Saturday, June 13, 2015

মুহাম্মদ তাঁর দত্তক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেন আল্লাহর দোহায় দিয়ে


মুহাম্মদ তাঁর অষ্টম বিয়েটি সম্পন্ন করেন ৬২৯ খৃস্টাব্দে তাঁরই প্রাণপ্রিয় পালিত পুত্র জায়েদের স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহাসের সঙ্গে। কেউ কেউ বলেছেন এটা সপ্তম বিয়ে, ইহুদি নারী জুয়াইরিয়ার সঙ্গে বিয়েটা ছিলো অষ্টম বিয়ে। তবে জয়নব বিনতে জাহাসের সঙ্গে বিয়েটাই অষ্টম বিয়ে বলে অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। মুহাম্মদ এমন কয়েকটি বিয়ে করেন যা নিয়ে আজো সারা দুনিয়ায় চর্চা হয়। তবে সব চেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয় দু’টি বিয়ে নিয়ে যার রেশ এখনও বহমান  সেই বিয়ে দু’টির  একটি হলো এই বিয়েটি, অন্যটি হলো প্রিয়তম বন্ধু আবু বকরের ছ’বছরের শিশু কন্যা আয়েশার সঙ্গে বিয়ে জয়নবকে বিয়ে করার ঘটনায় আরবের মানুষের মধ্যে যে তীব্র ও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিলো। চারিদিকে ছি ছি ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিলো যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো মুহাম্মদের শিষ্যরাও। লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিলো। কারণ, তৎকালীন আরবে সন্তান দত্তক নেওয়ার রীতিটি প্রচলিত  ছিলো সর্বজনগ্রাহ্য একটি উত্তম প্রথা হিসেবে। মুহাম্মদও স্বয়ং সেই প্রথাটাকে সম্মান করতেন। দত্তক পুত্রকে আরবের মানুষ নিজের পুত্রের মতোই মর্যাদা ও অধিকার দিতো। দত্তক পুত্রও পালক পিতামাতার উত্তরাধিকারী হতো। প্রথাটির সঙ্গে যে উচ্চ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পৃক্ততা ছিলো সেটাকে মুহাম্মদ অবলীলায় পদদলিত করেন এই বিয়েটা করে ফলে স্বভাবতই তৎকালীন আরব সমাজে এই বিয়েটার জন্যে মুহাম্মদকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিলো। এর কোনো সদুত্তর  তাঁর শিষ্যদের কাছে  ছিলো না। অতীতে মুহাম্মদ তাঁর কোনো কাজের জন্যে যখনই ঘরে বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন তখনই তিনি আল্লাহর সাহায্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে তিনি ঘোষণা দেন যে বিয়েটা আল্লাহর ইচ্ছানুসারেই সম্পন্ন হয়েছে। পালিত পুত্র তথা দত্তক পুত্র নেওয়ার যে প্রথাটা তখন প্রচলিত ছিলো সেটা একটি নিকৃষ্ট প্রথা। তাই সেই প্রথাটি বাতিল করার প্রয়োজনেই আল্লাহ স্বয়ং এই বিয়েটির আয়োজন করেছে। আসলে বিয়েটা কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে সম্পন্ন হয়েছিলো সে বিষয়ে এবার  আলোচনা করা যাক।  


দত্তক পুত্র জায়েদ ছিলেন একজন যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাস 

যায়েদ বিন হারিস ছিলেন একজন সিরিয় যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাস। খাদিজা তাঁকে কিনে নিয়ে এনেছিলেন। মুহাম্মদকে বিয়ে করার পর যায়েদকে উপহার স্বরূপ তাঁর হাতে তুলে দেন। যায়েদের আচার-আচরণে, সেবায় ও আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মদ তাঁকে একসময় মুক্ত করে দেন। এদিকে যায়েদের খোঁজ পেয়ে তাঁর বাবা-মা তাঁকে  মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে মুহাম্মদের কাছে এসে হাজির হনএসে  শোনেন যে যায়েদকে মুক্ত ও স্বাধীন করে দিয়েছেন তাঁর মালিক মুহাম্মদ। সে খবরে তাঁরা ভীষণ প্রীত হয়ে মুহাম্মদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু যায়েদ মুক্ত ও স্বাধীন হলেও আর বাবা-মা’র সঙ্গে ফিরে যান নি। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেন যে মুহাম্মদের মধুর ব্যবহারে অতিশয় প্রীত ও মুগ্ধ হয়ে যায়েদ তাঁকে মনে প্রাণে এতোটাই ভালবেসেছিলেন যে তাঁকে ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দেয় নি। এটাই যে সত্যি ঘটনা তা নাও হতে পারে। ঘটনাটা এ রকমও হতে পারেঃ যায়েদই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি সবার আগে ইসলামকে গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন। মুহাম্মদ ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এটা  তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, এবং এটাও বিশ্বাস করতেন যে তাঁর সঙ্গে  থাকলে মৃত্যুর পর তিনি নিশ্চিতভাবেই বেহেস্ত[স্বর্গ] লাভ করবেন। সুতরাং হয়তো বেহেস্তের লোভেই তিনি বাবা-মা’র প্রতি অন্তরের ভালোবাসার আকর্ষণকে দমন করে মুহাম্মদের কাছে থেকে গিয়েছিলেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, মুহাম্মদ্দের জন্যে বাবা-মা’কে ত্যাগ করার ঘটনাটি হয়তো মুহাম্মদকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া ক্রীতদাস হিসেবে যায়েদের অক্লান্ত ও আন্তরিক পরিষেবা ও পরিচর্যা, মনিবের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শনে অশেষ প্রীত হয়ে মুহাম্মদ তাঁকে আগেই মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তারপর যায়েদ যখন  মা-বাবার কাছে  না গিয়ে আমৃত্যু তাঁর সেবায় নিয়োজিত থাকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন মুহাম্মদ তাঁর প্রতি আরো প্রীত  ও সদয় হয়ে  তাঁকে  দত্তক নিয়ে নেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে  মুহাম্মদের কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। তাঁর ঔরসে খাদিজা যে চারজন কন্যা ও দু’জন পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে পুত্র সন্তানরা শিশু বয়সেই মারা গিয়েছিলো। 


  জায়েদের তাঁর পত্নীকে তালাক দেবার নেপথ্য ঘটনা

দত্তক নেওয়ার কিছুদিন পর মুহাম্মদ জয়নবের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। জয়নব ছিলেন মুহাম্মদের মায়ের দিক থেকে সম্পর্কে বোন। যায়েদের সঙ্গে বিয়েতে যয়নব ও তাঁর বাড়ির লোকেদের সম্মতি ছিলো না এমন একটা মত শোনা যায় তাঁরা নাকি মুহাম্মদের ইচ্ছাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছিলেনএর কারণ হিসাবে বলা হয় যে, জয়নব ছিলেন বংশ মর্যাদায় অভিজাত পরিবারের মেয়ে, অপরদিকে  যায়েদ ছিলেন একজন ক্রীতদাসকিন্তু এই মতটাকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই অবিশ্বাসযোগ্য বলে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি হলো এ রকম – এক]. যায়েদ আফ্রিকান ক্রীতদাস ছিলেন না।  তিনি  ছিলেন একজন সিরিয় যুদ্ধবন্দি যাঁকে খাদিজা মুক্তিপণ দিয়ে ক্রয় করে এনেছিলেন। দুই]. মুহাম্মদ তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফলে তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন মানুষ। এবং তিন]. তিনি আর্থিক, পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে মর্যাদায় কোনো অংশেই যয়নবের চেয়ে  নিম্নবর্গের ছিলেন না, কারণ তিনি ছিলেন তখন মুহাম্মদের দত্তক পুত্র। 
বিয়ের পর  মাঝে মাঝেই মুহাম্মদ তাঁর পালিত পুত্র জায়েদের গৃহে যেতেন । কিন্তু একদিন যায়েদের  গৃহে যাওয়ার পর এমনা একটা ঘটনা ঘটে যা ছিলো কল্পনা ও বিশ্বাসের অতীতসেদিন গৃহে যায়েদ উপস্থিত ছিলেন না। জয়নব একাকিই গৃহে অবস্থান করছিলেন। এরূপ  অবস্থায় মেয়েদের শরীরের পোশাকগুলো  সাধারণতঃ  আলগা ও অগোছালো অবস্থায় থাকে, ফলে শরীরের অনেক অংশই অনাবৃত থাকে।  মুহাম্মদ দরজা ঠেলে গৃহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই জয়নবকে ঐ অবস্থায় দেখতে পান। জয়নব এমনিতেই ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, তারপর  ভরা যৌবনবতী। ভরপুর যৌবনা ও অসাধারণ সুন্দরী যয়নবকে প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেখে মুহাম্মদ অতিশয় মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাঁর চোখ ও মন দুটোই আটকে যায়  তাঁর অর্ধনগ্ন অপরূপ দেহসৌষ্ঠবের প্রতি। মুহাম্মদ হতচকিত ও হতবাক হয়ে পড়েন। যয়নবের মনোহারিণী দেহসৌষ্ঠব দেখে বিমোহিত ও বিমুগ্ধ হয়ে বিড়বিড় করে বলেন, সকল প্রশংসা আল্লাহর! আল্লাহ যাকে চাহেন তার মন বদলে দিতে পারেন। এরপর মুহাম্মদ সেখান থেকে তড়িৎ গতিতে বের হয়ে যান। মুহাম্মদ যখন বিড়বিড় করে কথাগুলি  আপন মনে উচ্চারণ করেন তখন জয়নবের কানে কথাগুলি পৌঁছে গিয়েছিলো। কারণ, তিনি ছিলেন তখন মুহাম্মদের থেকে সামান্য দুরত্বে। নিজের কানে মুহাম্মদের এমন প্রশংসা শুনে জয়নবের মন গর্বে ভরে ওঠে। পরে যায়েদ গৃহে ফিরলে যয়নব তাঁকে ঘটনাটা সম্পূর্ণ বর্ণনা করেন। আমেরিকার এক প্রবাসী ঐতিহাসিক আনোয়ার হেকমত এই ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন –
      One day Muhammad went to his adopted son’s house unexpectedly. Zayd was not at home, but           his wife welcomed her father-in-law in even though she was not fully dressed. Being his daughter     -  in-law, she probably did not bother to put on attire or to cover herself completely. Muhammad did       not  fail to notice the hidden beauties of his daughter-in-law, and after murmuring a few       incoherent        words, he exclaimed: “praise to Allah, the most high! Praise to Allah, who changes men’s hearts.”  [Vide: Women and the Koran, page-56] 
ইনভার্টেড কমার মধ্যেকার কথাগুলি আনোয়ার উদ্ধৃত করেছেন মুহাম্মদের প্রথম দিককার জীবনীকার আল-তাবারির গ্রন্থ থেকে। মুহাম্মদের জীবনীকারদের মধ্যে যে অল্প কয়েকজন সব চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য তাঁদের একজন হলেন আল-তাবারি।
জায়েদ জয়নবের মুখে ঘটনা শুনে চঞ্চল ও অস্থির হয়ে ওঠেন। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। বাবা তাঁর গৃহে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন না বলে বাবা না বসে ফিরে গেছেন – এমন ঘটনার মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব কিছু থাকার কথা নয়। তা হলে যায়েদ ঘটনাটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নি কেনো? নিতে না পারার কারণ হলো তিনি মুহাম্মদের মনোভাব  যথার্থভাবেই আঁচ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  তিনি তাঁকে দীর্ঘকাল খুব কাছ থেকে দেখেছেন। প্রথমে দাস হিসাবে, পরে পুত্র হিসাবে দীর্ঘদিন মুহাম্মদের কাছে থেকে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে তিনি যে সম্যক ধারণা অর্জন করেছিলেন তারফলেই তিনি খুব ভালো করে জানতেন মুহাম্মদের চরিত্রে কী ভয়ঙ্কর দানবীয় যৌনতা বিদ্যমান ছিলো। তাই তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিলো যে, যয়নবের অর্ধনগ্ন দেহসৌষ্ঠব দেখে মুহাম্মদের সেই দানবীয় যৌনতা নিশ্চয়ই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি এও জানতেন যে, তিনি যেটা আকাঙ্ক্ষা করেন সেটা পেতে কতো মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি এটাও নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে কোনো বাধা তাঁর আকাঙ্খার  সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ালে নৃশংসভাবে সেই বাধাকে দুরমুশ  করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে  তাঁর জুড়ি  মেলা ভারতিনি এও নিঃশংসয়ে  বিশ্বাস করতেন যে, তিনি আল্লাহর নবী এবং স্বয়ং আল্লাহ তাঁর  সহায়, সুতরাং পৃথিবীতে কোনো শক্তিই ছিলো না যে তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করে নিজের জীবন রক্ষা  করতে পারে। তাই তিনি যখন বুঝলেন যে মুহাম্মদ যয়নবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং তাঁদের দুজনের মধ্যে তিনিই একমাত্র বাধা তখন তিনি জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সে অবস্থায় কী করা উচিৎ তা স্থির করতে তিনি বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেন নি এবং দ্রুতই ঘর থেকে বেরিয়ে যান মুহাম্মদের সন্ধানে।
যয়নবের কাছ থেকে আসার পর মুহাম্মদ কীভাবে তাঁকে তাঁর হারেমের অন্তপুরে ঢোকাবেন সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েন। কারণ, তাঁকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে দু’টো প্রকাণ্ড বাধা রয়েছে। প্রথম বাধাটি হলো যয়নব বিবাহিতাআর দ্বিতীয় বাধাটি হলো যয়নব তাঁর পালিত পুত্রের স্ত্রী। তখন সে সময়ে আরবে পালিত পুত্রের স্ত্রীকে আপন পুত্রের স্ত্রীর সমান মর্যাদা দেওয়া হতো এবং সে কারণে পালিত পুত্র তার স্ত্রীকে তালাক দিলেও তাকে পালক পিতার বিয়ে করা অবৈধ ছিলো। কোরানের ৪/২৩ নং আয়াতেও স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে যে পিতা ও পুত্রবধুর মধ্যে বিয়ে অবৈধ। কীভাবে এই দুটো বাধা অতিক্রম করে যয়নবকে বুকের মাঝে পাওয়া যায় সেটাই তিনি গভীরভাবে ভাবতে থাকেনমুহহাম্মদ যখন গভীরভাবে সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন সে সময়ে যায়েদ তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে তাঁর কাছে পৌঁছে যান। ফলে  তিনি যখন মুহাম্মদের কাছে গিয়ে দাঁড়ান তখন মুহাম্মদ সেটা টের পান নি। যয়নব তখন বুঝে যান  নি যে, মুহাম্মদ তখনও যয়নবের ধ্যানেই মগ্ন রয়েছেন এবং তিনি তখনও হয়তো  তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে  যয়নবের সেই অর্ধনগ্ন দেহসৌষ্ঠবের দৃশ্যটাই অবলোকন করছেন। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে যয়নব মুহাম্মদকে বললেন যে তিনি তাঁর [মুহাম্মদের] কাছেই এসেছেন একটা কথা বলবার জন্যে। যয়নবের কথায় মুহাম্মদের ধ্যান ভঙ্গ হয় এবং যয়নবের দিকে ফিরে চানঅন্যমনস্ক থাকার জন্যে মুহাম্মদ  যায়েদের কথাটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। মুহাম্মদ যায়েদকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বললে? যায়েদ তার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন। মুহাম্মদ তখন বললেন, বলো কী বলতে চাওযায়েদ বললেন, যয়নবকে যেহেতু আপনার ভীষণ পছন্দ হয়েছে তাই আমি জয়নবকে তালাক দিতে চাই, আর সে জন্যেই আপনার অনুমতি চাইতে এসেছিমুহাম্মদ বুঝলেন যে যায়েদ ঠিক তাঁর মনের কথাটা বলেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর মনের ইচ্ছাটা সেই মুহূর্তে দমন করেন এ কথা ভেবে যে এই ঘটনার খুব খারাপ প্রতিক্রিয়া হবে আরববাসীদের মধ্যে, এমনকি তাঁর শিষ্যদের মধ্যেও। তাই তিনি তখন  নিস্পৃহভাবে যায়েদকে  বলেন, না, তুমি যয়নবকে তালাক দিও না, তোমার কাছে রাখো মুহাম্মদের শরীরি ভাষা পড়ে যায়েদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, মুহাম্মদ যা বলেছেন সেটা  তাঁর মনের কথা নয়। তিনি যে কোনো মূল্যেই যয়নবকে তাঁর হারেমে তুলবেনই। আর সে ক্ষেত্রে তিনি যদি বাধা হয়ে থাকেন তবে তাঁর জীবন নিশ্চিতভাবেই বিপন্ন হবে। সে জন্যে তিনি মুহাম্মদের কথায় আশ্বস্ত হন নি। বরং আপন জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্তই নেন এবং বাড়ি গিয়ে তালাক দিয়ে দেনজায়েদ যয়নবকে তালাক  দেওয়ায় তাঁকে (যয়নবকে) স্ত্রী রূপে পাওয়ার ক্ষেত্রে মুহাম্মদের প্রথম বাধাটি অপসারিত হয়ে যায়।    
যায়েদ কীভাবে যয়নবকে তালাক দেবার প্রসঙ্গটি উপাস্থাপনা করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। একটি মত হলো, শুধু তালাক দেবার ইচ্ছাটাই ব্যক্ত করেছিলেন, কেনো তালাক দিতে চান সেটা পাছে মুহাম্মদ ক্রুদ্ধ হন সেই  ভয়ে অব্যক্তই রেখেছিলেন। আর একটি মত হলো এই যে, মুহাম্মদ যয়নবের প্রতি যে  যারপরনাই কামাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন সে বিষয়ে  যায়েদ এতোটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি কেনো তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান সে কথাটি ব্যক্ত করার মধ্যে ভয় পাওয়ার কিছু দেখেন নি। আনোয়ার হেকমত  তাঁর উক্ত গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –
·                      When Zayd heard the history of his father’s visit to his wife, he went to him and proposed to               divorce her. But Muhammad, who was aware of his followers’ reaction, would be, apparently           preferred to take an indifferent attitude, and therefore advised his son to take his wife for himself.
     Nevertheless, Zayd divorced his wife, perhaps because he feared the outcome of his opposition  to    his father, particularly when it means another woman. Being a submissive believer and  sheepish son, Zayd could not have opposed his father’s will, even after being told to keep his wife.Thus, the first obstacle was removed from Muhammad’s desire to take Zaynab as his wife. [see page no. 57 ]
সিরিয় আরব মুসলিম বংশোদ্ভুত ঐতিহাসিক মুমিন সালেহ লিখেছেন যে জয়নবের প্রতি মুহাম্মদের কামাসক্তি সম্পর্কে জায়েদ এতোটাই নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি মুহাম্মদকে সরাসরি সে কথা বলেই তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি যা লিখেছেন –
... কাজেই, মুহাম্মদ যখন জয়নবের নগ্ন দেহসৌষ্ঠব দেখে ঐ কথাগুলি উচ্চারণ করেছেন, তখন জায়েদ ভাল করেই বুঝে ফেলেন যে পৃথিবীর কোন শক্তিরই নবীকে নিজ স্ত্রী জয়নবের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে নবীকে বিরত করতে পারবে না। জায়েদের জন্য পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে, এই লড়াইয়ের ফলাফল কখনোই তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না।
জায়িদ মুহাম্মদের প্রকৃতি সম্পর্কে এতটাই জানতেন যে, আরবের সাধারণ মানুষের জন্য যেটা অচিন্তনীয় ছিল যে, সে ধরনের কথাও তিনি মুহাম্মদকে বলতে সাহস করেছিলেন। ঘটনা জানার পর আতঙ্কিত জায়েদ মুহাম্মদকে খুঁজে বের করেন। মুহাম্মদ তখনও জয়নবের কল্পনায় বিভোর ছিলেন। জায়েদ খোলাখুলি পালক-পিতাকে বললেনঃ আপনি হয়ত জয়নবকে পছন্দ করেছেন সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য আমি তাকে ত্যাগ করছি
এ কথা শুনে মুহাম্মদ উত্তর দিলেন, “তুমি তোমার স্ত্রীকে রাখ।
এ উত্তরে মুহাম্মদ জয়নবকে কী দৃষ্টিতে দেখতেন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। জায়েদও অবশ্যই জানত যে জয়নবকে মুহাম্মদ একজন ব্যক্তি হিসাবে পছন্দের পরিবর্তে কেবল যৌন সামগ্রী হিসাবে পছন্দ করেছিলেন।  [সুত্রঃ http://nobojug.org/posts/mumin-salih/158]

পুত্রবধূকে বিয়ে করতে ওহির অবতারণা

মুহাম্মদ তাঁর দত্তক পুত্র যায়েদকে তাঁর স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে রেখে দেওয়ার যে কথাটি বলেছিলেন সে কথাটি যে তাঁর মনের আসল কথা নয়, আসলে তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন, তুমি  শীঘ্রই তালাক দাও যাতে করে যয়নবকে আমার বিয়ে করার প্রথম প্রধান বাধাটি সরে যায়। না, এ কথাটা ইসলাম-বিদ্বেষী কোনো ঐতিহাসিক বা মুহাম্মদের জীবনীকারের তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করার জন্যে মনগড়া কোনো মিথ্যে অভিযোগ নয়। এটা যে সত্যি ঘটনা তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কোরান। কোরানের কোন আয়াতে এ কথাটা লিপিবদ্ধ রয়েছে তা একটু পরেই প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত হবে।  
জয়নব এখন বিবাহ বিচ্ছিনা যুবতী। সুতরাং তাঁকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে প্রথম প্রধান বাধাটি আর রইলো না। বাকি থাকলো দ্বিতীয় বাধাটি। সেটা হলো দত্তক পুত্রের পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিয়ে করা সামাজিক প্রথা ও কোরানের আইনের পরিপন্থী যে কথাটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো বাধা বা সমস্যাই মুহাম্মদের আকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ পূরণের পথ রুদ্ধ করতে পারে নি। কারণ, মুহাম্মদের  আকাঙ্খা পূরণে স্বয়ং আল্লাহই তো সর্বদাই তৎপর ছিলো। এর পূর্বে দেখা গেছে যে, মুহাম্মদের যখনই যে ওহির  [প্রত্যাদেশ/আদেশের] দরকার হয়েছে, আল্লাহ তখনই সেই সেটা পাঠিয়ে দিয়েছে। যয়নবকে পাওয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। জয়নবকে বুকের মাঝে পেতে তার আর তর সইছিলো না। মুহাম্মদ একদিন আয়েষার ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করছেন, আসলে মনে মনে ভাবছেন কী উপায়ে  যয়নবকে পাওয়ার বাধাটা সরানো যায়, কিছুক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকার ভান করে থাকার পর হঠাৎই  উল্লসিত হয়ে আয়েষাকে উদ্দেশ্যে করে চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, কে আছো, যাও,  জয়নবকে সুখবরটা দিয়ে এসো, তাকে বলো যে,  তাকে বিয়ে করার জন্যে আল্লাহ  আমার প্রতি ওহি [নির্দেশ]  প্রেরণ  করেছে।  এ কথা বলার পর পরই মুহাম্মদ সেই  ওহিটি আবৃত্তি করলেন আয়েষার সামনে। আয়েষা  ওহিটি শুনে মুহাম্মদকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “আল্লাহ সর্বদায় তৎপরতার সঙ্গে আপনার অভিলাষ পূরণ করে থাকেন।”  আনোয়ার হেকমত এই উক্তিটি এভাবে উদ্ধৃত করেছেন –
“Your Lord is very quick in answering your wish.”
আল্লাহর মুখ দিয়ে যে ওহিটি বা আদেশটি তিনি আবৃত্তি করেছিলেন সেই ওহিটির ভাষ্য এরূপঃ
মনে রেখ, আল্লাহ্‌ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, তুমি তাকে বলছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করতুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছ আল্লাহ্‌ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোকভয় করছিলে অথচ কেবল আল্লাহ্‌কেই ভয় করাই তোমার জন্য অধিক সঙ্গত। অতঃপর জায়েদ যখন জয়নবের সহিত বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সহিত বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে-সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহ্‌র আদেশ কার্যকর হতে বাধ্য।” (কোরান- ৩৩:৩৭)
ওহিটি নানা দিক থেকে অনেকবেশী তাৎপর্যপূর্ণ। ওহিটি ঘোষণা করছে যে মুহাম্মদ ও জয়নবের বিয়েটা  ইতিমধ্যেই আল্লাহর হেফাজতে বেহেস্তের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ জানাচ্ছে, “জায়েদ যখন জয়নবের সহিত বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম এ ঘোষণা এ জন্যে যে, যাতে সামাজিক প্রথা ও কোরানীয় আইনভঙ্গের অজুহাতে মুহাম্মদের শিষ্যরা যয়নবের সঙ্গে তাঁর বিয়েটা কোনোভাবেই ভণ্ডুল করতে না পারে। যে বিয়েটা স্বর্গে সম্পন্ন হয়েই গেছে আল্লাহর ইচ্ছায় ও তত্ত্বাবধানে তাকে নাকচ করার প্রশ্ন তোলাই যায় না। সুতরাং নির্বিঘ্নেই মদিনার মাটিতে  মুহাম্মদ ও জয়নবের বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বটি খুব ধূমধাম করে সম্পন্ন হয়ে যায়। মুহাম্মদ এই বিয়েটি উপলক্ষ্যে বিশাল ভোজের আয়োজন করেন। ভোজের অনুষ্ঠানটি এতোটাই বিশাল ছিলো যে ভোজের অনুষ্ঠান চলেছিলো কয়েকদিন ধরে মুহাম্মদ কিন্তু তাঁর অন্য বিয়েগুলিতে ভোজের অনুষ্ঠান করেন নি। ওহির এক জায়গায় আল্লাহ বলছে(আসলে মুহাম্মদ আল্লাহকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন) – “তুমি তাকে বলছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করতুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছ আল্লাহ্‌ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেনঅর্থাৎ মুহাম্মদ যায়েদকে তাঁর স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে তাঁর কাছেই রেখে দিতে বলেছিলেন সেটা যে তাঁর মনের  কথা নয় তা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। এটাকে মুসলিমরা মুহাম্মদের সত্যবাদীতার একটা চমৎকার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আসলে মোটেই তা নয়, মুহাম্মদ এই কথা বলে মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মাত্র। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক প্রথাকে সম্মান জানাতেই তিনি তাঁর মনের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়েছেন এবং এর মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে একজন উদার ও মহানুভব ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আবার তিনি এটাও দেখাতে চেয়েছেন যে, যয়নবকে বিয়ে না করে তাঁর উপায় ছিলো না, কারণ সর্বশক্তিমান ও মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আদেশকে তো অমান্য করা যায় না। এই প্রতারণায় তিনি এক ঢিলে দুটো পাখি মারেন। এক দিকে তিনি দেখালেন যে, তিনি এতো উদার যে সমাজের স্বার্থে তাঁর  যে কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করতে তিনি প্রস্তুত। আর এক দিকে দেখালেন যে, আল্লাহর সমস্ত আদেশই মুসলমানদের মানতে হবে যদি তা কারো কাছে ভালো না লাগতেও পারে। মুহাম্মদ মুসলমানদের যতই বোকা বানানোর চেষ্টা করুন না কেনো, এই ওহিটি কিন্তু মুহাম্মদ একজন ত্রুটিমুক্ত মানুষ এই মিথটাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ এখানে মুহাম্মদকে বলছে, - তুমি লোকভয় করছিলে অথচ কেবল আল্লাহ্‌কেই ভয় করাই তোমার জন্য অধিক সঙ্গতঅর্থাৎ আল্লাহ  মুহাম্মদকে একটু মৃদু তিরস্কার করেছে আল্লাহকে ভয় না করে লোকভয় করার জন্যে। বিষয়টা কিন্তু এতো সহজ নয়। ইসলামি মতে আল্লাহকে ভয় না করে মানুষকে ভয় করাটা পাপআল্লাহর চোখে যেটা পাপ সেটা  অপরাধওসুতরাং আয়াতটি এটা প্রমাণ করছে যে মুহাম্মদ আল্লাহর নবি বলে নিজেকে দাবি করলেও তিনি সম্পূর্ণ নিরাপরাধ ও ত্রুটিমুক্ত মানুষ ছিলেন না।  

পুত্রবধূকে বিয়ে করার জন্যে দত্তক প্রথাকে বলি প্রদান

পালিত পুত্রের বধূকে বিয়ে করাটা - কী সমাজের চোখে, কী আল্লার চোখেও (আয়াত নং ৪/২৩)- এতো বড়ো গর্হিত কাজ ছিলো যে মুহাম্মদ জানতেন যে জয়নবকে বিয়ে করলে লোকসমাজে এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রবল  সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠবেআর তাই আগেভাগেই  ৩৩/৩৭ নং ওহিটি নিয়ে আসতে হয়েছিলো মুহাম্মদকে। কিন্তু সেই বিয়েটাকে বৈধ প্রমাণ করার জন্যে তো ৩৩/৩৭ নং ওহিটিই যথেষ্ট ছিলো না। কারণ, সেই আয়াতে/ওহিতে পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করাটা কেনো অবৈধ নয় - সে প্রশ্নের  জবাব ছিলো না। তাই মুহাম্মদকে এই বিয়েটাকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে আর একটি আয়াত বা ওহি আনাতে হয়েছিলো। ওহিটি হলো – “...  এবং তোমাদের পোষ্য-পুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেন নি। এ তোমাদের জন্যে তোমাদের মৌখিক কথা মাত্র, এবং আল্লাহ সত্য কথাই বলেন, তিনিই সরলপথ প্রদর্শন করেন।” [৩৩/৪]  মুসলিম ধর্মগুরুগণ এবং ইসলামের পক্ষ সমর্থনকারী লেখকগণ বলেন যে আরবে তৎকালীন সমাজে পুত্র দত্তক নেওয়ার এবং দত্তক পুত্রকে আপন পুত্রের মর্যাদা দিয়ে উত্তরাধিকার করার যে কুৎসিত প্রথা চালু ছিলো সেটা বাতিল করে তার পরিবর্তে একটা উৎকৃষ্ট প্রথা, আইন ও নীতি প্রবর্তন করার প্রয়োজনেই আল্লাহকে স্বয়ং  উদ্যোগ নিয়ে মুহাম্মদ ও তাঁর দত্তক-পুত্রের স্ত্রী জয়নবের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থাটা করতে হয়েছিলো। তর্কের খাতিরে  সন্তান দত্তক নেওয়ার প্রথাটাকে একটা কুৎসিত প্রথা বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন উঠে, এই প্রথাটা নিষিদ্ধ করার জন্যে  মুহাম্মদ ও জয়নবের মধ্যে বিয়েটার  কি সত্যিই কোন আবশ্যকতা ছিলো? তার জন্যে ৩৩/৪ নং আয়াতটাই তো যথেষ্ট ছিলো কিংবা প্রয়োজনে আরো একটা বা দু’টো আয়াত/ওহি  পাঠিয়েই  তো প্রথাটা নিষিদ্ধ করা যেতো। আসলে একটা প্রথা তুলে দিয়ে আর একটা প্রথা প্রবর্তন করাটা ছিলো অজুহাত। মুসলিমদের এই [অপ]যুক্তিটা আরবের একটা প্রবাদের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। সেটা ছিলো এ রকম - অপরাধের চেয়ে অজুহাত বেশী খারাপ। আর দত্তক-পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করাটা অবৈধ – আরব সমাজে চালু থাকা এই প্রথাটাকে কি কোনো অর্থেই কুৎসিত প্রথা বলে মেনে নেওয়া যায়? প্রথাটি ছিলো নিঃসন্দেহে নৈতিকতা ও সভ্যতার দিক থেকে একটি উচ্চ মানেরএখনও সারা বিশ্বে অমুসলিম সমাজে এই প্রথাটাকে সম্মানের সাথে অনুসরণ করা হয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে মুহাম্মদও স্বয়ং এটাকে একটা উত্তম প্রথা বলে অনুসরণ করতেন এবং সে জন্যেই তিনি জায়েদকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসাধারণ সুন্দরী যয়নবের অর্ধনগ্ন দেহসৌষ্ঠব দেখে তাঁর প্রতি এতোটাই কামাসক্ত হয়ে পড়েন যে তাঁকে তিনি যে কোনো মূল্যেই পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, আর সে জন্যেই তিনি তাঁর স্বার্থ পূরণের জন্যে একটা সুন্দর ও সভ্য প্রথাকে তাঁর ব্যক্তিগত হীন স্বার্থের হাড়িকাঠে অনায়াস ভঙ্গিতে বলি চড়িয়ে দেন।
জয়নবকে জায়েদ কেনো তালাক দিয়েছিলেন সেটা কিন্তু একটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রশ্নটি তখনও উঠেছিলো, এখনও রয়েছে। এর উত্তরে ইসলামের বাখ্যাকারগণ কী বলেন সে কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা বলেন যে, জায়েদ ও যয়নবের মধ্যে দাম্পত্যজীবন কখনই সুখকর ছিলো না। থাকা সম্ভবও ছিলো না, কারণ উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবার ও বংশের মেয়ে যয়নব একদা ক্রীতদাস জায়েদকে পছন্দ করতেন না এবং বিয়ের পরও ভালবাসতে পারেন নি এটা যে সত্যি কথা নয় এবং মুহাম্মদের  জয়নবের বিয়ে করার  নিকৃষ্ট ঘটনাটাকে বৈধতা দেওয়ার জন্যে মনগড়া গল্প সে কথা সবিস্তারে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, যয়নব জায়েদকে পছন্দ করতেন না এবং তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ ছিলো সে কথা আল্লাহ তার পাঠানো ওহিতে কোথাও উল্লেখ  করে নি। আর একটা বিশেষ লক্ষ্যণীয় ঘটনা হলো এই যে, জায়েদ যয়নবের মুখে মুহাম্মদের তাঁর বাড়ি আসা এবং যয়নবকে দেখে  তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসার কথা শোনার পরই  তিনি যয়নবকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার আগে নয়। সুতরাং জায়েদের যয়নবকে তালাক দেওয়ার পশ্চাতে তাদের মধ্যে কলহ নয়, ছিলো অন্য গল্পজায়েদ তাঁর জীবনের নিরাপত্তার জন্যেই তাঁর স্ত্রী যয়নবকে তালাক দিয়েছিলেন  সে আগেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ জায়েদের তাঁর প্রিয়তম স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পেছনে মুহাম্মদের পরোক্ষ হাত ও প্রভাব ছিলো এবং জায়েদ সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যায়েদের কাছে এই ঘটনাটা ছিলো তাঁর মনের উপর একটা মারাত্মক আঘাত। যাঁর তিনি আজীবন সেবা করেছেন, যাঁকে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছেন এবং যাঁর প্রবর্তন করা নতুন ধর্মে বিনা প্রশ্নে পুরুষদের মধ্যে সর্ব প্রথম দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়েছেন এবং যাঁর অনেকগুলি স্ত্রী ও যৌনদাসী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও  তাঁর  মনোবাঞ্ছা  পূরণের জন্যে   নিজের প্রিয়তম স্ত্রীকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হলো – এটা তাঁর কাছে কতো বড়ো  মানসিক আঘাত তা বোধ হয় বাখ্যার অতীত। মানুষের সহনশীলতা ও ইচ্ছাশক্তি যতোই দৃঢ়ই হোক না কেনো, এমন একটা বিরাট আঘাত যে কোনো মানুষকেই মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু জায়েদের জন্যে বিরাট এই আঘাতটাই শুধু নয়, অপেক্ষা করছিলো তার চেয়েও আরো বড়ো একটা আঘাত। সেই আঘাতটা নেমে এসেছিলো কোরানের ৩৩/৪ নং আয়াতটি যখন মুহাম্মদ আবৃত্তি করেন তখন যে আয়াতে মুহাম্মদ আল্লাহর মুখ দিয়ে  ঘোষণা দিলেন যে জায়েদ তাঁর কেউ নয়, পুত্র তো নয়ই। অথচ আয়াতটি আবৃত্তি করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদ ও জায়েদের মধ্যে ছিলো পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তিলে তিলে ৩৪/৩৫ বছর ধরে। প্রথমে ছিলেন দাস। দাস হিসেবে যে অক্লান্ত সেবা ও অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন, এবং সততার প্রমাণ রেখেছিলেন তার পুরস্কার স্বরুপ মুহাম্মদ তাঁকে প্রথমে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে স্বাধীন মানুষের মর্যাদা দেন।  সেবা করতে করতে তিনি মুহাম্মদকে এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে দাসত্ব থেকে মুক্তি অর্জন করার পরও  তিনি তাঁকে ছেড়ে পিতা-মাতার কাছে ফিরে যান নি। জায়েদের এই সেবা, আনুগত্য, সততা ও ত্যাগ মুহাম্মদের মনেও প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছিলো এবং তিনিও তাঁকে পুত্রের মতোই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে এক সময় মুহাম্মদ তাঁকে দত্তক-পুত্র করে নিজের ছেলের মর্যাদার আসনে বসিয়ে দেনক্রীতদাস থেকে স্বাধীন মানুষ, তারপর একেবারে আল্লাহর নবীর পুত্র – এই যে উত্তরণ, সামাজিক মর্যাদায়  শূন্যস্থান থেকে  একেবারে  শিখরে আরোহণ, একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের  আর কিছু হয় না এবং এর চেয়ে বেশী কিছু অর্জনেরও থাকে না। কিন্তু জায়েদের সেই আকাশ ছোঁওয়া সুখ বেশী দিন স্থায়ী হলো না। জয়নবকে পাওয়ার নেশায় মুহাম্মদ এক লহমায় তাঁর সব সুখ কেড়ে নিয়ে তাঁকে নিঃস্ব করে দিলেনআচমকা এক ধাক্কায় সামাজিক মর্যাদার শীর্ষ চূড়া থেকে একেবারে ভূমিতে আছড়ে ফেলে দিলেন। ফলে জায়েদ শুধু নিজের প্রিয়তম স্ত্রী ও পিতাকেই হারালেন না, হারালেন তাঁর ভবিষ্যৎ এবং জীবনের সব চেয়ে বড়ো অর্জন যে সামাজিক উচ্চতম মর্যাদা সেটাও। চোখের পলকে বাদশা থেকে ফকির হয়ে গেলেন। এটা যে কতো বড়ো আঘাত ও অপমান তা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব।   

যুদ্ধক্ষেত্রে জায়েদের মৃত্যুর পেছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র

জায়েদকে অবশ্য বেশী দিন সেই আঘাত ও অপমান সহ্য কিরতে হয় নি। কিছুদিন পরই, সেই ৬২৯ খৃস্টাব্দেই মুতা অভিযানে গিয়ে শত্রুসেনাদের হাতে নিহত হনসেই অভিযানে মুহাম্মদ মাত্র তিন হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর নেতা তথা প্রধান সেনাপতি করেছিলেন জায়েদকে। মুতা ছিলো তখন বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীন একটি অঞ্চল যেটা এখন জর্ডনে মধ্যে অবস্থিত। জায়েদের বাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে এবং স্বভাবতই সেই অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছিলো এবং অকালে জায়েদসহ অনেক মুসলমানকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিলো।
মুতা অভিযানের অনিবার্য ব্যর্থতা ও করুণ পরিণামের কথা খুব কমই শোনা যায় ইসলামি ভাষ্যকারদের রচনায়। তাঁরা ওহুদ যুদ্ধের পরাজয় নিয়ে ব্যাপক বাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেখান থেকে মুহাম্মদ ও মুসলমানরা কী কী অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা পেয়েছেন তা নিয়ে প্রচুর কালি-কলম খরচ করেছেন কিন্তু মুতা অভাযানের পরাজয় ও ব্যর্থতা কে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্ব তাঁরা দিয়েছেন উল্টে জায়েদকে অভিযানের নেতা করা জন্যে। এই ঘটনায় তাঁরা মুহাম্মদ ও ইসলামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যে জায়েদ  একদা ক্রীতদাস ছিলেন তাঁকে এমন একটা সৈন্যদলের নেতা করা হয়েছিলো যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আর্থ-সামাজিক মর্যাদায় উচ্চ বর্গের মানুষ এটা ঠিকই যে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবিদেরকে জায়েদের নেতৃত্বে অভিযানে যেতে নির্দেশ করাটা সত্যিই অকল্পনীয় ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। এই ঘটনাকে তাই তাঁরা মুহাম্মদের একটি  অতুলনীয় উদার মনোভাব এবং সাম্যবাদী চিন্তাধারার অসাধারণ দৃষ্টান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। জায়েদকে কেন এরূপ অবিশ্বাস্য মর্যাদার আসনে মুহাম্মদ বসিয়েছিলেন? এ প্রসঙ্গে মুসলিম পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা যা বলেন তার মোদ্দা কথা হলো, জায়েদ আজীবন যে আনুগত্য দেখিয়েছেন, এবং বিশেষ করে মুতা অভিযানের মাত্র কিছুদিন আগে তাঁর স্ত্রী যয়নবকে ঘিরে যে যে চরম বেদনাদায়ক কাণ্ডগুলি ঘটে গিয়েছে তাঁর জীবনে, এবং তারপরও মুহাম্মদের প্রতি তাঁর আনুগত্যে সমান অটল থেকেছেন, মুহাম্মদ তারই মহা পুরস্কার  জায়েদকে দিয়েছিলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করে। শুধু ইসলামের অনুরাগীরাই এটা বিশ্বাস করেন তা নয়, যারা ইসলামের অনুরাগী নয় এবং নিরপেক্ষভাবে ইতিহাসের পর্যালচনা করেন তাঁরাও এমনটাই বিশ্বাস করেনআনোয়ার হেকমতও তেমন বিশ্বাসটাই অকপটে ব্যক্ত করেছেন তাঁর  উপরে উল্লেখিত গ্রন্থে তিনি কী লিখেছে শোনা যাক –
   Muhammad seemed to care much for Zayd, his freed slave, and later rewarded him for his                  devotion. He was appointed as a head of a small army on several expeditions, and it is reported by     some exegetes that Muhammad intended to make him his own successor. Aysha is among those who held that zayd was chosen as the successor of the Prophet. However, the ill-fated husband was killed in one of the forays against the tribes who were under the protection of the Byzantine Emperor. [see page – 61]
ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু, কৌতুহলী ও যুক্তিবাদী পাঠক ও ছাত্র হিসেবে এই ঘটনাটাকে আমার অন্য রকম হয়। মনে হয় জায়েদকে পুরস্কৃত করা নয়, এর পেছনে অন্য গল্প আছে। কী সেই গল্পটা হতে পারে তা বলার আগে মুতা অভিযান নিয়ে একজনে ইসলামের অন্ধানুরাগী লেখক ও ঐতিহাসিক কী লিখেছেন সেটা পড়ে নেওয়া যাক। তিনি লিখেছেন –

অভিযান (৬২৯ খ্রীঃ) পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের এক থেকে দেড় লক্ষ সৈনিকের বিরুদ্ধে ইসলামের তিন হাজার বীরসেনাঃ   ... ...

অষ্টম হিজরীর জামাদিউল আওয়াল মাসে(৬২৯ খ্রীঃ, জুলাই) হযরত মহম্মদ(দঃ) জায়েদ বিন হারিসের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈনিকের একটি ছোট্ট দল পাঠালেন, পূর্ব সাম্রাজ্যে শুধু প্রমাণ করতে ক্ষুদ্র মুসলমান দল তাদের ভয়ে ভীত নন। কিন্তু এবার একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল – অভিযানের বহু পুর্বেই। হযরত যে কোন স্থানেই যখনই কোন অভিযান পাঠিয়েছিলেন তিনি তা পাঠাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখতেন। কিন্তু এবার তা হয় নি। মদিনায় কিছু সংখ্যক শত্রু রয়ে যায়। যে কোন প্রকারেই হোক এই গোপন কথা তাদের কাছে পৌঁছে যায়। তারা সে খবর রোমে পৌঁছে দেয়।
হযরত মহম্মদ (দঃ) পূর্বেই অভিযান সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সকলকে বলেছিলেন – যদি এই অভিযানে নেতা যায়েদ বিন হারিস শহীদ হন, তাহলে জাফর বিন আবু তালিব তাঁর স্থান দখল করবে। যদি তিনিও শহীদ হন, তাহলে আবদুল্লাহ বিন রওয়াহ তাঁর  স্থলাভিষিক্ত হবেন।[দ্রঃ মহানবি, ড. ওসমান গণী, পৃ – ৩১৫]
ওসমান গণী যে বর্ণনা উপাস্থাপন করেছেন তা থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মুতা অভিযান যে ব্যর্থ হবে সে ব্যাপারে  মুহাম্মদ নিশ্চিত ছিলেন তিনি নিশ্চিত ছিলেন বলেই সেনাপতি জায়েদের মৃত্যু হলে তারপর কে সেনাপতি হবেন, দ্বিতীয় সেনাপতির মৃত্যু হলে তৃতীয় সেনাপতি কে হবেন তা অভিযানটি শুরু করার প্রারম্ভেই ঠিক করে দিয়েছিলেন। দেড় লক্ষ সেনাদের সামনে তিন হাজার সেনা পাঠানো মানে তো  তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। ড.গণী অবশ্য একটা হাস্যকর যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেছেন মুহাম্মদ রোম সম্রাটকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে মুসলমানরা তাঁর ভয়ে ভীত নয়। সেই বার্তা তো একটা চিঠি পাঠিয়েও দেওয়া যেত। ঐ রকম একটা তুচ্ছ বার্তা দেওয়ার জন্যে কোনো সমরনায়কই  আহাম্মকের মতো নিজের সামরিক শক্তি ও সৈন্য ক্ষয় করতে পারে  না গণী আর একটা তথ্য দিয়েছেন। তাহলো মুতা অভিযানের খবর রোম সম্রাটের কাছে আগাম পৌঁছে  গিয়েছিলো যে ঘটনা মুহাম্মদের আর কোনো অভিযানের ক্ষেত্রে কখনই ঘটে নি। এটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলে গণী একটা সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে যে কারণে মুহাম্মদ জায়েদকে ঐ অভিযানের সেনাপতি করেছিলেন সে কারণেই তিনি অভিযানের খবরটাও আগাম ফাঁস করে দিয়েছিলেন যাতে রোম সম্রাটের কানে খবরটা আগেভাগেই  পৌঁছে যায়, এবং ঘটেছিলও তাইমুতা অভিযানের আর একটি  ঘটনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুহাম্মদ তাঁর প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা ও বিশ্বস্ত সাহাবীদের – যেমন আবু বকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি, আলী [মুহাম্মদের জামাই], আল-জুবায়ের প্রমুখ -  সেই অভিযানে পাঠান নি। পাঠান নি, কারণ তিনি চান নি যে তাঁদের কারো প্রাণ হানি হোক। সমগ্র ঘটনাটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে এটাই স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় যে জায়েদকে সেই অভিযানের নেতা বানানো হয়েছিলো যাতে শত্রুসেনারা তাঁকেই  আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করে এবং শত্রুসেনাদের হাতে তিনি নিহত হনবলা বাহুল্য যে ঘটেছিলও তাই, এবং জায়েদ যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিহত হয়েছিলেন। যাঁরা মুতা অভিযানে জায়েদকে নেতা করার ঘটনাটিকে তাঁকে এক অসামান্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন তাঁরা হয় নিজেরা বিভ্রান্ত হয়েছেন, না হয় সচেতনভাবে এক নৃশংস সত্য ঘটনাকে গোপন করার অন্যায় চেষ্টা করেছেন। সত্য ঘটনাটি হলো মুহাম্মদ জায়েদকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যেই ঠাণ্ডা মাথায় মুতা অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাঁর নেতা করেছিলেন জায়েদকে। প্রশ্ন উঠবে মুহাম্মদ হঠাৎ কেনো জায়েদের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য পরিকল্পনা করতে যাবেন? কিন্তু এ পেশ্ন তোলার আগে তাদের তো এ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে যে, যে অভিযানে সেনাপতির মৃত্যু নিশ্চিত ঠিক সেই অভিযানেই জায়েদকে সেনাপতি করা হয়েছিলো কেনো?    
এর উত্তর পেতে হলে  মনোবিদের  দৃষ্টিতে মুহাম্মদ-যয়নব-জায়েদ কাণ্ডটি  বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে  হবে । এর জন্যে কাউকে মনোবিদ হতেই হবে তা নয়, কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অপর জনের মনের কথা বোঝার অল্প-বিস্তর জ্ঞান থাকেই। জায়েদের স্ত্রী যয়নবকে পাওয়ার জন্যে মুহাম্মদ কীভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন এবং তারজন্যে কী কী জঘন্য পদক্ষেপ তিনি করেছেন তা নিয়ে উপরে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। পাহাড় প্রমাণ সব বাধা সরিয়ে জয়নবকে স্ত্রীরূপে কাছে পেলেও তিনি যেন তার আনন্দটা পুরোপুরি উপভগ করতে পারছিলেন না। জায়েদকে দেখলেই  মুহাম্মদের মনের মধ্যে একটা পাপবোধ মাথা তুলছিলো, সে বোধ তাঁকে সব সময় দগ্ধ করছিলোজায়েদ স্ত্রী হারিয়েছেন, পিতা হারিয়েছেন, পরিবার হারিয়েছেন, ভবিষ্যত হারিয়েছেন, এবং হারিয়েছেন সামাজিক মর্যাদাও। সব কিছু হারিয়ে একটা মানুষ যখন নিঃস্ব হয়ে যায় তখন তাঁর সব হারানোর ব্যথা স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে তার শরিরী ভাষায়। আর সেই ভাষাটা যিনি সবচেয়ে ভালো পড়তে পারেন তিনি হলেন সেই ব্যক্তি যে তার কাছ থেকে সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। মুহাম্মদের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিলো। জায়েদের বিষণ্ণ মুখ ও বিবর্ণ চেহারা দেখলে মুহাম্মদ কিছুতেই স্বস্তিবোধ করতেন না, সব সময় আত্মগ্লানিতে ভুগতেন জায়েদের উপস্থিতিটা  মুহাম্মদের কাছে ক্রমশঃ একটা বড়ো পীড়ার কারণ হয়ে উঠছিলো। একদা অতি স্নেহের পোষ্য-পুত্র জায়েদ তাই মুহাম্মদ কাছে অবাঞ্ছিত একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। ফলে তাঁকে চোখের সামনে থেকে সরানোটা ছাড়া মুহাম্মদের কাছে অন্য বিকল্প ছিলো না। জায়েদকে শেষ করার জন্যেই তাই মুহাম্মদ মুতা অভিযানের পরিকল্পনা [আসলে ষড়যন্ত্র] করেছিলেন মুতা অভিযানের উদ্দেশ্যই যে ছিলো জায়েদকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়া সে কথা বলেছেন সিরিয় ঐতিহাসিক মুমিন সালেহও। তিনি ‘পুত্রবধূ জয়নবের সঙ্গে নবী মুহাম্মদের স্বর্গীয় বিবাহ ও পুত্র জায়েদের জীবন ধ্বংস’ প্রবন্ধে লিখেছেন –
মনে হচ্ছেঃ মুহাম্মদ যা কিছু চেয়েছিলেন সব পেলেও তাঁর সুখভোগের অনুভূতির ভিতরেও একটি সূক্ষ্ম কাঁটা বিঁধে থেকেছিল। সেটা হচ্ছে জায়েদের বিষণ্ন দৃষ্টি। জয়নবের সঙ্গে বিবাহের পর থেকে জায়েদের অস্তিত্ব ছিল মুহাম্মদের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে পীড়াদায়ক ও গ্লানিকর। এক সময় যে জায়েদ ছিলেন মুহাম্মদের প্রিয় পোষ্য পুত্র, এখন তিনি আল্লাহ্‌র নিখুঁত মানুষের পৃথিবীতে অবাঞ্ছিত। কাজেই পৃথিবী থেকে জায়েদের বিদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। [সুত্রঃ http://nobojug.org/posts/mumin-salih/158]

মুহাম্মদ ও জয়নবের বিয়ের সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যোগ আছে যেটা না বললে মুহাম্মদ-জয়নব কাণ্ডটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হিজরী ৪র্থ সনে মুসলিম মেয়েদের উপর হিযাব আরোপ করা হয়। এটা একটা চরম অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপে মুসলিম নারীদের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছে। হিযাবকে আমার চলমান কারাগারের একটি বদ্ধ কুঠুরি ব্যতীত অন্য কিছু মনে হয় নাহিযাব নিয়ে বিধি-নিষেধের  বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় মুহাম্মদ ও জয়নবের মধ্যে বিয়েটা সম্পন্ন হওয়ার পর। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে একমাত্র এই বিয়েটাতেই মুহাম্মদ ভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেই ভোজে এতো বেশী সংখ্যক আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যে কয়েকদিন ধরে ভোজ পর্বটি চলেছিলো। সেই ভোজের মধ্যে একদিন একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। সেদিন সমস্ত অতিথি বর্গ চলে যাওয়ার পরও তিন জন অতিথি তখনও যয়নবের ঘরে আলাপ-চারিতায় মগ্ন। মুহাম্মদ বার বার জয়নবের ঘরে ঢুকে দেখে একই দৃশ্য, তাঁরা গল্পে এতোটাই মশগুল যে ওঠার কথা যেন ভুলেই গেছেন। এদিকে যয়নবকে একান্তে পাওয়ার জন্যে মুহাম্মদের ক্রমশঃ ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন, তাঁর আর একেবারেই তর সইছে না, অথচ চক্ষুলজ্জায় অতিথিদের উঠে যেতে বলতে পারছেন না। এ রকম পরস্থিতিতে অবশ্য স্বয়ং আল্লাহ নিজেই বেশী অস্থির হয়ে পড়তেন তাঁর পিয়ারা নবির জন্যে এবং কাল বিলম্ব না করে ওহি পাঠিয়ে নবিকে উদ্ধার করতেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। আল্লাহ জিব্রাইল  ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছিলো একটি এমন ওহি  দিয়ে  যাতে নবির ঘরে আর কোনো অতিথির প্রবেশ করা তো দূরের কথা,  যাতে তাঁরা নবির উঁকিও না মারতে পারেনসেই বিখ্যাত [?] ওহিটি হলোঃ 
হে মুমিনগণ! তোমাদিগকে অনুমতি দেওয়া না হইলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করিয়া ভোজনের জন্য নবী-গৃহে প্রবেশ করিও না। তবে তোমাদিগকে আহ্বান করিলে তোমরা প্রবেশ করিও এবং ভোজনশেষে তোমরা চলিয়া যাইও; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হইয়া পড়িও না। কারণ তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদিগকে উঠাইয়া দিতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ্‌ সত্য বলিতে সংকোচ বোধ করেন না। তোমরা তাহার পত্নীদের নিকট হইতে কিছু চাহিলে পর্দার অন্তরাল হইতে চাহিবে। এই বিধান তোমাদের ও তাহাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কাহারও পক্ষে আল্লাহ্‌র রাসূলকে কষ্ট দেওয়া সঙ্গত নহে এবং তাহার মৃত্যুর পর তাহার পত্নীদিগকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কখনও বৈধ নহে। আল্লাহর দৃষ্টিতে ইহা ঘোরতর অপরাধ।” (কোরান ৩৩:৫৩)


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...