Thursday, December 14, 2017

শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক নয়, নিষিদ্ধ করতে হবে পুরো শরিয়তি তালাক আইনটাই

তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটি খসড়া আইন তৈরী করেছে। এটা বিল আকারে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে পেশ করা হবে। বিলটির নাম দেওয়া হয়েছে 'মুসলিম  উইমেন প্রটেকশন অব রাইটস অন ম্যারেজ বিল'এটা আইনে উন্নীত হলে কাশ্মীর ছাড়া সমগ্র ভারতে প্রযোজ্য হবেখসড়া বিলটি ইতিমধ্যেই রাজ্যগুলির কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের মতামত দেবার জন্যে। বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদ কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ রাজ্যের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবুও রাজ্যগুলির মত চাওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ দু’টি। (এক). এই বিলের পক্ষে গোটা বিরোধী পক্ষের সহমত আদায় করা। (দুই). বাম দলগুলি এবং কংগ্রেস-সহ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ পেটি বুর্জোয়া দলগুলিকে  বিড়ম্বনায় ফেলা। কারণ, এসব দলের নেতারা মুসলিম মৌলবাদী ধর্মীয় নেতাদের তুষ্ট করতে এতোকাল তাৎক্ষণিক তালাক আইনটিকে সযত্নে রক্ষা করে এসেছেন। সুপ্রীম কোর্ট যেহেতু ইতিমধ্যেই এই আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, তাই তাঁদের এই বিলকে এবার সমর্থন দিতেই হবে এটা জেনেও যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁদের প্রতি বিরূপ  হবে।         
পাঁচ জন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীর আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রীম কোর্ট গত আগস্ট মাসে এক সঙ্গে তিন তালাক প্রদানকে অসাংবিধানিক ও বেআইনী বলে রায় দিয়েছিলো। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটতেই আছে। মুসলিম সমাজের এই অসাংবিধানিক ঔদ্ধত্যমূলক ঘটনা নতুন কিছু নয়। কারণ, মুসলিম সমাজের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো তাদের নিজেদের দেশের সংবিধান ও সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করা এবং শরিয়তি আইন ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে চলা। কেন্দ্রীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে সুপ্রিম কোর্টের উক্ত রায় প্রদানের পর ৬৭ জন মুসলিম নারী সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে যে তাঁদেরকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান করে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে তিন তালাক দেওয়ার ঘটনা নিশ্চয় আরো বেশী হবে, কারণ এরূপ তালাক দেওয়ার সব ঘটনা যে সরকারের গোচরে আসেনি তা বলাই বাহুল্য। আর একটা কথা এখানে বলা দরকার। তা হলো, উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানরাও আদালতে রায়কে অগ্রাহ্য করে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে দ্বিধা করছেন না। তালাকদাতা উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানদের তালিকায় সম্প্রতি নাম নথিভুক্ত করেছেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালিদ বিন ইউসুফ খাঁনও। তিনি তাঁর বৌ ইয়াসমিন খালিদকে প্রথমে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে এবং পরে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে তালাক দিয়েছেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান ও মান্যতা দিয়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজ একসঙ্গে তিন তালাক দেবার কুৎসিত আইনটি বিসর্জন দিতে মোটেই প্রস্তুত নয়। তাই এ বিষয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারে না যে কেন্দ্রীয় সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাককে নিষিদ্ধ ও বেআইনি করতে যে খসড়া আইনটি তৈরী করেছে সেটা অত্যন্ত জরুরী ছিলো।    
প্রস্তাবিত খসড়া বিলে কী কী বিধান রয়েছে তার প্রতি এবার একটু চোখ বোলানো যাক। পুরো খসড়া বিলটি সামনে আসেনি এখনো। যেটুকু খবর পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, বিলটিতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান করাকে অবৈধ, নিষিদ্ধ ও বেআইনী ঘোষণা করার সংস্থান রয়েছে। যদি কেউ তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেয় তবে সেটা আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেবে তার তিন বছরের জেল ও জরিমানা হবে। তালাকদাতা যাতে জামিন না পায় তার ব্যবস্থা রয়েছে বিলে। খসড়া বিলে তালাকপ্রাপ্ত নারীকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার সংস্থান রাখা হয়েছে। যেমন, তিন তালাক দেওয়ার পর তালাকপ্রাপ্ত নারীকে যাতে তার বর বা শ্বশুরের বাড়ি থেকে বের করে দিতে না পারে তার আইনী রক্ষাকবচ রয়েছেতালাকপ্রাপ্ত নারী শুধু বর বা শ্বশুরের গৃহে থাকতে পারবে তাই-ই নয়, সে খোরপোষও পাবে। তার যদি সন্তানাদি থাকে তবে তারাও খোরপোষ পাবে।
মুসলিম ধর্মগুরু ও মুসলিম পুরুষ সমাজের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিল ও বেআইনী করার জন্যে যে খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু তবুও যে কথাটা বলা খুবই জরুরী তা হলো, শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইনকে নিষিদ্ধ করলে মুসলিম নারীদের আখেরে কোনো লাভই হবে না। তাদের অবর্ণনীয় দুঃসহ অবস্থা এখন যেমনটি রয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ হলে অবস্থাটা প্রায় তেমনটাই থেকে যাবে। কেননা, ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বিধিটি মূল তালাক আইনের একটি ধারা মাত্র। ২য় খলিফা ওমর ফারুক এই ধারাটি কোরানের মূল তালাক আইনের সঙ্গে যুক্ত করেন মুহাম্মদের মৃত্যুর ২/৩ বছর পর অনেকের ধারণা যে মুহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত কোরানের মূল তালাক আইনটি নারীর পক্ষে কল্যাণকর ও সুখকর। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, মূল তালাক আইনটি ভীষণ অগণতান্ত্রিক, অমানবিক এবং চরম নারীবিরোধী আইন। যতোই অবিশ্বাস্য শোনাক, কিন্তু এটাই বাস্তব যে ইসলামি আইনে নারীকে তালাক দেবার অধিকার দেওয়া হয়নি। একজন পুরুষ কিন্তু কারণে অকারণে যখন তখন খেয়ালখুশী মতো তালাক অধিকারী। এমনকি একজন বিবাহিত পুরুষের যদি অন্য নারীকে পছন্দ হয় তবে তাকে বিয়ে করার জন্যে সে তার আগের বৌদের  তালাক দিতে পারবে। কোরানের ৪/২০ নং আয়াতে পুরুষের এই অধিকারের কথা স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে। কোরানের সেই অবিশ্বাস্য ভাষ্যটি হলোঃ তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির করো, এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবু তার থেকে কিছু গ্রহণ করো না, তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচরণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে। তালাক আইনের এই বিধি থাকার সুযোগ নিয়েছিলেন মুহাম্মদের আপন জৈষ্ঠ নাতি ইমাম হাসানতিনি মোট একশ’টি বিয়ে করেছিলেন। একদিনে চারজন বৌকে তালাক দিয়ে সেদিনই চারজন নারীকে বিয়ে করার কুৎসিত নজিরও রেখে গিয়েছেন তিনিকোরানের তালাক আইনে পুরুষ তার প্রয়োজনে বা ইচ্ছা হলেই যখন খুশী তালাক দিতে পারবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই, বর যতোই মাতাল, লম্পট, চোর-জোচ্চর, বদমাশ, অত্যাচারী ও নির্যাতনকারী হোক, মুসলিম নারী তালাক দিতে পারবে না। এইগুলো হলো কোরানের তালাক আইনের কয়েকটি নমুনা।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে কোরানে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার বিধান নেই।  
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার যে  আইন প্রণয়ন করতে চলেছে তার ফলে  মুসলিম পুরুষদের তালাক দেওয়ার অধিকারটি মোটেই রহিত বা খর্বিত হচ্ছে না। কারণ,  উক্ত আইনে তিন বারে বা তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার তালাক আইনটি রদ হচ্ছে না। ফলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা রদ করা হলে মুসলিম পুরুষরা তাদের তালাক দেওয়ার পদ্ধতি বা কৌশল পরিবর্তন করবে এবং একসনে তিন তালাক না দিয়ে তিন মাসে তিন তালাক দেবে। ফলে  মুসলিম নারীদের দুর্দশার  লাঘব বিশেষ হবে না।
মূল তালাক আইন বহাল থাকলে বহাল থাকবে ‘হিল্লা বিয়ে’ তথা ‘হালালা বিয়ে’ও। কারণ,  ‘হিল্লা/হালালা বিয়ে’ হলো মূল তালাক আইনের অবিচ্ছেদ্য ধারা বা অংশ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ যোগ্য যে, ‘হিল্লা বিয়ে’ নারীর পক্ষে চরম  অবমাননাকর শরিয়তি আইনে ভুলবশতঃ বা  ক্রোধবশতঃ কেউ তালাক দিলেও রক্ষে নেই, তৎক্ষণাৎ তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ কার্যকরী হয়ে যাবে। পরে সে যদি তালাক প্রত্যাহার করে নেয় এবং তারা উভয়েই যদি  দাম্পত্যজীবন পুনরায় শুরু করতে প্রবল ইচ্ছুক থাকে তবু তা করার ছাড়পত্র শরিয়তি বিধানে নেই। এমনকি যদি তারা ইসলামি মতে পরষ্পরকে বিয়ে করতে চাই তারও অনুমতি নেই। সেক্ষেত্রে বিধিটি হলো এ রকমঃ তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করতে হবে অন্য একজন পুরুষকেবিয়ের পর  সেই পুরুষটিকে অবাধে তার সঙ্গে যৌনক্রিয়া (পড়ুন ধর্ষণ) করতে দিতে হবে। এই যৌনক্রিয়াটি কিন্তু বাধ্যতামূলক, ইচ্ছামূলক বা ঐচ্ছিক নয়। তারপর সেই লোকটি যদি অনুগ্রহ করে তাকে তালাক দেয় তবেই সে তার আগের পুরুষকে পুনরায় বিয়ে করার উপযুক্ত হতে পারবে, নচেৎ নয়। এই জঘন্য বিয়েকে ইসলামের পরিভাষায় বলে ‘হিল্লা বিয়ে’ বা ‘হালালা বিয়ে’। আল্লাহর  আইন এমনই যে  পুরুষ যদি ভুল করে  তালাক দেয় তবে তারজন্যেন তাকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না, চড়া মাশুল দিতে হবে নারীকে তারে সতীত্ব ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে এই চরম নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য বিধান কোরানের। ২/২৩০ নং আয়াতে রয়েছে এই বিধানটি। কোরান সেখানে বলছে, “তারপর যদি সে তালাক দেয় তবে এরপর সে তার জন্য বৈধ হবে না যে পর্যন্ত না সে অন্য স্বামীকে বিবাহ করে। এখন যদি সেও তালাক দিয়ে দেয় তাহলে তাদের উভয়ের অপরাধ হবে না যদি তারা পরষ্পরের কাছে ফিরে আসে, - যদি তারা বিবেচনা করে যে তারা আল্লাহর গণ্ডির মধ্যে থাকতে পারবে।” নতুন পুরুষটির সঙ্গে যৌনসঙ্গম করার বাধ্যতামূলক নির্দেশটি রয়েছে হাদিসে। সেই হাদিসটি হলো – “একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞাসিত হন, ‘একটি লোক তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছিলো। অতঃপর সে অন্য লোকের সাথে বিবাহিত হলো। এরপর দরজা বন্ধ করে ও পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে যৌন মিলন না করেই দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিল। এখন কি স্ত্রীটি তার পূর্ব স্বামীর জন্যে হালাল হবে?’ রালুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘না, যে পর্যন্ত না মধুর স্বাদ গ্রহণ করে’ (সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম) (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ১ম-৩য় খণ্ড, পৃ-৬৪২, ৬৪৩)     

পরিশেষে তাই আবার বলতে চাই যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা বা আইনটি রদ ও বেআইনি করা নিশ্চয়ই মোদি সরকারের একটি ঐতিহাসিক কাজ। সেটা এজন্যে যে, চরম নারীবিরোধী  বর্বর তালাক আইনটি  সহস্রাধিক বছর ধরে ভারতীয় মুসলিম সমাজের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে রয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাটি বেআইনী হলে সেই জগদ্দল পাথরটাকে অন্ততঃ একটু হলেও নরানো তো যাবে আর এ কাজটাও তো মোটেই সহজ বা তুচ্ছ কাজ নয়। কিন্তু আবার এটাও চরম বাস্তব যে, এই আইনটি  মুসলিম নারীদের নিরাপত্তা প্রদানে এবং শোষণ ও নির্যাতন লাঘব করতে বিশেষ ফলপ্রসু হয়ে উঠতে পারবে না। কোরানের মধ্যযুগীয় তালাক আইনটির দানবীয় নির্যাতন থেকে মুসলিম নারীদের মুক্তি দিতে হলে সমগ্র তালাক আইনটাই বাতিল করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...