গত ২রা অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে একটি বাড়িতে ‘আইইডি’ [ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস] বিষ্ফোরণ
কান্ডে ঘটনাস্থলেই যে দুজন মারা যায় [শাকিল
গাজি ও সুবহান সেখ] তারা ছিল বংলাদেশের ‘জামাতুল মুজাহিদিন বংলাদেশ’ [জেএমবি]-র সদস্য। কেন্দ্রীয় সরকার তাই এন.আই.এ [ন্যাশ্নাল ইনভেষ্টিগেটিং এজেন্সী] –এর উপর ৯ই অক্টোবর ঐ ঘটনার তদন্তভার তুলে দেয় রাজ্য সরকারের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই। এন.আই.এ-এর তদন্তে ইতিমধ্যেই যে
সব তথ্য উঠে এসেছে তা ভীষণ উদ্বেগের। প্রথম দিকে অনুমান করা হচ্ছিল যে এই ঘটনার
সঙ্গে শুধু ‘জেএমবি’রই সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু এখন এটা প্রায় স্পষ্ট যে
‘জেএমবি’ই শুধু নয়, এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে ভারতের নিষিদ্ধ
সন্ত্রাসবাদী জেহাদি সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান
মুজাহিদ’ ও ‘জমিয়ত-উল-মুজাহিদিন’, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই এবং
অন্তর্দেশীয় আরো কিছু জঙ্গি সংগঠনের। জঙ্গিরা খাগড়াগড়ের সেই বাড়িতে গড়ে
তুলেছিলো ‘আইইডি’ তৈরী করার একটি কারখানা এবং একটি
গবেষণাগারও। সেখানে
যেসব রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে তা মূলতঃ যুদ্ধের জন্যে বিষ্ফোরক তৈরীতে ব্যবহার করা
হয় বলে তদন্তকারী আধিকারিকরা জানিয়েছেন। যে বাড়িতে বিষ্ফোরণ হয়েছে সেখান
থেকে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক
পদার্থ সহ ৫০টিরও বেশী আইইডি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব রাসায়নিক
বিষ্ফোরক দ্রব্য ও ‘আইইডি’ বিষ্ফোরিত হলে দশ হাজার
মানুষের প্রাণ যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। বিষ্ফোরণ কান্ডের আর এক পান্ডা
রেজাউলের বাড়ি থেকে আরো ৩৯টি আইইডি পাওয়া
গেছে। এ সব তথ্য থেকেই এটা স্পষ্ট যে খাগড়াগড় সহ মুসলিম জঙ্গিদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বিশাল আইইডির ভান্ডার গড়ে
উঠেছিলো।
তদন্তে আরো মারাত্মক যে তথ্যটি উঠে
এসেছে তা হলো – এ রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠেছে কিছু মাদ্রাসা যেখানে মূলতঃ জেহাদি তৈরী করা হয়। ইতিমধ্যেই এ
রকম দুটি মাদ্রসাকে চিহ্নিত করা গেছে, মাদাসা দুটি হলো - বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের
‘শিমুলিয়া মাদ্রাসা’ ও মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার ‘মকিমনগর মাদ্রাসা’। আরো কোথায় কোথায় এ রকম মাদ্রাসা আছে তা
অনুসন্ধান করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এসব মাদ্রাসায় জিহাদের ধর্মীয় শিক্ষা এবং জিহাদি কর্মকান্ডের তালিম বা প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।আর একটি গভীর উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে গোয়েন্দাদের তদন্তে – তা হলো,
জেহাদিদের দলে রয়েছে প্রায় ২০-২৫ জনের নারীও যারা আদর্সগত ও মানসিকভাবে পুরোদস্তুর জঙ্গি
ও সন্ত্রাসী। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। সেই নটোরিয়াস মেয়েরা হলো রাজিয়া, আলিমা, জিন্নাতুন বিবি, জরিনা বিবি, রূম্পা খাতুন, খালেদা বিবি ও আয়েষা বিবি। প্রথম দুজন খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ডে ঘটনাস্থলেই ধরা পড়েছে, বাকিরা ফেরার।
রাজিয়া ও আলিমা হলো যথাক্রমে বিষ্ফোরণ কান্ডে নিহত শাকিল গাজী ও আহত আব্দুল হাকিমের স্ত্রী। এই মেয়েদের মধ্যে
আয়েষা বিবি, শিমুলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউসুফ সেখের স্ত্রী, শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদ্রাসায় মেয়েদের জেহাদি
পাঠ ও প্রশিক্ষণ দিতো বলে জানা গেছে। আয়েষার সঙ্গে আরো কয়েকজন নারী এই কাজে নিযুক্ত ছিলো। তারা বাংলাদেশের
‘জেএমবি’র সদস্য বলে তদন্তকারিদল জানতে পেরেছে।
এই বিষ্ফোরণ কান্ডটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে
দিয়েছে যে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী
সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গকে তাদের একটা ঘাঁটিতে পরিণত করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। অথচ আমরা শুধু এটুকু জানতাম যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো
ভারতে ঢুকে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম করার জন্যে পশ্চিমবঙ্গকে তাদের সেফ করিডর
হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বাম সরকার সব কিছু জেনেও তা আটকানোর জন্যে কার্যতঃ কোনো ব্যবস্থা নিতে
তৎপর হয় নি। সরকার নির্লিপ্ত ও নির্বিকার থাকতো মুসলিম
মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট রাখতে। এ দেশে সব রাজনৈতিক
দলগুলোই মনে করে যে মোল্লা-মুফতি-ইমামরা চটে গেলে মুসলমানরা ভোট দেবে না, বামফ্রন্টও তার ব্যতিক্রম নয়। এটা যদিও ভুল
ধারণা তবু মোল্লা-মুফতিদের
সন্তুষ্ট করতে বামফ্রন্ট সরকার তাদের বহু অন্যায়
দাবীর কাছে বারবার মাথা নত করেছে। কি তসলিমা ইস্যু, কি মাদ্রাসা ইস্যু, কি
অনুপ্রবেশ ইস্যু – সব ইস্যুতেই সরকার মাথা নত করে রাখতো। সরকার তসলিমার বই নিষিদ্ধ করেছে, তাঁর মাথা কেটে নেওয়ার
যারা ফতোয়া দিয়েছে তাদের মহাকরণে লাল কার্পেট অভর্থনা জানিয়েছে, এবং শেষ
পর্যন্ত তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়িতও করেছে। সরকার শয়ে
শয়ে নতুন মাদ্রাসার
অনুমোদন দিয়েছে, এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকি করণে ‘কি দোয়াই’ কমিটির বাস্তবসম্মত প্রস্তাবগুলিকে প্রত্যাখানও করেছে। এভাবেই বাম সরকার মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করে গিয়েছে। ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জেহাদিরা ভারতে জেহাদি কর্মকান্ড চালানোর জন্যে পশ্চিমবঙ্গকে করিডর হিসেবে অনায়াসে ব্যাবহার করতে
পেরেছে। এ দেশের মুসলিম মৌলবাদীরা সরকারকে সর্বদা চাপে
রাখতো, আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জেহাদি সন্ত্রাসবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় অবাধে
ঢুকে সারা দেশে তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিতো। এটা কি নেহাতই কাকতালীয়? না কি এর মধ্যে এই
রাজ্যের মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদীদের গূঢ় সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে?
এটা সর্বজন বিদিত যে ২০১১ সালে মমতা ব্যনার্জী ক্ষমতায় আসার পর মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করা আরো অনেকগুণ বেড়েছে। ফলে মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের গতিবিধি এ রাজ্যে যে আরো বৃদ্ধি পাবে তা জানাই ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যে করিডর থেকে ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে তা আমরা ভাবতে পারি নি। খুব সম্প্রতি সারদা কেলেঙ্কারীতে সিবিআই তদন্তে যখন উন্মোচিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী দল ‘জামাত-ই-ইসলামের’ মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা, তখনও আমরা এমন ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা কল্পনাতেও আনতে পারি নি। এবং এমন শোচনীয় পরিণতির কথা আমরা হয় তো জানতেও পারতাম না যদি জঙ্গিদের ক্ষণেকের ভুলে বা অসতর্কতায় খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ডটি না ঘটতো। শোনা যাচ্ছে জেহাদিদের কর্মকান্ড চলছে এ রাজ্যে ৪/৫ বছর ধরে। বাম সরকারের অবসান ২০১১ সালে হলেও ২০০৯ কার্যতঃ প্রশাসনের উপর বাম সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, প্রশাসন তখন তটস্থ থাকতো তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রীর দাপটের কাছে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে আসার আগে দু বছর এবং আসার পর তিন বছর – এই সময়টাই দেখা যাচ্ছে জেহাদি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সেরা সময় গেছে। এটাও কি কাকতলীয়? না কি অন্য কোনো সূত্র রয়েছে এর পশ্চাতে?
খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ড অভ্যন্তরীণ
নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদেরকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এবং মুসলিম
সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে তার চেয়েও বেশী। রাজ্য সরকার গোড়া থেকেই খাগড়াগড় কান্ডকে লঘু করে
দেখানোর চেষ্টা করেছে। কখনো বলেছে সিলিন্ডার বিষ্ফোরণের
ঘটনা তো কখনো বলেছে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে
বোমাবাজির ঘটনা। আবার বড়ো বিপদের গন্ধ পেয়ে এন.আই.এ -এর আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে
ছুটে গেলে রাজ্যের প্রশাসন তাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দিয়েছে। যে আইইডিগুলি ঘটনাস্থলে তখন মজুত ছিলো সেগুলি
সবকটায় ফাটিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কেনো নিয়ম মেনে দু-একটি নমুনা রাখা হলো না? প্রশ্ন উঠছে, এর মধ্যে বিশেষ কোনো অভিসন্ধি নেই তো? এন.আই.এ যাতে তদন্ত না করতে পারে তার জন্যে শাসক দল বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। ফলে এন.আই.এ তদন্তভার পেতে সাত দিন
দেরী হয়ে যায়। এই বিলম্বের ফলে জঙ্গিরা বহু
তথ্য প্রমাণ লোপাট করার ও ডেরা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার অনেক সময় পেয়ে যায়। রেজাউলের যে বাড়ি থেকে তল্লাশি
চালিয়ে পুলিশ ও সিআইডি খালি হাতে ফিরে এলো, সেখান থেকে ৩৯টি আইইডি উদ্ধার করে
আনলেন এন.আই.এ – এর গোয়েন্দারা। তবুও মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন যে খাগড়াগড় কান্ডে তাঁর পুলিশ খুব ভালো কাজ করেছে। তিনি আজ পর্যন্ত বিষ্ফোরণ কান্ডের নিন্দা করে বিবৃতি দেন নি, ঘুরিয়ে এন.আই.একে তদন্তভার তুলে দেওয়ার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারকেই সমানে
দোষারোপ করে যাচ্ছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, রাজ্য সরকার কী কিছু লুকাতে চাইছে?
এ রকম উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে মুসলিম
সমাজের ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সরকার
ও জনগণের এটাই প্রত্যাশা যে তাঁরা সব থেকে
বেশী মুসলিম জঙ্গিদের নিন্দা করবেন,
জেহাদি কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাদ্রাসাগুলির বিরুদ্ধে সরব হবেন এবং জঙ্গি
মোকাবিলায় সরকারের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তাঁদের ভূমিকা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। সন্দেহজনকও। মোল্লা-মুফতি-ইমামরা বিষ্ফোরোণ কান্ড ও
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিন্দা করছেন না, ঘুরিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের
অভিযোগ আনছেন। বলছেন যে সবই নাকি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তাঁদের এই ষড়যন্ত্রের গল্প প্রচারিত হচ্ছে আহমেদ হাসান ইমরানের ‘কলম’ পত্রিকায়। গত ১৪ই অক্টোবরের কলমে ধর্মীয়নেতাদের বক্তব্য লেখা
হলো এ ভাবেঃ সিদ্দিকুল্লাহকে বলেছেন - “মাদ্রাসা কোনও দিন সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয় না। ... মাদ্রাসায় যারা কুরআন-হাদিস পড়ছে তারা শান্ত। কুরআন-হাদিসের কোথাও সন্ত্রাসবাদীদের স্থান নেই। ... ধর্মের সঙ্গে জেহাদকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জেহাদ
আলাদা, ধর্ম একটি বিষয়। ... পুলিশ ও প্রশাসনকে বলবো এই ঘটনায় যেন নিরীহ মানুষ
হেনস্থার শিকার না হয়।” ত্বহা সিদ্দিকি বলেন, “আজকে মুসলিম সমাজের উপর মিডিয়া আক্রমণ শুরু করেছে। আমাদের হয়ে কথা বলার মতো কোনও শক্তিশালী
মিডিয়া নেই। রয়েছে একমাত্র ‘কলম’। এই কলমকে বন্ধ করার জন্য সম্ভবত চক্রান্ত।” আহমেদ হাসান ইমরান বলেন, “হঠাৎ আমাদের মাদ্রাসাগুলি সম্পর্কে অপপ্রচার শুরু
হয়েছে। ... হঠাৎ সন্ত্রাসবাদের তকমা দেওয়া হচ্ছে মাদ্রাসাগুলোর উপর।” বিভিন্ন প্রশ্নে অতিশয় প্রগলভ মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এখন পর্যন্ত স্পিকটি নট। মুসলিম বুদ্ধিজীবী আমি তাঁদেরই বলি যাঁদের কোরান-হাদিসে প্রশ্নহীন আস্থা ও
আনুগত্য আছে। তাঁরা নীরব থেকে কি মোল্লা-মুফতি-ইমামদের পাশে থাকার ইঙ্গিত দিতে
চাইছেন?
এটা নিশ্চয় ঠিক যে সব মাদ্রাসায়
জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এটাও ঠিক যে যারা জেহাদি সংগঠনে নাম লিখিয়েছে তারা
সংখ্যায় নগণ্যই। এখানকার মুসলিমরাও যদিও বিশ্বের মুসলমানদের মতোই ইসলাম ও মুহাম্মদের
সামান্য সমালোচনাতেই উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ওঠে, তবু এরাই আবার গভীরভাবে বিশ্বাস
করে যে ইসলাম হলো শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। হ্যাঁ, মুসলিমদের মধ্যে এই বৈপরিত্যই সত্যি ও বাস্তব।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিষ্ফোরণ কান্ডে যে সব তথ্য উঠে এসেছে তা সব মিথ্যে, সবই মাদ্রাসা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। শিমুলিয়া মাদ্রাসা ও মকিমনগর মাদ্রাসায় যেসব জেহাদি বইপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র
পাওয়া গেছে তা মিথ্যে? খাগড়াগড়ে যে আইইডি বিষ্ফোরণ হয়েছে তা মিথ্যে? রেজাউলের
বাড়িতে যে ৩৯ টি আইইডি পাওয়া গেছে তা কি মিথ্যে? বিষ্ফোরণ স্থল থেকে রাজিয়া,
আলিমা ও আব্দুল হাকিমকে গ্রেপ্তার করাটা মিথ্যে? কোনো মোল্লা, মুফতি কিংবা ইমাম তো এ সব ভয়ঙ্কর
কর্মকান্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ করলেন না। কোনো মুসলিম বুদ্ধিজীবীকেও দেখলাম না
প্রতিবাদ করতে বা উদ্বেগ প্রকাশ করতে। অথচ এই ধর্মীয় নেতারাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার
করে বলছেন যে, মাদ্রাসায় জিহাদের
শিক্ষা দেওয়া হয় না, কোরান-হাদিসে জিহাদের স্থান নেই, মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব দাবি তো সর্বৈব মিথ্যা। এগুলো যে
মিথ্যা প্রচারণা তার সাক্ষ্য দেবে কোরান ও হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস।
এই ধর্মীয় নেতারা ভালোভাবেই
জানেন যে মাদ্রাসায় জেহাদি পাঠ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া মোটেই ইসলামবিরুদ্ধ নয়। বরং না দেওয়াটাই
ইসলামবিরুদ্ধ কাজ। কারণ, মাদ্রাসা কোনো সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটা
মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জিহাদকে বাদ দিয়ে মাদ্রাসার
পাঠ্যক্রম কখনই সম্পূর্ণ হতে পারে না। কোরান-হাদিসের ছত্রে ছত্রে অবিশ্বাসিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস ও সশস্ত্র
জিহাদের আদেশ দেওয়া আছে। ইসলামের ইতিহাসও বলছে যে কোরানের জোরে নয়, তলোয়ারের জোরেই
ইসলামের বিজয় ও বিস্তার ঘটেছে। মুহাম্মদ স্বয়ং তাঁর জীবনে অসংখ্য
জিহাদ করেছেন। ড.ওসমান গণি লিখেছেন মুহাম্মদের জীবনে জিহাদের মোট সংখ্যা ছিলো
৪৩টি। [দ্রঃ মহানবী, পৃ- ৩৯৫] ইসলাম
নারীদেরও জিহাদে যাওয়ার আদেশ আছে। মুহাম্মদের স্ত্রী ও কন্যাও
জিহাদে অংশ নিয়েছেন। হাদিসে তার সাক্ষ্য বহন করছে। সে রকম একটি হাদিস হলো - “যুদ্ধের ময়দানে
যখন নবী (সাঃ) – এর শিরস্ত্রাণ ভেঙে গেল
ও তাঁর মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল এবং তাঁর সামনের দাঁত ভেঙে গেল, তখন আলী (রা)
ঢালে করে ভরে ভরে পানি আনতেন এবং ফাতিমা (রা) ধুতে দিতেন। যখন ফাতিমা দেখলেন যে,
পানির চাইতে রক্তক্ষরণ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন একখানা চাটাই নিয়ে তা পোড়ালেন এবং
ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন, তাতে রক্ত বন্ধ হয়ে গেল।” [বুখারী, ৫ম খন্ড, হাঃ নং ২৭০৩] জিহাদে শহীদের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মুহাম্মদ কী বলেছেন সে প্রসঙ্গে একটি হাদিস - “আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী
(সঃ)- কে আমি বলতে শুনেছি যে, ... সেই
সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, আমি পছন্দ করি আমেকে যেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ করা হয়। আবার জীবিত করা
হয়, পুনরায় আবার শহীদ করা হয়। আবার জীবিত করা হয়, পুনরায় শহীদ করা হয়।” (বোখারী
শরীফ, ৫ম খন্ড, হাঃ – ২৬০৪) এরূপ অজস্র হাদিস আছে যা
প্রমাণ করে যে জিহাদে অংশ গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমানের বাধ্যতামূলক ।
কোরানে প্রায় ২০০টি আয়াত আছে জিহাদ প্রসঙ্গে। কোরান
বলছে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে জিহাদ ফরজ [আবশ্যিক কর্তব্য]। ৯/১৬ নং আয়াত বলছে – “ভাবিয়াছ কি যে ছাড়া পাইবে? অথচ
আল্লাহ এখনও প্রকাশ করে নাই যে কে মুজাহিদ ... আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম অবহিত।” যারা
জেহাদ করে তাদের মুজাহিদ বলে। যারা বলে
যে জিহাদ হলো নিজের বিরুদ্ধে নিজের সংগ্রাম, নিজেকে আত্মশুদ্ধি করার সংগ্রাম, তারা মিথ্যে কথা বলে। জিহাদ কাদের বিরুদ্ধে তা
স্পষ্ট করে দিয়েছে ৯/১২৩ নং আয়াত –
“অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা নিকটবর্তী তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, তারা তোমাদের মধ্যে
কঠোরতা দেখুক, জেনো রেখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গী।” জিহাদ যে অবিশ্বাসীদের
বিরুদ্ধে সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ৯/৭৩
ও ৬৬/৯ নং আয়াতেও - “হে নবী! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে
জিহাদ করো, তাদের প্রতি কঠোর হও।” যারা বলে যে
শত্রুদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে ইসলাম জিহাদের নির্দেশ দিয়েছে
তারা সত্যের বেসাতি করে। বদর যুদ্ধ, বানু মুস্তালিকের যুদ্ধ, খায়বার যুদ্ধ সহ
বহু জিহাদ মুহাম্মাদ নিজে করেছেন সম্পূর্ণ
বিনা প্ররোচনায়। একেবারে অতর্কিতে ইহুদিদের উপর মুহাম্মদ তাঁর সশস্ত্র
বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা ও লুটপাঠ করেছে এবং নারী ও শিশুদের ক্রীতদাসী/ক্রীতদাস বানিয়েছে। বিধর্মীদের পক্ষ থেকে প্ররোচনা বা আক্রমনের প্রশ্ন নেই, যারা
স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করবে না তাদের সকলের বিরুদ্ধেই জিহাদের আদেশ দিয়েছে ইসলাম। ৯/২৯ নং আয়াতে কোরান বলছে, “যারা আল্লাহ ও
পরকালে বিশ্বাস করে না, এবং আল্লাহ ও রাসূল যা বৈধ করেছেন তা বৈধ জ্ঞান করে না,
এবং যাদের গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা সত্য ধর্ম স্বীকার করে না, তোমরা
তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যে পর্যন্ত তারা অধীনতা স্বীকার করে স্বহস্তে
জিজিয়া প্রদান না করে।” জিহাদ কতদিন চলবে? মুহাম্মদের যুগ শেষ হয়ে
গেছে মানে কি জিহাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে? না। ৮/৩৯ নং আয়াতে কোরান বলছে
পৃথিবীতে যতদিন না ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় ততদিন জিহাদ জারি থাকবে। সেই ভাষ্যটি
এরূপঃ “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো যতদিন না ফিতনা [অশান্তি] দূর হয় এবং
সামগ্রিকভাবে আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হয়।” বস্তুতঃ ইসলাম হচ্ছে আদতেই হিংসা ও জিহাদের ধর্ম, ইসলাম হচ্ছে একটা সন্ত্রাসবাদী
ধর্ম। ইসলাম মানবজাতিকে সরাসরি বিশ্বাসী ও
অবিশ্বাসী – এই দুভাগে ভাগ করেছে। অবিশ্বাসিদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিশ্বাসীদের [মুসলমানদের] অবিশ্বাস ও ঘৃণা
করতে শিখিয়েছে। অবিশ্বাসিদের বিরুদ্ধে
জিহাদ করতে, ও তাদের হত্যা করতে কঠোরভাবে আদেশ দিয়েছে। জিহাদ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলচনা করেছি আমার ‘আধ্যাত্মিক
সংগ্রাম নয়, ‘জিহাদ’ হলো সহিংস রাজনৈতিক আগ্রাসন’ প্রবন্ধে। সেটা পড়তে এখানে
ক্লিল্ক করুন - www.giasuddinonline.blogspot.in/2014_07_25_archive.html ইসলামের এই শিক্ষা ও বাণী এ দেশের মুসলমান সমাজের ধর্মীয়
নেতারা কি জানেন না? খুব ভালই
জানেন। জেনেও বলেন যে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম, ইসলামে হিংসা ও হত্যার
স্থান নেই। খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ডে সেই বস্তাপচা রেকর্ডই তাঁরা আরো জোরে জোরে বাজাচ্ছেন। এই কঠিন সময়ে কেন তাঁরা এতো মিথ্যা প্রচারণা নতুন করে?
কেন তাঁরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে
কেন্দ্রীয় সরকার ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
তুলছেন? জিহাদি সন্ত্রাসবাদী
সংগঠনগুলির সঙ্গে কি তবে তাঁদের গোপন
বোঝাপাড়া কিছু আছে? খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত জেহাদিদের কি আড়াল করতে চাইছেন? মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে কি কাউকে ভয় দেখিয়ে আই.এন.এ-র তদন্তকে কি প্রভাবিত করতে চাইছেন? এই প্রশ্নগুলিরও উত্তর খোঁজা জরুরী গোয়েন্দাদের।
সংযোজনঃ [১]. অবশেষে ১৯.১০.১০ তারিখ বিষ্ফোরণ কান্ডের ১৭ দিন পর ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের সংগঠন সভা করে খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ ও জিহাদি কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করলো। কিন্তু অনেক প্রশ্ন রেখে দিয়ে গেলো এই সভা। কেনো ১৭ দিন সময় লাগলো মুখ খুলতে ইমামদের? সভাটি হয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর শহরের অখ্যাত একটি জায়গা বরজে। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা কলকাতায় না করে এত মফস্বল ও একটি অখ্যাত জায়গায় করা হলো? সভায় ইমামদের চেনা কোনো মুখকে দেখা যায় নি। যাঁরা ইমামদের মুখ এবং সরকার ঘনিষ্ঠ তাঁদের কাউকে দেখা যায় নি কেনো?
[২]. শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদ্রাসার পর আর একটা জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারখানা তথা ডেরা তথা মাদ্রাসার খোঁজ পাওয়া গেছে বীরভুম জেলার বোলপুরে। বোলপুর শহর লাগোয়া মুলুক গ্রামে এই মাদ্রাসাটি গড়ে তোলা হয়েছিলো।
দ্বিতীয় সংযোজনঃ [১]. আর একটি মাদ্রাসার খোঁজ মিলেছে যেখানে জঙ্গিরা ডেরা তৈরী করেছিল। এটিও মুর্শিদাবাদ জেলায়। ডোমকলের ঘোড়ামারা গ্রামে এই মাদ্রাসাটি অবস্থিত।
[২]. লালগোলা থানার মকিমনগরের মাদ্রাসাটি ছিলো জঙ্গিদের প্রধান ডেরা। এখানে বাংলাদেশের 'জেএমবি'র সদস্য সাজিদ হোসেন থাকতো যার হাতে পৌঁছে যেতো আইইডি ও সকেট বোমাগুলি বাংলাদেশে পাচার করার জন্যে। বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসতো এখানেই সাজিদের কাছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে সাজিদের কাছে পাচার হয়ে আসতো গাঁজা, চরস, সোনা সহ নানা বেআইনী জিনিষ। এসব জিনিষ করে পাওয়া টাকা ও হুন্ডির মাধ্যমে আসা টাকা সাজিদ পাঠিয়ে দিতো জঙ্গিদের বিভিন্ন ডেরায়।
[৩]. খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের 'জেএমবি'র যোগ আছে তা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল এন.আই.এ নিশ্চিত করেছে।
[৪] সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বর্ধমান শহরে প্রকাশ্য সভায় মুসলমানদের বলেছেন তারা যেন মাদ্রাসায় তদন্ত করতে ঢুকতে না দেয় কিংবা তদন্তকারী দলের সদস্যদের দেহ তল্লাশী করে তবে ঢুকতে দেয়। তিনি আরো বনলেছেন যে, তাঁরা ধরা পড়া জঙ্গিদের হয়ে মামলা লড়বেন।
গোয়েন্দা আধিকারিকদের তদন্তে বাধা দেওয়ার ডাক তো রাষ্ট্রোদ্রোহীতা যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে জঙ্গিদের পক্ষ নিয়ে মামলা লড়ার প্রকাশ্য ঘোষণা এর আগে কখনো শোনা যায় নি। এতো বড়ো ঔদ্ধত্য ও দুঃসাহস মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের হয় কীভাবে? সরকার এখনও সিদ্দিকুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করে নি এবং শাসক দলও তাঁর নিন্দা করে নি ? তাহলে জঙ্গিদের সঙ্গে সত্যিই কোনো যোগসূত্র রয়েছে এই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও শাসক দলের? এ সব প্রশ্ন ক্রমশঃ জোরালো হচ্ছে।