Sunday, July 12, 2015

বিজেপির পক্ষে মুসলিম ভোট টানতে অবশেষে আরএসএসও মোল্লাতোষণের নাটক শুরু করলো




আরএসএস সম্প্রতি একটি কিছু কর্মসূচী হাতে নিয়েছে যা একেবারেই অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় । তারা ঠিক করেছে যে উলামার [উলামা হলো আলেমের বহু বচন;  মাওলানা, মুফতি, ইমামদের আলেম বলে]  সাথে তারা বৈঠ ক করবে । এ কর্মসূচী রূপায়নের  জন্যে আরএসএস তাদের মুসলিম শাখাকে দায়িত্ব দিয়েছে । ৮ই আগষ্ট লক্ষৌতে এ রকম একটি বৈঠক হওয়ার কর্মসূচী নির্ধারিত আছে  । আরএসএস এ বছর বেশ কিছু ইফতার পার্টি দেওয়ারও পরিকল্পনা করেছে যেখানে বিশিষ্ট মাওলানা, মুফতি ও ইমামদের  অনেককেই তারা উপস্থিত  করতে চায় ।  গত ৭ই জুলাই মোরাদাবাদে  একটি  ইফতার পার্টি তারা ইতিমধ্যেই সেরেও ফেলেছে । আরএসএস জানিয়েছে যে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্যে এ উদ্যোগ তারা নিচ্ছে যার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই । কিন্তু তাদের এই কথা কারো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে না, হওয়ার কথাও নয় ।  তারা যে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে ভাগ বসাবার জন্যেই এ সব পদক্ষেপ  করছে তা একেবারেই সংশয়াতীত ।  এ সব পদক্ষেপ স্পষ্টতঃই তাদের আদর্শ, লক্ষ্য  ও নীতিবিরুদ্ধ তা হলে তারা এ সব কেনো করছে ?  করছে তার কারণ হলো,  অনেক দেরীতে হলেও তারা এটা উপলব্ধি  করতে পেরেছে যে, মুসলিমদের  সম্পূর্ণ ব্রাত্য রেখে ভারতের ক্ষমতায় বেশি দিন থাকা যাবে না  বা পুনরায় ক্ষমতায় ফেরা যাবে না     তাই তারা মুসলিমদের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং  তাদের যে মূল লক্ষ্য তার প্রতি অবিচল ও অটল থেকেই তারা এ সব কর্মসূচী নিচ্ছে । বলা বাহুল্য যে  সংসদীয় রাজনীতিতে তারা এক নতুন রণকৌশল ও ধারা আনতে চাইছে    
বাহ্যিকভাবে হলেও আলেম সমাজের  প্রতি আরএসএস এরূপ  নরম মনোভাব নিতে পারে  তা এতো দিন কল্পনারো অতীত ছিলো ।  আরএসএসকে এতো নমনীয় করার মূল কারিগর অবশ্যই  প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ।   বিজেপির নেতাদের  মধ্যে  মোদির প্রতিই সর্বাধিক আস্থাশীল বর্তমান আরএসএস নেতৃত্বের । সে কারণেই তারা লালকৃষ্ণ আদবানির বদলে মোদিকেই প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিক উপযুক্ত মনে করেছিলেন । গভীর এই আস্থার জায়গা থেকেই মোদি আরএসএস নেতৃত্বকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, আরএসএসের  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করা  তাঁর সরকারের পক্ষে  মাত্র পাঁচ বছরে  কোনোমতেই  সম্ভব  নয় ।  এর জন্যে চায় দীর্ঘ সময়  ব্যাপক ধৈর্যআর দীর্ঘ সময় ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন থাকতে হলে   মুসলিমদের সমর্থন লাভ করা অত্যন্ত  জরুরী  । সমস্ত মুসলিম ভোট যদি বিরোধী শিবিরে চলে যায় তবে  পুনর্বার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবণা খুবই ক্ষীণ  । অবশেষে আরএসএস নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদির এই যুক্তি ও বাখ্যা মেনে নিয়েছেন । এবং তারই ফলশ্রুতিতে তারাও  মোল্লাতোষণের রাজনীতি শুরু করেছেন । তবে তাদের এই মোল্লাতোষণ কিন্তু মোটেই আন্তরিক বা  আসল নয়, যেমনটি  ইন্দিরা কংগ্রেস ও  অন্যান্য পেটি বুর্জোয়া দল এবং বামপন্থী দলগুলি করে  থাকে ।  আরএসএসের যা আদর্শ ও কর্মসূচী তাতে তাদের পক্ষে সত্যিকারের মোল্লাতোষণ করা মোটেই সম্ভবও নয় ।  তাই তারা মোল্লাতোষণের ভাণ  করছে মাত্র      মোল্লা সমাজের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করে  মুসলিম সমাজের আস্থা অর্জন করতে চাইছে । তারা বোঝাতে চাইছে যে আরএসএস ও মোদিকে মুসলমানদের আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখন তারাই মুসলমানদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে ।  এতে কাজ কিছু যে হচ্ছে তা বলা বাহুল্য । বিজেপিকে মুসলমানরা এতদিন তাদের শত্রু ভেবে তাদের বিরুদ্ধে যেখানে বিকল্প দল বা শক্তি পেতো তাদেরকেই সমর্থন করতো । এখন মুসলমানরাও ভোট দিচ্ছে বিজেপিকে । মাওলানারাও প্রধান মন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে, দরবার করছে । এই ধর্মীয় নেতারা যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে মোদির স্মরণাপন্ন হচ্ছেন তা নয় । প্রধানতঃ ভয়েই যাচ্ছেন । এটা বুঝেই যাচ্ছেন যে হিন্দু মৌলবাদিদের হাত থেকে বাঁচালে মোদিই বাঁচাবেন, অন্যরা পারবে না । মাওলানারা যে উদ্দেশ্যে বা যে কারণেই যাক না কেনো, তাতে একটা বার্তা যাচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে নীচু মহলে যে বিজেপি ও মোদিকে এখন কিছুটা নিশ্চয়ই ভরসা করা যায় এবং সেই ভরসার জায়গা থেকেই দেখা যাচ্ছে যে  পশ্চিমবঙ্গে অনেক জায়গায় মুসলিমরা কংগ্রেস ও বাম শিবির ছেড়ে  বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে ।  মাওলানাদের আরএসএসের পোস্টারবয় মোদির স্মরণাপন্ন হওয়াটা আবার মুসলিমদের অনেকেই পছন্দ করছে না । কারণ, হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল আরএসএস ও বিজেপি তো মুসলিম সমাজের,  বিশেষ করে মোল্লা সমাজের ঘোষিত শত্রু ।  শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করা কর্তব্য, তার কাছে দরবার করাটা ইসলামে নাজায়েজ [অবৈধ] ।  সাধারণভাবে এতাই ইসলামি নীতি ও সংস্কৃতি । কিন্তু না, ইসলামে এটাই একমাত্র নীতি নয় । সত্যি কথা বলতে গেলে ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট নীতিই নেই ।  যেখানে যেমন সেখানে তেমন নীতি – এটাই ইসলামের বৈশিষ্ট । ইসলাম  বিশ্বাস করে ‘দার-উল-ইসলাম’ ও ‘দার-উল-হারব’ নীতিতে । ‘ইসলামের দেশে’ এক নীতি   ‘শত্রুর দেশে’ আর এক নীতি – এই সুবিধাবাদী নীতিতে ইসলাম বিশ্বাসী  । ইসলামের দেশে কঠোরভাবে ইসলামি নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করো এবং শত্রুর দেশে আপোষ করো – এই হলো  ইসলামের নীতি  । এ প্রসঙ্গ থাক, ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে  । কথা হচ্ছিল আরএসএস কীভাবে  মাওলানাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে ।
নরেন্দ্র মোদি  স্বয়ং এটা শুরু করেছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনের আগে  বিজেপির প্রধান মন্ত্রী পদে মনোনীত হওয়ার পর ।  তিনি তখন একবারও আরএসএসের নাম তাদের কর্মসূচীর কথা মুখে আনেন নি পাছে মুসলমানরা বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে যায় এই ভয়ে    সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের মন থেকে আরএসএস ও বিজেপির আতঙ্ক দূর করা লক্ষ্যে একদিকে তিনি যেমন  বিকাশ ও সুশাসনের কথা বলেছেন  তেমনি তারই পাশাপাশি   শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের পরিবেশ নির্মাণের অঙ্গীকারও  ব্যক্ত করেছেন বারংবার    প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি সেই একই কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন ।  তাঁর কণ্ঠে  মুসলিমবিরোধী বা  মুসলিমবিদ্বেষী স্বর আর  শোনা যায় না । বরং  ইসলাম ও  মুসলমানদের প্রতি প্রশংসাই  বারবার  পঞ্চমুখ হতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে  । ইসলামি সন্ত্রাসবাদের পেছনে তিনি এখন ইসলামের হাত দেখতে পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না সত্যিকারের মুসলমানদের হাতও ।  ইসলামি সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায়   মুসলমানদে উপর তাঁর ষোলো আনা ভরসা আছে বলে পুনঃপুনঃ জানান দিচ্ছেন । বলছেন ইসলামি আদর্শ ও সংস্কৃতির কাছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ পরাস্ত হয়েছে ভারতে ও মধ্যপ্রাচ্যে । ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি এই যে তার এতো প্রশস্তি, সবই নাটকীয় সংলাপ । তিনি মৌলানা ও মুসলমান সমাজে র সঙ্গে প্রতারণা করছেন,  তাদের বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন পেতে চেষ্টা করছেন     এটা ভাবলে ভুল হবে যে  তিনি  আরএসএসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাঁর মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন ।  চারিদিকে ভালভাবে  লক্ষ্য করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি শনৈ শনৈ গতিতে  নীরবে ও নিঃশব্দে  আরএসএসের কর্মসূচী রূপায়ন করে চলেছন । এ কাজে আরএসএস নেতৃত্ব তাঁকে পূরণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন  তাঁরা মুখে সম্প্রীতির কথা বলছেন, লোক দেখানো ইফতার পার্টি দিচ্ছেন  এবং উলামর সঙ্গে বৈঠকে বসতে চাইছেন, কিন্তু  তাদের মাথায় তাদের আসল যে মূল কর্মসুচী সেটা যেমনটা ছিলো তেমনটাই আছে ।  একদিকে বলছেন ভারতবাসী মানেই হিন্দু, পাঁচ বছরের মধ্যে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ করা চাই, সারা দেশে গোহত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে, যারা খৃস্টান ও ইসলাম ধর্মে চলে গিয়েছিল তাদের আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে হবে, আর একদিকে ইফতার পার্টি দিচ্ছেন ও মাওলানাদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন । এক কথায় নরমে-গরমে  তাঁরা তাঁদের হিন্দুত্বের কর্মসূচী রূপায়নের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ।
মোদি ও আরএসএস কিন্তু তাদের  এই প্রতারণামূলক  নয়া রণকৌশলকে  মসৃণভাবে  প্রয়োগ করতে পারছে না ।   বাধা আসছে হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে থেকেই ।  বাধা আসছে যেমন সঙ্ঘপরিবারের ভিতর থেকে, বাধা আসছে বাহির থেকেও ।  সঙ্ঘপরিবারের বাইরের  হিন্দু মৌলবাদী শক্তি ইফতার পার্টি ও উলামার সঙ্গে বৈঠকের বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ জানাচ্ছে । তারা বলেছে এ সব কর্মসূচী তারা হতে দেবে না, তাতে যদি সঙ্ঘর্ষ হয় তবু তারা পিছু হটবে না । হিন্দু মহাসভা একটা পৃথক হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল যার জন্ম হয় আরএসএসের আগেই । হিন্দু মহাসভারই একটা অংশ হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরএসএস তৈরী করেছিলো । সেই হিন্দু মহাসভার সভাপতি কমলেশ তেওয়ারি বলেছেন,  ‘ ইফতার পার্টিতে আলেমদের আমন্ত্রণ করে আরএসএস নাটক করছে । এই নাটক  করছে তারা বিজেপির হয়ে মুসলম ভোট টানার জন্যে । এরা এভাবে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের সঙ্গেই প্রতারণা করছে ।’  তিওয়ারি আরো অভিযোগ হলো – ‘আরএসএস প্রথমে রামমন্দির ইস্যু তুলে হিন্দু ভোট টানার চেষ্টা করেছে, এখন ইফতার পার্টি করে মুসলমানদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছে । ঈদ, ইফতার ও মোল্লাদের সঙ্গে বৈঠক করে তারা আসলে বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রয়াস করছে । উত্তর প্রদেশের নির্বাচন  বেশি দেরি নেই  । সেই নির্বাচনকে মাথায় রেখেই তারা এ সব কর্মসূচী নিচ্ছে ।’ হিন্দু মহাসভা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে আরএসএসের প্রতি । বলেছে, ‘আরএসএস ও উলামার বৈঠক আমরা হতে দেব না । বৈঠকে আমরা ওদের কাউকে ঢুকতেই দেব না । যেখানে বৈঠক করবে সে জায়গাটাকে ঘিরে রেখে দেব, তাতে সঙ্ঘর্ষ যদি হয় হবে, তবু আমরা পিছিয়ে আসবো না ।’  হিন্দু মহাসভা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ভারতের ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিলো সর্বদায় বৈরীতামূলক । সেই ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে হিন্দু মহাসভার সভাপতি  বলছেন যে, ‘ইতিহাস বলছে হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না । কারণ অতীতে তারা কখনো ঐক্যবদ্ধ হয় নি ।’   আরএসএসের উদ্দেশ্যে  তিওয়ারি আরো বলেন যে, ‘দেশের মানুষ হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি চাই না ।‘ আরএসএসকে সাবধান করে দিয়ে তিনি বলেন যে, ‘হিন্দুরা কিন্তু আরএসএসকে ছেড়ে দেবে না । হিন্দু রাষ্ট্র কবে হবে ? এ প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে ।’ তিওয়ারি আরএসএসকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বনলেন যে, ‘রোযা ভাঙার জন্যে ইফতার করা ও উলামার সঙ্গে বৈঠক করা যেমন হিন্দু মহাসভার আদর্শবিরুদ্ধ তেমনই আরএসেসেরও আদর্শবিরুদ্ধ । হিন্দুরা এটা কিছুতেই মেনে নেবে না ।’
হিন্দু মহাসভার নেতা কিন্তু এক বর্ণও মিথ্যে বা ভুল বলে নি । আরএসএসের জন্মই হয়েছিলো ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর জন্যে যেখানে  মুসলমানদের ঠাঁই থাকবে না, আর যদি তারা থাকতেই চায় তবে তাদের হিন্দুদের আধিপত্য স্বীকার করেই  থাকতে হবে । আরএসএসের নেতা হিসাবে যে ক’জনের নাম সবার আগে উঠে আসে তাঁদের একজন হলেন গোলওয়ালকার । ১৯৩৮ সালে ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ [আমরা বা আমাদের জাতিত্বের সংজ্ঞা] নামে একটি গ্রন্থ লেখেন যে গ্রন্থে তিনি হিন্দুত্ব তত্ত্বের বিশদ আলোচনা করেছেন   সেই গ্রন্থ থেকে মাত্র দু’টি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে মুসলিমদের সম্পর্কে আরএসএসের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্যে । গোলওয়ালকার  সেই গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায়  লিখেছেন, “হিন্দুস্থানের সমস্ত অহিন্দু মানুষ হয় হিন্দু ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে ও পবিত্র বলে জ্ঞান করবে, হিন্দু জাতির গৌরব-গাথা ভিন্ন অন্য কোন ধারণাকে প্রশ্রয় দেবে না, অর্থাৎ তারা শুধু তাদের অসহিষ্ণুতার মনোভাব এবং এই সুপ্রাচীন দেশ ও তার ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাবই ত্যাগ করবে না, এর প্রতি  ভালোবাসা ও ভক্তির মনোভাব তৈরী করবে; এক কথায় তারা আর হয় বিদেশী হয়ে থাকবে না, না হলে সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জাতির এই দেশে তারা থাকবে অধীনস্থ হয়ে, কোনও সুবিধা ছাড়া এবং কোনও রকমের পক্ষপাতমূলক ব্যবহার ছাড়া । এমনকি নাগরিক অধিকারও তাদের থাকবে না ।” গোলওয়ালকার ঐ গ্রন্থেই  লিখেছেন হিন্দুরাই কেবল ভারতের সন্তান, অন্যরা নয় । এ প্রসঙ্গে ১২৩-১২৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “আমাদের এই বিশাল দেশ – উত্তরে হিমালয় – উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে এর সমস্ত শাখা এবং সেখানে অবস্থিত অঞ্চল সমেত- থেকে দক্ষিণে সমুদ্র এবং তার সমস্ত দ্বীপ সমেত বিস্তৃত এবং তার পুরোটা মিলে এটি একটি বিশাল প্রাকৃতিক একক । এই মাটির সন্তান রূপে, আমাদের বিকশিত সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে এখানে তৈরী হয়েছে । এই সমাজের পরিচয়, অন্তত আধুনিক সময়ে, হিন্দু সমাজ বলে । একথা ঐতিহাসিক সত্যও বটে । কারণ হিন্দুদের পূর্বপুরুষরাই এই ঐতিহ্য ও নিয়ম তৈরী করেছেন ... অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পচেতন করেছেন ... [এবং] মাতৃভূমির পবিত্রতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় রক্ত ঝরিয়েছেন । আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে যে সমস্ত কিছু করেছে হিন্দুরা । এর অর্থ এই যে কেবল হিন্দুরাই এই মাটির সন্তান হিসেবে এখানে বসবাস করেছে ।”  মুসলমান এবং খৃস্টানদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন – “তারা এদেশে জন্মেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কি যথার্থ এদেশের প্রতি অনুগত? ... না । তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতির প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি চলে গেছে ।” (ঐ, পৃ – ১২৭-১২৮)  মুসলিম ও খৃস্টানদের সম্পর্কে এই হলো গোলওয়ালকারের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও বাখ্যা । বলা বাহুল্য যে আরএসএস সেই তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়েই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চায় ।
মোল্লাতোষণের যে নাটক শুরু করেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তার ফলে হয়তো মুসলিমদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কিছুটা হলেও সফল হতে পারে, কিন্তু এর উল্টো প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল । সঙ্ঘ পরিবারের বাইরের হিন্দু মৌলবাদী শক্তি হিন্দু মহাসভা ইতিমধ্যেই এই নাটকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে এবং আগামি দিনে তারা কড়া বিরোধিতা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে । তাদের এই বিরোধিতা ও প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়বে সঙ্ঘ পরিবারের অন্দর মহলেও । কট্টর পন্থী আরএসএস ও বিজেপির কর্মী ও সমর্থকদের বিরাট অংশই ইমাম ও মাওলানাদের সঙ্গে হিন্দু নেতাদের গা ঘেঁষাঘেঁষি কিছুতেই মেনে নেবে না । তাছাড়া সবাই এটাকে নাটক বলে নাও মানতে পারে, একটা অংশ   এই নাটক বা ঘটনাটিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আদর্শগত বিচ্যুতি বলে  ভাবতেই পারে। তারা স্বভাবতই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে  সরব হবে ।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের ইফতার পার্টি দেওয়া এবং  উলামার সঙ্গে বৈঠক করার করার কর্মসূচীর পরিণতি কী হয় তা ভবিষ্যতই বলবে এবং সেই পরিণতি চাক্ষুস করার জন্যে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে ।  এর পরিণতি যাই হোক না কেনো, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এটা যে একটা নতুন সংযোজন তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই । শুধু তাই নয়, ভারত এক বিরল ও অত্যাশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো আরএসেসের সৌজন্যে । সেটা এ রকম - একদল ধর্মীয় মৌলবাদী  আর এক দল  অন্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রতারণা করার জন্যে আমন্ত্রণ করছে, আর দ্বিতীয় দলটি প্রতারিত হবে জেনেও  প্রথম দলের ডাকে সাড়া দিচ্ছে । এ যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায় ।  এই ঘটনাটি রামায়নের  সেই দৃশ্যটার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যেখানে রাম রাবণকেই ডাকছে একটা পূজো করে দিতে রাবণকে বধ করবে বলে  । এবং রাবণ সেটা বুঝেও রামের ডাকে সাড়া দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করছে না । অনুরূপভাবে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারাও  জানেন যে মুসলমানদের বধ করাই হলো আরএসএস ও বিজেপির প্রধান উদ্দেশ্য, কিন্তু  তা জেনেও তারা  আরএসএস ও বিজেপির ডাক প্রত্যাখান করতে পারছেন না ।  রাম-রাবণের আখ্যানের সঙ্গে এ ঘটনার অবশ্য একটা মৌলিক পার্থক্য আছে । রামের আহ্বানে রাবণ সাড়া দিয়েছিলেন যার মধ্যে রাবণের পৌরুষের প্রকাশ পেয়েছে । কিন্তু ইমাম ও মাওলানারা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন, এটা তাঁদের মজবুরী । পাছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, বিজেপি এবং প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরো রুষ্ট হয় এ ভয়ে তাঁরা বাধ্য হয়ে সাড়া দিচ্ছেন । 
      



KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...