Friday, January 15, 2016

মানবতা বনাম ধর্ম ও রাষ্ট্র




মানববাদ ও মানবতাবাদ
মানবতা শব্দটি এসেছে মানুষ বা মানব থেকে । মানবতা শব্দটি তাই যুগে যুগে সবচেয়ে বেশী আলোচিত ও চর্চিত হয়েছে । কারণ, যুগে যুগে একদল স্বল্প সংখ্যক মানুষ আর একদল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ  মানুষকে শাসন ও শোষণ করেছে  নির্মমভাবে । ফলে শোষিত মানুষের দল দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় নি, পোশাক পায় নি, চিকিৎসা পায় নি, বাস করার ঘর পায় নি ।  তাদের যাপন করতে হয়েছে মানবেতর জীবন  । অতি মুনাফা করতে গিয়ে শোষক শ্রেণি কখনো কখনো দুর্ভিক্ষ ডেকে নিয়ে এসেছে । গরীব মানুষগুলো তখন অনাহারে ও অপুষ্টিতে এবং মহামারীতে  মরেছে     হাজারে  হাজারে, গ্রামের পর গ্রাম ও শহরের পর উজার হয়ে  গিয়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে   এভাবে খেটে খাওয়া মানুষদের মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে চূড়ান্ত মাত্রায়  স্বভাবতই এর বিরুদ্ধে যুগে যুগে দেশে দেশে প্রতিবাদ হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, বিদ্রোহ হয়েছে, বিপ্লব হয়েছে ।  একদিকে শোষক শ্রেণির শাসন, শোষণ ও দমন এবং অন্যদিকে শোষিত শ্রেণির  প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের দ্বন্দের মধ্য দিয়েই মানব সমাজের বিবর্তন হয়েছে, হয়ে চলেছে ।  মানুষের উপর মানুষের শোষণ যতো বেড়েছে, প্রতিবাদী শোষিত শ্রেণির উপর শোষক শ্রেণির রাষ্ট্র যতো নিপীড়ন চালিয়েছে ততোই মানবতা বিপন্ন বলে আওয়াজ উঠেছে ।
আজকের বিশ্বেও যে শব্দবন্ধটি সব চেয়ে বেশী উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো ‘মানবতা বিপন্ন’ ।  বর্তমান বিশ্বে মানব সভ্যতার কাছে সব চেয়ে বড়ো হুমকি হয়ে উঠেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসযদিও   সীমিত পরিসরে কোথাও কোথাও অল্প বিস্তর ইহুদি সন্ত্রাস, খৃস্টীয় সন্ত্রাস, হিন্দু সন্ত্রাস নিরন্তর মানবতাকে  হত্যা করছে ঠিকই, কিন্তু ইসলামি সন্ত্রাস আজ মানবতার সাক্ষাৎ যম হয়ে আবির্ভুত হয়েছে এই সন্ত্রাসবাদীরা পাইকারি হারে মানুষ হত্যা করে চলেছে, মাছি মারার মতো মানুষকে গুলি করে মারছে কিংবা তলোয়ার বা চাপাতি দিয়ে মানুষের মাথা নামিয়ে দিচ্ছে, জীবন্ত মানুষদের মাটিতে পুঁতে দিচ্ছে,    হাজার হাজার নারীকে বন্দি করে তাদের যৌনদাসী করে রাখছে কিংবা বাজারে বিক্রি করছে, বয়স্কা নারীদের হত্যা করছে । ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এভাবে মানবতা কখনো বিপন্ন হয়েছে বলে মনে পড়ে না । অনীশ সংস্কৃতি পরিষদ  আজকে তাদের বার্ষিক সম্মেলনে আলচনার জন্যে অন্যতম একটি বিষয় হিসেবে ‘মানবতা’কে  অন্তর্ভুক্ত করেছে । তার জন্যে আয়োজকদের  অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি ।  কারণ এটা খুবই প্রসঙ্গিক ও  সময়োপযোগী বিষয় । আর এ বিষয়ে আমাকে আলোচক হিসাবে নির্বাচন করার জন্যে অনীশ সংস্কৃতি পরিষদের আয়োজকদের প্রতি আরেকবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি ।  কৃতজ্ঞতাও ।
নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবাসা, মানুষকে ঘৃণা না করা, মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ না করা, মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা পোষণ না করা, মানুষের সেবা করা, অসহায় ও বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা, মানবজাতির কল্যাণে কাজ করা হলো মানবতা । মানবতার পক্ষে কাজ করা নিঃসংশয়ে এক  মহৎ কাজ । বহু সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে বহু মানুষ মানবতার পক্ষে কাজ করছেন । এ কাজ চলছে আঞ্চলিক স্তরে, চলছে আন্তজার্তিক স্তরে, চলছে ভুবন জুড়ে ।  যাঁরা মানবতার পক্ষে কাজ করেন তাঁরা মানবতাবাদী বলে খ্যাত ।  তাঁদের আবার মানববাদী বলেও আখ্যায়িত করা হয় । আমি তা মনে করি নামানববাদীরাও মানুষের জন্যেই কাজ করেন । ফলে আপাতদৃষ্টিতে  মানবতাবাদী ও মানববাদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না । তাই সাধারণতঃ  মানবতাবাদ ও মানববাদ এই দুটো শব্দকে  আমরা সমার্থক শব্দ বলে ভাবি  । কিন্তু বাস্তবে মানবতাবাদী ও মানববাদীরা এক নয়  কাজের নিরিখে সব মানববাদীরাই মানবতাবাদী,  কিন্তু মানবতাবাদী মাত্রই মানববাদী নয় । সকল মানববাদীই মানবতাবাদী, কিন্তু সকল মনবতাবাদীই  মানববাদী নয় ।   বিজ্ঞানের বিচারে যেমন সব ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সব ক্ষারকই ক্ষার নয় ঠিক তেমনি   কিছু ধার্মিক ব্যক্তি তথা ঈশ্বরবিশ্বাসী ব্যক্তি মানবতাবাদী হতে  পারেন, কিন্তু তাঁদের পক্ষে মানববাদী হয়ে ওঠা অসম্ভব কিন্তু যে ব্যক্তি মানববাদী তাঁর পক্ষে মনবতাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, সমস্যা  নেই । একজন হিন্দু মানবতাবাদী হতে পারে কিন্তু তার পক্ষে মানববাদী হওয়া অসম্ভব ব্যাপার । অনুরূপভাবে  একজন মুসলমানও মানবতাবাদী হতে পারে কিন্তু তার পক্ষেও মানববাদী হয়ে ওঠা সম্ভব নয় অনুরূপভাবে এ কথা প্রযোজ্য একজন ইহুদি, খৃস্টান শিখ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির  ক্ষেত্রেও । বিষয়টা একটু পরে দৃষ্টান্ত যোগে স্পষ্ট করা হয়েছে    মানবতাবাদী ও মানববাদীদের  কাজ, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে । ফারাকটা একেবারে মৌলিক ।  মানুষ হিসেবেও তাদের মধ্যে পার্থক্য আসমান জমিনমানবতাবাদীরা ভাববাদী, ভাগ্যবিশ্বাসী ও ঈশ্বরবিশ্বাসী  অপরদিকে মানববাদীরা যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী ।  মানবতাবাদীরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা, অনাহার-অপুষ্টি-অকালমৃত্যুকে বিধিলিপি বলে বিশ্বাস করেন । তাঁরা তাই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট যথাসাধ্য লাঘব করার জন্যে কাজ করেন । প্রশ্ন তোলেন না কেন একদল মানুষের বৈভবের অন্ত নেই আর একদল মানুষ নিরন্ন ও  নিরাশ্রয় হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে ধুঁকে ধুঁকে মরে ? মানববাদীরা বিধিলিপিতে বিশ্বাস করেন না । তাঁরা প্রশ্ন তোলেন কেনো অল্প কিছু মানুষ একদিকে সম্পদের পাহাড়ে বসে সীমাহীন আরাম- আহ্লাদে জীবনটাকে ভোগ করবে   আর একদিকে বিপুল জনরাশি নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীন হয়ে জীবন যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে বংশপরম্পরায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে ?  প্রশ্ন তোলেন, কেনো একদল মানুষ সম্পদ তৈরী করবে আর সে সম্পদের মালিক হবে আর একদল মানুষ?   কেনো গরীবরা  বড়োলোকের গাড়ি তৈরী করবে আর  সেই গাড়ির চাকায়  গরীবরাই কেনো চাপা পড়বে ? মানববাদীরা শুধু প্রশ্নই তোলেন না, এমন সমাজটাকে, সমাজব্যবস্থাটাকেই আমূল বদলে দেওয়ার দাবিতে  লড়াই করেন এমন সমাজ নির্মাণের কথা বলেন যেখানে ধনী ও গরীবের বৈষম্য থাকবে না ।  যেখানে মানবতা এবং  সকলেরে  মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে ।  মানবতাবাদীরা ঐতিহ্য ও প্রথার পূজারী ও পাহারাদার । যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তার পশ্চাতে  নিশ্চয়ই মানুষের কল্যাণ নিহিত আছে এই ছেদো যুক্তিতে তাঁরা   প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সব বর্বর ঐতিহ্য ও প্রথার মধ্যে আতকে থাকতে চান, সবাইকে আটকে রাখতে চান । মানববাদীরা মানবস্বার্থবিরোধী ও প্রগরিবিরোধী ঐতিহ্য ও প্রথা ভেঙে  সংস্কার-কুসংস্কার মুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক সমাজ নির্মাণ করতে চান । মানবতাবাদীরা ধর্ম, বর্ণ ও  লিঙ্গ  নিরপেক্ষভাবে  সমস্ত দুর্বল মানুষের জন্যে কাজ করেন এ কথা ঠিক । কিন্তু তবুও  তাঁরা সর্বদা ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারেন না । ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্যে কাজ  করেও  তাঁরা ব্যক্তি জীবনে এবং  সমাজ জীবনে কেউ ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নিরপেক্ষ নন, বরং ধর্মভেদ, বর্ণভেদ ও লিঙ্গভেদকে ঈশ্বরের বিধান বলে পরমাদরে লালন পালন করেন এবং সেই ভেদ ব্যবস্থাকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করতে কট্টর ভূমিকা পালন করেন । এ সমস্ত ভেদ ব্যবস্থার শিকার হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো এবং নারীরা ।  মানববাদীরা মানুষের মধ্যে কোনো প্রকার ভেদাভেদে বিশ্বাস করেন না । তাঁদের কাছে সব মানুষই সমান ।  তাঁরা  তাই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন সকল ভেদ ব্যবস্থার অবসানের জন্যে কাজ করেন । আর সেজন্যেই ঐতিহ্য ও প্রথার সর্ব প্রকার শৃঙ্খল ভাঙতে চান । মানবতাবাদীরা মানবতার পক্ষে কাজ করেন  গরীব ও অসহায় মানুষদের প্রতি সেবা ও দয়ার মনোভাব থেকে । তাদের তাই ইংরাজী প্রতিশব্দে Humanitarian বলা যায় । তাঁরা আপাতদৃষ্টিতে নিঃস্বার্থভাবে মানবতার পক্ষে কাজ করেন বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা নয় । তাঁরা এ কাজ করেন পূন্য অর্জনের আশায় এবং  স্বর্গলাভের লালসায় । স্বর্গলাভের জন্যে করলেও অবশ্য তাঁদের কাজের মহত্ত্ব অবশ্য বিন্দুমাত্র খাটো হয় না । মানববাদীরা যথেষ্ট দয়াবান, কিন্তু দয়া পরবশ হয়ে কোনো কাজ করেন না । কাজ করে তার প্রতিদানে কিছু পাওয়ার আশায় করেন না । সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত মানুষদের শোষণ, বঞ্চনা ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, তার প্রতিকার করা প্রত্যেকটা মানুষের একটা  মানবিক কর্তব্য বলে করেন ।  মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, স্বভাবতই তার একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে । মানববাদীরা সেই সানাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করেন । তাঁরা কাজ করেন মানব সমাজে মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে । তাই তাঁরা মানববাদী, ইংরাজি প্রতিশব্দে যাকে আমরা  Humanist বলতে পারি ।  মানবতাবাদীরা যে কাজ করেন তাতে তাঁদের অনেক শ্রম দিতে হয়, অনেক দুঃখ-কষ্ট বরণ করতে হয়, সে কাজে কিন্তু তাঁদের জীবনের ঝুঁকি থাকে না ।   মানববাদীদের কিন্তু প্রতি পদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় । তাঁরা কায়েমী স্বার্থের চোখের বালি হয়, ধর্মান্ধদের শত্রু হয়, এবং অবশ্যই রাষ্ট্রের রোষানলে তাঁদের পড়তে হয় । মানবতাবাদীদের সঙ্গে মানববাদীদের আর একটা প্রধান পার্থক্য এ জায়গায় – মানবতাবাদীরা নিজেদের কখনোই শুধু মানুষ ভাবতে পারেন না । ‘মানুষ’ বিশেষ্য পদের আগে তাঁদের বিশেষণ লাগিয়ে তাঁদের আলাদা ধর্ম, আলাদা জাতের পরিচয় ঘোষণা করতে হয়  কারণ নিজেদের শুধু মানুষ ভাবতে পারেন না, তাঁদের প্রধান পরিচয় তাঁরা  হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, খৃস্টান  ইত্যাদি ইত্যাদি সেজন্যে তাঁদের নামের আগে বা পরে পদবি লাগে । পদবি ছাড়া নিজের নাম প্রকাশ করেন  না ।  মানববাদীরা নিজেদের শুধু মানুষই ভাবেনতাই তাঁরা বাবা মায়ের দেওয়া পদবি ব্যবহার করা একান্ত আবশ্যক মনে করেন না, কেউ ব্যবহার করেন কেউ করেন না ।  তাঁরা নিজেদের সন্তানদের নামের সঙ্গে পদবি দেওয়াটাও জরুরী মনে করেন না, পারিবারিক সংকট না থাকলে পদবি বাদ দিয়েই নাম রাখেন ।   মানবতাবাদীরা যে কাজ করেন তার মহত্ত্বের কথা স্মরণে রেখে এবং তাঁদের কাজকে সম্মান জানিয়েই একটা কথা এখানে বলতে চাই যে, যে কোনো মানুষের পক্ষেই মানবতাবাদী  হওয়া সম্ভব, কিন্তু যে কোনো মানুষের পক্ষে মানববাদী হওয়া মোটেই সম্ভব নয় । একজন মানুষকে বা একজন মানবতাবাদীকে মানববাদী হতে হলে  তাঁকে সব আগে ধর্ম পরিচয়হীন মানুষ হতে হবে । অর্থাৎ তাঁকে হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, ইহুদি ইত্যাদি সকল ধর্মের ঊর্ধে উঠতে হবে । একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ থেকে তাঁকে ‘মানুষে’ উত্তরণ ঘটাতে হবে । এটা সম্ভব করতে হলে মানুষকে যুক্তিবাদী, বিবেকবান ও সাহসি হতে হবে । মানবতাবাদী এবং মানববাদীদের মধ্যেকার এই পার্থক্যগুলি আমরা অস্বীকার করতে পারি না, পারি না তাই মানবতাবাদী ও মানববাদীদের এক করে গুলিয়ে দিতে । মানবতাবাদীরা ও মানববাদীরা যেহেতু এক নয়, তাই মানবতাবাদ ও মানববাদও এক নয় । এভাবে বলা যেতে পারে যে মানববাদ হলো মানবতাবাদের উপরের এক ধাপ এবং সর্বোচ্চ ধাপ ।
মানবতা সম্পর্কে  মানবতাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজ
আমাদের চারিদিকে আর্ত, ক্ষুধার্ত, অনাশ্রিত, উৎপীড়িত মানুষের ভিড় । এই মানুষদের জন্যে কাজ করা সব চেয়ে বড়ো মানবিক কাজ যা মানবতাবাদীরা করেন নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে ।  ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকেই করেন ।  এ কাজ করার জন্যে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে । আমাদের দেশে যে সব প্রতিষ্ঠান এ কাজ ধারাবাহিকভাবে করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম হলো ‘ভারত সেবাশ্রম’ ও ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ রা হিন্দু ধর্ম ও ভাবাদর্শে বিশ্বাসী । আমরা দেখতে পাই বহু খৃস্টান মিশনারি  এ কাজ  অনলস করে যাচ্ছে । খৃস্টানরা এ কাজে বোধ হয় সব চেয়ে এগিয়ে, পৃথিবী জুড়ে তাঁরা কাজ করেন ।  মুসলিমদের পক্ষ থেকে এ কাজ হচ্ছে তেমনটা বিশেষ চোখে পড়ে না । বাধাটা আছে ইসলামের মধ্যে নীতিগতভাবেই । ইসলাম ধর্ম সব ধর্মের মানুষকে আপন করে নিতে শেখায় নাঅমুসলমানরা  অবিশ্বাসী এবং আল্লাহ ও ইসলামের শত্রু – এ হলো ইসলামের মূলনীতি ।  এ কথা থাক, আবার  মূল আলোচনায় -মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর কাজের কথায়  -  ফিরে আসি । মানবতাবাদী সংগঠনগুলো সারা বছর ধরেই অসহায় ও দুর্বল মানুষের  জন্যে কাজ করে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান দুটি কাজ হলো অল্প পয়সায় বা বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দেওয়া এবং  অনাথ শিশুদের আশ্রয় ও শিক্ষা দেওয়া ।  এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, মহামারীতে এঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন দুর্গত মানুষদের বাঁচিয়ে তুলতে । এ কাজ যখন এঁরা করেন তখন জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ ও লিঙ্গ বিচার করেন না,  ধর্মনিরপেক্ষ ও লিঙ্গনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেন । সবাইকে সমান চোখে দেখেন, সবার মাঝে সমান সেবা বিতরণ করেন । কিন্তু তাঁরাই আবার তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে, আচরণে ও সমাজ জীবনে উল্টো আদর্শ বিশ্বাস করেন ও উল্টো আচরণ করেন । হিন্দু হলে বর্ণপ্রথার ধারক ও বাহকের ভূমিকা পালন করেন । উচ্চ বর্ণ ও নিম্ন বর্ণের ছেলে মেয়েরা পরষ্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করলে তাদের উপর নির্মমভাবে কঠোর নির্যাতন চালান । তাঁরা নারীকে ঊনমানব মনে করেন মনে করেন স্বয়ং ঈশ্বরই নারীকে ঊনমানব বা উপমানব করে সৃষ্টি করেছে । তাই তাঁরা  নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা, স্বাধীনতা ও অধিকার দিতে অস্বীকার করেন । তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঈশ্বরের অভিশাপগ্রস্ত বলে হয় করুণা, না হয় ঘৃণা  করেন । একজন নারী ধর্ষিতা হওয়ার পর তাঁর গর্ভে সন্তান এলে তাঁকে মানব সন্তানের স্বীকৃতি না দিয়ে জারজ সন্তান এবং নিরাপরাধ ধর্ষিতা নারীকে ভ্রষ্টা নারী বলে তাদের গায়ে মিথ্যা কলঙ্কের কালি ছিটিয়ে সমাজ থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন । এরূপ বহুক্ষেত্রেই এই মানবতাবাদীরা নির্মমভাবে মানবতাকে হত্যা করেন । একদিকে জীবনভোর বৃহত্তর সমাজ জীবনে মানবতার পক্ষে কাজ করেন, আবার অন্যদিকে  ব্যক্তি জীবন ও ধর্মাশ্রিত সমাজ জীবনে মনাবতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন । এটা শুধু হিন্দু মানবতাবাদীদের ক্ষেত্রেই নয়, ঈশ্বরবিশ্বাসী সব ধর্মের   মানুষদের ক্ষেত্রেই এ কথা সমান প্রযোজ্য । উল্টোদিকে মানববাদীরা সর্বদায় মানবতা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন, এবং যখনই মানবতাকে হত্যা করার ঘটনা ঘটে তৎক্ষণাৎ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হন । মানবতাবাদী ও মানববাদিদের মধ্যে এই মৌলিক পার্থক্যকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না    মানবতাবাদী থেকে মানববাদী হওয়ার ক্ষেত্রে  ঈশ্বরবিশ্বাস ও  ঈশ্বরের বিধানই চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় ।
এখন প্রশ্ন হলো যাঁদের মনের মধ্যে জাতভেদ, বর্ণভেদ, লিঙ্গভেদ প্রকট তাঁরা মানবতার পক্ষে কীভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে পারেন ?  ঈশ্বরবিশ্বাসের মধ্যেই এর উত্তর নিহিত রয়েছে । খরা, বন্যা, তুফান, ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদি প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় কেনো ?   ঈশ্বর চায় তাই  । দুর্ভিক্ষ, মহামারী হয় কেনো ? ?   ঈশ্বর চায় তাই ।  এ রকম বিশ্বাস পোষণ করেন মানবতাবাদীগণ । মানুষের মধ্যে সীমাহীন দারিদ্র, বেকারি, ক্ষুধা, অনাহার, অপুষ্টি কেনো ? এর জন্যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ  ও শোষণভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই যে দায়ী তা তাঁরা বিশ্বাস করেন না, মানেন না । তাঁরা বলেন মানুষকে অশেষ দুঃখ-কষ্টে ফেলে   ঈশ্বর মানুষের ঈশ্বরভক্তির পরীক্ষা নেয়    তাঁরা এও বিশ্বাস করেন যে,   দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের  সেবা করলে পূণ্যলাভ হয় এবং পূণ্যবান লোকদের প্রতি ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে তাদের স্বর্গবাসী করে ।  তাঁরা  মানবতার পক্ষে তাই কাজ করেন  সেবার মনোভাব থেকে এবং অবশ্যই  স্বর্গলাভের আশায়মানবতাবাদীরা তাই সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে মানবতার পক্ষে কাজ করেন এ কথা বলা যায় না হিন্দু মানবতাবাদীরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন । তাঁরা  প্রচার করেন যে যারা অর্ধাহারে, অনাহারে, অমর্যাদায় মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা  পূর্ব জন্মের পাপের ফল ভোগ করছে  সেজন্যে  তাঁরা  ঐ সমস্ত মানুষদের উপদেশ দেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্যে যেনো পরের জন্মে আনন্দময় জীবন লাভ করতে পারে ।  এভাবে তাঁরা মানব সেবার কাজের আড়ালে তাঁদের  ধর্মবিশ্বাস প্রচার করেন এবং মানুষকে প্রতিবাদ বিমুখ করে রাখতে চেষ্টা করেন  কিছু মানবতাবাদী সংগঠন মানবতার পক্ষে কাজের আড়ালে  ধর্ম প্রচারের কাজ নয়,  ধর্ম বিস্তারের কাজও করেন ।  খৃস্টান মিশনারীরা যে এ কাজ করেন তা সংশয়াতীত । যে মানুষগুলোর মাঝে  তাঁরা খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি পরিষেবা পৌঁছে দেন তাঁদের কাছে তাঁরা নিরন্তর খৃস্ট ধর্মের প্রচারও করেন । বলেন  যীশুর স্মরণাপন্ন হও,  তাঁর কাছে প্রার্থনা করো, তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন   এভাবে গরীব মানুষদের মধ্যে তাঁরা ধর্মান্তরকরণের কাজ  করেন বিশ্বজুড়ে । মাদার টেরিজার কথাই ধরা যাক । তাঁর নাম আজ মানবতার প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত । মানব সেবা করা যেমন  মূল আদর্শ ছিলো ঠিকই, কিন্তু এ কথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, খৃস্টান ধর্মের প্রচার করা ও প্রসার ঘটানোও ছিলো  তাঁর একটা বড়ো লক্ষ্য ।
সমাজের বর্ণবৈষম্য ও  লিঙ্গবৈষম্য প্রথা ও ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতির জন্যে একদল অল্প সংখ্যক মানুষ মর্যাদা ও সম্পদের চূড়ায় অবস্থান করছে, আর একদল  ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অমর্যাদা ও দারিদ্রের শিকার । এই সত্যটা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানবতাবাদী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো সজ্ঞানে হোক  অজ্ঞানে হোক আড়াল করেন এবং  মানবতাবাদী সংগঠনগুলি এভাবে একদিকে  সমাজের প্রান্তিক মানবগোষ্ঠীর  স্বার্থে  কাজ করে মানবতার পতাকা ঊর্ধে তুলে ধরেন, আবার অন্যদিকে তারাই তাঁদের বিধিলিপি বলে মেনে নিতে উপদেশ দিয়ে ।  

মানবতা বনাম ধর্ম
ধর্ম (Religion) সম্পর্কে এশিয়া মহাদেশের মানুষ ভীষণ উচ্চ ধারণা পোষণ করেন । ধর্ম মানেই ধারণ করা, মানবজাতির জন্যে মঙ্গলময়  সব কিছুই  ধারণ করে ধর্ম । মানুষ বিশ্বাস করেন ধর্মের উদ্দেশ্যই হলো মানবজাতির কল্যাণ করা । ঈশ্বর যুগে যুগে দূত পাঠিয়েছে দিকভ্রষ্ট মানবজাতিকে  সুপথ প্রদর্শনের নিমিত্ত এবং মানবজাতির দুঃ-কষ্ট লাঘব করার জন্যে । ঈশ্বর নাকি মাঝে মাঝে নিজেই ধরাতলে এসেছে অবতার রূপে ওই একই উদ্দেশ্যে । এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ বিশ্বাস করেন যে মোজেস, যীশু ও মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত দূত এবং তাঁরা যে ধর্ম প্রবর্তন করেছেন তা ঈশ্বরের ধর্ম। মানুষ বিশ্বাস করেন যে রামায়নের কল্পিত চরিত্র রাম, মহাভারতের কৃষ্ণ ছিলেন স্বয়ং ভগবান । মানুষ বিশ্বাস করেন যে সাঁই বাবাও ভগবান, তিনি মানুষের রূপ ধরে মানুষের মাঝে মানুষের কল্যাণের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ।  কিন্তু ধর্মের বিধানগুলিই প্রমাণ করে যে ধর্ম সম্বন্ধে মানুষ যা বিশ্বাস করেন তা অতিশয় ভ্রান্ত । বরং এর বিপরীত কথাটাই সত্যি যে ধর্ম সামগ্রিকভাবে মানবজাতির অকল্যাণ বৈ কল্যাণ করে নি এ কথার সমর্থনে  এ বিষয়ে  সংক্ষেপে কিছু আলোচনা  রাখছি,  কারণ সময় খুবই খুবই সীমিত ।
মানবতা বনাম হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্ম মূলতঃ ব্রাহ্মণধর্মকেন্দ্রিক । মানুষের জন্ম রহস্যের কথা বলতে গিয়ে এই ধর্ম সমগ্র মানবজাতিকে চারটি বর্ণে বিভক্ত করেছে । তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন বর্ণ শুদ্রদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে এবং তাদের জন্যে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা চরম অবমাননাকর ও মানবতাবিরোধীতাদের সম্পূর্ণ মানব হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি । তাদের বেদ পাঠ ও স্বর্গবাসের অধিকার দেওয়া হয় নি।  শুদ্র পুত্র শম্বুক বেদ পাঠ করেছিলো বা স্বর্গে যাওয়ার সাধনা করেছিলো বলে ভগবান রাম তাকে নিষ্ঠুরের মতো নৃশংসভাবে হত্যা  করেছিলো । শুদ্রদের যে মানুষের স্বীকৃতি দিতে হিন্দু ধর্ম অপরাগ সে প্রসঙ্গে  বেদ-পুরাণ বিশেষজ্ঞ সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ধর্মকে প্রথম থেকেই কতকগুলো শ্রেণীস্বার্থে নিয়জিত করা হয়েছে । এটা তো সত্যি কথাই যে সমাজে বা শাস্ত্রে শুদ্র ব্রাহ্মণের মতো মানুষ ছিলো না পুরোপুরি। শুদ্র বা নারী বরাবরই শাস্ত্রে ঊনমানব, পুরো মানুষের অধিকার তাদের দেওয়া হয় নি বা মানুষ বলেও মনে করা হয়নি । কাজে কাজেই এই যে বিভাজন, যার দ্বারা একজন হীন আর একজন উচ্চ – এর উপরেই কিন্তু ধর্ম দাঁড়িয়েছিল । আদিম ধর্মের সংজ্ঞা এখান থেকেই তৈরী হয়েছিল । ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্রকে আলাদা করা, এবং শুদ্র নিপীড়নের অস্ত্র হচ্ছে সেই শাস্ত্রগুলো । আমাদের দেশে তো প্রাচীনকালে আইন ছিল না, শাস্ত্র ছিল । শাস্ত্রগুলোকে ধর্মশাস্ত্র বলা হয়েছে এবং পরবর্তীকালে কুড়িজন ধর্মশাস্ত্রকার কুড়িটি ধর্মশাস্ত্র রচনা করেন । এই কুড়িজনের মধ্যে ছোট ছোট কিছু ব্যাপার নিয়ে গণ্ডোগোল থাকলেও কতকগুলো বড় ব্যাপার নিয়ে একদমই গোলমাল নেই । সেগুলো হচ্ছে শুদ্র পুরো মানুষ নয়, নারী পুরো মানুষ নয় । এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই । কতটা ঊনমানব সেটা নিয়ে অর্থাৎ তার মাত্রা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু এই যে পুরো মানুষ নয় এ ব্যাপারে সবাই একমত, এবং ব্রাহ্মণই যে শ্রেষ্ঠ ও পূজনীয় এ বিষয়েও কোনো দ্বিমত নেই । এই জাতিভেদের ভিতের উপর ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে । এটা একটা স্তম্ভ ।” (দ্রঃ মন্থন, সুকুমারী ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠ – ৭৭) হিন্দু শাস্ত্রে শুদ্র ও নারী সমগোত্রীয়, নারীও ঊনমানব, নারীকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি ।  হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে নারী সম্পর্কে  যে সব উক্তি করা হয়েছে তা ভয়ঙ্কর রকমের অবমাননাকর  তার কয়েকটি এরূপ – “কন্যা অভিশাপ” (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬/৩/৭/১৩)  ... আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে পড়ি, “(নারী) ন হৃদয়েন প্রাথয়েৎ” (১/২৭৭/১-১০) অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে নারীকে প্রার্থনা করা উচিৎ নয়; কিন্তু যথেচ্ছ ভোগ করার কোনো বাধা নেই । “নারী মিথ্যাচারিণী, দুর্ভাগ্যস্বরূপিণী, সুরা বা দ্যুতক্রীড়ার মত একটি ব্যসনমাত্র ।” (মৈত্রায়ণী সঙ্ঘিতা ১/১০/১১; ৩/৬/৩) (সূত্রঃ ধর্ম ও নারীঃ প্রাচীন ভারত, কংকর সিংহ, পৃঃ ৬২) শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে কংকর সিংহ তাঁর উক্ত গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় আরো কয়েকটি অমৃত (!) বচনের উল্লেখ করেছেন যেগুলির কয়েকটি এ রকমঃ “নারী রাত্রে স্বামীকে মুগ্ধ করে তার ইষ্টসিদ্ধি করে নেয়ই” (কাঠকসংহিতা ৩১/৩) অর্থাৎ নারী ছলনাময়ী, স্বার্থপর; যেন পুরুষ উৎকৃষ্ট জীব, এসব দোষ তার নেই; একা নারীরই আছে । “সর্বগুণান্বিতা শ্রেষ্ঠ নারীও তাই অধমতম পুর‍্যষের থেকে হীন” । (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২) অনৃত অর্থাৎ মিথ্যা কি ? “স্ত্রী, শুদ্র, কুকুর, কালপাখি; এদের দেখো না; নইলে শ্রী ও পাপ, জ্যৌতি ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যে মিশে যাবে ।” (শতপথব্রাহ্মণ  ১৪/১/১/৩১)  স্ত্রী স্বামীর পরে খাবে (ঐ) কারণ, “ভুক্ত্বোচ্ছিষ্টংবধ্বৈ দদাৎ”, (খাদির গৃহ্যসূত্র ১/৪/১১) ... “কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো ও কুকুর হত্যা করলে যে প্রায়শ্চিত্ত, নারীহত্যা ও শুদ্রহত্যাতেও সেই একই প্রায়শ্চিত্ত” অর্থাৎ মাত্র একদি কৃচ্ছসাধন (১/৯/২৩, ৪৫)  নারীকে প্রহার করার অধিকারও পুরুষকে দিয়েছে হিন্দুধর্মশাস্ত্র । এ প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য এক জায়গায় লিখেছেন, “বেদে বলাই আছে, ‘নিজের দেহের বা ধনের ওপরে নারীর কোনোওধিকার নেই ।’ তাই বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, স্ত্রী স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে অসম্মত হলে তাকে প্রথমে মিষ্টি কথায়, পরে উপহারের লোভ দেখিয়ে কিনে নেবে’ (অবক্রীণীয়াৎ); তাতেও সে সম্মত না হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মারবে। (দ্রঃ মন্থন, পৃঃ ৯৭, ৯৮) এই উক্তিগুলি প্রমাণ করে হিন্দুধর্মশাস্ত্র নারী কতো নিকৃষ্ট জীব বলে বিবেচনা করেছে  
হিন্দুগণ যাঁকে ভগবান মানেন সেই রামচন্দ্রের মুখে শুনি  নারীবিরোধী শ্রবণ অযোগ্য তীব্র অরুচিকর ও অবমাননাকর উক্তি  যা রামায়ণের ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে । সীতাকে উদ্ধার করা পর তাঁর প্রতি ভগবান রামচন্দ্র যে ভাষায়  অপমান করেছেন তাকে নারীত্বের চরম অবমাননা বল্লেও কম বলা হয়, রামচন্দ্রের যে সব উক্তি করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য । রাম বলছেন সীতাকে, “তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে । আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই । তাই, জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে – তোমাকে আর আমার কনো প্রয়োজন নেই । কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে,  স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে ? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব ? যেজন্য যুদ্ধ জয় করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার অভিলাষ নেই, যেখানে খুশী চলে যাও তুমি; বুদ্ধিমান তোমাকে আমি বলছি, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও । তোমার মতো দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে, রাবণ নিজগৃহে খুব বেশীদিন চুপচাপ সহ্য করেনি । ”  (৬/১১৫/১৫-২৪) রামচন্দ্র সীতাকে আরো বলেছেন, “যাও বৈদেহি, তুমি মুক্ত । যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি । আমাকে স্বামী পেয়ে তুমি রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে যাবে এটা হয় না, তাই রাক্ষস (রাবণ) – কে হত্যা করেছি । আমার মতো ব্যক্তি ধর্ম ও অধর্মের ভেদ জেনেও পরহস্তাগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্ত ধারণ করবে ? তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, মৈথিলি তোমাকে আমি ভোগ করতে পারিনে, (তুমি) যেন কুকুরে চাটা ঘি ।”  (দ্রঃ- বাল্মিকীর রাম ফিরে দেখা, সুকুমারী ভট্টাচার্য, পৃ; ১০,১১)
মহাভারতেও নারীকে ঐ একই চোখে দেখা হয়েছে যে চোখে  বেদ, পুরাণ ও রামায়ন দেখেছে । দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা প্রমাণ করে যে নারী অস্থাবর বস্তু ও ভোগ্যপণ্য বৈ নয় । দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্বে দুর্যোধন ও দুঃশাসনদের নারীর শ্লীলতা নষ্ট করার জন্যে যে সমালচনা করা হয় তার চেয়ে ঢের সমালোচনা প্রাপ্য ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের । যুধিষ্ঠির যদি জুয়ায় দ্রোপদিকে না হারতো তবে দ্রোপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা ঘটতো না । দ্রৌপদীকে জুয়ায় বাজি রেখে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে দেয় যে নারী ঘরের সামগ্রী বৈ নয় যাকে যেমন খুশী ব্যবহার করা যায়, ভোগ করা যায়, আবার প্রয়োজন পড়লে জুয়ায় বাজি ধরা যায়, বিক্রি করাও যায়দুঃশাসন ও দুর্যোধনরা দ্রোপদীর বস্ত্রহরণ করতে চেয়ে যতো না দ্রোপদীর (নারীর)  শ্লীলতা নষ্ট করেছিলেন  তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী শ্লীলতা নষ্ট করেছিলেন  যুধিষ্ঠির ও তাঁর চার ভাই যৌথভাবে  না জেনে না বুঝে মা যে বিধান দিয়েছিলো তার প্রতিবাদ না করে তাঁরা পাঁচ ভাই মিলে দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছিলেন । ফল হয়েছিলো এই যে, দ্রোপদীকে জীবনভোর পালা করে সেই পাঁচ ভাইয়ের কাছে শরীর মেলে দিতে হতো তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে  এ ঘটনা তো  গণধর্ষণ সদৃশ ঘটনাই ।  গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলে এ যুগে সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি হয় সমাজে ।  গণধর্ষণকে চরম অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তার জন্যে চরম শাস্তির (মৃত্যুদণ্ড) বিধান রয়েছে বিভিন্ন দেশে, যেখানে নেই সেখানে এই শাস্তির দাবি ক্রমশঃ জোরালো হচ্ছে    অথচ মহাভারতের যুগে হিন্দু শাস্ত্রকারগণ নারীকে গণভোগ করা (গণধর্ষণ করা)  বিধিসম্মত বলে বিধান দিয়েছিলেন
বেদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারতের পরতে পরতে এ ছবি আমরা দেখি যেখানে নারী ও শুদ্র নামের আড়ালে গতরখাটা দরিদ্র মানুষদের উপর সীমাহীন শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের স্টীম রোলার চালানো হয়েছেশাস্ত্রের বুলডোজার দিয়ে তাদের সমস্ত মানবাধিকারগুলি গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছে । ‘ভগবান’ নামের অদৃশ্য ছুরি দিয়ে মানবতাকে পদে পদে হত্যা করা হয়েছে । 

মানবতা বনাম ইসলাম
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অতীব সুউচ্চ ধারণা পোষণ করেন মুসলমানরা । তাঁরা মনে করেন সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো ইসলাম । অমুসলিমদের মধ্যেও বহু মানুষ ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা  পোষণ করেন প্রধান ধারণাগুলো এ রকম - ইসলাম শান্তির ধর্ম, সম্প্রীতির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম ও ন্যায়ের ধর্ম; ইসলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতায়  বিশ্বাস করে; ইসলাম নারীকে মর্যাদা, অধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তি দিয়েছে; ইসলামের শান্তি, সম্প্রীতি ও সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ বিভিন্ন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং শান্তিপূর্ণ পথেই ইসলাম সারা বিশ্বে প্রসারিত হয়েছে । মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রায় গোটা বিশ্বজুড়েই মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলি আজ ভয়ঙ্কর হত্যালীলায় মত্ত ।  তথাপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমগণই বিশ্বাস করে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং  ইসলামে হিংসা বিদ্বেষ ও হত্যার কোনো স্থান নেই । যারা জিহাদের ময়দানে হত্যালীলায় মত্ত এবং যারা জিহাদ ও এই হত্যালীলাকে সমর্থন করে তাদের সংখ্যা খুবই কম । যারা  বিশ্বাস করে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হলো মুসলিম জঙ্গিরা যা করছে তা মোটেই ইসলাম সম্মত নয় এবং  তারা যা করছে তার ফলে  ইসলামের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে ।  তাদের  এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস   এ জন্যে নয় যে  ইসলাম সম্পর্কে তাদের ভালো জ্ঞান আছে । বরং উল্টোটাই সত্যি যে,  হয় ইসলাম সম্পর্কে তারা  অজ্ঞ, না হয় খুব কমই জ্ঞান আছে তাদের ।  অজ্ঞতা সত্ত্বেও ইসলাম নিশ্চিতরূপেই   শান্তির ধর্ম  এমন গভীর বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে প্রথিত হয়েছে কীভাবে –এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে । এর কারণ হলো, জ্ঞান হওয়া অবধি ইসলাম শান্তির ধর্ম এ প্রচার দিনরাত শুনতে শুনতেই তারা বড়ো হয়েছে । এ প্রচার শুধু মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু এবং  লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাই করেন না, গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারাই প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে জপ করার মতো ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ বলে  কোরাস গাইছেন । ইসলামি সন্ত্রাস দিন দিন যতো বাড়ছে ততোই সেই কোরাস যেনো আরো উচ্চগ্রামে উঠছে । কোরাসে শামিল যেমন মুসলিম দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানগণ, তেমনি শামিল অমুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানপণও ।  বাংলাদেশের সেখ হাসিনা, পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ, তুরস্কের এরোদগান তায়েপ প্রমুখ থেকে শুরু করে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বারাক ওবামা, যুক্তরাজ্যের ডেভিড ক্যামেরুন প্রমুখ পর্যন্ত  কে নেই  সেই কোরাসে    সকল রাষ্ট্রনেতা, ধর্মীয়নেতা, এবং লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা যদি তারস্বরে অবিরাম প্রচার করেন যে ‘ইসলাম মানেই শান্তি’ আর ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ তবে শুধু মুসলিমদের মধ্যেই  নয়, অমুসলিদের মধ্যেও  এই বিশ্বাস জন্মানো ও তা দৃঢ় হওয়া স্বাভাবিক যে ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং ইসলামে হিংসা ও হত্যার স্থান নেই । কথায় আছে না,  দশচক্রে ভগবান ভূত । তারপর গোয়েবলস-এর বিখ্যাত সূত্রের কথাও তো সকলের জানা – একটা মিথ্যাকে বারবার বলো, নিরন্তর বলো ।  বারবার শুনতে শুনতে এক সময় মানুষ মিথ্যাটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করবে ।
হ্যাঁ, গোয়েবলসের  সূত্রটাই এ ক্ষেত্রে কার্যকরী হয়েছে । ইসলাম সম্পর্কে যা  প্রতিনিয়ত প্রচার হয় এবং  বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা যেটাকে সত্য বলে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তা আদৌ সত্যি নয়। ইসলামের প্রধান দুটি ধর্মগ্রন্থ কোরান ও হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস এ কথা বলে না যে ইসলাম মানে শান্তির ধর্ম এবং  ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম কিংবা ইসলামে দ্বেষ, হিংসা ও হত্যার স্থান নেই । বলে না যে,  শান্তির বাণী প্রচার করে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার হয়েছে । বলে না যে,  ইসলাম সাম্য ও সম্প্রীতির ধর্ম । বলে না যে, ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে,  কিংবা নারীকে মুক্তি দিয়েছে । কোরান ও হাদিস এবং ইসলামের ইতিহাস বরং বলে যে,  ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতিতে নয়  হিংসায় বিশ্বাস করে, ইসলাম হলো নিশ্চিতরূপে  একটি জিহাদি (যুদ্ধবাজ) ধর্ম, একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী ধর্ম ইসলাম হলো চরম প্রতিশোধপরায়ণ ও  প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ম । ইসলামের সংবিধানে অমুসলিমদের প্রতি দয়া ও ক্ষমার স্থান নেই । ইসলামের সংবিধানে অমুসলিমদের জন্যে ন্যায় বিচারের কোনো জায়গা নেই । ইসলামে সবার জন্যে সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি নেই ।  এবং  ইসলাম হলো অবশ্যই আর পাঁচটা ধর্মের মতোই একপেশে পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম, ইসলাম নিশ্চিত রূপেই একটি তীব্র নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী ধর্ম ।  
ইসলাম ও সাম্য
মুসলিমরা বিশ্বাস করে ইসলাম সাম্যবাদী ধর্ম । অমুসলিমদের মধ্যে অনেকেই এমনটাই বিশ্বাস করেন। হ্যাঁ, বাহির থেকে দেখলে ইসলাম সম্পর্কে এরূপ ধারণা হওয়া অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হতে পারে । কারণ ইসলামে যে কোনো মুসলমানই ইমাম, মুফতি, মুয়াজ্জিন হতে পারেন । যে কোনো মুসলমান খলিফা কিংবা রাজা-বাদশা-সম্রাট হতে পারেন । এক্ষেত্রে ধনী ও গরীবের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হয় না । এই নিয়মের জন্যে এমন ধারণা হতেই পারে যে ইসলামের চোখে সব মানুষই সমানকিন্তু বাস্তবে ইসলাম ধর্ম ঠিক এর বিপরীত । হিন্দু শাস্ত্র মানবজাতিকে যেমন ভাগ করেছে, ইসলামও তেমনি  ভাগ করেছে । প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিরা মানবজাতিকে ভাগ করেছেন চারটি বর্ণে, অপরদিকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদও মানবজাতিকে  বিভক্ত করেছেন দু’ভাগে  চার বর্ণের মধ্যে শুদ্র বর্ণের মানুষদের মানুষ বলেই স্বীকৃতি দেন নি মুনি-ঋষিরাশুদ্রদের সমস্ত মানবাধিকার তাঁরা হরণ করে নিয়েছিলেন    এবং এমনকি উচ্চ বর্ণের মানুষদের হাতে তাদের হত্যা করার অধিকারও  দিয়ে গেছেন   ইসলামও দু’দলের মধ্যে একদল মানুষের সমস্ত মানবাধিকার হরণ করেছে এবং তাদের হত্যা করার অধিকার অন্যদের উপর ন্যস্ত করেছে । ইসলাম মানবজাতিকে শুধু দু’ভাগে ভাগই করে নি, তাদের একেবারে আড়াআড়িভাবে  ভাগ করেছে ।  অর্থাৎ পরষ্পর পরষ্পরের শত্রু এভাবে ভাগ করেছেন । ইসলাম মানবজাতিকে যে দু’দলে ভাগ করেছে  তাদের একদল বিশ্বাসী, আর একদল অবিশ্বাসী । যারা আল্লাহ ও মুহাম্মদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারা বিস্বাসী, যারা করে নি তারা অবিশ্বাসী । ইসলামের পরিভাষায় বিশ্বাসীরা মুসলমান বা মুমিন, আর অবিশ্বাসীরা কাফির বা মুশরিক । কাফির ছাড়াও একদল অবিশ্বাসী আছে । যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করার পর ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে কিংবা নিরীশ্বরবাদী হয় তারাও অবিশ্বাসী, তবে ইসলামের পরিভাষায় তারা  মুরতাদ বা মোরতাদ । ইসলামের সংবিধানে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা পরষ্পর শত্রু ।  অবিশ্বাসী তথা কাফিররা যে বিশ্বাসীদের শত্রু তা কোরানে বারবার ঘোষণা  করা হয়েছে ।  কোরানের এরূপ দু’টি ঘোষণা হলো – “‘ ... নিশ্চয় কাফেরগণ তোমাদের শত্রু ।’  [৪/১০১]  ‘‘যে আল্লাহর, ফিরিস্তাদের, রাসূলদের, জিব্রাইলের ও মিকাঈলের শত্রু হয়, [সে জানিয়া রাখুক] আল্লাহ কাফিরদের শত্রু ।’’ [ কোরান, সুরা বাকারা, ২/৯৮]   কোরান কাফিরিদের খোলাখুলি অন্যায়কারী ও অত্যাচারী বলেছে । কোরান বলছে, “হে মুমিনগণ! আমি যাহা দিয়েছি তাহা হইতে ব্যয় করো, ঐদিন আসার আগে যে দিন দরদস্তুর করা চলবে না, কোনো বন্ধুত্ব বা সুপারিশ টিকবে না । আর কাফিররা – তারাই তো মূলতঃ অন্যায়কারী, অত্যাচারী ।” (২/২৫৪)  কাফির তথা ইসলামের শত্রুদের প্রতি আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, তাদের বিতাড়ন করতে, তাদের হত্যা ও নির্মূল করতে । এ প্রসঙ্গে ইসলাম ঠিক কী বলেছে সে কথায় পরে আসছি । তার আগে দেখা যাক  মৃত্যুর পর তাদের কী পরিণতি কী হবে সে প্রসঙ্গে আল্লাহ কী বলেছে । আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে শেষ বিচারের দিনে তাদের কাজের মূল্যায়ন হবে না । তারা যতোই সৎ হোক, ন্যায়বান হোক, বিবেকবান হোক, উদার ও মানবদরদী হোক, তার কোনো মূল্য নেই ইসলামের চোখে । শেষ বিচারের দিনে সমস্ত মানুষকে দু’টো লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে । একটা লাইন হবে বিশ্বাসীদের আর একটা লাইন হবে অবিশ্বাসীদের । অবিশ্বাসীদের কোনো রিপোর্ট কার্ড দেখা হবে না । যেহেতু তারা কাফের তাই তাদের সরাসরি কোনো বিচার ব্যতীতই দোজখের (নরকে) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে । আল্লাহ বলেছে তাদের স্থান জাহান্নামে এবং তারা নরককুণ্ডের জ্বালানী । এ প্রসঙ্গে কোরান বলছে তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়া হবে দোযখে, “নিশ্চয় যাহারা আমার নিদর্শন সকলের বিরুদ্ধাচারী হইয়াছে, আমি অবশ্য তাহাদিগকে অনলে প্রবেশ করাইব, যখন তাহাদের চর্ম দগ্ধ হইবে তখন তাহার বিনিময়ে তাহাদিগকে অন্য চর্ম দিব, যেন তাহারা শাস্তির আস্বাদ প্রাপ্ত হয়; নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রান্ত নিপুন হন” [ কোরান, সুরা নিসা, ৪/৫৬]  আল্লাহ যেখানে কাফিরদের দোযখের জ্বালানি বলেছে, “তোমরা ও তোমাদের উপাস্যগুলি তো দোজখের জ্বালানী, সেখানেই তোমরা অবতরণকারী ।” [সুরা আম্বিয়া, ২১/৯৮]  ইসলাম কাফিরদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রচার করেছে । তাদের মানুষ নামের অযোগ্য বলেছে । বলেছে তারা নিকৃষ্ট জীব, জন্তুর মতো খায় । এ প্রসঙ্গে কোরানের ভাষ্য হলো – “কাফিররা ভোগে মগ্ন, জন্তুর মত খায়, তাদের আবাস জাহান্নামে ।”  [সুরা মুহাম্মদ, ৪৭/১২]  “যাহারা কুফরী করে ও ঈমান আনে না তাহারা নিকৃষ্ট জীব ।” [সুরা আনফাল, ৮/৫৫]   অমুসলিমরা যেহেতু  আল্লাহর শত্রু, সুতরাং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব  করার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইসলামের সংবিধানে  । কোরান বলছে, “হে মুমিনগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত  অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না, তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে ত্রুটি করে না । তোমরা কষ্টে থাক তাতেই তাদের আনন্দ । শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে ওঠে আর যা কিছু তাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে তা আরও অনেকগুণ বেশী জঘন্য । তোমাদের জন্য নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেওয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সামর্থ হও /১১৮  ইসলাম মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছে যদি তোমার মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন কেউ অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তবে জেনে রেখো সেও আল্লাহর শত্রু । সুতরাং তার সঙ্গেও তোমাকে সম্পরক ছিন্ন করতে হবে । এ ব্যাপারে কোরান যা বলেছে, “হে মুসলমানগণ!  তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না তোমাদের পিতা ভ্রাতাগণে, যদি তারা ভালবাসে কুফরিকে ঈমানের উপর; তোমাদের যারা তাদিগে অভিভাবক করে, তারাই জালিম (অত্যাচারী ) । /২৩  এই হলো ইসলামের তথাকথিত সাম্যের চেহারা ।
ইসলাম ও শান্তি
সকলেই মনে করে ইসলাম মানেই শান্তি । এটা সম্পূর্ণ ভুল । ইসলাম লামে আত্মসমর্পণ । সমর্পণ আল্লাহ তথা মুহাম্মদ তথা ইসলামের পদতলে । এই সমর্পণের রূপ খুবই বীভৎস । সে কথা পরে হবে। ইসলাম ও শান্তি প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক । যাঁরা ইসলাম শান্তির ধর্ম বলে প্রচার করেন তারা দাবি করেন যে ইসলাম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে । এই দাবির সমর্থনে তাঁরা কোরানের  কয়েকটি আয়াতকে রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরেন । সে রকম কয়েকটি আয়াত হলো - “ধর্ম সম্বন্ধে বল-প্রয়োগ নেই ।” ২/২৫৬  “তোমার দ্বীন (ধর্ম) তোমাদের, আমার দ্বীন আমার দ্বীন ।” ১০৯/৬   “তোমার (রসুল) কর্তব্য শুধু প্রচার করা, হিসাব-নিকাশ তো আমার কাজ ।”  ১৩/৪০  আল্লাহ্‌কে ছেড়ে যাদের তারা (অবিশ্বাসীরা) ডাকে, তাদের গালি দিও না ।  কেন না তারা সীমালঙ্ঘণ করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহ্‌কেও গালি দেয় ।  ৬/১০৮  যদি আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করতেন, তবে তারা শিরক করতো না, এবং তোমাকে তাদের জন্য রক্ষক  নিযুক্ত করিনি, এবং তুমি তাদের অভিভাবক নও ।” ৬/১০৭  এ রকম কিছু আয়াত আছে যা বার্তা দেয় যে ইসলাম শান্তি ও সহবস্থানের কথা বলে, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে । কিন্তু মুশকিল হলো ইসলাম শেষ পর্যন্ত এই নীতি বা অবস্থানে অটল ছিলো না । মুহাম্মদ এই নীতি ও আদর্শ রক্ষা করতে পারেন নি । তিনি এ পথ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেছিলেন । কোরানের আয়াতগুলিকে দুভাগে ভাগ করে আমাদের বিচার করতে হবে বা মূল্যায়ন করতে হবে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে । দু’ভাগের এক ভাগ হলো মুহাম্মদ যতদিন মক্কায় থেকে ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন সেটা একটা ভাগ, আর একটা ভাগ হলো মদিনায় থেকে যতদিন ইসলাম প্রচার করেছেন সেটা আর একটা ভাগ । মক্কা থাকাকালীন মুহাম্মদ যে আয়াতগুলি আবৃত্তি করেছিলেন সেগুলিকে বলা হয় মক্কী সুরা, আর মদিনায় থাকাকালীন যে আয়াতগুলি আবৃত্তি করেছিলেন সেগুলিকে বলে মাদিনী সুরা । মুহাম্মদ ১২/১৩ বছর (৬১০-৬২২) মক্কায় ধর্ম প্রচার করে মদিনায় চলে যান ৬২২ খৃস্টাব্দে । সেখানে মৃত্যু পর্যন্ত (৬৩০) পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেন । উপরের যে আয়াতগুলি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলি মক্কী সুরা । মদিনায় গিয়ে দেড়-দু’বছরের মধ্যেই মুহাম্মদ আমুল বদলে ফেলেন নিজেকে এবং ইসলামকেও । মদিনায় গিয়ে তিনি শান্তি ও সহবস্থানের পথ ও নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেন । তারপর যে পথ গ্রহণ করেন তা অশান্তির পথ, হিংসা-প্রতিহিংসা ও যুদ্ধ বা জিহাদের পথ । যে পথ, মত ও নীতিটাই হলো আসল ইসলাম ।  এই পথে শান্তি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান নেই । অমুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, তাদের প্রতি ক্ষমা, দয়া ও ন্যায়বিচার নেই । এই ইসলাম একবজ্ঞা নীতিতে বিশ্বাস করে, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার নীতিতে বিশ্বাস করে । এই ইসলাম শান্তির কথা বলে না, অমুসলিমদের বলে,  হয় আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণ করো, না হয় মরো, মাঝামাঝি কোন পথ নেই তোমাদের জন্যে । যাঁরা ইসলাম শান্তির ধর্ম বলে কোরানের কিছু আয়াতকে উদ্ধৃত করে তাঁরা মদিনা পর্বের ইসলাম ও কোরানকেও ভালো করে জানেন । কিন্তু তাঁরা সেটা আড়াল করেন । তাঁরা সজ্ঞানে, সচেতনভাবে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপকে চেপে গিয়ে মুহাম্মদ স্বয়ং যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিলেন সেই ইসলামকে সামনে তুলে ধরে বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে । তাঁরা আসলে মিথ্যাচার করেন, মানুষের সঙ্গে প;রতারণা করেন ।
আসল ইসলাম
ইসলামের দু’টি রূপ – একটি আধ্যাত্মিক ইসলাম ও অন্যটি রাজনৈতিক ইসলাম । রাজনৈতিক ইসলামকে বাদ দিলে ইসলামের কিছুই থাকে না । রাজনৈতিক ইসলামের লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা এবং সমস্ত মানবমণ্ডলীকে ইসলামের পদতলে নিয়ে আসা । আধ্যাত্মিক ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলাম পরষ্পরের পরিপূরক ।  আধ্যাত্মিক ইসলাম মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে ব্যবহার করে  রাজনৈতিক ইসলামকে পেছন থেকে উদ্বুদ্ধ করে ও উৎসাহ  জোগায়  । আধ্যাত্মিক ইসলাম আসলে রাজনৈতিক ইসলামের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ।
পৃথিবীতে অনেক ধর্মের আগমন ঘটেছে । তাদের অনেকগুলোই অবলুপ্ত, এখন রয়েছে মাত্র আঙুলে গোনা কয়েকটি । কিন্তু ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মের এরূপ দু’টো রূপ দেখা যায় না । অর্থাৎ আধ্যাত্মিক হিন্দু, রাজনৈতিক হিন্দু কিংবা আধ্যাত্মিক খৃস্টান ও রাজনৈতিক খৃস্টান কিংবা আধ্যাত্মিক ইহুদি বা রাজনৈতিক ইহুদি এরূপ হয় না । চার্চ প্রাচীন কালে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতো ঠিকই, কিন্তু বাইবেলে বলা হয় নি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সবাইকে জোর করে খৃস্টান করতে হবে । ইজরায়েল ইহুদি রাষ্ট্র বটে কিন্তু ইহুদি ধর্মও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার কথা বলে নি । নেপাল দীর্ঘদিন হিন্দু রাষ্ট্র ছিলো এবং ভারতে দীর্ঘদিন থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার কথা বলেনি । এক্ষেত্রে ইসলাম হচ্ছে একমাত্র ব্যতিক্রমী ধর্ম যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে প্রচার ও কাজ করে । তাই ইসলামের অঙ্গে দু’টি রূপ যার একটি হলো রাজনৈতিক ইসলাম এবং বলা বাহুল্য যে এটাই হলো ইসলামের আসল রূপ । ইসলাম ও মানবতার মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে তা জানতে হলে রাজনৈতিক ইসলামকে সব আগে জানতে হবে, খুব ভালো করে জানতে হবে । এখানে রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে বিস্তারিত আলচনা করার অবকাশ নেই । তাই সংক্ষেপেই এ বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই ।
রাজনৈতিক ইসলাম
মুহাম্মদ মক্কায় ৬১০ খৃস্টাব্দ থেকে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন । কিন্তু কতিপয় মানুষ ছাড়া মক্কা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ তাঁর কথা বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেন নি যে তিনি আল্লাহর প্রেরিত দূত এবং ইসলাম হলো আল্লাহর ধর্ম । তিনি তাই ৬২২ খৃস্টাব্দে মক্কা ত্যাগ করে মদিনা চলে যান । ১২/১৩ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি বোঝেন যে, শান্তিপূর্ণ পথে যীশু ও মোজেস হয়ে উঠতে পারবেন না এবং একেশ্বরবাদী খৃস্টান ও ইহুদী ধর্মের মতো ইসলামকে মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বলপ্রয়োগ করতে হবে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে । তিনি তাই মদিনা এসে শান্তিপূর্ণ পথ পরিত্যাগ করে সহিংস পথ অবলম্বন করেন । ইতিমধ্যে অল্প সংখ্যক লোক যাঁরা তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন তাঁদের কাছে একটার পর জিহাদ তথা যুদ্ধের আয়াত আবৃত্তি করতে শুরু করেন । ৬২৪ সালে মাত্র ৩১৩ জন শিষ্য নিয়ে তিনি প্রথম বড়ো যুদ্ধ করেন মক্কার কোরেশদের বিরুদ্ধে । সেই যুদ্ধটা বদর যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত । সেই যুদ্ধে আশ্চর্যজনকভাবে কোরেশদের ১০০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি জয় পান । তারপর তিনি একের পর এক যুদ্ধ করতে থাকেন বিধর্মী তথা কোরেশ, ইহুদি, খৃস্টান ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধের পথ ধরেই তিনি মাত্র আট বছরে ৬৩০ খৃস্টাব্দে মক্কা জয় ও দখল করেন । মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদের আকাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ হয়, তিনি স্থাপন করেন ইসলামি রাষ্ট্র । তার আগে অবশ্য একে একে ইহুদিদের সব কটা গোষ্ঠীকে তাড়িয়ে মদিনায় তিনি ইসলামি রাষ্ট্রে সূচনা করেছিলে । মক্কায় বিজয় হাসিল করার পরেই কেবল মক্কা ও আশেপাশের মানুষ  প্রাণের ভয়ে স্বধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন । ৬৩০ সালের পর যুদ্ধের পথেই আরো বহু অঞ্চল, রাজ্য, সাম্রাজ্য ইসলামের অধীনে আসে এবং সারা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে, গড়ে ওঠে কমবেশী অর্ধেক বিশ্বজুড়ে বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যপৃথিবীর বুকে এখন যে প্রায় ৫০টি যে ইসলামি বা মুসলিম রাষ্ট্র আছে তা কিন্তু এক সময় ছিলো সেই ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ।
সারা বিশ্বে এখন ৫০টিরও অধিক  মুসলিম জঙ্গি সংগঠন ( ইসলামি জিহাদি সংগঠন) কাজ করছে । তারা রাজনৈতিক ইসলামের পথ ধরেই বিভিন্ন অঞ্চলে জিহাদের কাজ করছে । কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠন তাদের কাজে সফলও হয়েছে । তালিবানরা আফগানিস্তানে সফল হয়েছিল, পরে আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেলস্কর-ই-তৈবা ও আরো কিছু জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তানে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার  লক্ষ্যে অবিচল থেকে একের পর এক জঙ্গি হানা ও নাশকতা চালিয়ে  যাচ্ছে  জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)  জিহাদে লিপ্ত রয়েছে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেনাইজিরিয়ায় মুসলিম জিহাদি সংগঠন  বোকো হারাম ও সেখানকার রাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ  চলছে । ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস ও সেখানকার দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে চলছে   ভয়ঙ্কর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ  । বোকো হারাম নাইজিরিয়ার একাংশ দখল করে ইসলামিক খেলাফত গঠন করেছে এবং আইএস ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করে গঠন করেছে ইসলামিক স্টেট তথা ইসলামিক খেলাফত ।
রাজনৈতিক ইসলামের মূল স্তম্ভ জিহাদ
৬২৪ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদের নেতৃত্বে বদর প্রান্তে যে জিহাদ শুরু হয়েছিলো মক্কার পৌত্তলিক কোরায়েশদের বিরুদ্ধে সেই জিহাদ তাঁর মৃত্যুর পর এগিয়ে নিয়ে যান তাঁর সাহাবীগণ যাঁদের মধ্যে আবুবকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি, আলী, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদ প্রমুখ খলিফাদের নাম উল্লেখযোগ্য । ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর জিহাদের সেই পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন আফগানিস্তানের মাটিতে। তাঁরাও সারা বিশ্বে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন এবং দেখাতেন । এখন  আইএস-এর খলিফা আবুবকর বাগদাদী সেই পতাকা বহন করছেন । তাঁরা কোরান ও মুহাম্মদ  অনুসৃত জিহাদের পথ ধরেই হাঁটছেন । যে জিহাদের পথে তাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করছেন সেই জিহাদের পক্ষে কোরানে প্রায় দু’শোটি আয়াত আছে । জিহাদ মানে অবিশ্বাসীদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করা, তাদের হত্যা করা,   লুট করা,   বন্দি করা, তাদের ক্রীতদাস বানানো,   নারী হলে তাদের ধর্ষণ করা ।  এসব বর্বর, পৈশাচিক ও অমানবিক কাজ করতে মুহাম্মদের শিষ্যরা প্রথম প্রথম সম্মত ছিলেন না । তাদের রাজী করাতে মুহাম্মদকে বারবার তাই ওহি আনতে হয়েছে । সে সব ওহিতে কখনও বলা হয়েছে আল্লাহ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আদেশ পাঠিয়েছে । কখনও বলা হয়েছে শত্রুরা আক্রমণ করলে তোমরা পাল্টা আক্রমণ করবে । কখনও বলা হয়েছে  মুসলমানদের জন্যে ইসলামের পথে যুদ্ধ করা আল্লাহ ফরজ (আবশ্যিক) করেছে । তারপরেও যখন  যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সমস্ত মুসলমানদের অনীহা দূর করা যায় নি কিংবা সকলের মধ্যে সমান উৎসাহ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় নি তখন তাদের মৃত্যুর পর দোযখের ভয় দেখানো হয়েছে কিংবা বেহেস্তের লোভ দেখানো হয়েছে । লোভ দেখানো হয়েছে স্বর্গীয় ৭২ টি হুরীকে ভোগ করার । শুধু পরকালের শাস্তির ভয়  বা পুরস্কারের প্রলোভনে কাজ হবে না বুঝে মুসলমানদের অতি লোভনীয় ও আকর্ষণীয় নগদ লাভের প্রলোভনও দেওয়া হয়েছে ।   এ সব কারণে মুহাম্মদকে মাঝে মাঝেই এবং বলা যায় ঘন ঘনই  জিহাদের  আয়াত আবৃত্তি করতে হয়েছিলো । ফলে জিহাদের আয়াতের চরিত্রগুলোও দেখা যায় ভিন্ন প্রকৃতির এবং কখনও সেই আয়াতগুলির মধ্যে স্ববিরোধিতাও পরিলক্ষিত হয় । জিহাদের প্রত্যেকটা আয়াতেরই ভিন্ন প্রেক্ষাপট রয়েছে । কিন্তু এখানে স্বল্প পরিসরে তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয় । তাই এখানে একই সঙ্গে পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্টযুক্ত আয়াতগুলি উদ্ধৃত করে দিলাম । আয়াতগুলি উদ্ধৃত করার আগে জিহাদ সম্পর্কে ইসলাম ও কোরান সম্পর্কে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ মাওলানাদের কয়েকজনের উক্তি শোনানো যাক । ওসামা বিন লাদেন ছিলেন ইসলাম বিষয়ে সুপণ্ডিত এবং ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ । জিহাদ সম্পর্কে তিনি কী বলেছেন তা শোনা যাক, “মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহর সংক্ষিপ্ত ভাষ্যঃ ‘আমরা তোমাদেরকে  অস্বীকার করি । এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অনন্তকাল ঘৃণা ও শত্রুতা বিরাজ করবে । সুতরাং মুসলিমদের অন্তরে অমুসলিমদের প্রতি একটা প্রচন্ড বিদ্বেষমূলক শত্রুতা রয়েছে । আর এ প্রচন্ড শত্রুতা বা  লড়াই নিবৃত্ত হবে যদি অবিশ্বাসীরা ইসলামের কর্তৃত্বের কাছে  নত হয়,  অথবা যদি তাদের শরীর থেকে রক্তঝরা বন্ধ হয়ে যায়, অথবা সে সময় যদি মুসলমানরা দুর্বল অথবা অসমর্থ হয়ে পড়ে  কিন্তু কোনো সময় যদি (মুসলমানদের) হৃদয় থেকে এ ঘৃণা অন্তর্হিত হয়,  তবে সেটা হবে স্বধর্ম ত্যাগের শামিল । অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে  নবীর উপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর বাণীর সত্যিকার মর্মকথা হচ্ছেঃ ‘ও নবী ! অবিশ্বাসী ও ভন্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; তাদের প্রতি নির্মম হও । তারা দুর্ভাগা, তাদের স্থান নরকে ।’ অতএব এটাই হচ্ছে অবিশ্বাসী   মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কের মূল ভিত্তি ।  অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে মুসলিম পরিচালিত যুদ্ধ, বিদ্বেষ ও ঘৃণাই  আমাদের  ধর্মের ভিত্তি । আমরা একে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার ও দয়া বলেই মনে করি ।” (সূত্রঃ জিহাদ/এম.এ.খান,  পৃ – ২,৩)   যাঁর নেতৃত্বে আফগানিস্তানে ইসলামি জিহাদ সফল হয়েছিলো সেই মোল্লা ওমর জিহাদ সম্পর্কে   কি বলেছেন তা এবার শোনা  যাক – “মনে রাখবে জিততে আমাদের হবেই হবে । তা না হলে  পৃথিবী থেকে  মুছে যাবে ইসলামের নাম । ইসলামকে প্রসারিত করতে হবে । ইসলামই হবে একদিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একমাত্র ধর্ম । আর এই ইসলামকে প্রসারিত করার জন্যে আমাদের নবী তার জীবিত অবস্থায় কম করেও তিরিশ অথবা চল্লিশবার যুদ্ধে অবতীর্ণ  হয়েছিলেন । তার একমাত্র ইচ্ছা রেখে মারা গেছেন । ... কী ইচ্ছা ছিলো জানো ?  সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ধর্মের বীজ রোপণ করা এবং পৃথিবী থেকে কাফের নির্মূল করা । অন্য কোন কিতাব পৃথিবীতে থাকবে না, কেবল কোরাণ ছাড়া । ... যারা কোরাণ ছাড়া অন্য কিতাব পড়ে তারা সত্য অস্বীকার করে,  তাদের বর্জন কর ।”  (সূত্রঃ মোল্লা ওমর তালিবান ও আমি, সুস্মিতা মুখার্জী, পৃ – ১০)    ইসলামের  শ্রেষ্ঠতম তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ পন্ডিত বলে মানা হয় ইমাম গাজ্জালিকে ।    গাজ্জালি বলেছেন,  প্রত্যেক মুসলিমকে বছরে অন্ততঃ একবার অবশ্যই জিহাদে যেতেই হবে ... দুর্গের ভিতর যদি নারী শিশুরা থাকে, তবুও তাদের  বিরুদ্ধে ভারী পাথর বা তীর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে (দ্রঃ জিহাদ, এম..খান, পৃ )   
এবার জিহাদের আয়াতগুলির উপর  একটু চোখ বোলানো  যাক । “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, কিন্তু সীমা লঙ্ঘণ করো না ।”  ২/১৯০, কেউ কেউ এটাকেই জিহাদের প্রথম আয়াত বলেছেন । এই আয়াতটিকে উদারপন্থী উলামা ও বুধিজীবীরা প্রমাণ হিসেবে দেখান যে ইসলাম আগ বাড়িয়ে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বা যুদ্ধের কথা বলে নি । কিন্তু জিহাদের উপর  আরো অনেক আয়াত আছে যেখানে বিনা প্ররোচনাতেই বিধর্মীদের উপর আক্রমণ করার কথা, তাদের প্রতি কঠোর হওয়ার কথা, তাদের হত্যা করার কথা বলা হয়েছে ।   সে রকম আয়াতগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো – ২/১৯১, ১৯৩, ২১৬-২১৮; ৪/৭৬;  ৮/১২,১৩, ৩৯;  ৯/২৮,২৯, ৩৬, ৪১,৭৩, ১২৩; ৬৬/৯; ৭১/২৬,২৭ ।  এই আয়াতগুলির দুটির ভাষ্য উল্লেখ করা যাক -     ৯/১২৩ আয়াতটিতে কোরান বলছে,  “হে বিশ্বাসীগণ ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখুক, জেনে রেখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গী ।”  ৯/৭৩ নং আয়াতটি বলছে – “হে নবী! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, তাদের প্রতি কঠর হও; তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম, তা কতো নিকৃষ্ট পরিণাম ।”  আল্লাহর অনুগ্রহের প্রলোভন দেখানো হয়েছে এই আয়াতে - “যারা বিশ্বাস করে ও আল্লার পথে স্বদেশ ত্যাগ (হিজরত) করে এবং  ধর্মযুদ্ধ  করে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশী ।” ২/২১৮  পাল্টা যুদ্ধ নয় ইসলামে জিহাদের কথা বলা হয়েছে যতক্ষণ না অবিশ্বাসীরা মাথা নত করে এবং স্বহস্তে জিজিয়া দিতে সম্মত নয় । সেটা এই আয়াতে আছে,  - “যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না, এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল যা বৈধ করেছেন, তা বৈধ জ্ঞান করে না, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, যে পর্যন্ত তারা অধীনতা স্বীকার করে স্বহস্তে জিজিয়া দান না করা” ৯/২৯  কোরান বলেছে যতদিন না সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় ততদিন জিহাদ করে যেতে হবে । এটা রয়েছে ৮/৩৯ নং আয়াতে -  “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, যতক্ষণ না অশান্তি দূর হয় ও আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।”   যুদ্ধে যেতে অনিচ্ছুক মুসলমানদের ভয় দেখানো  ৯/৩৯ নং আয়াতে  – “যদি তোমরা অভিযানে বের  না হও, তবে তিন তোমাদের যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি দেবেন ।” কোরান বলেছে জিহাদ ছাড়া বেহেস্ত পাওয়া যাবে না । ৯/১৬ নং আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে -    তোমরা কি ধারণা করেছ যে, তোমাদেরকে এভাবেই ছেড়ে দেওয়া হবে ? অথচ আল্লহ তো এখনও সেই সব লোককে (প্রকাশ্যভাবে) প্রকাশ করেন নি, যারা তোমাদের মধ্য হতে জেহাদ করেছে এবং আল্লাহ, তাঁর রাসুল   মুমিনগণ ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি ;আর আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কর্মের পূর্ণ খবর রাখেন শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না বলে জিহাদে আকৃষ্ট করার জন্যে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে ইসলাম । বলেছে যুদ্ধে গিয়ে যা লুট করবে তার পাঁচ ভাগের চার ভাগ তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে । যারা যুদ্ধে যাবে না তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে বলেই লুটের মালের ভাগ পাবে তা নয় ।  এ ভাগ বাটোয়ারার কথা আছে ৮/৪১ নং আয়াতে । শুধু লুট করা টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, বাড়ি-ঘর, বিষয়-সম্পত্তি নয়, লুটের সব মালের ভাগ দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয় । অর্থাৎ বন্দি নারী, পুরুষ ও বালক-বালিকা সবকিছুর ভাগ দিতে অঙ্গীকার করা হয়েছে জিহাদিদেরএবং বন্দি নারীদের ভোগ করার ঢালাও অনুমোদন দিয়েছে ইসলাম । এ প্রসঙ্গে ৮/৬৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে – “যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করেছো তা বৈধ ও উত্তম ভেবে ভোগ করো ।”  ‘যা লাভ করেছো’ মানে বন্দি নারী, শিশু ও পুরুষ সব কিছু । অনেক মুসলমানদেরই পরস্ত্রী বা পরনারীকে লুট করতে ও তাদের ভোগ করতে বিবেকের দিক থেকে সায় ছিল না । কোরান সেই উচ্চ মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে জিহাদের প্রয়োজনে । সুতরাং জিহাদ যে ইসলাম সম্মত এবং রাজনৈতিক ইসলামের মূল স্তম্ভ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংসয়ের অবকাশ নেই ।  

ইসলাম ও নৃশংশতা
প্রায় দেড় দু’দশক ধরেই মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলির সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সংবাদের শিরোনামে থাকছে ।    বিগত ৩/৪ বছরে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড   এক   ভয়ঙ্কর ও বীভৎস চেহারা   নিয়েছে । পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালিবান, নাইজিরিয়ার বোকো হারাম এবং ইরাক-সিরিয়ায় আইএস নৃশংসতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছেতেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) পেশওয়ারে ২০১৪-র ১৬ ডিসেম্বর একটি সেনা স্কুলে হামলা চালিয়ে প্রায় দেড়শ জন ছোট ছোট স্কুল ছাত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে । শিশুদের উপর এ রকম পৈশাচিক বর্বর হামলা ও একসঙ্গে এতো জনকে হত্যা করার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । নাইজিরিয়ায় বোকো হারাম কয়েক হাজার নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে ইসলামিক খিলাফত তথা ইসলামিক রাষ্ট্র স্থাপন করার আগে ও পরে    বিগত কয়েক বছরে । স্কুল ছাত্রীসহ  কয়েক শ’ নারীকে তারা বিভিন্ন দফায় অপহরণ করেছে ।   তাদের সকলের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে । ইতিমধ্যেই তাদের অনেককেই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে  বিক্রী  করে দিয়েছে,  অনেককেই   যৌনদাসী করে রেখেছে ।  ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস যে রূপ ভয়াবহ সন্ত্রাস চালাচ্ছে , যে ভয়াবহ গণহত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে এবং নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে তা  বর্ণনা করা  সাধ্যাতীত ব্যাপার । ইতিমধ্যেই ইয়াজিদি, ইহুদি, খৃস্টান ও শিয়া সমাজের হাজার হাজার মানুষকে তারা পশুর মতো হত্যা করেছে । শুধু একদিনে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের পাঁচ হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে । যারা ওই হামলায় বেঁচে গিয়েছিলো এমন পাঁচশো জনকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দিয়েছে । তাদের অপরাধ তারা ইয়াজিদি অর্থাৎ অবিশ্বাসী এবং স্বধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি । নতুন নতুন এলাকা দখল করার পর সেখানকার সমস্ত অবিশ্বাসী ও সুন্নিদের বন্দি করে তাদের শিবিরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে সমস্ত পুরুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হত্যা করছে । তারপর নারীদের একাংশকে  বণ্টন করে দিচ্ছে জিহাদিদের মধ্যে, একাংশকে বিক্রি করে দিচ্ছে বাজারে নিলাম ডেকে । যারা বিগত যৌবনা নারী যাদের কেনার খদ্দের জোটে না তাদের হত্যা করা হচ্ছে । যুবতী নারীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার চালানো হচ্ছে, গণধর্ষণ করা হচ্ছে । বন্দি নারীদের ধর্ষণ করা ইসলামে বৈধ ।  অবিশ্বাসী বন্দি নারীগণকে স্ত্রীরূপে ভোগ করা যে বৈধ সে কথা কোরান ঘোষণা করা হয়েছে, এটা একটু আগেই উল্লেখ করেছি ।  কোরানের ভাষায় বন্দি নারীরা গণিমতের মাল, তাঁরা মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয় নি । তাদের ধর্ষণ করাকে ন্যায়সঙ্গত বলে বিধান দেওয়া হয়েছে ৮/৬৯ নং আয়াতে । কিন্তু সেক্ষেত্রেও ইসলামি কিছু নিয়ম-নীতি আছে যা জঙ্গিরা লঙ্ঘন করছে বলে  আইএস সম্প্রতি একটা ফতোয়া জারি করেছে ।  সেই ফতোয়ায় জানানো হয়েছে বন্দি নারীদের কীভাবে ভোগ করলে তা বৈধ এবং কীভাবে করলে তা অবৈধ । আইএস কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্দীদের ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তলোয়ারের কোপে নৃশংসভাবে মুণ্ডুচ্ছেদ করছে । এই সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর ভিডিও করে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছে । উদ্দেশ্য হলো গোটা বিশ্বে ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা   এটা মানতেই হবে যে আইএস গোটা বিশ্বে সে আতংক সৃষ্টি করতে পেরেছে । প্রাণের ভয়ে নাইজিরিয়া এবং সিরিয়া ও ইরাক থেকে এক কোটির উপর মানুষ দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে চোরা পথে ঢুকে পড়তে বাধ্য হচ্ছে  অথবা ঢুকতে চাইছেন,   এখনও  কয়েক লক্ষ মানুষ আশ্রয় পাই নি, তাঁরা অনাহার ও অনিদ্রায় এক মানবেতর জীবন যাপন করছেন মাসের পর মাস সম্প্রতি হাড় হিম করা আরো একটি বর্বর ঘটনার খবর সামনে এসেছে । জিহাদে বা অসুখে জঙ্গিদের ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্যে জোর করে বন্দিদের  দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিচ্ছে । জিহাদের তহবিল গঠন করার জন্যেও বন্দিদের শরীরের অং-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করছে ।   বিশ্বযুদ্ধের সময় ছাড়া মানব সমাজে এতো বড়ো বিপর্যয় এসেছে বলে মনে হয় না । আক্ষরিক অর্থেই আইএসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন ।  পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে এ কথা এখন  অনায়াসে বলা যায় যে,   ইসলামি সন্ত্রাস  এই মুহূর্তে মানব সবভ্যতার কাছে সব চেয়ে বড়ো হুমকি হয়ে উঠেছে ।
স্বভাবতই মানুষের  মধ্যে আজ  এটা একটা বড়ো প্রশ্ন -  ইসলাম মানেই কি  সন্ত্রাস ?    ইসলাম মানেই কি নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা ? ইসলাম মানেই কি বর্বরতা ?   এর পরেও সমানে সেই প্রচার চলছে যে ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম এবং আইএস ও অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলি যা করছে তা ইসলাম সমর্থন করে নাতা হলে প্রশ্ন হলো,  কোনটা ঠিক ? মুসলিম জঙ্গি নেতারা বলছে তারা য করছে তা ইসলামের নির্দেশ ও নীতি মেনেই করেই করছে,   আর এর বিপররীতে  বলা হচ্ছে যে, ইসলাম এ ধরণের হিংসা ও নৃশংস  কাজ অনুমোদন করে না ।
মডারেট মুসলমান ধর্মগুরু ও মুসলমানরা এটাও বলেন যে ইসলামে যুদ্ধ, হিংসা ও হত্যার স্থান নেই । কিন্তু এ দাবি যে সর্বৈব অসত্য তা উপরে কোরানের অনেক আয়াত উদ্ধৃত করে আলোচনা করা হয়েছে। সেই আয়াতগুলিতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ করতে এবং অবিশ্বাসীদের হত্যা করার স্পষ্ট  নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । সুতরাং আইএস ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি যে গণহত্যা করছে, মুণ্ডূচ্ছেদ করে হত্যা করছে, তা ইসলাম সম্মত নয় এ কথা ধোপে টিকে না । আইএস যা করছে তা যে ইসলাম সম্মত তার প্রমাণ  ইসলামের ইতিহাসেও পাওয়া যায় । মুহাম্মদ নিজে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে । সেই যুদ্ধগুলিতেও মুসলিমরা মুহাম্মদের নেতৃত্বে ও নির্দেশে ব্যাপক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, এবং বিধর্মীদের বন্দি করে আনা হয়েছে যাদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিলো    বন্দি নারী ও শিশুদের মুহাম্মদ নিজ হাতে বণ্টন করে দিয়েছেন তাঁর সৈন্যদের মধ্যে । কখনও কখনও তিনি বন্দি নারী ও শিশুদের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন । মুহাম্মদ নিজেই বন্দি নারীদের মধ্যে থেকে  পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিজের হেফাজতে রেখেছেন । তাদের কাউকে দাসী করে রেখেছেন কাউকে কাউকে উপপত্নী করে রেখেছেন, কাউকে কাউকে আবার বিয়েও করেছেন । পুরুষ বন্দিদের কতককে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দিয়েছেন, অনেককেই আবার মুহাম্মদ হত্যা করার দণ্ড দিয়েছেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে  সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন । আইএস তরোয়াল দিয়ে যে মুণ্ডুচ্ছেদ করে বিশ্বের বুকে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে সেই মুণ্ডুচ্ছেদ করার সংস্কৃতি প্রবর্তন করেছিলেন মুহাম্মদ স্বয়ং । আইএস বিগত দু’বছরে যতো জনের মুণ্ডুচ্ছেদ করেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মুণ্ডুচ্ছেদ করিয়েছেন মুহাম্মদ নিজেই । ৬২৭ খৃস্টাব্দে মদিনায় মুহাম্মদের নির্দেশে একই দিনে  ৯০০ জন ইহুদি পুরুষের মুণ্ডুছেদ করা হয়েছিল প্রকাশ্যে । 
দু-চার-দশটা নয়, মানবতা ও মনুষ্যত্বকে এ রকম নৃশংসভাবেই  হত্যা করার শত শত ঘটনা  ইসলামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে ।  রয়েছে এটাই বাস্তব সত্য যে আইএস ও অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলি যা করছে তা ইসলামের নির্দেশ ও বিধি মেনেই করছে ।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দ্রুতহারে কমছে । কারণ মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের উপর নিরন্তর পৈশাচিক অত্যাচার ও পীড়ন চালাচ্ছে, তাদের হত্যা করছে, তাদের নারীদের ধর্ষণ করছে । ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে । এসব করা হচ্ছে বিধর্মীমুক্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ গঠন করার জন্যে ।  বাংলাদেশে এখন মুক্তমনা মানুষদের বলে বলে হত্যা করছে তাঁরা ধর্মের সমালচনা করে লিখতেন এবং  নাস্তিক বলে । যাঁরা নাস্তিক লেখকদের বই প্রকাশ করছেন তাঁদেরকেও হত্যা করা শুরু হয়েছে । অচিরেই আমরা হয়তো শুনবো যে নাস্তিক লেখকদের পাঠকদেরও হত্যা করা শুরু হয়েছে । বলা হচ্ছে মানবতাবিরোধী এসব হত্যাকাণ্ড  খুনি ও দুষ্কৃতিদের কাজ, এর সঙ্গে ইসলামের কোনো যোগ নেই বলে  ভয়ঙ্কর এই  সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে  লঘু করে দেখানো হচ্ছে   কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা যে উক্ত বর্বর ও অমানবিক ঘটনার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই । এ কথা আড়াল করা হচ্ছে যে মুসলিম দেশ থেকে অবিশ্বাসীদের বিতাড়িত করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন স্বয়ং মুহাম্মদ । এবং তিনি নিজেই মদিনা থেকে সমস্ত ইহুদিদের নির্মমভাবে নির্বাসিত করে অথবা সহস্রাধিক ইহুদিকে হত্যা করে মদিনাকে কাফের মুক্ত করেছিলেন । এ কথাও ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে নাস্তিকদের হত্যা করার বিধান ইসলামি আইনেই রয়েছে । এবং মুহাম্মদ স্বয়ং নিজই  নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন এবং তারপর সেই মৃত্যুদণ্ড নির্মমভাবে কার্যকর করার জন্যে নিজে দাঁডিয়ে থেকে তদারকি করছেন । মুক্ত মনে ও খোলা চোখে সমগ্র ইসলামি আইন ও ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে এটা দেখা যাবে যে  ইসলাম একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি ধর্ম বৈ নয় যেখানে দয়া-মায়া, সম্প্রীতি, সহবস্থান, বিবেক এবং  শব্দটি মানবতা, মনুষ্যত্ব শব্দগুলির অর্থহীন ।
ইসলাম ও নারী
আগেই বলেছি যে ইসলাম আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম । স্বভাবতই ইসলাম ধর্ম নারীকে সম্মান, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সমানাধিকার  দিতে ব্যর্থ হয়েছে । এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলার সময় নেই, আমার জন্যে বরাদ্দ সময় হয়তো ফুরিয়ে এসেছে, কিংবা হয়তো ইতিমধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে । তাই এ বিষয়ে গুটি কয়েক কথা বলবো । নারীকে মানুষের পরিচয় থেকে টেনে কীভাবে নীচে গণিমতের মালের স্তরে নামানো হয়েছে সে কথা  ইতিমধ্যেই  আলচনা করেছি । নারীকে গণিমতের মাল তকমা দিয়ে যথেচ্ছ ভোগ করা যে মানবতার চরম উল্লঙ্ঘন তা বলা বাহুল্যনারীকে অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়া তো দূরের কথা, প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারী যে অধিকার, স্বাধীনতা এবং সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতো তা নির্মমভাবে হরণ করে নিয়েছে ইসলাম । নারী যে প্রচুর স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ  করতো, নারী যে প্রচুর সম্মান ও সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিলো তার বোঝা যায় মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজার জীবনী পড়ে । প্রমাণ রয়েছে কোরানেও । কোরান বলেছে নারীকে ঘরের কোণে অবস্থান করতে হবে, সে সাজ-সজ্জা করে ঘরের বাইরে বেরোবে না । (৩৩/৩৩) আরবের মুক্ত নারীকে শুধু ঘরবন্দিই করেন নি মুহাম্মদ, নারীকে বোরখাবন্দিও করেছেন । আইন তৈরী করে ফতোয়া দিয়েছেন যে আকান্ত আবশ্যকতায় নারীকে যদি গৃহের বাইরে পা রাখতে হয় তবে একটা কাপড় দিয়ে তাকে মাথা ও মুখ (চোখ বাদ দিয়) ঢেকে রাখতে হবে এবং সঙ্গে একজন পুরুষ অভিভাবককে নিতে হবে । (কোরান ৩৩/৫৯)   কোরান ডিক্রি জারি করে নারীকে পুরুষ সমাজ থেকে আলাদা করে দিয়েছে এবং সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে । (৩৩/৫৩)  ইসলাম নারীকে পুরুষের সেবাদাসী বানিয়েছে । বলেছে নারী হলো শস্যক্ষেত্র, পুরুষ যখন খুশী সেখানে গমন করবে এবং যে কোনো পদ্ধতিতে ও যত খুশী তাকে ভোগ করবে । (২/২২৩) ইসলাম বলেছে নারী যদি স্বামীর যৌনক্ষুধা মেটাতে না চায় তবে স্বামী তাকে প্রহার করবে । (কোরান ৪/৩৪) এরূপ অসংখ্য নারীবিরোধী, নারীর মানবাধিকারবিরোধী ডিক্রি জারি করেছে ইসলাম । নারীর প্রশ্নে  ইসলাম অসংখ্য বিধান রচনা করেছে যে বিধাবনগুলিতে পদে পদে মানবতার উপর নির্মমভাবে চাবুক চালানো হয়েছে, এবং মানবতাকে ক্ষত-বিক্ষত, ছিন্নভিন্ন ও রক্তাক্ত করা হয়েছে 
ধর্মের সঙ্গে মানবতার অহি-নকুল সম্পর্ক
একটা কথা প্রবলভাবে শোনা যায় যে ধর্মের নামে যে সব মানবতাবিরোধী কাজকর্ম হয় তার জন্যে ধর্ম দায়ী নয়, দায়ী ধর্মান্ধ ও ধর্মীয় গোঁড়া মানুষরা এবং ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি ও সংগঠনগুলি । যাঁরা এই মতের পক্ষে তাঁরা বলেন ধর্ম ভালো ধর্মান্ধতা খারাপ, ধর্ম ভালো ধর্মীয় মৌলবাদ খারাপ, সুতরাং ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে ধর্মের বিরুদ্ধে নয়,  মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নয় । এ রকম কথা ও মতের কোনো মানে হয় না । এ সব কথা  বলে এই সত্যটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম ধর্মের গর্ভে, ধর্মই লালন-পালন ও পরিপুষ্ট করে ধরমান্ধ ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের  এবং ধর্ম থেকে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না । মূল কথা হলো এবং এটাই নির্মম সত্যি ঘটনা যে ধর্মের অস্তিত্ব ও প্রতিপত্তি  যেখানে বিরাজ করে সেখানেই মানবতা বিপন্ন হয় ধর্ম কোনোকালেই মানবতার পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি । ধর্ম ও মানবতা কখনোই সহাবস্থান করতে পারে না । যুগ যুগ ধরে মানবতা ও ধর্মের মধ্যে  বিরোধ, দ্বন্দ ও যুদ্ধ চলে আসছে । এর কারণ হলো ধর্মের বিধানগুলোই, কী সাধারণ মানুষের জন্যে, কী নারীর জন্যে, ভীষণ অমানবিক ও প্রচণ্ড মানবতাবিরোধী । ধর্মের আর কয়েকটি বৈশিষ্ট হলো - ধর্মে ভিন্ন মত, বহু মত ও  বিরুদ্ধ মতের স্থান নেই । সহিষ্ণুতা, উদারতা, মহানুভবতা ও বিবেকবোধের ঠাঁই নেই । অর্থাৎ ধর্মে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা,  মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তমন, মুক্তবিবেক এবং বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের জায়গা নেই । অথচ আমরা জানি যে, মানবতা রক্ষার্থে  সেই পরিবেশ জরুরী যে পরিবেশে মানুষ মানবতাবিরোধী প্রথা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আইন, সমস্ত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবে । আর তারজন্যে  চাই পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক  অধিকার, বাক-স্বাধীনতার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার যা ঈশ্বরকেন্দ্রিক কোনো ধর্মে নেই ।     তাই পৃথিবীতে যতদিন ধর্ম টিকে থাকবে ততদিন মানবতার উপর আক্রমণ থাকবে ।  তাই এই সত্যিটা আমাদের উপলব্ধির মধ্যে আনতেই হবে যে মানবতাকে রক্ষা করতে হলে, মানবতার বিকাশ করতে হলে, মানবতাকে আরো উন্নত স্তরে উন্নীত করতে হলে ধর্মের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে, ধর্মের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করতে হবে, ধর্মমুক্ত পৃথিবী গড়তে হবে এবং কুসংস্কার-সংস্কার মুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্ব সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে । 
মানবতা বনাম রাষ্ট্র
যে কথাটা না বললে আলোচনার বৃত্তটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হলো রাষ্ট্র হলো  মানবতার সব চেয়ে বড়ো শত্রু ।  যেহেতু আলচনা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই, তাই দু’একটি কথা বলে শেষ করবো । রাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা প্রবাদ বাক্যের মতো একটা কথা শুনি – Government (State) is of  the people, by the people and for the people.  এ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা । এর চেয়ে মিথ্যে বোধ হয় আর হয় না । এ হলো মিথ্য কত কুৎসিত হতে পারে এটা তার একটা বড়ো উপমা । সরকার হলো রাষ্ট্রের অঙ্গ আর রাষ্ট্র কোনো ভাবেই নিরপেক্ষ হতে পারে না এবং সর্ব সাধারণের হতে পারে না । মানব সমাজ যেহেতু শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়, তাই রাষ্ট্র্ও শ্রেণী নিরপেক্ষ থাকতে পারে না । কোনো না কোনো শ্রেণীর (অবশ্যই শোষক শ্রেণীর) দ্বারা পরিচালিত হয়, শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হয় । ক্রীতদাস প্রথার যুগে দাস মালিকদের স্বার্থে পরিচালিত হতো, সামন্ততন্ত্রের যুগে সামন্তশ্রেণীর স্বার্থে চালিত হতো, এখন পুঁজিবাদী যুগে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হয় । এখন রাষ্ট্রের মূল নীতি হল পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা । তাই যত দিন যায় ধনী ও গরীবের বৈষম্য বাড়ে, ধনী আরো আরো ধনী হয় এবং গরীব আরো আরো নিঃস্ব হয় । তাই চা বাগানের শ্রমিকরা প্রতিদিন মরে, মরে অরণ্যবাসীরা, পাহাড়বাসীরা, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা । মরে অনাহারে, অপুষ্টিতে, অচিকিৎসায় । তাই মাঝে দুর্ভিক্ষ হয়, মহামারী হয়, গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যায় একদিকে, আর একদিকে ধনীদের সম্পদের পাহাড়গুলো ক্রমশঃ উঁচু হতে থাকেপুঁজিপতিদের স্বার্থেই রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ করে, রাষ্ট্র রাষ্ট্রে যুদ্ধ হয়, বিশ্বযুদ্ধ হয় । তাতে যুদ্ধের ময়দানে সাধারণ ঘরের মানুষগুলো পরষ্পরকে মারে ও মরে এবং যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমুল্য আকাশ ছুঁলে সাধারণ মানুষ খেতে না পেয়ে মরে । শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ যখন প্রতিবাদে রাস্তায় নামে তখন রাষ্ট্র সেই প্রতিবাদী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা কত্রে তাদের প্রতিবাদ কঠোর হাতে দমন করে ।  কোনো সরকারের অধীনে তাই গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে না । বুর্জোয়া রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কখনো মানুষকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দেয় না । যেখানে সম্পূর্ণ গণতন্ত্র নেই সেখানে মানবতা সুরক্ষিত থাকতে পারে না । তাই মানবতা ও রাষ্ট্র কখনোই হাত ধরাধরি করে চলে না, চলতে পারে না ।












KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...