Thursday, September 10, 2015

মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ সঙ্ঘ পরিবারের বিভ্রন্তিকর ও প্ররোচনামূলক মিথ্যা প্রচারণা

 
অবশেষে ২০১১ এর ধর্মভিত্তিক জনগণনার রিপোর্টটি  প্রকাশিত হলো । আরএসএস এবং বিজেপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলি  দীর্ঘদিন থেকেই এ রকম রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানিয়ে এসেছে জাতীয় কংগ্রেস, বামদলগুলি এবং আঞ্চলিক দলগুলির অধিকাংশই এ রকম রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করার বিপক্ষে ছিলো তাই কংগ্রেসের সরকার  এবং পরে  তাদের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার    আরএসএস ও বিজেপির দাবিকে বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে, কখনোই জনগণনার ধর্মভিত্তিক চিত্রটি প্রকাশ করে নি ।  বিজেপির সঙ্গে এই প্রশ্নে তাদের এনডিএ জোটের সব শরিকদলও এ প্রশ্নে একমত নয় ।  ফলে বিজেপি এর আগে ক্ষমতায় আসলেও এই রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে নি ।  এবার বিজেপির  একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা  রয়েছে বলে  মোদি সরকার  ধর্মভিত্তিক জনগণনার রিপোর্টটি প্রকাশ করতে পারলো   মোদি সরকারের কিন্তু জাতিগত রিপোর্ট প্রকাশের আগ্রহ নেই  । সামনে বিহারে ভোট আছে,  জাতিগত জনগণনার রিপোর্ট সামনে এলে ব্রাহ্মণবাদী দল বিজেপির অসুবিধা হবে এবং অপরদিকে লালু, মুলায়ম ও নীতিশদের সুবিধা হবে বলে সে রিপোর্টটি প্রকাশ  করার ব্যাপারে তাই সরকারের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না  
ধর্মনিরপেক্ষ ও  গণতান্ত্রিক দলগুলি  যে আশঙ্কা  ধর্মভিত্তিক জনগণনার চিত্রটি জনসমক্ষে আনতে চায় নি,  রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেলো যে সে আশঙ্কাটি মিথ্যে ছিলো না ।  হিন্দু মৌলবাদীরা  রিপোর্টটি নিয়ে নানা প্রকার বিভ্রান্তিমূলক, বিদ্বেষমূলক ও প্ররোচনামূলক প্রচারে মত্ত হয়ে উঠেছে । কী ধরণের সে প্রচার সে কথায় পরে আসছি । এ রকম প্রচারের উদ্দেশ্য হলো  হিন্দুদের  মধ্যে  মুসলিমদের বিরুদ্ধে  অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করা । বিজেপি যতই গোপন করুক, এটা  একটা হিন্দুমৌলবাদী  দল   মুসলিম দলন ও দমন এবং হিন্দুরাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠা করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ।  তারা জানে যে মানুষের মধ্যে ধর্মীয়  মেরুকরণ যতো ঘটবে তাদের শক্তি ততো বাড়বে এবং ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ সুগম হবে  সে উদ্দেশ্যে নিয়েই  ধর্মভিত্তিক জনগণনার তথ্য  প্রকাশ করার দাবিতে তারা সরব ছিলো তাই রিপোর্টটি হাতে পেতেই  সেটাকে একটা  হাতিয়ার হিসেবে  ব্যবহার করতে  মাঠে নেমে পড়েছে এক্ষেত্রে তাদের সুবিধা হয়েছে এই  যে  ধর্মীয়  মেরুকরণ ও বিভাজন ঘটাবার  কাজে ইন্ধন দেওয়ার মতো  কিছু উপাদান রিপোর্টের  মধ্যে তারা পেয়েছে যেমন  এক). হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির  হার কমেছে প্রায় ০.৭%, অপরদিকে মুসলিম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ০.৮% ।  দুই). পশ্চিমবঙ্গে শুধু মুর্শিদাবাদ জেলায় এতদিন মুসলিমরা সংখ্যাগুরু ছিলো, এবার  মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরেও  তারা সংখ্যাগুরু হয়ে গিয়েছে । হিন্দুদের  জনসংখ্যার হার  কমছে এবং উল্টোদিকে  মুসলিমদের বাড়ছে,  বাড়তে বাড়তে দু’ একটা জেলায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে – এটাকে  তারা  অস্ত্র  হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে বলছে,  এভাবেই  একদিন  ভারতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে,  ভারতকে  আবার তারা  শাসন করবে  এবং তখন ভারত হয়ে উঠবে  হিন্দুদের বধ্যভূমি ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে এরূপ  বিষাক্ত  প্রচার  হিন্দু জনমানসে কিন্তু ক্রমশঃ বিশ্বাসযোগ্য যে হয়ে উঠছে  বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার অবশ্য কিছু কারণও  রয়েছে   দুটি বড়ো  কারণ তো  খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর  হচ্ছে সকলের  যেমন  এক). মুসলিম মৌলবাদীদের অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক আচরণ এবং  সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড দুই). তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলির মুসলিম মৌলবাদীদের নির্লজ্জ তোষণ ।  এর ফলে   হিন্দু জনমানসে মুসলিমদের প্রতি ক্রমশঃ  বিরূপ ও বিরুদ্ধ  মনোভাব তৈরী হচ্ছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে যদি  কয়েকটি ঘটনার কথা আমরা স্মরণ করি । ঘটনা এক).  ১৯৮৫ সালে শাহবানু মামলায় সুপ্রীম কোর্ট তাঁর পক্ষে খোরপোষের রায় দেয়  যে রায়ের বিরুদ্ধে মুসলিম মৌলবাদীরা রাস্তায় নামে দেশ জুড়ে বলে, সুপ্রীম কোর্ট  তাদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, এ রায় তারা মানবে না । সুপ্রীম কোর্টের রায়কে মানবো না বলা ফৌজদারী অপরাধ । তবুও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকার  তাদের  বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করে নি । উল্টে তাদের তুষ্ট করতে  সংসদে আইন প্রণয়ন করে সেই রায়টাই বাতিল করে দেয়দুই). ২০০৭ সালে মুসলিম মৌলবাদীরা তসলিমার মুণ্ডুচ্ছেদের ফতোয়া দেয় কলকাতায় প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে ।  ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনি পদক্ষেপ তো রেই নি,  ঘুরিয়ে ঐ ফতোয়ার কিছুদিন পরই তসলিমাকেই  কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেয়  তিন).  একটি মুসলিম মৌলবাদী ছাত্র সংগঠন ২০১০ সালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফতোয়া জারি করে বলে,   সমস্ত ছাত্রী ও নারী অধ্যাপকদের  বোরখা পরতে হবে ছ’জন নারী অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের নিকট এর প্রতিবাদ করেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার কার্যতঃ ফতোয়াকেই সমর্থন করে ফলে পাঁচ জন অধ্যাপক ফতোয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেন  একজন অধ্যাপক, শিরীন মির্দা, ফতোয়ার কাছে নত হন নি বলে পদে পদে তাঁকে উত্যক্ত ও অপদস্থ করা হতোএবং অবশেষে  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকেই অন্য ক্যাম্পাসে   transfer করে দেয়   চার).   কিছু দিন আগে  মালদা জেলায়   একটি  ক্লাব  রাজ্য স্তরের একটি মহিলা ফুটবল প্রদর্শনী খেলার আয়োজন করেছিলো মুসলিম মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে  বিডিওকে ডেপুটেশন দিয়ে  বলেন যে,  মহিলাদের ফুটবল খেলা  ইসলাম-বিরুদ্ধ , এ খেলা বন্ধ করতে হবে ।  তাঁরা বিডিওকে হুমকিও দিয়ে  বলেন যে খেলা বন্ধ না করলে আগুন জ্বলবে । বিডিও  ওদের দাবি মেনে খেলাটি বন্ধ করে দেন  পাঁচ). ২০০৭ সালের ২১শে নভেম্বর  তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর দাবিতে মুসলিম মৌলবাদীরা  রাস্তা অবরোধের  নামে  কলকাতা  জুড়ে  তাণ্ডব চালিয়েছিলো  এবং গোটা কলকাতাকেই অবরুদ্ধ করে দিয়েছিলো সরকারি-বেসরকারি যানবাহন, অফিস, দোকানপাটে ভাঙচুর চালিয়ে ও আগুন লাগিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিলো । তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেষ পর্যন্ত  মিলিটারিও নামাতে হয়েছিলো । এতো বড়ো তাণ্ডবের পরেও দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে পুলিশ কার্যতঃ কোনো পদক্ষেপ করে নি ।  ছয়).  খুব সম্প্রতি  শিয়ালদহ হয়ে জনা ৬২ মাদ্রসার ছাত্র যাচ্ছিলো দক্ষিণ ভারতে  পুলিশ তাদের কাছে কাগজপত্র দেখতে চায়েখাতে না পারলে পুলিশ আটক করে ।  এ খবর পাওয়া মাত্রই  মুসলিম মৌলবাদীরা শিয়ালদহ জুড়ে তাণ্ডব চালায় । এই ঘটনার পরের শুক্রবার ঐ একই কারণে জুম্মার নামাযের পর  তারা পার্ক সার্কাসেও তাণ্ডব চালায় ।   মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তাণ্ডবাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে সংশ্লিষ্ট পুলিশদেরই  তিরস্কার করেন  কাগজপত্র দেখতে চেয়েছিলো বলে  সাত).  পাকিস্তান ও বাংলাদেশের  সন্ত্রাসবাদীরা পশ্চিমবঙ্গকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করতো বাম আমলে  মমতা ব্যানার্জীর আমলে পশ্চিমবঙ্গে  কয়েকটি ঘাঁটি  তৈরী করে ফেলেছে   এটা   জানাজানি হয় বর্ধমান শহরের খাগড়াগড়ে গ্রেনেড বিষ্ফোরণের পর । তখন এও জানা যায় যে  রাজ্যের অনেক  খারিজি মাদ্রাসাকেই বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদীরা  ঘাঁটি  বানিয়েছিলো ।   মাদ্রাসায় বসে তারা   জেহাদি নিয়োগ করতো  এবং তাদের জেহাদি শিক্ষা ও অস্ত্র-প্রশিক্ষণ   দিতো ।       
মুসলিম মৌলবাদীদের কার্যকলাপকে গোটা মুসলিম সমাজ সমর্থন করে না ।   কিন্তু তারা যেহেতু অসংগঠিত তাই   রাস্তায় নেমে তাদের  বিরোধিতা করে  না । তাদের এই অসহায় নীরবতাকে মুসলিম মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের পক্ষে সম্মতি বলে ধরে  নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে  প্রচার চালানো হয় যে মুসলমান মাত্রই গোঁড়া, জিহাদি, সন্ত্রাসী ও দাঙ্গাবাজ । মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে এ এক ভয়ঙ্কর অবমূল্যায়ন ।  মুসলিম মৌলবাদীদের  এরূপ কার্যকলাপে প্রতিবেশী হিন্দুমনে   প্রভাব  পড়া অস্বাভাবিক নয়  এটা ইন্টারনেটের যুগ, সব খবর মুহূর্তের মধ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে  যাচ্ছে ।  ফলে সমগ্র হিন্দু সমাজই প্রভাবিত হচ্ছে । এমন কি যারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে  তারাও ।   হিন্দু সমাজের অনেকের মনেই মুসলিমদের সম্পর্কে তাই  ভয়-ভীতি তৈরী হচ্ছে  । ফলে হিন্দুত্ববাদীরা  মুসলিমদের সম্পর্কে যে সব অসত্য, আপাত সত্য, অর্ধ সত্য, বিকৃত সত্য  বক্তব্য প্রচার করছে তা সাধারণ হিন্দু  জনগণ  পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারছে না  শুধু সাধারণ হিন্দু জনগণই নয়, উচ্চ শিক্ষিত ও  উচ্চ বিত্ত হিন্দু সমাজের একাংশ, এবং এমনকি আদর্শগতভাবে যারা  হিন্দুত্ববাদের বিরোধী তারাও প্রভাবিত হচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রে  
হিন্দুত্ববাদীরা কী কী প্রচার করছে সেদিকে এবার নজর দেয়া যাক ।  তারা বলছে যে   মুসলমানদের  ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি  কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয় ।   পরিকল্পনা করে তারা  জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে ।  জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বেশী বেশী  সন্তান  উৎপাদন করছে, আর অন্যদিকে ভারতে  মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে ।  তাদের আশু লক্ষ্য  হলো পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা, তারপর ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে   ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করা ।  ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্যে  কী হারে  মুসলিমরা  সন্তান উৎপাদন করছে তা বোঝাতে গিয়ে  সঙ্ঘ পরিবার ‘আট বনাম আটান্ন’-র একটা গাণিতিক গল্প প্রচার করছে । গল্পটা এ রকম – একটি হিন্দু দম্পতি পরিবার পরিকল্পনা অনুসারে দুটি সন্তান জন্ম দেয় । সেই দুটি সন্তান জন্ম দেয়  প্রত্যেকে  দুটি করে । অপরদিকে একটি মুসলিম দম্পত্তি জন্ম দেয় সাতটি  সন্তানের । তারা প্রত্যেকে জন্ম দেয় আরো সাতটি করে । সুতরাং দু প্রজন্ম পর হিন্দুরা  হবে আট জন, অপরদিকে দু’জন মুসলমান থেকে তারা হবে আটান্ন ।   অনুপ্রবেশ কী মাত্রায় হচ্ছে সে সম্পর্কে প্রচার চালাতে গিয়ে তারা একেক সময় একেক তথ্য সূত্র উল্লেখ করে একেক রকম প্রচার করছে ।   এ প্রচারে সামিল হচ্ছেন অহিন্দুত্ববাদীরাও একটা উদাহরণ দেয়া যাক ।   মোহিত রায় একজন  বিশিষ্ট  লেখক  যিনি  হিন্দুত্ববাদী নন বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন  তিনিও মুসলিম অনুপ্রবেশ  নিয়ে  তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করে  কড়া কড়া প্রবন্ধ লিখছেন,   বইও  লিখছেন তিনি একটি প্রবন্ধে  ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে’র সূত্র উল্লেখ করে  করে লিখেছেন, “সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সরকারী ভাষ্যেই ১৫ বছরে সাড়ে চার লক্ষ্য বাংলাদেশীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যার প্রায় ৭৫% মুসলমান । যদি ধরা যায় মাত্র ১০% ধড়া পড়ে, বাকিরা ধরা পড়ে না, তাহলে এই হিসেব মতো প্রতি বছর তিন লক্ষ বাংলাদেশী ভারতে চলে আসেন তবে তিরিশ বছরে এর মোট সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি, যার মধ্যে ৭৫ লক্ষ মুসলমান অনুপ্রবেশকারী । এর থেকে অনুপ্রবেশের ভয়াবহতা বোঝা কঠিন নয় ।” (সূত্রঃ পর্বান্তর, ১ অক্টোবর ২০১০, পৃ - ১২০)   মোহিত  সে লেখাতেই  একটি আধা বাস্তব ও আধা কল্পিত লেখচিত্র এঁকে  ভবিষ্যত বাণী করে বলেছেন  যে ২০৫৩ সালে মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গে  সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে এবং তখন পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চিতভাবেই হিন্দুদের বধ্যভূমিতে পরিণত হবে ।    
ধর্মভিত্তিক জনগণনার রিপোর্টটি খবর করার ক্ষেত্রেও সংবাদপত্রগুলির ভূমিকা হিন্দুত্ববাদীদের অপপ্রচারকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে  ২৬শে আগষ্ট ২০১৫ আনন্দবাজার হেডলাইন করেছে – “হিন্দু কমে ৯৬ কোটি, মুসলিম বেড়ে ১৭”  হিন্দু জনসংখ্যা কি সত্যিই কমেছে ? ডাহা মিথ্যে।  ২০০১ সালে ভারতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ১০২ কোটি, ২০১১ সালে হয়েছে ১২১ কোটি । এক দশকে  বেড়েছে ১৮.১ কোটি ।  ঐ একই দিনে টাইমস অফ ইণ্ডিয়া হেডলাইন করেছিলো – “Muslim share of population up 0.08%, Hindus’ down 0.07% ”  এই  শিরোনামেও জনগণনার রিপোর্টের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হয় নি মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি ০.৮% হয়েছে ঠিকই, কিন্তু  বৃদ্ধির হার আগের দশক থেকে প্রায় ৫% কম যা হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারকে নস্যাৎ করে । ২০০১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ২৯.৩%, ২০১১ সালে তা কমে হয়েছে ২৪.৬% ।  মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে নিম্নমুখী – এটা হওয়া উচিৎ ছিল শিরোনাম, অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটিই প্রচারে আসলো না । 
মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা শুধু নানা রূপ বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তাই নয় ।  কীভাবে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিহত করতে হবে সেটাও প্রচার করছে ।  এ ব্যাপারে তারা একদিকে হিন্দুদের  বলছে বেশী বেশী করে সন্তান উৎপাদন করতে, আর একদিকে  মুসলিমরা যাতে দুই-এর বেশী সন্তান উৎপাদন করতে না পারে তারজন্যে সরকারের কাছে  আইনি কড়া ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছে ।  হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলছে  যে দম্পত্তি পাঁচটি সন্তান জন্ম দেবে তাদের দু’লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবেশিবসেনা আগ্রা ইউনিটের প্রধান বিনু লাভানিয়া বলেছেন,  “হিন্দুর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রবণতায় উদ্বিগ্ন হয়েই তাঁদের এই উদ্যোগ । তিনি জানিয়েছেন, ২০১০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে যেসব হিন্দু পরিবারে পাঁচটি সন্তানের জন্ম হয়েছে, ২ লাখ রুপি করে পুরস্কার পাবে । এজন্য পুরসভার দেয়া জন্মের শংসাপত্র পেশ করতে হবে তাদের ।” (সূত্রঃ দ্য বেঙ্গলি টাইমস ডটকম ডেস্ক, ৪/৯/১৫)  বিশ্বহিন্দু পরিষদ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া সরকারের কাছে  দাবি   করেছেন যে মুসলিম পরিবারে দু’টির বেশী সন্তান হলে তাদের বিরুদ্ধে  শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে ।   কী রকম শাস্তি ?  “যদি মুসলমানরা দু’টির বেশী সন্তান জন্ম দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করে কেস চালানো উচিৎ এবং সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা উচিৎ । ওই সব মুসলমানদের চাকরি, এবং শিক্ষার সুবিধাও দেয়া যাবে না । যেসব মুসলিম পরিবার পরিকল্পনা অনুসরণ করবে না তাদের সরকারী চাকরি দেয়া উচিৎ নয় তার রেশন সুবিধা এবং শিক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা উচিৎ ।”    (সূত্রঃ – ঐ)

 

প্রবীণ তোগাড়িয়া এর আগে বলেছিলেন, “যদি এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে ভারত থেকে হিন্দু ঐভাবে সাফাই হয়ে যাবে যেরকম আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে  হয়েছে  
মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারের প্যাকেজে তাদের আরো অনেক বিষাক্ত তূণ  আছে । যেমন  ‘ঘর ওয়াপসি’ ও ‘লাভ জিহাদ’ ইত্যাদি ।  ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে যেসব প্রচারণা  করা হচ্ছে তা ভীষণ  প্ররোচনামূলক ।  বলছে, মুসলিম যুবকরা  ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে  হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করছে তাদের ধর্মান্তরিত  করার জন্যে তাই তাদের পাল্টা ‘লাভ জিহাদে’র কর্মসূচী ।  তারা  হিন্দু যুবকদের বলছে,  তোমরাও মুসলিম মেয়েদের ভালোবাসার প্রলোভন দেখাও, তারপর  ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করো  । আর অপরদিকে হিন্দু  নারীদের বলছে তোমরা মুসলিম যুবকদের ভালোবাসার ফাঁদে পড়ো না । তারা প্রেম নিবেদন করলে তাদের জুতা মারো । এ প্রসঙ্গে বিজেপি নেত্রী স্বাধ্বী প্রাচীর   বলেছেন,   মুসলিম যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কীভাবে তারা হিন্দু মেয়েদের ফাঁসাবে এবং ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করবে ।  বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু মেয়েদের মুসলিম বানিয়ে ফেলা হয় । এইভাবে বাড়ছে মুসলিমদের জনসংখ্যা । তারা বিয়ে করে একের পর এক সন্তান ধারণ করতে বাধ্য করে ।  তাই  স্বাধ্বীর পরামর্শ -  কেউ যদি প্রেম নিবেদন করে তাহলে তাদের পাথর ছুঁড়ে মারুন   ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচীও মূলতঃ মুসলিমদের বিরুদ্ধে । আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলছেন আমরা ভারতীয়রা সবাই হিন্দু, অতএব সবাই ঘরে ফিরে এসো অর্থাৎ সবাই হিন্দু হয়ে যাও । আদিবাসী খৃস্টান ও মুসলিমদের কোথাও জোর করে, কোথাও নানা প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছে ।  

সঙ্ঘপরিবার তাদের মুসলিম-বিরোধী ও মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারণার সুর  ক্রমশঃ উচ্চগ্রামে নিয়ে যাচ্ছে  যে দু’টি বিষয়কে ঘিরে তা হলো  মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মুসলিম অনুপ্রবেশ । সঙ্ঘপরিবার বলছে,  যা আগেই লিখেছি,  মুসলমানরা  দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে এবং মুসলিম অনুপ্রবেশ  ঘটাচ্ছে । তাদের আশু লক্ষ্য হলো, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে নিয়ে  বৃহৎ বাংলাদেশ গঠন করা, এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভারতকে পুনরায় দখল করা মুসলিম মৌলবাদীরা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামকে নিয়ে বৃহত বাংলাদেশ গঠন করা বা ভারতকে দখল করে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিবাস্বপ্ন দেখে না তা নয় ।   কিন্তু সমস্ত মুসলিমরাও  সেই দিবাস্বপ্ন দেখে, মুসলিমরা সবাই মৌলবাদী  এবং  সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে মদত দেয় বা সমর্থন করে এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ অবাস্তব ও ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সম্পূর্ণ  ভিত্তিহীন এই অভিযোগও যে ভারতের সমস্ত মুসলিমরাও  মৌলবাদিদের সেই পরিকল্পনা অনুসারেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি  করছে এবং বাংলাদেশের মুসলিমরা  ভারতে অনুপ্রবেশ করছে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের  জন্মহার  বেশী  এবং বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে  তা সংশয়াতীত । কিন্তু  সকল  মুসলমানই একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক জন্মহার বৃদ্ধি করছে এবং বাংলাদেশের মুসলিমরা ভারতে অনুপ্রবেশ করছে তা  সর্বৈব মিথ্যা ও উদ্দেশ্য  প্রণোদিত । ১৯৫১ থেকে  সেনসাস রিপোর্টগুলি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে যে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পশ্চাতে কোনো পরিকল্পনাই নেই, যা আছে তাহলো তাদের দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা,  বাস্তব জ্ঞান ও  চেতনার অভাব    ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণনার রিপোর্টগুলির উপর এবার একটু চোখ বোলানো যাক ।
সারণী – ১       

                 ভারতের মোট জনসংখ্যায় হিন্দু ও মুসলিমদের অংশ (%)
                     ১৯৫১      ১৯৬১      ১৯৭১      ১৯৮১      ১৯৯১     ২০০১       ২০১১
                    
হিন্দু                ৮৪.১      ৮৩.৪৫     ৮২.৭৩      ৮২.৩     ৮১.৫৩    ৮০.৪৬      ৭৯.৮

মুসলিম            ৯.৯        ১০.৬৯      ১১.২১      ১১.৭৫    ১২.৬১     ১৩.৪৩       ১৪.২৩


সারণী – ২  [মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার %]

দেশ/রাজ্য   ১৯৬১-৭১  ১৯৭১-৮১  ১৯৮১-৯১  ১৯৯১-২০০১  ২০০১-২০১১

ভারত          ৩০.৮৪    ২৩.০৪      ৩৪.৪৪       ২৯.৩            ২৪.৬  

পশ্চিমবঙ্গ       ২৯.৭৬    ২৯.৫৫      ৩৬.৮৯       ২৫.৯১            

 
   
সারণী ১ থেকে  কী পরিলক্ষিত হচ্ছে তা  দেখা যাক ।  ষাট বছরে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪.২৩ – ৯.৯ = ৫.১৪%, অর্থাৎ বছরে মাত্র ০.০৮%   ১৯৬১ তে  ১৯৫১ অপেক্ষা  মুসলিম জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে  ১.১%, তারপরের দশকগুলিতে যথাক্রমে বৃদ্ধি হয়েছে  ০.৫২%, ০.৫৪%, ০.৮৬%, ১.৮২%, এবং ০.৮% ।  অর্থাৎ ১৯৫১ থেকে ৬১-র দশকে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে ১.১%, কিন্তু তারপর পর পর তিনট দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১%-র নীচে । আবার  ২০০১ – ২০১১ দশকে পূর্বের দশক থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা নিম্নমুখী ।   মুসলিমরা ভারত গ্রাস করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে জন্মহার বৃদ্ধি করলে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির  গতি এতো শ্লথ হতো না এবং প্রতি দশকেই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির গতি ঊর্ধমুখী থাকতো, কখনই নিম্নগামী হতো  না  । সারণী ২ থেকে  কী পরিলক্ষিত হচ্ছে তা  দেখা যাক ।   ষাটের দশক থেকে জন্মহার বৃদ্ধি কমেছে প্রায় ৮%, তার পরের দশকে অনেকটাই বেড়ে গেছে - ১১.৪%, কিন্তু তার পরের দু দশকেই জন্মহার ক্রমাগত কমেছে,  এই কমাটা অল্প স্বল্প কমা নয়, কমেছে অনেকটাই,  প্রায় ৫% হারে । এই চিত্রটি দুটি কথা স্পষ্ট করছে, তাহলো – এক).  জন্মহারের লেখচিত্রটি ক্রমাগত ঊর্ধমুখী নয়, বরং শেষের দু’দশকে এই লেখচিত্রিটি নিম্নমুখী । মুসলিমদের ভারতকে দখল করার পরিকল্পনা থাকলে এটা হতো না । দুই). শেষের দু’ দশকে মুসলিমদের জন্মহার কমেছে  ৫ শতাংশ হারে,  এটা বড়ো মাত্রায় হ্রাস । এটা একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে মুসলিমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে এবং তাদের মধ্যেও  মধ্যেও  জন্ম নিয়ন্ত্রণ করার চেতনা ও প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এটা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা সঙ্ঘ পরিবারের অভিযোগটি নস্যাত করে  
         এবার আসি পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে । এখানে নাকি মুসলিম জনসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মুসলিম অনুপ্রবেশের কারণে আর অনুপ্রবেশটাও হচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক । সত্যি কি তাই ? ব্যাপারটা কী দেখা যাক । সারণি ২ - এ ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য দেয়া হয়েছে ।   তাতে দেখা যাচ্ছে যে ষাট ও সত্তরের দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় একই আছে । পরিকল্পনা করে অনুপ্রবেশ করলে তো মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি হবার কথা । আশির দশকে জনসংখ্যা এক লাফে বৃদ্ধিপায় ৬.৫১% । ব্যাপক হৈ চৈ পড়ে যায় -  দেখো, কী ভয়বঙ্কর  মাত্রায় মুসলিম অনুপ্রবেশ হয়েছে! কিন্তু পরের দশকেই বিপরীত চিত্র । জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস পায় এক লাফে ১১%, রেকর্ড মাত্রায় হ্রাস । সঙ্ঘ পরিবার এবার নীরব । পরিকল্পনা করে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির লেখচিত্র তো ঊর্ধমুখী হবে, উল্টে  হ্রাস পেয়েছে ১১% । তাহলে পরিকল্পিত অনুপ্রবেশের তত্ত্ব কী দাঁড়াচ্ছে ? এবার তুলনা করা যাক, সমগ্র ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের । ষাটের দশকে ভারতের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১% কম ছিলো,  কিন্তু সত্তরের দশকে সেটা বেড়ে যায় ৬.৫১% ।  এটা কেনো ? তা না কি এজন্যে যে   ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর থেকেই ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে পরিকল্পনা করে । কিন্তু তারপর দেখা যাচ্ছে যে ছবিটা অন্য কথা বলছে ।  আশির দশকে ভারতের  তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে ঊর্ধ গতি অব্যাহত থাকলেও তার হার কিন্তু অনেক কমে যায়, ৬.৫১% থেকে কমে হয় ২.৪৫% । আর তার পরের দশকে অর্থাৎ নব্বই-এর দশকে তো দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি, ভারতের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, প্রায় ৩.৫% । এই চিত্রটি সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পনা মাফিক বাংলাদেশ থেকে ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশের অভিযোগকে নস্যাত করে দেয় ।


অনুপ্রবেশের জন্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে তার প্রভাব বেশী পড়বেই ।  বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত জেলাগুলির মধ্যে পড়ে  মালদা, মুর্শিদাবাদ, কুচবিহার এবং দক্ষিণ দিনাজপুর  । ব্যাপকহারে মুসলিম অনুপ্রবেশ হলে এই জেলাগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যা দূরবর্তী জেলাগুলির চেয়ে যথেষ্ট বেশী হওয়ার কথা এবং  অবশ্যই যথেষ্ট  বেশী হওয়ার  কথা রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার অপেক্ষাও    কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নি । ১৯৭১ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে ভারতে  মুসলিম অনুপ্রবেশ হচ্ছে  বলে সঙ্ঘ পরিবার দাবি করছে ।  সুতরাং দেখা যাক  ১৯৭১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত  পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির  চিত্রটা কেমন ছিলো । নীচের সারণিতে সে চিত্রটি  রয়েছে ।
সারণি - ৩  (মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতাংশে)
মুসলিম জনসংখ্যা ও বৃদ্ধির হার
রাজ্য/জেলা             ১৯৭১             ২০০১                 বৃদ্ধির হার (শতাংশে)
পশ্চিমবঙ্গ             ৯০৬৪৩৩৮      ২০২৪০৫৪৪৩              ১২৩.২৯
পঃ দিনাজপুর          ৬৬৭৫৪৩        ১৫১৭৫৫০                 ১২৭.৩৩
মালদহ                 ৬৯৫৫০৪        ১৬৩৬১৭১                 ১৩৫.২৫
মুর্শিদাবাদ             ১৬৫৬৪০৬       ৩৭৩৫৩৮০                 ১২৫.৫১
বাঁকুড়া                ৯৮৪৮৯           ২৩৯৭২২                    ১৪৩.৪০
পুরুলিয়া              ৭৪৪১০            ১৮০৬৯৪                    ১৪২.৮৩
সীমান্ত থেকে অনেক ভিতরে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা । এই দুটি জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার এবং সীমান্তবর্তী জেলাগুলির চেয়ে যথেষ্ট বেশী । এই চিত্র থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির পশ্চাতে প্রধান কারণ নিশ্চয় ব্যাপকহারে  অনুপ্রবেশ নয়   কারণটি কী তা কারো অজানা নয়, তা হলো,  জনবিস্ফোরণের বিপদ সম্পর্কে মুসলিম সমাজের চরম অজ্ঞতা এবং বাস্তব সম্মত জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব । এটা কে না জানে যে যারা যতো  বেশী দরিদ্র ও  নিরক্ষর  তাদের মধ্যে জন্মহার ততো বেশী  । সুতরাং এ দেশে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশী হওয়াটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা । এই বৃদ্ধির পেছনে যারা  পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র দেখছেন তাদেরই নিশ্চয় কোনো  বিশেষ মতলব ও উদ্দেশ্য আছে ।  
উপসংহারে  এ কথা বলতে চাই যে  ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশ হয় না বা এটা কোনো সমস্যা নয় এ কথা আমি বলছি না । যেটা দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই তা হলো, মুসলিম অনুপ্রবেশকে যে দানবীয় চেহারায়  চিত্রিত করা হচ্ছে তা সত্যি ও বাস্তব নয় । এটা করা হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ঘটিয়ে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্যে ।  এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে   ভারতে মুসলিম প্রবেশের ঘটনা নিশ্চয় ঘটছে  এবং এটা নিশ্চয় একটা সমস্যা  এবং   সমস্যাটি নিয়ে আলচনা করার আবশ্যকতাও রয়েছে । কিন্তু এ অভিযোগটি অবশ্যই অতিশয় অতিরঞ্জিত যে অনুপ্রবেশকারীরা সবাই হিন্দুদের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন এবং তারা ভারতকে দখল করতে চায়  মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে নিশ্চয় কিছু মুসলিম মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীরা আছে তা সংশয়াতীত, কিন্তু  এটাও একশ’ ভাগ সত্যি যে সবাই মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী নয় । অনুপ্রবেশ একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা । নানা কারণে এটা হয় ।  তার মধ্যে  একটা বড়ো কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক । দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষ  কর্মসংস্থান এবং রুটি-রুজির  জন্যে  অবৈধভাবে পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভিন দেশে পাড়ি দেয় ।  কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ থেকে যেসব মুসলমান  ভারতে অবৈধভাবে ঢুকছে তাদের অধিকাংশও এই একই কারণেই ঢুকছে,  পেটের দায়ে ঢুকছে, জিহাদ করে ভারতে ইসলামি রাষ্ট্র বানাবার জন্যে ঢুকছে না   







KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...