Saturday, January 10, 2015

মুক্তচিন্তার আন্দোলনে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য


মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল, সৃজনশীল । মানুষ আবার সাধারণভাবে বিশ্বাসপ্রবণও । বিশ্বাসপ্রবণতা অবশ্য  মানুষের একটা নেতিবাচক বৈশিষ্ট বা অপগুণ তাই চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা পরষ্পরের পরিপূরক,  কিন্তু বিশ্বাসপ্রবণতার সঙ্গে   চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতার  সম্পর্ক   সাপে-নেউলের মতো  শত্রুতামূলক তথাপি প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে এই দুই বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট বিদ্যমান  সাধারণভাবে এটা দেখা যায় যে অধিকাংশ মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে বিশ্বাসপ্রবণতাফলে সমাজে চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষদের চেয়ে বিশ্বাসপ্রবণ মানুষের আধিক্য অনেক  বেশী ।  বিশ্বাসপ্রবণতা শেখায়  যুগ যুগ ধরে  যা দেখে আসছি, মেনে আসছি, সেগুলো সবই সত্য ও চিরন্তন   বিশ্বাসপ্রবণতা মানুষকে অন্ধবিশ্বাসী ও বিশ্বাসের দাস করে  তোলে । বিশ্বাসের দাস এই মানুষগুলোর অপর নাম গোঁড়া মানুষ  গোঁড়া মানুষরাও চিন্তাশীল । তবে তাদের চিন্তার পরিসর খুবই সীমিত, বিশ্বাসের গণ্ডি তারা অতিক্রম করতে পারে না ।
মানুষের এই গোঁড়ামি  সাধারণভাবে মানুষের চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে । মানুষের চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা ব্যক্তি মানুষের  বিকাশ ও উত্তরণ এবং  সামগ্রিকভাবে মানব সমাজের বিকাশ  ও উত্তরণে প্রধান  ভূমিকা নিয়ে থাকেঅপরদিকে গোঁড়া মানুষের দল  মানব সমাজের বিকাশের পথ রোধ করতে চায় । বিশ্বাসের দাস  গোঁড়া মানুষগুলো  সাধারণভাবে সর্বদাই সকল ঐতিহ্য তা যতই মন্দ হোক, সামাজিক বা পারিবারিক  প্রথা তা  যতই কুপ্রথা  হোক, এবং  সকল  সংস্কার তা যতোই কুৎসিত ও কুসংস্কার হোক তাকে  আঁকড়ে থাকতে চায় ।  যা যুগ যুগ ধরে মানুষ মেনে আসছে, সত্যি বলে জেনে আসছে তা যে ভুল হতে পারে  এরা তা বিশ্বাস করতে চায় না, ভাবতেও চায় না  তাই চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষ যখন  জরাজীর্ণ ও পচাগলা  ঐতিহ্য, প্রথা ও সংস্কারগুলি ভাঙতে চায় তখন  গোঁড়া মানুষরা  তা মেনে নিতে পারে না, তারা অস্থির ও চঞ্চল হয়ে ওঠে, এমনকি  মারমুখী ও হিংস্রও  হয়ে ওঠে । কিন্তু ব্যাপক সংখ্যাধিক্যের কারণে  গোঁড়া মানুষগুলোরই  আবার  সমাজের উপর  আধিপত্য থাকে  । তারাই সমাজের চালকের আসনে প্রতিষ্ঠিত । তারাই তৈরী  করে  সমাজের  যাবতীয় বিধি-নিষেধ ।  সেই বিধি-নিষেধের মধ্যে কতকগুলো কড়া নিষেধাজ্ঞা । যেমন,  কেউ মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করতে পারবে না,  প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার ও লঙ্ঘন করতে পারবে না । করলে  কী হবে ? কঠোর শাস্তি পেতে হবে । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে যারা প্রথা, ঐতিহ্য ও সংস্কার ভেঙে সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছে, কিংবা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে তাদের উপর দুঃসহ নির্যাতন চালানো হয়েছে, এমনকি চরমতম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তাঁদের হত্যাও করা হয়েছে ।   
আমরা জানি রাজা রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্রের কথা । প্রথম জন যখন সহমরণ প্রথা ভাঙার আহ্বান জানিয়েছিলেন,   দ্বিতীয় জন যখন বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করার কথা বলেছিলেন তখন  হিন্দু সমাজ তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলোমহিয়সী নারী রোকেয়া যখন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি ও নারীর অধিকারের জন্যে কলম ধরেছিলেন এবং স্কুল খুলেছিলেন তখনো তাঁর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো ।  রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও রোকেয়ার বিরুদ্ধে শুধু মোল্লা-পুরোহিত ও ধর্মপ্রাণ নিরক্ষর মানুষরাই নয়, উচ্চ শিক্ষিত মানুষরাও গেলো গেলো রব তুলেছিলেন  বিজ্ঞানের জগতে আমরা দেখেছি আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা । ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাসের লেখা ‘আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন’ গ্রন্থটিকে গীর্জা  নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো । গ্যালিলিও  যখন কোপার্নিকাসের  তত্ত্বকে আরো এগিয়ে নিয়ে বললেন পৃথিবী ঘুরছে  দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করলেন তখন গীর্জা তার   উপর প্রবল নির্যাতন করে । তাঁকে ধর্মোদ্রোহীতার অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে  তিনি পৃথিবীর গতির তত্ত্ব তুলে নিতে বাধ্য হন  । কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে সমর্থন  করায়  এবং পৃথিবীর মতো আরো অনেক গ্রহ আছে  বলায়  লিওনার্দো ব্রুনোকে ১৬০০ সালে খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল গীর্জার পাদ্রীরা ।  গ্যালিলিও ও ব্রুনোরও বহু আগে বলে সক্রেটিসকে ইহুদি যাজকরা বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলো  । তাঁর অপরাধ ছিলো তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না  এবং সেটা তাঁর ছাত্রদের মধ্যে  প্রচার করতেন ।  এভাবে প্রাচীন কাল থেকেই বিজ্ঞান ও দর্শনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে   ধর্মান্ধ মানুষরা  এ রকম ঘটনা এখন কম হলেও সম্পূর্ণ অতীত হয়ে গেছে এমন নয় । মাত্র কয়েক বছর আগে সৌদি  আরবের গ্রান্ড মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন এই মর্মে যে, পৃথিবী সমতল, যারা বলে পৃথিবী গোলাকার তারা আল্লাহ ও ইসলামের শত্রু, তাদের শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড ।  
মূল কথা হলো মানব সমাজে মানুষের চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতা এই দুটি বৈশিষ্টের সঙ্গে  মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও চিন্তার গোঁড়ামির  দ্বন্দ ও বিরোধ আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে ।  কোনো কালেই গোঁড়া মানুষের দল চিন্তাশীল মানুষদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার জায়গা ও অবকাশ দেয় নি । চিন্তাশীল মানুষেরা তারা দার্শনিকই হোন, কিংবা সমাজসংস্কারকই হোন কিংবা বিজ্ঞানীই হোন, যেই হোন না কেনো, কেউ স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ ও ক্ষেত্র পায় নি । সবাইকে দমবন্ধ করা পরিবেশে চিন্তা করতে হয়েছে এবং গোঁড়া মানুষ দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত মানুষের সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের কড়া বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে । সুখের কথা এই যে, চিন্তাশীল মানুষরা যুগে যুগে দেশে দেশে গোঁড়া মানুষদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত  হয়েছেন, অনেককেই নির্বাসিত হতে  হয়েছে, এবং অনেককেই এমনকি আত্মবলিদানও করতে হয়েছে, ফলে চিন্তাশীল মানুষদের সক্রিয়তা ও আন্দোলন  বাধাগ্রস্ত ও ব্যাহত হয়েছে ঠিকই কিন্তু থেমে যায় নি বা স্তব্ধ হয়ে যায় নি ।  
অনেক প্রথা, সংস্কার-কুসংস্কার ও ঐতিহ্য আছে যা মানব সমাজ ও সভ্যতার বিকাশকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত ও ব্যহত করছে,  তবুও মানুষ সেগুলো মানুষের পক্ষে কল্যাণকর মনে করে এবং আঁকড়ে থাকতে চায় । এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় । এখানে তার একটার উল্লেখ করতে চাই । বিবাহ একটা সে রকমই প্রথা যার উপর মানুষের গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা রয়েছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এ প্রথা ছিলো না । বিবাহ প্রথা চালু হওয়া একান্ত প্রয়োজন ছিলো এবং মানব সমাজের শেষ দিন পর্যন্ত এর প্রয়োজন থাকবে বলে মানুষের বিশ্বাস । মানুষের বিশ্বাস এ প্রথা না থাকলে সামাজিক ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, অবাধ যৌনাচারে সমাজ কলুষিত হবে, নারীর শালীনতা-সম্ভ্রম বিপন্ন হবে, মানুষ পশুর মতো যৌনাচারে লিপ্ত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি । এ ধারণা ও বিশ্বাসগুলির যে কোনো ভিত্তি নেই তার বহু প্রমাণ আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছি । প্রতিদিন যে সংবাদগুলি  আমাদের ব্যথিত ও পীড়িত করে তার মধ্যে অন্যতম ধর্ষণ । নারী ধর্ষিত হয় পথে-ঘাটে, কর্মস্থলে, দিনে-রাত্রে, চেনা-অচেনা পুরুষের কাছে, এমনকি নারী ধর্ষিত হয় ঘরের মধ্যে দাদা-কাকা-বাবার কাছেও । বিবাহ প্রথা যে নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারে নি অহরহ ঘটা ধর্ষণের ঘটনাগুলি তার প্রমাণ বিবাহ প্রথা না থাকলে অবাধ যৌনাচারে সমাজ কলুষিত হবে এবং পুরুষরা পশুর মতো যৌনাচারে লিপ্ত হবে এ ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলি । পাশ্চাত্যের মানুষ  বিবাহ প্রথা ক্রমশঃ বর্জন করে চলেছে । তথাপি পাশ্চাত্যে ধর্ষণের সংখ্যা প্রাচ্যের চেয়ে অনেক কম, এবং এ কথাও কেউ বলতে   পারবে না যে পাশ্চাত্যের মানুষরা পশুর মতো যত্রতত্র যৌনাচার লিপ্ত   একজন পুরুষ ও একজন নারী পরষ্পরকে ভালোবাসে ও বিশ্বাস করে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক ও পরষ্পরকে চায়, পরষ্পর পরষ্পরকে নিবেদন করতে চায় এবং তারজন্যে একসঙ্গে থাকতে চায়,  তারজন্যে ধর্মিয় কোনো মন্ত্র যপ করতে হবে কেনো, অগ্নিসাক্ষী করতে হবে কেনো,  কিংবা কারো [পরিবার, সমাজ বা সরকারের] অনুমতি বা স্বীকৃতি লাগবে কেনো ? বিবাহের মন্ত্র পড়লেই নারী ও পুরুষের মিলন বৈধ, না হলে অবৈধ – এটা নাকি একটা উচ্চ মূল্যবোধ যা সামাজিক শৃঙ্খলার জন্যে অপরিহার্য  এমন ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব মন্ত্র পাঠ করে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়ের সঙ্গে ন’ বছরের শিশু কন্যার বিয়ে হলে তাদের দৈহিক মিলন কি বৈধ বলে মানা সম্ভব ? মন্ত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে একজন প্রৌঢ় পুরুষের সঙ্গে একজন নাবালিকার বিয়ে হলে, কিংবা একজন পুরুষ বহু নারীকে বিয়ে করে একত্র করলে  এই বিয়েগুলিকে  সমাজ ও সরকার  বৈধ  বলে যতোই স্বীকৃতি দিক না কেনো,  তাতে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা আসে না, আসে বিপর্যয় । এর সব চেয়ে বড়ো প্রমাণ হলো মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন । তাঁর  দাম্পত্যজীবনে যে শান্তি, সুখ ও শৃঙ্খলা ছিলো না কোরান-হাদিসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে ।   সুতরাং এটা অনস্বীকার্য  যে বিবাহ  প্রথা কোনোকালেই পারিবারিক বা সামাজিক শৃঙ্খলা দিতে পারে নি, বরং  তৈরী করেছে বিশৃঙ্খলা এর কারণ হলো, বিবাহ প্রথার মূল উদ্দেশ্যই হলো নারীর উপর পুরুষের সর্বময় কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ।  পুরুষের অধিকার আছে সে কাকে বিয়ে করবে তা বেছে নেওয়ার, অনেকগুলি বিয়ে করার, ইচ্ছে মতো স্ত্রীদের বর্জন করার,  অপরদিকে নারীর এ সব কোনো অধিকারই নেই । এমনকি স্ত্রীর উপর শত অত্যাচার সত্ত্বেও  তার অধিকার নেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অত্যাচার থেকে  মুক্তিলাভ  করার । বহু প্রশংসিত বিবাহ প্রথায় আমরা যে ছবিটা দেখি তা হলো - স্বামী যখন চাইবে তখনই স্ত্রীকে তার মনোরঞ্জন করতে হবে, স্বামীর অনুমতি ব্যতীত সে কোথাও যেতে পারবে না, স্ত্রী কি পোশাক পরবে তা স্বামীই ঠিক করে দিবে, স্ত্রী চাকরি করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে, স্ত্রী চাকরি করলে তার উপার্জনের টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিতে হবে, স্ত্রী চাকরিস্থল থেকে কার সঙ্গে আসবে ও কীভাবে আসবে তা স্বামী ঠিক করে দিবে, স্ত্রী গর্ভে কখন সন্তান ধারণ করবে তাও স্বামী ঠিক করে দিবে, গর্ভে যদি সন্তান চলে আসে এবং স্বামি যদি না চাই তা হলে তাকে নষ্ট করে দিতে হবে, সন্তানের নাম কী হবে তা চূড়ান্ত করবে স্বামীই ইত্যাদি ইত্যাদি । অর্থাৎ বিবাহ প্রথার মানে হলো  নারীরা পুরুষদিগের, আরো স্পষ্ট করে বললে স্ত্রীরা স্বামীর দাসত্ব করবে স্বামী-স্ত্রীর এই বৈষম্যমূলক সম্পর্কের কারণেই পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দিন দিন বৃদ্ধি পায়  স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক দুঃসহ হয়ে উঠলেও সে সম্পর্ক ছিন্ন করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ঐ মন্ত্র পাঠ করা বিবাহ -বন্ধন ।  অর্থাৎ বিবাহ-বন্ধনটাই  দুঃসহ দাম্পত্যজীবন থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে শৃঙ্খল হয়ে ওঠে ।   মন্ত্রপাঠ করা তথাকথিত বৈধ বিবাহ প্রথায় ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিয়ে অবৈধ ও নিষিদ্ধ যা মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা  এবং  ভালোবাসার অধিকারকে খর্ব করে  । বিবাহ প্রথার এই বিধান অনার কিলিং-এর মতো বর্বর ঘটনা দিন দিন বাড়তে সাহায্য করছে   অনার কিলিং বন্ধ করা যেতে পারে একমাত্র বিবাহ প্রথা তুলে দিয়েই । বিবাহ প্রথার গর্ভে জন্ম ‘জারজ’ শব্দটি যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি কুৎসিত দিককেই উন্মোচিত করে । বিবাহ মানে সন্তান পরিচিত হবে পিতার পরিচয়ে যেখানে মায়ের পরিচয়কে উপেক্ষা বা অস্বীকার করা হয় । একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে ভালোবাসার কারণে প্রাক-বিবাহ দৈহিক সম্পর্ক থেকে যদি ওদের সন্তান আসে তবে ‘জারজ’ বলে ঐ সন্তানকে এই সমাজ অপমান করে । কী দোষ ঐ সন্তানের বা তাদের বাবা-মায়ের ? ভালোবাসা কখনোই দোষের হতে পারে না । বাবা-মায়ের প্রেম থেকে যে ‘সোনা’র জন্ম তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানোর ক্ষেত্রে বাধা বিবাহ প্রথা ।  এই কুৎসিত প্রথার জন্যে কতো শিশুকে যে মায়ের গর্ভে হত্যা করা হয় তার ইয়ত্তা নেই । একজন নারী যদি ধর্ষিতা হয়ে গর্ভবতী হয়, তবে নারীর ও তার গর্ভের সন্তানের অপরাধ কোথায় ? কিন্তু এই সমাজ ঠাঁই দিতে পারে না নির্দোষ সেই নারীকে এবং তার গর্ভের ফুলের কুঁড়ির মতো নিষ্পাপ সন্তানটিকে । ফলে বিনা দোষে আত্মহত্যা করতে হয় অসংখ্য নারীকে । বাংলাদেশে পাক-সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর হাতে ২/৩ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলো যাদের মধ্যে হাজার হাজার নারীর গর্ভে সন্তান এসেছিলো । সেই নারীদের ঠাঁই দেয় নি সে দেশের সমাজ, সেই নিরপরাধ নারীদের  অপবাদের হাত  থেকে মুক্তি আত্মহত্যা করতে হয়েছিল ।  পবিত্র [!] বিবাহ-বন্ধনের এমনই মাহাত্ম্য । বিবাহ-প্রথার আরো বহু নেতিবাচক দিক আছে, সে সব আলোচোনা করার অবকাশ এখানে নেই ।   মূল কথা হলো  বিবাহ প্রথা নানাভাবে  মানব সমাজের  বিকাশকে পদে পদে ব্যহত ও বাধাগ্রস্ত করে । তবুও এই প্রথাতেই মানুষ আটকে থাকতে চায়, এবং যারা এই প্রথা ভাঙতে  চায় তাদেরকে এই সমাজ  নির্মমভাবে কঠোর শাস্তি  দিতে দ্বিধা করে না    প্রথা ও ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের অন্ধবিশ্বাস এভাবেই  মানব সমাজকে সর্বদা পিছন দিকে টেনে রাখতে চায় ।
আরো বহু প্রথা আছে যা  প্রতিনিয়তই মানব সমাজকে পিছন দিকে টানছে এবং সামাযে নানাবিধ  বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে । সে প্রথাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, পৈতা, খাতনা [মুসলমানী], অন্নপ্রাশন, সৎকার [মৃতদেহকে পোড়ানো বা সমাধিস্থ করা], শ্রাদ্ধ, পশুবলী/কোরবানী ইত্যাদি । এই সামাজিক প্রথাগুলি মানব সমাজের প্রচুর অপকার সাধন করে । সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করার জায়গা এটা নয়, তবু সৎকার ও শ্রাদ্ধ প্রথা মানব সমাজের যেহেতু   অপূরণীয়  অপকার করে চলেছে তাই এ বিষয়ে  দু/একটি কথা বলতে চাই ।  মানুষের মৃতদেহ  পোড়ানো বা মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ফলে যে ক্ষতিগুলো হয় তা হলো – এক]. বিপুল অর্থের অপচয় হয়, দুই]. প্রচুর জায়গা নষ্ট হয়, তিন]. পরিবেশ, জল  ও বায়ুমন্ডল দুষিত হয়, চার]. মানুষের বিপুল সময় নষ্ট হয়, এবং সর্বোপরি পাঁচ]. নষ্ট হয় মানুষের মৃতদেহগুলি যা বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অপচয় । কারণ,  মানুষের মৃত্যুর পরেও শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সক্রিয় থাকে বেশ কয়েক গণ্টা যেগুলি অন্য জীবিত মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করে সারা বিশ্বে কোটী কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব, অন্ধ মানুষদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব । অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ছাড়াও মানুষের মরণোত্তর দেহগুলি ভীষণ কাজে লাগে ডাক্তারি পড়া শিক্ষার্থীদের । তাই সৎকার ও শ্রাদ্ধ প্রথা যে মানব সমাজের কী বিপুল ক্ষতিসাধন করছে তার সত্যিই সীমা-পরিসীমা নেই । এগুলো প্রমাণ করে যে পুরানো প্রথা, ঐতিহ্য ও সংস্কার ভাঙা  কতো  জরুরী মানব সমাজের  বিকাশ ও কল্যাণ সাধন করার জন্যে । এসব কথা এখন থাক, ফিরে আসি মূল আলোচনায় । 
গোঁড়া মানুষরা  সমাজের প্রচলিত ঐতিহ্য, প্রথা ও সংস্কারগুলি পরিত্যাগ করতে চায় না, কারণ তাদের বিশ্বাস যে সেগুলি সবই ঈশ্বরের বিধান ।  সেগুলির কোনো একটিও পরিত্যাগ করলে বা সংশোধন করলে ঈশ্বর রুষ্ট হবে এবং  ঈশ্বরের অভিশাপে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসবে  । তাদের বিশ্বাসের এতো জোর কোথা থেকে আসে  ? জোরের উৎস হলো ধর্মগ্রন্থ । এই ধারণা বা বিশ্বাস তাদের মনের গভীরতম তলদেশে প্রথিত যে ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের রচিত, আর ঈশ্বর কখনো ভুলে করতে পারে না । অন্ধবিশ্বাসী গোঁড়া মানুষরা সবাই যে ঈশ্বর-বিশ্বাসী তা নয় । ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসী, কট্টর ও গোঁড়া মানুষ আছে, কিন্তু সমাজ সংস্কার এবং বিজ্ঞান সাধনার পথে বাধা আসে মূলতঃ ধর্মীয় গোঁড়া মানুষদের কাছ থেকে ।  এই মানুষরাই  চিন্তাশীল ও সৃজনশীল  মানুষদের ঈশ্বরদ্রোহী ও সমাজের শত্রু বলে তাদের কাজে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে । অথচ সাধারণতঃ চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষরাই প্রগতিশীল এবং মানুষের কল্যাণে ব্রতী থাকে ।
অন্ধবিশ্বাসী মানুষরা ধর্মীয়  যাজকদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করে   আসলে ধর্মীয় গোঁড়া   মানুষদের যাবতীয় বিশ্বাস বাঁধা থাকে ঈশ্বর এবং  ঈশ্বরের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি । তারা জানে না যে ধর্মগ্রন্থগুলি মানুষের দ্বারা রচিত । জানে না বলেই   তারা   ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে  অন্ধভাবে বিশ্বাস করে এবং তাদের অধীনে সঙ্ঘবদ্ধ থাকে । তাই প্রকৃত বিচারে ধর্মান্ধ মানুষেরা নয়,  চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষদের  স্বাধীন চিন্তার অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের ক্ষেত্রে  আসল  বাধা হলো    ধর্ম ও ধর্মীয়  নেতৃবৃন্দ  । যারা বলে ধর্ম ভালো কিন্তু  ধর্মীয়  নেতৃবৃন্দ  খারাপ, তারা ভুল বলে ।  তারা বলে  মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে নয়, ধর্মকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েই মানব সমাজের সংস্কার  সাধন করতে হবে । আসলে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে । মনে রাখতে হবে যে চিন্তাশীল মানুষরা সবাই নাস্তিক হয় না । ঈস্বর বিশ্বাসী মানুষরাও চিন্তাশীল হন, তাঁরাও  সত্যের পূজারী হন  এবং মানব কল্যাণে তাঁরাও সমাজ সংস্কারের প্রয়াসে ব্রতী হন । আবার অপরদিকে সকল  বিজ্ঞানী ও দার্শনিক  এবং   যুক্তিবাদী  মানুষরা নাস্তিক হয় না । ঈশ্বরচন্দ্র নাস্তিক ছিলেন কিন্তু রামমোহন  ছিলেন না । রবীন্দ্রনাথও নাস্তিক ছিলেন না । সক্রেটিস নাস্তিক ছিলেন কিন্তু লিওনার্দো ব্রুনো  ছিলেন না । তবুও ঈশ্বরবিশ্বাসী এই মানুষদেরও  ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ  রেহাই দেয় নি । দেয় নি কারণ, তাঁদের চিন্তা, পর্যবেক্ষণ  ও সিদ্ধান্ত ধর্মীয় বিধান ও ধর্মগ্রন্থের বাণীর পরিপন্থী ছিলো । সুতরাং এটা সংশয়াতীত যে  স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ ও  পরিসরের জন্যে সূচগ্র মেদিনী দিতে প্রস্তুত নয় যে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও ধর্মীয় গোঁড়া মানুষের দল তাদের প্রধান হাতিয়ার হলো ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থ । ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি  ব্যাপক মানুষের অন্ধবিশ্বাস  যতদিন থাকবে ততদিন  স্বাধীনভাবে  চিন্তা করার ক্ষেত্র রুদ্ধ থাকবে ।   
রাষ্ট্র এক্ষেত্রে সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়ে থাকে । রাষ্ট্র কখনো যাজকতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ায় তো কখনো আবার যাজকতন্ত্রের বিপক্ষে চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায় ।  বুর্জোয়া বিপ্লবের সময় রাষ্ট্র ইতিবাচক ভুমিকা নিয়েছিলো । এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতেও আমরা রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্য করেছি । রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, মধুসূদন দত্ত, অক্ষয় কুমার দত্ত , রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মণীষীগণ যখন হিন্দু সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুৎসিত বিধানগুলির বিরুদ্ধে বাংলার বুকে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে নবজাগরণ আন্দোলনে নেতৃত্ব করছেন তখন বৃটিশ সরকার দাঁড়িয়েছিলো চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষদের পাশেই । বিংশ শতাব্দীতেও সদ্য স্বাধীন  ভারতেও রাষ্ট্র কিছুটা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে । জহরলাল নেহরুর সরকার হিন্দুদের বহুবিবাহ বেআইনী করেছে এবং হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে  পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে । এখন রাষ্ট্র তার প্রগতিশীল ভূমিকা পরিত্যাগ করে যাজকতন্ত্রের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করছে । রাষ্ট্র  হলো আসলে শোষক ও শাসক শ্রেণির  যন্ত্র ।  শোষিত শ্রেণিকে শোষণ ও দমন করার যন্ত্র । ধর্ম যখন শোষক শ্রেণির  মুনাফার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন রাষ্ট্র প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে গড়ে তোলা চিন্তাশীল ও সৃজনশীল  মানুষদের আন্দোলনকে সমর্থন করে । আবার রাষ্ট্রই শোষক শ্রেণির স্বার্থে শোষিত শ্রেণিকে ভাগ করে তাদের আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যে  ধর্মকে ব্যবহার করে এবং যাজকতন্ত্রের পাশে নগ্নভাবে দাঁড়ায় । এটাই হলো রাষ্ট্রের চরিত্র   
প্রাচীন  ও মধ্য যুগে ইহুদী ও খৃষ্টান  যাজকতন্ত্রের  যে আগ্রাসী ও হিংস্র রূপ দেখেছি  তার চেয়ে ঢের বেশী আগ্রাসী ও হিংস্রতা নিয়ে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দশকে আরবে আবির্ভাব হয়েছিলো ইসলাম ধর্ম  এবং ইসলামি যাজকতন্ত্র তথা মোল্লাতন্ত্র ।   ইসলামের নীতি হলো প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যে আহ্বান করো, সাড়া না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে ইসলামের পতাকা তলে নিয়ে এসো । 
   ইসলাম  বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী এই দু’ভাগে সমগ্র মানব জাতিকে ভাগ করেছে   যারা  আল্লাহ ও আল্লাহর নবির প্রতি ঈমান [বিশ্বাস] এনেছে তারা বিশ্বাসী, বাকিরা সবাই অবিশ্বাসী তথা কাফির তথা  মুশরিক ।   ইসলাম বলছে অবিশ্বাসীরা আল্লাহর শত্রু,  তাদের বিরুদ্ধে  যুদ্ধ করতে হবে  এবং তারা যদি ঈমান না আনে তবে  তাদের হত্যা করতে হবে ।   কোরান বলছে  যতদিন না সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে ততদিন কাফিরদের যুদ্ধ  জারি রাখতে হবে । যুদ্ধ করতে হবে  ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও । মুসলমানদের মধ্যে অনেক প্রকারের  মুনাফিক আছে, যারা জিহাদ করতে ভয় পায় ও জিহাদ  নিয়ে মনগড়া বাখ্যা দেয় তারাও মুনাফিক । ইসলামি হিংসা ও হিংস্রতা শুধু বিধর্মিদের উপর প্রযোজ্য ভাবলে ভুল হবে । মুসলিমদের উপরেও সমান প্রযোজ্য ।  ইসলাম এও বলে যে যারা ইসলাম ত্যাগ করবে  তাদেরকেও  হত্যা করতে হবে  । এবং যারা মুসলিম সমাজে ইসলামি আইনের উল্লঙ্ঘন করবে তাদেরও  । ইসলামের এই যুদ্ধ নীতি রূপায়ণেই আজ বিশ্বজুড়ে মুসলিম জঙ্গিরা যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ।   এখন যা পরিস্থিত তাতে এ কথা বললে  অত্যুক্তি হবে না যে, ইরাক, সিরিয়া, নাইজিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সহ  পৃথিবীর বহু দেশের বহু আঞ্চলকেই    মুসলিম জঙ্গিরা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে  । আল-কায়দার জঙ্গিরা গত সাতই জানুয়ারী’১৫ ও তারপর ৩/৪ দিন ধরে  ফ্রান্সে একটি পত্রিকা দপ্তর সহ বিভিন্ন জায়গায়  সশস্ত্র হামল চালিয়ে বারোজন সাংবাদিক ও একজন পুলিশ আধিকারিক সহ ১৫/২০ জন মানুষকে  হত্যা করেছে ।  তারা কয়েকজন সাংবাদিককেই শুধু হত্যা করে নি, আসলে তারা হত্যা করতে চাইছে  বাক-স্বাধীনতা,  স্বাধীনভাবে  চিন্তা করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই । ফ্রান্সে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে মুসলিম মৌলবাদীরা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, গোঁড়ামি মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণে নিবেদিত প্রাণ তাদের মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সঞ্চার করে গোটা বিশ্বকেই জিম্মী করতে চাইছে ।   
সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের এখন যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে এ কথা বলার সময় এসেছে যে চিন্তা করার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে লেখাপড়ার স্বাধীনতা, ধর্ম মানা না মানার স্বাধীনতা, প্রভৃতি সকল স্বাধীনতার পথে আজ প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসলাম । গোটা বিশ্বজুড়ে চিন্তাশীলতা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলির প্রসার ও ব্যাপ্তি ঘটিয়ে গোঁড়ামি ও কুসংস্কার মুক্ত এবং  বিজ্ঞানমনস্ক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নির্মাণের পথে প্রধান বাধা ইসলাম । অথচ গভীর বেদনার সাথে লক্ষ্য করছি যে মুসলিম জঙ্গিদের ধারাবাহিক  হত্যালীলার দায় চাপানো হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর এবং অবলীলায় এখনো  শান্তির ধর্ম বলে ঢালাও শংসাপত্র দিয়ে  মহিমান্বিত করা হচ্ছে । যারা এসব করছে তাদের একটা অংশ ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ন অজ্ঞ, ফলে বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদের সংকটের মধ্যে ইসলামি সন্ত্রাসের শিকড় সন্ধানে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে । আর একটা দল আছে যারা প্রতারক, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে যাদের মধ্যে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ পড়ে । যারা ইসলামি সন্ত্রাসের মধ্যে আমেরিকার হাত দেখছেন তাদেরকে বলি, ১৯৫৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পতনের পর মূলতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান শুরু হয়েছে । কিন্তু ইসলামি সন্ত্রাসের শুরু হয়েছে মুহাম্মদের নেতৃত্বে ৬২৪ সাল থেকে ইহুদি নির্বাসন ও নিধনের মধ্যে দিয়ে  । ৬৩০ সালে মুহাম্মদ মক্কা জয় করে  ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করেন ।  তারপর মুহাম্মদ ও তাঁর উত্তরাধিকার খলিফাগণ সারা বিশ্বকে দখল করার জন্যে একটার পর একটা দেশে অভিযান শুরু করেন  এবং অচিরেই গড়ে তোলেন  ইসলামি সাম্রাজ্য  । এভাবে মুহাম্মদের হাত ধরেই ইসলামি সাম্রাজ্যবাদের যখন সূচনা হয়েছিল আরবে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরই জন্ম হয় নি । আজকের আইএস, আল-কায়দা, বোকো হারাম, লস্কর-ই-তৈবা, হুজি, জেএমবি, হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড, ইণ্ডিয়ান মুজাহিদ, জামাতুল মুজাহিদ, সিমি প্রভৃতি মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলি মুহাম্মদ প্রবর্তিত ইসলামি সাম্রাজ্যবাদী নীতিই রূপায়ণ করছে । ইসলামি সাম্রাজ্যবাদী নীতি আজকের রাজনীতির পরিভাষায় ‘প্যান ইসলাম’ । সেই নীতি রূপায়ণে জিহাদি পন্থী কট্টর মুসলিম ধর্মীয় নেতারা কখনো আমেরিকার সাহায্য নেয় ঠিকই,  তবে তাদের পথে বাধা দিলে তারা আমেরিকায় ৯/১১ ঘটাতেও দ্বিধা বা ভয় করে না ।
উপসংহারে যে কথা বলতে চাই যে, যারা মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করে, মুক্তভাবে চিন্তা করার প্রয়াস করে, বাক-স্বাধীনতা ও মানুষের ব্যক্ত-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, শিল্পীর স্বাধীনতা ও  সৃজনশীলতার পক্ষে কথা বলে,  তারা কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে কিছু ভাবে না এবং করে না । মানব সমাজ সদা পরিবর্তনশীল বলে সমাজের উন্নতি ও বিকাশের প্রয়োজনে সমাজের সংস্কার করা অনিবার্যভাবেই আবশ্যক হয়ে ওঠে । আর তারজন্যেই একান্তভাবে আবশ্যক হয়ে ওঠে মানুষের মস্তিষ্কের সমস্ত বাঁধন খুলে দেওয়ার যাতে মানুষ তার চিন্তাশক্তি ও সৃজনশক্তি নিয়ে মুক্ত আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলতে পারে ।  কিন্তু তা সহজে হবার নয় । মানুষ যখন সে চেষ্টা করে তখনই প্রবল বিক্রমে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তথা ধর্মের ধারক ও বাহকরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ।  আর ধর্মীয়  নেতাদের সমস্ত শক্ত যে নিহিত রয়েছে  ধর্ম ও ধর্ম গ্রন্থের মধ্যে সে কথা উপরে  উল্লেখ করা হয়েছে । সুতরাং  চিন্তার স্বাধীনতার জন্যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে এবং  আধুনিক ও  বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণের জন্যে  ধর্মকে আঘাত করতেই হবে, ধর্ম কীভাবে মানুষের ক্ষতি করছে সে কথা বলতেই হবে   
পরিশেষে বলি যে, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষদের মধ্যেও সংকীর্ণমনা, অনুদার, স্বার্থপর, খ্যাতি ও ক্ষমতালোভী বহু মানুষ থাকে । তারা সব সময় নিজেদের স্বার্থে চিন্তা করে ও তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের জন্যে উদ্ভাবন করে কতো নতুন নতুন তত্ত্ব । তাদের হাত তো ধরেই এসেছে যতো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো । তারাই তো সৃষ্টি করছে মহান সৃষ্টিকর্তার তত্ত্ব ।  ঈশ্বর তথা ভগবান তথা আল্লাহ তো তারাই সৃষ্টি করেছে । যারা ‘মহান সৃষ্টিকর্তা’-র স্রষ্টা এবং ধর্মের প্রবর্তক  ও প্রবক্তা তারাই যে মহা প্রতারক  তা সংশয়াতীত ।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...