Sunday, May 22, 2016

কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা - (দুই)



দ্বিতীয় অধ্যায়

আলী ও মুহাম্মদ দুহিতা ফাতেমা আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন নি



খলিফা পদ তথা ক্ষমতা না পেয়ে আলী নিজে যতটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলীর পত্নী এবং মুহাম্মদ-দুহিতা বিবি ফাতেমা । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ফাতেমা ছিলেন মুহাম্মদের অতি আদরের কন্যা ।ফাতেমা কত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ সাধ্যের অতীত । আলী ও ফাতেমার ক্ষোভ অবহিত হওয়া মাত্র আবু বকর কাল বিলম্ব না করে তাঁদের গৃহে গিয়েছিলেন তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মুহাম্মদের আর একজন অতি ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সাহাবী (অনুগামী ও অনুচর) ওমর ফারুককেতাঁরা আলীর গৃহের ভিতর প্রবেশ করার পূর্বেই দরজার মুখে দাঁড়িয়েই বিবি ফাতেমাকে সালাম জানান । ফাতেমা মুসলমানদের চোখে অতি আদরণীয় ও আদর্শস্থানীয় রমণী তিনি ‘খাতুনে জান্নাত’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন এবং এখনও তাঁকে সেই উপাধিতে সম্মান প্রদর্শন করা হয় । ‘খাতুনে জান্নাত’ মানে স্বর্গীয় রমণী বা জান্নাতের (স্বর্গ ) নারীদের নেত্রী । সেই ফাতেমা আবু বকর ও ওমরকে তাঁদের গ্রহের অভ্যন্তরে আমন্ত্রণ করার সৌজন্যটুকু প্রদর্শন করেন নি । এ প্রসঙ্গে যে কথাটি খেয়াল রাখা দরকার তা হলো তখন আবু বকর একজন ব্যক্তিমাত্র শুধু নন, তিনি একধারে একটি দৌর্দন্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রের প্রধান এবং আর একধারে তাঁরই (ফাতেমা) পিতার সবচেয়ে প্রিয়, ঘনিষ্ট ও সর্বাধিক  বিশ্বস্ত । ওমরও ছিলেন মুহাম্মদের অতি প্রিয় ও বিশ্বস্ত সাহাবী । তবুও তাঁদের প্রতি তিল পরিমাণ সৌজন্য ও সম্মান প্রদর্শন করেন নি বিবি ফাতেমা । উল্টে অপমান করে গৃহের দরজা থেকেই অনেক কটু কথা বলে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । ফাতেমা ওঁদেরকে অনেক রূঢ় স্বরে বলেন, ‘আপনারা খলিফা নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করেছেন । তারপরেও আপনারা কোন মুখে জনগণের নিকট হতে বয়াত গ্রহণ করেছেন ।’ ( দ্রঃ হযরত আবু বকর (রাঃ), ড. ওসমান গণি, পৃ- ৬৪ ) । সে সময় ঐখানে মদিনার অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন, তাদেরকে তিনি নালিশের সুরে বললেন, ‘আপনারা রসুলের উম্মত, আপনারাই বলুন, খলিফা নির্বাচনে কি ন্যায়-নীতির অনুসরণ হয়েছে ! শের-ই খোদা হযরত আলী কি  মহানবীর অতি ঘনিষ্ঠতম নন ! তাছাড়া তাঁর গুনাগুণ কি সকলের অপেক্ষা কি কোন অংশে কম । তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, জ্ঞান-গরিমার কথা, বীরিত্বের কাহিনী কে না জানেন  বিদায় হজে আব্বাজান (মহানবী) তাঁর সম্পর্কে জনগণকে কি বলে গেছেন !’ (দ্রঃ ঐ) ফাতেমা কোনো মতেই তাঁর জীবদ্দশায় আবু বকরকে খলিফা বলে স্বীকার করেন নি এবং মেনেও নেন নি  আলীও তাঁর কাছে বয়াত নেন নি (অর্থাৎ খলিফা বলে স্বীকার করেন নি)
অনেক পরে আবশ্য আলী আবু বকরের কাছে বয়াত নেন । সেটা কমপক্ষে ছ’মাস পর । ফাতেমা মারা যান মুহাম্মদের মৃত্যুর ছ’মাস পর, ফাতেমার জীবদ্দশায় আলী আবু বকরের কাছে বয়াত নেন নি । পরে বয়াত নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর মনের ক্ষোভ মুছে যায় নি । পরিস্থিতি তাঁকে বয়াত নিতে বাধ্য করেছিল এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বয়াত নেওয়ার পশ্চাতে বলে মনে হয় । তিনি যে মন থেকে আদৌ বয়াত গ্রহণ করেন নি তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় । সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করবো । এখন দেখা যাক কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তিনি খলিফা আবু বকরের কাছে বয়াত নেন ।
আবু বকর মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা হওয়ার পর ইসলামি সাম্রাজ্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয় । সে সব নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই । আবু বকর কিন্তু দৃঢ় অত্যন্ত হস্তে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং ইসলামি সাম্রাজ্যকে বিপদ মুক্ত করে অনেকখানি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হন । মুহাম্মদের মৃত্যু পরবর্তী কালের সঙ্কট যখন কেটে গেল তখন আবু বকর মন দিলেন ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে এবং এক্ষেত্রেও একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে তিনি সক্ষম হলেন । এ সময় আলীর ভূমিকা ছিল হতাশাব্যঞ্জক । ফলে একদিকে মুহাম্মদের সাহাবী ও সাধারণ উম্মতদের উপর আবু বকরের নেতৃত্ব ক্রমে দৃঢ় হতে থাকলো, অপরদিকে আলীর প্রতি মুহাম্মদের জামাই ও বংশধর বলে যে আবেগ ও সহানিভূতি ছিল তা ফিকে হতে শুরু করলো । এই সুযোগকে কাজে লাগালেন আবু বকর ও ওমর ফারুক তাঁরা প্রভূত ক্ষমতার মালিক এখন, সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আলীর অনুগামীদের তাঁদের পক্ষে টানার কাজ শুরু করলেন । আলীর অনুগামীরাও ক্ষমতার প্রসাদ লাভের জন্যে ধীরে ধীরে তাঁদের প্রিয় মহানবীর প্রিয় জামাই ও বংশধরের সঙ্গ ত্যাগ করে আবু বকরের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলেন । আলী এক সময় আবিষ্কার করলেন যে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন, কেউ আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চাইছে না এবং সবাই তাঁকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছেন । এদিকে আবু বকর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে তাঁর উপার্জনও (গণিমতের মালের অংশ পাওয়া) বন্ধ, ফলে শুরু হয়েছে আর্থিক সঙ্কট । আলীকে আর একটা বিষয় ভাবিয়ে তুলেছিল, তাহলো ইসলামি সাম্রাজ্যের পরবর্তী খলিফা পদটি হাসিল করার ভাবনা । আবু বকর থেকে দূরে থাকলে তো সেই পদটি তথা ক্ষমতা কব্জা করা সম্ভব হবে না । তাই শেষ অবধি তিনি সিদ্ধান্ত নেন আবু বকরের আনুগত্য মেনে নেওয়া তথা বয়াত নেওয়াটাই শ্রেয় এরূপ বিবেচনা করেই পরবর্তী খলিফা হওয়ার লোভের বশবর্তী হয়ে তিনি খলিফা আবু বকরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও বয়াত নেন ।  
আলীর পক্ষে কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছিলো, প্রধানতঃ যে উদ্দেশ্যে আবু বকরের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন সেটা পূরণ হয় নিআবু বকর খলিফা হওয়ার পর মাত্র দু বছর বেঁচে ছিলেন । তিনি মারা যান ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে । তিনি যখন বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তখন সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে পরবর্তী খলিফা পদে তিনি ওমর ফারুককে মনোনীত করছেন । উপস্থিত সকলেই তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত ও সমর্থন জানালেন । একমাত্র আলীই আশা করেছিলেন মুহাম্মদের সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু ও সাহাবী (অনুচর) আবু বকর মুহাম্মদের হাতে গড়া সাম্রাজ্য তাঁর জামাই ও বংশধর আলীর হাতে অর্পণ করে মুহাম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করবেন । কিন্তু আলী গভীর হতাশা নিয়ে শুনলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত হলেন ওমর ফারুক । এই ঘোষণা তাঁর কাছে আশাতীত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তবু তা তাঁকে নীরবেই শুনতে হলো ও মেনে নিতেও হলো, কারণ তিনি নিজের চোখেই দেখলেন যে উপস্থিত সকলেই সহর্ষে ওমরকে খলিফা মেনে নিয়েছেন । আলীকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত না করার জন্যে কোনোদিক থেকেই কোনো প্রশ্ন ওঠে নি । এর কারণ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর পরের দু বছর যে সীমাহীন সংকট ও দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছে মুহাম্মদের সাহাবী ও উম্মতদের সেক্ষেত্রে আলীর ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও নৈরাশ্যজনক, ফলে আলীর প্রতি যে আবেগ ও সহানুভূতি ছিল তা ক্রমশঃ বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল । ফলে সবকিছুই আলীকে মুখ বন্ধ করে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল নাতাই আবু বকরের মৃত্যুর পর বিনা বাক্য ব্যয়ে ওমরের নিকট গিয়ে বয়াত নিতে আর বিলম্ব করেন নি ।
ওমরের প্রতি আলীর আনুগত্য ছিল নিতান্তই মুখোশ মাত্র, অন্তর থেকে তাঁকে তিনি খলিফা মেনে নিতে পারেন নি । ওমরের দশ বছরের খেলাফতকালে এর অজস্র প্রমাণ রয়েছে । এখানে তারই একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক । ওমরকে প্রকৃত পক্ষে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতা রূপে ইতিহাস আখ্যায়িত করেছে । কারণ আবু বকর যে সাম্রাজ্যটিকে চারিদিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, ওমর সেখান থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিলেন এবং প্রকৃত অর্থেই শিশু ইসলামি রাষ্ট্রটিকে একটি সাম্রাজ্যের চেহারা দিয়েছিলেন । রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যটি জয় করে সেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন । সেই কারণে তাঁকে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতা বলে অভিহিত করা হয় । যে ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাইছি সেটা পারস্য সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পূর্বেকার ঘটনা । ৬৩ থেকে ৬৪২ সালের মধ্যেকার ঘটনা ।  ইসলামের ইতিহাসে কাদিসিয়ার যুদ্ধের একটি বিশেষ জায়গা আছে । এই যুদ্ধটির উদ্দেশ্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করা । কাদিসিয়ার যুদ্ধকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ বলে বর্ণয়া করেছেন, কারণ এই যুদ্ধে ওমরের বাহিনীর পরাজয় হলে ইসলামি সাম্রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। আর তা যদি হতো তবে ইসলাম ধর্মটাই ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেত । যুদ্ধের এমন গুরুত্ত্বের কথা বিচার করে ওমর কয়েকটি নতুন রণকৌশল ও রণনীতি রচনা করেছিলেন । তার মধ্যে একটি হলো তিনি সর্বাধিনায়কের পদ ও গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । আর একটি হলো তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সামরিক পরিষদ গঠন করেছিলেন । এই সামরিক পরিষদই ওমরের  রণকৌশলের একটি পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিয়েছিল যা ছিল অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবসম্পন্ন   ওমর তা মেনে নিয়েছিলেন । প্রস্তাবটি ছিল এ রকম – যদি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে তবে শত্রুরা চারদিক থেকে মদিনা (ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী) আক্রমণ করবে, তাই খলিফার মদিনা ছেড়ে যাওয়া সমীচীন হবে না, শত্রুর আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষা করার জন্যে কিছু সৈন্য নিয়ে তাঁর মদিনায় থাকা বাঞ্ছনীয় হবে এবং সেক্ষেত্র সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বটি পালনের সব থেকে উপযুক্ত মানুষটি হলেন আলী, তাই আলীকেই এই যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হোক । ওমরের সম্মতিতে ও সর্বসম্মতিতে যখন এই সিদ্ধান্তটি সামরিক পরিষদে গৃহীত হলো তখন আলী বেঁকে বসলেন । সবাইকে বিস্মিত করে তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁর অসম্মতি ও অক্ষমতার কথাআলী কেন খলিফা ও সামরিক পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করলেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না । ওমরকে খলিফা হিসাবে মনের ভিতর  থেকে গ্রহণ করতে না পারার জন্যেই এই যুদ্ধে তিনি ইসলামের জয়ের জন্যে ব্যাকুলতাবোধও করেন নি কিংবা ইসলামের পরাজয় ও মুছে যাওয়ার আশঙ্কাতেও বিচলিত হন নি । খলিফা ওমর শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের খালাতো (মাসতুতো) ভাই ও বিশিষ্ট সাহাবী সাদ বিন আক্কাশকে সর্বাধিনায়ক করে যুদ্ধাভিযানের নির্দেশ দেন । এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল । এই যুদ্ধে ওমর বিজিয়ীর হাসি হেসেছিলেন তা বলা বাহুল্য এবং তখন আলীর মনের কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।
ওমর ফারুকের রাজত্বকালের সময়সীমা ছিলো দশ বছর । এই সময়কালে স্বাভাবিকভাবেই ওমর ও আলীর মধ্যে মানসিক দুরত্ব আরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এর জন্যে যে আলীই দায়ী ছিলেন তা বলা বাহুল্য ।  ওমর ছিলেন ভীষণ ধর্মনিষ্ঠ ও কড়া ধাতের মানুষ । মুহাম্মদের নির্দেশ ও কোরানের বাণী অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, কোনো রকম আপোষ-রফা করতেন না । মুহাম্মদের নির্দেশ ছিল সমগ্র আরবকে মোশরেক মুক্ত (অমুসলমানদের থেকে মুক্ত) করা । মুহাম্মদ যেহেতু মক্কা বিজয়ের মাত্র দু বছর পর আকস্মিকভাবে মারা যান, তাই এই কাজটি নিজে সম্পূর্ণ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি । মৃত্যুর প্রাক-মূহুর্তে এই কাজটি সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর সাহাবীদের উপর । আবু বকরও সময় পান নি । ওমর এটা একশভাগ সম্পন্ন করেন । এর ফলে যাঁরা নিরুপায় হয়ে প্রাণে বাঁচার তাগিদে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই ওমরের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তাঁদেরই কেউ ওমরকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছুরিকাহত করেন এবং সেই আঘাতের কারণেই তাঁর জীবনাবসান হয় । মৃত্যুর পূর্বে তিনিও আবু বকরের পথ অনুসরণ করে একজন বিশিষ্ট সাহাবীকে খলিফা মনোনীত করে যেতে চেয়েছিলেন  । এ ব্যাপারে তাঁর পছন্দ ছিল আব্দুর রহমান নামের একজন বিশিষ্ট সাহাবী । খলিফা পদের দাবীদার ছিলেন অনেকেই, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আকাঙ্খা ও আশা ছিল যাঁর তিনি হলেন আলী । যাঁরা দাবীদার ছিলেন তাঁদের কারও প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ছিল না ওমরের, এদিকে আব্দুর রহমানও খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অসম্মত হলেন ওমর তখন একটি কমিটি গঠন করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে তুলে দিলেন । এই কমিটির পক্ষে খলিফা নির্বাচনের কাজ দুরূহ হয়ে উঠেছিল, কারণ খলিফা পদের দাবীদার যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আলী ও ওসমান গণি দুজনেই শেষ অবধি নিজের নিজের দাবীতে অটল ছিলেন । খলিফা তখন কমিটির সম্প্রসারণ করেন । এই কমিটিকে খলিফা পদে একজনকে নির্বাচিত করার জন্যে শেষ অবধি ভোটাভুটি করতে হয় । ভোটে আলী পরাস্ত হন এবং ওসমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পরবর্তী খলিফা তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন । আলীর তখনও যাঁরা অতি অল্প কয়েকজন অনুগামী ছিলেন তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ওসমানকে তাঁরা মানবেন না বলে জানিয়ে দিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন । খলিফা ওমর কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে জানিয়ে দিলেন এবং খেলাফতের দায়িত্ব ওসমান গণির হাতে সঁপে দিলেন । তৃতীয় খলিফা এই ওসমান গণিও ছিলেন মুহাম্মদের আর এক জামাই । তৃতীয় খলিফা হিসাবে ওসমান গণিকে আলী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি । ওসমান গণির খেলাফতকালে নানাভাবে ওসমানকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টায় আলী নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন । এরই ফলশ্রুতিতে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধে এবং শেষ অবধি বিদ্রোহীদের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয় । তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহে খলিফার মৃত্যুর ঘটনাই কারবালার  ঘটনাকে অবধারিত করে তুলেছিল । কিভাবে পরিস্থিতি দ্রুত কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছিল তা নিয়ে আলোচনার পূর্বে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোচনা করে নিতে চায় যা এই লেখার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক । মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচন কোনোবারই সুষ্ঠ, সুন্দর ও সাবলীলভাবে যে সম্পন্ন হয় নি তা ইতিপূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট । প্রতিবারই বেশ কঠিন সমস্যা তৈরী হয়েছে । প্রথম খলিফা আবু বকর তাঁর নিজের খলিফা হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্যে আলোচনার পথে হাঁটেন নি, খেলাফতের ক্ষমতাবলে মুসলিম উম্মার উপর দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে ওমর ফারুককে চাপিয়ে দিয়েছিলেন । তিনি যেহেতু খলিফা তাই তাঁর বিরোধিতা করার সাহস কারো হয় নি । ওমর খলিফাও সেই পথ ধরে তৃতীয় খলিফা নির্বাচন পর্ব সম্পন্ন করে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে, কিন্তু পারেন নি তা উপরের আলোচনায় বর্ণনা করা হয়েছে । চতুর্থ খলিফা নির্বাচনে সংকট হয়েছিল আরো তীব্র যা কারবালা কান্ডের পরিস্থিতিকে অনিবার্য ও অধিক নিকটবর্তী করে তুলেছিল । কেন এরূপ সমস্যাগুলির উদ্ভব হয়েছিল তার কারণগুলি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না প্রধান কারণ দুটি হলো এরূপঃ এক) খলিফা নির্বাচনে মুহাম্মদ কোনো নীতি ঠিক করে যান নি । এটা তাঁর অদূরদুর্শিতার জন্যে হয়ে থাকতে পারে । তিনি ভাবতেই পারেন নি যে তাঁর মৃত্যু খুবই সন্নিকটে । দুই) মুহাম্মদের সাহাবীরা ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতালোভী । প্রধানতঃ এই দুটি কারণের জন্যে খলিফা নির্বাচনের সময় সংকট সৃষ্টি হয়েছে । এই সত্যটি কোনো মুসলিম ঐতিহাসিক স্বীকার করেন নি এবং সযত্নে গোপন করে গেছেন । অথচ তাঁরাই পঞ্চম খলিফা মাবিয়ার বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ করেছেন যে, তিনি তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে ইসলামের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেনএবং এটাকে কারবালা যুদ্ধের একটা বড়ো কারণ বলে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন । কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায় মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়াকেই দাঁড় করিয়েছেন এবং তার সপক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে আরও বহু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যা অতিশয় পক্ষপাতদুষ্ট সে সব বিষয় আলোচনা হবে আরো পরে, এখন ফেরা যাক ওসমান গণির খলিফা নির্বাচনোত্তর কালের ঘটনায় । 


(বিঃদ্রঃ- এই ব্লগটি আমার 'কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা' বইয়ের অংশ। পুরো বইটি এভাবে প্রবন্ধাকারে পাঠকদের জন্যে আমার ব্লগে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।)  
 





কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা (এক)

                                                          
প্রথম অধ্যায়

 

আবুবকর যেদিন ম খলিফা নির্বাচিত হন সেদিনই কারবালা যুদ্ধের বীজ পোঁতা হয়ে যায় 

 

বিশ্ব ইতিহাসে যুদ্ধের ইতিহাসটি সব দিক থেকেই বিশাল। কত যুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছে সাড়া বিশ্বে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য খুব কম যুদ্ধই হয়েছে মানুষের স্বার্থে ও প্রয়োজনে। কিন্তু সব যুদ্ধেই খুন-জখম হয়েছে মানুষই, মানুষ বলতে সাধারণ মানুষ। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যুদ্ধ হয়েছে, বলা ভালো করা হয়েছে ক্ষমতা বিস্তার, কিংবা ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্যে। সে সব যুদ্ধ হতো রাজায় রাজায় বা রাজা-বাদশা-সম্রাটদের মধ্যে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্ব সভ্যতা প্রবেশ করলে যুদ্ধের প্রকৃতি পাল্টে যায়। কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে মধ্য যুগে, অর্থাৎ প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে মানব সভ্যতা প্রবেশ করার ঢের পূর্বে। স্বভাবতঃই সে যুদ্ধের বৈশিষ্ট আলাদা কিছু ছিল না। কিন্তু আমরা যে ইতিহাস পড়ি সে ইতিহাস এই যুদ্ধটাকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট প্রদান করেছে। কী বৈশিষ্ট প্রদান করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে পরে আসবো।
যুদ্ধ বিষয়ে এখানে আর একটা কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। ইতিহাসে সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়া যুদ্ধ ছাড়া আমরা অনেক যুদ্ধের কথা শুনতে পাই। সে সব যুদ্ধ হলো পৌরাণিক যুদ্ধ। এ সব যুদ্ধের কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরে । অপরদিকে যে যুদ্ধগুলো সত্যি সংঘটিত হয়েছে তার কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরা তো দূরের কথা, মানুষ সে সব যুদ্ধ সম্পর্কে অবহিতই থাকেন না।  কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো কারবালা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটির কথা মুসলিম সমাজের মানুষের মুখে মুখে আজও সমানে ঘোরেশুধু তাই নয়, প্রতি বছর এই যুদ্ধের দিনটি স্মরণও করা হয়। একটি সত্যিকারের যুদ্ধ পরিণত হয়ে গেছে যেন পৌরাণিক যুদ্ধে। তাই এই যুদ্ধটির একটা আলাদা তাৎপর্য আছে ইতিহাসে। অথচ খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই যুদ্ধটির যে ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং প্রকৃতই যা ঘটেছিল তার সঙ্গে পাহাড় সমান পার্থক্য রয়েছেসত্যি কথা বলতে কি এর আসল ইতিহাসটাই হারিয়ে গেছে এবং তার পরিবর্তে একটা সম্পূর্ণ বিকৃত, অর্ধসত্য ও অসত্য ইতিহাস লেখা হয়েছে যা আমরা যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
বলা বাহুল্য যে, যে ইতিহাসের কথা আমি বলছি তা মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস । কারবালা যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসের বাইরেও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে সাহিত্যের অঙ্গনে । কবিতা, ছড়া, মুর্শিয়া, জারিগান, গল্প, নাটক, থিয়েটার,উপন্যাস প্রভৃতি কত যে লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই এবং আজও তা সমানে অব্যাহত রয়েছে । এ সব রচনায় ঐ একই ধারা, যে ধারা ইতিহাসে অনুসরণ করা হয়, আজো চালু আছে।
                                          
কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অধুনা ইরাকে অবস্থিত ইউফ্রেটাস (ফোরাত) নদীর ধারে কারবালা নামক একটি প্রান্তরে। সেজন্যে ইতিহাসে এটা কারবালা যুদ্ধে নামে খ্যাত। এটা আবার মহরম নামেও পরিচিত। কারণ যেদিন যুদ্ধটি হয় সেদিন ছিল আরবী বছরের মহরম মাসের ১০ তারিখ। তাই প্রতি বছর ১০ই মহরম এই দিনটি উদপযাপিত হয় গোটা দুনিয়ায় মুসলমান সমাজে। এটা উদযাপন করা হয় অবশ্য শোক দিবস হিসাবে, কারণ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ইমাম হোসেন যিনি ছিলেন মুহাম্মদের নাতি এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলীর পুত্র। বলা বাহুল্য একমাত্র সে কারণেই এই যুদ্ধটি পৌরাণিক যুদ্ধের মতো মুসলমানদের মুখে মুখে ঘোরে। এবং এই কারণেই মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেছেন মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতিএকই অবস্থা হয়েছে যাঁরা কারবালা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও। যুদ্ধটি হয় হোসেন ও ইসলামি সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ খলিফা এজিদ (ইয়াজিদ)–এর সৈন্যবাহিনীর সাথে। মুসলিম ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের কলমের আক্রমণের অভিমুখ থেকেছে তাই এজিদ ও তাঁর পিতা ইসলামের পঞ্চম খলিফা মাবিয়া (মুয়াবিয়া)–র দিকেঅপরদিকে সমস্ত প্রশংসা উজার করে দুহাতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে হোসেন ও নবীর (মুহাম্মদ) বংশধরদের প্রতি। দেখানো হয়েছে হোসেনকে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো নিষ্পাপ এবং আল্লাহ্‌, ইসলাম, আদর্শ ও মানুষের জন্যে আত্মবিসর্জনকারী এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহান ত্যাগী পুরুষ হিসাবে।
যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে ৬৮০খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর। তার আগের বছর মাবিয়া পরবর্তী খলিফা হিসাবে মনোনীত করেন তাঁর পুত্র এজিদকে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেছেন সেটাই হলো কারবালা যুদ্ধের মূল সূত্রপাত। অর্থাৎ তাঁদের মতে কারবালা যুদ্ধের সময়কাল সীমাবদ্ধ মাত্র দুবছর বয়সকালের মধ্যে। এই যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে অনেকটা দীর্ঘ সময়। এর সূত্রপাত মূলতঃ ঘটে মুহাম্মদের মৃত্যুর অব্যবহতি পরেই তাঁর উত্তরসূরী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেহেতু ইতিহাস লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, হোসেন ইসলামি সাম্রাজ্য ও ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্যেই কারবালা প্রান্তরে আত্মবলিদান করেছেন। সেজন্যে তাঁরা কারবালার সময়কালকে সীমায়িত করেছে মাত্র দুবছরের অতি স্বল্প সময়কাল ও ততোধিক ক্ষুদ্র পরিসরের সময়সীমার মধ্যে।
যে যে কারণগুলিকে কারবালা যুদ্ধের জন্যে দায়ী করা হয়েছে সেগুলি হলো এ রকম – মাবিয়া যখন খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন তখন কথা ছিল তাঁর পরে খলিফা পদে মনোনীত করতে হবে ইমাম হোসেনকে। কারণ, এ রকম একটা চুক্তি হয়েছিল মাবিয়া ও ইমাম হাসান (মুহাম্মদের জ্যেষ্ঠ নাতি ও আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র)– এর সঙ্গেমাবিয়া সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন। এর মধ্যে দিয়ে শুধু যে হোসেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন মাবিয়া তা নয়, আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ইসলাম, মুহাম্মদ ও গোটা মুসলমান সমাজের সঙ্গে। এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করা হয়েছে। হোসেনের পক্ষে এজিদের খেলাফত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না আরো একটা কারণে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হলো, এজিদ ছিল স্বৈরাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ ও লম্পট প্রকৃতির যুবক, সুতরাং তার হাতে খেলাফত হস্তান্তর মানেই ইসলামের অপমৃত্যু। তাই ইসলামকে বাঁচাতে এজিদকে ক্ষমতা থেকে সরানো ব্যতীত অন্য বিকল্প ছিল না। তারজন্যে হোসেনকে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই হয়েছিল। কেন মাবিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? সে কি অন্ধ পুত্রস্নেহের বশেই কেবল? ঐতিহাসিকগণ বলেছেন,না তা নয়। তাঁরা এর জন্যে দায়ী করেছেন মাবিয়ার বংশপরম্পরাকেও। মক্কায় হাসেমি ও উমাইয়া এই দুটি বংশের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল প্রাক-ইসলাম যুগে মুহাম্মদ ছিলেন হাসেমি বংশের প্রতিনিধি । তিনি যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন সব থেকে বেশী বাধা পেয়েছিলেন উমাইয়া বংশের নিকট থেকে। মুহাম্মদের যাঁরা প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান। এই আবু সুফিয়ান একেবারে বাধ্য হয়েই মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়েছিলেন মুহাম্মদ মক্কা জয় করার পরসেই আবু সুফিয়ানের পুত্র ছিলেন মাবিয়া। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন যে পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা মুহাম্মদের বংশধরদের হাতে না দিয়ে নিজের বংশ ও বংশধরদের হাতে তুলে দিয়েছিলেনতাঁরা তাই এজিদকে নয়, মাবিয়াকেই কারবালার ঘটনার প্রধান ষড়যন্ত্রী ও প্রধান হোতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
কেউ কেউ মাবিয়াকে নয়, প্রধান হোতা বলেছেন এজিদকেই। তাঁরা বলেছেন জয়নব নামে একজন বিধবা কিন্তু অসাধারণ সুন্দরীও এই যুদ্ধের পেছনে বড় কারণ হিসাবে কাজ করেছে। ইমাম হাসান জয়নবের রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। একই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এজিদও। জয়নব সম্মতি জানিয়েছিলেন হাসানের পক্ষেই। কিন্তু নাছোড় বান্দা ছিলেন এজিদ। যে কোনো মূল্যে তিনি জয়নবকে পেতে চেয়েছিলেন। আর এটা সম্ভব করার জন্যে ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হাসিল করা তাঁর কাছে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে তিনি পিতার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে খলিফা মনোনীত করার জন্যে। মাবিয়া সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন বাধ্য হয়েই। এদিকে জয়নবের প্রশ্নে শেষ হাসি হেসেছিলেন হাসানই। তারপরে হাসানকে বিষ খাইয়ে হত্যা রিয়েছিলেন এজিদ একজন মহিলার সাহায্য নিয়ে। এজিদ এখানেই ক্ষান্ত হন নি, পরবর্তী পর্যায়ে হাসানের ভাই হোসেনকে হত্যা করে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
খোলা মনে ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করলে অবশ্য কারবালার ঘটনার জন্যে মাবিয়াকে কোনো প্রকারেই দায়ী করা যায় না এবং এজিদকেও খুব একটা দায়ী করা যায় না। মাবিয়া যেদিন তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তার পুত্রকে নির্বাচিত করেন সেদিনই কারবালা যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয় বলে মুসলিম ঐতিহাসিকরা যে কথা লিখেছেন সেটা ইতিহাসের অতি সরলিকরণ বৈ নয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এই যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল মুহাম্মদের মৃত্যুর পরপরই। হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ মুহাম্মদের মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে প্রচন্ড কলহপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হতে তথা অসীম ক্ষমতার পদটি পেতে লালসা হয়েছিল অনেকেরই। ঐ প্রশ্নে সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না। অবস্থা এমন হয়েছিল যে মুহাম্মদের দাফন-কাফনের কাজ তথা অন্তিম সৎকারের কাজ একদিন (অন্য মতে তিন দিন) স্থগিত রাখতে হয়েছিল। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই সমাধানে সকলের সম্মতি ছিল না। অনেক হৈ-হট্টগোলের পর আবু বকর মুহাম্মদের উত্তরসূরী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই নির্বাচনে সব চেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলী (মুহাম্মদের জামাই)আলী মুহাম্মদের আপন খুড়তুতো ভাইও ছিলেন, অর্থাৎ সে সময় তিনি ছিলেন মুহাম্মদের একমাত্র উপযুক্ত জীবিত বংশধর। তিনি মুহাম্মদের জীবনের ছায়াসঙ্গীও ছিলেন। পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলামকে কবুল (স্বীকার) করেছিলেন, অর্থাৎ তিনিই প্রথম মুসলমান মুহাম্মদের পর। আলী যখন ইসলাম কবুল করে মুসলমান হন তখনও তিনি নাবালক ছিলেন। তাই তাঁর মতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুহাম্মদের সঠিক উত্তরসূরী এবং সব দিক থেকেই খলিফা পদের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তাই তিনি একদিকে আবু বকরের খলিফা নির্বাচনে যেমন অবাক হয়েছিলেন অপরদিকে তেমনই প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবং বলা বাহুল্য যে, আলীর অনুগামীরাও অবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই কারবালার ইতিহাসের সূচনা হয়ে গিয়েছিল সবার অলক্ষ্যে। এভাবেও বলা যায় যে আবু বকরের খলিফা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সেদিনই কারবালা যুদ্ধের বীজটি পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সেই বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমে ক্রমে সবার অলক্ষ্যে কারবালা যুদ্ধ নামক বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল

 


(বিঃদ্রঃ- এই ব্লগটি আমার 'কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা' বইয়ের অংশ। পুরো বইটি ধাপে ধাপে পাঠকদের জন্যে আমার ব্লগে তুলে দেওয়ারনিচ্ছে আছে। এই ব্লগটি দিয়ে সেটা শুরু হলো।)  


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...