Saturday, February 14, 2015

আপ ও কেজরিওয়ালের জয়ে অভিনন্দন জানানোর নৈতিক অধিকার মমতা ব্যানার্জীর নেই


দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে এমন চমক  ছিলো কেউ আন্দাজ করতে পারে নি – মিডিয়া থেকে রাজনোতিক দল, কেউই, এমনকি কেজরিওয়াল এবং তাঁর নেতাকর্মীরাও  । কেজরিওয়াল নিরঙ্কুশ পাবেন এমন আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু ৬৭-৩-০ এই অনুপাত ছিলো সকলের কাছেই অকল্পনীয় । শতাব্দী প্রাচীন জাতীয় দল কংগ্রেস যারা স্বাধীনতা এনেছে বলে বড়াই করে এবং বৃটিশদের অনুকরণে অহঙ্কার করে বলে যে ভারতের কোথাও কংগ্রেসের সূর্য অস্ত যাবে না সেই কংগ্রেস দিল্লিতে সত্যিই অস্তাচলে চলে গেলো – একেবারে শুন্য আর মোদি-অমিত জুটি যাঁরা দিল্লির মসনদে বসেই গেছেন বলে শুধু দিন গুণছিলেন তারাও প্রায় নিশ্চিহ্ন আপের ঝাড়ু-ঝড়ে -  সত্তরে মাত্র তিনবিভিন্ন দলের ভোট প্রাপ্তির হারেও রয়েছে সমান চমক ।  ২০১৩-র বিধানসভায় কংগ্রেস পেয়েছিলো ২৫% ভোট । ২০১৪-র লোকসভায় কমে ১৫%, এবারে আরো কমে গিয়ে মাত্র ৯.৭%    আর মোদির অশ্বমেধের ঘোড়া দিল্লিতে কেজরিওয়ালের পায়ের কাছে এসে শুধু  চিৎপাটাংই  হয় নি, ভোটের ভূমিতেও ধ্বস নেমেছে তাঁদের । ২০১৩-র বিধান সভায় ৩৩.১% ভোট ২০১৪-র লোকসভায়  ১৫% বেড়ে  ৪৬% । এবার ঝাড়ু-ঝড়ে ১৪% উড়ে গিয়ে  ৩২.২%  
কেনো এতো বড়ো জয় একদিকে,  আর অন্যদিকে বিপর্যয় ? কংগ্রসের কথা যতো কম বলা যায় ততোই ভালো, বেশি কথা বলে শুধু শুধু সময় ও কাগজ নষ্ট । একটা কথা বলাই  যথেষ্ট কংরেস সম্পর্কে,  মানুষের কাছে দলটার বিশ্বাসযোগ্যতা  সব দিক থেকেই  একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এবং এই দলের নেতৃত্ব কোনো কিছু থেকেই  শিক্ষা নিতে চায় না । আর বিজেপি, কংগ্রেসের বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে যে দল  একের পর এক রাজ্য জয় করে  তর তর করে  এগিয়ে যাচ্ছিল,  তার  কেনো এমন ভূমিধ্বস পরাজয় ? কেজরিওয়াল বলেছেন কংগ্রেস ও বিজেপির অহঙ্কারই তাদের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে । অবশ্যই এটা একটা বড়ো কারণ । লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ে পেয়ে মোদি যে ভীষণ অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন তা তাঁর চলনে-বলনে এবং জীবন-যাপনে নগ্নভাবেই প্রকট  হয়ে দেখা দিয়েছে । তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন  যে গত লোকসভা নির্বাচনে বিশাল জয় তাঁর জন্যেই হয়েছে, বিজেপির জন্যে নয়,  এই ধারণা  তাঁকে অহঙ্কারী করে তোলে । এই অহঙ্কার দিল্লির  মানুষ  পছন্দ করে  নি । শুধু মানুষ কেনো তাঁর দলের লোকেরাও পছন্দ করে নি । মোদি সচেতনভাবে একটা কাজ করে আসছেন প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে, তা হলো সরকারে ও দলে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করা । দলে ও সরকারে একটাই মুখ – শুধু মোদির মুখ – এই অবস্থা তিনি ইতিমধ্যেই অনেকটাই তৈরী করেও ফেলেছেন । তা করতে গিয়ে সর্বত্র তিনি বশংবদদের তুলে নিয়ে এসেছেন যাতে সবাই  বিজেপির বদলে তাঁর নামে জয়ধ্বনি করে । সে লক্ষ্যেই তিনি দিল্লির যে নেতৃত্ব ২০১৩-র নির্বাচনে বিজেপিকে প্রায় ক্ষমতার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো তাঁদের মাথায় বসিয়ে দেন কিরণ বেদিকে   বিজেপি জিতলে  কিরণ যে মোদির নির্লজ্জ বশংবদ হতেন তা বলা বাহুল্য ।  অহঙ্কারী ব্যক্তির মাটিতে পা পড়ে না মোদিও মাটি ছেড়ে আকাশে উড়তে চাইছে    ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ফিগার হতে চাইছেন । দেশের কাজকর্ম ফেলে রেখে বিশ্ব পরিক্রমায় মন দিয়েছে  সেই লক্ষ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান ওবামাকে নিয়ে এসেছেন প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি করে । গান্ধিজি, জহরলাল, ইন্দিরাগান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের  আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পরিচিতিকে ছাপিয়ে বিশ্বের আঙিনায়  নিজেকে তুলে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন । তা করতে গিয়ে তিনি জীবন-যাপনেও দৃষ্টিকটু পরিবর্তন আনতে দ্বিধা করেন নি – প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে পরেছিলেন একটা দশলাখি কোট । এ   সব দিল্লির মানুষ ভালোভাবে নেয় নি । মোদি বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লোকসভা নির্বাচনে  দিল্লীর মানুষ তা বিশ্বাস করে তাঁকে দুহাত উজাড় করে ভোট দিয়ে কেজরিওয়াল ও কংগ্রেসকে শূন্য হাতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছিলকংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের প্রধান ক্ষোভ ছিলো তিনটি – অনুয়ন্নন, অপশাসন ও দুর্নীতি । মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষেরজন্যে কাজ করবেন, অপশাসন দূর করবেন এবং দুর্নীতি উচ্ছেদ করবেন এবং বিদেশে পাচার হওয়া  কালোটাকা ফিরিয়ে আনবেন ১০০ দিনের মধ্যে ।  কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই এই প্রতিশ্রুতিগুলি রূপায়নের সদিচ্ছার ছাপ রাখতে পারে নি ।
একটা প্রবাদ চালু আছে ইংরাজীতে – Success has many fathers, but failure has none.   হ্যাঁ, সঙ্ঘপরিবারও হারের জন্যে দোষ চাপাচ্ছে মোদির উপর ।   অথচ সঙ্ঘপরিবারের উগ্র হিন্দুত্ববাদও বিজেপির বিপর্যয়ের একটা বড়ো কারণ ।  সঙ্ঘপ্রধান ভাগবত বলেছেন ভারতবাসী মানেই হিন্দু । তাঁর কথা তো শুধু কথা নয়, অহিন্দু সকলকে হিন্দু বানাতে জোর কদমে চালানো হচ্ছে  ‘ঘর ওয়াপাসি’ কর্মসূচী যাতে আছে  যেমন আর্থিক প্রলোভনের দাওয়ায় তেমনি আছে  বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসের  প্রয়োগও । মোদি জামানার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কমপক্ষে সাতটি গির্জায় হিন্দু সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে । ইসলামি কায়দায় প্রচার করে অহিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে দেশজুড়ে  ইসলাম মানুষকে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী এই দুভাগে ভাগ করে অবিশ্বাসীদের উপর অত্যাচার চালায়, আর সঙ্ঘপরিবার বলছে – যারা বিজেপি তারা রামজাদা ও বাকিরা হারামজাদা । হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর লক্ষ্যে   হিন্দু নারীদের কেউ বলেছে চারটি সন্তান, কেউ বা বলেছে দশটি সন্তানের জন্ম দিতে । গান্ধিজীর হত্যাকারি নাথুরাম গডসের নামে মন্দির নির্মাণ করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে ।  সঙ্ঘপরিবার আরো বলেছে যে  জহরলাল নেহরুকেও হত্যা করাও দরকার  ছিলো । দিল্লির মানুষ এ সব পছন্দ করে নি । তাই হিন্দু-অহিন্দু নির্বিশেষে সব অংশের মানুষ এই উগ্র  হিন্দুত্ববাদকে প্রতিহত  করতে বিজেপির  বিরুদ্ধে আপকে ঢেলে ভোট দিয়েছে   দিল্লি এবার   স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র  চাই, হিন্দুরাষ্ট্র নয়  । এই বার্তাটাই আমার মতে আপের বিশাল জয় ও বিজেপির পরাজয়ের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ।
এ কথা ঠিক যে কেজরিওয়ালের পক্ষে ব্যাপক নেতিবাচক ভোট পড়েছে,  কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে তাঁর পক্ষে ইতিবাচক ভোটও খুব কম পড়ে নি ।  এখন সারা ভারতে দুর্নীতি একটা বড়ো ইস্যু । এই প্রশ্নে কোন দলেরই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, কংগ্রেস ও বিজেপির তো একেবারেই নেই ।  সেখানে কেজরিওয়ালই একমাত্র রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে পা রেখেছেন এবং সেই লড়াই তাঁর জারি থাকবে বলে অঙ্গিকার করেছেন । বহু  মানুষ  তাঁর এ কথায়  বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর দলকে ভোট দিয়েছে   সুশাসন আজ গোটা দেশেই দুর্লভ । ঘুষ ছাড়া সরকারি অফিসে যেমন  কাজ হয় না, তেমনি  ঘুষ কিংবা শাসক দলের ইশারা ছাড়া পুলিশও কোনো কাজ করে না । কেজরিওয়াল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বচ্ছ প্রশাসন উপহার দেবেন । তিনি যে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেন নি তার নমুনা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়েছিলো তাঁর ৪৯ দিনের সরকার ।  বিদ্যুতের  দাম কমানো ও প্রত্যকে বাড়িতে ন্যুনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ জল সরবরাহ করার যে প্রতিশ্রুতি  তিনি  দিয়েছিলেন তা যে একদম ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ছিলো  না তার প্রমাণও দিল্লির মানুষ পেয়েছিলেন তাঁর সরকারের কাছ থেকে । ক্ষমতা পেলে সবাই দাম্ভিক ও অহংকারী হয়ে যায়,  কেউ নিজের ভুল স্বীকার করে না । কেজরিওয়াল যে তাঁদের দলে পড়েন না তার প্রমাণ দিল্লিবাসী পেয়েছে বহু ঘটনায় । ৪৯ দিনের মাথায় তাঁর সরকার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা দিল্লির মানুষ পছন্দ করে নি । এটা যে তাঁর ভুল হয়েছিলো তা উপলব্ধি  করা মাত্রই তা স্বীকার করে নিয়ে মানুষের কাছে গিয়ে   ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন । আর এটাও স্পষ্ট ছিলো যে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে তাঁর আন্তরিকতা ছিল, কপটতা ছিলো না,  যা  মানুষকে আশ্বস্ত করেছে অনেকটাই ।  একজন গরীব মানুষ ভুল বুঝে তাঁর গলায় মালা পরানোর নাম করে চড় মেরেছিলেন । তিনি ঐ লোকটার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে তাঁর বাড়ি গিয়ে জানবার চেষ্টা করেছিলেন  তাঁর উপর ঐ লোকটার ক্ষোভের কী কারণ যে মেরেছে তার দোষ না খুঁজে তিনি জানবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর নিজের কোনো দোষ বা ভুল আছে কী না । এমন ক্ষমাশীল, অদাম্ভিক, নিরহঙ্কারী, হৃদয়বান ও আত্মসমীক্ষক মানুষ তো দিল্লি কেনো ভুভারতেই  বিরল   আর একটা জিনিষ দিল্লির মানুষকে অনেক বেশী ভরসা জুগিয়েছে যা হলো দিল্লির জামা মসজিদের প্রধান ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারীর সেধে সমর্থন দেওয়াকে পত্রপাঠ প্রত্যাখান করা । এ ঘটনা ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ঘটলো যা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এক নতুন দিক ও অধ্যায়ের সূচনা হলো বলে মনে হয়   এ প্রসঙ্গে আরো কিছু দরকারি কথা নিবন্ধের শেষ পরিচ্ছেদে আলোচনা করবো ।
দিল্লির এই ফলাফল সারা দেশে, এমনকি ভারতের বাইরেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় ।  আমাদের রাজ্যে যে পরিবর্তনের সরকার চলছে তার কাজকর্মে মানুষ যারপর নাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ । মানুষ পরিবর্তনের পরিবর্তনের চাইছে । এই রাজ্যে দিল্লির ভোটের প্রভাব কতটা পড়ে, কীভাবে পড়ে তার দেখার জন্যে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে । কিন্তু কেজরিওয়ালের বিপুল জয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে যেভাবে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কেজরিওয়াল ও দিল্লির মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তা তা রাজ্যবাসীকে অবাক করেছে । তবে মমতা ব্যানার্জীর উচ্চ্বাস দেখে শুধু অবাকই নয়,  রাজ্যের মানুষ হাসাহাসিও করছে  কারণ, দিল্লির মানুষ সেখানে যেমন বিজেপির হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো এ রাজ্যের মানুষও তেমনি মমতার হাত থেকে মুক্তি পেতে আগ্রহী ।  মমতার তাই কেজরিওয়ালের জয়ে উচ্চ্বসিত হওয়ার চেয়ে বিমর্ষ হওয়ারই কথা ।   মমতার উচ্চ্বাসের পশ্চাতে  বোধ হয় দুটি কারণ আছে । এক. তাঁর প্রধান শত্রু পরাস্ত হয়েছে । দুই. স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কেজরিওয়ালের উজ্জ্বলতায় তাঁর নিজের কালিমালিপ্ত ইমেজকে আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস  মমতা ব্যানার্জীর কেজরিওয়ালকে অভিনন্দন জানানোর ঘটনা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করছে, মমতার কি  অভিনন্দন জানানোর কোনো নৈতিক অধিকারই আছে ?  কেজরিজির প্রধান লড়াই লড়াই যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেখানে মমতা নিজেই বিরাট বিরাট দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর  অভিযোগে অভিযুক্ত । হাওয়ায় চপ্পল পরে, আটপৌরে শাড়ি পরে ও টালির ছাউনির নীচে বাস করে সততার যে ইমেজ তৈরী করেছিলেন সেটা যে ছিলো অভিনয় ও নিরেট ভণ্ডামি তা এখন স্পষ্ট । তাঁকে আগে সততার প্রতীক বলা হতো, এখন কুখ্যাত চিটফাণ্ড সংস্থা সারদার প্রতীক বলছে মানুষ । কেজরিওয়াল যেখানে দিল্লির সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন সেখানে মমতার সরকারের তো দুঃশাসন ও অপশাসনের সীমা-পরিসীমা নেই ।  পুলিশ প্রশাসন থেকে সাধারণ প্রশাসনের সর্বস্তরে ঘুষ ও দলতন্ত্রের দাপাদাপি  অসহনীয় হয়ে উঠেছে  চারিদিকে তোলাবাজি, সিণ্ডিকেট রাজ ও প্রোমোটার রাজের দাপট বাংলার অবস্থা আজ সঙ্গীন ।  নারী নির্যাতন ও ধর্ষণে পশ্ছিমবঙ্গকে এক নম্বরে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর সরকার ।   তাঁর সরকার ও  দলের নীতি-নৈতিকতার বালাই বলতে কিছু নেই । দেদার অর্থ    পদ বিলিয়ে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের ভাঙিয়ে এনে একের পর এক পঞ্চায়েত ও পৌর প্রতিষ্ঠানগুলি  দখল নেওয়ার এক নজিরবিহীন কুৎসিত খেলায় তিনি মত্তকেজরিওয়াল  ২০১৩-র নির্বাচনে  মুস্লিম ধর্মীয় নেতাদের স্মরণাপন্ন  হয়ে যে ভুল করেছিলেন এবার সে ভুলটি সংশোধন করে এক নয়া সোনালি ইতিহাস রচনা করেছেন    তিনি দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম বুখারীর  যেচে দেওয়া সমর্থনকে  রূঢ়ভাবে  প্রত্যাখান করে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা তুলে ধরার নজিরবিহীন সাহস দেখিয়েছেন ।  আর  মমতাতো   ইমাম বরকতি ও  পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকের মাঝে বসে হিজাব পরে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে দোওয়া করার ভণ্ডামি করে ধর্মনিরপেক্ষতার বুকে ছুরি মারতেও দ্বিধা করছেন না  বরকতি,  ত্বহা সিদ্দিকি, সিদ্দিকুল্লাহ প্রমুখ ধর্মীয় নেতারা তো তাঁকে রীতিমতো নাকে দড়ি দিয়ে যেমন খুশী ঘোরাচ্ছেন । তাঁরা বলেছিলেন সলমান রুশদি যেনো কলকাতায় পা না দেয় । মমতা রুশদিকে আসতে দেন নি । তাঁরা বলেছিলেন তসলিমা যেনো এ রাজ্যে আর ঢুকতে না পারে, মমতা তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছেন না । তাঁরা মাদ্রাসা চেয়েছিলেন, তিনি এক হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন দিতে বিলম্ব করেন নি । তাঁরা বলেছিলেন ইমাম ও মোয়াজ্জেনদের ভাতা দিতে, তিনি দিয়েছেন । তাঁরা দাবি করেছিলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-এর নাম বদলে আলিয়া মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয় রাখতে,  দাবি পূরণ করতে দ্বিধা করেন নি । তাঁরা   ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার বন্টনের চুক্তি হোক চায় নি,  মমতা সেই চুক্তি হতে দেন নি । ঐ নেতাদের কথাতেই কট্টর মৌলবাদি নেতা এবং সিমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহমেদ হাসানকে রাজ্যসভার সদস্য করেছেন    তাঁদের কথাতেই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাঞ্চাল করার জন্যে  জামাতের সরকারবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও হিংস্র আন্দোলনকে  তাঁর দল  নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে  এ ক্ষেত্রে প্রধান মধ্যস্থাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন  সেই আহমেদ হাসান । কলকাতার ধর্মীয় নেতারা বাংলাদেশের জামাতের  আহত কর্মীদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়ে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা  করেছেন ধারাবাহিকভাবে   সব জেনে শুনেও রাজ্য সরকারের পুলিশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় থেকেছে । বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে এ বঙ্গের  মৌলবাদীরা পুলিশী  প্রহরায় কলকাতার বুকে মিছিল করেছে, কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের  সমর্থনে মমতা ব্যানার্জীর পুলিশ আমাদের সংহতি মিছিল করতে দেয় নি । বরকতি-সিদ্দিকি-সিদ্দিকুল্লাহারা খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কাণ্ড ধামাচাপা দিতে বলেছিলেন, মমতা ব্যানার্জী  তাঁদের হতাশ করেন নি ।  এ সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন ভাবার অবকাশ নেই, কারণ তৃণমূল কংগ্রেস বা রাজ্য সরকার একটি অভিযোগকেও চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারে নি   এহেন মমতা ব্যানার্জি কোন অধিকারে কেজরিওয়ালকে তাঁর জয়ের জন্যে অভিনন্দন জানাতে পারেন  ?   
প্রচুর ত্রুটি ও ঘাটতি থাকা সত্বেও ভারত  একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ । স্বভাবতই রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে   ধর্মের সংযোগ ও সম্পর্ক থাকার কথা নয় এখানে । কিন্তু আছে । ভালোভাবে  এবং  দৃঢ়ভাবেই আছে । রাষ্ট্রের উপর ধর্মের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সর্বত্র । ধর্মীয় নেতারা সর্বদা রাষ্ট্র ও  রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ছড়ি ঘোরায় । মোল্লা-ইমাম, ঠাকুর-পুরোহিত, পীর বাবা ও সাধু বাবারা দেশ ও সমাজটাকে সর্বদা পেছন দিকে টানে । তবুও রাজনীতিকরা ভোট পাওয়ার জন্যে তাদের কাছে ছুটে যায় বারবার এবং তারা যা বলে তাই পালন করেনতাদের কথাতেই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে সাংবিধানানিক  মর্যাদা দেওয়া হয়েছে একদিকে, আবার আর একদিকে বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করার সময় সরকার চোখ বুঁজে থেকেছে । এ রকম অজস্র দৃষ্টান্ত আছে । তবে এটা অনস্বীকার্য যে মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের খুশী করার প্রবণতা তুলনায় অনেক বেশী । এই কুসংস্কৃতি আবার এ রাজ্যেই  অধিক প্রবল । মূল কথা হলো প্রাক-স্বাধীন ভারতবর্ষে  রাষ্ট্রের সঙ্গে  ধর্মের এবং রাজনীতিক নেতাদের সঙ্গে  ও ধর্মীয় নেতাদের যে অশুভ জোট তৈরী হয়েছিলো তা স্বাধীনোত্তর ভারতে ফুলে-ফলে আরো পল্লবিত হয়েছে  এই জোট শুধু তো অশুভই নয়, এটা রাষ্ট্রের শরীরের পক্ষে যক্ষা ব্যাধির মতো বিপজ্জনক যা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাদের  গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও আদর্শকে ।  এই রোগটা যতদিন থাকবে ততোদিন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে থাকবে  রাষ্ট্র থেকে তাই ধর্মকে এবং রাজনীতি থেকে ধর্মীয় নেতাদের বিচ্ছিন্ন করার বিকল্প নেই । কাজটা খুব কঠিনও নয় বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি । কারণ ধর্মভীরু মানুষরা ধর্মীয় নেতাদের কথায় ভোট দেয় বলে যে ধারণা আছে তা একেবারে সঠিক নয়  । মুসলিমরা নাকি মোল্লা-মুফতিদের  কথায় ভোট দেয়, এই অভিযোগ শোনা যায় । রাজনিতিকরাও তাই বিশ্বাস করেন বলে তাঁরা মোল্লা-মুফতিদের কথায় প্রায় কান ধরে ওঠা-বসা করার মতো আচরণ করেন  । এই ধারণাটাও ভুল ।  এটা যে ভুল তা প্রমাণ পাওয়া গেলো দিল্লির এবারের ভোটে । কেজরিওয়াল এবার মুখের উপর দিল্লির জামা মসজিদের ইমামকে বলে দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর সমর্থন চান না । তৎসত্ত্বেও দিল্লির মুসলিমরা দুহাত উপুর করে ভোট দিয়েছেন কেজরিওয়ালকে । কেজরিওয়াল এ ভাবেই ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার যে নতুন অধ্যায় শুরু করলেন তা ভারতের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা ও অধ্যায় যা স্বর্ণাক্ষরে খোদায় করা থাকবে । আমার মতে দিল্লির নির্বাচনে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন যা আপ ও কেজরিওয়ালের জয়ের থেকেও অনেক অনেক বড়োঅন্য রাজনীতিকরা  কেজরিওয়ালের পথ অনুসরণ করেন কী না সেদিকেই এবার গোটা ভারতের চোখ থাকবে ।  

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...