Tuesday, September 25, 2018

তিন তালাকের বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ


তিন তালাককের বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স জারি মোদি সরকারের একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গত ১৯ শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সে সই দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরিয়তি তিন তালাক আইন একটি দণ্ডনীয় ফৌজদারী অপরাধে রূপান্তরিত হয়ে গেলোএর ফলে ভারতের মাটিতে তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের একটি অধ্যায় সমাপ্ত হলো। মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীর মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এই অধ্যায়টি ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই ইতিহাসটি রচনায় নরেন্দ্র মোদি অপ্রত্যাশিতভাবে যে ভূমিকাটি পালন করলেন তার জন্যে ইতিহাসে তাঁর নামও লেখা থাকবে। কারণ, এটা স্বীকার করতেই হবে যে তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের সংগ্রাম সাফল্য পেত না নরেন্দ্র মোদি তাদের সংগ্রামের পাশে অকুতোভয়ে দৃঢ়ভাবে না দাঁড়ালে।


কী কী আছে অর্ডিন্যান্সে তা এক নজরে দেখা যাক। (এক). সরাসরি মুখে, চিঠিতে, টেলিফোনে, এসএমএসে, হোয়াটসঅ্যাপে, বা অন্যভাবে তিন তালাক প্রদান সম্পূর্ণ বেআইনী। (দুই). তিন তালাক প্রদান শাস্তিযোগ্য ফৌজদারী অপরাধ – তিন বছর জেল ও জরিমানা। (তিন). তিন তালাক প্রদান জামিন আযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশ অভিযুক্তকে জামিন দিতে পারবে না। আদালতের হাতে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছেতবে বিচারকও স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে তাঁর সম্মতি ব্যতীত জামিন দিতে পারবেন না। এবং দু’পক্ষের কথা শুনে সন্তুষ্ট হলে বিচারক মামলা তুলে নিতেও পারবেন।  (চার). তিন তালাকের বিরুদ্ধে স্ত্রী কিংবা তাঁর বাবার বাড়ির যে কেউ থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারবে। (পাঁচ). তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার নিজের ও সন্তানসন্ততির জন্য খোরপোষ চায়তে পারবেন। (ছয়).  সন্তান মায়ের কাছে থাকবে।          
গত বছর লোকসভায় যে বিলটি পাশ হয় তার উপর কয়েকটি সংশোধনী-সহ এই অর্ডিন্যান্সটি জারি করা হয়সংশোধনী আনা হয়েছে বিরোধিদের দাবির ভিত্তিতে। বিলে ছিল যে কেউ অভিযোগ জানাতে পারবে বিলে বিচারকের জামিন দেওয়ার এবং মামলা তুলে নেওয়ার ক্ষমতা ছিলো না। কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধিদের দাবি মেনে সংশোধনী-সহ রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করে। কিন্তু তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা বিলটি পাশ হতে দেয় নি। তাই সরকারের কাছে অর্ডিন্যান্স জারী করা ছাড়া অন্য বিকল্প ছিলো না। মুসলিম নারীদের তালাকের খড়্গ থেকে বাঁচাতে এবং তাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সরকারের পক্ষে এই অর্ডিন্যান্সটি জারি করা জরুরী হয়ে পড়েছিলো 
অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে বিরোধিপক্ষ সমস্বরে হৈ চৈ শুরু করেছে। সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে তাঁরা যেভাবে একই সুরে বিলের বিরোধিতা করেছিল ঠিক সেভাবেই তারস্বরে গলা ফাটাচ্ছে অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধেও। হাজার চেষ্টা করেও মোদির সরকারকে ভোটে হারাবার ক্ষেত্রে তাঁরা একমত ও জোটবদ্ধ হতে না পারলেও মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে তারা সবাই এককাট্টা সংসদের ভিতরে ও সংসদের বাইরে, সর্বত্রই, বিরোধীদলগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে কে কত বেশী মুসলিম ধর্মগুরু ও মুসলিম পুরুষদের পদলেহন করতে পারে তারই। এক্ষেত্রে ডান বামে কোনো প্রভেদ নেই। মুসলিম নারীদের অন্যায় তালাকের জুলুম থেকে রক্ষা করা, ওদের একটু নিরাপত্তা দেওয়া এবং ওদের হাতে কিঞ্চিত ক্ষমতা তুলে দেওয়ার যে প্রয়াস করছে বিজেপি সরকার তাকে বাঞ্চাল করতে গোটা বিরোধী পক্ষই ঐক্যবদ্ধভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আধুনিক যুগে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিশ্চিতভাবেই এটা একটা জঘন্য দৃষ্টান্ত ও কুৎসিত অধ্যায়।
তিন তালাক আইনটি মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অংশ। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি যে সম্পূর্ণ নারীবিরোধী ও পুরুষকেন্দ্রিক তা মুসলিম বিশ্বেও স্বীকৃতি লাভ করেছে আর তাই তো ২২টি মুসলিম দেশ - যার মধ্যে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত –  তিন তালাক আইনকে নিষিদ্ধ করেছে ২২টি মুসলিমদেশেই আদালতের মাধ্যমে তালাক প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে এবং স্ত্রীকেও তালাক দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ঐ দেশগুলি বহুবিবাহকেও নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অথচ ভারতের মত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে তিন তালাক আইন-সহ  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি আজও অপরিবর্তিত ও অক্ষত রয়েছে যা বিশ্বের সামনে আমাদের মাথা হেঁট করেছে।   
কংগ্রেস দল দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তিন তালাককে বেআইনি ও দণ্ডনীয় ফৌজদারী অপরাধে রূপান্তরিত করে আজ যে গৌরবজনক ইতিহাস তৈরী করলেন সে ইতিহাস তৈরী করার সুযোগ ছিলো জহরলাল নেহরু উত্তর যুগের কংগ্রেস দলের প্রধানমন্ত্রীদের সামনে। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ সে দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে অর্পণ করে যান। সংবিধানের নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা আছে যে, সংবিধানে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তর্ভুক্তি একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র, যত দ্রুত সম্ভব এটা বাতিল করে সবার জন্যে একই আইন প্রণয়ন করতে হবে। কংগ্রেস দলের কোনো প্রধানমন্ত্রীকেই সংবিধানের সেই নির্দেশনা কার্যকরী করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায় নি। বরং তাঁরা সচেতনভাবে তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন। পশ্চাদপদ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি বাতিল করার পরিবর্তে তাকে আরও সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছেন। যেমন দৃষ্টান্ত এক - কংগ্রেসের সবচেয় জনপ্রিয় নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের নির্দেশনার বিপরীত পথে হেঁটে ১৯৭২ সালে তৈরী করে দেন নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ (All India Muslim  Personal law Board) ইন্দিরা গান্ধীর এই পদক্ষেপটি মুসলিম সমাজের বিরাট সর্বনাশ করেছে। এর পেছনে অতিশয় হীন একটা উদ্দেশ্য ছিলো। তা হলো মুসলিম সমাজকে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে আরো নিবিড়ভাবে যাতে শৃঙ্খলিত করতে পারে তার জন্যে মুসলিম ধর্মগুরুদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। দৃষ্টান্ত দুই – ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন সুপ্রিম কোর্ট শাহবানুর খোরপোষ মামলায় তাঁর পক্ষে রায় দেয়। সে রায়ের মূল কথা ছিল এই যে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর যদি তার নিজের ও সন্তানের ভরণপোষনের সামর্থ না থাকে তবে তার স্বামীকে তাদের খোরপোষ দিতে হবে। মানবতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটা ছিল একটি ঐতিহাসিক রায়। মুসলিম ধর্মগুরুগণ কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রায়টি বাতিল করার জন্যে সরকারের কাছে দাবী জানায়।  ইন্দিরা গান্ধী নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ তৈরী করে মুসলিম ধর্মগুরু ও গোঁড়া মুসলমানদের মাথায় তুলে দিয়েছিলেন, ফলে তারা সুপ্রীম কোর্টের রায়কে বাতিল করার দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করার ঔদ্ধত্য ও দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলো। রাজীব গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে মোল্লা সমাজের পক্ষে দাঁড়ান। সংসদে বিল এনে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খারিজ করে দেন। রাজীব গান্ধীর এই পদক্ষেপটিও যে মুসলিম সমাজের বিরাট সর্বনাশ করেছে তা বলা বাহুল্য। ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে মুসলিম নারী ও মুসলিম সমাজের এরূপ ভয়ঙ্কর সর্বনাশ করেন একদম বিনা বাধায়। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কোনো বাম বা ডান দলই বিরোধিতা করে নি। কংগ্রেস এ সব হীন করেছে মুসলিম ভোট পাবার স্বার্থে। কারণ মুসলিম সমাজে পুরুষরাই নারীর ভোটও নিয়ন্ত্রন করে। ঐ একই কারণে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও হয় চুপ ছিলো না হয় ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে সমর্থন করেছিলো। বামপন্থীরা খুব আদর্শ ও নীতির বড়াই করে। বলে যে, নীতি ও আদর্শের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যেই নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার স্বার্থে নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করতে তারা একবারও দ্বিধা করে নি।   
কংগ্রেস, অন্যান্য অধিকাংশ পেটি বুর্জোয়া দল ও তামাম বামপন্থী দলগুলি নির্লজ্জভাবে সেই ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে। ফলে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার যখন মুসলিম নারীর স্বার্থে তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছে তখন তারা নানা অজুহাতে তুমুল বিরোধিতা করেছে। লোকসভায়  বিরোধিতা করেছে, রাজ্যসভায় বিরোধিতা প্রবল বিরোধিতা করে বিলটি আটকে দিয়েছে, এখন অনন্যোপায় হয়ে সরকার যখন অর্ডিন্যান্স জারি করেছে তখনও বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওঁদের অজুহাতগুলি ছেঁদো বা বিভ্রান্তিমুলক বৈ নয়।  ওঁরা কী কী বলছেনঃ
·         এক). ভোটের স্বার্থে তিন তালাক নিষিদ্ধ করতে চাইছে বিজেপি। তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ তো জনস্বার্থ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী একটি পদক্ষেপ। ভোটের স্বার্থেই বিজেপি যদি এ কাজটি করে সেটা কি দোষের?
·         দুই). সামনে লোকসভা ভোট তাই বড্ড তাড়াহুড়ো করে অর্ডিন্যান্স এনেছে সরকার। এ অভিযোগটি বিভ্রান্তিকর বৈ নয়। কারণ, ক). তিন তালাক নিষিদ্ধ করার বিলে তারা সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছে। তাদের কয়েকটি দাবী মেনে বিলে সংশোধনী আনা সত্ত্বেও তারা দু দু’বারই রাজ্যসভায় সর্বাত্মক বিরোধিতা অব্যাহত রাখে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে  বিলটিকে আটকে দেয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, তিন তালাক বেআইনী করতে অর্ডিন্যান্স ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প কিছু ছিলো না।
·         তিন). সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু তিন তালাক বেআইনি ঘোষণা করেছে তাই তিন তালাক বাতিল করতে আইন প্রণয়ন করায় তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন ছিল না। এটা এক ধরণের ডাহা মিথ্যাচার। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক বেআইনি বলে রায় দিলেও তিন তালাক অব্যাহত রয়েছে এবং তিন তালাকের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে পুলিশ আইন নেই বলে অভিযোগ নিচ্ছে না। সরকারি হিসেব মতে সুপ্রিম কোর্ট রায়ের (২৯/৮/১৭) পর এ বছর (২০১৮) ১৩ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০১ টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। তালাকের সব ঘটনার খবর সরকারের কাছে থাকে না। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে, তিন তালাকের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যাটা আরো অনেক বেশী। এই পরিসংখ্যানটি প্রমাণ করে যে সরকারের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে অর্ডিন্যান্স জারি করার অভিযোগটি করে বিরোধিরা কত বড়ো মিথ্যাচার করছে।      
·          চার). তিন তালাক দেওয়ার অপরাধে স্বামীর কারাবাসের বিধিতে আপত্তি তোলা হচ্ছে এই অজুহাতে যে, এটা স্ত্রীর পক্ষেই ক্ষতিকর, কারণ স্বামীর জেল হলে কে খোরপোষ দেবে? এটাও একটা প্রতারণামূলক অজুহাত। কারণ, শরিয়তি তালাক আইনে খোরপোষ দেওয়ার বিধান নেই। সুতরাং স্বামীর জেল না হলে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী খোরপোষ পাবে, জেল হলে পাবে না - এমন কথা বলার অর্থ হলো মুসলিম নারীর সাথে সজ্ঞানে প্রতারণা করা।   
·         পাঁচ). তিন তালাক বাতিল আইনের বিরুদ্ধে তাদের আর একটি বড় আপত্তি হলো এই যে, এই আইনের না কি পুরুষদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার হতে পারে। এরূপ অভিযোগ উত্থাপন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, তিন তালাক না দিলে কারো বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং এটা একটা হাস্যকর অজুহাত বৈ নয়। নির্লজ্জ মানুষদের পক্ষেই এমন অজুহাত খাড়া করা সম্ভব।
তিন তালাক নিয়ে বিজেপি ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে যে তীব্র লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। বিজেপি ও বিরোধীদের মধ্যেকার লড়াইটা আসলে মুসলিম নারী বনাম মোল্লাতন্ত্রের লড়াই। মুসলিম নারী বনাম মুসলিম পুরুষদের লড়াই। এই লড়াইয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি পক্ষ নিয়েছে মুসলিম নারীরএটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। অবিশ্বাস্য, কারণ, আরএসএস ও বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যে অবিচল এবং তাদের মূল প্রতিপক্ষ হলো ইসলাম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। তথাপি মোদিজি তিন তালাককে বেআইনী করতে কেন এত তৎপর ও সংকল্পবদ্ধ তা এক বিরাট রহস্য। অপরপক্ষে তথাকথিত সংখ্যালঘু (মুসলিম) দরদি এবং নারীর সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা সরাসরি নগ্নভাবে মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করছেনএটা প্রমাণ করে যে, এ দেশে এ যুগে কোনো রাজনৈতিক দলেরই নীতি ও আদর্শ বলতে কিছু নেই। এই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনগণ যাঁরা পান থেকে চূণ খসলে, কিংবা কোথাও  মানবাধিকারের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ মুখর হন তাঁরা চূড়ান্ত রূপে মূক ও বধির সেজে বসে রয়েছেন। তাঁদের এই ভূমিকা শুধু হতাশাব্যাঞ্জকই নয়, ভীষণ লজ্জাজনকও। অন্যদিকে মিডিয়ার বৃহৎ অংশ কার্যতঃ অবস্থান নিয়েছে নিয়েছে মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে কংগ্রেস, টিএমসি, সিপিআই, সিপিএম সহ তামাম বিরোধী পক্ষ তিন তালাক বিরোধী বিল ও অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার করছে সেগুলিকেই তারা ব্যাপক মাত্রায় প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছেপ্রধানতঃ বাণিজ্যিক কারণেই যে মিডিয়া এই অন্যায় পক্ষপাত করছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু নাগরিক সমাজ কেন অন্ততঃ  বিবেকের তাগিদে মুসলিম নারীর ন্যায় লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াবার সৎসাহস দেখাতে পারছে না তা চরম বিষ্ময়কর ব্যাপার। নাগরিক সমাজের এই কাপুরুষোচিত বধিরতাকে নিন্দা জানাবার ভাষা আমার নেই।

Saturday, June 16, 2018

হিজাব সকল মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোজ্য, কেবল মুহাম্মদের পত্নী ও কন্যাদের জন্যে নয়


হিজাব কী শুধু মুহাম্মদের পত্নী ও কন্যাদের জন্যে প্রযোজ্য, না কি সকল মুসলিম নারীর জন্যেই? এ প্রশ্নে মুসলিম সমাজ দ্বিধা বিভক্ত। মুসলিম সমাজ আবার বহুধা বিভক্ত হিজাব পরার ধরণ নিয়ে। বহুধা বিভক্ত হিযাবের প্রেক্ষাপট নিয়েও। বহুধা বিভক্ত হিজাবের পোশাক নিয়েও। হিযাবের তৃতীয় ও চতুর্থ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের প্রচুর অবকাশ রয়েছে। কিন্তু প্রথম দুটি বিষয় নিয়ে মতভেদ থাকার কথা নয়। তবুও আছে প্রবলভাবেই আছে।
হিজাব কাদের জন্যে তা নিয়ে মতভেদ ও বিতর্ক কেন?
 
Hijab for safety of women, ensures they're not harassed
হিজাব নিয়ে মতভেদ ও বিতর্ক যেটা আছে সেটা তৈরী করা। ইসলামি বিধানে অস্পষ্টতা বা ধোঁয়াশা থাকার কারণে বিতর্ক ও মতভেদ তৈরী হয়েছে এমনটা আদৌ নয়। হ্যাঁ, আবারো বলছি যে, হিজাব কাদের জন্যে প্রযোজ্য এবং কীভাবে হিজাব পরতে হবে সে বিষয়ে ইসলামি বিধান অত্যন্ত প্রাঞ্জল যেখানে অস্পষ্টতা বা ধোঁয়াশা একেবারেই নেই। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিজাব নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণের মধ্যে যাঁরা মডারেট তকমাধারী বুদ্ধিজীবী তাঁরাই এই বিতর্কের স্রষ্টা। এই বুদ্ধিজীবীরা ইংরাজী পরিভাষায় apologist বলে  পরিচিতএঁরা ইসলামের পশ্চাদপদ, বর্বর ও অমানবিক বিধানগুলিকে প্রাণপণ আড়াল করার চেষ্টা করেন এবং সেই বিধানগুলির মনগড়া বাখ্যা দিয়ে ইসলামের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে দেখানোর চেষ্টা করেন। এঁরাই বলেন যে, হিজাব প্রযোজ্য কেবল মুহাম্মদের পত্নী ও কন্যাদের জন্যে, সকল মুসলিম নারীর জন্যে নয়। তাঁরা আবার হিজাব পরার ধরণেও মডারেট পন্থার স্রষ্টা।  
আধুনিক যুগে মুসলিম নারীর জন্যে হিজাব পরার বিধানটি অতি নিন্দনীয় একটি কুৎসিত বিধান হিসেবে পরিগণিত। হিজাব অনেকের চোখেই একটি চলমান কারাগার সদৃশ। হিজাবকে নারী দাসত্বের প্রতীক হিসেবেও গণ্য করা হয়। যে যে বিধানগুলির জন্যে ইসলামের কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা করা হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো হিজাব। মুসলিমরা কিন্তু দাবী করে যে ইসলাম নারীকে পুরুষের অধীনতা ও দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে, নারীকে স্বাধীনতা ও সম্মান দিয়েছে এবং পুরুষের সমানাধিকার দিয়েছে। মুসলিমরা মুহাম্মদকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নারীবাদী ব্যক্তিত্ব বলেও দাবী করেন। মুসলিমদের এই সকল দাবীকে সম্পূর্ণ নস্যাত করে দেয় হিজাবের বিধানটিহিজাব শুধু নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা,  স্বাধীনতা ও স্বাধিকারই খর্বই করে নি, নারীকে করেছে চরম অপমান ও অপদস্থও। তবে হিজাব আরোপ করে নারীকে খাটো করতে গিয়ে ইসলাম নিজেও কম খাটো হয় নি। হিজাবের কারণে মানব সমাজে ইসলামের মাথাও যথেষ্ট হেঁট হয়েছেহিযাব ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল তো করেই নি, বরং ঢের মলিন ও কালিমালিপ্ত করেছে। ইসলামের যে যে বিধানের জন্যে মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ প্রচণ্ড বিব্রত বোধ করেন তার মধ্যে একটি হলো হিজাব উলামা (মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ) ইসলামে ভাল মন্দ যা আছে তার সবটার জন্যেই গর্ব বোধ করেন। ফলে কোনো বিধানকেই, তা যতই খারাপ, কুৎসিত ও বর্বর হোক, তাঁরা অস্বীকার ও আড়াল করেন না এবং কোনো বিধানের জন্যেই তাঁরা বিব্রত বোধ করেন নাহিজাবের ক্ষেত্রেও তাঁরা তাই কোনো প্রকার ছলনা করেন না, বরং সৎ ও অকপট থাকেন মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ কিন্তু ইসলামের অনেক বিধানের জন্যেই বিব্রত বোধ করেন তাই তাঁরা সেই বিধানগুলির বেলায় উলামার মতো সৎ ও অকপট থাকতে পারেন না। আধুনিক যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের যে বিধানগুলি মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরকে অস্বস্তিকর ও লজ্জাকর অবস্থায় ফেলে সেগুলির কয়েকটি হলো বহুবিবাহ, মুতা বিবাহ, হালালা বিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক, জিহাদ, দাসপ্রথা, গণিমতের মাল, ফারাজ আইন, দত্তক আইন, হিজাব ইত্যাদি ইত্যাদি। মুহাম্মদের ব্যক্তিজীবনের বহু ঘটনাও তাঁদের প্রচণ্ড বিব্রত ও লজ্জিত করে। এ রকম বিব্রতকর ও লজ্জাকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁরা ব্যাপক কপটতা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেন। তাঁরা মিথ্যাচার করেন আপাদমস্তক কুৎসিত ও বর্বর ইসলামি বিধানগুলি বর্ণনা ও বাখ্যা করার সময়। যে বিধানগুলি ইসলামের ভাবমূর্তি মলিন ও মসীলিপ্ত করে সেই বিধানগুলিকে তাঁরা মনের মাধুরী মিশিয়ে এমনভাবে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেন যাতে ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখায়, এবং ইসলামকে একটা মহান ধর্ম বলে দাবী করা যায়ফল হয় এই যে, তাঁদের বর্ণনাকৃত ও ব্যাখ্যাকৃত বিধানগুলির সঙ্গে কোরানে বর্ণিত ও ব্যাখ্যাকৃত বিধানগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈপরীত্যও দেখা যায়। মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারের শিকার হিজাবের বিধানও। ফলে হিজাব নিয়ে মুসলিম সমাজে তুমুল মতভেদ ও বিতর্কের উদ্ভব হয়েছে।     
 
হিজাবের কোরানীয় বিধান 
 
কোরানে অনেকগুলি আয়াত আছে যেগুলির সঙ্গে হিজাবের সম্পৃক্ততা রয়েছেকিন্তু শুধু হিজাব নিয়েই অন্ততঃ যে দু’টি আয়াত আছে তাতে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছে যে, সমস্ত মুসলিম নারীকেই হিজাব পরতে হবে। না, শুধু বলাই হয় নি, নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। হিযাবের প্রথম যে আয়াতটি মুহাম্মদ আবৃত্তি করেন ওহীর নামে তাতে হিযাব আরোপ করা হয় তাঁর স্ত্রী ও কন্যা এবং সকল মুসলিম নারীদের উপর। হিজাবের দ্বিতীয় যে আয়াতটি মুহাম্মদ আবৃত্তি করেন সে আয়াতে শুধু মুসলিম নারীদের হিজাব পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয় নি। হিযাবের প্রথম যে আয়াতটি মুহাম্মদ তাঁর সাহাবীদের শোনান সেটা হলো ৩৩/৫৯ নং আয়াত। এই আয়াতটির আদি সুরা নম্বর হলো ৯০ (নব্বই)। এই আয়াতটির ভাষ্য হলো,         
·          হে নবী (সঃ)! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের নারীদেরকে বলঃ তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ তাদের নিজেদের উপরে টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে; ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে নাআল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু” (সুরা আহযাব, ৩৩/৫৯)  
এই আয়াত এটা স্পষ্ট করেছে যে, শুধু নবীর স্ত্রী ও কন্যাদেরকেই নয়, সকল মুসলিম নারীকেই হিজাব পরতে হবে। হিজাবের যে আয়াতে মুহাম্মদের পত্নী ও কন্যাদের কথার উল্লেখ নেই, কেবল সাধারণ মুসলিম নারীর কথা বলা হয়েছে সেটি হলো ২৪/৩১ নং আয়াত (আদি নম্বর ১০২ একশ’)। এই আয়াতটির বয়ান হলোঃ
·         “এবং বিশ্বাসিনী নারীদিগকে বল, তারা যেনো স্ব স্ব দৃষ্টি সকলকে বদ্ধ করে এবং স্ব স্ব ভূষণ যাহা তাহা হইতে ব্যক্ত হইয়া থাকে তদ্ব্যবতীত প্রকাশ না করে, এবং যেন তাহারা আপন কণ্ঠদেশে স্বীয় বস্ত্রাঞ্চল ঝুলাইয়া রাখে, আপন স্বামী বা আপন শ্বশুর বা আপন পুত্র (এবং পৌত্র) বা আপন স্বামীর পুত্র (সপত্নীজাত পুত্র) বা আপন ভ্রাতা বা আপন ভ্রাতুষ্পুত্র বা আপন ভাগিনেয় বা আপন (ধর্মাবলম্বী) নারিগণ বা তাহাদের দক্ষিণ হস্ত যাহাদের উপর স্বত্ব লাভ করিয়াছে সেই (দাসীগণ) বা নিষ্কাম অনুগামী পুরুষগণ এই সকলের এবং যাহারা নারিগণের লজ্জাজনক ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে না সেই শিশুদিগের নিমিত্ত ভিন্ন তাহারা আপন আভরণ যেন প্রকাশ না করে, এবং তাহারা যেন আপন শব্দায়মান (ভূষণযুক্ত) চরণ বিক্ষেপ না করে, তাহা করিলে তাহারা আপন ভূষণ যাহা গোপন করিয়া থাকে (লোকে) তাহা জানিতে পাইবে, এবং হে বিশ্বাসিগণ, তোমরা একযগে ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়া আইস, সম্ভবতঃ তোমরা মুক্ত হইবে” (সুরা নুর, ২৪/৩১)  

৩৩/৫৯ নং আয়াতটি স্পষ্টতই জারি হয়েছে মুহাম্মদের স্ত্রী, কন্যা ও সকল মুসলিম নারীদের উদ্দেশ্যে। ২৪/৩১ নং আয়াতটি জারি হয়েছে সকল মুসলিম নারীর জন্যে যেখানে তাদের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে জানানো হয়েছে যে কীভাবে হিজাব পরতে হবে এবং কার কার সামনে হিজাব পরার দরকার নেই। ৩৩/৫৯ নং আয়াতে মুসলিম নারীদের কেন হিজাব পরতে হবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে যে, এতে তাদের চেনা সহজ হবে; ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না অর্থাৎ নারীদের হিজাব পরার আদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে তাদের কেউ ‘উত্যক্ত’ না করে। ‘উত্যক্ত’ হওয়ার হাত থেকে মুহাম্মদ নিশ্চয় সকল মুসলিম নারীকে রক্ষা করার কথাই ভেবেছেন, শুধু তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের রক্ষা করার কথাই  ভাবেন নি। সুতরাং নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা  যা বলেন (হিজাবের বিধান শুধু মুহাম্মদের স্ত্রী ও কন্যাদের জন্যেই প্রযোজ্য, সাধারণ মুসলিম নারীর জন্যে নয়) তা নির্ভেজাল মিথ্যা।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে হিজাব
 
হিজাব কথাটা এসেছে আরবি ‘হাজাবা’ শব্দ থেকে। হাজাবা শব্দের অর্থ আড়াল করা। হিজাবের মূল উদ্দেশ্যই হলো নারীর চেহারা পুরুষের সামনে থেকে আড়াল করা। আরও স্পষ্ট করে বললে নারীকে পর পুরুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা। প্রাক ইসলাম যুগে নারী পুরুষ স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করতো, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতো, নারী পছন্দ করে বিয়ে করতে পারতো ও বিয়ে ভাঙতে পারতো, এক কথায় নারী অনেক স্বাধীন ছিলো এবং তাদের অনেক অধিকার ছিলো। ইসলাম নারীর সে সমস্ত অধিকারগুলি একে একে হরণ করে নিয়েছে। আল্লাহর দোহায় দিয়ে মুহাম্মদ যে যে বিধানগুলির সাহায্যে নারীর সমস্ত অধিকার হরণ করেছেন তার মধ্যে হিজাব হলো অন্যতম একটি। হিজাব বলতে আমরা সাধারণতঃ বুঝি যে এটা মুসলিম নারীর জন্যে কেবল ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময় প্রযোজ্য। কিন্তু আসলে তা নয়, হিজাব নারীর জন্যে আপন গৃহের মধ্যেও সমান প্রযোজ্য। আসলে হিজাব একটা অনেক বড়ো বিষয় শরিয়তি সংস্কৃতিতে, এটা শুধু এক টুকরো কাপড় দিয়ে নারীর শরীর বা চেহারা ঢেকে ফেলার বিষয় নয়। তাই হিযাবের নানা দিক আছে, নানা ধরণ আছে। হিযাবের আর একটি সহজ প্রতিশব্দ হল পর্দা। ইসলামে নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী জোর দেওয়া হয়েছে এই পর্দার উপর। হিজাব বা পর্দার মূল উদ্দেশ্য হলো নারীকে পুরুষজাতির (স্বামী এবং রক্তযোগ আছে এমন কতিপয় পুরুষ ছাড়া) থেকে সম্পূর্ণ আড়াল করা, বিচ্ছিন্ন করা এবং আপন গৃহের বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্যে ইসলাম নারীকে তার বাস গৃহের মধ্যেই অন্তরীণ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। নারীকে গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরানের ৩৩/৩৩ নং আয়াতে। সেই আয়াতে বলা হয়েছে,
·                 "তোমরা আপন আপন গৃহ সকলে স্থিতি করিতে থাক ও প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।"  

পূ    নামাজ পড়ার জন্যে মুসলমানদের মসজিদে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে মুহাম্মদ বলেছেন যে তারা মসজিদে যেতে পারে, তবে তাদের জন্যে বাড়িই উত্তম। তিনি ঠিক কী বলেছেন তা শোনা যাকঃ
·     রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর বাদীদেরকে আল্লাহর মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করবে না। কিন্তু তাদের উচিত যে, তারা বাড়ীতে যে সাদাসিধা পোশাকে পরে থাকে ঐ পোশাক পরেই যেন মসজিদে গমন করে।” অন্য একটি রেওয়াতে আছে যে, স্ত্রীলোকদের জন্য বাড়ীই উত্তম। (তফসিরঃ ইবনে কাথির, ১৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা – ৭৮৪) 
মুহাম্মদ নারীকে মসজিদে যেতে নিরুৎসাহিত করেছেন কেন? সেটা যে তাদেরকে পুরুষজাতি ও বাইরের জগত থেকে  বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যেই তা বলা বাহুল্য। পুরুষজাতির থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে পুরুষকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরানে। সেই নির্দেশে বলা হয়েছে যে তারা যেন নারীর কাছ থেকে কিছু চাইলে আড়াল থেকেই চায়। সেই নির্দেশটি হলো,
·            "তোমরা তাঁদের (নবী পত্নীদের) নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।" (৩৩/৫৩) 
 
উপরের আয়াতটি যদিও মুহাম্মদের সাহাবিদের উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে আসলে সমস্ত মুসলমান পুরুষ ও নারীদের কাছেই একটা স্পষ্ট বার্তা পাঠানো হয়েছে যে পুরুষরা চেনাজানা  বা প্রতিবেশী কোনো পরিবারের নারীর কাছে কিছু চাইলে যেন পর্দার আড়াল থেকেই চায়নারীর একান্ত প্রয়োজনেও যদি ঘরের বাইরে যাওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে তবুও একা তার বাইরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ বলেছেনঃ
·             কোনও স্ত্রী লোক যেন সাথে মুহরিম আত্মীয় ছাড়া একাকি একদিন এক রাত্রির দুরত্ব অতিক্রম না করে।  (তিরমিযি শরীফ, হাঃ নং১১০৬ )
পাছে নারী একাকী বাইরে গিয়ে অন্য পুরুষের সাথে কথা বলে, তাদের সাথে মেলামেশা করে, তাই নারীর উপর এই অন্যায় ও অপমানকর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এমনকি নারীকে অন্ধ লোকের সামনেও পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কথা শোনা গেছে মুহাম্মদের স্ত্রীদের কাছ থেকেইসেই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদের পত্নী  উম্মে সালমা হাদিসটি এরূপঃ
·               "হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি এবং হযরত মাইমুনা (রাঃ) রাসূলুল্ললাহ (সঃ) – এর নিকট ছিলেন এমন সময় হযরত ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) তথায় আগমন করেনএটা ছিলো পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পরের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা পর্দা কর।” তাঁরা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তিনি তো অন্ধ লোক। তিনি আমাদেরকে দেখতেও পাবেন না এবং চিনতেও পারবেন না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা তো অন্ধ নও যে তাকে দেখতে পাবে না?” (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ১৫শ’ খণ্ড, ২৪/৩১ – এর তফসির, পৃঃ ১৪৪)
অন্ধ পুরুষ মানুষের সামনেও নারীকে পর্দা করতে হবে কেন? মুহাম্মদের স্ত্রীদের প্রশ্ন বা আপত্তি ছিলো যথার্থ। কিন্তু মুহাম্মদ তাঁদের আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যেভাবে স্বৈরশাসকরা উড়িয়ে থাকেন। নারীজাতিকে পুরুষজাতি ও বহিঃর্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করতেই মুহাম্মদ অন্ধ পুরুষদের সামনেও নারীকে পর্দা করার নির্দেশ দেন। এসব কুৎসিত উদাহরণগুলি থেকেও এটা বোঝা যায় যে, মুহাম্মদ হিযাবের বিধান আরোপ করেছেন সমগ্র মুসলিম নারীর উপর, শুধু তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদেরে উপর নয়

মূলত মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সৌজন্যে শুধু হিজাবের বিধান নিয়েই নয়, ব্যাপক বিতর্ক ও মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে হিজাবের আকার, আয়তন ও ধরণ নিয়েও। এটার উপর আলোকপাত করবো অন্য একটি লেখায়।

 
 

Tuesday, May 29, 2018

কোরানের প্রতি অন্ধানুগত্য মুসলমানদের কোনো কল্যাণ করেনি


মুসলিম সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস হলো কোরানই একমত্র সঠিক ধর্মগ্রন্থ এবং বিশ্বের সব চেয়ে পবিত্র গ্রন্থ। কোরানের প্রত্যেকটি বাক্য নির্ভুল, সত্য ও শাশ্বত। তাদের এই গভীর বিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে আর একটি বিশ্বাসের উপর। সেটা হলো, কোরান মানব রচিত গ্রন্থ নয়, এটা মহান সৃষ্টিকর্তা ও সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্‌র সৃষ্টি। মুসলমানদের দাবী করে যে, কোরান শুধু আরবদের বা শুধু মুসলমানদের জন্যে পৃথিবীতে আসেনি, কোরান এসেছে সমগ্র বিশ্বের জন্যে বিশ্বের সকল মানুষের পথ প্রদর্শক হিসেবে। মুহাম্মদ হলেন আল্লাহ্‌র সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (প্রফেট) যাঁর উপর এই গ্রন্থটি অবতীর্ণ হয় তেইশ বছর ধরে জিব্রাইল ফেরেস্তার (আল্লাহ্‌র একজন বিশেষ অশরিরী দূতের) মারফত। মুসলিমরা  বিশ্বাস করে যে কোরানের শক্তিতেই মুহাম্মদ মক্কা বিজয় করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পরবরতীকালে তাঁর উত্তরসূরি খলিফাগণ অর্ধেক বিশ্বব্যাপী ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। আবার খলিফাগণ যখন কোরানের পথ থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করেন তখন থেকেই শুরু হয় ইসলামের পতনের যুগ এবং অবশেষে এক সময় ইসলামি সাম্রাজ্য ও খলফাতন্ত্রের অবসান হয়। এভাবে কোরানকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সম্প্রদায়ের চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান-বুদ্ধি আবর্তিত হয়ে থাকে। মোদ্দা কথা হলো কোরানই হলো বিশ্বের মুসলমানদের জীবন-দর্শন। কোরান সম্পর্কে মুসলিমদের মনে এই অগাধ বিশ্বাস আজও সমান প্রবল এই একবিংশ শতাব্দীতেও যে যুগে মানুষের কল্পনা শক্তিও হার মেনেছে বিজ্ঞান সভ্যতা এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞানের প্রায় অবিশ্বাস্য উন্নতি ও অগ্রগতির কাছেএ কথা বলা বাহুল্য যে, কোরান সম্পর্কে মুসলিমদের এই অগাধ বিশ্বাস একেবারেই অন্ধবিশ্বাস যার কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অন্ধবিশ্বাসের গর্ভে জন্ম নেই অন্ধানুগত্য ও অন্ধ শ্রদ্ধাবোধ যা ব্যক্তিপূজায় পর্যবসিত হয়। তাই কোরানের প্রতি মুসলমানদের অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধানুগত্য যতটা তীব্র মুহাম্মদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধানুগত্যও ততটাই তীব্র। ফলে কোরান ও মুহাম্মদ সম্পর্কে সামান্য প্রশ্ন বা সমালচনাতেও মুসলিম সমাজ প্রচণ্ড উত্তেজিত ও অস্থির হয়ে ওঠে। তাদের সেই উত্তেজনা ও অস্থিরতা প্রায়শঃই হিংস্রতার রূপ নেয়।      
এই অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধানুগত্য মুসলিম সমাজের কোনো কল্যাণ করেনি, বরং মুসলিম সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে ক্রমশঃ। কোরানে ভাষা আরবি কারণ আরবদের ভাষা আরবি – এভাবে মুসলিমরা ভাবে না। তাদের বিশ্বাস আরবি আল্লাহ্‌র ভাষা, সুতরাং তাদের কাছে আরবি ভাষার স্থান মাতৃভাষারও উপরে। বাংলার মুসলিম নবাবকে পরাস্ত করে ইংরেজরা ভারতে সান্রাজ্য বিস্তার করেছিল বলে মুসলমানরা ইংরেজি ভাষা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। মুফতিরা ফতোয়া দিয়েছিল যে ইংরেজি শেখা পাপ। এমনকি বাংলাকেও হিন্দুদের ভাষা বলে ফতোয়া জারি করে বলেছিল মুসলমান বাঙালিদের বাংলা ভাষা শেখাও পাপকোরান ও মুহাম্মদের প্রতি অন্ধানুগত্যের কবলে শুধু ভাষাই পড়েনি, পড়েছিল বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়গুলিও। কোরানেই সব আছে – এই অন্ধবিশ্বাস থেকে মুসলমানরা কয়েকশ’ বছর ধরে বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসের চর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মুসলিম সমাজের স্বাধীন বুদ্ধি, যুক্তি ও চিন্তার সমাধি রচনা করেছিল কোরানের প্রতি অন্ধবিশ্বাস। সেই অন্ধবিশ্বাসে মুসলিম সমাজ আজও নিমজ্জিত রয়েছে। কোরানে বর্ণিত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আইন ও বিধি-নিষেধগুলি আধুনিক সমাজে সম্পূর্ণ অপাঙ্কতেও একথা মুসলিম সমাজ এখনও মানতে নারাজ। তাই কোরানের মধ্যযুগীয় আইন-কানুনগুলি বর্জন বা সংস্কার করার কথা বললেই আলেম সমাজ উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করেন। তারা কতল (হত্যা) করার ফতোয়া জারি করে বাংলাদেশ তো এখন মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ব্লগারদের বধ্যভূমি। মুক্তবুদ্ধির এই চিন্তাবিদরা প্রতিদিনই আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হচ্ছেন। তাঁদের অনেককেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেকেই প্রাণ নিয়ে স্বদেশ পরিত্যাগ করে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। রাষ্ট্রব্যবস্থা নগ্নভাবে মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ভারতে এবং একদা বাম আন্দোলনের পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গেও মুক্তবুদ্ধির মানুষদের নিরাপত্তার বড়ই অভাব। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণকারী মমতা ব্যানার্জীর দল ক্ষমতায় আছে বলে নয়, কেন্দ্রের ক্ষমতায় যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বকারী জাতীয় কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় যখন সিপিআই(এম) ছিল তখনও মুক্তবুদ্ধির লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের নিরাপত্তার অভাব ছিল। পশ্চিমবঙ্গ তো মোল্লাতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।               
কোরান ও হাদিসেই মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণের বীজ নিহিত আছে এমন বিশ্বাস যে অলীক কল্পনা তা নিয়ে তর্ক করার অবকাশ নেই। সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলির দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অনুন্নত বিশ্বের মানচিত্রে মুশলিম দেশগুলির যেন একচেটিয়া অধিকার। আমাদের (ভারতের) দেশের অভ্যন্তরীণ চিত্রটাও অনুরূপ। সবচেয়ে পশ্চাদপদ যারা তাদের প্রধান অংশটাই মুসলিম সম্প্রদায়। দারিদ্র, নিরক্ষরতা, অধিক জন্মহার, অধিক শিশুমৃত্যুহার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা সবচেয়ে বেশী মুসলিম সমাজেই। প্রশ্ন হল, এসব অভিশাপ ও পশ্চাদপদতা থেকে মুসলমানদের মুক্তির উপায় কী? মুক্তি পেতে এবং প্রগতি ও উন্নতির পথ খুঁজতে সর্বাগ্রে ত্যাগ করতে হবে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধানুগত্য। পথ খুঁজতে হবে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজভাবনার মধ্যে। কিন্তু মোল্লাতন্ত্র তা মানতে একদম নারাজ। তবে মডারেট মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এ কথাটা অনেকটাই মানছেন। হ্যাঁ, সেই বুদ্ধিজীবীদের কথাও বলছি যাঁদের আল্লাহ্‌ ও মুহাম্মদের প্রতি একশ’ ভাগ আনুগত্য বিদ্যমান। আমরা যারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বস্তুবাদী মানুষ যখন বলি যে পশ্চাদপদ  ধর্মশিক্ষা, ধর্মীয় আইনকানুন ও ধর্মীয় সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে আধুনিক শিক্ষা ও আধুনিক সমাজের মূল স্রোতে প্রবেশ করতে হবে তখন আলেম সমাজ আমাদের গায়ে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুর তকমা সেঁটে দিয়ে মুসলমান সমাজকে বিভ্রান্ত করে। তাই এখানে আল্লাহ্‌ ও ইসলামে বিশ্বাসী  মুসলিম সমাজের একজন উচ্চশিক্ষিত অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীর চিন্তাধারার কিছু অংশ এ নিবন্ধে উল্লেখ করতে চাই যেখানে তিনি বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছেন যে, কোরান ও হাদিসের বহু জিনিষই আজকের মুসলিম সমাজে অপ্রযোজ্য ও অপাঙ্কতেও হয়ে পড়েছে। সেই অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী হলে ড. ওসমান গণী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কর্মজীবনে এবং ইসলামের ইতিহাস, মুহাম্মদ ও খলিফাদের জীবনী ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এখানে তাঁর চিন্তাধারা থেকে যে কথাগুলি লিখব সেগুলি তিনি লিখেছেন একটা দীর্ঘ প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি রয়েছে একদা সিপিএমের নেতা মইনুল হাসান সম্পাদিত ‘মুসলিম সমাজ এবং এই সময়’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে। এই সময়ে মুসলিম সমাজের কী কী করণীয় সে বিষয়ে ড. গণীর নিজস্ব চিন্তাধারার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে সেই নিবন্ধটিতে।  
তিনি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক নির্ধারিত কালের জন্য কেতাব (ঐশীগ্রন্থ) আছে’ কোরানঃ সুরা রাদঃ১৩/৩৮।’ কোরানের এই আয়াতটি দিয়েই ড. গণী প্রবন্ধটির সূচনা করেছেন। আয়াতটির বাখ্যায় তিনি লিখেছেন, ‘কোনকালের কোনো একটি কেতাব সকল কালের সমস্যার সমাধান দেয় নি, দেওয়াটা অযৌক্তিকও। চলমান সমাজে এটা সম্ভবও নয়।’ (পৃ-১৫২) অর্থাৎ ড. গণী প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন যে কোনো ধর্মগ্রন্থই চিরন্তন নয়। তিনি এ কথাটা আরও স্পষ্ট করেছেন এভাবে, ‘চলমান মানব সমাজ এমনই স্থান, যেখানে জোর করে কিছু আনাও যায় না, রাখাও যায় না, আবার তাড়িয়েও দেওয়া যায় না। তারা কখনও ধর্মের প্রয়োজনে আসেন না, যায় না, থাকেনও না। তাই কোনো ধর্মগ্রন্থই চলমান সমাজে তার বিধি-বিধানগুলোকে কোনোদিনই চিরন্তন করতে পারে নিপারবেও না।’ (পৃ-১৫৩) কোরানের বিধানগুলি আজকের সমাজে আঁকড়ে থাকা যে নির্বুদ্ধতা ও সংস্কার সে কথা তিনি বলেছেন অকপটেএ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সময় ও যুগ ও কালের সাথে যেগুলোর আর কোনো সম্পর্ক নেই, মুসলমানগণ তাদেরই বুকে জড়িয়ে বসে আছে। পিতা-মাতা যতই প্রিয় হোন, মারা গেলে কবরে বা শ্মশানে নিয়ে যেতেই হয়। বন্য জন্তু তাদের সন্তান মারা গেলেও তাদের বুকে জড়িয়ে বসে থাকে। মানুষ ওরূপ করবে কেন। সমাজের বদ্ধ সংস্কার, কুসংস্কার, অপসংস্কার, অন্ধ অনুশাসন-অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকাটা একেবারেই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।’ (পৃ-১৬০) স্বাধীন চিন্তা ও চেতনার অভাবে কীভাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল তার বাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি  বলেছেন, ‘... একটি জাতির অস্থি ও মজ্জাকে অসাড় করে তুলতে মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত চেতনার অনুপস্থিতির যে প্রভাব, মুসলিম জাহান দশম খ্রিস্টাব্দের পর তা হতে আর নিষ্কৃতি লাভ করেনি। নচেৎ বাগদাদের খলিফাগণ যতই অপদার্থ হন, ওইরূপ অচিন্তনীয় শোচনীয় পরাজয় ঘটত না। বাগদাদ খলিফাগণ অনেক পূর্বেই স্বাধীন চিন্তা ও চেতনার সমধি রচনা করেছিলেন। তবু খেলাফত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ১০০০ হতে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এসেছিল। এই পর্যন্ত খলিফাগণ চালিত হয়েছিলেন কিছু ধর্মান্ধ মোল্লা দ্বারা।’  (পৃ-১৬০, ১৬১)  বলা বাহুল্য যে বিজ্ঞানের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত এই একবিংশ শতাব্দীতেও মুসলিম সমাজ চালিত হচ্ছে ধর্মান্ধ মোল্লাদের দ্বারা। আর তাই মুসলিম সমাজ আজও বিশ্বব্যাপী দারিদ্র, নিরক্ষরতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, সংস্কার ও কুসংস্কারের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে।
কোরানের বিধানগুলি আজ যে অপাঙক্তেয় সে কথা ড. গণী ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে এই ভাষায়, ‘ধর্মের বিধি বিধানের সময় সীমা অনুপাতে, বর্তমান সামাজিক নানা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে, বা সমাজের উত্থান পতনে, আবর্তনে-বিবর্তনে সময়ানুপাতিক বিচার-বিশ্লেষণে, পবিত্র কোরানের বহু জিনিষ আজ মুসলিম সমাজেও অপ্রয়োজ্য ও অপাঙক্তেও হয়ে পড়েছে। কেননা চলমান সমাজ বহুদূর এগিয়ে এসেছে।’ (পৃ-১৫৫) গণী তাঁর যুক্তিবাদী বক্তব্যের সমর্থনে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছেন। এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো মাত্র। দৃষ্টান্ত – এক). ‘চোরের হাত কাটাঃ পুরুষ বা নারী চুরি করলে তার হাত কেটে দাও। কোরানঃ সুরা মায়দাঃ ৫/৩৮  একমাত্র আরব দেশ ব্যতীত  কোনো মুসলমান দেশেও এ বিধান আর প্রচলিত নেই। ... এখানে বর্তমান যুগে কোরানের বিধান রহিত হয়েছে।’ (পৃ-১৫৫, ১৫৬)  
 দৃষ্টান্ত – দুই). ‘ব্যাভিচারের শাস্তিঃ তাদের ঘরে আবদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত তাদের মৃত্যু হয়। কোরান, ৪/১৫। ব্যাভিচারিণী ও ব্যাভিচারী ওদের একশ’ ঘা বেত মারো। কোরাণ, ২৪/২। এতদ্ব্যতীত ব্যাভিচারের পাথর ছুঁড়ে প্রাণদণ্ড ইত্যাদি শাস্তিগুলো একমাত্র আরব ব্যতীত সকল দেশেই রহিত। মহাকালের কোলে চলমান সমাজ ও আগত মানব সমাজ কোনো যুগেই কোনো নীতি বা বিধানকে শাশ্বত বলে মেনে নেয়নি।’ (পৃ-১৫৬)   
দৃষ্টান্ত – তিন). ‘সাক্ষীঃ তোমাদের মধ্য হতে  দুজন পুরুষ সাক্ষীকে সাক্ষী কর, কিন্তু যদি পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায়, তাহলে সাক্ষীদের মধ্য হতে তোমরা একজন পুরুষ ও দুইজন নারী মনোনীত কর। কোরানঃ ২/২৮২। এখানে সাক্ষীদানে কোরাণ নারীকে পুরুষের অর্ধেক মর্যাদা দান করেছে। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সাক্ষিদানে নারী ও পিরিষ সমান মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। এখানে কোরানের ঐ আয়াত রহিত হল।’ (পৃ-১৫৬) দৃষ্টান্ত – চার). ‘ক্রীতদাসীঃ যারা নিজেদের যৌন অঙ্গ সংযত রাখে। তবে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণের ক্ষেত্রে অন্যথা কামনা করলে তারা নিন্দনীয় হবে না। কোরানঃ ২৩/৫-৭, ৭০/২৯, ৩০। কোরাণ অনুমোদন করেছে, মুসলমানগণ তাদের ক্রীতদাসীকে ইচ্ছা করলে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করতে পারবে। চলমান সমাজে দাসপ্রথা রহিত। সুতরাং কোরানের অনুমোদন আজ অপাংক্তেয়।’  (পৃ-১৫৮) দৃষ্টান্ত – পাঁচ). ‘তালাকঃ তালাক দুবার। অতঃপর তাকে নিয়মানুযায়ী রাখতে পার, অথবা সৎভাবে ত্যাগ করতে পার। কোরানঃ ২/২২৭-২৪১, ২৮/৪-১২, ৩৩/৪, ৪৯, ৫৮’২, ৬৫/১-১২। মুসলিম সমাজে বহু নাম করা বড়ো বড়ো জামাতগোষ্ঠী কোরানের বিশুদ্ধ দু তালাককে লাটে তুলে মনগড়া তালাকের ফতোয়া জারি করে সমাজের সর্বনাশ তো করছেনই, অধিকন্তু কোরাণের বিধানটিকেও বোধ করেছেন।’ (পৃ-১৫৯)  দৃষ্টান্ত – ছয়). ‘ইদ্দতকালঃ তালাকপ্রাপ্তাগণ তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ... আল্লাহ্‌ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা গোপন করা তাদের জন্য বৈধ নয়। কোরানঃ ২/২২৮-২৩২, গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল প্রসব হওয়া পর্যন্ত। ৬৫/৪। দুজন মুসলিম নর-নারীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, অন্য বিয়ের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হয়, ওই অপেক্ষারত সময়টার নাম ইদ্দতকাল। ... কোরান বলছে তার গর্ভে বাচ্চা আছে কীনা, জানার জন্য। ওই জিনিষতা জানার জন্য আজ বিজ্ঞানের যুগে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে কেন। ওটা তো এখন যে কোনো ক্লিনিকে তিন ঘণ্টাতেই জানা যাবে। সুতরাং এ যুগে পরিত্যাক্ত নারীকে আর তিন মাস অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। ... গর্ভবতী নারীর ইদ্দতকাল তার প্রসবকাল পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন উঠছে, এখন সন্তানের জননী আর গর্ভধারণ করছে না। অন্য নারীর ‘গর্ভ’ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সুতরাং যে নারীর গর্ভে বাচ্চা নেই, তার প্রসবের প্রধ্ন নেই। তার ইদ্দতও নেই।’ (পৃ-১৫৯)  দৃষ্টান্ত – সাত). ‘ফারাজঃ আল্লাহ্‌ তোমাদের সন্তান সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান। কোরানঃ ৪/১১-১৩। মুসলিম ছেলে-মেয়ে, নিকট আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কোরানের নির্দেশ মতো জমি বণ্টনের নাম ‘ফারাজ’।   ‘ফারাজ’ প্রথাও আজ লাটে উঠেছে। সমাজের পণপ্রথা ‘ফারাজ’ প্রথাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। পিতা কন্যার বিয়েতে দায়গ্রস্ত হয়ে পণের বিশাল টাকা মেটাতে জমি বিক্রি করছেন। পরে যেটুকু জমি থাকছে তা পুত্রদের নামে লিখে দিচ্ছেন। ফলে মুসলিম ঘরে ঘরে কোরাণের ‘ফারাজ’ আজ প্রয় কবরস্থ। এরই নাম পরিবর্তনশীল সমাজ। সে পরিবর্তন সুসংস্কারেই হোক, আর কুসংস্কারেই হীক চলছে, চলবে। সে চলমান (পৃ-১৫৮, ১৫৯)            
‘পবিত্র কোরানের বহু জিনিষ আজ মুসলিম সমাজেও অপাঙক্তেয় হয়ে গেছে’ – লেখক তাঁর এই বক্তব্যের চোদ্দটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছেন। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র সাতটি। লেখক যে কথাগুলির সাহায্যে তাঁর প্রবন্ধ শেষ করেছেন সে কথাগুলির কিছুটা অংশও যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। তিনি  লিখেছেন, ‘... উন্নতির নদীতীরে পাড়ি দিতে হলে যুগের আধুনিক তরিতে চাপতেই হবে। ... নচেৎ জগতের বোঝারূপে পেছনে পড়ে থাকতেই হবে। এ কথাও কিছুতেই ভোলা উচিৎ হবে না যে, বিজ্ঞান ব্যতীত ধর্ম যেমন একটি অন্ধ মানুষ, ধর্ম ব্যতীত বিজ্ঞানও একটি বিপজ্জনক দুর্বৃত্ত মানুষ। ... যারা হবে সমুন্নত বিদ্বান, তারা কেবল নাবালকের মতো স্বাধীন দেশের নাগরিকই হবে না, হবে চিন্তা ও চেতনায় স্বাধীন।’ (পৃ-১৬১)  ড. ওসমান গণী তাঁর প্রবন্ধে যা বলেছেন তার সারমর্ম এরূপঃ  এক). কোরানের বিধানগুলি সর্বকালের জন্য নয়, দুই). আজকের যুগে কোরানের বিধানগুলির অধিকাংশই অপাঙক্তেয়, তিন). আলেম সমাজ (মুসলিম ধর্মগুরুগণ) ধর্মান্ধ এবং তারা যুগে যুগে মুসলমানদের সর্বনাশ করেছে, চার). সমাজের পরিবর্তনশীলতার অমোঘ নীতি মেনে মুসলমানদের স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, এবং পাঁচ). কোরানের অপাঙক্তেয় আইন ও বিধি-নিষেধগুলি নির্মমভাবে বিসর্জন দিতে হবে এবং আধুনিক আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতিকে গ্রহণ করার সাহস  অর্জন করতে হবে। প্রবন্ধটির মূল সুর বা আহ্বানটি হলো –  মুসলিম সমাজের ব্যাপক সংস্কার সাধন জরুরী এবং তা করার সাহস অর্জন করতে হবে।
ড. ওসমান গণী পশ্চিমবঙ্গের একজন নাম করা বিদ্বান মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি একজন বিশিষ্ট লেখক ও বহু গ্রন্থের রচিয়তাও। তিনি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো ‘মহানবী’ এবং ছয়টি খণ্ডে লেখা ‘ইসলামের ধারাবাহিক ইতিহাস’তাঁর সব চেয়ে বড়ো পরিচয় হলো তিনি একজন ভীষণ ধর্মভীরু মানুষ এবং আল্লাহ্‌ ও মুহাম্মদের বিশ্বস্ত অনুগামী। তথাপি তাঁর ওই নির্ভীক উচ্চারণে -  পবিত্র কোরানের বহু জিনিষ আজ মুসলিম সমাজেও অপাঙক্তেয় হয়ে গেছে এবং সেগুলি বর্জন করতে হবে – যুক্তিবাদী মানুষরা  যুগপৎ বিষ্মিত ও চমৎকৃত না হয়ে পারে নাকিন্তু মুসলিম সমাজের চিন্তাশীল ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের প্রচণ্ড হতাশ করেন। তাঁরা মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো কলাম লেখেন, কিন্তু কোরানের প্রতি অন্ধানুগত্য মুসলিম সমাজের কী ভয়ংকর সর্বনাশ করছে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। বরং শরিয়তি আইনের বীভৎস চেহারা উন্মোচন করে মুসলিম সমাজের কোনো যুক্তিবাদী লেখক যখন মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হন তখন ঐ বুদ্ধিজীবীরা আক্রমণকারী মুসলিম মৌলবাদীদেরই পাশে দাঁড়ান। বলেন, বাক-স্বাধীনতার নামে  মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেবার অধিকার কারো নেই। ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত’ – এর অজুহাতে এটা তো বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা। এ বিরোধিতা তাঁরা করেন মুসলিমদের তুষ্ট ও তোয়াজ করার জন্যে। এটা আসলে মুসলিমদের সাথে এক প্রকারের প্রতারণা করা। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ এই বুদ্ধিজীবীদের এই প্রতারণা আমাকে ভীষণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু হতাশা ও ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমার মতো অনামি ও অখ্যাত ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী লোক যাঁরা আছেন, যাঁরা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও নিবেদিত প্রাণ এবং মোল্লাতন্ত্রের লাল চোখের ভয়ে যাঁরা ভীত-সন্ত্রস্ত নন, তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একটা বৃহৎ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস করতে হবে।                

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...