Friday, May 19, 2017

কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা ----- (আট/এক)

                         অধ্যায় - আট/এক

কারবালা যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল

এখন থেকে ১৩৩২ বছর পুর্বে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে তবুও তার প্রভাব রয়েছে মুসলিম সমাজেপ্রতিবছর সমগ্র বিশ্বে এই দিনটি উদযাপিত হয় ‘মহরম’ হিসাবেযুদ্ধের তারিখটি ছিল আরবি ক্যালেন্ডারের মহরম মাসের ১০ তারিখ, তাই এই দিনটি ‘মহরম’ দিবস  নামেই অভিহিত হয়ে আসছেদিনটি বলা বাহুল্য যে একটি শোকের দিনকিন্তু মহরম যে ভাবে উদযাপিত তাতে উদযাপনকারীদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র থাকে নাভীষণ আনন্দ  সহকারে তাঁরা দিনটি উদযাপন করে থাকেন। ঢাক-ঢোল ও নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের বাজনার তালেতালে উদ্দাম নৃত্যে মত্ত হয়ে ওঠেন তাঁরা১০ ই মহরমের  কয়েকদিন পূর্ব থেকেই এই আনন্দ যজ্ঞ শুরু হয় এবং ‘মহরমে’র দিন তার সমাপ্তি ঘটেমহরমের এই ধরণের অনুষ্ঠানে যাঁরা সামিল হন তাঁরা অনেকেই পুরো মাত্রায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য মদ পান করেনমহরম দিবসের এইরূপ উদযাপন থেকে এটা স্পষ্ট যে কারবালা যুদ্ধের সত্য-মিথ্যা কোনো ইতিহাসই অধিকাংশ মুসলমানই জানেন নামহরমের দিনে অতি নগণ্য একটি অংশ হোসেনকে স্মরণ করেন বেদনা ভরা মনেতাঁদের মধ্যে আবার একটি অংশ আছে যাঁরা আরও নগণ্য তাঁরা নিজেদের বুকে পেটে খুর দিয়ে আঘাত করে  হোসেন তাঁর মৃত্যুর সময়ে যে শারিরীক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন সেটা ভাগ করে নিতে চায় । এই দৃশ্য  সত্যিই হৃদয় বিদারক। ধর্মান্ধতা মানুষকে কত আবেগপ্রবণ ও নিরেট মূর্খ করে তুলতে পারে এটা তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণও বটেএই আবেগপ্রবণ ধর্মান্ধ মুসলিম জনতা মুসলিম ঐতিহাসিক এবং ধর্মগুরুগণ কারবালা যুদ্ধ নিয়ে আলি ও তাঁর পুত্রদ্বয় হাসান ও হোসেনের পক্ষে যে নগ্ন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ এবং অসত্য ও বিকৃত ইতিহাস প্রচার করেন তাঁরই শিকার
কারবালা যুদ্ধ অখণ্ড মুসলিম জামাতকে সর্ব প্রথম সরাসরি দুভাগে ভাগ করে দেয়। বিশ্ব মুসলিম সমাজ এখন আক্ষরিক অর্থেই বহুধা বিভক্ততবে প্রাধান দুটি ভাগ হলো শিয়া ও সুন্নীশিয়া সুন্নীর বাইরেও রয়েছে ‘আহমদীয়া মুসলিম জামাত’।  আবার শিয়া ও সুন্নীদের ভিতরে বহু ভাগ-উপভাগ আছেএই যে আলাদা আলাদা ভাগ বা গোষ্ঠী তাদের মধ্যেকার বিভাজন বা  দ্বন্দগুলো এতই তীক্ষ্ণ ও প্রকট যে একটা গোষ্ঠী আর একটা গোষ্ঠীকে শত্রুতা জ্ঞান করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রধান দুটি ভাগের উৎপত্তি হয় কারবালা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এক পক্ষের মত ছিলো (এখনো আছে) ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা পদ অলঙ্কৃত করার অধিকার মুহাম্মদের বংশধর ছাড়া আর কারোরই নেই তাঁদের অভিমত ছিলো -   প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফাগণ খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অন্যায়ভাবে,  সেই সময়ে যিনি একমাত্র ন্যায্য ও যোগ্য উত্তরাধিকার ছিলেন সেই আলিকে বঞ্চিত করে, তাই তাঁরা ছিলেন অবৈধ খলিফাশিয়া মুসলমানরা এই মতের অনুসারীবাকিরা সুন্নী মুসলমানএঁরা বিশ্বাস করেন যে নবী ও রসুলদের কোনো উত্তরাধিকার হয় নাতাঁরা এও বিশ্বাস করেন যে আলির পূর্ববর্তী তিন খলিফাই ইসলাম-সম্মত উপায়েই খেলাফত লাভ করেছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন অবশ্যই বৈধ খলিফাশিয়া মুসলিমরা তৃতীয় খলিফার খেলাফত কালে সংকলিত কোরানকে (সুন্নী মুসলমানরা এখন যে  কোরানটিকেই আল্লাহর প্রেরিত বলে বিশ্বাস করেন) সত্য ও বিশুদ্ধ কোরান বলে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা এই কোরানটিকে ‘খেলাফতি কোরান’ অর্থাৎ নকল বা জাল কোরান বলে মনে করেন   শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করেন আলির সঙ্গে প্রতারণা করে যাঁরা খলিফা হয়েছিলেন তাঁরা নিজেদের অন্যায় চাপা দিতে কোরানের কিছু অংশ বাতিল করেছেন, কিছু অংশ সংশোধন করেছেন এবং কিছু অংশ নিজেরা রচনা করে কোরানে জুড়ে দিয়েছেনঅপরদিকে সুন্নী মুসলমানরা এই কোরানকেই সহি তথা আসল কোরান বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করেন এবং এইরূপ বিশ্বাসও পোষণ করেন যে এই কোরানটাই বেহেস্তে আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রয়েছেএইরূপ প্রবল মতভেদের কারণে দুপক্ষই পরষ্পরকে প্রতিপক্ষ বলে মনে করে এবং এক পক্ষ অন্য পক্ষকে মুসলমান বলেই মনে করে নাকারবালা যুদ্ধের সময়েই মুসলমানরা দুটো ভাগে হয়ে যায় যাদের একটি ভাগ ছিলো এজিদের পক্ষে,  আর অপর ভাগটি ছিলো হোসেনের পক্ষেহোসেনের পক্ষে যারা ছিলো তারা ছিলো নগণ্য একটি অংশ মাত্রব্যাপক সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন খলিফা এজিদের পক্ষেই  যাঁরা পরে সুন্নী মুসলমান রূপে পরিচিত লাভ করেন। সেই ধারা আজও  অব্যাহত আছে, পৃথিবীতে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা  তুলনামূলকভাবে আজও নগণ্য, দশ শতাংশ মাত্রঅবশ্য এখন সুন্নী মুসলমানরাও মনে করেন যে মাবিয়ার পর খেলাফতের ন্যায্য দাবীদার ছিলেন শুধু হোসেনই, এজিদ ছিলেন একজন অবৈধ খলিফা, তিনি অনৈসলামিক পথে খলিফা হয়েছিলেন
কারবালা যুদ্ধের পরিপ্রক্ষিতে মুসলমান জগৎ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেও ইসলামি সাম্রাজ্যে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে নিঅতি সামান্য প্রভাব যে টুকু পড়েছিল তা  মক্কা ও মদিনা শহরেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিলআব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের এজিদকে শেষ পর্যন্ত খলিফা পদে স্বীকার করেন নি এবং তিনি নিজেকেই খলিফা বলে ঘোষণা করেছিলেনএজিদ আব্দুল্লাহর বিদ্রোহোকে খুব সহজেই দমন করে মক্কা-মদিনায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেনএজিদ বেশীদিন জীবিত ছিলেন না, সাড়ে তিন বছর খেলাফত চালানোর পর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনতারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দ্বিতীয় মাবিয়া খলিফা হন, কিন্তু তিনি ছিলেন ভীষণ অসুস্থ এবং ৩/৪ মাসের মধ্যে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনতারপর খলিফা হন প্রথম মারোয়ান যিনি খলিফা হওয়ার পর সাম্রাজ্যের মধ্যে যে টুকু অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা তখনো অবশিষ্ট ছিল তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় এবং  সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ যেটা থমকে গিয়েছিল তা আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় মারোয়ান তাঁর পুত্র অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি আব্দুল মালিকের হাতে খেলাফত অর্পণ করে যান আলির পর প্রথমে মাবিয়া ও পরে প্রথম মারোয়ান ইসলামি সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের কিনারা থেকে তুলে নিয়ে এসে তাকে এত শক্ত ও সুসংহত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যে সেই ইসলামি সাম্রাজ্য ও তার খলিফাতন্ত্র অর্থাৎ  খেলাফতি শাসন-ব্যবস্থা টিকে ছিল কারবালা যুদ্ধের পরও প্রায় ৬০০ বছর (১২৫৮ খৃঃ পর্যন্ত)। এই সময়ের মধ্যে আবার উমাইয়া যুগকে (৬৬১-৭৫০ খৃঃ) বলা হয় ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বর্ণযুগমাবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক তাই তাঁর খেলাফতকাল থেকে শুরু করে ঐ বংশের যিনি শেষ খলিফা (দ্বিতীয় মারোয়ান, ৭৪৪-৭৫০) ছিলেন তাঁর সময়কালকে বলা হয় উমাইয়া যুগআলি ও হোসেনের পক্ষে যদি যথেষ্ট জনসমর্থন থাকত কিংবা মাবিয়া ও এজিদের পক্ষে যদি মুসলিম জাহানের নিরঙ্কুশ সমর্থন না থাকতো তবে এটা কখনোই সম্ভবপর হতো না 
নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে, মুহাম্মদ প্রবর্তিত ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রায় অপমৃত্যু হুতে যাচ্ছিল আলি ও তাঁর পুত্র হোসেনের কবলে পড়েমাবিয়া সেই অপমৃত্যুর হাত থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। সেজন্য তামাম দুনিয়ার মুসলমানদের উচিত ছিল মাবিয়ার নিকট কৃতজ্ঞ থাকাকিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো মাবিয়াই এখন মুসলিম উম্মাহর কাছে সব চেয়ে বড় নিকৃষ্ট ব্যক্তিসে কথা থাক,আলোচনা হচ্ছিল কারবালা যুদ্ধের প্রভাব কতটা পড়েছিল সে প্রসঙ্গেএই প্রসঙ্গে শেষ ও মুল কথাটি হলো, কারবালা যুদ্ধের পর যে ব্যাপকভাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের শক্তি ও আয়তনের বৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটেছে তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে কারবালা যুদ্ধের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নি মুসলিম সমাজ ও ইসলামি সাম্রাজ্যের উপর।


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...