Saturday, August 2, 2014

মোদিও কি খালেদা ও বুদ্ধদেবের কাতারে দাঁড়াতে চান ?


গত পোরশু (৩১.০৭.১৪) মোদি সরকার তসলিমা নাসরিনের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিল করে দিয়েছে । তার পরিবর্তে দু মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা (এক্স ভিসা) দিয়েছে । দু মাস পর সরকার কী করবে তা নিয়ে খোলসা করে কিছু বলে নি । স্বভাবতই আশঙ্কা আমাদের মনে – মোদি কি তসলিমার ভারতে বসবাসের অধিকার কেড়ে নিতে চায় ? ২০০৪ সাল থেকে ভারত সরকার তাঁকে প্রথমে ছ মাস মেয়াদী, পরে এক বছর মেয়াদী ভারতে বসবাসের অনুমতি (রেসিডেন্ট পারমিট)  দিয়ে এসেছে । মুসলিম মৌলবাদীরা তসলিমাকে ভারত থেকে বিতাড়ণের জন্যে কংগ্রেস শাসিত ভারত সরকারের উপর ধারাবাহিকভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে এবং তার ফলে কংগ্রেসের সরকারও একসময় তস্লিমার উপর প্রবল মানসিক চাপ তৈরী করেছিলো যাতে তিনি  ভারত ত্যাগ করে চলে যেতে  বাধ্য হন । কিন্তু তিনি যান নি । তখন আন্তর্জাতিক স্তরে ভাবমূর্তি মলিন হবে বলে সরকার অবশেষে তাঁকে রেসিডেন্ট পারমিট দিতে বাধ্য হয়েছিলো   অনেকেরই ধারণা যে, তসলিমা ভারতের নাগরিকত্ব পেতে চান । এটা ভুল ধারণা । তাঁর তো সুইডেনের নাগরিকত্ব আছে,  তিনি চেয়েছিলেন দশ বছর মেয়াদী নবীকরণ যোগ্য রেসিডেন্ট পারমিট । কিন্তু কংগ্রেস সরকার অসন্তুষ্ট মুসলিম মৌলবাদীরা আরো বেশী অসন্তুষ্ট হবে বলে তা মঞ্জুর করে নি, যদিও আর একজন বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক ও মানবাধিকার কর্মী সালাম আজাদকে মঞ্জুর করেছিলো । বিজেপির তো মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করার দায় নেয়, তাই আশা করা গিয়েছিল মোদি তসলিমার দশ বছর মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিটের আবেদন মঞ্জুর করবেন । কিন্তু যা আশা করা গিয়েছিলো ঘটলো ঠিক তার উল্টো ।  খালেদা নির্বাসিত করেছিলেন তসলিমাকে তাঁর স্বদেশ বাংলাদেশ থেকে, বুদ্ধদেব করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, এবার কি মোদি ভারত থেকে নির্বাসিত করতে চান ? মোদিও কি খালেদা ও বুদ্ধদেবের কাতারে দাঁড়াতে চান ? মনে পড়ে যাচ্ছে খালেদা ও বুদ্ধদেবে কীভাবে তসলিমাকে নির্বাসিত করেছিলেন সে কথাগুলি ।
সেটা ১৯৯৪ সাল । খালেদা জিয়া অতি নিষ্ঠুরভাবে তসলিম নাসরিনকে তাঁর স্বদেশ থেকে চিরদিনের জন্যে নির্বাসিত করেছিলে । তারপর ১৯০৭ সালে একইভাবে  ভারতের কমুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা থেকে নির্বাসিত করেছিলেন চিরদিনের জন্যে । এই দুজনের কেউই আর তসলিমাকে ঢুকতে দেন নি যইথাক্রমে বাংলাদেশ ও  পশ্চিমবঙ্গে । খালেদার প্রচ্ছন্ন মদতে মুসলিম মৌলবাদীরা বল্গাহীন অপপ্রচার ও কুৎসার বন্যা বইয়ে  তসলিমার বিরুদ্ধে প্রথমে জনমতকে ক্ষুব্ধ করে তোলে । তারপর ‘তসলিমার মুন্ডু চাই’ ধ্বনি তুলে তান্ডব শুরু করে । খালেদা জিয়া, তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী, মৌলবাদীদের তান্ডবে কোনো দোষ দেখেন নি, দেখেছিলেন তসলিমার । এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা  দায়ের করেছিলেন । তখন খুনি মোল্লা-মুফতিদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে দীর্ঘ দুমাস এ বাড়ি ও বাড়ি করে আন্ডারগ্রাউন্ডে কঠিন কষ্টের জীবন কাটাতে হয়েছিলো ।  সে সময় বাড়ি বাড়ি হন্যে হয়ে খুঁজেছে মোলা-মুফতিদের ঘাতক দল তাঁকে হত্যা করার জন্যে । এই ঘাতকদের বিরুদ্ধে  খালেদা কোনো পদক্ষেপ করেনি, এমন কি সামান্য পদক্ষেপ্ব করেনি এই জল্লাদদের হাত থেকে তসলিমাকে রক্ষা করার জন্যেও  । উল্টে তাঁকেই দেশ থেকে নির্বাসিত করেছিলেন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার অজুহাতে । কমবেশী এই একই চিত্রনাট্য দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে ।
খালেদা যা করেছিলেন তা অপ্রত্যাশিত ছিলো না , কিন্তু বুদ্ধদেবের সরকারের কাছে এটা ছিলো একেবারেই অপ্রত্যাশিত । কারণ, সিপিএম (ভারতের কমিউনস্ট পার্টি মার্কসবাদী ) আদর্শগতভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ও দীর্ঘ সময় ধরে এই নীতিকে চোখের মণির মতো আগলে রেখেছিলো । তথাপি এই দলের সরকারই ২০০৭ সালের ২২শে নভেম্বর হঠাৎই  তসলিমাকে নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একদম জোরকরে একটি বিশেষ বিমানে তুলে দিয়ে রাজস্থানে নামিয়ে দিয়ে চলে আসে । রাজস্থানে নির্বাসিত করার পর সরকার বলেছিলো যে তসলিমা স্বেচ্ছায় কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন ।  তসলিমার সেচ্ছায় কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাটা একেবারেই মিথ্যা ছিলো । বুদ্ধবাবুরা মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করতে তসলিমাকে কলকাতায় থাকতে দিতে চান নি তা বহু আগেই কেন্দ্রীয় সরকারকে (১৪/৩/০৫) একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলো । সরকার একটা অজুহাত খুঁজছিলো তাঁকে কলকাতা থকে তাড়ানোর ।  সেই অজুহাত ২১/০৭/১৪ তারিখে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েও ছিলো যেদিন তাঁকে তাড়ানো হয় তার আগের দিন ।  আর নির্বাসনে পাঠানোর জন্যে  বুদ্ধবাবু রাজস্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন কেন ? বুদ্ধবাবুরা হয়তো তসলিমার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেয়েছিলেন, কারণ সে সময় সেখানে বিজেপির  সরকার ছিল নিজের দোষ আড়াল করতে এবং অপরের  ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করতে মার্কসবাদী একটা রাজনৈতিক দল এত মিথ্যাচার করতে পারে তা সত্যিই আমার কল্পনার অতীত ছিলো
আমি একজন ভারতীয় হিসেবে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপ দেখে ভীষণ লজ্জা পাই । এখানে সবাই নির্লজ্জভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের পদলেহন করে তারা । ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতো সমাজের বড়ো শত্রু কমই আছে জেনেও সবাই করে । করে কারণ, তারা মনে করে মুসলিমরা ঢেলে ভোট দেবে  মোল্লাতন্ত্রকে তোষণ করলে, না করলে দেবে না । এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা, তবুও মোল্লাতন্ত্র তোষণের পরম্পরা চলে আসছে ভারতীয় রাজনীতিতে । আর যেটা আরো অধিক লজ্জা ও বেদনার বিষয় তা হলো,  এই জঘন্য রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছে বামপন্থীরাও । ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) ক্ষমতায় আসার পর তাদের মধ্যে এই ভয়ানক বিচ্যুতিটির জন্ম হয় । ধীরে ধীরে এই বিচ্যুতিটি এমন ভয়ানক আকার নেয় যে তারা কংগ্রেস সহ অন্যান্য বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা  শুরু করে দেয় কে কত মোল্লা-মুফতিদের পদলেহন করতে পারে সে বিষয়ে । ডানপন্থী ও বামপন্থী  সকল রাজনৈতিক দলের এই নোংড়া খেলায় আমি লক্ষ্য করেছি তসলিমা যেন একটা প্যারামিটার কে কতো মোল্লাদরদী তা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে । সবাই চেয়েছে বারবার মোল্লাতোষণে তসলিমাকে বলির পাঁঠা করতে । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও বামপন্থীরা কত নগ্নভাবে এই নোংড়া খেলা খেলেছে তার দু একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক । 
 ১৯৯২ সাল মোদির দল বিজেপি ও সঙ্ঘপরিবার বিতর্কিত বাবরি মসজিদটি ধ্বংস করে দিলে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো ভারতে ও ভারতের বাইরে  । বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কররূপে । সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর বীভৎস অত্যাচার, উৎপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হয়েছিলো এবং অসংখ্য মন্দির ভেঙে ধ্বংস করা হয়েছিলো । তসলিমা সেই ভয়াবহ অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখে যেখানে সেই বীভৎস অত্যাচারের ছবি এঁকেছিলেন নজিরবিহীন দুঃসাহসিকতায় । এই বইটি লেখার জন্যে আগে থেকেই ক্ষিপ্ত মুসলিম মৌলবাদীরা  তসলিমার উপর আরো সহস্রগুণ ক্ষিপ্ত হয়  ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর শিরচ্ছেদ করতে না পারলেও তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করতে সক্ষম হয় । লজ্জা লেখার জন্যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল ও প্রতিষ্ঠানের কাছে তসলিমার প্রাপ্য ছিল ধন্যবাদ, অন্ততঃ বামপন্থীদের কাছে তো বটেই কিন্তু তখন আমি দেখেছি এ রাজ্যে মৌলবাদিদের সঙ্গে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা একই সুরে তসলিমার তীব্র সমালোচনা করেছে  সেই বোধ হয় শুরু, তারপর বামপন্থীরা মোল্লাতন্ত্রকে খুশী করতে তসলিমাকে বারবার বলির পাঁঠা করেছে । ২০০৪ সালে তসলিমার আত্মজীবনীমূলক বইয়ের ৩য় খন্ড ‘দ্বিখন্ডিত’কে নিষিদ্ধ করে বুদ্ধদেব বাবুর সরকার মুসলিম মৌঈলবাদীদের নিষিদ্ধ করতেই । কারণ, তার আগে ২০০৩ সালে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলায় ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিলো ।  ২০০৫ সালে ৩০শে এপ্রিল মেদিনীপুরে ‘স্বর ও আবৃত্তি’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তসলিমাকে আমন্ত্রণ করেছিল । মুসলিম মৌলবাদীরা হুঙ্কার দিয়েছিলো তসলিমা গেলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে । বুদ্ধদেব বাবু, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যারা এমন বেআইনী হুঙ্কার দিলো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানটাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন । ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বড়ো শহর শিলিগুড়িতে বইমেলার অনুষ্ঠান । তার শুভ উদ্বোধন করবেন তসলিমা । আবার মুসলিম মৌলবাদীদের তরফ থেকে রক্তগঙ্গা বওয়ানোর হুঙ্কার । বুদ্ধবাবু আবারো নেমে পড়লেন মোল্লাদের তুষ্ট করতে । সরকার আয়োজকদের জানালো, যদি বইমেলা করতে চাও তবে তসলিমার আমন্ত্রন বাতিল  করো বলা বাহুল্য যে আয়োজকরা  তাই করেছিলো । এভাবে সিপিএম ও বামপন্থীরা মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে  বারবার আপোষ করেছে । এমন কি ভিতর ভিতর শুভ আঁতাতও গড়ে তুলেছে  । 

এই আঁতাতে যেটুকু গোপনীয়তা ছিল তার সবটুকুই উদাম হয়ে যায় ২০০৭ সালের ২১ শে নভেম্বর । ওই দিন তসলিমা বিতাড়নের দাবীতে মুসলিম মৌলবাদীরা সারাদিন কলকাতার রজপথে তান্ডব চালায় । স্কুলের ছাত্রছাত্রী, পথচারী, দোকানদার, অফিস-কাচারি, যানবাহন কিছুই রেহাই পায় নি ওদের হাত থেকে । পুলিশও রেহায় পায় নি ।  দিনের শেষে বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা সিপিএমের সম্পাদক বিমান বসুর কন্ঠেও আমরা শুনেছিলান সে একই দাবীর প্রতিধ্বনি – মুসলিমরা যখন চাইছে না তখন তসলিমার  এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত । ধর্মীয় আবেগের নামে মুসলিম দুষ্কৃতিরা পুলিশের উপর হামলা চালালো, বাস-ট্রাক-ট্রাম জ্বালালো, দোকান-অফিস ভাঙচুর করলো, এবং গোটা কলকাতাকে জিম্মি করে রাখলো সারাদিন অথচ নির্মমভাবে গণআন্দোলন ভাঙায় সিদ্ধহস্ত পুলিশ কী সংযমই না সেদিন দেখিয়েছিলো ! অন্যদিকে আবার হিংস্র ও উন্মত্ত মৌলবাদী দুষ্কৃতিদের আমরা দেখেছি সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় কত শান্ত ভূমিকায় যখন  বিমান বসু তাঁর পার্টির পক্ষ থেকে শান্তিমিছিল করেছিলেন ।   আমরা সেদিন দেখেছি সিপিএম ও মুসলিম মৌলবাদীদের লজ্জাজনক অশুভ বোঝাপাড়া । আর ঠিক সে ঘটনার পরের দিনই তসলিমাকে নিরাপত্তার অজুহাতে বুদ্ধদেব বাবুর পুলিশ জোর করে বিমানে তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি শাসিত রাজস্থানে পাঠিয়ে দেন ।  কী ন্যক্কারজনক (কু)নাট্য চিত্র আর কী নিপুণ তার পরিচালনা ও সঞ্চালনা বুদ্ধবাবু ও বিমান বাবুদের ! তসলিমাকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রশ্নে মুসলিম মৌলবাদ ঘেঁষা খালেদা জিয়া ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কী আশ্চর্য চিন্তা ও কাজের মিল দেখেছি আমরা !  
কলকাতা থেকে তসলিমাকে নির্বাসিত করা শুধু অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও বেআইনীই ছিলো না, তা ছিলো কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধীও । গত শতকের বিশ ও ত্রিশ দশকে  তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর মুসলিম মৌলবাদীরা কী ভয়ানক অত্যচার ও নির্যাতন চালাতো সে কথা আমাদের কাছে অজানা নয় । কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আব্দুল কাদির, আবুল হোসেন প্রমুখ লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের তারা ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়ে জনসমক্ষে নাক খত দেওয়া করিয়েছিলো ।  শেষ অবধি প্রাণ রক্ষার্থে তাঁরা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন  পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) বগুরা কলেজের অধ্যক্ষ  সৈয়দ মুজতুবা আলীকেও কলকাতা পালিয়ে এসে মুসলিম মৌলবাদীদের হাত থেকে প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছিলো । তিনি বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কাব্য প্রতিভায় কবি ইকবালের চেয়েও বড়ো । তারজন্যে তাঁকে নাস্তিক ও হিন্দুর দালাল বলে তাঁর ওপর হামলা করেছিলো গোঁড়া মোল্লার দল ।  ঢাকায় বা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বা পূর্বপাকিস্তানে মুসলিম সমাজের যাঁরা মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁদের সবাইকে পরম আদরে বুকে টেনে নিয়েছিলো কলকাতা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আমরা দেখেছি একই ছবি । পাক সেনা ও মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে  এক কোটি বাঙালি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল যাদের ৯০ শতাংশই ছিলে পশ্চিমবঙ্গে । সবাইকে প্রেম-প্রীতি দিয়ে মায়ের মতো বুকে ঠাঁই দিয়েছিল আমাদের কলকাতা ও পশ্চিমবাংলা ।  অপরদিকে রাজা রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র যখন সমাজ সংস্কারের আন্দোলন করেছিলেন তখনও হিন্দু মৌলবাদীরা ও হিন্দু সমাজ তাঁদের ওপর কম খড়্গহস্ত ছিলো না । কিন্তু তারজন্যে তাদের মুন্ডু নিতে কেউ চায় নি বা  তাঁদেরকে কলকাতা ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি । এই হলো পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য ।  বুদ্ধবাবুরা মানব সমাজ ও সভ্যতার শত্রু মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তসলিমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করে সেদিন কলকাতার সেই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছিলো । কিন্তু তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় থাকতে কখনোই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না ।  অথচ এদিকে যেহেতু তাঁর স্বদেশ ফেরার পথ রুদ্ধ, ফেরার পথ রুদ্ধ কলকাতাতেও, তাই তিনি  বাংলার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগের টানে থাকতে চান বাংলার কাছাকাছিই, তথা ভারতেই এবং ভারতের রাজধানী দিল্লীতে । বহু টালবাহানার পর অবশেষে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে ভারত সরকার ২০০৪ সালে । তিনি  ভারত সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেছেন দশ বছর মেয়াদি নবীকরোণযোগ্য রেসিডেন্ট পারমিট দেওয়ার জন্যে । কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা অসন্তুষ্ট হবে বলে তাঁর সে দাবী বারবার প্রত্যাখান করা হয়েছে । বিজেপি সর্বদায় কংগ্রেস ও বামপন্থীদের এই তোয়াজ করার নীতির বিরুদ্ধে সরব থেকেছে । তাই এটাই প্রত্যাশা ছিলো যে মোদির সরকার এবার তসলিমাকে দীর্ঘ মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিট  মঞ্জুর  করবে । কিন্তু একি! রেসিডেন্ট পারমিটের সময়কাল বৃদ্ধি করা তো দূরের কথা, উল্টে তাঁর সেই পারমিটটাই কেড়ে নিলো ।  এ কাজ করে মোদি নিঃসন্দেহে  ভারতের  ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেই কলঙ্কিত ও পদদলিত  করলেন । তিনি যা করলেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে  পদদলিত করলেন গণতন্ত্র ও  মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই । হত্যা করলেন মানবাধিকার ও মানবতাকেই ।   
মোদি কেন এ কাজ করলেন তা এক কঠিন রহস্যজনক ঘটনা । লোকসভা ভোটের আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী  মোদির কন্ঠে একটু পরিবর্তনের সুর আমরা লক্ষ্য করেছি । তিনি মুসলিমদের প্রতি একটা নরম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিলো  সেটা ছিল তাঁর একটা ছলনা  মাত্র, এবং তিনি শুধু মুসলিম ভোটের আশায় তা করেছিলেন মোটেই তা নয় । সেটা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হিন্দু সমাজের ভোটারদের টানতে তাঁর একটা কৌশলী  প্রয়াস মাত্র । কিন্তু তসলিমার  ক্ষেত্রে মোদি যা করলেন তাতে  তাঁর সম্পর্কে  রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের আবার  নতুন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু করতে হবে । মোদিও কি সত্যি সত্যিই মুসলিম ভোট পাওয়ার প্রত্যাশী হয়ে উঠেছেন ? তারজন্যে তিনি কি মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করে মুসলমানদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন ?  তারজন্যেই কি তসলিমা বিতাড়নে তিনি বুদ্ধ-খালেদার কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লেন ?  
পাছে মুসলিম মৌলবাদীরা অসন্তুষ্ট হয় ও মুসলিম ভোট হারাতে হয় ভেবে কোনো রাজনৈতিক দলই  মুখ খুলছে না । সব কটা রাজনৈতিক দল এ দেশে নীতি ও আদর্শহীন এবং দু কান কাটার মতো নির্লজ্জ । এ বাংলার বুদ্ধিজীবীরাও সকলেই হয় ভীতু ও কাপুরুষ,নয়তো  সুবিধাবাদী ও উচ্ছিষ্টভোগী । একটু-আধটু উচ্ছিষ্টের আশায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে টিকি বাঁধা রেখেছেন তাঁরা । মুসলিম মৌলবাদীদের বর্বর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এবং  সরকারের মোল্লাতোষণের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করার মুরোদ নেই তাঁদের ।  বাংলার বাইরে অবস্থা এতো খারাপ নয় । তসলিমার প্রশ্নে কিছু কিছু মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যাচ্ছে ।  তসলিমাকে ভারতে থাকার অনুমতি পত্র ফিরিয়ে দিতে, কেউ কেউ  এমন কি তসিলিমাকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিতও  সোচ্চার হয়েছেন   কিন্তু মোদি এ সব দাবীতে কর্ণপাত করবে কী না একমাত্র তিনিই জানেন । বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে নির্বাসিত হয়ে অবশেষে তসলিমা ভারতেই পাকাপাকি থেকে যেতে চেয়েছিলেন । যদি তাঁকে মোদি ও বিজেপির সৌজন্যে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হয়, তবে সেটাও হবে তাঁর কাছে আর একদফা স্বদেশ থেকে নির্বাসনের মতোই কষ্টদায়ক ঘটনা । সত্যি কী ঘটে তা দেখার জন্যে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে ।  
পুনশ্চঃ আজ (০৩. ০৮.১৪) ভোরে  সংবাদ পত্রে দেখলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং তসিলামাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন শীঘ্রয় অন্ধকার কেটে যাবে । তিনি এমন কি দীর্ঘ মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিট দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন তসলিমাকে যখন তিনি স্বয়ং তাঁর (রাজনাথ সিং) সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতে থাকার আবেদন জানা । সে কথা তসিলিমাও নিজে টুইট করে জানিয়েছেন  ।   আশাকরি সরকার কথা রাখবে এবং তা যদি হয় তবে তা হবে সত্যিই একটা ভালো দৃষ্টান্ত ।      

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...