Monday, March 13, 2017

পুরো 'ইদ্দত' আইন জুড়েই চোখে পড়ে উৎকট নারীবিদ্বেষ ও নগ্ন পুরুষবাদের তাণ্ডব



পুরুষবাদী সমাজে বিয়ের তাৎপর্য নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে এক নয়। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর বিয়ে হয় বটে, কিন্তু বাস্তবে যা হয় তা হলো একজন পুরুষ একজন নারীকে বিয়ে করে এবং একজন নারীর বিয়ে হয় একজন পুরুষের সঙ্গে। একজনের বিয়ে করা ও একজনের বিয়ে হওয়ার মধ্যে যে পার্থক্য থাকে তা আকাশ-পাতাল পার্থক্যের মতো। একজন পুরুষের বিয়ে করা মানে একজন নারীকে নিজের অধীনে নিয়ে এসে তার উপর সর্বময় কতৃত্ব ও প্রভুত্ব স্থাপন করার বৈধ ছাড়পত্র হাসিল করা।  আর একজন নারীর বিয়ে হওয়ার অর্থ হলো একজন চেনা বা অচেনা পুরুষের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার দাসখতে স্বাক্ষর করা।  বিয়ে মানে একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক স্থাপন করা। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছেইসলাম ও বিয়ে’ অধ্যায়ে। পুরুষবাদী সমাজে বিয়ের এই বৈশিষ্টের পরিপূর্ণ প্রতিফলন  ঘটেছে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে যদিও মুসলমানরা দাবি করে যে মধ্যযুগে ইসলামের আগমন হয়েছিলো দাসত্বের হাত থেকে নারীজাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে। তাদের এ দাবি যে কতো অসার ও হাস্যকর তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি এর আগের আলোচনাগুলিতে। ইসলাম তালাকের ক্ষেত্রে যে বিধানগুলি প্রণয়ন করেছে সেই বিধানগুলিতেও রয়েছে পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক  বিবাহ-বন্ধন থাকবে কী না, থাকলে বিবাহ-বন্ধনের স্থায়ীত্বকাল কতদিন থাকবে, তা সবই ঠিক করার মালিক বর বা পুরুষ। এক্ষেত্রে বৌএর বা নারীর কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা  জানাবার বিন্দুমাত্র সুযোগ বা অধিকার নেই। পুরুষ যখন খুশী তার বৌকে তালাক দিয়ে বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করে তাকে তাড়িয়ে দিতে পারে। তালাক দেওয়া মানেই তো একজন নারীকে দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি দেওয়া। না, মুসলিম নারীরা তবুও তালাক চায় না, চায় না একজন পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি, চায় না পেতে দাসত্ব থেকে মুক্তির আস্বাদ। চায় না, কারণ তারা যে পরনির্ভরশীল। তাই যখন নারীর উপর তালাকের খড়্গ নেমে আসে তখন তারা দু’চোখে আঁধার দেখে, আকাশ যেনো তাদের মাথার উপর ভেঙে পড়ে।
ভবিষ্যত জীবনে নিশ্ছিদ্র আঁধার নেমে আসলেও মুসলিম নারীর কিছু করার থকে না, তালাকের অভিঘাত তা যতোই ভয়ঙকর হোক তাদের মেনে নিতেই হয়। পুরুষ তালাক দিয়েই খালাস, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আর পালন করতে হবে না। তালাক দিয়ে পুরুষ তো খালাস, কিন্তু তালাকপ্রাপ্ত নারী কি খালাস? না, মুসলিম নারী খালাস পায় না। তালাকের পরেও  তাদের উপর পুরুষের দাসত্বের বন্ধন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বহাল থাকেতালাকপ্রাপ্ত নারী যার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে গেছে সে একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না।  এই সময়কালটা তাকে অতিবাহিত করতে হবে তার আগের বর বা পুরুষের জন্যে। এই সময়কালটাকে শরিয়তের পরিভাষায় বলা হয় ‘ইদ্দত’। অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীকে ‘ইদ্দত’ পালন করতে হয় সেই লোকটার জন্যে যে তাকে নির্দয়ভাবে তালাক দিয়ে তার গৃহ থেকে বিতাড়িত করেছে। ইদ্দতের এই বিধি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, তালাকপ্রাপ্তির পরেও মুসলিম নারীর দাসত্ব-বন্ধনে বাঁধা থাকে।   এই সময়টা প্রাক্তন বরের দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়।   
‘ইদ্দত’ আরবি শব্দ। ইদ্দত মানে সংখ্যা ও গণনা। ইদ্দত মানে গণনা করাও। ‘ইদ্দাতুল মার-আতে’ মানে নারীর ইদ্দত, হায়েয বা তোহরের সময় কাল, তালাক বা বরের মৃত্যুর পর ইদ্দত গণনার সময়।   তাই ইদ্দতকে অপেক্ষাধীন কাল বলে অভিহিত করা হয়। স্বামীর মৃত্যুতে কিংবা তালাকের পর যে সময়ের জন্য স্ত্রীকে  পুনরায় বিয়ে করা থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে ইদ্দত বলে।  ‘শরিয়তি আইন ১৯৭৩’ (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১৯৭৩) - এর আইন প্রণেতা বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ‘ইদ্দত’ – এর যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন তা হলোঃ  
ধারা – ৩৭৩
ইদ্দত - এর সংজ্ঞা
·       তালাক অথবা মৃত্যুজনিত কারণে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর যে সময়-সীমার মধ্যে কোন নারী  পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারে না তাহাকে ‘ইদ্দত’ বলে।  
ইসলাম মুসলিম নারীর ‘ইদ্দত’ পালন বাধ্যতামূলক করেছেঅবশ্য বিয়ের পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিলে ইদ্দত পালন করতে হয় না।  কোন কোন অবস্থায় নারী ইদ্দত পালন করবে আর কোন অবস্থায় করবে না তা শরিয়তি আইনের ৩৭৪ ধারায়  নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।  
ধারা – ৩৭৪
ইদ্দত পালন  বাধ্যতামূলক 
·         নিম্নলিখিত অবস্থায়  নারীর ইদ্দত পালন বাধ্যতামূলক –
·      (ক) ধারা (২৬৬*) মোতাবেক বৈধ (সহিহ) বিবাহের ক্ষেত্রে সহবাস অথবা (২৮৮) নির্জনে মিলনের পর বিবাহ বিচ্ছেদ হইলে; (২৬৬* -  এটা হলো শরিয়ত আইনের ২৬৬ নং ধারা। এই ধারাটি সহিহ বিবাহ বা বৈধ বিবাহ সংক্রান্ত)
·       () ধারা (২৬৬) মোতাবেক অনিয়মিত (ফাসিদ) বিবাহের ক্ষেত্রে সহবাস বা নির্জনে মিলনের পর বিবাহ বিচ্ছেদ হইলে;
·         (গ) উপধারা  (ক)() - এ বর্ণিত উভয় প্রকার বিবাহের পর স্বামীর মৃত্যু হইলেঃ
·         তবে শর্ত থাকে যে, নির্জনে মিলন বা সহবাসের পূর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ হইলে ইদ্দত পালন করিতে হইবে না।  
সব নারীর ক্ষেত্রে ইদ্দত পালন করার সময়-সীমা এক নয়। কারো ক্ষেত্রে তিন মাস, কারো ক্ষেত্রে চারমাস দশ দিন, কারো ক্ষেত্রে আবার দশ মাস দশ দিনশরিয়তি আইনের ৩৭৫ নং ধারায় সেই সময়কাল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেটা নিম্নরূপঃ
ধারা – ৩৭৫
ইদ্দতের সময়সীমা

·         (ক) বালেগা নারী যাহার নিয়মিত হায়েয হয় তাহার ইদ্দতকাল তিন হায়েয পর্যন্ত এবং হায়েয অবস্থায় তালাক দেওয়া হইলে ইদ্দতকাল হইবে উহার পরের তিনটি পূর্ণ হায়েযকাল।
·        (খ) অল্প বয়স, বার্ধক্য, রোগব্যাধি বা অন্য কোন কারণে কোন নারীর হায়েয না হইলে তাহার ইদ্দতকাল পূর্ণ তিন মাস।
·        (গ) কোন নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করিলে তাহার হায়েযকাল চারমাস দশ দিন।
·        (ঘ) কোন নারীকে রিজঈ তালাক দেওয়ার পর তাহার ইদ্দত চলাকালে স্বামী মারা গেলে তাহাকে স্বামীর মৃত্যুর তারিখ হইতে চারমাস দশদিন ইদ্দত পালন করিতে হইবে।
·        (ঙ) গর্ভবতী নারীর ইদ্দতকাল গর্ভখালাস হওয়া পর্যন্ত এবং বিবাহ বিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর অন্তঃসত্তা প্রকাশ পাইলে ইদ্দতকাল হইবে গর্ভখালাস হওয়া পর্যন্ত।
ইদ্দত পালনের শরিয়তি আইনের মূল ভিত্তি হলো কোরান  ৩৭৪ - এর (গ) উপধারাটি তৈরী করা হয়েছে  ৩৩/৪৯ নং আয়াতের নির্দেশে। আয়াতটি হলোঃ 
·        ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন বিশ্বাস স্থাপনকারীণী নারীগণকে বিয়ে কর, অতঃপর তাদের স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক প্রদান কর, তখন তোমাদের পক্ষ হতে তাদের কোন ইদ্দত নেই যা তারা অতিবাহিত করবে, তোমরা তাদেরকে কিছু আসবাবপত্র দিয়ে দাও এবং বিহিতভাবে পরিত্যাগ কর।        
৩৭৫ - এর (গ) উপধারাটি তৈরী করা হয়েছে  ২/২৩৪ নং আয়াতের আলোকে। আয়াতটি হলোঃ
·      তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মৃত্যমুখে পতিত হয়, তাদের স্ত্রীগণ চারমাস দশদিন প্রতীক্ষা করবে, যখন তারা তাদের ইদ্দতকাল (নির্ধারিত সময়) পূর্ণ করবে, তখন তারা যথা নিয়মে নিজেদের জন্য যা করবে, তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই,  তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌ অভিজ্ঞ
৩৭৫ – এর (খ) ও (ঙ) উপধারা দুটি প্রণয়ন করার নির্দেশ রয়েছে ৬৫/৪ নং আয়াতে। আয়াতটি হলোঃ
·         “তোমাদের স্ত্রীগণের মধ্যে যাহাদের হায়েয হওয়ার আশা নাই তাহাদের ইদ্দত সম্পর্কে  তোমরা সন্দেহ করিলে তাহাদের ইদ্দতকাল হইবে তিন মাস এবং যাহারা এখনও হায়েযগ্রস্তা  হয় নাই তাহাদেরও। আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত।”
৩৭৫ – এর (ক)  উপধারাটি প্রণয়ন করার নির্দেশ রয়েছে  ২/২২৮ নং আয়াতে। আয়াতটি হলোঃ  
·      তালাকপ্রাপ্তাগণ তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, এবং তারা যদি আল্লাহ্‌ ও পরকালে বিশ্বাস করে, আল্লাহ্‌ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা গোপন করা তাদের জন্য বৈধ নয় । এবং এর মধ্যে যদি তারা সন্ধি কামনা করে তবে তাদের স্বামীই তাদের প্রতিগ্রহণে সমধিক স্বত্ববান।  
৩৭৩ নং এর মূল ধারাটি (তালাক অথবা মৃত্যুজনিত কারণে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর একটা নির্দিষ্ট সময়-সীমার মধ্যে কোনো নারী পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না) প্রণয়নের ভিত্তি হলো কোরানের বাকারা সুরার ২/২৩৫ আয়াত।   আয়াতটি হলোঃ   
·        ইদ্দত পালনরত স্ত্রীলোকদের নিকট তোমরা ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব করলে অথবা তা তোমাদের অন্তরে গোপন রাখলে তোমাদের কোনো পাপ নেইআল্লাহ্‌ জানেন যে তোমরা তাদের সম্বন্ধে  আলোচনা করবে, কিন্তু নিয়মিত কথাবার্তা ব্যতীত গোপনে তাদের নিকট কোনো অঙ্গীকার করো না, নির্দিষ্টকাল (ইদ্দতকাল )পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ-কার্য সম্পন্ন করার সংকল্প করো না        
কেনো মুসলিম নারীদের ইদ্দত পালন করতে হবে তার জবাব বা কৈফিয়ত রয়েছে কোরানের ২/২২৮ নং আয়াতে যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা গোপন করা তাদের জন্য বৈধ নয়। এ কথাটির অর্থ হলো এই যে, তালাকপ্রাপ্ত নারী যেনো তালাকের পূর্বে তার গর্ভে সন্তান এসে থাকলে তা গোপন না করে।         
পুরো ইদ্দত আইনটি পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতিভাত হবে যে, নারীকে ইদ্দত পালনের হেতু হিসেবে ২/২২৮ নং আয়াতে যে কৈফিয়ত দেওয়া হয়েছে তা স্রেফ অজুহাত ছাড়া কিছু নয়। ইদ্দত আইন প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য একটাই, আর তা  হলো শেষ পর্যন্ত নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং  পুরুষের স্বার্থ  রক্ষা করা। ইদ্দতের বিধানে নারীর  সামান্যতম স্বার্থ নেই, বরং বিভিন্নভাবে তাদের স্বার্থের হানি করা  হয়েছে। এবং এই বিধানে করা হয়েছে তাদের প্রতি প্রভূত অবিচার, বৈষম্য ও অত্যাচারও ইদ্দত আইনটি এবার পর্যালোচনা করা যাক। বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, ৩৭৫ (খ) উপধারাটি ২/২২৮ নং আয়াত - এর ক্ষেত্রে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়।  কারণ, ২/২২৮ এর উদ্দেশ্য হলো তালাকপ্রাপ্ত নারীর গর্ভে সন্তান আছে কী না তা নির্ধারণ করা। কিন্তু ৩৭৫ (খ) উপধারাটি সেই নারীদের জন্যে যাদের হায়েজ হয় না। যাদের হায়েয হয় না তাদের গর্ভে  সন্তান   আছে কী না এ প্রশ্ন আসে না।  সুতরাং তাদের ইদ্দত পালনের কোনো আবশ্যকতা থাকে না।  তবুও তাদের উপর ইদ্দত পালনের বিধান আরোপ করা ফালতু উপদ্রব বা অত্যাচার ছাড়া আর কি হতে পারে? এবার আসা যাক যে নারীদের হায়েজ নিয়মিত হয় তাদের প্রসঙ্গে। এই নারীদের জন্যে ৩৭৫ (ঙ) উপধারা বাদে বাকি সমস্ত উপধারায় অপ্রাসঙ্গিক ও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। যাদের রজঃস্রাব জনিত অসুখ নেই এবং ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত রজঃস্রাব হয় তাদের গর্ভে সন্তান আছে কী না তা জানার জন্যে এক এক ঋতু কালই যথেষ্ট।  অথচ তাদেরও তিন মাস বা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করা বাধ্যতামূলক।  এবার ৩৭৫ (ক) উপধারার দ্বিতীয় অংশটির প্রতি লক্ষ্য করা যাক। এই উপধারাটি ৩৭৫ (খ) উপধারাটির মতোই বিনা প্রয়োজনেই নারীর উপর ফালতু চাপানো হয়েছে। কারণ এই ৩৭৫ (ক) উপধারাটি সেই তালাকপ্রাপ্ত নারীদের জন্যে যাদের হায়েয চলাকালীন সময়ে তালাক দেওয়া হয়যাদের হায়েয অবস্থায় তালাক দেওয়া হয় তাদের গর্ভে সন্তান থাকার প্রশ্নই ওঠে নাসুতরাং এই নারীদেরও  ইদ্দত পালন করা অনাবশ্যক।  আর একটি তালাকের প্রতি লক্ষ্য করা  যাক –  সেটা সুন্নত তালাক। কেউ যদি  সুন্নাত তালাক দেয়  অর্থাৎ পবিত্র তোহরে (রজঃস্রাবের পর) সহবাস না করে তালাক দেয় তবে ২/২২৮ আয়াত অনুসারে তালাকপ্রাপ্ত বৌ-এরও ইদ্দত পালন করার আবশ্যকতা থাকে না। কারণ, যে নারীর সঙ্গে রজঃস্রাবের পর সহবাস করা হয় নি তার গর্ভে সন্তান আসবে কী করে? সুতরাং এক্ষেত্রেও ইদ্দত পালন করার কোনো হেতু ও প্রয়োজনীয়তা নেই।    পবিত্র তোহরে তালাক (সুন্নত তালাক) দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তো স্বয়ং মুয়াম্মদই। তাহলে যাদের সুন্নাত তালাক দেওয়া হবে তারা কেনো অহেতুক ইদ্দত পালন করবে? এবার শোনা যাক সুন্নাত  তালাক সম্পর্কে বিজ্ঞ আলেমগণ কী বলেছেন তা – “হযরত ইকরামা (র) বলেন যে, ... হামল বা গর্ভবতী অবস্থায় তালাক দাও, যখন হামল প্রকাশিত হয়ে যাবে। যে তোহরে সহবাস করেছো ঐ তোহরে তালাক দিও না। কেননা, এর দ্বারা হামল হলও কী না তা জানা যায় না।  এখান হতেই বিজ্ঞ আলেমগণ তালাকের আহকাম গ্রহণ করেছেন এবং তালাকের দুই প্রকার করেছেন। তালাকে সুন্নাত ও তালাকে বিদআত। তালাকে সুন্নাত তো এটাই যে, এমন তোহরে বা পবিত্র অবস্থায় তালাক দিবে যাতে স্ত্রী-সহবাস করে নি অথবা হামল অবস্থায় তালাক দিবে। আর তালাক বিদআত এই যে, হায়েযের অবস্থায় তালাক দিবে অথবা এমন  তোহরে তালাক দিবে যাতে স্ত্রী-সহবাস হয়েছে এবং হামল হয়েছে কী না জানা যায় নি।” (দ্রঃ ইবনে কাশিরের তফসির, আয়াত – ৬৫/১, সপ্তদশ খণ্ড, পৃ – ৫৩৪)  এই তফসির থেকে এটা স্পষ্ট সংশয়াতীতভাবে এটা প্রমাণিত হয় যে, গর্ভবতী হয় নি এমন বৌকে রজঃস্রাবের পর সহবাস না করেই তালাক দেওয়া ছিলো মুহাম্মদের বেশী পছন্দের। সুতরাং মুহাম্মদের পরামর্শ মেনে অগর্ভবতী বৌদের তালাক দিলে তাদের ইদ্দত পালন করার প্রশ্ন ওঠে না। তবুও ইদ্দত আইনে সুন্নাত তালাকপ্রাপ্ত নারীরও ইদ্দত পালন করা বাধ্যতামূলক।
তালাকপ্রাপ্ত নারীর পুনরায় বিয়ে করার আগে তার গর্ভে সন্তান আছে কী না তা জানা দরকার  - যদি তর্কের খাতিরে এই বিধানটাকে একটি সঠিক ও ভালো বিধান বলে ধরে নেওয়া যায় তবুও এটা মানতে হবে যে, বিধানটিতে প্রচুর ত্রুটি রয়েছে যেগুলো উপরে আলোচনা করা হয়েছে। যে শ্রেণীর তালাকপ্রাপ্ত নারীদের গর্ভে সন্তান নেই তাদের একটা শ্রেণীকে (যাদের বিয়ের পর স্পর্শ করবার আগেই তালাক দেওয়া হয়েছে) মাত্র ইদ্দত পালন থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।  কিন্তু যাদের গর্ভে সন্তান নেই এমন আরো কয়েকটি শ্রেণীর  নারীদের উপর অহেতুক ইদ্দত পালনের বিড়ম্বনা চাপানো হয়েছে। এরূপ বিড়ম্বনায় ফেলা মানে যেমন একদিক দিয়ে তাদের প্রতি ভয়ানক অবিচার, তেমনি এক প্রকার মানসিক জুলুমও বটে।
আরো দুটি বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। তার মধ্যে একটি বিষয় হলো, ৩৭৫ (ঙ) উপধারাটি। গর্ভাবস্থায় তালাকপ্রাপ্ত হলে কিংবা তালাকের পর গর্ভাবস্থার প্রকাশ পাইলে ইদ্দতের সময়কাল হবে গর্ভখালাস পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন হলো তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে গর্ভবতী জেনেও যদি কোনো পুরুষ বিয়ে করতে সম্মত হয় এবং সম্মতি থাকে সেই মহিলাও তবে গর্ভখালাস পর্যন্ত কেনো তাকে ইদ্দত পালন করতে হবে?  কেনই বা বিয়ে করার জন্যে গর্ভখালাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রাক্তন বরের ঔরসজাত সন্তানের অভিভাবকত্বের কী হবে? সে ক্ষেত্রে যদি  ইসলামি অভিভাবকত্ব আইনকে মেনেই ওরা পরষ্পরকে বিয়ে করতে সম্মত থাকে তবে তো গর্ভখালাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা একেবারেই অনাবশ্যক হয়ে ওঠে। ইদ্দত আইন অনুযায়ী এই অনাবশ্যক কালটা নারীকে অপেক্ষা করতে বাধ্য করা হয়। এটা নারীর প্রতি শুধু অবিচারই নয়, এটা তাদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপও। একজন নারী কখন বিয়ে করবে তা সে নিজে ঠিক করতে পারবে না? ইদ্দত আইন এখানে নারীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তা হলো ২/২২৮ নং আয়াতটিএই আয়াতটিই ইদ্দত আইনের ভরকেন্দ্রে অবস্থিত। কারণ এই আয়াতটি তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বলছে আগে জেনে নাও তোমার গর্ভে সন্তান নেই তারপর বিয়ে করো। আর যদি তোমার গর্ভে সন্তান থাকে তবে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো। প্রশ্ন হলো, ২/২২৮ নং আয়াতটির এই বিধানটা কি মানব সমাজে  একান্তই অপরিহার্য? এর উপযোগিতা যতোটা দেখানো হয়  সত্যিই কি ততোটা আছে?  প্রথমে   ভেবে দেখা যাক একজন ব্যক্তির গর্ভবতী বৌকে রেখে মারা যাওয়ার পরের পরিস্থিতিটা সম্পর্কে। এই বিধবা নারীটি যখন সন্তান প্রসব করবে তখন তার সন্তানের অভিভাবক হবে তো একমাত্র সেই-ই, দ্বিতীয় অভিভাবক তো আর কারো হওয়ার কথা নয়। তাহলে সেক্ষেত্রে সেই নারী ২/২২৮ নং আয়াতটির ভিত্তিতে গর্ভে সন্তান আছে কী না তা জানার জন্যে তিন ঋতুকাল অপেক্ষা করবে কেন?  এবং কেনই বা অপেক্ষা করবে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত?  সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, একজন মুসলিম বিধবার জন্যে ২/২২৮ আয়াতটি অপরিহার্য তো নয়ই, বরং এই আয়াতটি মুসলিম বিধবা নারীদের মৌলিক অধিকারকে নির্মমভাবে হরণ করছে। এবার আসা যাক যে লোকটা তার গর্ভবতী বৌকে তালাক দিয়েছে এবং তারপরেও জীবিত আছে। যে লোকটা গর্ভবতী বৌকে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে  দিতে পারে  সে লোকটার কি সেই তালাকপ্রাপ্ত নারীর গর্ভের সন্তানের অভিভাবক  নৈতিক অধিকার থাকতে পারে? যে নারী বরের গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে পরের অন্নে ও আশ্রয়ে থেকে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির যুদ্ধ করে দশ মাস গর্ভে লালন করে সন্তানের জন্ম দেয় সেই সন্তানের উপর তারই কি নৈতিক অধিকার বেশী জন্মায় না?  এই সব নৈতিক ও মৌলিক অধিকারগুলি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে ২/২২৮ নং আয়াতের প্রয়োগ করে। সন্তানের প্রতি মায়ের অধিকার নস্যাৎ। করে দেওয়া হয়েছে এই আয়াতটির সাহায্যে। এই আয়াতটির উপরেই যেহেতু নির্মাণ করা হয়েছে ইদ্দত আইনটি, তাই গোটা আইনটিতেই  নারীর প্রতি অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে,  তাদের প্রতি মানসিক নির্যাতন সংগঠিত করা হয়ে হয়েছে এবং তাদের ন্যায্য ও মৌলিক অধিকারগুলি খর্ব ও হরণ করা হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে পুরুষের স্বার্থে, নারীর উপর শত শতো যুগ ধরে চেপে বসা পুরুষের আধিপত্য ও প্রভুত্বের পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে। মূল কথা হলো গোটা ইদ্দত আইনটাতে তীব্র নারীবিদ্বেষ ও নগ্ন পুরুষবাদের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। 










  

Tuesday, March 7, 2017

শরিয়তি খোরপোষ আইনে নারীর প্রতি যে অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে তা নজিরবিহীন


পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্যে খোরপোষ একান্ত অপরিহার্য। কারণ, এ সমাজে নারীর আত্মনির্ভরশীল হবার সকল পথই বন্ধ।  ফলে নারীকে আজীবন পুরুষের উপর পরনির্ভরশীল ও   মুখাপেক্ষী থাকতে হয়বিয়ের আগে থাকে পিতার উপর নির্ভরশীল, বিবাহিত জীবনে বরের উপর এবং শেষ বয়সে থাকে পুত্রের প্রতি নির্ভরশীল। ফলে  নারীকে তালাক দিয়ে যখন তার বিবাহবন্ধন ছিন্ন করে দেওয়া হয় তখন তার জন্যে খোরপোষ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তুলনামূলকভাবে পুরুষদের প্রতি নির্ভরশীলতা মুসলিম নারীদের অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী। কারণ,  পুরুষতন্ত্রের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশী পশ্চাদপদ স্বভাবতঃই তালাকপ্রাপ্তা মুসলিম নারীদের জন্যে খোরপোষের অপরিহার্যতাও অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী।  কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতেও শরিয়তি তালাক আইনে তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্যে খোরপোষের বিধান নেই। তালাকপ্রাপ্ত বিবাহবিচ্ছন্ন অসহায় মহিলাদের  ভরণপোষণ কীভাবে চলবে সে বিষয়ে তালাক আইন সম্পূর্ণ নীরব মুসলিমরা কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং উচ্চ ধারণা পোষণ করে। তারা  বিশ্বাস করে যে ইসলামই হলো একমাত্র ধর্ম,  যে ধর্ম নারীকে পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে, পুরুষের সমান অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে, সর্বোপরি সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে এবং সর্বোপরি দিয়েছে তাদের জান-মালের নিরাপত্তাও কিন্তু মুসলিমদের সেই বনিশ্বাসের যে ভিত্তি নেই তা আমরা দখেছি তালাক আইনের পরতে পরতে। দেখেছি সেই আইনে একদিকে পুরুষের প্রতি সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব, আর একদিকে নারীর প্রতি পাহাড় প্রমাণ অবিচার, বঞ্চনা ও বৈষম্য।  সেই একই ছবি বহাল রয়েছে  খোরপোষের ক্ষেত্রেও। মুসলিম নারীদের  খোরপোষ পাওয়ার ন্যায্য দাবি ও অধিকারকে নির্মমভাবে নস্যাৎ  করে দেওয়া হয়েছে। এবং তালাকপ্রাপ্ত এবং বিবাহবিছিন্ন অসহায় নারীদের খোরপোষ না দিয়ে অনিশ্চিত ও অন্ধকারে ভবিষ্যতের অতল গহ্বরে নির্মমভাবে ঠেলে দেওয়া হয়েছেএ কথাটা  মুসলিমদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে,   এটাই কিন্তু বাস্তব এবং   সত্যি।  হ্যাঁ, ভারতীয় শরিয়ত আইন (আইনটির বাংলা সংস্করণ হলো বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন) তালাকপ্রাপ্ত অসহায় নারীদের  সত্যি  সত্যিই খোরপোষের  অধিকার দেয় নি এই আইনের  চতুর্দশ অধ্যায়টি সম্পূর্ণ খোরপোষ সংক্রান্ত। এই অধ্যায়ে ৩৭৯ নং থেকে ৩৯৬ নং পর্যন্ত মোট ১৭টি ধারা রয়েছে যার মধ্যে তিনটি উপধারা  বিশিষ্ট ৩৯৬ নং ধারাটি কেবল তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের জন্যে সেই ধারাটির উপর  চোখ রাখা যাক -   
ধারা - ৩৯৬
তালাকপ্রাপ্তার খোরপোষ ও উপঢৌকন (মাতা)
·         (ক) ধারা (২৮৮*) মোতাবেক নির্জনে মিলন হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদান করিলে এবং মুহর ধার্য হইয়া না থাকিলে স্ত্রী কিছু উপহার সামগ্রী (মাতা) পাইবে এবং তাহা প্রদান করা স্বামীর জন্য বাধ্যতাকর; কিন্তু মুহর ধার্য হইয়া থাকিলে উপহার সামগ্রী প্রদান করা স্বামীর জন্য ঐচ্ছিক। (খ) ধারা (২৮৮*) মোতাবেক নির্জনে মিলন হইবার পর স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদান করিলে তাহার ইদ্দতকালের খোরপোষ ও বাসস্থান করা স্বামীর জন্য বাধ্যকর (গ) ইদ্দত চলাকালে স্বামী মারা গেলে সে খোরপোষ ও বাসস্থান পাইবে না, তবে সে তাহার  পরিত্যাক্ত মালে ওয়ারিশ হইবে। (২৮৮* - শরিয়ত আইনের ২৮৮ নং ধারা)
·          
৩৯৬ নং ধারায় তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে খোরপোষ যে দেওয়া হয় নইতা স্পষ্ট,  খোরপোষের বদলে  কিছু উপহার সামগ্রী দিতে বলা হয়েছেসেটাও আবার শর্ত সাপেক্ষে। শর্তটি হলো বিয়ের সময় মোহর (মুহর) ধার্য না করা থাকলে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা কিছু উপহার সামগ্রী পাবে।  কিন্তু মোহর ধার্য  থাকলে উপহার পেতে পারে, না পেতেও পারে, কারণ উপহার দেওয়াটা তালাকদাতার জন্যে ঐচ্ছিক করা হয়েছে। কোনো আইনে নারীর প্রতি এতো অন্যায় ও অবিচার হতে পারে তা সত্যিই ভাবা যায় না। তাই মুসলিমদের হয়তো এটা মনে হতে পারে যে, এ আইনটি নিশ্চয়ই আলেমদের মস্তিষ্কপ্রসূত, কোরানের আইন নয়।  কিন্তু না, আলেমদের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। আইনটি আসলেই ইসলাম-সম্মত, এবং ওতে আলেমদের মনগড়া বিধি নেই বিধানটি তারা প্রণয়ন করেছেন কোরানের ২/২৩৬ এবং ২/৩৬৭ নং আয়াতের আলোকে। দেখুন ২/২৩৬ নং আয়াতটি কী বলছেঃ  “যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ না করে অথবা তাদের প্রাপ্য নির্ধারণ করে তালাক প্রদান কর, তবে তাতে কোনো দোষ নেই, এবং তাদেরকে কিছু সংস্থান করে দেবে, অবস্থাপন্ন লোক তাদের অবস্থানুসারে এবং অভাবগ্রস্থ লোক তার অবস্থানুসারে বিহিত সংস্থান (করে দেবে), সৎকর্মশীল লোকদের উপর এই কর্তব্য।” (অনুবাদ – প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাশির)  এই আয়াতের অথবা তাদের প্রাপ্য নির্ধারণ করে তালাক প্রদান কর’ - কথাগুলি এবং  ৩৯৬ (ক) ধারার   মুহর ধার্য হইয়া না থাকিলেকথাগুলি যে একই তা বলা বাহুল্যসুতরাং এটা সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হলো যে ৩৯৬ (ক) ধারাটি  রচনা করা হয়েছে কোরানের ২/২৩৬ নং আয়াতের  ভিত্তিতে।    
এবার ৩৯৬(ক)ধারার ২য় অংশটি (মুহর ধার্য হইয়া থাকিলে উপহার সামগ্রী প্রদান করা স্বামীর জন্য ঐচ্ছিক) প্রসঙ্গে আসা যাক। এই অংশটি যে প্রণয়ন করা হয়েছে  ২/২৩৭ নং আয়াতের আলোকেই তা আয়াতটির কথা থেকেই প্রতীয়মান হয় কারণ, আয়াতটি বলেছে -  “আর যদি তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক প্রদান কর এবং তাদের মোহর নির্ধারণ করে থাক, তবে যা নির্ধারণ করেছিলে তার অর্ধেক; কিন্তু যদি তারা ক্ষমা করে কিংবা যার হাতে বিবাহ বন্ধন সে ক্ষমা করে অথবা তোমরা ক্ষমা কর তবে এটা ধর্মপ্রাণতার নিকটবর্তী; এবং পরষ্পরের উপকারকে যেন ভুলে যেও না; তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তা প্রত্যক্ষকারী।”  (অনুবাদ – ঐ) ৩৯৬(ক) ধারার ২য় অংশটি এবং  ২/২৩৭ নং আয়াতটি তুলনা করলে এটা স্পষ্টতঃই পরিলক্ষিত হয় যে আয়াত এবং আইনের ধারাটির মধ্যে অমিল বা গড়মিল নেই বললেই চলে। গড়মিল যেটুকু রয়েছে তা গণ্য করার মতো মোটেই নয়। মোহর ধার্য থাকলে তালাকপ্রপাপ্ত নারীকে উপহার সামগ্রী দেওয়াটাকে ঐচ্ছিক করা হয়েছে আইনটিতে যে কথা কোরানের আয়াতে নেই। গড়মিল এতোটুকুই। অন্যদিকে কোরান প্রথমে নারীর মোহর অর্ধেক কেটে নিয়েছে এবং পরে বাকি অর্ধেকটা তাকে মাফ করে দিতে বলেছে। অর্থাৎ কার্যতঃ নারীকে তাদের মোহরের ন্যায্য অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেছে। আলেমগণ কিন্তু তাদের  তৈরী করা আইনে  মোহরের ন্যায্য অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেন নি। সুতরাং কোরান অপেক্ষা আলেমদের তৈরী করা এই আইনটি একটু কম অমানবিক বলেই প্রতিভাত হয়।   
শুধু কোরানের আলোকেই ৩৯৬(ক) ধারাটি প্রণয়ন করা হয় নি, আইনটির ভিত্তি যে হাদিসও - সে কথাটি জানিয়েছেন উক্ত আইন প্রণোয়নকারী বিশেষজ্ঞ আলেমগণ। তাঁরা ৩৯৬ নং ধারার শেষে তার প্রমাণ রেখেছেন। তারা এক্ষেত্রে দু’টি হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিস দুটি হলোঃ  মহানবী (সঃ) বলেনঃ “তালাকপ্রাপ্তা নারী ইদ্দত পর্যন্ত খোরপোষ পাইবে।” (হিদায়া ২য় খণ্ড)  “হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার খিলাফতকালে এই ফরমান জারি করেন যে, তালাকপ্রাপ্তা নারী তাহার ইদ্দতকাল পর্যন্ত তাহার তালাকদাতা স্বামীর নিকট হইতে খোরপোষ পাইবে।”  (ইমাম কুরতুবির আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, তখ, পৃ. ১৬৭)    
৩৯৬(খ) ধারায় বলা হয়েছে যে, তালাকপ্রাপ্ত নারীর ‘ইদ্দতকালের খোরপোষ ও বাসস্থান করা স্বামীর জন্য বাধ্যকর এরইএরই সূত্র ধরে  মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা দাবি করেন যে তালাকপ্রাপ্তদের খোরপোষ দেবার বিধান আছে। এর মধ্যে দিয়ে তারা ইসলামের মানবিক মুখটি তুলে ধরতে চায় এবং বলতে চায় যে দেখো,  ইসলাম নারীর প্রতি কতো সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল। কিন্তু এটা আসলে তাদের একটা চতুর প্রতারণা ও মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। কারণ, তাদের দাবিটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের ইদ্দতকালে খোরপোষ দেওয়া বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে তারা প্রকৃত অর্থে তালাকপ্রাপ্ত নয়।  যাদের এক তালাক বা দু তালাক দেওয়া হয়েছে তাদের কথা বলা হয়েছে এখানে। এক তালাক এবং দু তালাক দেওয়ার পরেও তালাক ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে যে কথা ২/২২৯, ৬৫/১, ৬৫/২ প্রভৃতি আয়াতে বলা হয়েছে। এই ধরণের তালাককে শরিয়তের পরিভাষায় বলে ‘রিজঈ’ তালাক যা ফিরিয়ে নেওয়া যায়। অর্থাৎ এক ও দু তালাক দেওয়ার পরেও তালাকপ্রাপ্ত নারী তার বরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকে। এই সময়কালটাই শরিয়তের পরিভাষায় হলো ইদ্দতকাল (এক সঙ্গে তিন তালাক দিলেও তালাকপ্রাপ্ত নারীকে ইদ্দত পালন করতে হয়) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকা নারীর ইদ্দতকালের সময়ে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন তার বরের বাড়িতেই থাকে এবং বরকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে সে যেন তার বৌকে বাড়ি থেকে বের করে না দেয়। সুতরাং  এই সময়টা (ইদ্দতকালটা) তো সে (বর) তার বৌকে খোরপোষ দিতে বাধ্য। এখানে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতীশীলতার কথা বলা অবান্তর যা মিথ্যাচারের শামিল। প্রকৃত তালাক হলো তিন তালাক দেওয়া তা একসঙ্গেই হোক কিংবা তিন বারেই হোক। কারণ, এই তালাক হলো ইসলামের ভাষায় ‘বাইন’ তালাক  যা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না  এবং এই ‘বাইন’ তালাকে বিবাহবন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এই তালাকপ্রাপ্ত নারীরাই হলো আসল তালাকপ্রাপ্ত নারী।  পুরুষদের অন্যায়ভাবে দেওয়া ‘বাইন’ তালাকের অভিঘাতে মুসলিম নারীদের জীবন যখন বিপন্ন হয়ে ওঠেসেক্ষেত্রে আইন এমন হওয়া উচিৎ  যাতে কেউ এভাবে একজন নারীরও জীবনকে বিপন্ন করতে না পারে। আর যদি করেও বা তাহলে জীবন বিপন্নকারী যাতে কঠিন শাস্তি  পায় তার ব্যবস্থা  থাকা উচিৎ। তারই পাশাপাশি  তালাকপ্রাপ্ত অসহায় নারী যাতে ন্যূনতম খেয়েপরে বাঁচতে পারে আইনে তার ব্যবস্থাও থাকা উচিৎ। শরিয়ত আইন এ সবের কোনোটাই করে নি।  যেমন তালাকপ্রাপ্ত ও বিবাহবিচ্ছিন্ন  অসহায় নারীকে বাঁচাতে তার খোরপোষের ব্যবস্থা করে নি এবং তালাকদাতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ করে নি।  ফলে বিবেকহীন পুরুষরা  তাদের হীন স্বার্থ পূরণের জন্যে খেয়ালখুশি মতো যখন তখন তালাক দিতে পারে এবং প্রতিদিন কতো নারী যে তাদের খেয়ালখুশীর শিকার হয় তার ইয়ত্তা নেই।  
মূলকথা হলো শরিয়তি খোরপোষ আইন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম নারীকে খোরপোষ পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে তালাকপ্রাপ্ত নারীর যদি ধন-সম্পদ না থাকে (সচরাচর থাকে না) এবং তার পিতাও যদি গরীব হয় এবং মেয়ের ভার নেবার তার সামর্থ না থাকে, তবে  তালাকপ্রাপ্ত নারীর সামনে তিনটি পথ খোলা থাকে - এক. অনাহারে  মৃত্যুবরণ করা, অথবা দুই. দেহবিক্রীর ঘৃণ্য পেশা বা অনুরূপ কোনো আত্মহননকারী পেশা অবলম্বন করা, অথবা  তিন. আত্মহত্যা করা। ইসলাম নারীর খোরপোষের দাবিকে নস্যাৎ করে তাদের সে পথেই ঠেলে দিয়েছে।      

(বিঃদ্রঃ এই লেখাটি আমার ‘নারী ও ইসলাম’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। লেখাটা পড়লে কিছুটা তার আঁচ পাওয়া যাবে। ‘নারী ও ইসলাম’ গ্রন্থটি লেখার কাজ চলছে, তবে শেষ পর্যায়ের লেখা চলছে এখন। কোনো সমস্যা হঠাৎ এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালে খুব শীঘ্রয় গ্রন্থটি লেখা শেষ করতে পারা যাবে আশা করি।  ০৭.০৩.২০১৭)  






KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...