Tuesday, March 31, 2015

কাজী মাসুম আক্তারের বিরুদ্ধে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ বাক-স্বাধীনতার উপরেই আক্রমণ


কাজী মাসুম আক্তার মুসলিম মৌলবাদিদের হাতে গত বৃহষ্পতিবার [২৬.০৩.১৫] আক্রান্ত হলেন তাঁর নিজের স্কুলের মধ্যেইতিনি মেটিয়াবুরুজের একটি হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ।  তিনি লেখকও । আক্রান্ত হলেন লেখালেখির কারণেই । স্কুলের ভিতর ঢুকে তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে ও তাঁকে স্কুল থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে বলে চিৎকার করলে তিনি পুলিশে খবর দেন । পুলিশ এসে তাঁকে স্কুল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সামনেই ঐ দুষ্কৃতিরা তাঁর উপর চরাও হয়ে কিল চড় লাথি ঘুষি মারতে থাকে । এরই মাঝে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে দুষ্কৃতিরা তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেয় ।  তিনি অভিযোগ করেছেন যে সে সময় পুলিশ তাঁকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করে নি । কাজী মাসুম এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন । তিনি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করা সত্ত্বেও পুলিশ কাউকে ধরার তৎপরতা দেখায় নি ।
ধর্মগুরুদের সমালোচনা করলে কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বললে এ রকম আক্রমণের  ঘটনা বারবার  ঘটছে । ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে হিন্দু সমাজের ধর্মগুরুরা চিকিৎসার নামে যে রমরমা ব্যবসা করে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিলেন এবং  ভণ্ড ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজ করছিলেন বলে  হিন্দু মৌলবাদিরা দাভোলকারকে ২০.০৮.১৩ তারিখে গুলি করে হত্যা করে । বালা সাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পর গোটা মুম্বাই শহরকে গায়ের জোরে  স্তব্ধ করে রেখেছিলো তাঁর অনুসারীরা । এর সমালোচনা করে  একটি মেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট  করেছিলো বলে তাঁর বাবার হোটেলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিলো । কিছুদিন আগে সিপিআই নেতা পানিক্করকে পাঞ্জাবে হত্যা করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা । ধর্মীয় মৌলবাদীদের - তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন – আক্রমণ সমাজের পক্ষে উদ্বেগের এবং তার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে । না হলে সমাজে শান্তি-সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র বিলুপ্ত হবে ।  এ কথাও মনে রাখতে হবে যে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু মৌলবাদের বিপদ অনেকটাই বেড়েছে এবং সেই বিপদের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে হবে । তৎসত্ত্বেও আমাদের দেশ ও রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে  আমি একটা কথা বিশেষভাবে বলতে চাই যে, মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে অন্য সব ধর্মীয় মৌলবাদকে  গুলিয়ে দিলে বা এক করে দেখলে ভুল হবে । মুসলিম মৌলবাদ অনেক বেশী ভয়ঙ্কর এবং মুসলিম মৌলবাদীরা অনেক বেশী সংগঠিত ও শক্তিশালী ।  মুসলিম মৌলবাদ মতাদর্শগতভাবেই বেশী ভয়ঙ্কর কারণ তার ধর্ম তথা ইসলামের মধ্যেই তার শিকড় আছে ।  সেখান থেকেই সে সর্বদা বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার রসদ পাচ্ছে । তবে সেই রসদ পেয়েই তারা সব চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা নয়, তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সর্বদা শাসক দলের মদত ও প্রশ্রয়  পেয়ে এবং কোনো দিক থেকে কোনো প্রকার বাধা না পেয়ে । এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের দেখতে হবে কাজী মাসুম আক্তারের উপরে আক্রমণের ঘটনা ।
আক্তারের উপর আক্রমণ হলো কেনো ? তিনি কারবালা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন । মুসলিম মৌলবাদিরা সেই লেখা পড়েই ক্ষিপ্ত হয়েছেন তাঁর উপর । লেখাটায় না কি ইসলামের অবমাননা হয়েছে । আক্তার অবশ্য দাবি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ভিত্তিহীন । তিনি দাবি করেছেন যে তিনি কারবালার সঠিক ইতিহাসটাই তুলে ধরেছেন এবং  কোনোভাবেই ইসলামের অবমাননা করেন নি । এক বছর আগে কারবালা নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি । আমার বইয়ে কারবালার যে ইতিহাস তুলে ধরেছি তাতে ইসলামের অবমাননা হয়েছে এরূপ মনে হওয়ার যথষ্ট উপাদান আছে । মাসুম আক্তারের  লেখাটা পড়ি নি, সুতরাং জানিনা সেই লেখায় মুসলিম মৌলবাদিদের  ক্ষিপ্ত হওয়ার মতো কিছু আছে কী না । তবে আক্তারের কথায় আমি বিশ্বাস রাখছি যে তিনি এমন কিছু লেখেন নি যাতে ইসলামের অবমাননা হতে পারে । এ বিশ্বাস আমার হয়েছে,  কারণ আমি তাঁর লেখা কয়েকটি নিবন্ধ পড়েছি । তিনি তাঁর প্রতিটি লেখায়  যে কথা বলেন তা হলো ইসলাম হলো একটি সত্য ও সঠিক ধর্ম, কিন্তু মুসলিম ধর্মগুরুরা হয় ইসলামটা ভালো করে জানেই না,  না হয় নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ইসলামের অপবাখ্যা করে ইসলামের বদনাম করছে এবং মুসলামানদের সর্বনাশ করছে ।  মৌলবাদীদের হাতে মার খাওয়ার পরও তিনি দৈনিক স্টেটসম্যানকে একই কথা বলেছেন । তিনি বলেছেন, “আমি মোটেই ইসলাম-বিরোধী নই । আমি ইসলামের প্রকৃত বাখ্যায় বিশ্বাস আগ্রহী । ইসলামের যে অপবাখ্যা দিয়ে থাকে  তার সঙ্গে আমি মোটেই একমত নই । আমি বিশ্বাস করি, ইসলামে অপর ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সহনশীলতা আছে, যেটা মৌলবাদীরা হয় জানে না, নচেৎ জেনেও সাধারণ মানুষকে তারা ভুল বোঝায় । এদের জন্যই মুসলমান ও ইসলাম ধর্মকে মানুষ ভুল বুঝতে শুরু করেছে ।”
আমরা [আমাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য, ভারতে তো দ্বিতীয় কাউকে দেখি না ] যাঁরা মুসলিম পরিবারে জন্মে ও বড়ো হয়ে এ কথা সোচ্চারে বলি যে  ইসলাম ধর্ম আর পাঁচটা ধর্মের মতই মানুষেরই সৃষ্টি এবং মানব সমাজের কল্যাণ ও বিকাশের পথে একটা মস্ত বড়ো অন্তরায়   তাঁরা মুসলিম মৌলবাদিদের ঘোষিত শত্রু । মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তাতে মুসলিম মৌলবাদীদের দোষ দেখেন না, বরং বেশ খুশীই থাকেন  মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই ভূমিকায় মুসলিম মৌলবাদীরাও খুব সন্তুষ্ট থাকে । তাই তাঁদের  উপর সাধারণতঃ আক্রমণ নেমে আসে না । মাসুম আক্তার হয় তো সে কারণে ভাবতেই পারেন নি যে তাঁর মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমানও আক্রান্ত হতে পারেন এবং এভাবে কখনো মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে এবং তাঁর জীবনও সংশয় হতে পারে ।   এ রকম  ধারণা কারো থাকলে তা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত ধারণা ।   মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও অতীতে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে, তবে সংখ্যাটা খুবই কম । মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উপর [তাঁরাই মুসলিম বুদ্ধিজীবী যাঁরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ও ইসলামের গুণগ্রাহী]  মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের আক্রমণের ধারা চলে আসছে অখণ্ড ভারত ও অখণ্ড বঙ্গদেশের সময় থেকেই । ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে পূর্ববঙ্গে মুসলিম মৌলবাদিদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আব্দুল কাদির ও আবুল হোসেন প্রমুখ বিশিষ্ট মুসলিম বুদ্ধিজবীরা । তাঁদের শেষ পর্যন্ত কলকাতা পালিয়ে আসতে হয়েছিলো প্রাণ বাঁচাতে । এই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা সবাই ইসলাম ধর্মেই বিশ্বাস করতেন,  কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিলো না । তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে সকল সমস্যার সমাধান কোরান-হাদিস নেই,  মুসলিম সমাজকে এগোতে হলে চিন্তা-ভাবনার জগতটাকে উন্মুক্ত করতে হবে এবং আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ও অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাবনাগুলিকে গ্রহণ করতে হবে । এটা ছিলো তাঁদের অপরাধ ।  ১৯৪৭ সালে [দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে ] স্বনামধন্য ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি সৈয়দ মুজতবা আলিকেও মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে । তিনি তখন ছিলেন খুব সম্ভবতঃ বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ । তিনি বলেছিলেন যে কাব্য প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি ইকবালের চেয়ে এগিয়ে । এ কথা বলার জন্যে তাঁকে নাস্তিক ও হিন্দুদের দালাল বলে তাঁর উপর হামলা চালানো হয়েছিলো । ২০০৫ সালে আক্রান্ত হন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার আক্রা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লা । তাঁর লেখা কয়েকটি বই তখন পশ্চিমবঙ্গে হাই মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকাভূক্ত ছিলো । তিনি একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় ‘সত্য মিথ্যা’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন । তিনি ইসলাম ও মুহাম্মদ সম্পর্কে খুবই নিরীহ কয়েকটি কথা লিখেছিলেন    তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, যদি  দেখা যায় যায় যে কোনো বিষয়ে কোরান ও বিজ্ঞানে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে, তা হলে কোনটা সত্য  বলে ধরা উচিৎ ?  মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে মুহাম্মদ হলেন পৃথিবীর সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ । মোরসেলিন লিখেছিলেন যে, মুহাম্মদের পর অনেক বড়ো বড়ো বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও মনীষী জন্ম গ্রহণ করেছেন । মুহাম্মদ তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে কি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যায় ?  এ রকম কিছু কথা লেখার জন্যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে মোরতাদ ঘোষণা করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিয়েছিলো । তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করতে চেয়েছিলো । যে পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন তাঁর সম্পাদক একজন মুসলমান । তাঁর উপরেও একই ফতোয়া দিয়ে তাঁর বাড়িতেও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছিলো । শেষ পর্যন্ত দুজনকেই   মুসলিম মৌলোবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুচলেকা লিখে দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছিলো । এ ছাড়া প্রাণে বাঁচার জন্যে তাঁদের সামনে বিকল্প পথ ছিলো না, কারণ পুলিশ ও শাসক দল সিপিএম যাদের আক্রান্তদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিলো তারা ফতোয়াকেই সমর্থন জানিয়েছিলো ।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন এ রকম আক্রমণ ইসলাম সম্মত নয় । তাঁরা মিথ্যাচার করেন । এমন কোনো কথা বলা যাবে না যাতে ইসলাম এবং ইসলামের নবী এবং ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি  নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ পায় । ইসলামের উপর পরিপূর্ণ আস্থা ও আনুগত্য রাখতে হবে, যারা কিছু মানবে কিছু মানবে না বা কোনো কোনো বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করবে তারা কপট মুসলমান, ইসলামের পরিভাষায় যাদের  মুনাফেক বলা হয় । মুনাফেকদের বিরুদ্ধেও কঠোর মনোভাব নিতে এবং যুদ্ধ করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে । কোরানে তাদের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ভাষ্য আছে ।  একটি ভাষ্য এ রকম -  “মুনাফেক নরনারী  একে অপরের দোসর, কুকাজের নির্দেশ দেয়, সৎকর্মে নিষেধ  করে ।”  [৯/৬৭]   কোরান স্পষ্ট ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে - - “হে নবী ! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন ও কঠোর হউন, তাহাদের আবাস জাহান্নাম, উহা নিকৃষ্ট স্থান ।” [৯/৭৩]  কাজী ওদুদদের কোরান-হাদিসের বাইরে গিয়ে মুসলিম সমাজকে উন্নতির পথের সন্ধান করতে বলার পরামর্শ, কিংবা কোরানের সত্যতা নিয়ে মোরসেলিনের সংশয় প্রকাশ প্রভৃতি ঘটনাগুলি কুকাজ বৈ নয় । কবি ইকবাল ইসলাম-অন্তপ্রাণ, তাঁকে একজন কাফেরের সঙ্গে তুলনা করে ছোট করে দেখানোর পেছনেও অসৎ উদ্দেশ্যের গন্ধ খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না ধর্মান্ধ মুসলিম  সুতরাং তাঁরা মুনাফেক । হয় তো মাসুম আক্তারের কারবালা প্রবন্ধে সে রকম কিছু গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন মুসলিম মৌলবাদীরা । 
মাসুম আক্তারের উপর আক্রমণের এই ঘটনার জন্যে শুধু মুসলিম মৌলবাদিদের  বিরুদ্ধে আঙুল তুললেই  হবে না ।  এটা তো ইসলামিক রাষ্ট্র নয় যে তারা স্বচ্ছন্দে এভাবে ইসলামের নীতি অনুসারে মুনাফেক বা কাফিরদের উপর হামলা চালাবে, তাদের হত্যা করবে কিংবা ক্ষত-বিক্ষত করবে । এটা তো গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে লেখকের উপর আক্রমণ করলে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং আক্রমণকারীকে আইনের অধীনে শাস্তি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য   । আর যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদেরও তো লেখকের পাশে দাঁড়ানো ও আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ করা কর্তব্য । রাষ্ট্র   এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষেরা যে যার  দায়িত্ব পালন করলে কি মুসলিম  মৌলবাদীরা এ রকম আক্রমণ করার সাহস পাবে ?  নাগরিক সমাজ চোখ বন্ধ করে থাকে আর রাষ্ট্র তো সরাসরি মুসলিম মৌলবাদিদের পক্ষেই  দাঁড়িয়ে যায় । অমুসলিম বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনরা  এ প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া চাইলে জড় পদার্থের মতো নিরুত্তর থাকেন । হিন্দু মৌলবাদিদের ক্ষেত্রে তাঁরা আবার ভীষণ সরব । তাঁদের এই দ্বিচারিতা আমাকে অবাক করে, লজ্জিতও করে । তাঁদের প্রতি আমার যতো রাগ হয় তার চেয়ে বেশী করুণা হয় । ধর্মীয় মৌলবাদিদের জাত বিচার করা এই বুদ্ধিজীবীরা কি ভিতু ?  না কি মুসলমানরা মুসলমানদের মারছে  আমরা তার মধ্যে নাক গলাবো না, ওটা মুসলমানরা বুঝে নেবে -  এ রকম হীন ও দৈন্য চিন্তার শিকার ? আমার মনে হয় দুটোই । এই সব বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা নাকি জাতির বিবেক । তাঁরা যাই হোন না কেনো, তাঁরা মুসলিম সমাজের চোখে কিন্তু খুবই সজ্জন ও ধর্মনিরপেক্ষ  মহাপুরুষ । এই বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা কিন্তু জেনে করুক কিংবা না জেনে করুক মুসলিম মৌলবাদীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছেন । আর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল । তাঁরা তো ইসলাম শান্তির ধর্ম বলেই খালাস । মুসলিম মৌলবাদীরা ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা কী সর্বনাশ করছে সে ব্যাপারে তাঁরা ভাবিত নয়, তাঁরা ভাবিত এটা ভেবে যে ইসলামের বদনাম হচ্ছে । মানুষ মরুক, দেশ ডুবুক অন্ধকারে, গণতন্ত্র এবং শান্তি-সম্প্রীতি ধ্বংস হয় হোক, কিন্তু তবুও কীভাবে ইসলামকে শান্তির ধর্ম, দয়া ও ক্ষমার ধর্ম, মানবতার ধর্ম বলে জাহির করা যায় সেই  চিন্তা ও কাজে তাঁরা বিভোর ! মুসলিম মৌলবাদীদের পাশে কিন্তু আমরা দেখতে পাই আর একটা বিরাট শক্তিকে । সংবাদ মাধ্যম – খবরের কাগজ ও বৈদ্যুতিন চ্যানেল, দুটোই । মুসলিম মৌলবাদীরা যতই ফতোয়া দিক, যতই হামলা করুক, সেই হামলাই যতই ক্ষয়ক্ষতি হোক সংবাদ মাধ্যমগুলি নীরব থাকে । বৈদ্যুতিন চ্যানেলগুলো কতো নামে কতো টক শো করে, কিন্তু কোনোদিন মুসলিম মৌলবাদিদের বাড়-বাড়ন্ত নিয়ে টক শো করা তো দূরের কথা, তাদের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডগুলো সবই চেপে যায় । মাসুম আক্তারের উপর আক্রমণের ঘটনা নিশ্চয় ছোটো ঘটনা নয় । কিন্তু কোনো মিডিয়াতেই খবরটা করা হয় নি ।  এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম দৈনিক স্টেটসম্যান । এই কাগজই একমাত্র খবরটা করেছে । সংবাদ মাধ্যমগুলির এই ভূমিকা মুসলিম মৌলবাদিদের মনোবল ও উৎসাহ বাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করে ।
মুসলিম মৌলবাদীদের আজ এতো শক্তি ও সাহস হয়েছে তার পশ্চাতে রয়েছে রাষ্ট্রের মোল্লাতন্ত্রতোষণ নীতি এ ব্যাপারে ডান-বাম সবাই সমান । মোরসেলিনের উপর যখন আক্রমণ হয়েছিলো তখন খোলাখুলি বাম সরকারের প্রশাসন মৌলবাদীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো । তসলিমার উপর যখন আক্রমণ হয়েছিলো তখনও বাম সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে ও মোল্লাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো । ২০০৫ সালে যখন আমার মুণ্ডু কাটার ফতোয়া দিয়েছিলো তখনো বাম সরকার আমাকে নিরাপত্তা দেয় নি   থানা  আমার অভিযোগই নেয় নি । প্রশাসন ফতোয়াবাজদেরই সমর্থন জানিয়েছিলো । মাসুম আক্তারকে তো পুলিশের সামনেই মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো ও নিগ্রহ করলো । পুলিশ না দিলো তাঁকে নিরাপত্তা, না আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলো । পুলিশের এই ভূমিকার পেছনে সরকারের মোল্লাতোষণ নীতি ছাড়াও আর একটা বড়ো কারণ আছে ।  মাসুম আক্তার শুধু মুসলিম ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধেই সরব নন,  মুসলিমদের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জী যে প্রতারণা করে চলেছেন তার বিরুদ্ধে তিনি সমানে সরব    তাই এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে তাঁর উপর যে হামলা হয়েছে তাতে প্রশাসনের ইন্ধন ছিলো । মাসুমের তবু বরাত ভালো বলতে হবে এ জন্যে যে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামের অবমাননার অভিযোগ  তোলে নি । তসলিমা, মোরসেলিম মোল্লা ও আমার বিরুদ্ধে তো পুলিশ ও শাসক দল এই অভিযোগই করেছিলো । কয়েক মাস আগে মেটিয়াবুরুজের ফারুক উল ইসলাম নামে একজন যুক্তিবাদী যুবক ফেসবুকে শুধু একটা হাদিস শেয়ার করেছিল । তার জন্যে   মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁর বাড়িতে হামলা করেছিলো । অল্পের জন্যে সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো    পুলিশ কিন্তু তাঁকেই  মুসলিমদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছিলো,  আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কেস দেয় নি ।  
কাজী মাসু আক্তারের বিরুদ্ধে মুসলিম  মৌলবাদীদের হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । এই হামলা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধেও নয় । এটা বাক-স্বাধীনতার উপর হামলা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হামলা । এই হামলা কোনো একজন মুসলমান লেখকের উপর কিছু ধর্মান্ধ মোল্লা ও মুসলমানদের হামলা নয় । এটা একজন লেখকের উপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলা । লেখকের যেমন কোনো জাত হয় না, তেমনি ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও জাত হয় না  সব ধর্মীয় মৌলবাদীদের চরিত্র কম বেশী একই রকম -  তারা বিশ্বাসে গোঁড়া, অসহিষ্ণু, হিংস্র, অমানবিক, আধিপত্যবাদী ও সন্ত্রাসবাদীএকজন লেখক যে মতেরই হোক, মতাদর্শেরই হোক, আস্তিক বা নাস্তিক বা সংশয়বাদীই হোক, সে একজন লেখক ।  কেউ  যদি ধ্বংসের কথা না বলে, কাউকে হত্যা করার কথা না বলে, কাউকে হত্যার প্ররোচনা না দেয়, সে যে মতেরই লেখক হোক তাঁর বাক-স্বাধীনতার পক্ষে ও মত প্রকাশের পক্ষে আমাদের সকলকেই দাঁড়াতে হবে । না হলে  ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে, বিশেষ করে মুসলিম মৌলবাদীদের  হাত থেকে আমরা কেউই রেহাই পাবো না ।  


Monday, March 16, 2015

রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়পুষ্ট উলামা পশ্চিমবঙ্গে তালিবানি রাজ কায়েম করার দুঃস্বপ্ন দেখছে



মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিলো জেলা প্রশাসন মুসলিম মৌলবীদের চাপে । মৌলবিদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় মানুষজনের  মধ্যে ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্য দলীয় কর্মীরাও মালদহ জেলার হরিশচন্দ্র পুরের চণ্ডীপুরে ‘প্রগ্রেসিভ ইয়ুথ ক্লাব’ পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি মহিলা ফুটবল খেলার আয়োজন করেছিলো । জাতীয় মহিলা দলে খেলা কিছু খেলোয়ার নিয়ে গড়া কলকাতা একাদশ ও উত্তরবঙ্গ একাদশের মধ্যে খেলা হওয়ার কথা ছিলো ।  মৌলবিদের বক্তব্য হলো যে  আঁটোসাঁটো স্বল্প পোশাক পরে মেয়েদের যে কোনো খেলা এবং পুরুষদের সেই খেলা দেখা দুটোই শরিয়তবিরোধী , কারণ ঐ পোশাকে মেয়েদের শরীরের অনেক অঙ্গই দৃশ্যমান হয় ।  
 footbal
ক্লাবের সদস্যদের অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের যারা মহিলাদের মধ্যে ফুটবল খেলায় আগ্রহ বাড়ানোর জন্যে মহিলা তারকা ফুটবলারদের নিয়ে এই প্রদর্শনী খেলাটির আয়োজন করেছিলো । ক্লাবের সভাপতি রেজা রাজী আক্ষেপ করে বলেছেন,  প্রশাসন এভাবে অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করলো, ভাবতেই পারছি না । তবে ক্লাবের সদস্যরা মোল্লাদের ফতোয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রাস্তায় যায় নি বলে খবরে প্রকাশ ।
মুসলিম ধর্মগুরুদের ফতোয়ার কাছে এ দেশের জাতীয় সরকার এবং এ রাজ্যের সরকারগুলির  আত্মসমর্পণ করার ঘটনা  প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছেতাই এসব খবর আমাকে ব্যথিত করে ঠিকই, কিন্তু আর অবাক করে না । ১৯৮৫ সালে ধর্মগুরুরা তালাকপ্রাপ্তা মুসলিম মেয়েদের খোরপোষের অনুকূলে দেওয়া  সর্বোচ্চ আদালতের  রায়কে  শরিয়তবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়ে তা  বাতিল করার দাবীতে যখন পথে নেমেছিলো,  তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাদের দাবি মেনে একটি খোরপোষবিরোধী আইন প্রণয়ন  করেছিলেন   কেন্দ্রীয় সরকার দত্তক আইন প্রণয়ন করলে মুসলিম ধর্মিয় নেতারা তা শরিয়তবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়ে দাবি জানিয়েছিল যে মুসলমানদের এই আইনের বাইরে রাখতে হবে । কেন্দ্রীয় সরকার সে দাবি পূরণ করতে বিলম্ব করে নি । মেদিনীপুর শহরে তসলিমার একটি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান বাতিলের দাবি জানিয়েছিলো এই ধর্মগুরুরা । বলেছিল তসলিমা মেদিনীপুর শহরে ঢুকলে রক্তগঙ্গা বইবে । একবার শিলিগুড়ি বইমেলা উদ্বোধনের  কথা ছিলো  তসলিমার । সেবারও তসলিমা শিলিগুড়ি শহরে প্রবেশ করলে রক্তগঙ্গা বইবে বলে হুমকি দিয়েছিলো । দুটো ঘটনার ক্ষেত্রেই তৎকালীন বাম সরকার মোল্লাদের কাছে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণ করেছিলো । আর ফতোয়াবাজদের দাবিতেই তো শেষ পর্যন্ত বামফ্রণ্ট সরকার তসলিমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করতেও দ্বিধা করে নি ।  আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে  মুসলিম ছাত্র সংগঠন ফতোয়া দিয়েছিলো  যে প্রত্যেক ছাত্রী ও মহিলা শিক্ষককে বোরখা পরতে হবে । এই ফতোয়ার প্রতিবাদ  যারা করেছিলে তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃপক্ষ ও বাম সরকার  ফতোয়াবাজদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো ।  কাশ্মীরের মুসলিম ধর্মগুরুরা সেখানকার দু’জন মুসলিম  তরুণী গায়িকার উপর  ফতোয়া জারি করে বলেছিলো যে তারা যদি গান বন্ধ না করে তবে তাদের প্রকাশ্যেই হত্যা করা হবে । সরকার  মেয়ে দুটির নিরাপত্তা না দিয়ে ঘুরিয়ে  তাদেরকেই  গান করবে না বলে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছিলো । এমন ঘটনা যে কতো ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই ।  এ দেশে এটাই দস্তুর যে মুসলিম মৌলবাদিরা   ফতোয়া দেবে আর সরকার সেটাই পালন করবে ।  তাই উলামার র কাছে সরকারের নতজানু হওয়ার  ঘটনাগুলো আমাকে  উদ্বিগ্ন করলেও বিস্মিত করে না । কিন্তু মালদহ জেলার চণ্ডিপুরের ঘটনা আমাকে চরম বিস্মিত করেছে । শুধু বিস্মিতই নয়,  আমাকে স্তম্ভিতও করেছে ।
এতদিন পর্যন্ত উলামা প্রদত্ত সমস্ত ফতোয়ার একটা  সাধারণ বৈশিষ্ট ছিল  তাদের ফতোয়ার শিকার হয়েছে হয় মুসলিমরা, নয়তো  মুসলিম সমাজের যুক্তিবাদী মানুষরা । কিন্তু  মোল্লা-মুফতিরা এবার তাদের লক্ষণরেখা অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছে । তারা শুধু মুসলিম মেয়েদের ফুটবল খেলার উপর কিংবা শুধু মুসলিম সমাজের উপরেই মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখার বিরুদ্ধে  নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া জারি  করে নি, ফতোয়া জারি করেছে  গোটা সমাজের উপরেই  তাদের এই দুঃসাহসটাই আমাকে স্তম্ভিত করেছে । এবার আমার জানতে ইচ্ছা করে অমুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা কী বলেন ।  তাঁরা তো বলেন যে  মুসলিম সমাজে ধর্মগুরুদের ফতোয়া সন্ত্রাসের বিষয়টি মুসলমানদের নিজেদের সমস্যা এবং সেক্ষেত্রে  তাঁদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মুসলমানদেরই  মোকাবিলা করতে হবে ।
চণ্ডিপুরের উক্ত ফতোয়া আফগানিস্তানের তালিবানি যুগের কথা আমাদের স্মরণ করাচ্ছে । তালিবানরা শুধু মেয়েদের  খেলাধূলা নয়, পুরুষদেরও খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছিলো । বন্ধ করে দিয়েছিলো গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটার, চিত্র অঙ্কনওসমস্ত স্টেডিয়াম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বিনোদনের জায়গুলিতে তালা মেরে দিয়েছিলো ।  বন্ধ করে দিয়েছিল টিভি সেণ্টারও । মেয়েদের পুরুষদের সঙ্গ ছাড়া ঘরের বাইরে পা ফেলা এবং পুরুষ ডাক্তারের কাছে নারীর চিকিৎসা নেয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলোপুরুষসঙ্গহীন নারীকে রাস্তায় দেখলে প্রকাশ্যেই চাবুক মারতো । কোনো নারী পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়েছে খবর পেলে তার হাত-পা’র রগ কেটে  তাকে হত্যা করতো  । মালদহের মুসলিম ধর্মগুরুরা দেখছি  তালিবানদের মতোই শরিয়তি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়ছে । ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে মুসলিমরা অতিশয় সংখ্যালঘু সেখানে এ ধৃষ্টতা দেখাবার দুঃসাহস তাদের হলো কি কীভাবে ? এটা কি নেহাতই কতিপয় মূর্খ ধর্মগুরুর আগুনে হাত দেওয়ার মতো শিশুসুলভ দুঃসাহসিক অভিযান ? না কি এটা একটা পরিকল্পিত দুঃসাহসিক মহড়ার ইঙ্গিত ?  নজিরবিহীন এই ফতোয়া দেখে এরূপ ধারণা যদি হয় যে,  যেখানে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সেখানে তারা শরিয়িতি শাসন বলবৎ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে , তা হলে কী তা খুবই অমূলক হবে ?  এর উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না, তবে এটাকে হাল্কা করে দেখাও ঠিক হবে না । যদি তারা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে শরিয়তি শাসন চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে নিশ্চয় তারা মূর্খ । ধর্মান্ধদের পক্ষে মূর্খের মতো পদক্ষেপ করা  মোটেই  অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় । কিন্তু আমাদের এটাও ভেবে দেখা দরকার যে তাদের মূর্খের স্বর্গে বিচরণ করার কারণ কি শুধুই ধর্মান্ধতা, না কি অন্য কোনো কারণও আছে ?   
স্বাধীনোত্তর যুগে ডান-বাম সমস্ত দলের সরকারগুলি সীমাহীন ভাবে মোল্লাতোষণ [মুসলিম তোষণ নয়] করে চলেছে ফলে মোল্লা-মুফতিরা নেতা-মন্ত্রীদের নাকে দড়ি বেঁধে যেদিকে  ঘুরতে বলেছে সেদিকেই তাঁরা দাসানুদাসের মতো ঘুরেছেন ।  নেতা-মন্ত্রীদের এই নির্লজ্জ ভুমিকা তাদের আশ্বস্ত করেছে যে তারা যাই-ই করুক তাদেরকে অন্ততঃ আইনের আওতায় আনা হবে না । মোল্লাতোষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী নগ্ন ও ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে চলেছেন তৃণমূলের সরকার ও তার সুপ্রীমো মমতা ব্যানার্জি । তিনি মোল্লাদের হুকুম মেনে আদালতের রায়কে নস্যাত করে অসাংবিধানিক ভাবেই ইমাম-ভাতা ও মোয়াজ্জিন-ভাতা দিয়ে যাচ্ছেন । এক হাজার খারিজি মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়েছেন । নতুন হজ হাউস নির্মাণ করেছেন । ভারতের নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন সিমির প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ হাসান ইমরানকে রাজ্যসভার সাংসদ করেছেন । ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি রূপায়ণ আটকে দিয়েছেন । বাংলাদেশের জঙ্গিরা এ রাজ্যের মাটিতে নিশ্চিন্তে ঘাঁটি তৈরী করতে পেরেছে । খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কাণ্ডের পর অনায়াসে  বাংলাদেশের জঙ্গিরা  ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো । খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কাণ্ডকে মোল্লা-মুফত-ইমামরা বিজেপির সাজান ঘটনা বলে একদিকে বিনা বাধায় তারস্বরে চিৎকার করেছে যখন তখন মুখ্যমন্ত্রী তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছেন যে খাগড়াগড়ের পেছনে মুসলিম জঙ্গিরা নয়, ‘র’-এর হাত আছে  । তাঁর এই ভূমিকা  মুসলিম ধর্মগুরুদের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে শরিয়তি শাসন চাপিয়ে দেয়ার অলীক স্বপ্ন দেখতে ও  মূর্খের স্বর্গে বিচরণ করতে অনেকটাই উৎসাহ জুগিয়েছে ও প্ররোচিত করেছে     
তালিবানি ফতোয়ার কাছে জেলা প্রশাসনের নতজানু হওয়ার ঘটনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে । প্রথমতঃ মুসলিম ধর্মগুরু ও ধর্মান্ধ মুসলিমদের দুঃসাহস অনেকটাই বাড়বে এবং এর পর অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও এরূপ তালিবানি ফতোয়া জারি হতে পারে ।  এর ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতির যে আবহ আছে তা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ।  দ্বিতীয়তঃ এরূপ ঘটনা ঘটতে থাকলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে মুসলিমরা । কারণ, তাদের উপর ফতোয়া-সন্ত্রাসের মাত্রা বহুগুণ বাড়বে । তৃতীয়তঃ মুসলিম সমাজের বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ যাঁরা মুসলিম সমাজের সংস্কারের কথা বলেন ও সেই উদ্দেশ্যে লেখালেখি করেন তাঁদের উপর হুমকি ও আক্রমণ আরো তীব্র হবে । এবং চতুর্থতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার করবে যা  হিন্দুত্ববাদীদের হাতকে শক্তিশালি করতে ভীষণভাবেই সাহায্য করবে  
ইসলামি ফতোয়ায় একটা রাজ্য স্তরের ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে গেল – এটা তো একটা অশনি সংকেত আমাদের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার  উপর । তথাপি কোনো দিক থেকে কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না ।  হিন্দুত্ববাদীরা ছাড়া সবাই নিশ্চুপ ও নির্বিকার । না মোল্লা-মুফতিদের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে, না শোনা যাচ্ছে প্রশাসন ও সরকারের বিরুদ্ধে । একদা প্রতিবাদী রাজ্যটা এখন একটা  কাপুরুষোচিত নির্বিবাদী ডরফুক রাজ্যে পরিণত হয়েছে । নজরুল, সুকান্ত, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ক্ষুদিরাম ও সুভাষের বিদ্রোহী  বাংলার   এই পরিণতি আমাকে যতটা বিস্মিত করে তার চেয়ে বেশী লজ্জিত করে ।
ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে জোটবদ্ধ হতে হবে তা সে যে ধর্মের মৌলবাদই হোক । তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে ইসলামি মৌলবাদ ক্রমশঃ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সারা বিশ্বে, এবং আমাদের দেশেও কিন্তু তাই বলে এর বিরুদ্ধে শুধু মুসলমানরাই প্রতিবাদ করবে এটা কোনো সৎ যুক্তি হতে পারে না । তবে এটাও অনস্বীকার্য যে ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে মুসলিম সমাজের লোকদেরই । কিন্তু  এখানেও সেই একই হতাশার চিত্র, কিছু কপট প্রতিবাদ দেখা যায় ঠিকই, সত্যিকারের প্রতিবাদ একেবারেই চোখে পড়ে না । মুসলিম বুদ্ধজিজীবিদের  কপট প্রতিবাদের সেই ভাষা বা কৈফিয়ত থাকে একই গতে বাঁধা – ইসলামি মৌলবাদীদের ফতোয়া বা সন্ত্রাসী কাজকর্মগুলো অনৈসলামিক  এ ক্ষেত্রেও তাঁরা বলবেন যে ইসলাম মহিলাদের খেলাধূলার বিরোধী নয়, বরং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে এবং পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে । তবে কেউ কেউ আবার পাশ কাটিয়ে যাবেন এ কথা বলে যে শরিয়তে এমন ফতোয়ার বিধান আছে কি না জানা নেই । মেয়েদের ফুটবল খেলা ও সেই খেলা পুরুষদের দেখা শরিয়তবিরোধী বলে যে ফতোয়া  জারি হয়েছে তার উপর মীরাতুন নাহার সে রকমই কৌশলী   একটি প্রতিক্রিয়া  দিয়েছেন ।  মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও লেখক বলে যাঁদের পরিচিতি ও খ্যাতি আছে তাঁদের মধ্যে মীরাতুন নাহার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব । তিনি  বলেছেন, “শরিয়তি আইনে এমন ফতোয়া আছে কি না,  জানা নেই । শরিয়ত আইন কতটা শাস্ত্র সম্মত তা-ও জানা নেই ।” তিনিই আবার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে, “কোরান তো বলছে যে নারী ও পুরুষ উভয়কে এমন পোশাক পরতে হবে যাতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ না পায় । কই, সে ফতোয়া তো তাঁরা মানেন না ।” মেয়েদের খোলা ময়দানে যে কোনো খেলাধূলাই যে শরিয়তবিরোধী তা জানে না এমন অজ্ঞ মুসলমান খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় নাঅথচ মীরাতুন নাহার বললেন যে মেয়েদের ফুটবেলা খেলা শরিয়তবিরোধী কী না জানেন না ।  তিনিই আবার শরিয়তের এই বিধানটা ভাল করেই জানেন যে নারী ও পুরুষকে কীরূপ পোশাক পরতে হবে । এটা যে স্পষ্টতঃই দ্বিচারিতা তা পাগলেও বোঝে  তিনি ধর্মগুরুদের দেওয়া ফতোয়া নিয়ে অজ্ঞ সাজলেন এজন্যে যাতে  ইসলামের মুখ না পুড়ে, আর পোশাক নিয়ে যেচে শরিয়তি বিধানের বিষয়ে বিজ্ঞ সাজলেন যাতে ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখায়।   এটাই হলো প্রগতিশীল [!]  মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বৈশিষ্ট
এবার একটু চোখ বুলানো যাক মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে শরিয়তি আইন কী বলছে । শরিয়তি আইনের প্রধান ভিত্তি হলো কোরান । কোরানে এমন কোনো আয়াত পাওয়া যাবে না যাতে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে সরাসরি কোনো বিধান রয়েছে । এ সব ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে এই বিষয়গুলিতে কোরান ও হাদিসের আলোকে ইসলামি বিধান প্রণয়ন করতে হবে যার ভার দেওয়া হয়েছে ধর্মগুরুদের উপর । কোরান ও হাদিসের আলোকে যে ইসলামি বিধান প্রনণয়ন করা হয় তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইজমা’ বলে । শরিয়তি বিধানের চারটি উৎসের মধ্যে একটি হলো ‘ইজমা’ যা নিয়ে মুসলিম সমাজে মতান্তর নেই । মেয়েদের ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, টেনিস খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা প্রভৃতি ময়দানের খেলাগুলি [outdoor game] ইজমার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিতে শরিয়তবিরোধি বলে স্বীকৃত হয়েছে    মেয়েদের ঘরের বাইরে খেলাগুলি যে ইসলামের পরিপন্থী তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এমন অনেক আয়াত আছে কোরানে । সেই আয়াতগুলির কয়েকটা এ রকম – “তোমরা [নারী] গৃহকোণে স্থিতি করবে । পূর্বতন মূর্খতার সাজসজ্জার  ন্যায় সাজসজ্জা করবে না ।” [৩৩/৩৩]  “যখন তোমরা নবিপত্নীদের নিকট কিছু চাইবে তখন আড়াল থেকে চাইবে ।” [৩৩/৫৩]  “হে নবি ! তুমি স্বীয় পত্নীদের, কন্যাদের এবং মুমিনদের পত্নিদের বলো, তারা যেন তাদের  মাথার উপর চাদরের কিয়দংশ টেনে দেয় ।” [৩৩/৫৯]  চাদর দিয়ে মাথা ঢাকা পোশাককে ইসলামের পরিভাষায় বলে বোরখা । কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর বোরখা পরা শিথিল করা হয়েছে সে কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে  কোরান কোরানের সেই ভাষ্যটি এরূপঃ   “পিতৃগণ, পুত্রগণ, ভ্রাতুষ্পুত্রগণ, ভগ্নিপুত্রগণ, সেবিকাগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাসীগণের পর্দা পালন না করলে অপরাধ নেই ।” [৩৩/৫৫] অর্থাৎ ঐরূপ নিকটাত্মীয় পুরুষ এবং দাসদাসী ব্যতীত যে কোনো পুরুষের সামনে নারীর বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ।
নারীর ফুটবল খেলা নিয়ে প্রদত্ত ফতোয়াটিতে দুটি অংশ আছে । একটি অংশে নারীর ফুটবল  খেলাকে শরিয়তবিরোধী বলা হয়েছে । আর একটা অংশে বলা হয়েছে পুরুষদের সেই খেলা দেখা শরিয়তবিরোধী । ফতোয়ার এই দুটি অংশই যে শরিয়ত সম্মত তা উপরের আয়াতগুলি থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট । সুতরাং ফতোয়াটি যে সম্পূর্ণ শরিয়তসম্মত তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই । এর পরেও প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোরানের উক্ত আয়াতগুলিতো মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তাহলে অমুসলিমদের উপর ফতোয়া দেয়া কি অনৈসলামিক নয় ? না,  অনৈসলামিক নয় । কারণ, ইসলাম অন্যত্র বলেছে যে এ পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি, তাই এই পৃথিবীতে বাস করতে হলে সবাইকে আল্লাহর বিধান মানতে হবে ।
মুসলিম সমাজ এখনও সবচেয়ে অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ হয়ে রয়েছে এই শরিয়তি ফাঁসে আটকে থাকার জন্যে । এই ফাঁস থেকে না বেরোতে পারলে মুসলিম সমাজ কোনোদিনই পশ্চাদপদতা কাটিয়ে প্রগতি, উন্নতি ও অগ্রগতির পথে পা রাখতে পারবে না । আর তা করতে হলে মুসলিম সমাজের সংস্কার সাধন করা একান্তই আবশ্যক । সমাজ সংস্কারের কাজে মুসলিমরা তখনই এগিয়ে আসবে যখন শরিয়তি আইনের প্রতি তাদের অন্ধ মোহ কাটবে । সেই মোহ কাটানোর জন্যে শরিয়তি আইনের অন্ধকার ও কুৎসিত দিকগুলো নির্মমভাবে উন্মোচন করতেই হবে । খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো এ কাজে মুখ্য ভূমিকা নেয়ার দায়িত্ব যাদের সেই মুসলিম বুদ্ধজিজীবীগণ মুসলমানদের আরো বেশী বেশি করে শরিয়ত আইনের প্রতি মোহগ্রস্ত করে তুলছেন ।  

Thursday, March 5, 2015

অভিজিত হত্যায় বিব্রত মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা প্রগতিশীল সাজতে চরম মিথ্যাচার করছেন


অমর একুশে বই মেলার বাইরে  পুলিশের নাকের  ডগায় খুন হয়ে গেলেন  মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায় । তাঁকে হত্যা করার পর বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তা প্রমান করে তাঁর কাজ  আন্তর্কজাতিক স্তরেও যথেষ্ট প্রশংসা ও খ্যাতি অর্জন  করেছিলোএমন একজন তরুণ  প্রতিভাবান লেখককে  হত্যা করলো  মুসলিমদের জঙ্গিরাতিনি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন কারণ, তিনি যে স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্যে অক্লান্তভাবে কাজ করছিলেন তা শুধু তাঁর দেশ বাংলাদেশের মানুষদের  জন্যেই নয়, কাজ করছিলেন সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্যে । এ কথাটা বুঝেছে তাঁর  ছোট মেয়ে তৃষা আহমেদও, কিন্তু কথাটা বুঝতে অক্ষম বিশ্বের তাবৎ মুসলমানরা ।  তৃষা যা বলেছে    – “বিশ্বকে আরও উন্নত করার জন্য আওয়াজ ওঠানোয় তিনি [বাবা] প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন ।” [বনন্ধনীভুক্ত শব্দটি লেখকের] হ্যাঁ, সারা বিশ্বের মানুষের স্বার্থে ও পক্ষে  কাজ করার জন্যে যে বুদ্ধি, মেধা, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, ভাবনা ও বোধ  থাকা দরকার তা অভিজিতের ছিলো ।  অভিজিত সম্পর্কে  তসলিমা লিখেছেন,  অভিজিৎ রায় বয়সে আমার চেয়ে প্রায় আট-বছরের ছোট। কিন্তু স্নেহ নয়, ওঁকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের যে সব কঠিন জটিল খুঁটিনাটি সাধারণের পাঠযোগ্য করে অভিজিৎ একের পর এক বই লিখে গেছেন, আমার পক্ষে সেসব লেখা কখনই সম্ভব হতো না। অভিজিৎ রায়ের মতো ধৈর্য আর ধীশক্তি আমার নেই।” তসলিমা আরো  লিখেছেন,   যে কথা আমি কোথাও বলতে পারিনি, সবসময় জানতাম সে কথা বলার জন্য একটি মাত্র জায়গা যদি কোথাও থাকে, সে মুক্তমনা ... বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের বিভিন্ন মত প্রকাশ, আর একই সঙ্গে বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো মুক্তমনায়  ... একটা অশিক্ষিত মৌলবাদী মানুষের দেশ আমার দেশএই ভাবনাটি আমাকে মাথা নত করিয়েছিলো, অভিজিৎ এরমুক্তমনাআমার নতমস্তক উঁচু করিয়েছে
অভিজিত খুন হলেন  কেনো ?  তিনি ছিলেন  বাক-স্বাধীনতা এবং অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতায়  বিশ্বাসী । সেই বিশ্বাস তিনি শুধু অন্তরে পোষণই করতেন না, ছড়িয়ে দিতেন অকুতোভয়ে তিনি জানতেন ধর্ম প্রভাবিত রাষ্ট্র ও সমাজ সে অধিকার দেবে না, তা সংগ্রাম করে অর্জন করতে হবে । সেই সংগ্রামে তিনি নিজেকে যেমন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন মৃত্যুর ভ্রুকূটিকে উপেক্ষা করে, তেমনি সঙ্ঘবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে খুলেছিলেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগও   এই ব্লগটি সারা বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ও  এপার বাংলায়  মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার  আন্দোলন গড়ে তুলতে একটি মশাল হয়ে পথ দেখিয়েছে  অভিজিত ও তাঁর সহযোদ্ধারা এই ব্লগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি যে অন্ধবিশ্বাস, অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার বাতাবরণ তৈরী করে মানবসমাজের সর্বনাশ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন  শুধু ইসলামের নয়, মুক্তমনা  সব ধর্মেরই মুখোশ খুলেছে নির্মমভাবে  যুক্তিপূর্ণ  সমালোচনায় বিদ্ধ করে  এই মহান কাজটি অন্য কোনো ধর্মের মানুষের কাছে অসহ্য  ঠেকে নি, কেবল  সহ্য হয় নি ইসলামের পতাকা  বহনকারী অন্ধকারের  কীটগুলোর  তারা  অভিজিতকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়েই দিলো । অভিজিতকে  হত্যা করে তারা একজন ব্যক্তিকেই কেবল  হত্যা করে নি,  কিংবা কারো সন্তান,  বা কারো বাবা,  বা কারো স্বামী,  বা কারো আত্মীয়কেই শুধু হত্যা করে নি । তারা হত্যা করেছে  মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের একজন সেনাপতিকেও । এবং তারা  হত্যা করতে চেয়েছে  একটা আদর্শকে, একটা আন্দোলনকে, একটা প্রতিষ্ঠানকে এবং  একটা মশালকে ।  এর আগেও বাংলাদেশের মাটিতে তারা হত্যা করেছে  মুক্তচিন্তার বহু মানুষকে যাঁদের মধ্যে আছেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক হুমায়ুন আযাদ, শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্লগার রাজীব হায়দার শোভোন এবং  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও   এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয় । সারা বিশ্বেই ধর্মান্ধ মুসলমানরা  অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির মানুষদের উপর তাঁদের কণ্ঠ স্তব্ধ  করার জন্যে । স্বভাবতই বিশ্বের মুক্তমনা মানুষরা অভিজিত হত্যার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে  হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে এবং ইসলামি সন্ত্রাসকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ এবং পরাস্ত করার  অঙ্গিকারবদ্ধ হতে      
অভিজিত হত্যার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী উল্টো প্রতিক্রিয়াও আছে । সে প্রতিক্রিয়া উল্লাসের । উল্লাসে মেতে উঠেছে বিশ্বের ধর্মান্ধ মুসলিমানরা যাদের মধ্যে আছে যেমন মাওলানা-ইমাম-মুফতি ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা, তেমনি আছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতি মুসলিম শিক্ষক-অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, কলাকুশলী, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপুল অংশও  প্রথম দল  উল্লাস ব্যক্ত  করছে সোচ্চারে, পরের দলভুক্ত   লোকেরা তাদের উল্লাস ভাগাভাগি করে নিচ্ছে আড়ালে একান্তে নিজেদের মধ্যে শেষোক্ত দলভুক্ত  লোকেরাও মোল্লা-মুফতিদের মতোই মনে করেন তাঁরা আগে মুসলিম পরে অন্য কিছু    আর মুসলমানদের পক্ষে তো ইসলাম এবং নবির সমালোচনা একেবারেই অসহনীয় । তাঁরা যে  অভিজিত হত্যায় মনে মনে আহ্লাদিত হবেই   কিন্তু যেহেতু তাদের আর একটা সত্তা আছে, তাই তারা  মুক্তমনা মানুষদের  হত্যা করার ঘটনায়  প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন না । তাদেরই  একাংশ  আবার  এ রকম  হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কলম ধরতে দ্বিধা করেন না   এই কলমচিরা মুসলিম জঙ্গিদের [কপট] নিন্দা করার জন্যেই যে শুধু কলম ধরেন তা মোটেই নয়, , তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো  ইসলাম ও ইসলামের নবির  নামে জয়গান করা   এঁরা  জঙ্গিদেরযত  নিন্দা করেন তার চেয়্ব বেশী নিন্দা করেন যাঁরা  সন্ত্রাসের শিকার হন তাঁদের  তাঁদের বক্তব্য,  বাক-স্বাধীনতার  সীমা থাকতে হবে, বাক-স্বাধীনতার নামে  মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না    তাঁরা বলেন যে, বাক-স্বাধীনতার নামে ইসলামের সমালোচনা করে প্ররোচনা সৃষ্টি করার কারণে  মুসলিম জঙ্গিরা বিভ্রান্ত হয়েই  সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে । গত ৭ই জানুয়ারী প্যারিসে ব্যাঙ্গ পত্রিকা শার্লু হেব্দুর  ব্যাঙ্গশিল্পীদের  হত্যার  দায়   পত্রিকাটির কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে  তাঁরা  বলছেন যে মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র আঁকাটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না, ওটা মারাত্মক অপরাধ যা   মুসলমানদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছেতাই পত্রিকাটি  মুহাম্মদকে ব্যাঙ্গ করে যে প্ররোচনা সৃষ্টি করেছিলো তারই পরিণামে আইএস জঙ্গিরা ঐ  কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে   
এই কলমচিরা ইসলামি সন্ত্রাসের জন্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমি দেশগুলিকে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার  করতে সিদ্ধহস্ত   আর এ কাজে অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁদের   দোসর ও দোহারের ভূমিকা পালন করে থাকে  সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বামপন্থী  দলগুলি ।  পুঁজিবাদের সংকট দেখিয়ে এরা সর্বদা কোরাস গায়  যে বিশ্বজুড়ে  ইসলামি সন্ত্রাসের জন্মদাতা হলো  পশ্চিমি দেশগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা  তারা নাকি তাদের সংকট লাঘব করার জন্যে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের সৃষ্টি করেছে  বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি তার যুদ্ধশিল্প টিকিয়ে রাখতে  এ সব করছে । তারাই নাকি মধ্যপ্রাচ্যে  আল-কায়দা ও তালিবানকে  সৃষ্টি করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।  বিশ্বের নানা প্রান্তে যে সব ইসলামি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে সেগুলো তাঁদের  মতে মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম  তাঁদের অভিযোগ হলো সেই মুক্তি সংগ্রামকেই  সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে   ইজরায়েল ও পশ্চিমি দেশগুলো   পশ্চিমি দেশগুলো নাকি  রুশদি, তসলিমা, আলি সিনা, এম.এ খান, আনোয়ার হেকমত, ইবন ওয়ারাক  প্রমুখ বিশ্বের নাম করা যুক্তিবাদি লেখক এবং ফরাসি ও ডেনিস  কার্টুনিস্টদের পেছনে ঢালাও টাকা খরচ করছে সেই অপপ্রচারকে বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ।
মুসলিম কলমচিদের সুবিধা হলো এই যে তাঁরা যা বলেন তা বলেই খালাস, কোনো  বাখ্যা বা   অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়ার দায় নেন  না । পশ্চিমি দেশগুলি কেবল মুসলিমদেরই  সন্ত্রাসবাদী বানাতে পারে, অন্যদের কেনো পারে না ?   এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় নেই তাঁদের  মুহাম্মদ এবং তাঁর শিষ্য খলিফাগণ  তরবারি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে, লক্ষ লক্ষ নরনারীকে ক্রীতদাস বানিয়ে  অর্ধেক বিশ্বকে  পদানত  করে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলো তার পেছনে কোন সাম্রাজ্যবাদের হাত ছিলো ? উত্তর পাওয়া যায় না । লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, নাইজিরিয়া, মিশর, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশগুলিতে  ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা হাজার হাজার  নিরীহ  ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে দিনের পর দিন  - এগুলো মুসলিমদের কোন মুক্তি সংগ্রাম ? কার বিরুদ্ধে এই মুক্তি সংগ্রাম ?   এই কলমচিরা বলেন,  আমরাও বাক-স্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু  মুসলমানদের  ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার বিপক্ষে  সে আবার কেমন বাক-স্বাধীনতা ? কলমচিদের কথা মানলে তো  বিজ্ঞানের পরিক্ষীত সত্যগুলো বলা যাবে না যেমন – সূর্যের চারিদিকে  পৃথিবি ঘোরে, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্যে দিন-রাত্রি হয়, পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্যে ঋতু পরিবর্তন হয়, পৃথিবী ও চন্দ্র ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের সঙ্গে এক সরল রেখায় আসে বলে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয়, সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা হয়, প্রাকৃতিক নিয়মেই  ঝড়-বৃষ্টি হয়, ভিটামিনের অভাব ও জীবাণুর কারণে অসুখ-বিসুখ হয়   এই সত্যি ঘটনাগুলো তো  বলা যাবে না, কারণ এগুলো বললে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে । পৃথিবীর গতি আছে এ কথা বলার জন্যে তো ব্রুনোকে ক্যাথলিক যাজকরা পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো । ৪/৫ বছর আগে সৌদি আরবের গ্রাণ্ড মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন যে পৃথিবী গোলাকার যে বলবে তাকে শরিয়তি আইনে শাস্তি দেওয়া হবে । এবার  দয়া করে একতা লিস্ট বানিয়ে দিন মুসলিম কলমচিরা,  আমরা  কোনটা বলতে পারবো, কোনটা পারবো না ।  এটা বলা যাবে না, ওটা বলা যাবে না – এ সব  শর্ত আরোপ করলে বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কিছু থাকে না কি ? মুসলমানরা ছাড়া আর কোনো ধর্ম  সম্প্রদায়ের মানুষ তো ধর্মের সমালোচনা করলে  আজকাল  রুষ্ট হয় না ।   আমার বিশ্বাস, আমার ভাবনা, আমার কথা আমি  প্রকাশ করতে  পারবো না  ? তা হলে  বাক-স্বাধীনতার কি থাকে  ?  বাক  স্বাধিনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে হবে চূড়ান্ত, অবাধ । আমার উপর কেউ কারো ধর্ম বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দিতে পারবে না এবং আমিও আমার নাস্তিকতা কারো উপর  চাপিয়ে দিবো না – এটা হতে হবে বাক স্বাধিনতা ও মত প্রকাশের স্বাধিনতার নীতি 
আবার  ফিরে আসি অভিজিৎ হত্যা প্রসঙ্গে । অভিজিত হত্যায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ একটু  বেশী বিব্রত বলে মনে হচ্ছে । কারণ,  অভিজিত ছিলেন  হিন্দু পরিবারের  সন্তান এবং  তিনি  কোনো পশ্চিমি দেশের নাগরিক ঞ্ছিলেন না    মুসলিম পরিবারের লোক হলে তাকে বিধর্মীদের চর  বলে সহজেই দেগে দেওয়া যায় এবং তাতে মুসলিমদের  সন্তুষ্ট করাও  যায় আবার তার জন্যে বিধর্মীরাও অসন্তুষ্ট হয় না । আর কোনো পশ্চিমি বিধর্মী হলে তো ইসলামবিদ্বেষী  বলে দিলেই কেল্লা ফতে । কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মাটিতে অভিজিতের বিরুদ্ধে এই সস্তা বস্তাপচা অভিযোগ উত্থাপন করা একটু অসুবিধা বৈকি । করলে মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ে ঠিকই,  কিন্তু  প্রতিবেশী  হিন্দুদের কাছে প্রগতিশীলতার  অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি  থাকে ।  তাই  অভিজিত হত্যাকাণ্ডে নতুন তত্ত্ব  আমদানি করতে হলো   তাঁরা বলছেন যে  শার্লু হেব্দুর ব্যাঙ্গচিত্র শিল্পীদের হত্যা ও অভিজিতকে হত্যা এক জিনিষ নয় ।  আর অভিজিতকে হত্যার ঘটনাকে  মুক্তচিন্তার  উপর আঘাত বলা যায় না  অভিজিত তো শার্লু এব্দু  পত্রিকার মতো ইসলাম ও আল্লহর নবীকে ব্যাঙ্গ করেন নি ।  আর অভিজিত ধর্ম নিয়ে যা লিখেছেন তা বিতর্কিত বটে, কিন্তু  তিনি নবীকে নিয়ে হাসিমস্করা করেন নি ।  সুতরাং তাঁকে হত্যা করা নিন্দনীয় এবং তা ইসলামবিরোধী কাজ । এই তত্ত্বে হিন্দু সমাজের কাছে প্রগতিশীলতার  লেবাশটাও  থাকলো আবার ইসলামের জয়গান গেয়ে মুসলমানদের কাছে প্রিয় থেকে যাওয়াও গেলো । বাঃ! কি চমৎকার দ্বিচারিতা ! বহুচারিতা ! এঁরা কাকের কোকিল সাজার গল্পকেও হার মানায় ।
অভিজিতের  লেখা নিয়ে উল্লেখিত  কলমচিরা যে কথাগুলি বলছেন  তা মোটেই সত্যি নয় । হয় তাঁরা   মিথ্যাচার করছেন,  না হয় অভিজিতের লেখা সম্পর্কে অবহিত না হয়েই নিজের হাস্যকর মতের পক্ষে  প্রমাণ  না পেয়ে  মনগড়া কথা বলছেন । একজন যুক্তিবাদী লেখক যতই প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ হোন, তিনি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে যতই মার্জিত ও পরিশীলিত থাকার চেষ্টা করুন না কেন, এবং তিনি  যত নম্রভাবেই  ইসলামের সমালোচনা করুন না কেন, তাঁর লেখাগুলি ইমুসলিমদের কাছে সলাম ও নবির অবমাননা ও  ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত বলে মনে হবেই  আর তা ছাড়া অভিজিত তাঁর লেখায় নবিকে কোথাও একদম  ব্যঙ্গ করেন নি এ কথা মোটেই ঠিক নয় ।  করেছেন তো কী হলো ?   সবাইকে ব্যঙ্গ করা যাবে, কিন্তু নবিকে ব্যঙ্গ  করা যাবে না -  এটা কোন যুক্তি ? বিশিষ্ট  ব্যক্তিদের কিংবা প্রতিষ্ঠানের  কাজের বা মতের প্রতিবাদ করার নানা পন্থা ও নানা  কৌশলের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা তো একটা অন্যতম স্বীকৃত পন্থা বা কৌশল । অভিজিতের লেখায় সে রকম  কিছু  থাকলে  তা অপরাধ হতে যাবে কেন ?  এবার অভিজিতের লেখা থেকে কিছু  উদ্ধৃত করা যাক যা   মুসলিম কলমচিরা কত মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দেবে মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর – একটি দার্শনিক আলোচনা’ নিবন্ধে অভিজিত আল্লাহ তথা ঈশ্বরকে ‘বড় বাবু’ বলে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন – “মহাবিশ্বের কোন নিয়ন্ত্রক কোন ‘ঈশ্বর’ নামক কোন ‘বড় বাবু’ নন, বরং পদার্থ বিজ্ঞানের কিছু সহজ সূত্রাবলী [Laws of Physics]  আল্লাহর বৃষ্টিতত্ত্ব খণ্ডন  করতে গিয়ে   মুহাম্মদ  গোঁজামিল দিয়েছেন  বলে  অভিজিত তাঁকে  তীব্র কটাক্ষ করে   লিখেছেন  – “স্কুলের ছোট ছেলেটিও জানে মিকাইল ফেরেস্তা বা ইন্দ্রের হাতের কারসাজিতে নয়, বৃষ্টি হয় পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে ।   ... এটা অনেকটা প্রাচীনকালে বৃষ্টি কিভাবে হয় তা বুঝতে না পেরে এর পেছনে ‘মেকাইল ফেরেস্তাকে’ কল্পনা করে  গোঁজামিল গুঁজে দেওয়ার মত ব্যাপার ।”   আল্লাহকে যে অস্বীকার করবে  তাকে  হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । সেই আল্লাহ তথা ঈস্বরকে  অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করেছেন  তিনি লিখেছেন – “অজ্ঞতার অপর নামই হল ঈশ্বর  অভিজিত একজন বিজ্ঞানীকে উদ্ধৃত করেছেন যেখানে আল্লাহকে সরাসরি মূর্খ বলে হেয়  করা হয়েছে – “... তেমন একটা বিশ্বকে মূর্খের সৃষ্ট বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে ।” আর দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই, এই কয়টি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট এটা বুঝতে যে অভিজিত সম্পর্কে  মুসলিম কলমচিরা  যা বলছেন তা এক মস্তবড়ো গোঁজামিল বই নয়
ধরা যাক, অভিজিত ইসলাম ও নবিকে ব্যঙ্গ করেন নি, তা হলেই কি মুসলিম কলমচিদের ম্বাখ্যা অনুযায়ী তাঁকে হত্যা করা অনৈসলামিক হয় ? মোটেই নয় । ইসলামি আইনে অভিজিত যেহেতু হিন্দু পরিবারের সন্তান সেই কারণেই তাঁর বাঁচার অধিকার নেই এই  পৃথিবীতে, বিশেষ করে কোনো একটি মুসলিম দেশে, কারণ তিনি বিধর্মী ।   কোরান বলছে – “হে রব! পৃথিবীতে কোনো কাফেরকে রাখবেন না । রাখলে আপনার বান্দাকে বিভ্রান্ত করবে ।” [৭১/২৬-২৭] কোরান তো মিথ্যে বলে নি, কারণ যুক্তিবাদীরা তো সব সময় আল্লাহার বান্দাদের বিভ্রান্ত [!] করেই । কোরানের এই নির্দেশ পালন করছে বিশ্বজুড়ে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা । বাংলাদেশেও । সেখানে  প্রতিনিয়ত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান নিধন চলে    ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে] হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২%, ২০১১ সালে  সেটা কমে হয়েছে ৮% ।  বাংলাদেশে বিধর্মীদের কত যে হত্যা করা হয়েছে ও হচ্ছে , কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে ও হচ্ছে  তার ইয়ত্তা নেই ফলে দলে দলে তারা এ দেশে চলে এসেছে । বিধর্মীদের উপর এই অত্যাচারও কি পশ্চিমি দেশগুলোর চক্রান্ত ? সাধারণ হিন্দুদের যেখানে  ঠাঁই  নেই সেখানে  অভিজিতের যে  ঠাঁই হওয়া সম্ভব ?    তিনি যে ছিলেন  ঈশ্বর ও ঈশ্বরের ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একজন সেনাপতি । অভিজিতদের  বিরুদ্ধে জিহাদ করা, তাঁদেরকে হত্যা করার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে ইসলামে । কোরানে বলছে   – “যারা আল্লাহ ও তার নবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে হত্যা করা হবে বা শুলিতে দেওয়া হবে ।” [৫/৩৩] “যারা ধর্মদ্রোহী তাদের গলদেশে আঘাত করো, তাদের আঙুলের গিটে গিটে আঘাত করো । এটা এজন্যে যে তারা আল্লাহ ও নবির বিরোধী । [৮/১২,১৩]   “হে নবি ! কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ  করো, ওদের বিরুদ্ধে কঠোর হও ।” [৯/৭৩]    এ রকম অসংখ্য বাণী/নির্দেশ আছে কোরান ও হাদিসে যার শিকার হয়েছেন অভিজিত । যে কলমচিরা বলছেন অভিজিতকে হত্যা করা ইসলামবিরোধী কাজ তাঁরা মিথ্যাচার করছেন  
পরিশেষে বলতে চাই যে অভিজিত নিহিত হওয়ায় আমরা বেদনাহত, কিন্তু হতাশ নই । এর আগে অনেক অভিজিতকে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করেছে কিন্তু তাতে মুক্তচিন্তা থেমে যায় নি, থেমে যায় নি মুক্তবুদ্ধি ও বাক-স্বাধীনতার আন্দোলন । ভবিষ্যতেও আমাদের অনেক অভিজিতকে হারাতে হবে, কিন্তু মুক্তচিন্তার আন্দোলন কোনোদিনই স্তব্ধ হবে না । কারণ, একজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করা যায়, কিন্তু বিজ্ঞানসাধনাকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন লেখককে হত্যা করা যায় কিন্তু কলমকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন গায়ককে হত্যা করা যায় কিন্তু সঙ্গীতকে স্তব্ধ করা য্য না । একজন শিল্পীকে হত্যা করা যায় কিন্তু শিল্পির তুলি ও ক্যানভাসকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন দার্শনিককে হত্যা করা যায় কিন্তু দর্শনকে হত্যা করা যায় না । 
সব শেষে যে প্রশ্নটা আমাকে  ক্ষত-বিক্ষত করে তা নিবেদন করতে চাই, বর্বর ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল ।  সেই আত্মবলিদান কি ব্যর্থ হয়ে যাবে ? আর কতকাল ঐ বর্বর ইসলামি শক্তির হাতে  মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উত্তরাধিকার যারা বহন করছে তারা  প্রাণ দেবে ?       


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...