Thursday, June 16, 2016

হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের পেছনে রয়েছে গভীর হিন্দুত্ববাদী ঘৃণ্য রাজনীতি




অবশেষ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। অবসান ঘটালেন আরএসএস-এর পোস্টার বয় মোদিজি। হ্যাঁ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু রিফিউজিদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানের কথা বলছি। ১৯৭১ সালের পর যারা ভারতে এসেছেন ইসলামি ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বলি হয়ে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার পথে যে কাঁটা ছিলো সেটা মোদিজি সরিয়ে দিলেন তারা এবার ভারতের নাগরিকত্ব পাবেনএই সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ ছিলো না, যদিও বিজেপি বরাবরই হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবীকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। অটল বিহারী বাজপেয়ীজি দু’ দু’বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেনতবুও পারেন নি। অবশ্য তাঁর সরকারে বিজেপির একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না। থাকলেই যে পারতেন তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ  তিনি ছিলেন নরম হিন্দুত্ববাদী নেতা। মোদিজি পারলেন শুধু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নয়, পারলেন একজন কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা বলে। মোদিজির সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমি সমর্থন জানাই। কেনো তা বলছি পরে। তার পূর্বে  দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে নিতে চাই যে মোদিজির নেওয়া এই সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন জানালেও  তাঁর প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করতে পারছি না। কারণ কোনো মানবতাবোধ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদারতা দেখান নি। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন তা খুবই সংকীর্ণ, নিকৃষ্ট ও মানবতাবিরোধী যার জন্যে তাঁর প্রতি তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার  বর্ষণ করা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কী সেই বদ উদ্দেশ্য তা নিয়ে আলোচনা করবো পরে, তার আগে কেনো হিন্দু স্মরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি সেটা আগে বলে নিই।   
আমি নিশ্চিত যে হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যে ভারতের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনেকটাই বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।  এবং মোদিজি যে একটি ভয়ঙ্কর কুমতলব দ্বারা চালিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে বিষয়েও আমি সম্পূর্ণ সচেতন। এতদসত্ত্বেও সিদ্ধান্তটিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন জানাচ্ছি।  জানাচ্ছি  কারণ,  প্রথমতঃ আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের দেশে যে বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা সমবেত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব।  দ্বিতীয়তঃ দেশ ভাগের  কারণে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে(?) যে লক্ষ লক্ষ মানুষগুলো  কয়েক দশক ধরে উদ্বাতু হয়ে এদেশে পরগাছার মতো বসবাস করছেন তাঁরা নিজের একটা দেশ, নিজের একটু  মাটি পাবেন, বৈধ নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার পাবেন এই অধিকার পাওয়া তো ছিন্নমূল ও উদ্বাস্ত মানুষদের জীবনে সর্ব্বোচ্চ  পাওয়া। তাঁদের এই সর্ব্বোচ্চ প্রাপ্তিকে  সমর্থন জানাতে যদি আমি কুণ্ঠিত হই তবে নিজেকে কোন মুখে মানুষ বলে দাবি করবো? এক টুকরো পরিচয় পত্র, একটা রেশন কার্ড, একটু পানীয় জল, একটু বিদ্যুতের আলো, আপন সন্তানসন্ততির জন্মের শংসাপত্র, তাদের স্কুলে ভর্তি-সহ আরো কতো প্রকার দৈনন্দিন প্রয়োজনে  লক্ষ লক্ষ এই স্মরণার্থীরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের দ্বারে দ্বারে  ধর্ণা  দিয়ে আসছেন। নেতানেত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিরন্তর একটু করুণা ভিক্ষা করে চলেছেন। এ কি শুধু তাদের লজ্জা? এ তো মানবতার লজ্জা! এই লজ্জার হাত থেকে তাঁরা নিষ্কৃতি  পেতে চলেছেন।  তাঁদের এই মহাপ্রাপ্তিকে যদি সরবে স্বাগত জানাতে না পারি তাহলে  আমার মানুষ পরিচয়টাই বৃথা।
এই অসহায় মানুষগুলো ইসলামী সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচতে নিজের দেশ, নিজের ভিটে-মাটি, জমি-জায়গা, ব্যবস্যাবাণিজ্য সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে নিঃস্ব হাতে ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কী তাদের অপরাধ ছিলো? একটাই অপরাধ তাদের, তারা হিন্দুতাই তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে চিরতরে, এবং তাদের নিজের দেশে, নিজের ভিটেয় ফেরার রাস্তা তাঁদের চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।ঘরে ফেরার রাস্তা চিরদিনের জন্যে বন্ধ বলেই তারা ভারতের নাগরিকত্বের দাবিতে  আন্দোলন করে আসছেন বহুদিন ধরেহ্যাঁ, তাদের এ দাবি করার অধিকার আছে বৈকিতাদের পূর্বপুরুষরা তো ভারতেরই নাগরিক ছিলেন। নিজেদের দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দেশটাকে দু’টুকরো করেছিলো বলেই তো তাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছেএতে তাদের অপরাধ কোথায়? তারা পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিলো সেটা কি তাদের অপরাধ? কিন্তু তারা তো ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলেই মেনে নিয়েছিল।  তারা তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবং কাতারে কাতারে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল কিন্তু মুশকিল হলো  কী পাকিস্তান,  কী বাংলাদেশ, কোনো একটি রাষ্ট্রও তাদের দেশের নাগরিক  হিসেবে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি, আজো পারছে না। ফলে মুসলিম মৌলবাদীরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, এবং বলছে যে, এটা মুসলিমদের দেশ, এ দেশে থাকতে হলে মুসলমান হতে হবে, নইলে এ দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। যখন তারা এ কথা বলে  তখন কোনো  রাষ্ট্রই  তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে তৎপর হয় নাফলতঃ মুসলিম মৌলবাদীরা সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিকভাবে বীভৎস অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে সাহস পায়। আর সে কী অত্যাচার ও নিপীড়ন! অত্যাচার মানে বাড়িঘর এবং মন্দির-গীর্জা-বৌদ্ধমঠ জ্বালিয়ে দেওয়া, জমিজায়গা ও দোকানপাট দখল করে নেওয়া, নারীদের ধর্ষণ করা, পুরুষদের হত্যা করা, ইত্যাদি। অর্থাৎ অত্যাচারের মাধ্যমে  সংখ্যালঘুদের  প্রতি একটা বার্তা দেওয়া যে, হয় দেশ ছাড়ো, না হয় মুসলমান হও। এহেন পরিস্থিতিতে তারা কী করবে? তাই দলে দলে তারা ভারতে চলে আসছে। কী বিপুল সংখ্যায় হিন্দুরা এ দেশে পালিয়ে আসছে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান দেওয়া হলো নীচের সারণীতে যা দেখলে সকলের গায়ে কাঁটা দেবে, অবশ্য যদি তাদের মানবিক বোধ থাকে এই তথ্য থেকে খানিকটা আমরা খানিকটা অনুমান করতে পারি যে সংখ্যালঘুদের উপর কীরূপ অত্যাচার করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, তারা ভারত ছাড়া কোথায় যাবে? ভারত ছাড়া তাদের আশ্রয়স্থল আর কোথায় আছে? ভারত যে তাদের বাপ-ঠাকুর্দার দেশ। আর নিজের ভিটেয় ফেরার রাস্তা যেহেতু চিরতরে বন্ধ হয়ে রয়েছে, এ অবস্থায় তারা ভারতের নাগরিকত্ব চাইবে না তো কী শুধু রিলিফ চাইবে? তারা তো নাগরিকত্বই চাইবে। এটাই তো স্বাভাবিক। তাইতো এই ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোর নাগরিকত্বের দাবীকে আমার কখনো অযৌক্তিক ও অন্যায্য বলে মনে হয় না। 
১৯৫১ সাল থেকে হিন্দুরা কী হারে দেশ ছেড়ে ভারতে এসেছে তার তথ্য ও পরিসংখ্যান নিম্নরূপ:                                         
                                    
                                                                    সারণী
জনগণনার রিপোর্ট শতাংশে
সম্প্রদায় ----১৯৫১ -  ১৯৬১  -  ১৯৭৪  -  ১৯৮১  -  ১৯৯১   -  ২০০১  -  ২০১১
মুসলিম  -    ৭৬.৯ –   ৮০.৪ -   ৮৫.৪  -   ৮৬.৭  -  ৮৮.৩  -   ৮৯.৭  -  ৯০.৪
 হিন্দু     -     ২২.০  -   ১৮.৫ -  ১৩.৫  -   ১২.১   -  ১০.৫  -    ৯.২   -   ৮.৫
সূত্রঃ প্রথম আলো, ২২.০৯.২০১২ (বিঃদ্রঃ বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় কাগজ হলো এই পত্রিকাটি)
সূত্রটি বলেছে দশ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখি যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, বাংলাদেশের সর্বত্রই কিন্তু সমহারে হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে না। জনগণনার রিপোর্ট থেকে এই তথ্যটি উঠে এসেছে।  রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, দশ বছরে (২০০১ থেকে ২০১১) ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে, সব জেলায় নয়সে কথা থাক, এখন প্রশ্ন হলো হলো, দশ বছরে যে ৯ লক্ষা হিন্দু কমে গেলো, তারা কোথায় গেছে? সরকার ‘মিসিং পপুলেশন’ আখ্যা দিয়ে বলছে যে, দেশের মধ্যে অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু প্রথম আলো বলছে, “হিন্দুরা দেশের অন্য কোথাও চলে গেছে সে কথা কিন্তু য়পরিসংখ্যান বলছে না।” পত্রিকাটি সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছে যে, “অন্য জেলায়ও হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ে নি।” আসল কথা হলো সরকার খুব ভালো করেই জানে যে ‘মিসিং পপুলেশন’ ভারতে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ সরকারের সংখ্যালঘুদের  নিরাপত্তা  দেওয়ার সদিচ্ছার কতো অভাব।
যে দেশে রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে চাই না, এবং বিশেষ করে সে দেশটি যদি মুসলিম দেশ হয় তবে সে দেশ সংখ্যালঘুদের  বাসযোগ্য থাকতে পারে না। এই নির্মম বাস্তব পরিস্থিতি এ দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি বুঝতে চাই না।  চাই না বলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্বের দাবীকে বারবার অন্যায্য ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের দুঃসহ যন্ত্রণা ও কষ্টগুলি সাধারণ পররাষ্ট্রনীতির মানদণ্ডে যান্ত্রিকভাবে বিচার-বিবেচনা  করেছেন, মানবিক দৃষ্টিতে কখনই বিচার করেন নি আমাদের পূর্ব পুরুষরা দেশ ভাগ করে যে অন্যায় করে গেছেন যার ফলে আজ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে আজ চরম বিপন্ন,  তাদের রক্ষা করার দায় যে আমাদের এই প্রজন্মের উপরেই বর্তেছে সে কথা কষ্মিনকালেও তাঁদের মস্তিষ্কে উদয় হয় নি। বরং এই ভাবনাটাকেই তাঁরা বড়ো করে দেখেছেন যে, নাগরিকত্ব দিলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে (যেনো এখন খুব ভালো সম্পর্ক আছে!), ভারতের মুসলিম মৌলবাদীরা রুষ্ট হবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে  সংখ্যালঘুরা হু হু করে চলে  আসবে এবং তার ফলে সরকারের উপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপবে। রাষ্ট্রনায়কদের এই ভাবনা কতোখানি বাস্তব সম্মত তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ বাংলাদেশের তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে যে, সেদেশে সর্বত্র সংখ্যালঘুদের উপর সমান অত্যাচার হয় না, ফলে সব জেলাতেই হিন্দু জনসংখ্যা  হ্রাস পায় নি। সে বিতর্ক থাক হিন্দুরা সবাই হু হু করে  চলে  আসবে বলে যে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় নি তাতে কি এ দেশে হিন্দুদের আসার স্রোত বন্ধ হয়েছে?  উপরের তথ্যটি বলছে, হয় নি। এবং যারা চলে এসেছে তারা ফিরে যায় নি, এতে কি সরকারকে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ বইতে হচ্ছে না? আসলে দূরদর্শিতা ও মানবিক বোধের অভাবে লাগামহীন সন্ত্রাস থেকে মানপ্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা বিপন্ন মানুষগুলোকে রক্ষা করার  দায়িত্বই নিতে চাই নি  কংগ্রেসী ও অকংগ্রেসী সরকারগুলি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। এই ইস্যুটি নিয়ে বিজেপি একটু একটু করে  জমি তৈরী করেছে। সেই জমিতে মোদিজি এসে সপাটে হিন্দুত্বের ব্যাট চালাতে দ্বিধা করেন নি মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার  ধ্বজাধারীরা তখন চেয়ে চেয়ে শুধু দেখলেন। পাছে হিন্দুভোট আরো ক্ষয় হয় সেই ভয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে সাহস করলেন না। 
হিন্দু স্মরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন ও স্বাগত জানালেও কেনো মোদিজির প্রতি আমি নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি  সে প্রসঙ্গে আসি।  কথাগুলি বরং মোদিজিকেই সরাসরি বলি।
শ্রদ্ধেয় মোদিজি, 
আপনি ভালো করেই জানেন যে আপনি ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ  রাষ্ট্রের  প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে, সেই পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে শুধু হিন্দুদের জন্যে কোনো কাজ  করতে পারেন না, আপনাকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যেই কাজ করতে হবে  যদি শুধু হিন্দুদের জন্যেই করেন তা অবশ্যই গণ্য হবে একটি গুরুতর ত্রুটি ও অন্যায় হিসেবে। অথচ সেই ত্রুটি ও অন্যায় কাজটিই  আপনি করে বসলেন প্রধানত হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। মুসলিম বাদে অন্য সংখ্যালঘুরা যেমন বৌদ্ধ, খৃষ্টান, প্রভৃতি যারা ভারতে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাদেরও  নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেটা কোনো মানবিক মূল্যবোধ থেকে নয়, সেটা বিজেপির ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্য। আমরা জানি  আপনি একজন কট্টর ও গোঁড়া হিন্দু।  সে আপনি হতেই পারেন, কিন্তু আপনি যেটা পারেন না তা হলো, একজন হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতবর্ষকে পরিচালনা করতে, কারণ ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, হিন্দুরাষ্ট্র নয় এ বিষয়ে আপনি যথেষ্ট বিজ্ঞ মানুষ, তথাপি  হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেশটা চালাবার চেষ্টা করছেন যেমন করেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। মনে পড়ে মোদিজি সেদিনকার কথা যেদিন আপনার নেতা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়েজি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজধর্ম পালন করতে, হিন্দুনেতার ধর্ম পালন না করতে।  আপনি তখন তাঁর পরামর্শ  মেনে মুসলিম নিধন যজ্ঞ থেকে অসহায় মুসলিমদের  বাঁচাবার চেষ্টা করেন নি,  উল্টে মদতই দিয়েছিলেনসেই আপনি মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন,  তবু  একটুও পাল্টান নি, যেমন ছিলেন তেমনই  রয়ে গেছেন, ছিলেন হিন্দু মুখুমন্ত্রী এখন হয়েছেন হিন্দু প্রধানমন্ত্রীপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বলেছিলেন, হিন্দুত্বের রথে বসবেন না, বিকাশের রথে বসতে চান। কিন্তু  সে সব যে ভাঁওতা ছিলো  তা স্পষ্ট করে দিলেন শুধু বাছাই করে স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। আপনি তো যথেষ্ট ওয়াকিবহল এ বিষয়ে যে, বাংলাদেশ ও  পাকিস্তানে শুধু হিন্দুরাই ইসলামি সন্ত্রাসে অত্যাচারে লুণ্ঠিত, ধর্ষিত, আহত-নিহত ও  নির্বাসিত হচ্ছেন না। অন্য সংখ্যালঘুরাও হচ্ছেন, এবং  যারা  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের দাবীতে সরব  সেই মুক্তমনা লেখক ও ব্লগাররাও অত্যাচারিত হচ্ছেন, খুনও হচ্ছেন তাই শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যেই নয়, মুক্তমনা লেখক ও নাস্তিক ব্লগারদের জন্যেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বধ্যভূমি। ফলে তাঁরা দেশ ছেড়েছেন অনেকেই, এবং আরো অনেকেই দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন।  তাঁদের মধ্যে যাঁদের সুদূর ইউরোপের কোনো দেশে বা আমেরিকায় যাওয়ার সামর্থ নেই তাঁরা তো  ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে চান। তাঁদের কথা তো ভাবলেন না?  তাঁদের পূর্বপুরুষরাও তো ভারতে নাগরিক ছিলেন। স্বভাবতই তাঁদেরো তো ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ও পাওয়ার সমান অধিকার আছে।  এ দেশটা তো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কেবল আপনাদের মতো  গোঁড়া হিন্দুদের দেশ নয়তা হলে শুধু বিপন্ন হিন্দুরাই এখানে স্বাগত, বিপন্ন  অন্য মানুষরা নয় কেনো মোদিজি?  কেনো মোদিজি এক যাত্রায় পৃথক ফল?  মোদিজি, না, এখানেই আপনার সমালোচনায় দাঁড়ি টানতে পারছি না। এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ আছে আপনার বিরুদ্ধে। সেটা এবার অনুগ্রহ করে শুনুন।
মোদিজি, আপনি যদি  হিন্দুদের প্রতি দরদ থেকে এটা করতেন তাহলে  সেটাও অন্যায় হতো ঠিকই, কিন্তু  ইতিহাস হয়তো সেটা আপনার একটা লঘু ত্রুটি ও  অন্যায় বলে  ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো। লক্ষ লক্ষ বিপন্ন  মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে আপনার সংকীর্ণ মানবতাবোধকে  আমরাও হয়তো আমাদের  উদারতা দিয়ে আপনাকে  ক্ষমা করে দিতে পারতাম। কিন্তু আপনি তো তা করেন নি।  আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার আরসএস-এর রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্যে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে  পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করলেন মাত্র যাতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর কর্মসূচীকে আরো তীব্র করা যায়। আপনি যেদিন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন সেদিন থেকেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘপরিবারের বিদ্বেষ ও বৈরীতামূলক বিষাক্ত প্রচার তীব্র হতে শুরু করেছে এবং সে সঙ্গে  তাদের উপর এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের উপর আক্রমণের মাত্রাও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বলপূর্বক অথবা প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তকরণের (ঘর ওয়াপসি কর্মসূচী) ঘটনাও। মোদিজি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ধ্বংস করে যারা ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করতে এসব করছে তাদের আপনি এক ফোঁটা নিন্দাও করেন নি। এতে তো এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আপনি তাদের পেছনে আছেন। এবং আপনি যে ওদের সঙ্গে আছেন সেটা স্পষ্ট করে দিলেন শুধু হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। এবার আপনিই বলুন মোদিজি, হিন্দু স্মরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানকে মানবিক কারণে সমর্থন জানালেও আপনার প্রশংসা করি কোন আক্কেলে?  যে মতলবে আপনি এই কাজটা করলেন সেটা যে অমার্জনীয় অপরাধ। তারজন্যে মোদিজি আপনাকে নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর জন্যে কোনো ভাষাই যে যথেষ্ট নয়।   


 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...