সংবৎসর সব রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা মুসলিম ধর্মীয়নেতাদের তোয়াজ ও তোষণ
করে । এর মাত্রা যদি হঠাৎ বাড়তে শুরু করে তবে জানতে হবে যে ভোট আসন্ন । কিছু দিন আগে মমতা ব্যানার্জী সবাইকে চমকে দিয়ে
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর তথা উলামায়ে জমিয়তে হিন্দ,পশ্চিমবঙ্গ শাখার জনসভায় গিয়ে মঞ্চ আলো করে বসলেন । তা নিয়ে
সর্বস্তরে গুঞ্জন ও ফিসফাসের রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১৮ই ডিসেম্বর মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাজির হলেন তথাকথিত পীরজাদা
ত্বহা সিদ্দিকির জনসভায় । এ সব ঘটনা বলে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট আসন্ন । মুসলিম
সমাজের ধর্মীয়নেতাদের আগেই তো বগলদাবা করা হয়ে গেছে, এবার সিদ্দিকুল্লাহ ও ত্বহা
সিদ্দিকিকে বগলদাবা করে মমতা ব্যানার্জী আসন্ন বিধানসভা ভোটে কেল্লা ফতে করতে
চাইছেন ।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনংখ্যা অনেক, ২৭% । সব দলেরই
চোখ থাকে তাই মুসলিম ভোটের দিকে । সবাই
মুসলিমদের ভেড়া ভাবে । মনে করে
ধর্মীয়নেতাদের কথায় তারা দলবেঁধে ভোট দেয় (এটা আদৌ সত্যি নয়) । তাই সবাই এই ধর্মীয়নেতাদের
ভজনা করে । কথায় কথায় তাদের গলায় মুসলিম দরদ উথলে ওঠে । বলে আমাদের ভোট দাও, আমরা
মুসলমানদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবো। আর এই সুযোগে এই ধর্মীয়গুরুরাও লম্বা লম্বা ফর্দ তুলে
দিয়ে বলে এই করতে হবে সেই করতে হবে । সরকারের জনবিরোধী নীতির কারণে যখন সংকট
সর্বস্তরে তীব্র হয় তখন মানুষ সরকারের পরিবর্তন চায় । পরিবর্তন হয়ও । তখম মুসলিম
ধর্মগুরুরা বলে আমরাই অর্থাৎ মুসলিমরাই পরিবর্তনের কাণ্ডারী। সংবাদ মাধ্যমও তাদের সঙ্গে গলা
মেলায় উচ্চগ্রামে, বলে সংখ্যালঘুরা
তাদের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে শাসক দলের
বিরুদ্ধে ঢেলে ভোট দিয়েছে । যারা ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং যারা ক্ষমতায় আসে সবাই সে
রকমটাই ভাবে । ফলে যারা ক্ষমতাচ্যুত হয় তারা যেমন সম্বৎসর মুসলিম ধর্মগুরুদের মন
ফিরে পিতে তাদের তোয়াজ করার ধারা অব্যাহত রাখে, তেমনি শাসক দলও । শাসক দল ও
বিরোধীদলগুলির মধ্যে এভাবে মুসলিম ধর্মীয়নেতাদের তোয়াজ করার হীন প্রতিযোগীতা চলতে
থাকে । ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে এটাই অলিখিত দস্তুর ।
মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ একদিকে চলতেই থাকে, অপরদিকে
কিন্তু মুসলিমরা যে তিমিরে ছিলো সে
তিমিরেই থেকে যায় । ভুল বললাম, তারা আরো পিছিয়ে যায় । তাদের দারিদ্র, বেকারি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা,
অচিকিৎসা-কুচিকিৎসা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার বেড়েই চলে । রাজনৈতিক দাদা-দিদিরা যতই মুসলিম দরদ দেখাক,
মুসলিমরা ভবিষ্যতেও পিছোতে থাকবে, এ ধারাই অব্যাহত থাকবে।
কারণ, তাঁরা কেউই মুসলিম সমাজের দৈন্যদশার জন্যে ভাবিত বা উদ্বিগ্ন নন । কেউই এই সমাজের উন্নতির জন্যে আন্তরিকও নয়
। বরং সবাই চাই তারা পিছিয়ে থাক, এবং আরো পিছিয়েই যাক । কারণ, মুসলিমদের পশ্চাদপদতাকে তাঁরা ভোটের
রাজনীতিতে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চায় । ট্রাম্প কার্ড হিসেবে
সমানে ব্যবহার করতে চায় তসলিমা ও রুশদি ইস্যুকেও । মুসলিম ধর্মীয়নেতারাও চায় না মুসলিমদের
পশ্চাদপদতার অবসান । এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান । একটি কারণ হলো শরিয়তি, আর একটি রাজনীতি । শরিয়তি কারণটা কী তার
বাখ্যা পরে অন্যত্র দেয়া যাবে। রাজনৈতিক কারণটা এ রকম – ধর্মগুরুদের রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের সঙ্গে বার্গেনিং করার ক্ষেত্রে
প্রধান হাতিয়ার তো মুসলিমদের পশ্চাদপদতা ও অনগ্রসরতাই ।
ক্ষমতায় বা সরকারে আসার পর তাই শাসক দল কীভাবে এই
ধর্মগুরুদের পদলেহন করবে সেটাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে । কংগ্রেস, বামফ্রণ্ট,
তৃণমূল এবং অন্যান্য সব দলের ক্ষেত্রেই কথাটা সমান প্রযোজ্য । তবে এক্ষেত্রে তৃণমূল সর্বাধিনায়ক মমতা
ব্যানার্জী অতুলনীয় । বামফ্রন্ট বড়াই করে, তারাই একমাত্র
নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে আপোষ করে না । কিন্তু
মুসলিম ধর্মগুরুদের তথা মুসলিম মৌলবাদীদের পদতলে তারা বারবার নতজানু হয়েছে তাদের
৩৪ বছরের শাসনে । কংগ্রেসের শাসনে (১৯৭৭ সাল পর্যন্ত) পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা তৈরী হয়েছিলো ২৩৮টি, বামেদের
শাসনে (২০০৮ সাল পর্যন্ত) তা বেড়ে হয় ৫০৮ টি, দ্বিগুনেরও বেশী । ১৯৭৭ সালে মাদ্রাসার জন্যে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ
ছিল ৫.৮ কোটি টাকা, বাম শাসনে ২০০৮ সালে সেই বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ১৮৮ কোটি টাকা । বাম শাসনে
পাক-বাংলাদেশের মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলি পশ্চিমবঙ্গকে করিডর বানিয়ে ফেলেছিলো । সীমান্ত জেলাগুলিতে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ ও মলদহে, খারিজি
মাদ্রাসা ও মসজিদগুলির একাংশে জঙ্গিরা যোগাযোগ বাড়তে থাকে, কোথাও কোথাও ঘাঁটি গেড়ে বসে । তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব
ভট্টাচার্য তখন বেআইনি মাদ্রাসাগুলির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন ।
সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম মৌলবাদীরা বুদ্ধবাবু ও সিপিএম মাদ্রাসা ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে
বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয় । তখন দেশের স্বার্থ
জলাঞ্জলি দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে কিংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসও মুসলিম
মৌলবাদীদের সঙ্গে গলা মেলায় । তা দেখে আলিমুদ্দিনও দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে
সরকারের লাগাম টেনে ধরে । বুদ্ধবাবু তখন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেন মাদ্রাসার বিরুদ্ধেই
সরকার পদক্ষেপ করবে না । মুসলিম
ধর্মগুরুদের তুষ্ট করতে বামফ্রন্ট সরকার
আরো কয়েকটি কদর্য পদক্ষেপ নেয় । যেমন তসলিমার বই ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করা, তসলিমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করা, আলিয়া
মাদ্রাসাকে পরিকাঠামোর উন্নতি করেই তড়িঘরি আলিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ে উন্নীত করা,
ইত্যাদি ইত্যাদি । মোল্লাতন্ত্র-তোষণের নগ্ন রাজনীতির এরূপ আরো অনেক নগ্ন দৃষ্টান্তই
বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনে খুঁজলে
পাওয়া যাবে ।
মোল্লাতন্ত্র তোষণে সবকে ছাপিয়ে গেছেন মমতা
ব্যানার্জী । বামফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রীরা অন্ততঃ প্রকাশ্যে মুসলিম ধর্মীয়নেতাদের সঙ্গে গা
মাখামাখি করতেন না, তাঁদের কিছুটা হলেও চক্ষু লজ্জা ছিলো । মমতা ব্যানার্জীর তো
তারও বালাই নাই । তাঁর বামদিকে ইমাম,
ডানদিকে ইমাম, ইমামদের দুই পাশে দুই মুসলিম মৌলবাদী নেতা ও
সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান ও ইদ্রিশ আলি – এ
ছবি প্রায়শই চোখে পড়ে । তিনি প্রায়শই ছুটে
যাচ্ছেন মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে । মাথায় আঁচল দিয়ে ধর্মীয়নেতাদের পাশে
বসে রোজা ভাঙছেন, আল্লাহর কাছে দু
হাত তুলে দুয়া করছেন, অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠে ‘সালেমালেকুম’ ‘ইনশাল্লাহ’, ‘খোদা হাফেজ’ প্রভৃতি ভুলভাল আরবি শব্দ উচ্চারণ করছেন । একজন মুখ্যমন্ত্রী নগ্ন মোল্লা-তোষণে এভাবে এতো নীচে নামতে পারে ভাবাই যায় না । শুধু কথা ও
আচরণের চটকদারি দিয়ে নয়, মোল্লা-তোষণে সরকারি কাজেও মমতা ব্যানার্জী বামফ্রন্ট সরকারের চেয়ে অনেক কদম এগিয়ে । ক্ষমতায় আসীন হয়েই দশ
হাজার খারিজি মাদ্রাসাকে সরকারী অনুমোদন দেবার ঘোষণা দেন । হজ হাউসের সম্প্রসারণ
করেছেন এবং নতুন একটা হজ হাউস নির্মাণ করেছেন। অসাংবিধানিক ভাবে ইমাম ও মোয়াজ্জিন
ভাতা চালু করেছেন । তসলিমার একটি বই উদ্বোধন অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন এবং তার লেখা
একটা মেগা সিরিয়ালের টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছেন । সলমান রুশদিকে কলকাতা বইমেলায় আসতে দেন নি । আছে এ রকম আরো অনেক ঘটনা । এমনকি বাংলাদেশী মুসলিম
জঙ্গিসংগঠনগুলি যখন এ রাজ্যে খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে একটার পর ঘাঁটি গেড়েছে তখনও
তাঁর সরকার না দেখার ভাণ করে নিষ্ক্রিয় থেকে গেছে । এনআইএ (NIA) – র তদন্তে উঠে
এসেছে যে খাগড়াগড় বিষ্ফোরণের সঙ্গে
বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) যুক্ত । অথচ ঐ বিষ্ফোরণকে ‘র’-এর কাজ বলে জঙ্গিদের আড়াল
করার চেষ্টা করা হয়েছে । এ সবই যে সংকীর্ণ
দলীয় স্বার্থে মুসলিম মৌলবাদীদের তুষ্ট করতেই করা হয়েছে তা বলা বাহুল্য ।
রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে এভাবে মোল্লাদের তোষণ
করে । আর হিন্দুত্ববাদীরা এটাকে মুসলিমতোষণ বলে ফায়দা তোলার চেষ্টা করে ।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে তার মূলে রয়েছে কংগ্রেস, টিএমসি ও
বামফ্রন্টের মোল্লাতোষণ নীতি । আর তার উল্টোদিকে প্রতারিত হয় সাধারণ মুসলমানরা ।
মুসলমানদের সঙ্গে তঞ্চকতা করে সবাই, মমতার
তুলনায় সবাই শিশু ।