [মাধ্যমিকের
সমতূল্য], ‘আলিম’ [মাধ্যমিকের সমতূল্য],
এবং ‘ফাজিল’ [উচ্চ মাধ্যমিকের সমতূল্য], এই তিনটি পরীক্ষায় যারা পাশ করেছে তাদের
সংখ্যা যথাক্রমে ৩২৩৭০, ৫০২২ ও ২৬৯০, মোট ৪০০৮২ জন । ‘আলিম’ ও ‘ফাজিল’ পরীক্ষায় যারা পাশ করেছে তাদের অধিকাংশই জনারণ্যে হারিয়ে যাবে । তাদের মধ্যে থেকে একজনও ন্যূনতম সম্মানজনক বেতন
ও পদমর্যাদার চাকরি অর্জন করতে পারবে না । তাদের কিয়দংশ হবে আলেম, তারপর মসজিদ মসজিদে এবং খারিজি মাদ্রাসায় অত্যন্ত
সামান্য বেতনে চাকরি করবে এবং স্বভাবতই তাদের পক্ষে নিজেদের সন্তানদের উপযুক্তভাবে
প্রতিপালন করা সম্ভব হবে না । ফলে এখন
অনেক আলেমকেই দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের হাই মাদ্রাসা বা সিনিয়র
মাদ্রাসার পরিবর্তে হাইস্কুলে পড়াচ্ছেন ।
যারা মাদ্রাসা ফাইন্যাল পাশ করেছে তারাও প্রায় সকলেই
কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবে । মাদ্রাসায় পড়ে অধ্যাপক,
ইঞ্জিনিয়র, ডাক্তার, বিডিও-এসডিও-ডিম, এসডিপিও-এসপি, গবেষক-বিজ্ঞানি হয়েছে
এমন কথা শোনা যায় না ।
বাস্তবে যা ঘটে তা হলো, মাদ্রাসার
ফাইন্যাল পরীক্ষায় রাজ্যস্তরে সর্বোচ্চ মেধাতালিকায় যাদের নাম থাকে তারাও সচরাচর
হারিয়ে যায় । কারণ, যারা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ
ও অন্যান্য নামিদামি পর্ষদের অধীনে পড়াশোনা করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বা সমতুল্য কোনো
পরীক্ষায় পাশ করে তাদের সঙ্গে কোনো বিভাগেই প্রতিযোগিতা করতে সমর্থ হয় না । এমনকি
মাদ্রাসায় পড়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা রাজ্যস্তরের সেরা ছাত্রছাত্রী বলে বিবেচিত তাদের মেধা ও জ্ঞানের তুলনায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে পড়া ছাত্রছাত্রীদের
জেলা স্তরের সেরা ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও জ্ঞান অনেক মাত্রায় বেশী । ফলে মাদ্রাসা
ফাইন্যাল পরীক্ষায় চমকপ্রদ ফলাফল করার পরেও ছেলেমেয়েরা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয় । তাদের মধ্যে অতি নগণ্য একটা অংশ প্রাথিমক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি পেয়ে থাকে,
বড়ো জোর দু’ একটা হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারে । মুসলিম সমাজের যাঁরা অধ্যাপক, ইঙ্গিনিয়র,
ডাক্তার এবং ডাব্লুবিসিএস ও আইএস অফিসার
হয়েছেন তাঁরা কেউ মাদ্রাসায় পড়েছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
কেনো হাই মাদ্রাস ও সিনিয়র মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে
যায় ও হারিয়ে যায় হারিয়ে যায় সে বিষয়টি জানতে ও বুঝতে হলে মাদ্রাসার সিলেবাসের উপর
দৃষ্টিপাত করতে হবে । হাই মাদ্রাসার
সিলেবাসে অনেকটা আধুনিকীকরণ করা হলেও পঠন-পাঠনের
পরিকাঠামো ও পরিবেশের দিক থেকে মাদ্রাসাগুলি ব্যাপক পিছিয়ে
রয়েছে থাকায় হাই মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে যায়
। চোখ রাখা যাক সিনিয়র মাদ্রাসার সিলেবাসে
। পরিসরের স্বল্পতা হেতু এই নিবন্ধে পুরো সিলেবাস তুলে ধরা যাবে না । (এই সিলেবাসটি
নিয়ে কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা করা আছে আমার ‘হিযাবঃ নারী দাসত্বের প্রতীক’ বইয়ের
একটা নিবন্ধে ) তাই এখানে উক্ত
সিলেবাসটিকে খুব সংক্ষেপে রাখা হলো । সেটা এ রকমঃ
সিনিয়র
মাদ্রাসা
থেকে
পড়ে
যে
ডিগ্রীগুলো
অর্জন
করা
যায়
সেগুলী
হলো
এক).
আলিম, দুই). ফাজিল,
তিন). কামিল (স্নাতক সমতুল্য), এবং
চার).
এম.এম (স্নাতকোত্তর
ডিগ্রীর
সমতুল্য)
। আগেই বলেছি
যে
আলিম
হলো মাধ্যমিকের সমতুল্য । মাধ্যমিকের মোট নম্বর যেখানে ৭০০ (সাতশো) সেখানে আলিমে মোট নম্বর ৯০০ (নয়শো) । ৯০০
নম্বরের
মধ্যে
আধুনিক
শিক্ষার
জন্যে
বরাদ্দ
৫৫০
নম্বর,
আর
ইসলামি
শিক্ষার
জন্যে
বরাদ্দ
৩৫০
নম্বর
। ভৌত বিজ্ঞান,
জীবন বিজ্ঞান ও ভূগোলের জন্যে
বরাদ্দ
৫০
নম্বর,
অপরদিকে
আরবি, হাদিস ও তফসির – এর প্রত্যেকটির জন্যে ১০০ নম্বর এবং ফেকা (ইসলামি আইন শাস্ত্র) –এর জন্যে ৫০ নম্বর । ফাজিল উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য । কিন্তু সিলেবাসে তারতম্য মাধ্যমিক ও আলিমের মতোই
। ফাজিলের সিলেবাসে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ইংরাজী, বাংলা ও ইতিহাসে ১০০ নম্বর
করে মোট ৩০০ নম্বর, এবং আরবি ভাষার জন্যে ১০০ নম্বর এবং হাদিস ও ফেকাহ-এর জন্যে
১০০ নম্বর । লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ফাজিলের সিলেবাসে বিজ্ঞান বিভাগের ঠাঁই নেই
এবং কলা বিভাগেও ঠাঁই পায় নি ভূগোল, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিও । কামিল ও এম.এম – এর সিলেবাস নিয়ে এখানে আলচনা করার অবকাশ
নেই, তবে কামিল ও এম.এমের সিলেবাস যে আরো পশ্চাদপদ তা বলা বাহুল্য ।
সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত
মাদ্রাসাগুলিতে পড়াশোনা করে মুসলিম ছেলেমেয়েদের এই যে পিছিয়ে যাওয়া ও হারিয়ে যাওয়া
– এটা নতুন কোনো ঘটনা নয় । ভারতের স্বাধীনতার আগের ও পরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে
দেখা যাবে যে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে পড়া
ছাত্রছাত্রীদের ভবিতব্য এটাই, তারা ধারাবাহিকভাবে পশ্চাদগামী হয়েই চলেছে ।
ধারাবাহিকভাবে পশ্চাদগামী হওয়ার এই ছবিটা যে কথা নীরবে ঘোষণা করছে তা হলো
, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও মাদ্রাসা
বোর্ড মুসলিম সমাজের যে বিপুল ক্ষতি করছে
তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয় । ছবিটা আরো বলতে চাই যে
মুসলিম সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের স্বার্থে অবিলম্বে মাদ্রাসা
শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেওয়া আবশ্যক । কিন্তু খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো এই যে এ
দাবিটি মুখ ফুটে বলার লোক মুসলিম সমাজে
আজো জন্ম নেয় নি । অথচ
মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গেছে কবেই, সেই ১৮৩৭ সালেই যখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি আরবি ও ফার্সির বদলে
ইংরাজীকে সরকারি ভাষা ঘোষণা করে এবং সরকারি সমস্ত পদে ইংরাজি ভাষা জানা আবশ্যক করে
। তখন থেকে মাদ্রাসাগুলির কাজ হয়ে দাঁড়ায় কেবল
কট্টর মোল্লা-মুফতি উৎপাদন করা । তখনই মুসলিম সমাজের উচিত ছিলো মুসলিমদের কল্যাণের
জন্যে আরব থেকে আমদানি করা আরবি ভাষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে
পেছনে সরিয়ে দিয়ে ইংরাজি ও বিজ্ঞানসহ
আধুনিক শিক্ষাকে আবাহন করা । কিন্তু সেটা করার জন্যে যে
উদারনৈতিক ভাবধারা ও দূরদুর্শিতা আবশ্যক ছিলো তা মুসলিম সমাজে কারো মধ্যে ছিলো না
। ফলে মুসলিম সমাজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজদের ইসলাম-বিদ্বেষী তকমা দিয়ে এবং ইংরাজি ভাষাকে
কাফেরদের ভাষা জ্ঞানে আধুনিক শিক্ষার
স্পর্শ এড়িয়ে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার লেজ
ধরে জীবন সমুদ্রে ক্রমশঃ ডুবতে থাকলো । হিন্দু সমাজ কিন্তু মুসলমানদের মতো
অর্বাচীন ছিলো না কখনই । মুসলিম শাসনে ধর্মীয় গোঁড়ামি হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষায় আটকে
রাখতে পারে নি, তারা তার বদলে আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখে সরকারি পদে নিয়োগের
ক্ষেত্রে মুসলিমদের পিছনে ফেলে অনেক বেশী এগিয়ে গিয়েছিলো । ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি যখনই ইংরাজীকে সরকারি
ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে, তখনই তারা আরবি- ফার্সি ভাষা ত্যাগ করে ইংরাজী
ভাষা ও
আধুনিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে ।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি হিন্দু নেতাদের তুষ্ট করতে যখন ১৮২৩ সালে কলকাতায়
দ্বিতীয় একটি সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়,
তখনই তৎক্ষণাৎ রাজা রাম মোহন রায় তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি
পাঠান । সেই চিঠিতে তিনি দাবি করেন যে, ভারতীয়দের জন্যে ধর্মীয় শিক্ষা নয়, চাই
ইংরাজিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষা । ভাবতে অবাক লাগে, তার চেয়ে বেশী লজ্জা
লাগে, রাজা রাম মোহন প্রায় দু’শো বছর আগে যে দাবি সোচ্চারে জানিয়েছিলেন, মুসলিম
সমাজ আজো সে দাবি উচ্চারণ করার যোগ্যতা ও সাহস অর্জন করতে ব্যর্থ থেকেই গেছে । হয় তো আধুনিক শিক্ষার দাবি
জানিয়েছেন অনেকেই, কিন্তু আর ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ নয় এ কথা সোচ্চারে বলার স্পর্ধা
আজো হলো না মুসলিম সমাজের কোনো
বুদ্ধিজীবী-বিদ্বজনের । মুসলি সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এই তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবী
ও বিদ্বজনরা ক্ষমা পাবেন বলে মনে হয় না ।
নিবন্ধটি শেষ করার পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা
সম্পর্কে আর একটি কথা অন্ততঃ স্পর্শ করে যাওয়া আবশ্যক মনে হয় । তা হলো, নিবন্ধটি পড়ে মনে হবে যে মাদ্রাসা
শিক্ষা শুধু মুসলমানদেরই সর্বনাশ করছে । এটা আংশিক সত্য । সম্পূর্ণ সত্যিটা হলো যে
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা দেশের পক্ষে ও গোটা বিশ্বের পক্ষেই সর্বনাশা ।
জিহাদের শিক্ষা তথা মুসলিম সন্ত্রাসবাদের শিক্ষা এবং সর্বোপরি প্যান ইসলামের পাঠ এবং তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মাদ্রাসাতেই
। এই সময়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখলেই তা টের পাওয়া যায় । যদিও এ কথা
ঠিক যে ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয় । কারণ,
ভারতে সেরূপ মাদ্রাসা স্থাপন করার অনুকূল
পরিস্থিতি নেই । কিন্তু এ কথাও ঠিক
নয় যে এ দেশে সকল মাদ্রাসাই সন্দেহের ঊর্ধে । বর্ধমানের খাগড়াগড়
বিষ্ফোরণ কাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে । মূল কথা হলো, যেটা
আমরা কখনোই অস্বীকার বা উপেক্ষা করতে পারি না যে,
মাদ্রাসা থাকলে সেটা জিহাদের আঁতুড় ঘর তৈরী হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায় ।