Monday, August 21, 2017

শরীয়া তালাক আইন নিয়ে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দটি সমাধান অযোগ্য



এখন একজন মুসলিম পুরুষ তার বৌকে তালাক (divorce) দিতে পারে নানা পন্থায়। ইসলাম কিন্তু শুরুতে তালাক দেওয়ার যে বিধান প্রচলন করেছিলো তাতে পদ্ধতি ছিলো মুলতঃ একটিই। বরকে তার বৌ-এর মুখের সামনে ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করে তালাক দিতে হতো। বলতে হতো, তোমাকে ‘তালাক’ দিলাম। তবে অন্য শব্দ বা কথা বলেও তালাক দেওয়া বৈধ বলে গণ্য হতো। যেমন মুহাম্মদ স্বয়ং তাঁর ২য় বৌ সওদাকে ‘তোমার ইদ্দত গণনা করো’ বলে প্রথম তালাক প্রদান করেছিলেন।  প্রথম দিকে এক মাস অন্তর দু’বার তালাক দেওয়ার পর তিন তালাক দিয়ে ‘বাইন’ তালাক বললে তালাক কার্যকর হতো। পরে সেটায় একটি সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধনিতে ঠিক হয় যে, এক সঙ্গে পরপর তিনবার তালাক দিয়ে বাইন তালাক বললেও তালাক কার্কর হবে। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নেওয়াকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।  ফলে তালাক দেওয়ার পদ্ধতিতে একটা বৈপ্লবিক  পরিবর্তন এসেছে। এখন তাই তালাক দেওয়ার নানা পন্থা বেরিয়েছে এবং বৌকে তালাক দেওয়া অনেক সহজ হয়েছে। এখন একজন মুসলিম পুরুষ তার  বৌকে তালাক দিতে পারে ডাক যোগে বা ক্যুরিয়ার মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে, মোবাইলে বা হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে, ইমেল পাঠিয়ে অথবা মোবাইলে ফোন করে কিংবা ভিডিও কলিং করেইন্টারনেটের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার এই অভিনব ও সহজ পন্থাগুলি ইসলাম-সম্মত কী না তা নিয়ে অবশ্য উলামা বা আলেম সমাজের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এই বিরোধ যে খুব প্রবল  তা বলা যায় না। তবে প্রবল মতবিরোধ রয়েছে মূল তালাক আইন (বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন/Divorce law) নিয়েই  এই মতবিরোধের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ ভাগ রয়েছে দেখা যায় যার একটি হলো ইসলামি তত্ত্বভিত্তিক, আর অন্যটি লিঙ্গভিত্তিক। প্রথম বিরোধটি সীমাবদ্ধ মূলতঃ আলেম সমাজের মধ্যে। দ্বিতীয় বিরোধটি মুসলমান সমাজের সঙ্গে আলেম সমাজেরএই বিরোধটি খুবই তীক্ষ্ণ ও  বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত।  প্রথম বিরোধটি তথা আলেম সমাজের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধটির  বীজ নিহিত রয়েছে মুসলমানদের দু’টি ধর্মগ্রন্থ  কোরান ও  হাদিসের মধ্যে। কোরানে তালাক সংক্রান্ত যে বিধি-নিষেধ রয়েছে, হাদিসে রয়েছে তার থেকে অনেকটাই আলাদা বিধি-নিষেধএকদল (শিয়া মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুগণ) কোরানের বিধানকেই একমাত্র ইসলাম-সম্মত বিধান বলে মানেন। তাঁদের মতে যারা (সুন্নি মুসলমানরা) যে হাদিসের কথা বলে তা মনুষ্যরচিত তথা খলিফাদের মনোনীত ধর্মগুরুদের রচিত মনগড়া   যা জাল এবং সেই হাদিসের বিধানগুলি ইসলামবিরোধী অপর দল (সুন্নি সমাজের আলেমগণ) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস  করেন যে  কোরান এবং হাদিস দু’টো ধর্মগ্রন্থই সমান সত্য, সংশয়াতীত ও নির্ভুল  তাঁদের অভিমত  হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিবার্য কারণে কোরানের বিধি আল্লাহ স্বয়ং পরিবর্তন করেছেন যে পরিবর্তনগুলির কিছু এসেছে আল্লাহর প্রেরিত দূত মুহাম্মদের মাধ্যমে, কিছু পরিবর্তন আল্লাহ  সরাসরি  জিব্রাইলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেনতাঁদের মতে হাদিস ও কোরান পরষ্পরের পরিপুরক এবং কোরানের প্রত্যেকটি কথা যেমন সত্যি তেমনি প্রত্যেকটি হাদিসও সমান সত্যি কারণ,  মুহাম্মদ আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছা ব্যতীত কিছু বলেন নি ও করেন নি  নিজ নিজ বিশ্বাসের জায়গায় অনড় থাকার পরিণতিটা হলো এই যে  শিয়া মুসলিম সমাজ শুধু কোরানে বর্ণিত তালাক আইন মেনে চলে এবং সুন্নি মুসলিম সমাজ মেনে চলে কোরান ও  হাদিস উওভয় ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা তালাক আইন যা শরিয়তি আইন (Sharia Law) নামে খ্যাত ভারতের সুন্নি সমাজের আলেমগণ ১৯৩৭ সালে কোরান ও হাদিসের সমন্বয়ে শরিয়তি তালাক প্রণয়ন করেন যা বাংলা সংস্করণে ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বলে খ্যাত। তত্ত্বগত এবং বিধিগত প্রবল মতবিরোধের জন্যে শিয়া মুসলিম এবং সুন্নি মুসলিম সমাজের আলেমদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এই দ্বন্দ ভারতের মাটিতে এক সময় চূড়ান্তরূপে প্রকটিত হয়ে পড়ে এবং শিয়া সমাজের প্রতিনিধিরা ‘নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Personal Law Board) থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি পৃথক  নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Personal Law Board) গঠন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এই দ্বন্দ শুধু শিয়া ও সুন্নি সমাজের পুরুষ আলেমদের  মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। দ্বন্দ প্রসারিত হয়ে পড়েছিলো সুন্নি সমাজের পুরুষ ও নারী ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। ফলে ‘নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ – এর নারী সদস্য এবং পুরুষ সদস্যদের মধ্যেও সেই দ্বন্দটি সেই সময়ে  চরম আকার ধারণ করে এবং পর্ষদের নারী সদস্যগণ এক সময়  ‘নিখিল ভারত  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন  পর্ষদ’ কর্তৃক প্রণীত বিয়ে ও তালাক আইনকে সম্পূর্ণ পুরুষকেন্দ্রিক ও নারীবিরোধী আখ্যা দিয়ে পুরো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের  দাবী উত্থাপন করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পুরুষ সদস্যগণ তাঁদের দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখান করেন। এর প্রতিবাদে নারী সদস্যগণ ‘নিখিল ভারত  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ থেকে পদত্যাগ করে বেরিয়ে  গিয়ে গঠন করেন মুসলিম মহিলাদের নিজস্ব পৃথক ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ - ‘নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Women Personal Law Board)  সেটাও ২০০৫ সালের ঘটনা। মুসলিম নারীদের এই পর্ষদ পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ পৃথক একটি ‘নিকাহ নামা’ অর্থাৎ ‘নিকাহ আইন’ প্রণয়ন করে যে  ‘নিকাহ নামা’য় তাঁরা নারীদের পুরুষদের সমান অধিকার প্রদান করেন।  ‘নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim  Women Personal Law Board) - তাদের প্রণয়ন করা নতুন ‘নিকাহ নামা’টি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পেশ করে আইনটিকে অনুমোদন ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে।       
তালাক আইন নিয়ে দ্বিতীয় যে বিরোধটি রয়েছে সেটা হলো মূলতঃ মুসলিম  জনতার সঙ্গে মুসলিম সমাজের আলেমদের বিরোধ এই বিরোধটি কোনো একটি দেশের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই, এটা যে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত সে কথা এর আগেই বল হয়েছেলিঙ্গগত বৈষম্য হলো এই বিরোধটির উৎপত্তির মূল কারণ গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজ এই বিরোধকে কেন্দ্র করে সরাসরি দু’টি শিবিরে বিভক্ত  আলেম সমাজ এবং সাধারণ মুসলিম জনতার মধ্যেকার দ্বন্দে এক পক্ষে যে শুধু আলেম সমাজ     এবং অপর পক্ষে সাধারণ মুসলিম জনতা  রয়েছে তা নয়।  ভারতে যে ছবিটা আমরা দেখি তাতে দেখা যায় যে মুসলিম জনতার একটা বিপুল অংশও রয়েছে আলেমদের সঙ্গে এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে   তালাক মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর অপরদিকে বাকি  অংশের মুসলমানরা চায় যে এই আইনটি সংশোধন বা বাতিল হোক তাদের দৃঢ় অভিমত হলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষিত হয় নি এবং আধুনিক সমাজে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা আর নেই এই বিরোধটি ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে। যারা  মুসলিম ব্যক্তিগত  তালাক আইনের  পরিবর্তে নারীর স্বার্থবাহী নতুন তালাক আইন প্রণয়নের পক্ষে তাদের পাল্লা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। এমনকি মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুদের মধ্য থেকেও একটা অংশ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি হালনাগাদ (update) করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। তাঁরাও খোলামেলা এটা বলছেন যে পরিবর্তিত পরিস্থিতে নতুন মুসলিম ব্যক্তিগত আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। আলেম সমাজের সঙ্গে মুসলিম সমাজের তীব্র বিরোধে  আলেম সমাজের একটা অংশ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের দাবিকে সমর্থন জানানোর ফলে মুসলিম বিশ্বে ২২/২৩টি তালাক আইন-সহ সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি হয় সম্পূর্ণই বাতিল হয়ে গিয়েছে, না হয় ব্যাপক মাত্রায় সংশোধিত হয়েছে। এ সব দেশ বহুবিয়ে হয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে, নতুবা দ্বিতীয় বিয়ের আগে আদালতের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। আর শরিয়া  তালাক আইনটি তো সবগুলি দেশই  সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছে।  এই দেশগুলি  আদালতের বাইরে তালাক প্রদান সম্পূর্ণ নিষদ্ধ করেছে। যে দেশগুলি  শরিয়া বিয়ে ও তালাক আইন সংশোধন বা বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে  তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ হলো ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া,   মালয়েশিয়া, তাজকিস্তান, কাজাখাস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইত্যাদি। ভারত একটি হিন্দু অধ্যুষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তথাপি এ দেশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তথা ইসলামি বিয়ে ও তালাক আইন চালু রয়েছে। সেটা এ জন্যে নয় যে এ দেশের সমগ্র মুসলিম সমাজ মুসলিম ব্যক্তিগত আইন আঁকড়ে থাকতে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান দেখা যায় কেবল উলামা তথা আলেম সমাজের মধ্যেই দেশের ভোটভিখারি রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণ মুসলিমদের স্বার্থের কথা মোটেই ভাবে না, তারা আলেম সমাজকেই কেবল  তুষ্ট রাখতে সদা তৎপরএই রাজনৈতিক দলগুলো চায় না মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি সংস্কার হোক। তাই এ দেশে আজো মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তথা শরিয়া বিয়ে ও তালাক আইন আজও চালু রয়েছে। কিন্তু এই  আইনটির বিরুদ্ধে এ দেশে জনমত ও আন্দোলন ধীরে  ধীরে হলেও ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করছেন প্রধানতঃ   এ দেশেরই মুসলিম মহিলারা। ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করছে। বলা বাহুল্য যে এই সংগঠনটি ভারতের মুসলিম মহিলারাই তৈরী করেছেন এবং পরিচালনা করছেন। তাঁরা কয়েকমাস আগে ৭০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন পত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছেন যেখানে বহু বিয়ে এবং তালাক আইন বাতিল করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার দাবি জানানো হয়েছে। তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতেও একই দাবি জানিয়ে একটা রিট পিটিশন দাখিল করেছেনসুপ্রিম কোর্ট সেই পিটিশন গ্রহণ করে আইনি প্রক্রিয়া শুরুও করেছে। এখন ভারতে গোটা দেশ জুড়েই এই মুহূর্তে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে।  
তালাক আইনের কথায় ফিরে আসা যাক। এই আইন নিয়ে দ্বন্দের যে ছবিটি আমরা দেখি তা হলো এই যে, তালাক আইন নিয়ে আলেম সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ এবং আলেম সমাজ ও মুসলিম জনগণের দ্বন্দ ক্রমবর্ধমান। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয় এই দ্বন্দটি নিয়ে তা হলো - উপরে উল্লেখিত দ্বন্দ দু'টি সমগ্র বিশ্বজুড়েই রয়েছে এবং দ্বন্দ দু'টি ক্রমশঃ তীব্র ও প্রকট হচ্ছে, কোথাও হ্রাস পাচ্ছে না বা প্রশমিত হচ্ছে না। দ্বন্দের এই ছবিটি থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে দ্বন্দ দু'টি মীমাংসার অযোগ্য এবং এই দ্বন্দটির অবসান হতে পারে কেবল মুসলিম ব্যক্তগত আইনটির মৃত্যু বা বিলুপ্তি ঘটার মধ্য দিয়ে। পরিস্থিতি সেই দিকেই এগোচ্ছে। তালাক আইন নিয়ে উদ্ভূত দ্বন্দ কেনো ক্রমবর্ধমান এবং কেনো এর বিলোপ অবশ্যম্ভাবী তা জানতে হলে জানতে হবে ভালো করে শরিয়া তালাক আইনটি।    
     

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...