Monday, February 6, 2017

কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা – ৭ ( দুই)


সপ্তম অধ্যায় - দুই

হোসেন নিজেই কারবালা যুদ্ধ অনিবার্য করে তুলে অকালে মৃত্যু বরণ করেন  

সে দিনটি ছিল ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর (আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬১ হিজরির ১০ই মহরম)আর একটি মত হলো তারিখটি ছিল ১০ই অক্টোবর নয় ১৩ই অক্টোবরএজিদের সৈন্যবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কত ছিল তা নিয়েও অনেক মতভেদ আছে।  তবে সকলেই একমত যে সৈন্য সংখ্যা ছিল কমপক্ষে তিন হাজার এবং সর্বাধিক দশ হাজারউভয় পক্ষের সৈন্য সংখ্যা যাই হোক না কেন কারবালা প্রান্তরের সেই যুদ্ধটা ছিল একেবারেই অসম যুদ্ধস্বভাবতই ঐ যুদ্ধে হোসেন পরাস্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর পক্ষের সকল সৈন্যই নিহত হয়েছিলেনআগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে হোসেনের সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল সত্তর জন থেকে একশ দশ জনহোসেনের প্রতিরোধ করার শক্তি যখন নিঃশেষিত এবং তিনি যখন ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন তখন সিমার নামের একজন সেনাপতি তলোয়ারের আঘাতে তাঁর শিরচ্ছেদ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কারবালা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়ের

কারবালা যুদ্ধের  যে সব বর্ণণা শোনা যায় তাতেও লক্ষ্য করা যায় একটা বর্ণণার সঙ্গে আর একটা বর্ণণার আকাশ-পাতাল বিভেদতার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে কারবালা যুদ্ধের উপর মুসলিম ঐতিহাসিক এবং গল্পকারগণ তাঁদের লেখায় এজিদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা, বর্বরতা এবং অমানবিকতার কথা লিখেছেন তার অধিকাংশই তাঁদের মনগড়া এটা হওয়ার কারণ হলো এই সব লেখকগণ কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস লেখার মনোভাব নিয়ে লিখছেন এমনটা নয়, তাঁরা লিখেছেন এটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে ইমাম হোসেন ইসলামের নীতি ও আদর্শকে রক্ষা করার জন্য মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু এজিদের বিরুদ্ধে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধ করে আত্মাহুতি দিয়েছেনস্বভাবতই তাঁদের লেখা ইতিহাসে এবং গল্প-উপন্যাসে যেমন অমিলের ছড়াছড়ি দেখা যায়, তেমনি তাঁদের লেখায় কারবালা যুদ্ধ্বের সত্যিকার ইতিহাসের পরিবর্তে উঠে এসেছে বিকৃত, অর্ধসত্য এবং অসত্য ও মিথ্যা ইতিহাসতাঁরা কতটা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কারবালা যুদ্ধের মনগড়া ইতিহাস রচনা করেছেন তা বুঝবার সুবিধার্থে দুটো লেখা থেকে কয়েকটি  বিবরণ এখানে  উদ্ধৃত করা হলো“... নবীজীর প্রাণের নাতি বারবার অনুরোধ করলেন – তোমরা নদী তীর বন্ধ করো না। আমাদের পানি দাওআমরা সকলেই অত্যন্ত পিপাসার্ত, আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, আমরা চরম পিপাসাতে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরাশায়ী হয়ে যাবো। তোমরা আমাদের জল দাও... জানালেন সকরুণ প্রার্থনা – আমাকে ও আমার পুরুষকুলকে জল দিতে হবে না , তোমরা আমাদের মহিলাদের বাঁচাও, তাদের একটু জল দাও... তারা তোমাদের মা বোনদের মতই অবলা, নিরপরাধ তাদের একটু জল দাও, তারা পিপাসাতে বড়ই কাতর স্বরে ছটফট করছে। বাঁচার মত একটু জল দাও... আমাদের শিশুদের একটু জল দাও, তারা চরম পিপাসায় তাদের মায়ের কোলে চিৎকার করছেতারা কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে...
মহাত্মা হোসেন আকুল কন্ঠে, ব্যাকুল চিত্তে আকাশ-পাতাল ভেদ করছেন, তখনও নরাধমদের বুকের কোণে এক বিন্দুও করুণার উদ্রেক হয় নি, তখন তারা অট্টহাসিতে মশগুল...
ইমাম শত্রুপক্ষের নিকট শিশুদের জন্য সামান্য পানি প্রার্থী হওয়ার পর শত্রুপক্ষের অগণিত তীর ইমামের শিবিরে ও লোকজনের উওপর পড়তে আরম্ভ করলোএইবার ইমাম হোসেনের ১০ বছরের ভ্রাতুষ্পুত্র কাসেম শাহাদাত বরণ করেনপরে পিপাসার্ত ইমাম পুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে পানির জন্য সামান্য অগ্রসর হওয়া মাত্রই আসগরও তীরবিদ্ধ হলেনএইভাবে একের পর এক শিবিরের প্রায় সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে  পড়লেন পিপাসার্ত ইমাম সকলের শেষে নদীতীরে যাওয়ার চেষ্টা করলে শত্রুকুল তাঁকে ঘিরে ফেললেনতিনিও শরবিদ্ধ হয়ে ক্ষুধায় পিপাসায় অর্দ্ধমৃত অবস্থায় ভূপতিত হলে নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠ সিমার ইমামের শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে ইমাম তাকে তাঁর গলার পরিবর্তে ঘাড়ের উপর আঘাত হানতে নির্দেশ দেন এইভাবে ১০ মহরম কুখ্যাত সীমার কর্তৃক একের পর এক ৭০ জনই শাহাদাত বরণ করেন” (দ্রঃ – উমাইয়া খেলাফত, ড.ওসমান গণি, পৃ – ৪৮-৫২)  ইমাম হোসেনকে নিয়ে লেখা ঐ একই ঘটনায় আর একটি বিবরণ এরূপঃ Hussein ibn Ali told Yazid’s army to offer him single battle, they gave his request. He killed everybody that fought him in single battles. He frequently forced his enemy into retreat, killing a great number of opponents. Hussein and earlier his son Ali al – Akbar ibn Husayn were the two warriors who penetrated and dispersed the core of ibn Sa’ad army (Qualb – e -Lashkar), a sign of extreme chaos in traditional warfare.
Hussein advanced very deep in the back ranks in the Syrian army when the enemies stood between him and the tents he shouted: ‘ woe betide you oh followers Abu Sufyan ibn Harb’s dynasty! If no religion ever been accepted by you and you have not been fearing the resurrection day then be noble in your world that is if you were Arabs you clam.
Then his enemies evaded back toward him. They continuously attacked each other until his numerous injuries caused him to stay a moment. At this time he was hit on his forehead with a stone. He was cleaning blood from his face while he was hit on the heart with arrow and said: In the name of Allah and by Allah and on the messenger of Allah.’  Then he raised his head up and said: ‘Oh my God! You know that they are killing a man that there is son of daughter of a prophet on the earth except him.’ He then grasped and pulled the arrow out of his chest, which caused heavy bleeding.
He became very weak and stopped fighting. The soldiers approaching him give up confrontation, seeing his position. One soldier, however, walked up to Hussein and hit him his on his head with his sword.
Hussein got on his horse and tried to leave, but Yazid’s army continued to pursuit. …
Omar bin Sa’ad ordered a man to dismount and finish the job. … then Shimr ibn Dhiljawshan dismounted his horse and cut Hussein’s throat with his sword while Hussein was prostrating to God. Just before his throat was about to be cut, Hussein asked Shimr ibn Dhiljawshan, “Have you done your prayers today? (Source: Wikipedia). উপরের দুটি বর্ণণা কারবালা প্রান্তরে ১০ই মহরমের দিনের হোসেনের  ভুমিকা কে কেন্দ্র করেকিন্তু দুটি বর্ণণার মধ্যে কত প্রভেদ? বস্তুত কোনো মিলই নেই এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারেএখানে আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাকসেটা কারবালা যুদ্ধ পরবর্তী একটি ঘটনাকে ঘিরে. ওসমান গণি লিখছেন তাঁর উক্ত পুস্তকে, “পরে ৭০ টি কর্তিত মুন্ডু এবং স্ত্রীলোক ও শিশু সন্তানদের বন্দী অবস্থায় কুফায় উবাইদুল্লাহর নিকট প্রেরণ করা হলযখন রসুলে আকরমের দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের রক্তাক্ত শির উবাইদুল্লাহর পদপ্রান্তে হাজির করা হল, তখন কুফার আকাশে-বাতাসে শুধু একটিই রব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল – হায় হোসেন, হায় হোসেন। অসতী নারীর জারজ সন্তান জিয়াদের পুত্র সমগ্র মনুষ্যকুলের মধ্যে সাক্ষাৎ-শয়তান ইবলিস – উবাইদুল্লাহ অতি তাচ্ছিল্যভাবে যখন ইমামের পবিত্র ছিন্ন মস্তককে একটি ছড়ির দ্বারা নাড়াচাড়া করছিলেন, তখন একজন বৃদ্ধ সাহাবী গগনভেদী আর্তনাদ করে বলে উঠলেন –‘ধীরে, ওহে ধীরে! এইটি হযরতের দৌহিত্র, আল্লাহর কসম, আমি স্বচক্ষে  রসুলে করিম হযরত মহম্মদ (দঃ) – এর পবিত্র মুখদ্বারা এই ওষ্ঠদ্বয়ে বারবার স্নেহ-চুম্বন করতে দেখেছি।’ বৃদ্ধের মুখদ্বারা এই কথা  সজোরে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুরাত্মা উবাইদুল্লাহর শরীর ভুমিকম্পের মত প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল, সত্যের ঘোষণা এমনি অনিবার্য। তাই আজিও ইয়াজিদ, উবাইদুল্লাহ, ওমর ও সীমার প্রমুখ নরাধমদের উপর সমগ্র মনুষ্য জগতের অভিসম্পাত শ্রাবণের বারি ধারার মত ঝরছে। ...
পরে নরাধম উবাইদুল্লাহ হোসেনের ছিন্ন মস্তক ও অন্যান্য পরিজনবর্গকে রাজধানী দামেস্কে প্রেরণ করলে ইয়াজিদ ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় অতি সত্বর ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করেন, এবং কারবালা প্রান্তরে সকলকে সমাধিস্থ করা হয়। জীবিত শিশু ও স্ত্রীলোকগণকে ইয়াজিদ সস্মমানে মদিনায় প্রেরণ করেন।’ (পৃ -৫২) কারবালা প্রান্তরে ১০ই মহরমের ঐ বিয়োগান্ত ঘটনার পরের দৃশ্যের বিবরণ অন্য একটি লেখায় এ রকমঃ কুফায় হোসেনের ছিন্ন মস্তক সহ তাঁর পরিবারের লোকজনদের নিয়ে পৌঁছানোর পর আলীর কন্যা তথা হোসেনের ভগ্নী জয়নব কুফাবাসীদের বলছেন - ‘Oh! People of Kufa! Oh deceitful renege people! Do you weep? So let tears not be dried and let groans not be finished. … Beware, such a bad preparation you have made for yourself that Allah became furious of you and you will be at punishment for ever. Do you weep and cry?  yes, by Allah , do weep numerously and do laugh less! Since you brought its shame and fault on yourself and you will not be cleanse forever. ‘বন্দীদের দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার পর সূত্রটি লিখছে, ‘(Zaynab) Gave a famous speech in which she denounced Yajid’s claim to be the caliphate and eulogized Hussein’s uprising. 'এজিদের (ইয়াজিদের) প্রাসাদে বন্দীদের কতদিন আটকে রাখা হয়েছিল এবং বন্দীগণ কীরূপ আচরণ করেছিলেন সে বিষয়ে যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা এই রকমঃ ‘The  prisoners were held in Damascus for a year, some prisoners died of grief, most notably Sukayna bint Husayn. The people of Damascus began to frequent the prison, and Zaynab and Ali ibn al-Husayn used that as opportunity to further propagate the message of Huseein and explain to the people the reason for Hussein’s uprising. As public opinion against Yazid began to foment in Syria and part of Iraq, Yazid ordered their release and return to Medina, where they continued to tell the Hussein,s cause . (Wikipedia).  
কারবালা যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে উক্ত দুটি বিবরণের মধ্যে কোনো সায়ুজ্যই নেই তা বলা বাহুল্য। উইকিপিডিয়া যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে তা যে প্রায় সম্পূর্ণই  মনগড়া তা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোধগম্য হয়। নবীর দোহিত্র হোসেনের প্রতি যাঁদের গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁদের মনের গভীরে এজিদের সৈন্যদের প্রতি ভয়-ভীতিও যে ছিল সে কথাও খেয়ালে রাখা প্রয়োজন। সেই ভয়-ভীতি ঊপেক্ষা করে সবাই হোসেনের কাটা মুন্ডু এবং পরিবারের লোকজনদের দেখতে ব্যাপক মানুষ হুমরি খেয়ে পড়েছিল এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয় দাবী হলো রাজধানী দামেস্ক শহরে কারাগারে দলে দলে মুসলমানরা হোসেনের পরিবারের সদস্যদের দেখতে ভীড় করেছেন এবং সেই লোকজনদের সামনে মনের সুখে বা মনের দুখে হোসেনের পরিবারের লোকেরা এজিদের সমালোচনা করেছেন এবং হোসেনের প্রশংশা করেছেন আর এজিদ ও তাঁর সৈন্য-সামন্ত সবাই চুপচাপ দেখেছেন ওই বিবরণে আরও আছে যে, কারাগার থেকে হোসেনের পরিবারের সদস্যদের প্রচারে সিরিয়ায় এবং ইরাকের বিভিন্ন জায়গায় এজিদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও জনরোষ বাড়তে শুরু করায় এজিদ ভীষণ ভীত হয়ে পড়েন এবং তাঁদেরকে মুক্তি দিয়ে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এই সব দাবীগুলি শুধু অসারই নয়, গল্পের গরুর গাছে ওঠার মতই হাস্যকর এবং কাল্পনিক। অবশ্য হোসেনের কাটা মুন্ডু সহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া এবং তারপর এজিদের ভুমিকা সম্পর্কে ড.গণির বিবরণের মধ্যে কিছুটা সত্যতা রয়েছে। ওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর উচ্চারিত বিশেষণগুলি শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করলেও এজিদের ভূমিকা প্রসঙ্গে যেটা বলেছেন তাতে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার কিছুটা ছাপ আছে। এজিদ হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সাথে যে ব্যবহার প্রদর্শন করেছেন তাতে তাঁর মহানুভবতার ছাপ রয়েছে। কোনো মুসলিম ঐতিহাসিক যদি তা স্বীকার করেন তবে তা মুসলিমদের পক্ষে খুবই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ড.গণি ওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সর্বৈব অসত্য ও আক্রোশমূলক। হোসেনের কাটা মুন্ডু নিয়ে ওবাইদুল্লাহ যে পৈশাচিক আচরণ করেছেন বলে তিনি দাবী করেছেন তাতে প্রমাণিত হয় যে হোসেনের প্রতি ওবাইদুল্লাহর মনে অশেষ ক্রোধ ও ঘৃণা যুগযুগ ব্যাপী সঞ্চিত ছিল। কিন্তু এটা কতটা সত্য তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। বরং হোসেনের প্রতি অনেকটা উদার ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এমন কথায় জানাচ্ছে অন্য একটি সুত্র যেটা মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত। সূত্রটি লিখছে, ‘... Upon learning that his army had succeeded to lay a siege around the Imam's camp, Governor Ibn Ziyad sent additional military units to Karbala and appointed Umar Ibn Sa'ad in charge. Imam Husain (a.s.) opened a dialogue with Umar Ibn Sa'ad and convinced him to lift the siege so that the Imam with his family and companions could leave Iraq. Umar Ibn Sa'ad liked the Imam's proposal and sent a message to Governor Ibn Ziyad notifying him about the results of the talks with Imam Husain (a.s.). Ibn Ziyad also found the Imam's proposal acceptable. However before agreeing to it officially, Shimr Bin Dhil-Jawshan, opposed it strongly. As a result Ziyad wrote a letter to Umar Ibn Sa'ad commanding him to either go to war with Imam Husain (a.s.) or be relieved of his duties as commander of the army and Shimr would not only replace him but despatch Ibn Sa'ad's head to Kufa. (www.al-islam.org/short/karbala.htm).  
এখানে যে ইবন জিয়াদের কথা বলা হয়েছে তিনিই হলেন কুফার নব নিয়ুক্ত গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ। সুত্রটি বলছে তিনি হোসেনকে মক্কায় ফিরে যেতে দিতে তিনি সম্মত ছিলেন, কিন্তু সীমারের তীব্র আপত্তির কারণে তাঁকে (হোসেনকে) সে সুযোগ দিতে পারেন নি। এই ঘটনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় না যে হোসেনের কাটা মুন্ডুকে অসম্মান ও অপমান করার নিকৃষ্ট মনোভব ওবাইদুল্লাহ পোষণ করতেন। ওবাইদুল্লাহর নেতৃতাধীন বাহিনীর হাতে হোসেন নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, সুতরাং ওবাইদুল্লাহ একজন নিকৃষ্ট ও নিচু প্রবৃত্তির মানুষ – এই তথ্যটা বা কথাটা ধর্মান্ধ মুসলমানদের যতটা স্তি দেয়, ততোটাই অস্বস্তি দেয়   তার উলটো কথাটা। তাই ড.গণি এজিদ সম্পর্কে যা লিখেছেন এবং উক্ত ওয়েব সাইটটি ওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে যা লিখেছে তা ধর্মান্ধ মুসলমানদের কাছে খুবই অস্বতিকর। এইসব অস্বস্তিদায়ক তথ্যগুলি আধুনিক যুগের মুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকগণ সর্বতভাবে চেষ্ট করে থাকেন আড়াল করার বা গোপন করার কিংবা খন্ডন করার। কিন্তু তা সম্ভব নয় কারণ, আরবের প্রথম যুগের ঐতিহাসিকগণ যে সব ইতিহাস লিখে গেছেন তাতে তাঁরা কোনো তথ্যই গোপন করেন নি তা যতই মুসলিমদের পক্ষে অস্বস্তিকর হোক না কেন। সেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে আল তাবারি হলেন একজন। আল তাবারি লিখেছেন যে এজিদ হোসেনের কর্তিত মুন্ডু দেখে ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সেই কর্তিত মুন্ডু সহ অন্যান্য সকল মুন্ডুগুলি মর্যাদার সঙ্গে সমাধিস্থ করার নির্দেশ দেন এবং সসম্মানে হোসেনের পরিবারবর্গকে মদিনায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেনআল তাবারি সহ সেই যুগের ঐতিহাসিকপগণ যাঁরা যথাসম্ভব সত্য ইতিহাস লিখে গেছেন সেই ইতিহাস গ্রন্থগুলি পরবার্তীকালে নষ্ট করে ফেলা হয়। তাঁদের লেখা ইতিহাসকে খণ্ডন করে অনেক ইতিহাস ও সমালোচনা লেখা হয়েছে। এইসব বই ও সমালোচনামূলক লেখাগুলি থেকে প্রথম যুগের ঐতিহাসিদের লেখা  অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ফলে আলি মহান আর মাবিয়া নিকৃষ্ট এবং হোসেন মহান আর এজিদ নিকৃষ্ট বলে তুলে ধরার বহু শতাব্দী ধরে হাজার চেষ্টা সত্বেও মাবিয়া ও এজিদের মধ্যে যে ভাল গুণাবলীগুলি ছিল তা মুছে দেওয়া যায় নি। এবং ঐ কারণে হাজার চেষ্টা করেও ইসলাম ধর্ম এবং  ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও তার প্রসারের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক বলপ্রয়োগ, খুন-সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে তা চাপা দেওয়া যায় নিএ প্রসঙ্গ থাক, ফিরে যাওয়া যাক কারবালার ইতিহাসে।  স্ব
কারবালার যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনায় যাওয়ার আগে আরও একবার যুদ্ধের প্রাকমূহুর্তের ঘটনার উপর দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। ইতিমধ্যেই সেই অধ্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। সেই আলোচনায় আমরা দেখেছি যে হোসেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য যথাসাধ্য প্রয়াস করেছেন এমন দাবী করেছেন ড.ওসমান গণি। তিনি লিখেছেন যে হোসেন এজিদের সেনাপতিদের তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন যা মেনে নিলে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী হত না। প্রস্তাব তিনটি কি কি তার উল্লেখ উপরে করা হয়েছে। সেই প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখান করে এজিদের সৈন্যবাহিনী ফোরাত নদীর জল বন্ধ করে দিয়ে এজিদের বাহিনীকে অবরোধ করা হয় তখন হোসেন পিপাসার্ত শিশু ও নারীদের জন্য হোসেন সকলের কাছে এক ফোঁটা জলের জন্য বারবার কাতর অনুরোধ করেছেন, প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু এক ফোঁটা জল না দিয়ে এজিদের বাহিনী সবার বুকে তীর নিক্ষেপ করে সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। এক্ষেত্রে নরাধম ও পৈশাচিকের দল শিশুদেরও রেহাই দেয় নি। এ সব বিবরণের মধ্যে দিয়ে যা বলা হয়েছে তা হলো এজিদের পরিকল্পনা ও নির্দেশই ছিল হোসেনকে হত্যা করা এবং প্রকৃতিগতভাবে এজিদ এবং তাঁর নিযুক্ত গভুর্ণর ওবাইদুল্লাহ ও প্রধান সেনাপতি ওমর বিন সা’দ প্রমুখরা প্রত্যেকে ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর,বর্বর ও পিশাচ। এজিদ হোসেনকে হত্যা করার জন্য বহু পূর্বেই সঙ্কল্প করেছিলেন এমন দাবী করেছে ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মোশারফ হোসেন। তিনি লিখেছেন, ‘যদি আমি মাবিয়ার পুত্র হই, তবে হাসান-হোসেনের বংশ একেবারে নিপাত না করিয়া জগৎ পরিত্যাগ করিব না। শুদ্ধ হাসানের মৃতদেহ দেখিয়াই যে, সে মহাগ্নি নির্বাপিত হইবে, তাহা নহে; হাসানের বংশ মধ্যে সকল মস্তক দ্বিখন্ডিত করিয়াই যে এজিদ ক্ষান্ত হইবে তাহাও নহে। মোহাম্মদের বংশের একটি প্রাণী বঁচিয়া থাকিতে এজিদ ক্ষান্ত হইবে না; তাহার মন মনোবেদনাও হইতে বিদুরিত হইবে না।’ (পৃ- ৩২)  এই সব দাবী সত্যি হলে তবে সবার লেখা ইতিহাসে বা উপন্যাসে এগুলির সমর্থন বা উল্লেখ থাকত। কিন্তু না, পাওয়া যায় না। শধু তাই নয়, এর বিপরীত বিবরণই আমরা দেখতে বিভিন্ন সুত্রের লেখায়। এর কিছু প্রমাণ অন্য ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি। এবার আমরা দেখব ড.গণি ও মীর সাহেবের দাবী কত অসার এবং মনগড়া তা অন্য সূত্রের বিবরণ থেকে যে সূত্রটিরও মুহাম্মদ এবং হোসেনের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আনুগত্য বিদ্যমান। এই সূত্রটি দাবী বলেছে যে, এজিদের সৈনিবাহিনী যখন হোসেনের গতিরোধ করে তখন তিনি দুটি কথা বলেছিলেন – আমি কুফার মানুষদের আহবানে কুফা যাচ্ছি, আমাকে তোমরা যেতে দাও, যদি কুফার মানুষ আমাকে না চায় আমি ফিরে আসব। আর আমাকে যদি কুফায় যেতেই না দাও তবে অবরোধ তুলে নাও, আমি এখান থেকেই মক্কা ফিরে যাচ্ছি। এর বাইরে কোনো কথা বলেন নি বা প্রস্তাব দেন নি। সূত্রটি কি লিখেছ দেখা যাক, ‘The enemy army blocked the camps of Imam Husain (a.s.) from advancing. Tension started to rise between the two. The Imam addressed the enemy explaining to them his motives for going to Kufa, that it was in response to the invitation of the people. He even showed them a bagful of letters he received from Kufa. Hur said that he and his men were not the writers of those letters. Imam told them that if they did not like him to advance with the journey, he was prepared to return to Hijaz.  (www.al-islam.org/short/karbala.htm)
ইমামের এই কথা শুনে সৈন্যদলের প্রধান ‘হুর’ ইমামকে জানালেন অকর্কশ ভাষায় জানালেন তাঁর প্রতি কি নির্দেশ রয়েছে গভর্ণর ওবাইদুল্লাহর। সেই নির্দেশে তাঁকে (হোসেনকে) হত্যা করার  আদেশ ছিল না
হুর’ ইমামকে কি বলেছিলেন তা তাঁর কথাতেই শোনা যাক –‘Hur replied, "We are commissioned to follow you until we take you to Governor Ibn Ziyad, and suggested to the Imam to go towards a station which is neither Kufa nor Medina." Imam Husain found the proposal fair and turned the caravan away from Kufa. Hur and his army marched parallel to the Imam. The two sides reached a village called Nainawa where Ibn Ziyad's messenger (Yazid's governor over Kufa) delivered a message to Hur. The message read, " ...force Husain to a halt. But let him stop in an open space, without vegetation or water." Hur conveyed the contents of the letter to Imam Husain. The Imam, his family and companions defiantly resumed their journey and reached a place where another enemy force blocked their move and forced them to stop. When Imam Husain learned that the place was called Karbala, he felt he reached the destination and ordered his camp to be setup. That day was 2nd of Muharram, Hijri 61.

সেনাধক্ষ্য  হুরের  জবাবের ভাষা ও সুর আদৌ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আক্রোশমূলক ছিল না এবং হোসেন স্বয়ং তাঁর জবাব ও আচরণে খারাপ কিছু যে দেখেন নি তা উপরের বিবরণে অত্যন্ত স্পষ্ট। যাকে হত্যা করার আদেশ থাকে  তাঁর সঙ্গে সেনাধ্যক্ষরা যেরূপ আচরণ  করেন সেরূপ আচরণ যে হুর করেননি তা বলা বাহুল্য। ড.গণি ও তাঁর মত অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক দাবী করেছেন যে এজিদের বাহিনী এত নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন ছিল যে হোসেন যখন এক ফোঁটা জলের জন্য তাদের কাছে ব্যাকুল হয়ে হাত পেতেছেন এবং পাগলের মত একজনের কাছ থেকে আর একজনের কাছে ছুটে গিয়েছেন তখন তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছেন এবং পরপর তীর ছুঁড়ে হোসেন এবং তাঁর লোকজনকে হত্যা করেছেন। কিন্তু এটা  এত বড় মিথ্যাচার য্র তুলনা মেলে ভার । এই দাবী খণ্ডিত হয়ে গেছে উইকিপিডিয়ার ইতিহাসে। উইকিপিডিয়া লিখছে এ প্রসঙ্গে, - Hussein ibn Ali told Yazid's army to offer him single battle, and they gave him his request. He killed everybody that fought him in single battles.[53] He frequently forced his enemy into retreat, killing a great number of opponents. Hussein and earlier his son Ali al-Akbar ibn Husayn were the two warriors who penetrated and dispersed the core of ibn Sa'ad's army (Qalb-e-Lashkar), a sign of extreme chaos in traditional warfare.

Hussein advanced very deep in the back ranks of the Syrian army. When the enemies stood between him and the tents he shouted:

"Woe betide you oh followers of Abu Sufyan ibn Harb's dynasty! If no religion has ever been accepted by you and you have not been fearing the resurrection day then be noble in your world, that's if you were Arabs as you claim."[54]

Then his enemies invaded back toward him. They continuously attacked each other,[55] Until his numerous injuries caused him to stay a moment. At this time he was hit on his forehead with a stone. He was cleaning blood from his face while he was hit on the heart with arrow and he said: "In the name of Allah, and by Allah, and on the religion of the messenger of Allah." Then he raised his head up and said: "Oh my God! You know that they are killing a man that there is son of daughter of a prophet on the earth except him." He then grasped and pulled the arrow out of his chest, which caused heavy bleeding.[56]
He became very weak and stopped fighting. The soldiers approaching him gave up confrontation, seeing his position. One soldier, however, walked up to Hussein and hit him on his head with his sword.
কেউ যদি নিজগুণে বড় ও মহৎ না হন, তাঁকে সেই রূপে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যকে ছোট ও নিকৃষ্ট  করতেই হয় – এটাই নিয়ম। আলি ও আলির পুত্রদের সেইরূপ বড় ও মহৎ প্রমাণ করতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়া ও এজিদ এবং তাঁদের অনুগামীদের অত্যন্ত ছোট, নীচ ও নিকৃষ্ট করে উপস্থাপিত করেছেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও  মাবিয়া ও এজিদের মধ্যে মানুষ হিসাবে যে দোষ-ত্রুটি বা ক্ষুদ্রতা-সহ যে  মহৎ গুণগুলি ছিল তা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া যায় নিবরং যাঁরা তাঁদের চরিত্রের ভাল ও মহৎ দিকগুলিকে অস্বীকার ও নস্যাত করতে গিয়ে তাঁদেরকে কুৎসিত ও কদর্য ভাষায় কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস করেছেন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষুদ্রতা ও নীচতাকেই অনাবৃত করে ফেলেছেন তাঁদের নিজেদের অজান্তে।




কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা - ৭ (এক)

সপ্তম অধ্যায় - প্রথম অংশ

হোসেনের আপত্তি সত্ত্বেও ৬ষ্ঠ খলিফা পদে ইয়াজিদের আরোহণ পর্ব ছিলো মসৃণ


   
মাবিয়ার মৃত্যুর পর এজিদ ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে ইসলামি সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ খলিফা নিযুক্ত হনবলা বাহুল্য যে, যেহেতু তিনি পূর্ব থেকেই ঐ পদে মনোনীত ছিলেন, তাই একদম নির্বিঘ্নে ও মসৃণভাবেই খলিফার সিংহাসনে তাঁর আরোহণ প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন হয় এমনকি মদিনার মুসলমানরাও এজিদকে খলিফা পদে স্বীকার করে নিতে বিলম্ব করেন নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল ইমাম হোসেন এবং তাঁর মুষ্টিমেয় আঙুলে গণা কয়েকজন সঙ্গী-সাথীতাঁরা এজিদকে খলিফা মানতে অস্বীকার করেনপ্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এজিদের হাতে সমগ্র মুসলিম জাহানে যখন বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে তখন হোসেন মদিনাতেই অবস্থান করছিলেনমাবিয়া যখন এজিদের মনোনয়নের প্রস্তাব নিয়ে মদিনা এসে মদিনাবাসীর সঙ্গে মত বিনিময় করছিলেন তখন মাবিয়া আহুত সভাস্থল থেকে উঠে হোসেন একেবারে মদিনা ত্যাগ করে মক্কা চলে গিয়েছিলেনএটা নিয়ে অবশ্য দুরকম মত রয়েছেএকটা মত হলো, মক্কা থেকে পুনরায় মদিনায় ফিরে এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যুর ঢের পূর্বেই,  আর একটা মত হলো মাবিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি মদিনা এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যু-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মদিনার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্যকিন্তু বলা বাহুল্য যে তিনি যে পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখলেন (মক্কার প্রায় সকলেই এজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন স্বতস্ফূর্তভাবে)  তা তাঁকে আরও একবার ভীষণ হতাশ করলোএদিকে দামেস্কে (ইসলামি সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী) এজিদের কাছে যথারীতি খবর পৌঁছে গেল যে হোসেন ও তাঁর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী বা অনুচর তাঁকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেনএজিদ মানসিকভাবে এ খবর শোনার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন, তিনি শুধু খবরটি কখন এসে পৌঁছায় তারজন্য অপেক্ষা করছিলেন। খবর পৌঁছানো মাত্রই মদিনার গভর্নর ওয়ালিদকে একটি জরুরী বার্তা পাঠান যে বার্তায় ওয়ালিদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, যাঁরা খলিফার বয়াত নিতে অস্বীকার করেছেন তাঁদেরকে যেন অবিলম্বে বয়াত নেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়মদিনার গভর্ণর স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের নিকট খলিফার বার্তা পৌঁছে দেন এবং তাঁকে খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার অনুরোধ করেন এবং অনুরূপভাবে তাঁর অনুচরদেরও (ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র, যুবায়েরের পুত্র এবং আর একজন বিশিষ্ট সাহাবী  আব্বাসের দুই পুত্রকেও) একই অনুরোধ করেনখলিফার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র এবং আব্বাসের দুই পুত্র ইমাম হোসেনকে উপেক্ষা করে ষষ্ঠ খলিফা এজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়ে নেনশুধু বাকি থাকলেন হোসেন এবং যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহহোসেন যখন নিজের চোখে দেখলেন তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ, এমনকি এক বছর আগেও যে কয়েকজন তাঁর সাথে ছিল তাঁরাও তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়ে এজিদকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন, তখন মদিনায় আর এক মূহুর্তও অবস্থান করা অসমিচীন ভেবে কাল বিলম্ব না করে তিনি মদিনা ত্যাগ করেনস্বাভাবিকভাবেই একমাত্র আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরকেই তিনি সঙ্গী হিসাবে পেলেনগভর্ণর সে খবরও যথারীতি খলিফা এজিদের দরবারে পৌঁছে দিলেনওদিকে খলিফার নিকট থেকে হোসেনের উপর বলপ্রয়োগ করে আনুগত্য আদায়ের জন্য কোনও নির্দেশ না আসায় তিনিও এবিষয়ে নীরব থাকায় শ্রেয় ও সমীচীন মনে করলেনসুতরাং হোসেন এবং আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের বিনা বাধায় মক্কায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন
মক্কায় গিয়ে হোসেন এজিদের খেলাফতের বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তা নিয়ে তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন মুহাম্মদের নাতি ও বংশধর ইমাম হোসেন, এবং মাবিয়া যেহেতু সম্পূর্ণ অন্যায় ও অনৈতিকভাবে এবং ইসলামি নীতিবিরুদ্ধ পথে নিজ পূত্রকে খলিফা মনোনীত করে গেছেন, তাই এজিদ কোনোভাবেই বৈধ খলিফা নয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা এরূপ সিদ্ধান্তও গৃহণ করেন যে শুধু এজিদের হাতে বয়াত নেওয়া থেকে বিরত থাকলেই হবে না, তাঁর (এজিদের) খেলাফতের বিরুদ্ধে সরব হয়ে জনমত গঠন করতে হবে যার লক্ষ্য হবে এজিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে হোসেনের হাতে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফত তুলে দেওয়া এমনটা শোনা যায় যে, এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত বা প্ররোচিত করেছিলেন  নাকি যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহ এই কথাটার কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছেতবে বিশাল একটি সাম্রাজ্যের একজন খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ভাবনা কীভাবে হোসেন ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাথায় ঠাঁই পেয়েছিল সেটাই সবচেয়ে বেশী বিস্ময়করতাঁরা বোধহয় এরূপ আশা করে ছিলেন যে  মুহাম্মদের বংশধর বলে হোসেনের পক্ষেই মুসলমানরা রাস্তায় নেমে সমর্থন জ্ঞাপন করবেন কিন্তু এতট আশা করার কোনো উপাদানই যে তখন অবশিষ্ট ছিল না তা তাঁরা কেউ বুঝতে সক্ষম হন নিে যাই হোক, তাঁরা স্থির করলেন যে, এজিদকে বৈধ খলিফা বলে তাঁরা যে স্বীকার করছেন না সে কথা লিখিতভাবে তাঁকে জানিয়ে দিতে হবেসেই সিদ্ধান্ত মতো হোসেনের নেতৃত্বে কিছু মানুষ একজন দূত মারফত এজিদকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, মাবিয়া আপনাকে খলিফা পদে মনোনীত করে চরম অন্যায় ও পাপ কাজ করেছেন, তাই আপনি একজন অবৈধ খলিফা বৈ নয়  ইসলামি সাম্রাজ্যের একমাত্র ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন ইমাম হোসেনআমরা তাই আপনাকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করছি না
এজিদকে সেই চিঠি পাঠিয়ে হোসেন তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের কাজে নেমে পড়লেন। প্রথমে তিনি কুফা প্রদেশে নিজে গিয়ে জনমত গড়ার পরিকল্পনা করলেনএই প্রদেশে তাঁর পিতা আলির অনুরাগীর  সংখ্যা ছিলো তুলনায় বেশীকুফাবাসীর প্রতি বেশী ভরসা রেখেছিলেন তাঁর পিতা স্বয়ং আলিওতিনি (আলি) যখন খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন ওসমানের হত্যাকারীদের হাত ধরে তখন মদিনাবাসী তাঁর প্রতি ভীষণ বিরূপ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেনতাই তিনি খলিফা হওয়ার কিছুদিন পরেই ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অথচ আলির বংশধর ও অনুগামীরা প্রবলভাবে দাবী করে এসেছেন যে, আলি যেহেতু আল্লাহর শেষ নবী তথা মুহাম্মদের বংশধর তাই ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার একমাত্র আলিই, আর অন্য কেউই হতে পারেন নাআলিও বারবার সেই একই দাবী করেছেন আলির পত্নী ফতেমাও সেই একই দাবী করেছিলেন এবং আবু বকরকে (মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা) খলিফা পদে কিছুতেই মেনে নেন নিঅথচ সেই আলিই মুহাম্মদ যে মাটিতে চির নিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন সেই মদিনা থেকে রাজধানী কুফা শহরে সরিয়ে নিয়ে যেতে দ্বিধা করেন নিআলির এমনই ছিল আল্লাহর শেষ নবী তথা আপন শ্বশুর তথা আপন চাচাতো দাদার প্রতি শ্রদ্ধা,আবেগ ও ভালবাসা!  ওসমান কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও মদিনা ছেড়ে যান নি বা মদিনা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন নি তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় নবী যে মাটিতে শায়িত রয়েছেন চির ঘুমে সেই মাটির তুলনায় আমার আমার জীবন ও খলিফার সিংহাসন অতিশয়  তুচ্ছ, আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই মদিনা পরিত্যাগ করে যেতে পারব নাশেষ নবীর প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা কত গভীর ও কত আন্তরিক ছিল ওসমানের হৃদয়ে তার প্রমাণ নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেনওসমান কিন্তু নবীর উত্তরাধিকার বা বংশধর ছিলেন না, এমনকি তাঁর গোত্রের লোকও ছিলেন নাঅপরদিকে আলি ছিলেন নবীর অতি আদরের চাচাতো ভাইনবী আলিকে এত ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন যে তাঁর নিজের প্রাণাধিক কন্যা ফতেমার সঙ্গে তাঁর(আলি) বিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও ইতিমধ্যেই আবু বকর ও ওমর দুজনেই নবীর কাছে ফতেমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রদান করেছিলেনমুহাম্মদ আলিকে ‘আল্লাহর তরবারি’ (সাইফুল্লাহ) এবং ‘জ্ঞানের দরজা’ এই দুটি অসামান্য উপাধিতে ভুষিত করেছিলেনসেই আলিই নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে মুহাম্মদের প্রাণাধিক প্রিয় শহর মদিনাকে ত্যাগ  করে চলে গিয়েছিলেন কুফা শহরেহোসেন সেই কুফা শহরকেই সব আগে তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বেছে নিলেনকুফা যাওয়ার আগে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে আগে সেখানে প্রেরণ করলেন
সর্ব প্রথম হোসেন কুফা শহরেই কেন যেতে মনস্থির করেছিলেন তা নিয়ে ভিন্ন মতও শোনা যায়সে মতটি এ রকমঃ এজিদের খলিফা হওয়াটা কুফাবাসী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নিতাঁরা হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে আগ্রহী ছিলেনতাঁরা মনে করতেন যে এজিদ একজন স্বেচ্ছাচারী, লম্পট ও মদ্যপ যুবক, এবং খলিফা পদের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ততাঁরা এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত, এবং তাঁরা চান যে সেই বিদ্রোহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর আলির সুযোগ্য পুত্র হোসেন যেন নেতৃত্ব করেন সে জন্যে তাঁরা হোসেনকে কুফা শহরে আসতে আহবান করছেন । কুফাবাসীগণ তাঁদের এই অভিমত, আহবান ও সঙ্কল্পের কথা লিখে অসংখ্য পত্র হোসেনের কাছে  প্রেরণ করেন । কুফাবাসীদের এ সব পত্র পেয়ে হোসেন এজিদের বিরুদ্ধে এবং তাঁর নিজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন এবং সে জন্যেই সর্ব প্রথম তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্যে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনহোসেন খুব শীঘ্রয় কুফা যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁর আর তর সইছিলো না কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে সরাসরি কুফা যেতে নিষেধ করেন তাঁরা বলেন কুফাবাসীদের কিছু মানুষের কথায় বিশ্বাস করে হোসেনের সেখানে যাওয়া সমীচীন হবে না, কারণ তাঁরা সিফফিনের যুদ্ধে আলির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তাই হোসেনের নিজে যাওয়ার আগে কাউকে সেখানে প্রেরণ করে সরেজমিন তদন্ত করে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক বলে তাঁরা হোসেনকে পরামর্শ দেন তাঁরা বলেন যে পরিস্থিতি অনুকূল এমন নিশ্চিত খবর পেলে তবেই হোসেনের যাওয়া উচিত হবেশেষ পর্যন্ত হোসেন সকলের পরামর্শ মেনে নেন এবং হোসেনন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে গোপনে কুফায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন  
মুসলিম অতি গোপনীয়তার সাথে কুফা যাত্রা করলেন এবং সেখানে গিয়ে জনৈক হানি নামের আলির অতি বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছ থেকে কুফার মানুষদের মনোভাব সম্পর্কে খোঁজ-খবর সংগ্রহ করেনহানি যে আলির অতি ভক্ত তা কুফায় সর্বজন বিদিত ছিল এবং সেই কারণে যাঁরা আলি ও আলির পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন কিন্তু প্রকাশ্যে মাবিয়ার বিরোধিতা বা সমালোচনা করা সমীচীন মনে করতেন না তাঁরা এজিদের খলিফা হওয়ায় খুশী ছিলেন নাসেই মানুষগুলো গোপনে সুযোগ পেলেই তাঁদের মনের কথা হানির কাছে ব্যক্ত করতেনএই মানুষগুলোর সংখ্যা ঠিক কত বা এঁরা কুফার জনসংখ্যার কত অংশ তার সঠিক হিসাব হানির কাছে ছিল নাকিন্তু কিছু লোকের কাছ থেকে তাঁদের উক্ত মনোভাবের কথা শুনেই তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল যে ওটাই কুফাবাসীর মনের কথা । মুসলিমকে অতি সোৎসাহে সে কথাটাই হানি জানালেন, তিনি জানালেন যে কুফার মানুষ কেউ এজিদকে চায় না, তাঁরা সবাই হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে চানএই কথায় বিশ্বাস করে মুসলিম কাল বিলম্ব না করে হোসেনকে পত্র মারফত জানিয়ে দিলেন যে কুফার মানুষ  তাঁকেই খলিফা হিসাবে পেতে চায়, তাঁরা এজিদের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট, সুতরাং তিনি যেন পত্র প্রাপ্তির সাথে সাথে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেনহোসেন ভীষণ ঊদগ্রীব ছিলেন মুসলিমের ঠিক এই চিঠির জন্যেই, তাই চিঠি পাওয়া মাত্র কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । বলা বাহুল্য যে সঙ্গে নিলেন পরিবারের লোকজন সহ অনুগত কিছু লোক-লস্কর
এদিকে এজিদের নিকট এই খবর পৌঁছে গেল যে হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়ে কুফা যাওয়ার সিধান্ত করেছেনমুসলিমকে কুফায় পাঠানো হয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝবার জন্যে – এ খবরও যথারীতি এজিদের নিকট পৌঁছে গিয়েছিলএ সব খবর পেয়ে তিনি অতি তৎপরতার সাথে হোসেনের বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করলেনআর এ কাজে তিনি কুফার তৎকালীন গভর্ণরের প্রতি আস্থা রাখা ও নির্ভর করা সমীচীন হবেনা মনে করে তাঁকে সরিয়ে ওবাইদুল্লাহ ইবন জিয়াদকে গভর্ণর করে পাঠালেনজিয়াদ পুত্র ওবাইদুল্লাহকে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে হোসেনকে যেন কুফা প্রবেশ করার পূর্বেই আটকে দেওয়া হয়  জিয়াদ ছিলেন মাবিয়ার খুবই বিশ্বস্ত এবং অত্যন্ত যোগ্য, দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ প্রশাসক ও যোদ্ধাওবাইদুল্লাহও ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী এবং এজিদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগতওবাইদুল্লাহ দ্রুত কুফায় পৌঁছে গিয়ে সেখানকার গভর্ণরের দায়িত্বভার বুঝে নিলেন। তারপর কুফায় কি ঘটলো তা বর্ণণা করার পূর্বে জিয়াদ সম্পর্কে এখানে কয়েকটি কথা বলা নেওয়া জরুরী। কারণ, কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় এর যেমন প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে তেমনই জিয়াদ সম্পর্কে খুব বিশ্রী ভাষায় অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এমন কিছু আলোচনা করেছেন যা খুবই অনৈতিক ও কুৎসায় পরিপূর্ণ যার জবাব দেওয়াও একান্তই  আবশ্যকজিয়াদ ইতিহাসে জিয়াদ-ইবন-আবিহ নামে খ্যাতপঞ্চম খলিফা মাবিয়া জিয়াদকে এই নামে ডাকতেন, তারপর থেকে ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত হতে থাকলেনমাবিয়ার জিয়াদকে ঐ নামে ডাকার একটি মহৎ প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটা এ রকমঃ  জিয়াদ জন্ম পরিচয়ের দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত অসম্মান, অগৌরব এবং উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অনুগ্রহের পাত্রএটা যেমন তৎকালীন সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল তেমনি এই সময়ের  আধুনিক ও তথাকথিত সভ্য সমাজের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য কারণ, জিয়াদের মা ছিলেন জন্মসূত্রে তায়েফের অধিবাসী এবং  আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নীআবু সুফিয়ান ছিলেন মক্কার একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ধনী বণিকওতখন ধনী ব্যক্তিরা বহু উপপত্নী রাখতেন, সে যুগের সেটাই ছিল রীতিআল্লাহর স্বঘোষিত শেষ নবী তথা মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিলতাঁর উপপত্নীদের মধ্যে মারিয়ার নাম খুবই পরিচিত।  একদিন মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর পত্নী হাফসার প্রবল   ঝগড়া হয়েছিল ঐ মারিয়াকে নিয়েইসে কথা থাকনবী মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিল - এটা উল্লেখ করা আবশ্যক হলো এ কথা বলার জন্য যে উপপত্নী রাখাটা সে সময় দোষের কিছু ছিল নাআর যে মেয়েরা উপপত্নী রূপে কোনো পুরুষের হারেমে থাকতেন তাঁরা খারাপ মেয়ে বা দুশ্চরিত্রা মেয়ে - তা মোটেই নয়হয় তাঁরা ক্রীতদাসী, না হয় হত-দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তাননিজের ইচ্ছায় কোনো নারীই ঐ জীবন বেছে নিতেন নাসে যুগে উপপত্নীদের গর্ভে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তান সে সমাজেই বড় হতো, কিন্তু যার ঔরসে তার জন্ম সে তার পিতৃ পরিচয়ের দায় নিত না এবং তাকে তার উত্তরাধিকার বলে গণ্য করত নাএই নীতি বা প্রথা যতই অন্যায়, অনৈতিক ও অমানবিক হোক না কেন,  তবু আল্লাহর স্বঘোষীত নবী তথা মুহাম্মদ সেই নীতিকেই বহাল রেখে যান । শুধু তাই নয়, তিনি এও বলে যান যে, একজন পুরুষ যতখুশী উপপত্নী রাখতে পারবে - এটা আল্লার বিধান যাঁরা উপপত্নী হিসাবে কোনো পুরুষের যৌনসঙ্গী হয়ে থাকতে বাধ্য হতেন তাঁদের এই অভিশপ্ত জীবনের উপর তাঁদের যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, তেমনই তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদেরও তাঁদের নিজেদের অনাকাঙ্খিত জীবনের উপর কোনো হাত ছিল নাতবুও তাঁদের ঐ অবাঞ্ছিত জীবনের জন্য তাঁদেরকেই মাশুল গুণতে হতোসমাজে তাঁরা আর পাঁচটা মানুষের মত স্বীকৃতি পেতেন না, উপপত্নীগণ পেতেন না পতির পরিচিয় ও স্বীকৃতি এবং তাঁদের সন্তানগণ পেতেন না পিতৃ-পরিচয়এ যুগেও কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বিবাহের পূর্বে সন্তানের জন্ম দেয় তবে তথাকথিত এই সভ্য সমাজের মানুষ সেই নারী ও তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে অসভ্য, নোংরা ও কুৎসিত ভাষায় গালাগাল দেয় এবং সমাজ থেকে নির্বাসিত করে। আলোচনা হচ্ছে জিয়াদ প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন যেহেতু আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তান, তাই তিনি ছিলেন পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্চিত এবং সমাজের কাছে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও করুণার পাত্রসে যুগের ক্ষেত্রে সেটাই ছিল সামাজিক রীতি, কিন্তু এ যুগের ঐতিহাসিকগণ যদি তাঁদের কে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন তবে তা নিশ্চিতভাবেই হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হ্যাঁ, বহু মুসলিম ঐতিহাসিক সেই অপরাধে অপরাধীতাঁরা জিয়াদের নির্দোষ মা’কে অসতী ও দুশ্চরিত্রা রমণী এবং নির্দোষ জিয়াদকে জারজ সন্তান ও তাঁর পুত্র ওবাইদুল্লাহকে জারজের পুত্র বলে অকারণে আক্রমণ করেছেন। মানুষ পূঁথিগত বিদ্যায় যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না কে, তিনি যদি প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে সফল না হন, তবে তাঁর মন যে কুসংস্কার, কুপ্রথা ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক অফুরন্ত গরল ভান্ডারের বিরাট আধার হয়ে বিরাজ করবেই তার প্রমাণ হলেন এই ঐতিহাসিকগণ  জিয়াদ জন্মসূত্রে অখ্যাত ও অবজ্ঞার পাত্র হলে কি হবে, তিনি তাঁর তীব্র মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কঠোর পরিশ্রম, অতুলনীয় সততা ও দায়িত্ববোধের দ্বারা সকলের কাছ থেকে সমীহ ও সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেনতাঁর এই গুণের জন্য  মাবিয়া তাঁর অত্যন্ত কদর করতেন এবং তাঁকে প্রশাসনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেনতাঁর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতায় এবং বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে মাবিয়া তাঁকে প্রথমে বসরার শাসনকর্তা এবং পরে তাঁর একার হাতেই বসরার শাসনভার সহ কুফার শাসনকর্তারও দায়িত্বও অর্পণ করেছিলেনধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাবিয়ার দক্ষিণ হাতমাবিয়া তাঁকে শুধু প্রশাসনের উচ্চপদে নিযুক্ত করে সম্মানিত ও পুরস্কৃতই করেন নি, তাঁকে এইসব বিরাট সম্মান অপেক্ষাও অনেক বড় সম্মান প্রদান করেছিলেন যে সম্মানের কোনো তুলনাই হয় নামাবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ান জিয়াদকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করেন নি, মাবিয়া কিন্তু জিয়াদকে তাঁর পিতার সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করে এক অমর কীর্তি স্থাপন করে গেছেন । তিনি জিয়াদকে ‘আমার ভাই’ বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন একজন খলিফা হয়েওতিনি জিয়াদকে ডাকতেন ‘জিয়াদ আমার ভাই’ এই নামে ‘জিয়াদ আমার ভাই’ – এই কথাটাই আরবিতে হলো ‘জিয়াদ-ইবন-আবিহ’  মুসলিম ঐতিহাসিকদের চোখে মাবিয়া একজন মুসলমানের শত্রু এবং অতি জঘন্য ব্যক্তি কারণ,  মাবিয়া আলির কাছে বয়াত নেন নি এবং ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে অনড় থেকে আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন আর জিয়াদ যেহেতু তাঁর উপর ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করে মাবিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন তাই তাঁদের চোখে তিনিও মুসলমানদের শত্রুতাই তাঁর জন্ম পরিচয় তুলে জিয়াদ এবং তাঁর পুত্রকে এই ঐতিহাসিকগণ কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে নিজেদের অন্তরের জ্বালা প্রাণভরে মিটিয়ে নিয়েছেন। থাক এখন সে কথা, ওবাইদুল্লাহ কুফায় যাওয়ার পরে সেখানকার পরিস্থিতি কি হল তা এবার দেখা যাক ।
ওবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়েই মুসলিমের খবর জানতে পারলেনএটা জানতে পারা খুব স্বাভাবিকই ছিলকারণ মুসলিম সেখানে গিয়ে এজিদের বিরুদ্ধে এবং হোসেনের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ গোপনে চালালেও তা গোপন থাকেনি, এজিদের পক্ষের মানুষজন তা জেনে যায় এবং তাঁরা ওবাইদুল্লাহকে জানিয়ে দেনতিনি তখন কাল বিলম্ব না করে মুসলিম ও হানিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের কাছ থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে জানতে চানমুসলিম স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি যা শুনেছেন তা সবই সত্যিতিনি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন যে, মাবিয়া এজিদকে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা মনোনীত করে ইসলামি নীতির লঙ্ঘন ও অবমাননা করেছেনতা ছাড়া এজিদ খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিও নয় । তাই তাঁকে আমরা খলিফা বলে মানি নাইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের উত্তরাধিকার হলেন একমাত্র হোসেন, কারণ তিনি ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র ও বংশধর এবং খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিওএ কথা শোনার পর কুফার গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর আশ্রয়দাতা ও মদতদাতা হানিকে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাণদন্ড দেনহোসেন সদলবলে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন সে খবর এজিদ ও ওবাইদুল্লাহর কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, সে খবর যে সত্যি তা মুসলিমের মুখ থেকে শোনার পর সংশয় যে টুকু ছিল তাও দূরীভূত হলোমুসলিম ও হাসির মৃত্যুদন্ড কার্যকরার পর ওবাইদুল্লাহ ওমর ইবন সাদের নেতৃত্বে বড় একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলেন কুফা শহরের বাইরেই হোসেনের গতিরোধ করার জন্যেপরে ওবাইদুল্লাহ স্বয়ং সেই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন ।
এদিকে মহানন্দে কুফার পথে হোসেন যখন এগিয়ে চলেছেন  তখন পথিমধ্যেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মত সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছে গেল যে কুফার গভর্ণর মুসলিমকে হত্যা করেছেখুব স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের শিবিরে নেমে এল গভীর শোকের ছায়া এবং তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেনএই পরিস্থিতিতে কুফা যাত্রা বাতিল করার দাবী উঠলো শিবিরেসবাই তাকিয়ে আছে হোসেনের দিকে তিনি কি বলেন তা শোনার জন্যে  হোসেন কিছুক্ষণ ভেবে জানিয়ে দিলেন যে তিনি কুফা যাত্রা বাতিল করবেন নাহোসেনের এই ঘোষণা সবাই মুষড়ে পড়লেনকারণ এই পরিস্থিতিতে কুফা যাওয়ার অর্থ কী তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেনএমন কি যাঁরা হোসেনের নিজের বংশধর এবং নিকট আত্মীয়স্বজন যাঁরা তাঁরাও অকারণে এবং অযথা আত্মাহুতি দিতে কুফা যাওয়ার কোন অর্থই খঁজে পাচ্ছেন নাকিন্তু হোসেনের মুখের ওপর তাঁদের পক্ষে  সে কথা তাঁরা বলতে পারলেন নাআবার হোসেনের সহযাত্রীরা সবাই যে জেনেশুনে হোসেনের জন্য মরণকূপে ঝঁপ দিতে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন তা নয়, অনেকেই আশা করেছিলেন কুফা শহরের মানুষ হোসেনের সাথে নিশ্চয় থাকবেনতাঁরা মুসলিমের নিহত হওয়ার খবরে অসম্ভব বিচলিত হয়ে হোসেনকে বারংবার কুফা যাত্রা বাতিল করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেনকিন্তু হোসেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ও অনড়ই থাকলেনএই অবস্থায় যাঁরা কুফা যাত্রা বাতিল করার বিষয়ে হোসেনকে পীড়াপীড়ি করছিলেন তাঁরা মক্কা ফিরে গেলেনহোসেন তখন বাকি সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পুনরায় কুফা অভিমুখে রওনা দিলেনসেই সময় তাঁর সাথে খুব সামান্যই সৈন্য-সাথী ছিলঠিক কতজন সৈন্য ছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়সেই সংখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে  তবে সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য তা সংশয়াতীতবিভিন্ন যে মত রয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে সেই সংখ্যাটা ৭০ (সত্তর) থেকে ১১০ (একশত দশ) এর মধ্যেসত্তরের মধ্যে ৩০ (ত্রিশ) জন মাত্র অশ্বারোহী এবং ৪০ (চল্লিশ) জন পদাতিক সৈন্য ছিলেনঅপরদিকে ওবাইদুল্লাহ ওমরের নেতৃত্বে যে সৈন্যদল পাঠিয়ে ছিলেন তাতে অশ্বারোহী সেনাই ছিল ৪০০  (চারশত) জনহোসেনের বাহিনীকে প্রথমে আটকে দেয় কুফা শহর থেকে প্রায় ৪০ (চল্লিশ) কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় সেখানকার অধিবাসী তামিম গোত্রের লোকেরাজায়গাটির নাম হলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই ‘কারবালা’কারবালা প্রান্তরেই তাই বাধ্য হয়ে হোসেন তাঁবু খাটিয়ে শিবির স্থাপন করেনইউফ্রেটস বা ফোরাত নদী থেকে অতি সামান্য দূরে এই কারবালা প্রান্তর অবস্থিততার কিছু পরে সেখানে ওমরের সৈন্যবাহিনী এসে পৌঁছায়তাঁরা যে খলিফা এজিদের বাহিনী তা প্রথমে হোসেন বুঝতে পারেন নিতিনি ভেবে ছিলেন তাঁরা কুফা থেকে এসেছেন তাঁর সমর্থনেওমর সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছালে হোসেন মনে মনে অনেকটাই উৎসাহ বোধ করলেন এবং উৎসাহভরে ওমরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কারা? তোমরা কি আমার সাথে যোগদান করতে এগিয়ে এসেছো? ওমর তাঁর পরিচয়  দিলেন এবং তাঁর সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেনতখন মূহুর্তেত মধ্যে হোসেনের মুখমন্ডলে যে আশা ও ভরসার হর্ষভাব ছিল তা মিলিয়ে গেল এবং এক অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার দুশ্চিন্তায় তাঁর মুখমন্ডল কালো হয়ে গেলসেই হতাশা ও আশঙ্কার মেঘ মূহুর্তের মধ্যে হোসেনের শিবিরকে ছেয়ে ফেললো ।
ফোরাত নদীর তীরে হোসেনের শিবির থেকে কিছুটা দূরে ওমরও তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে শিবির স্থাপন করেনওবাইদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে পরে যোগদান করেন আর একদল বড় সৈন্যবাহিনী নিয়েহোসেনের সঙ্গে শুরু হয় তাঁদের আলাপ-আলোচনাঠিক কী কী আলোচোনা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে, কে কি প্রস্তাব বা শর্ত রেখেছিল, হোসেন ঠিক কবে সেখানে পৌঁছান, ওবাইদুল্লাহর বাহিনীতে কত সৈন্য ছিল, এবং আলোচনা ভেঙে গেলে কবে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, কতদিন যুদ্ধ চলেছিল, উভয় পক্ষের কতজন হতাহত হয়েছিল ইত্যাদি বিষয়ের  সম্পূর্ণ নির্ভুল তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না, সে সময় ইতিহাস লেখার প্রচলন ছিল নাইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়  তার অনেক পর থেকেকয়েক শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে মুখে কারবালা যুদ্ধের কথা ঘুরতে ঘুরতে যখন ইতিহাস লেখার কাজ শুরু ততদিনে কারবালার ইতিহাস যে বহুলাংশে বিকৃত হয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্যআর এর ইতিহাস বা এটা নিয়ে অজস্র যে গল্প-উপন্যাস-কবিতা রচিত হয়েছে তার রচয়িতাদের সিংহভাগই মুসলমান যাঁরা লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে এজিদ অনৈতিক পথে খলিফা হয়ে ইসলামের পতাকাকে ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছিল, হোসেন ইসলামের সেই পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেনস্বভাবতই সে সব লেখায় লেখকদের নিজেদের মনের কল্পনার রঙ লেগেছে যথেষ্টইতাই এ সব লেখার মধ্যেও দেখা যায় তথ্যগত, পরিসংখ্যানগত এবং আরও নানা বিষয়ে নানা মতসে কথা মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরাও মানেনএ প্রসঙ্গে মাদ্রাজের (চেন্নাই) গভর্ণমেন্ট কলেজের অধ্যাপক হাজী মাওলানা মির্জা গোলা আব্বাস লিখেছেন, Several authors have attempted to give vivid pictures of stories, whose chronology is not yet traceable and whose antiquity has led many to doubt the reality and genuineness of the stories themselves and to suspect them as of the production of intelligent heads for the inculcation of high moral and ethical principles of the common folk  in the most appealing and dramatic fashion. (source: Wikipedia) স্বভাবতই কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে লিখতে হলে মূলত নির্ভর করতে হয় মুসলিম লেখকদের লেখা ইতিহাস বা গল্প-উপন্যাসের উপরেইতাঁদের অনেকের মতে হোসেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন, কিন্তু ওবাইদুল্লাহ সে প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখান করেছিলেন
হোসেনের প্রস্তাব তিনটি হলো – ১) তাঁকে মক্কা কিংবা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়া হোক, অথবা ২) এজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেওয়া হোক, অথবা ৩) তুর্কি সিমান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করবার অনুমতি দেওয়া হোক। কুফার গভর্ণর ঐ তিনটি প্রস্তাবই খারিজ করে দিয়ে তাঁকে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেনহোসেন আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের দাবী মত হোসেনের দেওয়া উক্ত তিনটি প্রস্তাব কতটা যথার্থ তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছেতিন নম্বর প্রস্তাবটি যে অবাস্তব ও মনগড়া তা সহজেই অনুমেয়কারণ মাবিয়ার দীর্ঘ কুড়ি বছরের শাসনে হোসেন মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এর প্রমাণ পাওয়া যায় নাএমন কি খলিফা মাবিয়াকে অন্য কোনভাবেও যে তিনি সহযোগিতা করেছেন এমন কথাও শোনা যায় নাসুতরাং তুর্কি প্রান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি চাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তরর হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করার নিমিত্ত এজিদের কাছে যেতে দেওয়ার প্রস্তাবটিও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা কে হবেন সে প্রশ্নে আলোচনা করার কোন সুযোগ বা অবকাশই তখন আর ছিল নাএজিদের সঙ্গে হোসেনের মধ্যে আলোচনা করার প্রশ্ন তখনই উঠতো যদি হোসেন এজিদকে খলিফা পদে মেনে নিতে সম্মত হতেনএজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে অন্য বিষয়ে কিছু দাবী বা শর্ত থাকলে তা নিয়েই শুধু আলোচনা করার প্রশ্ন উঠতে পারতকিন্তু হোসেন যেহেতু এজিদকে কোন মতেই খলিফা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না  তাই দ্বিতীয় প্রস্তাব মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিজেদের মস্তিষ্ক প্রসূত বৈ নয়। সুতরাং একমাত্র সত্যি হলে হতে পারে প্রথম প্রস্তাবটিকিন্তু ঐ প্রস্তাবটি যে কোনো খলিফার পক্ষে মানা সম্ভব নয় তা বলা বাহুল্য ।
স্বভাবতই কারবালা প্রান্তরে পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল হতে থাকলওবাইদুল্লাহ হোসেনের উপর চাপ দিতে থাকলেন এজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে তাঁর হাতে বয়াত নেওয়ার জন্যে, অপরদিকে হোসেন সে প্রস্তাবকে তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখান করে তাঁকে মক্কা বা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়ার দাবী জানাতে থাকলেনএই অবস্থায় ওবাইদুল্লাহ হোসেনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল অবলম্বন করলেনওমরকে নির্দেশ দিলেন হোসেনের লোকজনের জন্য ফোরাত নদীর জল বন্ধ করে দিতে এবং তার জন্যে নদীর ধারে সেনা মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেনওমর তখন  কয়েক হাজার সেনা নদীর তীর বরাবর দাঁড় করিয়ে দিলেনবাইদুল্লাহ হয়তো আশা করেছিলেন যে, জলকষ্টে যখন সকলের প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হবে তখন হোসেন নিজের প্রণের জন্যে না হলেও অন্যদের জন্যে, বিশেষ করে তাঁর সঙ্গের শিশুদের প্রাণ রক্ষার জন্যেও এজিদকে খলিফা মেনে নিতে সম্মত হবেনকিন্তু ওবাইদুল্লাহর আশা বা ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিলহোসেন জলের জন্য বারবার নদীর ধারে নিজে ছুটে গেছেন, সেনাদের কাছে বহু অনুরোধ করেছেন, অনুরোধ করেছেন ওমরের কাছে, ওবাইদুল্লাহর কাছেও বারবার গিয়ে কাতর আবেদন করেছেন, তবুও একফোঁটা জলের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। এ অবস্থাতেও তিনি আপোষ করেন নি, এজিদকে খলিফা মেনে নিতে সম্মত হন নিহোসেন তখন  এ রকম ভাবলেন যে, যদি মরতেই হয় তাহলে  জলতেষ্টার অসহ্য কষ্ট ভোগ করে তিলে তিলে মরা অপেক্ষা জলের জন্যে জেহাদ করে মরা অনেক শ্রেয়তিনি এজিদের বাহিনীর সঙ্গে জেহাদ (যুদ্ধ) করাই স্থির করলেন। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ
(বিঃদ্রঃ এর আগের অংশটির লিঙ্ক - http://giasuddinonline.blogspot.in/2016/11/blog-post_97.html )
  

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...