Wednesday, March 23, 2022

হিল্লা বিয়ের স্পষ্ট বিধান রয়েছে কোরানের মধ্যেই

 

হিল্লা বিয়ে, মুতা বিয়ে এবং দখলি বিয়ে – এই তিন প্রকার বিয়েও শরিয়তি বিয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর শুধু কেতাবেই নয়, আজো এই বিয়েগুলির প্রচলন রয়েছে মুসলিম সমাজেতবে এ কথাও ঠিক যে মুসলিম  সুন্নী সমাজে ‘হিল্লা বিয়ে’র প্রচলন বিদ্যমান থাকলেও ‘মুতা বিয়ে’ ও ‘দখলি বিয়ে’র প্রচলন বিশ্বের সর্বত্রই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কয়েক বছর আগেও মনে হচ্ছিল বিশ্ব জুড়েই মুসলিমরা এ দু’টো বিয়েকে চিরতরেই বর্জন করেছে মনে হয়েছিলো যে এই বিয়ে দু’টি চিরতরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, এবং ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের এ ধারণা যে ভুল তা আইএস (IS – Islamic State)  খুব সম্প্রতি প্রমাণ করেছে আইএস জঙ্গীরা সিরিয়া ও ইরাকে এখন ‘মুতা বিয়ে’ ও ‘দখলি বিয়ে’ দু’টিরই পুনঃপ্রবর্তন ঘটিয়েছে। আইএস  অধিকৃত অঞ্চলে স্বমহিমায় ফিরে এসেছে ‘মুতা বিয়ে’ ও ‘দখলি বিয়ে’। আইএস জঙ্গীরা মুহাম্মদের সেই বাণীকে অমোঘ বাণী বলে প্রমাণ করতে এখন ভীষণ  তৎপর।  মুহাম্মদের সেই বিখ্যাত বাণিটি হলো শরিয়তি আইন চিরন্তন ও চিরোনতুন,  শরিয়তি আইন পুরানো হয় না, বাতিলও হয় না, পৃথিবী যতোদিন থাকবে শরিয়তি আইনের প্রচলনও থাকবে, কারো শক্তি নেই যে এই আইন কোনোদিন পাল্টাতে বা বাতিল করতে পারে। আইএস -এর  কথা থাক। ফিরে আসি ‘হিল্লা বিয়ে’, ‘মুতা বিয়ে’ এবং ‘দখলি বিয়ে’র আলোচনায়। প্রথমে আলোচনা করবো ‘হিল্লা বিয়ে’ নিয়ে, তারপরে আলোচনা করবো ‘মুতা বিয়ে’ ও ‘দখলি বিয়ে’ নিয়ে। তবে ‘হিল্লা বিয়ে’ নিয়ে আলোচনা করার আগে এই বিয়ে তিনটির চরিত্র ও প্রকৃতি কীরূপ সে বিষয়ে আগাম একটু আভাষ দেওয়া যাক।

উক্ত তিন প্রকারের বিয়ের যে বিধি ও নীতিমালা তা নারীর পক্ষে যার পর নাই অবমাননাকর। নারী এই তিনটি বিয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপেই পণ্য।  মানুষ হিসেবে তাদের সমগ্র সত্ত্বা ও অস্তিত্ব এখানে অস্বীকৃত। তাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আপত্তি-সম্মতি, আগ্রহ-অনাগ্রহ ব্যক্ত করার অধিকার এখানে অপহৃত। দ্রপদীর বস্ত্র হরণের মতো তাদের সমস্ত মান-মর্যাদা এবং স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করা হয়েছে। দ্রপদীর শ্লীলতা ও সম্মান রক্ষার ব্যবস্থা তবু রয়েছে মহাভারতে, একটি অদৃশ্য হাত অনবরত কাপড় জোগান দিয়ে তাকে নগ্নতার হাত থেকে রক্ষা করেছে। এই তিনটি বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীর শ্লীলতা ও সম্মান রক্ষার কোনো রক্ষাকবচ নেই।  তাদেরকে পুরুষের পদতলে নগ্ন করে সমর্পণ করা হয়েছে যাতে তারা তাদের ইচ্ছা মতো অবাধে তাদের ভোগ করতে পারে। এই বিয়ে তিনটিতে নারীকে বিয়ের নামে বলাৎকার করার অনুমতি ও অধিকার দেওয়া হয়েছে পুরুষকে।  বিয়ের নামে নারীর উপর বলাৎকারের  কুৎসিত ও বর্বর বিধানকে আধুনিক যুগের মুসলমান ধর্মগুরুরাও মেনে নিতে পারেন নি। তাই তাঁরা এই বিয়ে দু’টিকে চিরতরে বর্জন করেছিলেন। বর্জন করার মানে তাঁরা এটা মেনে নিয়েছিলেন যে ‘মুতা বিয়ে’ ও ‘দখলি বিয়ে’-র বিধিমালা নারীর পক্ষে চরম অবমাননাকর এবং  অসভ্য, অমানবিক ও কুৎসিত প্রকৃতির যা সভ্য সমাজের অনুপযুক্ত। কিন্তু তাই বলে তাঁরা সেই বিধিমালায়  কোরান ও কোরানের প্রবক্তার কোনো দোষ দেখতে পান নি। তাঁরা বলেছেন তৎকালীন পরিস্থিতি ও পরিবেশের প্রয়োজনে ঐ বিয়ে দু’টির প্রবর্তন করা জরুরী ছিলো। তাঁরা আরো বলেন যে  এখন সে পরিস্থিতি ও পরিবেশ নেই, তাই ঐ বিয়ে দু’টি এখন অবৈধ হয়ে গিয়েছে। বিয়ে দু’টিতে কী এমন সব বিধি রয়েছে যে এ যুগে  সেগুলিকে রদ করতে হলো? সে আলোচনা হবে একটু পরে। এখন আলোচনা করা যাক ‘হিল্লা বিয়ে’ নিয়ে। 

 হিল্লা বিয়ে

হিল্লা বিয়ে হলো মুসলিম সমাজের একই পুরুষ এবং একই নারীর মধ্যে দুবার বিয়ে সম্পন্ন হওয়া। ব্যাপারটা রকমঃ ধরা যাক একজন স্বামী একদিন তুচ্ছ কারণে বা অকারণে  রাগের মাথায় স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে বসলো। কিছুদিন পর স্বামী দেবতার মাথা থেকে রাগের ভূতটি নেমে গেলে সে বুঝতে পারলো যে বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে। লোকটি এখন সেই ভুলটি সংশোধন করে পুনরায় তার স্ত্রীকে বিয়ে করে ফিরিয়ে নিতে চায়। অপরদিকে স্ত্রীও তার স্বামীকে পুনরায় বিয়ে করতে সম্মত এবং সে পুনরায় তার স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে চায়। স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরেছে, সে তার প্রাক্তন স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করে আবার নতুন করে সংসার পাততে চায়, এদিকে তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও তার প্রাক্তন স্বামীকে বিয়ে করতে তার সঙ্গে পুনরায় সংসার বাঁধতে চায় এটা তো মন্দের ভালো। খবরে স্বামী স্ত্রীর পরিবারের তো আনন্দিত হবার কথা, অনন্দিত হবার কথা পাড়া-প্রতিবেশী গ্রামের মানুষেরও। সবার পক্ষ থেকে হৈ হৈ করে তাদের সাধু ভাবনা সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো উচিত,  আনন্দ-উৎসবের পরিবেশে তাদের দ্বিতীয় বিয়ের পর্বটা যাতে সুসম্পন্ন হয় তার জন্যে দ্রুত পদক্ষেপ করা উচিৎ। কিন্তু না, ইসলাম বলছে, ওদের দ্বিতীয় বিয়েটা অতো সহজে সম্পন্ন করা যাবে না। ওদের মধ্যে আর বিয়েই হবে না না, ইসলাম তা অবশ্য বলছে না। ইসলাম বলছে যে, আল্লাহর সীমারেখাগুলি মেনে চলতে পারবে বলে ওরা যদি মনে করে, তবে নিশ্চয়ই ওরা পরষ্পরকে  পুনরায় বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু তার জন্যে ওদের একটি শর্ত পালন করতে হবে। শর্তটি হলো রকমঃ প্রথম স্বামীর তালাক প্রদানের পর স্ত্রীর ইদ্দতকাল অতিক্রান্ত হলে  তাকে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে করতে হবে। সেই অন্য পুরুষ অর্থাৎ দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দেবার পর ইদ্দতকাল শেষ হলে সে তখন তার প্রথম স্বামীর জন্যে হালাল (বৈধ) হবে। তখন তারা পরষ্পরকে বিয়ে করতে পারবে। এর মধ্যখানে যে বিয়েটা করতে হবে সেটাই হলো শরিয়তের ভাষায় হিল্লা বিয়ে প্রাক্তন দম্পত্তি মাঝখানে বিচ্ছেদের পর উভয়ের সম্মতিতে পুনরায় বিয়ে করে আবার নতুন করে দাম্পত্যজীবন শুরু করতে চাইলে সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের বাধা দেবে কেনো?  কে কাকে বিয়ে করবে বা করবে না, সে তো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়, কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র বাধা দিতে পারে না যে বিধির দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয় সে বিধি যার নামেই আসুক সেটা অগণতান্ত্রিক  প্রতিক্রিয়াশীল বিধি বৈ নয়। আর হিল্লা বিয়ে বিধি  দুজন মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্খা স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে শুধু তাই নয়, একজন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য একজন পুরুষকে বিয়ে করতে বাধ্য করছে।   বিধি তাই শুধু অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীলই নয়, এ বিধি নারীর পক্ষে ভীষণ অমর্যাদাকর ও অবমাননাকরও। শুধু অন্য পুরুষকে বিয়ে করলেই হবে না, ইসলাম তার সঙ্গে আর একটা অবশ্য পালনীয় একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছে ‘হিল্লা বিয়ে’র বিধিতে যা নারীর পক্ষে আরো  আপত্তিকর, অশ্লীল ও অবমাননাকর, এবং মানব সমাজের ইতিহাসে যা বোধ হয় সব চেয়ে জঘন্য ও কুৎসিত শর্ত। কী সেই শর্তটি? সেটা বলার আগে ইসলামের সংবিধানে ‘হিল্লা বিয়ে’র আইনে ঠিক কী বলা আছে সেটা দেখা যাক। এই বিয়েটির আইন কোরানের বাকারা সুরার ২৩০ নং আয়াতে লিপিবদ্ধ  রয়েছে। আইনটি বলছে, - ‘অনন্তর যদি সে তালাক প্রদান করে তবে এর পরে অন্য স্বামীর সাথে  বিবাহিতা না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য বৈধ হবে না, তৎপর সে তাকে তালাক প্রদান করলে যদি উভয়ে মনে করে যে, তারা আল্লাহর সীমাসমূহ স্থির রাখতে পারবে, তখন তারা যদি পরষ্পরে প্রত্যাবর্তিত হয় তবে উভয়ের পক্ষে কোনই দোষ নেই এবং এগুলোই আল্লাহর সীমাসমূহ, তিনি অভিজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্যে এগুলো ব্যক্ত করে থাকেন। (অনুবাদ – ইবনে কাসির) এই তর্জমাটি সঠিক ও যথাযথ কিনা সে বিষয়ে সংশয় নিরসনের জন্যে আর একজন ইসলামি পণ্ডিতের বঙ্গানুবাদ এবং ইংরাজী তর্জমাও দেওয়া যাক। বঙ্গানুবাদটি হলো -  অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে সে তার জন্য বৈধ হবে না, যে পর্যন্ত না অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহিত না হবেতারপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, এবং যদি উভয়ে মনে করে যে তারা আল্লাহ্‌র সীমারেখা রক্ষা করতে সমর্থ হবে, তবে তাদের পুনর্মিলনে কারও কোনো অপরাধ হবে না, এবং এটাই আল্লাহ্‌র সীমারেখা, আল্লাহ্‌ তা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। (ড.ওসমান গণি)  ইংরাজী অনুবাদটা হলো - ‘‘ So if a husband divorces his wife (irrevocably), he cannot, after that, re-marry her until she has married another husband and he has divorced her. In that case there is no blame on either of them if they re-unite; provided they feel that they can keep the limits ordained by Allah. Such are the limits ordained by Allah, which He makes plain to those who understand.’’  Holy koran Holuy Korand and prayer beads quran stock pictures, royalty-free photos & images

হিল্লা বিয়ের সঙ্গে আর একটি শর্ত রয়েছে বলে একটু আগে উল্লেখ করেছি। সেটা হলো এটা - শুধু বিয়ে করলেই হবে না, বিয়ে করার পর তাদের একটি অবশ্যই শর্ত পূরণ করতে হবে। সে শর্তটি আরো জঘন্য, আরো কুৎসিত, আরো ঘৃণ্য ও বর্বরতমশর্তটি হলো, অন্য পুরুষের সঙ্গে যদি এই শর্তে বিয়ে হয় যে তাদের মধ্যে যৌনমিলন সংঘটিত হবে না, শুধু নাম কা ওয়াস্তে তাদের বিয়েটা হবে এবং বিয়ের পর দ্বিতীয় স্বামীটি তাকে তালাক দিয়ে দেবেনা, তাহলে সে তার পূর্বতন স্বামীর জন্যে হালাল বা বৈধ হবে না। বিয়েটা এই শর্তেই হতে হবে যে দ্বিতীয় স্বামীটি তার সঙ্গে সহবাস করবে এবং সহবাসের সমস্ত সুখ দ্বিতীয় স্বামীটি ভোগ করবে। কোরানের ২৩০ নং ধারায় বা আয়াতে এই শর্তটি (দ্বিতীয় ও অস্থায়ী স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলন বাধ্যতামূলক) অবশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয় নি। সুতরাং ইসলামের অনুরাগী ও অনুসারীদের মনে হতে পারে যে এমন ঘৃণ্য শর্তের সঙ্গে  হিল্লা বিয়ের সম্পর্ক নেই। ইসলাম-বিদ্বেষীরা ইসলামকে হীন প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে শর্তটি জুড়ে দিয়েছে  না, মোটেই তা নয়। মুহাম্মদ স্বয়ং উক্ত আয়াতটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় এই শর্তটির কথা বলেছেন। সমস্ত সহিহ হাদিসে এটা বর্ণিত রয়েছে। রয়েছে উক্ত আয়াতের তফসিরেও।  দেখা যাক তফসিরে ঠিক কী বর্ণনা রয়েছে। তফসির বলছে,  – “যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে দু’তালাক দেয়ার পরে তৃতীয় তালাক দিয়ে ফেলবে, তখন সে তার উপর হারাম হয়ে যাবে। যে পর্যন্ত না অন্য কেউ নিয়মিতভাবে তাকে বিয়ে করতঃ সহবাস করার পর তালাক দেবেবিয়ে না করে যদি তাকে দাসী করে নিয়ে সহবাসও করে তথাপি সে তার পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে না। অনুরূপভাবে যদি নিয়মিত বিয়েও হয় কিন্তু দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সহবাস না করে থাকে তাহলেও সে পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে না।   

একটি হাদিসে রয়েছে যে, নবী (সঃ) – কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ ‘একটি লোক একটি স্ত্রী লোককে বিয়ে করলো এবং সহবাসের পূর্বেই তালাক দিয়ে দিল। অতঃপর সে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহিত হলো, সেও তাকে সহবাসের পুর্বে তালাক দিয়ে দিল। এখন কি তাকে বিয়ে করা তার পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে?’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘না, না। যে পর্যন্ত না তারা একে অপরের মধুর স্বাদ গ্রহণ করে। মুসানাদ-ই-আহমাদ, সুনানে ইবনে মাজাহ ইত্যাদি।

একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞাসিত হন, ‘একটি লোক তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছিলো। অতঃপর সে অন্য লোকের সাথে বিবাহিত হলো। এরপর দরজা বন্ধ করে ও পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে যৌন মিলন না করেই দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিল। এখন কি স্ত্রীটি তার পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে?’ রালুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘না, যে পর্যন্ত না মধুর স্বাদ গ্রহণ করে’ (সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)  (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ১ম-৩য় খণ্ড, পৃ-৬৪২, ৬৪৩)  পাঠক, লক্ষ্য করুন, তফসিরকার উক্ত শর্তটি সম্পর্কে মুহাম্মদের উম্মতদের (মুসলমানদের) মধ্যে যাতে বিন্দুমাত্র সংশয় বা দুর্বলতা তৈরী না হয় তার জন্যে একাধিক হাদিসকেও উদ্ধৃত করেছেন। একে তো হিল্লা বিয়েটাই নারী জাতির পক্ষে চরম লজ্জা ও অপমানের। তার সঙ্গে একজন অন্যপুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে বাধ্য করার শর্তটি জুড়ে দিয়ে নারীজাতির যে অপমান ও অবমাননা করা হয়েছে তা বর্ণনা করা মানুষের সাধ্যের বাইরে।

উক্ত জঘন্য শর্তগুলি পূরণ করলেই যে প্রাক্তন দম্পত্তি আবার পরষ্পরকে বিয়ে করে পুনরায় নতুন করে দাম্পত্যজীবন শুরু করতে পারবে তারও নিশ্চয়তা কিছু নেই। কারণ, হিল্লা বিয়ের আইনে এ কথা বলা হয় নি যে, যে লোকটির সাথে বিয়ে হবে সে লোকটি তালাকপ্রাপ্তা সেই নারীকে ভোগ করার পর তালাক দিতে বাধ্য। যেহেতু আইনে সে কথা বলা নেই, তাই লোকটি তালাক নাও দিতে পারে, এবং না দিলে তালাক দেওয়ার জন্যে তাকে বাধ্য করা যাবে না। অর্থাৎ একবার রাগের মাথায় উত্তেজনার বশে ভুল করে কেউ যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয় তবে তাদের পুনর্মিলনের জন্যে হিল্লা বিয়ের আইনে কোনো রক্ষাকবচ পর্যন্ত নেই। সুতরাং বিষয়টি হলো এই যে, ‘হিল্লা বিয়ে’টা শুধু একটি জঘন্য ও কুৎসিত আইনই নয়, আইন হিসেবেও এটা বড়োই দুর্বল আইন।    

Wednesday, March 9, 2022

শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে পারষ্পরিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও যুদ্ধের নেপথ্য কারণ

 গতকাল শুক্রবার (৪ঠা মার্চ) পাকিস্তানের পেশোয়ারে শিয়া মুসলমানদের একটি মসজিদে সুন্নি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসের একজন মানববোমার হামলায় ৬৫জন মুসলমান (সংখ্যাটা বাড়তে পারে) নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ২০০ জন। হামলা সংগঠিত করে আইএস সদর্পে জানিয়েছে,  Blue Mosque, Istanbul, People, Area

·         শুক্রবার, একটি শিয়া মসজিদে সফলভাবে হামলা চালিয়েছে আমাদের এক যোদ্ধা

নৃশংস এই গেরিলা হানার ঘটনাটি নিয়েই এ লেখার অবতারণা। ঘটনাটি আমাকে আহত করেছে ভীষণই, কিন্তু অবাক করে নি একটুও সেটা এজন্য যে, শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে এরূপ বীভৎস সন্ত্রাসী হানা ও পাল্টা হানার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। এই দুটি মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী হানা ধারাবাহিকভাবে অবিরাম ঘটে চলেছে যার বিরাম নেই। ভবিষ্যতেও এমন সন্ত্রাসী আক্রমণ যে সংঘটিত হবে তা নিয়ে কারো সংশয় আছে বলে মনে হয় না।   

শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব বহু পুরনো ও বৈরিভাবাপণ্ণ একটি দ্বন্দ্ব। এর সূত্রপাত হয় ৬৮০ খৃস্টাব্দে কারবালা যুদ্ধের সময়। প্রসঙ্গত আর একটি কথা উল্লেখ্যনীয় যে, শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে আরও বহু গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ বিদ্যমান। সুন্নী ও শিয়ারা যে সবাই ঐক্যবদ্ধ তা নয়। তাদের মধ্যেও বহু সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে যারা পরষ্পর যুদ্ধ ও সংঘর্ষে লিপ্ত। সুন্নীদের মধ্যে এই সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে যে দ্বন্দ্বটি সবচেয়ে বেশি প্রকটিত সেটি হলো আইএস ও তালিবানদের দ্বন্দ্ব। আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখলটা আইএস মেনে নিতে পারছে না। তাই আইএস একটার পর গেরিলা সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে আফগানিস্তানে। এসব হামলার লক্ষ্য হলো আফগানিস্তান থেক তালিবানি সরকারকে উচ্ছেদ করা। সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা থাক। এখন ফেরা যাক শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও ধারাবাহিক সংঘর্ষের আলোচনায় যেটা এই লেখার আলোচ্য বিষয়। 

 শিয়া-সুন্নি বিভাজন ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত

ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, কে খলিফা হবে তাই নিয়ে, মুসলিম সমাজ সর্বপ্রথম সরাসরি দু’ভাগে ভাগ হয় ৬৮০ খৃস্টাব্দে। ইসলামি সাম্রাজ্যের ৫ম খলিফা মৃত্যুর আগে তাঁর পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন। নবীর কনিষ্ঠ নাতি ইমাম হোসেন এবং তাঁর গুটি কয়েকজন সহযোগী সেটা মানতে পারেন নি। ফলত ইয়াজিদ যখন খলিফা হন তখন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে তিনি সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্য কতিপয় সঙ্গী নিয়ে তিনি কুফা শহরের পথে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যেই কারবালা নামক একটি প্রান্তরে খলিফার সৈন্যবাহিনী তাঁর পথরোধ করে এবং সেখানেই একটা অসম যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং সদলবলে হোসেন মারা যান। যুদ্ধটি ইতিহাসে কারবালা যুদ্ধ নামে খ্যাত। যুদ্ধটি হয় ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে।

সেই প্রথম মুসলিম সমাজ সরাসরি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একভাগ হোসেনের পক্ষ অবলম্বন করে এবং অপর পক্ষ খলিফা ইয়াজিদের। সেই যে দু’ভাগ বিভাজন হয়েছিলো সেটা যতদিন গেছে ততই দিনে দিনে আরও প্রকট ও তীব্র হয়েছে। আজও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেই দু’ভাগের একভাগকে বলা হয় শিয়া এবং অপরভাগকে সুন্নি। যারা হোসেনের পক্ষ অবলম্বন করেছিলো তারা শিয়া এবং ইয়াজিদের পক্ষালম্বীরা পরিচিত হয় সুন্নি হিসাবে।

ইমাম হোসেন ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে স্বীকার করেন নি, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন খলিফা পদের দাবিদার। তিনি যেহেতু নবীর নাতি ও বংশধর তাই ধরেই নিয়েছিলেন যে, খলিফা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তিনিই হবেন পরবর্তী খলিফা। তিনি মনেপ্রাণে এ কথা বিশ্বাসও করতেন যে, তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের একমাত্র  উত্তরাধিকার। তিনি তাই খলিফা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর দিন গুণতেন সর্বদা। কারণ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি যেহেতু নবীর নাতি তাই মুয়াবিয়া তাঁকেই পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যাবেন।

ইসলামি সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা এবং আরও সম্প্রসারণ করার জন্যে যে যোগ্যতা ও দক্ষতার আবশ্যক তা হোসেনের মধ্যে একদমই ছিলো না। তাছাড়া তাঁকে খলিফা করলে ইসলামি সাম্রাজ্যের গভর্ণরগণ কেউ মেনে নিতে পারতেন না কারণ, তাঁর আচার ব্যবহারে ইসলামি সাম্রাজ্যের গভর্ণরগণ সকলেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই মুয়াবিয়া পরবর্তী খলিফা হিসাবে হোসেনের কথা ভাবতে পারেন নি। মুয়াবিয়া এটাও লক্ষ্য করেছিলেন যে বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের হাল ধরার জন্যে যারা যোগ্য ব্যক্তই তাদের সকলের মধ্যেই খলিফা হওয়ার বাসনা ও আকাঙ্খা আছে। ফলে কোনো একজনকে নির্বাচন করলে বাকিরা প্রবলভাবে অসন্তুষ্ট যা ইসলামি সাম্রাজ্যের পতন ডেকে নিয়ে আসতে পারে। তাই তিনি তাঁর পুত্র ইয়াজিদকেই পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন।

মুয়াবিয়ার সেই চিন্তাভাবনার সঙ্গে তৎকালীন ইসলাম বিশ্ব সহমত ছিলেন এবং তাই ইয়াজিদকে সবাই খলিফা হিসাবে মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। শুধু বাদ সেধেছিলেন হোসেন এবং তাঁর পরিবার ও গুটিকয়েক অনুগামী। সেটা যে নিছকই ক্ষমতার স্বার্থে তা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট।  

প্রসঙ্গত একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। তা হলো এই যে, কারবালা যুদ্ধের সময় হোসেনের পক্ষে অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষের সমর্থন থাকলেও পরবর্তী পরবর্তী কালে সেই বিন্যাসটা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। আজকের মুসলিম বিশ্ব হোসেনের খলিফা হওয়ার দাবিকেই সমর্থন করে এবং মুয়াবিয়ার ইয়াজিদকে খলিফা করে যাওয়াটাকে প্রবলভাবে নিন্দা করে। এটা হওয়ার পেছনে রয়েছে যুক্তি ও আবেগের খেলা। সে সময় মুসলিম সমাজ তৎকালীন পরিস্থিতি বিচার ও পর্যালোচনা করেছিলো যুক্তি দিয়ে বিধায় তারা ইয়াজিদকে খলিফা নির্বাচন করাটা সমর্থন করেছিলো। আর এখন মুসলমানরা কারবালা যুদ্ধের ঘটনাটা বিচার করে তাদের নবী ও তাঁর বংশধরদের প্রতি আবেগ দিয়ে যার মধ্যে যুক্তি, পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবার লেশ নেই 

ত্রূটিপূর্ণ প্রথম খলিফা নির্বাচনই মুসলিম সমাজের বিভাজন অব্যশম্ভাবী করে তুলেছিলো

মুসলিমদের নবীর মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন আবুবকর। খুবই বিষ্ময়কর ও লজ্জাজনক ঘটনা হলো মুসলমানরা তাদের নবীর মৃতদেহের দাফন-কাফন (সৎকার) না করেই কে খলিফা (নবীর উত্ত্রাধিকারী) হবে তা নিয়ে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেই কলহের আপাত নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছিলো তিনদিন। স্বভাবতই তিনদিন পর নবীর মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়। প্রবল ঝগড়ার পর আবুবকর নির্বাচিত হন প্রথম খলিফা। আলোচনা বা ঝগড়াস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাত্র আবুবকর সহ মাত্র তিনজন সাহাবী। আবুবকরের খলিফা নির্বাচন অধিকাংশেরই মনপসন্দ হয় নি এবং তাদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করেন নি। যারা স্বীকার করেন নি এবং প্রকাশ্যেই আবুবকরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নবীর চাচাতো ভাই তথা জামাই আলি এবং নবীর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা তথা আলীর স্ত্রী বিবি ফাতেমা ফলে তখনই মানসিকভাবে মুসলিম সমাজে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।  এক দল আবুবকরের পক্ষ নেয়, আর এক দল আলি ও ফাতেমার।

আলি ও ফাতেমা এবং তাদের অনুগামীরা মনে করতেন যে নবীর মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা হওয়ার দাবীদার ছিলেন একমাত্র আলী, আর অন্য কেউ নয়। কারণ, আলী ছিলেন যুগপৎ নবীর বংশধর ও জামাই এবং ইসলামের একজন অসমসাহসী বীর ও যোদ্ধা। তারা এও মনে করতেন যে আবুবকর অন্যায়ভাবে আলীকে বঞ্চিত করে নিজে খলিফা হয়েছেন এবং তিনি বৈধ খলিফা নন। তাই তারা আবুবকরকে খলিফা হিসাবে স্বীকৃতি দেন নি এবং তাঁর কাছে বয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন নি। ফাতেমা আবুবকরকে বেইমান, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক বলে তাঁর বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিয়েছিলেন। খলিফা আবুবকর সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে কোনো কার্পণ্য করেন নি। তিনি ফাতেমার কাছ থেকে তার পিতার দেওয়া ফাদাকের একটি অতি উৎকৃষ্ট খেজুর বাগান কেড়ে নিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পর ওমরকে পরবর্তী খলিফা করে আলির বিরুদ্ধেও প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। ওমরও আলির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন কৌশল করে ওসমান গণিকে তৃতীয় খলিফা নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে।

আবুবকরের প্রথম খলিফা হওয়াটা ছিলো খুবই বিতর্কিত। তার ফলে অনিবার্যভাবেই ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজের একতায় প্রথম ফাটল সৃষ্টি হয়। তার পর সেই ফাটল দিনে রাতে ক্রমশ দৈর্ঘে ও প্রস্থে বৃদ্ধি পায়। এবং অবশেষে ৬ষ্ঠ খলিফা নির্বাচনকে ঘিরে প্রবল বিষ্ফোরণে মুসলিম সমাজ সরাসরি দু’ভাগে বিভক্ত ও খণ্ডিত হয়ে যায়। সেটা একটা লম্বা ইতিহাস। সেই ইতিহাস নিয়ে কারবালাঃ মিথ ও মিথ্যা’ নামে আমার লেখা একটি বই আছে।    

শিয়া ও সুন্নিদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ নিষ্পত্তি হবার নয়

এ যুগে মুসলিমরা (শিয়া ও সুন্নি নির্বিশেষে সকলেরই) বিশ্বাস করে যে ইসলামের আদর্শকে রক্ষা করতে গিয়ে হোসেন কারবালা যুদ্ধে আত্মবলিদান করেছিলেন। এ দাবিটির কোনো ঐতিহাসিক বাস্তব ভিত্তি নেই। খলিফা হওয়ার তীব্র বাসনার জন্যেই হোসেন বিদ্রোহ করে যুদ্ধ ডেকে আনেন এবং মারা যান। হোসেনের জন্যেই যেমন কারবালা যুদ্ধ হয়েছিলো এবং তাঁর জন্যেই মুসলিমরা দ্বিখণ্ডিত হয়ে শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিলো।

শুরুতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যেই শিয়া ও সুন্নিদের উদ্ভব হলেও পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় মতাদর্শগত বিষয়ও। শিয়া গোষ্ঠী মতাদর্শগতভাবে সুন্নি গোষ্ঠীর লোকজনকে মুসলমান বলেই মানে না। সুন্নিদের সঙ্গে শিয়াদের মতাদর্শগত বিরোধ রয়েছে মূলত দুটি বিষয়ে। তা হলো –

·         প্রথমতঃ সুন্নিদের মতে প্রথম চারজন খলিফা (আবুবকর, ওমর, ওসমান ও আলি) ছিলেন বৈধ ও সৎ খলিফা। শিয়ারা প্রথম তিনজনকে খলিফা বলে স্বীকার করে না। তাদের মতাদর্শগত দৃঢ় অভিমত হলো, মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন আলি। প্রথম তিনজন খলিফা অন্যায়ভাবে আলির সঙ্গে প্রতারণা করে খলিফা হয়েছিলেন।

·         দ্বিতীয়তঃ খলিফা ওসমান সর্বপ্রথম কোরান সংকলন করেন। সুন্নিরা সেটাকেই আল্লাহ্‌র প্রেরিত আসল কোরান বলে মানেন। শিয়ারা সেই কোরানকে জাল কোরান বলে প্রত্যাখান করেছেসেই কোরানের বিরুদ্ধে তাদের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তিনটি। যেমন এক. খলিফা ওসমান আসল কোরানের এক-চতুর্থাংশ পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। দুই. কোরানের অনেকগুলি ওহি সংশোধন করেছে। এবং তিন. ওসমানের কোরানে বহু প্রক্ষিপ্ত আয়াত/বাণী রয়েছে। অর্থাৎ ওসমান তাঁর তৈরি করা বহু কথা আয়াত হিসাবে কোরানে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন।

দু’জনের মধ্যে কিংবা দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে শুধু ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে থাকলে তার নিষ্পত্তি হওয়া অসম্ভব নয়। এর বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু দ্বন্দ্বের মূল কারণ যদি মতাদর্শগত হয় তবে সেই দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি বা সমাধান অসম্ভব। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো মতাদর্শগত কারণে। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ঐ একই কারণে দ্বিক্ষণ্ডিত হয়েছিলো। রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টিও একই কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়ে বলশেভিক পার্টি ও মেনশেভিক পার্টিতে বিভক্ত হয়েছিলো। দ্বিধা বিভক্ত বা ত্রিধা বিভক্ত হওয়ার পর সেই কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো আর কখনো তাদের মতাদর্শগত মতপার্থক্যের সমাধান করতে পারেনি। এই একই কারণে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার মতাদর্শগত পার্থক্য মুছে যাওয়ার নয়। সেজন্যেই তাদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে যে বৈরিতামূলক রক্তক্ষয়ী হিংস্র সংঘর্ষ ও যুদ্ধ চলছে তা আগামী দিনেও চলতে থাকবে। এটা মুসলিমদের উপর একটা ভয়ংকর অভিশাপ যার বীজ নিহিত আছে ইসলামের গর্ভে। তাই পৃথিবিতে যতদিন ইসলাম থাকবে ততদিন গত ৪ঠা মার্চ শুক্রবার পেশোয়ারের মসজিদে যে গণহত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেরূপ বীভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে থাকবে। আর সেই ধর্ম যুদ্ধে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা যত মারা পড়বে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সাধারণ গোবেচারা মুসলমানরা মারা পড়বে। এ হচ্ছে মুসলমানদের উপর একটা ভয়ংকর অভিশাপ যার বীজ নিহিত রয়েছে ইসলামের গর্ভে।

 

 

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...