Saturday, August 17, 2019

জম্মু-কাশ্মীরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত

জম্মু-কাশ্মীর যেভাবে ৩৭০ ধারা রদ করে রাজ্যটিকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে তা স্বাধীনোত্তর ভারতে একটি বেনজির ঘটনা। ঘটনাটা কি অভিপ্রেত ছিলো? কয়েকটি রাজ্য বাদে গোটা দেশের অধিকাংশ হিন্দুদের চোখে এটি একটি চমৎকার ঘটনা। তাদের কাছে এটি বহুদিনের একটি বহু প্রতিক্ষিত ঘটনা। আরএসএস ও বিজেপির অনুগামীরা তাই এই ঘটনায় মেতেছে বাঁধনহারা উল্লাসে। ভারত পাকিস্তানের ভুখণ্ডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও এয়ার স্ট্রাইক করার পর যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল তাদের চোখেমুখে তার চেয়ে ঢের বেশি উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে। এবার উচ্ছ্বাস যেন আক্ষরিক অর্থেই বাঁধনহারা।
শুধু বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছে এনডিএ-এর বাইরের কয়েকটি দলও। এমনকি যারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করেন বলে জাহির করতেন এবং আপাদমস্তক বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদবিরোধী তারাও কেউ কেউ এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন। উদ্বাহু হয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেই ছেদ পড়ে নি‌। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের অভিঘাতে ইউপিএ-এর ঘর পর্যন্ত ভেঙেছে। ভেঙেছে এমনকি কংগ্রেসের ঘরও। কংগ্রেসের কিছু নেতা ও সাংসদ দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারসরকারের পক্ষে সোচ্চারে সমর্থন প্রদান করেছেন। দলের আদর্শ, ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলাকে পদদলিত করেছেন অক্লেশে। অকপটে। কী করে সম্ভব হলো এটা? আরএসএস ও বিজেপির ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী অবস্থানে থেকেও যারা জম্মু-কাশ্মীর অপারেশনে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা কোন চোখে দেখছেন এই অপারেশনটিকে? তারাও কি সাধারণ হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীদের চোখে দেখছে? তারা যে এই ঘটনাটিকে ওদের চোখে দেখছেন না তা বুঝবো কী করে? কই, তারা তো ৩৭০ ধারার মতনই প্রায় অন্য ধারাগুলো - ৩৭১এ থেকে ৩৭১জে - রয়েছে সেগুলো রদ করার কথা বলছেন না? জম্মু-কাশ্মীরের ৩৫এ ধারার প্রায় সমগোত্রীয় অন্য যে ধারাগুলো রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া অন্য কয়েকটি রাজ্যে সেগুলো তো রদ করার দাবি জানাচ্ছেন না?
সরকার যখন কোনো পদক্ষেপ নেয় সেটা হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান, কোন পক্ষের পক্ষে কতটা ভালো বা মন্দ সেটা বড়ো বিবেচ্য হওয়া কাম্য নয় এদেশে। কারণ, এ দেশটা যে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ। সরকারের প্রতিটি কাজের বিচার হওয়া উচিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও আদর্শের মানদণ্ডে। সরকারের সমস্ত কাজের মূল্যায়ন করা উচিত সংবিধানের নিক্তিতে। কিন্তু ভারত সরকারের এই পদক্ষেপটি কি আমাদের দেশের নীতি ও আদর্শ এবং আমাদের সংবিধানের মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা সম্ভব? এ কথা ঠিক যে, পদক্ষেপটি সংসদের দু' কক্ষেই গৃহীত হয়েছে, এ কথাও ঠিক যে, হয়তো বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এই পদক্ষেপটির পেছনে রয়েছে, তার অর্থ কি এই যে, পদক্ষেপটি নি:সংশয়ে সাংবিধানিক দিক থেকে সঠিক ও শুভ পদক্ষেপ? পদক্ষেপটি কি আদৌ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে খাপ খায়?
এই পদক্ষেপটি কতটা গণতন্ত্রসম্মত, কিংবা কতটা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কিংবা আদৌ সংবিধানসম্মত হয়েছে কী না তা নিয়ে আলোচনা চলছে দেশজুড়ে। এই পদক্ষেপটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনেকেই সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন তা শোনা যাচ্ছে। সংবিধান মেনে কেন্দ্রীয় সরকার পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছে কী না সে বিষয়ে শেষ কথা বলবে সর্বোচ্চ আদালতই। তবু প্রত্যেক নাগরিকেরই অধিকার আছে এ বিষয়ে আলোচনা করার, নিজস্ব মতামত জ্ঞাপন করার। তাই আমিও এর উপর আমার মতামত ব্যক্ত করতে চাই। কিন্তু তার আগে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদ করা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই।
প্রথমেই সরাসরি ও অকপটে বলি যে এই ধারা দু'টি রদ করার বিরুদ্ধে আমি নই। ধারা দু'টি রদ করা হয়েছে বলে আমার কোনো খেদ বা ক্ষোভ নেই। ৩৭০ প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথমেই বলি যে, ৩৫এ ধারাটি সব সময়ের জন্যেই রদযোগ্য। কারণ, আইনটি তো আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী ও নারীবিরোধী। জম্মু-কাশ্মীরের কোনো নারী সে রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, সে তার পূর্ব পুরুষের সম্পত্তির কিছুই পাবেনা। এমনকি তার উত্তরাধিকারগণও বঞ্চিত হবে, এমন আইন যে কোনো সভ্য দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে যে অনুপযুক্ত ও বেমানান তা বলা বাহুল্য। কাশ্মীরের পুরুষ গোটা দেশের যে কোনো প্রান্তে যেখানে খুশী ব্যবসা বা চাকরি করতে পারবে, সেখানকার সম্পত্তি কিনতে পারবে, সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে, সেখানে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে, কিন্তু দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ জম্মু-কাশ্মীরে সে অধিকারগুলি ভোগ করতে পারবে না, এমন তীব্র বৈষম্যমূলক আইন কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় জোর অতি স্বল্প সময়ের জন্য প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু এমন আইন যা সংবিধানের মূল ধারার সঙ্গে অসামন্জস্যপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক তা চিরকাল বলবৎ থাকা সমীচীন নয়। তাই এই ধারাটি (৩৫এ) রদ করা অনেক আগেই উচিত ছিল। এবং ৩৫এ ধারার প্রায় অনুরূপ অন্য যে ধারাগুলো রয়েছে অন্যান্য রাজ্যে বা অঞ্চলে সেগুলিও রদ করা সমান কর্তব্য।
৩৭০ নং ধারা সম্পর্কে সংবিধানের একবিংশ অংশের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এটা একটা সাময়িক, পরিবর্তনসাপেক্ষ ও বিশেষ আইন (Temporary, transitional and special Act)। এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে তিনটি ক্ষেত্র (পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ) ছাড়া তাদের নিজস্ব সংবিধান তৈরি করার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারাটি সংবিধানে সংযুক্ত করার পেছনে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল - জম্মু-কাশ্মীরের জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান, সে রাজ্যের মানুষদের নিজস্ব জীবনধারা (কাশ্মীরিয়াত) অটুট ও অক্ষুন্ন রাখা এবং ধীরে ধীরে ভারতের বাকি অংশের মানুষের সাথে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সম্প্রীতি ও সংহতি নির্মাণ করা। এই ধারাটি সংবিধানে সংযুক্ত করা সাত দশক হয়ে গেছে। এটা নি:সন্দেহে দীর্ঘ সময়। এতদিনে এবার আমাদের এটা পর্যালোচনা করার সময় নিশ্চয়ই হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরকে উক্ত বিশেষ সুবিধা ও অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করার পরিণাম বা পরিণতি কী হয়েছে তা আমাদের এবার অবশ্যই পর্যালোচনা করে দেখা দরকার। আত্মনিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণকে স্বশাসনের যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তার কতটা সুফল পেয়েছে সে রাজ্যের মানুষ? সে রাজ্যের জনগণের নিজস্ব জীবনধারা তথা কাশ্মীরিয়াত কি অক্ষুন্ন রয়েছে? ভারতের বাকি অংশের জনগণের সঙ্গে সে রাজ্যের জনগণের সম্প্রীতি ও সংহতি গড়ে উঠেছে? তিনটি প্রশ্নের একটাই উত্তর - না, না, না। বরং হয়েছে উল্টোটাই। জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসনের ফলে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার অমুসলিম সমাজের মানুষ। তাদের অপরিসীম বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা দিনের পর দিন অত্যাচারিত ও নিপীড়িতও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কাশ্মীরি ব্রাক্ষণদের নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের কাশ্মীর ত্যাগ করে জম্মুতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করার বর্বর ঘটনাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবুও জম্মু-কাশ্মীরের কোনো সরকার এগুলিকে কোনো সমস্যা মনে করার সঙ্গত কারণ খুঁজে পায় নি। কোনো সরকারই তাদের প্রতি ধারাবাহিকভাবে হতে থাকা বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান করতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। স্বশাসনের ফায়দা কিন্তু সাধারণ মুসলিমরাও পাই নি। তা ভোগ করেছে মূলতঃ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণী, বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি ও মুসলিম মৌলবাদীরা। কাশ্মীরের সাধারণ মেহনতি মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? বিগত সাত দশকের শাসনে কখনও কি এগুলোর পর্যালোচনা হয়েছে? পর্যালোচনা করলে এ ছবিটিই স্পষ্ট হয় যে, জম্মু-কাশ্মীরের সেই মেহনতি মানুষগুলো যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ সাত দশক ধরে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ নং ধারার শুধু অপপ্রয়োগই হয়েছে। এই ধারাটি কি কাশ্মীরিদের কাশ্মীরিয়াত অটুট ও অক্ষুন্ন রাখতেও সফল হয় নি যে কথা আগেই বলেছি। তাদের কাশ্মীরিয়াত ধীরে ধীরে ইসলামিয়াতে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসলামী মৌলবাদী ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদী চিন্তাধারা ও নেটওয়ার্ক ক্রমশ বিস্তারলাভ করেছে, এবং মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে যার অভিঘাতে কাশ্মীরিয়াতি মূল্যবোধ ব্যাপক বিচ্যুতির কবলে পড়েছে। কাশ্মীরিয়াতি মূল্যবোধকে সরিয়ে সেখানে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে  ইসলামিয়াতি সর্বনাশা মূল্যবোধ। জম্মু-কাশ্মীর ও ভারতের বাকি অংশের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি কি গড়ে উঠেছে? বলা বাহুল্য যে, গড়ে ওঠেনি। বরং দিনে দিনে বেড়েছে দুরত্ব, অবিশ্বাস ও অসংহতি। না, বলছি না যে, এই ভয়ংকর ব্যর্থতা এবং নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক পরিণতির দায় বর্তায় এককভাবে জম্মু-কাশ্মীরের সরকারগুলির উপরেই। এর দায় রয়েছে ভারত সরকারেরও। কিন্তু প্রধানত ও প্রথমত দায় বর্তায় তো জম্মু-কাশ্মীরের সরকারগুলোর উপরেই। কারণ, সংখ্যালঘু তথা অমুসলিমদের প্রতি ন্যায় বিচার প্রদান করা ও তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার প্রধাান দায়িত্ব ছিল তো তাদের কাঁধেই। এবং ইসলামিয়াত তথা ইসলামাইজেশনের হাত থেকে কাশ্মীরিয়াতকে রক্ষা করার দায়িত্বটিও ছিল তাদের উপরেই। জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সংবিধানে ৩৭০ নং ধারা সংযুক্ত ক‍রার মূল উদ্দেশ্যগুলিই যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং উন্নতির প‍রবর্তে রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটেছে তা নিয়ে তো সংশয়ের কোনো অবকাশই নেই।  এহেন পরিস্থিতিতে ৩৭০ নং ধারা রদ করার জন্যে ক্ষোভ বা বিলাপ করার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে আমার হয় না।
৩৭০ ও ৩৭১ নং ধারার নানা উপধারাগুলো সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছিল কয়েকটি রাজ্যে বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িক কালের জন্যেই। না, আমি এটাও সমীচীন মনে করিনা যে, বিশেষ কয়েকটি রাজ্য আজীবন সেই বিশেষ ক্ষমতা ও সুযোগগুলি অনন্তকাল ভোগ করতে থাকবে। কারণ, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল বৈ সবল হতেই পারেনা। জম্মু-কাশ্মীরকে ৩৭০ নং দেওয়ার ফল যে ভালো হয় নি তা তো দিবালোকের মতন স্পষ্ট। অন্যান্য যে সব জায়গায় ঐ রকম বিশেষ ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েও যে কাজের কাজ কিছু হয় নি তা ঐ জায়গাগুলির দিকে চোখ ঘোরালেই বোঝা যায়। তাই ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদ করার জন্যে যারা গেল গেল রব তুলেছে তাদের সঙ্গে কন্ঠ মেলানোর প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। এবং এর পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরও তীব্র নিন্দা করছি যারা ৩৭১ নং ধারা ও তার উপধারাগুলি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে।
৩৭০ ও ৩৫এ নং ধারা দু'টি বিলোপে আমার আপত্তি নেই তো বটেই, বরং বিলোপই চাই। কিন্তু ভারত সরকার যে উদ্দেশ্যে ও যে পদ্ধতিতে ধারা দু'টা বিলোপ করেছে তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখন্ডিত করে তার রাজ্যের মর্যাদা (status of state) হরণ করার পদক্ষেপকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন যে ৩৭১ নং ধারাগুলো (৩৭১এ থেকে ৩৭১জে ধারাগুলো) রদ ক‍রা হবে না। তাঁর এই ঘোষণায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য ও মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মানুষদের মনে গভীর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সন্দেহ - এক. জম্মু-কাশ্মীর ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলেই কি ৩৭০ নং ধারা বাতিল করা হলো? সন্দেহ - দুই. রাজ্যটিকে দু'টুকরো করা হলো কি একমাত্র বৌদ্ধ অধ্যুষিত ক্ষুদ্র ভুখন্ড লাদাখকে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেবার জন্যে? যা করা হয়েছে তা নাকি জম্মু-কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্যে আর জম্মু-কাশ্মীরের বিকাশের জন্যে! এসব ভালো ভালো সুন্দর সুন্দর কথা বলে কি কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি যদি মনে করে যে তাদের উদ্দেশ্য ও মনোভাব সম্পর্কে মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবে তবে বলবো যে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে।
যেভাবে আচমকা কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭০ ও ৩৫এ নং ধারা রদ করে জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখন্ডিত করেছে তাতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। কার্যত সংসদের দু'টি কক্ষকে ফাঁকি দিয়েই ঐ ধারা দুটি রদ এবং রাজ্যটিকে দুটি অংশে বিভাজিত করার বিলটি পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবং অস্বাভাবিক তৎপরতায় ও দ্রুততায় বিলটিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে বিলটিকে আইনে পরিণত করা হয়েছে। সংবিধানের দু দুটো ধারা বাতিল করা, এবং একই সঙ্গে কোনো একটি রাজ্যকে দ্বিখন্ডিত করে তার রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া একটা মস্তবড় পদক্ষেপ। এটা আমাদের দেশে একটি বেনজির ঘটনাও বটে। বস্তুত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা যে হতে পারে তা ভাবাই যায় না।  সংবিধান থেকে কোনো ধারা বাতিল করতে হলে সংসদকে তা অনেক আগেই অবহিত করা  এবং সেখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা একান্ত আবশ্যক যাতে সাংসদগণ তাদের মূল্যবান মতামত সংসদ কক্ষে রাখতে পারেন। এমনকি এ রকম বিষয়ে সংসদের বাইরেও আলোচনা করা দরকার যাতে সংসদে যাদের প্রতিনিধি নেই তারাও সরকারের কাছে তাদের মতামত জ্ঞাপন করতে পারে। আর কোনো রাজ্যকে ভেঙে দু'টুকরো করতে হলে শুধু সংসদের নয় সে রাজ্যের আইনসভাতেও ব্যাপক আলোচনা করা, সে রাজ্যের জনগণের মতামত জানা জরুরী। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর বিকল্প নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এতো বড়ো একটি কর্মকান্ড সম্পন্ন করে মাত্র দুদিনে‌। একদিন নামমাত্র আলোচনা করা হয়েছে লোকসভায় এবং একদিন রাজ্যসভায়। এভাবেই বিলটি তড়িঘড়ি সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিলটি সংসদে উত্থাপন করাও হয়েছে প্রায় অকস্মাৎই। কোনো বিল সংসদে আনার যথেষ্ট আগে সংসদদের আগাম নোটিশ দেওয়ার যে রীতি চালু আছে সে রীতিটি সচেতনভাবেই লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফলে অনেক সদস্যই সেদিন সংসদে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। আসলে সরকার তো চেয়েই ছিল সাংসদদের কম উপস্থিতি যা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।
এর আগে ভারতের অনেক রাজ্যকেই ভাঙা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় দিনের পর দিন ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে, বিধানসভার বাইরেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত নেওয়া হয়েছে, সংসদেও দীর্ঘ সময় ধরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাজ্য পুনর্গঠনের এটাই তো সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতি ও পদ্ধতি। কেন্দ্রীয় সরকার সেই রীতি ও পদ্ধতিকে নস্যাৎ করেছে, পদদলিত করেছে। এটা আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষ অশনিসংকেত।
৩৭০ নং ধারা গ্রহণ বা বর্জন করার জন্য কি কি করণীয় সে বিষয়ে ভারত সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। সে চুক্তিটিও ভঙ্গ করেছে সরকার। উক্ত চুক্তিতে ৩৭০ নং ধারা গ্রহণ কিংবা বর্জন করার সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এবং সে রাজ্যের বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে তৈরি গণপরিষদের উপর। বলা বাহুল্য যে বিধানসভা ও গণপরিষদে গৃহীত হবার পরই ৩৭০ ধারাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারত সরকার ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদলের মধ্যে সম্পাদিত হওয়া চুক্তি অনুসারে ঐ রাজ্যের বিধানসভা ও গণপরিষদ সেটি গ্রহণ না করে বর্জন ক‍রতেও পারতো। অথচ এমন একটা সময়ে আচমকা এই ধারাটি বাতিল করা হলো যখন সেখানে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পর রাজ্যপালের শাসন তথা রাষ্ট্রপতির শাসন তথা বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন জারি রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো রাজ্যের জন্যে চালু করা বিশেষ আইন রদ করা অসমীচীন। অসমীচীন দুদিক থেকেই। কী ভারত সরকার ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের মধ্যে হওয়া সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে, কী ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি ও নীতি অনুসারে, উভয় দিক থেকেই রাজ্যের জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে অন্ধকারে রেখে রাজ্যের পুনর্গঠন করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। কেন্দ্রীয় সরকার তথাপি এই বিতর্কিত কাজটিই সম্পন্ন করে বসলো। এ কাজ করে কেন্দ্রীয় সরকার শুধু গণতন্ত্রের রীতিনীতিকেই নগ্নভাবে লঙ্ঘন করে নি, প্রশ্ন উঠেছে সংবিধানকেও লঙ্ঘন করেছে কী না তা নিয়েও। অবশ্য এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলবে সর্বোচ্চ আদালত।
৫ই আগষ্ট জম্মু-কাশ্মীরকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। তার ২-৩ দিন আগে থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার গোটা রাজ্যটিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ দিয়ে গোটা রাজ্যটিকে মুড়ে ফেলা হয়েছে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা, চারিদিক সুনসান। সেনা-আধাসেনার বুটের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। মানুষের রুটিরুজি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাভাবিক জীবন স্তব্ধ। শত প্রয়োজনেও মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে সাহস করছে না, রাজ্যের বাইরে যেতে পারছে না, যারা বাইরে আছে তারা ঘরে ফিরতে পারছে না। গোটা রাজ্যে ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার গোটা উপত্যকাটিকে কার্যত  কারাগার বানিয়ে ফেলেছে। এসব করা হচ্ছে নাকি জম্মু-কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্যে, রাজ্যের মানুষের বিকাশ ও উন্নতি করার জন্যে! বটে!
সন্ত্রাস মুছে দেওয়া হবে মানুষকে সঙ্গে না নিয়েই? সন্ত্রাস মুছে দেওয়াটা আসলে বাহানা, আসল উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্র মুছে দেওয়া এবং মুসলিমদের হীনবল করা ও কোনঠাসা করা।
                            শেষ


[বি:দ্র:- ৫ই আগষ্ট যেদিন ৩৭০ নং ধারা রদ এবং জম্মু-কাশ্মীরকে দু'টুকরো করা হয় সেদিন খুব সম্ভবত ওড়িশার বেরহামপুর শহরে ছিলাম। খবরটি জানার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে আমার প্রতিক্রিয়া পোস্ট করি। সেই পোস্ট দেখে একটি বাংলা অনলাইন পোর্টালের (যে কাগজে মাঝে মাঝে লিখি) কর্ণধার ঐ  বিষয়ে একটি লেখা পাঠাতে বলেন। ওড়িশা থেকে বাড়ি ফিরে দ্রুত এই লেখাটি লিখে ফেলি। লিখতে লিখতেই মনে হয়েছিল লেখাটি সম্পাদকের পছন্দ হয়তো হবে না। সেটা তাঁকে জানিয়েছিলামও। তবু তিনি লেখাটা পাঠাতে বলেন। যথারীতি পাঠিয়েও দি। কিন্তু আমার আশঙ্কাটাই সত্যি প্রমাণিত হয়। তিনি লেখাটা ছাপান নি। এটা হতেই পারে, সব লেখা ছাপানো নানা কারণে সম্পাদকের হয় না। কিন্তু আশা করেছিলাম যে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে লেখাটা ছাপানো হবে না। লেখাটা ছাপানো হচ্ছে না যখন বুঝলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপর আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কাহিল হয়ে পড়ি। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। তবুও কষ্ট করে লেখাটি আমার ব্লগে আপলোড করবার সিদ্ধান্ত নি‌। তাই এত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি ব্লগে আপলোড করতে দু'মাস বিলম্ব হলো।]




KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...