Saturday, October 31, 2015

মুসলিম নারীদের ন্যায় বিচার দিতে হলে ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’কে বাতিল করা জরুরী



সর্বোচ্চ আদালতের দুই সদস্যের (এ.আর.দাভে ও এ.কে.গোয়েল) একটি বেঞ্চ সম্প্রতি মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছেবেঞ্চটি প্রধান বিচারপতিকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেও অনুরোধ করেছেবিচারপতিদের  মন্তব্যগুলি এবং প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া তাঁদের  প্রস্তাবগুলি   খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অনুধাবনযোগ্য এবং ভীষণ সময়োপযোগী । বিচারপতিদ্বয়  বলেছেন যে, মুসলিম মহিলারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে খুবই  প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে রয়েছে,  কারণ এই আইনে বহু বিবাহ এবং তালাকের স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার রোধের কোনো ব্যবস্থা নেই ।  ফলে মুসলিম মহিলাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারগুলি  লঙ্ঘিত হচ্ছে ।  বিচারপতিদ্বয় তাই এই আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা  আছে কী না খতিয়ে দেখা আবশ্যক বলে  মন্তব্য করেছেন । তাঁরা বলেছেন বহু বিবাহ জননৈতিকতার পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক । এর আগে এ প্রসঙ্গে আদালতের একটি রায় রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে,  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বিচার ব্যবস্থা (জুডিসিয়ারি) হস্তক্ষেপ করতে পারে না,  কারণ এটা নীতিগত বিষয় । এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে শুধু সরকার ও আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলি । সেই  রায়ের প্রসঙ্গ টেনে এ.আর.দাভে ও এ.কে.গোয়েলের  বেঞ্চ বলেছে যে বহু বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার শুধু ধর্মের বিষয় নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে  মুসলিম নারীদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়টিও ।  এটা তাই শুধু নীতির বিষয়ই নয়,  এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সংবিধান প্রত্যকের জন্যে সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার যে অঙ্গীকারের  কথা বলেছে  সেটাও ।   সুতরাং কোনো আইনে সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে কী না তার উপর  লক্ষ্য রাখাও  বিচার  ব্যবস্থার সাংবিধানিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত    যদি দেখা যায়  কোনো আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে , তবে সর্বোচ্চ  আদালত  সেই অসাংবিধানিক আইনটি  সম্পর্কে নীরব থাকতে  পারে না বিচারপতিদ্বয় আরো  বলেন যে, সতীদাহ প্রথার মতো মুসলিম সমাজে চলতে থাকা বহু  বিবাহ ও তালাক প্রথাও বাতিল  করা আবশ্যক  এবং   এটাই হচ্ছে উপযুক্ত সময়  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি পর্যালোচনা করে দেখার । তাঁরা বলেন যে,  সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম ব্যক্তিগত   আইনেও পরিবর্তন আনা জরুরী  সমগ্র বিষয়টি পর্যালচনা করার জন্যে তাঁরা প্রধান বিচারপতির নিকট একটি পৃথক বেঞ্চ গঠন করার  প্রস্তাব রেখেছেন ।   মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে শীর্ষ আদালতের আরো কয়েকটি রায় বিশ্লেষণ করার পর বিচারপতিদ্বয় আ্যাটর্নি জেনারেল ও ন্যাশন্যাল লিগেল সার্ভিসের অথরিটিকে একটি নোটিশ জারি করেছেন । আগামি ২৩শে নভেম্বরের মধ্যে ঐ নোটিশের নোটিশের জবাব দিতে  নির্দেশ দেওয়া  হয়েছে  
সর্বোচ্চ আদালত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করার কথা এর আগেও বলেছে । ১৯৮৫ সালে শাহবানু  মামলার রায় দিতে গিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চও সরকারকে বলেছিলো সমস্ত ব্যক্তিগত আইনগুলি রদ করে সকলের জন্যে এক আইন তৈরী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে । সরকারকে সংবিধানের নির্দেশাত্মক অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেঞ্চ বলেছিলো যে, সংবিধান প্রণেতাগণ জানিয়েছিলেন  যে পৃথক পৃথক ব্যক্তিগত আইন একটি সাময়িক ব্যবস্থা, যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশে সকলের জন্যে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন করতে হবে ।  প্রতিবারই  সংবিধানের শপথ নিয়ে সরকার তৈরী হয় বটে,   কিন্তু  কোনো সরকারই সংবিধানের সেই নির্দেশ  রূপায়ন করার চেষ্টা করে না  । ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ শুধু অগ্রাহ্যই করে নি, তালাক প্রাপ্তা মুসলিম মহিলাদের পক্ষে খোরপোষের যে রায় দিয়েছিলো সেই রায়কেও সংসদে নতুন আইন করে বাতিল করে দিয়েছিলো । অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি করার ক্ষেত্রে কোনো উৎসাহ দেখায় নি ।
বিচারপতি দাভে ও গোয়েলও এবার মুসলিম ব্যক্তিগত আইন রদ করার জন্যে বলেছেন । এ প্রসঙ্গে তাঁরা যা যা বলেছেন তার সবগুলিই মুসলিম নারীদের মনের কথা ।  মুখের কথাও । তাঁরা   যথার্থই  বলেছেন যে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে পুরুষের বহু বিবাহ ও ইচ্ছে হলো তালাক দিলাম প্রথার বিরুদ্ধে কোনো রক্ষাকবচ নেই । উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও মুসলিম নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে । ফলে পদে পদে মুসলিম নারীদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে  এবং  তারা ন্যায্য অধিকার, সমানাধিকার ও  ন্যায় বিচার  থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । মুসলিম মেয়েরাও এখন  লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শিখে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে, স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হচ্ছে, আধুনিক যুগের  সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের আধুনিক করে গড়ে তোলার সাধনা করছে । কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে শরিয়তি সংস্কৃতি ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন প্রতি পদে বাধাগ্রস্ত করছে । বিচারপতি দাভে ও গোয়েল তাই সঙ্গতঃ কারণেই বলেছেন যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেরও সংস্কার ও  উন্নতি বিধান করা জরুরী ।  ভারতীয় মুসলিম নারীরাও তাই চাই । মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বাধীন একটি স্বাধীন   সংস্থা, বিএমএমও (ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন) সম্প্রতি এই বিষয়েই একটি সমীক্ষা চালায় তাতে দেখা গেছে যে প্রায় ১০০%  মুসলিম মহিলাই চাই যে বহু বিবাহ ও তালাক প্রথা বাতিল করা হোক ।   ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতের দশটি রাজ্যে ৪৭১০ জন নারীর মধ্যে একটি  সমীক্ষা চালানো হয় । তাদের মধ্যে  ৯২.১% নারীই বলেছে যে তারা মৌখিক  তালাক  আইনের অবসান চায়, আর ৯১.৭% নারী বলেছে তারা বহু বিবাহ আইনের বিরুদ্ধে । তারা এমন  একটা আইন  চায় যাতে পুরুষরা একতরফা খেয়াল খুশীমতো   তালাক দিতে না পারে । তারা চাই যে  সালিশি বা আদালতের মাধ্যমে তালাকের বিষয়টা    নিষ্পত্তি হোক   যে রাজ্যগুলিতে সমীক্ষা চালানো হয় তারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গও আছে,  বাকি রাজ্যগুলি হলো  মহারাষ্ট্র, গুজরাট,  কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহার । 

বিএমএমও অনেকদিন ধরেই মুসলিম মহিলাদের স্বার্থে কাজ করে আসছে । তারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করে এমন একটা নতুন আইন প্রণয়ন করার দাবীতে আন্দোলন করছে যে আইনে মুসলিম নারীদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার সুব্যবস্থা থাকবে । সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করার জন্যে যে জোরালো বক্তব্য রেখেছে তা নিশ্চয় তাদের   প্রচুর উৎসাহ ও সাহস  জোগাবে  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় নিয়ে তারা খুব শীঘ্রয় দিল্লীতে একটি  কর্মশালা সংগঠিত করতে চায়  পশ্চিবঙ্গেও দুটি মহিলা সংগঠন  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সংস্কার  করার দাবিতে আন্দোলন করছে । সংগঠন দুটি মূলতঃ মুসলিম মহিলাদের নিয়ে তৈরী এবং নেতৃত্বেও রয়েছে মুসলিম পরিবারের মেয়েরাইসংগঠন দুটির একটি হলো ‘রোকেয়া উন্নয়ন সমিতি’ যার নেতৃত্ব রয়েছেন খাদিজা বানু এবং অন্যটি হলো ‘ফোরাম ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইণ্ডিয়া’ যার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক আফরোজা খাতুন । তাঁরা যে দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন করছেন তার মধ্যে  প্রধান দাবিগুলি হলো – এক).   বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে ।  দুই).   আদালতের বাইরে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তালাক দেওয়ার বিষয়ে নারী ও পুরুষ উভয়কেই  সমানাধিকার  দিতে  হবে ।  তিন). উত্তরাধিকার আইনে নারী ও পুরুষ উভয়কেই  সমান অধিকার দিতে হবে । চার). মুসলিমদেরকে দত্তক আইনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে । সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও অভিমত তাদের সংগঠন ও আন্দোলনকেও নিশ্চিতভাবেই শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে ।
মুসলিম সমাজের রক্ষণশীল ধার্মিক মহিলারাও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বদল চান, তাঁরাও চান নতুন বিবাহ আইন যে আইনে পুরুষের বহু বিবাহ ও  যখন খুশী তালাক প্রদান রোধে মুসলিম নারীদের হাতে রুক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকবেতাঁরা অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন । ফলে প্রতি  পদে উলামার সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ও সংঘাত হচ্ছে  । তারই ফলশ্রুতিতে  ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’  থেকে বেরিয়ে তাঁরা পৃথক ‘অল ইণ্ডিয়া  মুসলিম মহিলা পার্সোনাল ল বোর্ড’ গঠন করেছেন ।  এই বোর্ড ২০১১ সালে   একটি পৃথক ‘নিকাহ নামা’ (বিবাহ আইন) প্রণয়ন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছে এবং দাবি জানিয়েছে তার ভিত্তিতে নতুন করে ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ প্রণয়ন করার     তাঁরাও তাঁদের প্রস্তাবিত নতুন ‘নিকাহ নামা’য় নারী ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করেছেন নস্যাত করে দিয়েছেন  ইন্টারনেট, স্কাইপ, মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে তালাক প্রদানের বৈধতাকে  । পতি যদি অন্য নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তবে পত্নীর তাকে  তালাক দেওয়ার অধিকারও তাঁরা দাবি করেছেন । এমনকি  পত্নী চাইলে  এইডস রোগাক্রান্ত পতিকে  তালাক দেবার  অধিকারও তাঁরা দাবি করেছেন । পতি যদি প্রকৃতিবিরুদ্ধ   পদ্ধতিতে পত্নীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করার জন্যে পত্নীর উপর অত্যাচার করে তবে সে ক্ষেত্রেও নতুন ‘নিকাহ নামা’য়  পতিকে পত্নীর তালাক দেওয়ার অধিকারও চাওয়া হয়েছে । মোদ্দা কথায় ধার্মিক মুসলিম মহিলারা প্রায় একটি বৈপ্লবিক ‘মুসলিম নিকাহ নামা’ প্রণয়ন  করেছেন এবং তা আদায়ের জন্যে  আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন । এ কথাগুলি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে অবিশ্বাস নিরসনের জন্যে এই লিংকটি খুলতে পারেন - http://www.muslimwomenpersonallaw.com/aboutus.html
সুপ্রীম কোর্ট ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ সম্পর্কে যা বলেছে তা উপলব্ধি করেছে বিশ্বের  বহু মুসলিম দেশই এবং তারা এই আইনটির ব্যাপক সংস্কার করেছে । সে রকম  কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশ হলো   ইরাক, ইরান, মরক্কো, লিবিয়া, লেবানন, জর্ডন,  ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মিশর, আলজিরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি   পাকিস্তান ১৯৬১ সালে এই আইনের সংস্কার করে আদালতের বাইরে তালাক ও প্রথম পত্নীর অনুমতি ব্যতিরেকে দ্বিতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হলে সে দেশটিও সেই আইনকেই বহাল রেখেছে  কয়েকটি দেশ তো বহু বিবাহ সম্পূর্ণরূপেই  নিষিদ্ধ করেছে যার মধ্যে  মিশর, তুরস্ক ও ইরান রয়েছে  । বাকি দেশগুলিতে বহু বিবাহ  আদালতের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ । তালাকের ক্ষেত্রেও একই আইন করেছ,  অর্থাৎ আদালতের বাইরে তালাক দেওয়া বেআইনী ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে । মূল কথা হলো  গোটা  বিশ্ব  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে বর্জন করেছে অথচ ভারতে  এই আইন আজো চালু আছে ।  
আমাদের  দেশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কারের পথে প্রধান বাধা উলামা (মুসলিম সমাজের  ধর্মগুরুগণ)তাদের পক্ষ থেকে প্রবল বাধা আসাটা স্বাভাবিক । যে সব দেশে এই আইনে সংস্কার  হয়েছে সে দেশগুলিতেও তারা বাধা দিয়েছে প্রবল । সেই প্রবল বাধা অগ্রাহ্য করেই তারা সংস্কার  করেছে । তাহলে ভারত  পারছে না  কেনো ?  পারছে না এ জন্যে যে এ দেশের কোনো সরকারেরই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই । প্রত্যকটি রাজনৈতিক দলের (বিজেপি বাদ) মুসলিম নেতৃবৃন্দও চাই না যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কার হোক । এই নেতাদের মধ্যে দু’ শ্রেণীর লোক রয়েছে । তাঁদের একটা দল ধর্মান্ধ ও গোঁড়া, তাঁরা উলামার মতোই শরিয়ত আইনে (শরিয়ত আইনের একটা অংশ হলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইন) সামান্য সংস্কারেরও ঘোরতর বিরোধী । আর একদল আছে যারা প্রগতিশীল,  শরিয়ত আইন কতোটা  অপকারি, ক্ষতিকারক ও অপ্রাসঙ্গিক তা তাঁরা উপলব্ধি করেন, কিন্তু মুসলিম ভাবাবেগ আহত  হবে বলে তাঁরা এই আইনে  সংস্কার ও  সরকারি  হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন ।  এঁরা জ্ঞানপাপী ও স্বার্থপর, ভোটে জেতার জন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠলেই মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে উলামার সঙ্গে এক সুরে কথা বলেন ।   এই  গোঁড়া ও ধর্মান্ধ এবং জ্ঞানপাপী মুসলিম নেতাদের কথাতেই সীলমোহর লাগিয়ে দেয় সমস্ত রাজনৈতিক দল । এ ব্যাপারে ডান,  বাম, অতি বাম সবাই একই গোত্রভুক্ত,  কারণ নীতি ও  আদর্শগতভাবে সব দলই দেউলিয়া দশাপ্রাপ্ত । ফলে  তারা  মতাদর্শগতভাবে ইসলামি ধর্মান্ধতা ও  গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই করতে অপরাগ ও অক্ষম  এ দেশের বুদ্ধিজীবি ও বিদ্বজন বলে খ্যাতি ওয়ালা মানুষরাও আদর্শগতভাবে দেউলিয়া । হয় তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তল্পীবাহক, না হয় মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীহিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা হৈ হৈ করে প্রতিবাদে করেন, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের ভয়ঙ্কর হিংস্র আক্রমণেও তাঁদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙে না । মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল মানুষরা আক্রান্ত হলে, কিংবা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে  লক্ষ লক্ষ  মুসলিম নারী নির্যাতিত হলে, তাদের মানবাধিকার লংঘিত হলেও তাঁরা রা কাড়েন না । বলেন,  ওটা মুসলমানদের ব্যাপার,  মুসলমানদেরই বুঝে নিতে হবে । ওঁদের বিচারে মুসলিম মহিলারা শুধু মুসলিমই, মানুষ নয়, তাই তাদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার থাকতে নেই ।
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুদের  চেয়ে এই সমাজের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা অনেক বেশী ক্ষতিকারক ।  ধর্মগুরুরা তো সোজা ব্যাটে খেলেন, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন না । তাঁরা সাফ সাফ বলেন,  আল্লাহর আইনে হস্তক্ষেপ মানবো না ।   এই আইনে  বহু বিবাহ ও তালাক সহ যা যা আছে   তা যতই প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাদপদ হোক সবই তাঁদের চোখে সবই উৎকৃষ্ট, তাঁরা বলেন আল্লাহর চেয়ে উৎকৃষ্ট আইন মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় ।  তাই  তাঁরা যে কোনো মূল্যে শরিয়ত আইনকেই আঁকড়ে থাকতে চান ।   অপরদিকে মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা ও বুদ্ধিজীবীরা  অসৎ ও প্রতারক ।  তাঁরা  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে টিকিয়ে রাখার জন্যে নানা যুক্তির অবতারণা করেন যা আসলে অপযুক্তির নামান্তর  তাঁদের যুক্তি হলো, ভারতে সব ধর্মের মানুষের জন্যেই  ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত আইন রয়েছে ।   ভারতের মতো বহু বর্ণ, ভাষা ও ধর্মের দেশে এই ভিন্নতা স্বাভাবিক জোর করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক  বিষয়ে  অভিন্ন আইন  প্রবর্তন করলে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । সতিকারের সৎ প্রগতিশীল মানুষদের উচিৎ সমস্ত প্রকার পশ্চাদপদ ব্যক্তিগত আইনগুলির অবসান করে সকলের জন্যে একটি অধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ  অভিন্ন আইন প্রণয়ন করার দাবি তোলা এবং তার পক্ষে জনমত গঠন করা । কিন্তু মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবিরা ভিন্ন ভিন্ন যে ব্যক্তিগত আইন রয়েছে তাকেই  ঢাল করে বা যুক্তি হিসেবে খাড়া করে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে রক্ষা করতে চাইছেন ।  এটা যে অপযুক্তি তা বলা বাহুল্য । অপযুক্তি ছাড়াও এই লোকগুলো শরিয়ত আইনের পক্ষে সীমাহীন মিথ্যা প্রচারণা করতে সিদ্ধহস্ত তাঁরা বলেন যে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া শরিয়ত আইন সমর্থন করে না এবং  শরিয়ত আইন  বহু বিবাহকেও  উৎসাহ দেয় নাতাঁদের দাবি হলো বহু বিবাহ ও তালাকের যে ঘটনাগুলো ঘটে তারজন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন দায়ী নয়, দায়ী এই আইনের অপব্যবহার  সুতরাং বহু বিবাহ ও তালাকের ঘটনাগুলি রোধ করার জন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বদল বা রদ করার দরকার নেই, দরকার হচ্ছে এই আইন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা ।   
শরিয়ত আইনে একসঙ্গে তিন তালাক অবৈধ এবং এই আইন বহু বিবাহকেও উৎসাহিত করে না বলে যে প্রচারণা তাঁরা করেন তা নির্জলা মিথ্যাচার বৈ নয় । শরিয়ত আইনের প্রধান দু’টি স্তম্ভ হলো কোরান ও হাদিস । হাদিস বলছে যে মুহাম্মদ নিজেই  তিন তালাককে বৈধতা  দিয়ে যান ।  পরে  দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক ডিক্রি জারি করে  এক সঙ্গে তিন তালাককে  শরিয়তি আইনের অন্তর্ভুক্ত করে যান । এর সপক্ষে অনেক হাদিস  আছে , সে রকম একটি হাদিস হলো – “ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম(রঃ)  রেওয়ায়েত করেছেন, তাউস(রঃ) বলে যে, আবু ছাহাবা (রঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) –কে বললেন, আপনার সে দুষ্প্রাপ্য এবং অভিনব ধরণের হাদীস হতে কিছু পেশ করুন । রাসূলে পাক(সাঃ) এবং আবুবকর (রাঃ) –এর যমানায় তিন তালাক কি এক তালাক ছিল না ? তিনি বললেন, তা ছিল বৈ কি ।  পরে যখন ওমর (রাঃ) – এর যমানায় লোকগণ অহরহ এবং উপর্যুপুরি তালাক দিতে শুরু করলো । তখন ওমর (রাঃ) তিন তালাকের যথার্থ বিধান তাদের জন্য বাস্তবায়িত করলেন(  মুসলিম শরীফ, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, বাংলাদেশ, ত্রয়োদশ অধ্যায়, হাঃ নং – ৩৫৪০) । শরিয়ত আইন বহু বিবাহকে নিরুৎসাহিত করে বলে যে দাবি করেন মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ  তার পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁরা  পেশ করেন  না । আসল কথা হলো,  নেই তো রাখবেন কী করে । বরং দেখুন কোরান ৪/৩ নং আয়াতে  কী বলছে -  বিয়ে করবে স্বাধীন নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভাল লাগে, দুই, তিন, বা চার জনকে ।’’  এই আয়াতটি  স্পষ্টতই বহু  বিবাহকে  উৎসাহ প্রদান করছে তাছাড়া মুসলমানদের নিকট যাঁরা চিরো আদর্শ পুরুষ  সেই মুহাম্মদ ও তাঁর খলিফাগণও তো বহু বিবাহ করে বহু বিবাহে ব্যাপক উৎসাহ দিয়ে গেছেন । মুহাম্মদ ঠিক কয়টি বিয়ে করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছেতবে সর্ব নিম্ন চোদ্দটি যে বিয়ে করেছিলেন তা  তর্কাতীত ও সংশয়াতীত আর  তাঁর   সেরা চার জন খলিফা আবু বকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি এবং  আলিও   অনেকগুলি বিয়ে করেছিলেন । প্রথম খলিফা আবু বকর করেছিলেন চারটি বিয়ে, দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক করেছিলেন সাতটি, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি করেছিলেন আটটি এবং চতুর্থ খলিফা মুহাম্মদের জামাই  আলি করেছিলেন এগারোটি ।  তবে কোরানের নির্দেশ কেউ লঙ্ঘন করেন নি,  কেউই  চারজনের বেশী পত্নী  এক সঙ্গে  একত্রিত  করেন নি । বিবাহিত পত্নী ছাড়াও তাঁদের সকলেরই বহু উপপত্নী ছিলো । আলির ছিলো ১৯ জন উপপত্নী 
ভারত জুড়ে মুসলিম সমাজে বহু বিবাহ ও তালাকের যে সংস্কৃতি চালু আছে তা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের কারণেই । এই সত্যটাকে আড়াল করার জন্যে এ দেশের ধান্দাবাজ মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ মিথ্যাচার করে চলেছেন ।  আর তাদের মিথ্যাচারের বলি হচ্ছে ভারতীয় মুসলিম মহিলারা । সেই মহিলাদের রক্ষা করার জন্যে সর্বোচ্চ আদালত তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার জন্যে সৎ ও সাহসি পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হয়েছে । এই আদালতের দুই সম্মানীয় বিচারপতি বলেছেন যে মুসলিম মহিলাদের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার দিতে হলে সতীদাহ প্রথার মতো ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’কেও বাতিল করতে হবে না, সত্যি এর কোনো বিকল্প নেই ।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...