Tuesday, July 29, 2014

ঈদের উৎসবে নেই রমজানের তথাকথিত শুদ্ধাচার,আছে অন্য সুর


 গত কাল ঈদ হয়ে গেছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিশর, সিরিয়া, জর্ডন, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া প্রভ্রিতি দেশগুলিতে । একই সঙ্গে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডীয় মুসলমানরাও গতকাল ঈদ উদযপন করেছে । আর আজ (২৯.০৭.২০১৪) যথারীতি পৃথিবীর বহু দেশের সাথা এদেশের মুসলমানরাও  সাড়ম্বরে ও মহা ধূমধামে উদযাপন  করছে  ঈদ-উল-ফিতর ।  উদযাপন করছে  এই বঙ্গের মুসলমানরাও । ঈদের তথাকথিত অন্তর্নিহিত অর্থ যাই হোক, আমরা বুঝে গেছি ঈদ মানে খুশীঈদ মুসলমানদের  সব চেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব  । কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি – পার্ক সার্কাস, ,মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরীচ, রাজাবাজার, চিৎপুর, খিদিরপুর প্রভৃতি – কী সাজে সেজেছে, কতটা সেজেছে এবং কী বিপুল অর্থের অপব্যয় হয়েছে এই সাজসজ্জায়,  কার সাধ্য তার বর্ণনা দেয়, হিসেব দেয় । এ সব অঞ্চলগুলি ঘুরলে কে বলবে যে এ পোড়ার দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাস্তুহীন, গৃহহীন কোটী কোটী মানুষ  মানবেতর জীবনযাপন করে; লক্ষ লক্ষ শিশু অনাহারে,অপুষ্টিতে, অচিকিৎসায় অকালে ঝরে যায় মায়ের কোল খালি করে;  অন্ধ হয়ে যায় প্রতিদিন শত শত শিশু ভিটামিনের অভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে জীবনের মতো  এবং রক্তাল্পতায় ভুগতে ভুগতে প্রতিদিন শত শত জননী সন্তান প্রসব করতে গিয়ে শেষ শয্যা নেয় ফুটপাতে কিংবা হাসপাতালের বেডে    এ অপরূপ সাজসজ্জা শুধু কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেই নয়, বাংলার মফঃস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই এই ছবি দৃশ্যমান, সবখানেই যে যার সাধ্য মতো সাজিয়েছে নিজ নিজ অঞ্চলকে । হোর্ডিং, ব্যানার, ফ্লেক্স, চেইনফ্লাগ, আলোর বর্ণচ্ছটায় বাংলা জুড়ে সর্বত্রই ঈদের ঘোষণা । চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ, উৎসবের মেজাজ ।  বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঈদ উপলক্ষ্যে এই যে চারিদিকে খুশীর ফোয়ারা, উৎসবের জয়ধ্বনি – এসব  গরীব-গুর্বা মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকেই শুধু যে উৎসারিত হয় তা কিন্তু নয় ।   এর পেছনে আছে অবশ্যই  ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় স্তর থেকে নেওয়া সুনির্দিষ্ট ও সুগভীর পরিকল্পনা । অন্যান্য সব ধর্মীয় উৎসবে, বিশেষ করে হিন্দুদের দূর্গাপূজা, কালিপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন করে হয় ঠিক তেমন করেই ঈদ উদযাপন করতে হবে – এমন পরিকল্পনা বা নির্দেশ উপর থেকেই আসে । না হলে, ঈদ (রমযানের ঈদ) উপলক্ষ্যে কেন বাজিপটকা ফাটিয়ে, আলোর রোশনায় ছড়িয়ে এতো চোখ ধাঁধানো,  মন রাঙানো খুশীর বন্যা বয়ে যাবে রাজধানী শহরের চওড়া রাজপথ থেকে শুরু করে এঁদো গ্রামের সরুগলি রাস্তায়, মহল্লায় মহল্লায় ?
ঈদ-উল-ফিতর আসে রমজান মাস শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন । আর এই রমজান মাসের কঠিনতম উপবাস পর্ব শেষ হয় ঈদ-উল-ফিতরের মাত্র দু রেকাত নামাজের মধ্যে দিয়ে । রমজানের মাসের দুটি দিক আছে বলে শোনা যায় । একটা নাকি কঠোর সংযম তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ, আর একটা     কৃচ্ছসাধন । এর পিছনে নাকি এক বিশেষ ও বিশাল তাৎপর্য রয়েছে । এসব নিয়ে বিশোদ আলোচনা করার অবকাশ নেই এ নিবন্ধে । তবু প্রাসঙ্গিকতা হেতু কিছু কথা বলতেই হয় । সংযম মানে বলা হয় চরিত্র গঠন করা, নিজের মনে ও ভাবনায় যে মানুষের সহজাত যে কুপ্রবৃত্তিগুলি রয়েছে সেগুলিকে কঠোরভাবে  দমন করা, পরাস্ত করা এবং এ ভাবে নিজেকে রমজানের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করা । এসব কথার কী অর্থ তা শোনা যাক ।  মিথ্যে বলা যাবে না, চুরি ও দুর্নীতি করা যাবে না, পরনিন্দা-পরচর্চা করা যাবে না, দুর্বলের উপর অত্যাচার করা যাবে না । লোক ঠকানো যাবে না, লোককে শোষণ করা যাবে না, পরনারীর প্রতি কুনজরে দৃষ্টীপাত করা যাবে নাইসলাম এসব কাজে নিষেধাজ্ঞা করেছে এ কথা শুনে ইসলামের ইতিহাসি ও কোরান-হাদিস সম্পর্কে  যাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে সব মানুষের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে । সে কথা থাক । ইসলাম নাকি বলছে যে রমজান মাসে মুসলমানদের সম্পূর্ণ সৎভাবে এবং সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে জীবিনযাপন করতে হবে । শুধু কি তাই ? ইসলাম না কি বলে যে বছরের পরবর্তী এগারো মাসও সেই সততা ও নিষ্কলুষ মন ও চরিত্র নিয়ে জীবনযাপনের অঙ্গীকারও গ্রহণ করতে হবে রোজার মাসে । ধরে নেওয়া যাক, ইসলাম সত্যি এই শিক্ষাই দেয় । অধিকাংশ মুসলিমই কিন্তু সরল চিত্তে বিশ্বাস করে রমজান মাসের এই বিশেষ গুরুত্বের কথা ।
কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি ? আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলিই বা কী ? কেউ কি দাবী করতে পারেন, যাঁরা রোজা রাখেন, কিংবা প্রবল ইচ্ছা থাকলেও শারীরিক কারণে রোজা রাখেন না, তাঁরা ইসলামের  এই তথাকথিত নির্দেশগুলি পালন করেন ?  কিংবা অন্তত পালন করার চেষ্টা করেন ? না, কেউ করেন না । রমজানের আগুনে পুড়িয়ে নিজের আত্মশুদ্ধি ঘটানোই হলো রোজা রাখার উদ্দেশ্য বলে নিরন্তর  যে প্রচার শুনতে পাওয়া যায় তার ন্যূনতম প্রতিফলন দেখা যায় না মুসলমানদের মধ্যে সমগ্র রমজান মাসে । দেখা যায় বরং উল্টো ছবি । প্রতি পদে উপবাস মুখে সে নির্দেশগুলি নির্বিকার চিত্তে লঙ্ঘন করার হাজারো দৃষ্টান্ত নজরীভূত হয় রমজান মাসে । এই লঙ্ঘন করে মুসলিম সমাজ সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে । আর এই যে সজ্ঞানে রোজামুখে রমজানের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করা হয়,  তারজন্যে কি কোনো মানসিক যন্ত্রণা বা অনুতাপের ছাপ  চোখে পড়ে মুসলমানদের শরীরী ভাষায় ?  মোটেই না ।  তাহলে  ঈদের দিনে বা ঈদের উৎসবে খুশীতে মেতে ওঠার কী  মানে হথাকতে পারে  ?
রমজান মাস না কি কৃচ্ছতা সাধনের মাস । যারা খেতে পায় না, কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন যাপন করে তাদের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করা, তাদের ক্ষুধার ভাগীদার হওয়া নাকি  এ মাসের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য । সারাদিন উপবাস থেকে অনাহারক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মহান তাৎপর্য ও নির্দেশ নিয়ে নাকি রমজান মাস মুসলমানদের দরবারে এসে হাজির হয় । কিন্ত পবিত্র (!) এই রমজানের  ত্রিশ বা ঊনত্রিশ দিনের  প্রাত্যহিক জীবনের ছবিটা আমরা কীরূপ দেখি ?   কৃচ্ছতা সাধনের লেশ মাত্র আমরা দেখি না কোথাও । বরং  ঠিক এর বিপরীতটাই  দেখা যায় সর্বত্র । সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে দৃষ্টীগোচর হয় উপবাস ভাঙার বিশাল আয়োজন । হর কসিমের ফলমূল, উপাদেয় নানা প্রকার তেলের খাবার ও মিষ্টান্ন সহযোগে রোজা ইফতার (উপবাস ভঙ্গ)  করা হয়, আর রাত্রে খাবার মেনুতে থাকে ভুরিভোজের বিপুল ব্যবস্থা । যারা বারোমাস অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকে, ক্ষুধার কামড়ে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না তাদের যন্ত্রণাল্কলিষ্ট মুখের কথা কি একবারও মনে পড়ে   রোজাদার ইমানদার মুসলমানদের ?   রোজা ইফতারের নামে বড়ো বড়ো পার্টি হয়, ইফতার পার্টি যার নাম । সেখানে আমন্ত্রিত হয় রোজা রাখা, না রাখা বিশিষ্ট  মুসলমানরা এমন কি হিন্দু সমাজের  বিশিষ্ট জনেরাও । এই বিশিষ্ট জনেরা সবাই ক্ষমতাবান শ্রেণির থেকে আসা মানুষ – কেউ পলিটিসিয়ান, কেউ শিল্পপতি, কেউ  বড়ো ব্যবসায়ী , কেউ আড়ৎদার, কেউ সুদখোর, কেউ মদখোর, কেউ জোতদার, কেউ প্রমোটার, কেউ খেলোয়ার, কেউ শিল্পী ইত্যাদি ইত্যাদি । কে না আমন্ত্রিত হয় সমাজের বিত্তবান ও  ক্ষমতাবান শ্রেণি থেকে ! শুধু আমন্ত্রিয় হয় না সে মানুষগুলো যারা সারা বছর খেতে পায় না তারা থেকে যায় অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত তবু তারা অনেকেই ছুটে যায় রবাহূত হয়ে । অসম্মানে, অনাদরে ও অবহেলায় তাদের পাতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু খাবার যা বানানো হয় তাদের জন্যেই, কেবল তাদের মতো হতদরিদ্র সর্বহারা শ্রেণির জন্যেই । 
হতদরিদ্র মানুষদের কষ্টগুলি ভাগ করে নেওয়ার, তাদের কষ্টগুলিকে কিছুটা উপলব্ধি করার মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করা যদি অন্যতম একটা প্রধান উদেশ্য নিয়ে যদি রমজানের  আগমন ঘটে তবে সেই রমজানের শেষে উৎসবের প্রশ্ন আসে কী করে ? তবু উৎসব হয়, আনন্দ হয় এবং  মহা ধূমধাম করেই হয় । এ বছর আগের বছরের চেয়ে বেশীই ধূমধাম হচ্ছে, সামনে বছর আরো বেশি হবে । ধর্মের কথিত নীতি ও আদর্শগুলো  গৌণই আছে, গৌণই থাকে, আর ক্রমশঃ  গৌণতর হতে থাকে ।   রমজান মাস ও রমজানের শেষে ঈদ-উল-ফিতর যে নিছকই একটা  ধর্মীয় উৎসব, শুধুই উৎসব, এখানে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই,  তার ছাপ সর্বত্রই দৃশ্যমান ।   ইসলাম সম্পর্কে যতই বড়ো বড়ো দাবি করা হোক না কেন, এসব দেখে এটা স্পষ্টতঃ প্রতিয়মান হয় যে ইসলাম একটা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম বৈ নয়আর পাঁচটা ধর্ম যেমন অনুষ্ঠানসর্বস্ব, ইসলামও তাই । কোনো প্রভেদ নেই এ ক্ষেত্রে । কেন  এই  অনুষ্ঠানসর্বস্বতা ? রমজান ও ঈদের কথিত ভালো ভালো গুণাবলি ও আদর্শগুলি কেন ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে কেবল অনুষ্ঠানটাগুলোই বড়ো হয়ে উঠছে তার উত্তর অন্বেষণ করা যাক ।  প্রথমতঃ  আর পাঁচটা ধর্মের মতোই ইসলামের রীতি-নীতি, আইন-কানুন, ও  বিধিনিষেধগুলি আধুনিক সমাজে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে । প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ছিলো তা নিয়েও প্রশ্ন ও বিতর্ক থেকে গেছে । বর্তমান সময়ে তো সেগুলি সম্পূর্ণরূপেই অপাঙ্কতেয় ও অচল হয়ে গেছে । মানুষ সুদ নেবে না সুদ দেবে না, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে না, কথায় কথায় বৌ পেটাবে, ইচ্ছে হলেই তালাক দেবে, চারটে স্ত্রী রাখবে, মেয়েরা বোরখা পরবে – এসব বিধিবিধান আধুনিক সভ্য সমাজের পরিপন্থী । সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের  কবলে পড়ে যখন শোষণের ক্ষেত্রগুলি  আরো প্রশস্ত ও অবাধ হয়েছে, এবং শিল্পের উদারনীতির কুপ্রভাবে  দেশের অভ্যন্তরে যখন চুরি-দুর্নীতির বাজার আরো হাট হয়ে খুলে গেছে এবং দুর্নীতি যখন এক ভয়ঙ্কর মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে তখন মুসলমানেরা নরকের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে রমজান মাসে একমাস উপবাস করে সবাই সৎ ও চরিত্রবান হয়ে উঠবে – এ এক অলীক কল্পনা ব্যতীত নয় । উপদেশ দিয়ে বা পরলোকে বেহেস্তের লোভ বা নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করা যায় না । শোষণের বিরুদ্ধে, দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, বৈষম্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে  ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই  কেবল সৎ ও সংবেদনশীল মানুষ তৈরী হতে পারে । ইসলামে সেই কর্মসূচী কোথায় ? কোন ধর্মেই বা আছে ? নেই, কোনো ধর্মেই নেই । তাই সকল ধর্মই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । দ্বিতীয়তঃ  পবিত্র রমাজান মাসে রমজানের কথিত ইতি-কর্তব্য কোথাও কেউ যে পালন করে না , তা নিয়ে উলামা (যারা ইসলামের ধারক ও বাহক) ও তাদের ধর্মীয় সংগঠনগুলির সামান্যতম মাথা-ব্যাথা দেখতে পাওয়া যায় না । বরং আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠাতেই তাদের আগ্রহ সর্বাধিক ।  কতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করছে সে বিষয়েই কেবল তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকেযতো বেশী আড়ম্বর ও আতিশয্যের মধ্যে ঈদ উদযাপিত হয় ততো বেশী তারা আনন্দিত হয়, পুলকিত হয় ও উল্লসিত হয় ঈদ যখন আসে তখন তাদের অন্তর যে ভাবনায় মসগুল হয়ে ওঠে তা  এ রকমঃ   ওদের  (অবিশ্বাসীদের) দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানদেরও বিত্ত আছে, বিত্তের প্রাচুর্য আছে । ইসলামের নামে ও  ইসলামের জন্যে ওদের মতো মুসলমানরাও পারে চোখ ধাঁধানো সাজে নিজ নিজ অঞ্চলকে সাজিয়ে তুলতে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে যে ইসলামের আহ্বানে মুসলমানরাও কাঁধে কাঁধ  মেলাতে পারে, সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, সবদিক দিয়ে সবাইকেই  টেক্কা দিতে পারে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানরাও  তোমাদের চেয়ে কম যায় না । রমজানের কথিত ভালো কাজগুলি নয়, মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঈদের উৎসবে এই দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতাটাই কেবল কাজ করে । এই হীন ও বিদ্বেষের মনোভাবটি কাজ করে অবশ্যই সুপ্তভাবে, যা বাহির থেকে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না । বোঝা যায় না মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা ও গোঁড়া মুসলমানদের সৌজন্যে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে  কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত বয়ে যায় ঈদ তথা খুশীর  উৎসবে     একই স্রোত অবশ্য বয়ে যায় অন্য সকল ধর্মীয় উৎসবেও । তাই রমজান ও ঈদ হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানসর্বস্ব ।  তৃতীয়তঃ ঈদের উৎসবের পশ্চাতে কাজ করে আর একটা ভয়ঙ্কর  মানসিকতা যাতে থাকে কেবলই অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যের মনোভাব ।  তাহলো – ইসলামের  শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব ও মানসিকতা  ইসলামই একমাত্র আল্লাহর ধর্ম এবং সব ধর্মের সেরা ধর্ম ; শুধু সেরাই নয়, একমাত্র সত্য ও সঠিক ধর্ম আর সব ধর্মই ভুল ও মানুষের মনগড়া । মুহাম্মদই ঈস্বরের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ দূত, ও শেষ দূত (নবী) । এ দাবী কোরানের । মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতা  ও বুদ্ধিজীবীরা মনে করে কোরান অভ্রান্ত ।   সারা বছর ধরে চলে এই সদম্ভ প্রচারণা ও চলে স্বাভাবিকভাবেই কোরান-হাদিসের প্ররোচনামূলক বাণী বিতরণ । স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুধু বাণী বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা হতে পারে না । তাই দুই ঈদ, নবীর জন্মদিন, মহরম প্রভৃতি পরবকে ঘিরে চেষ্ঠা চলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার লড়াই । এ এক অশুভ  লড়াই । তার প্রতিফলন দেখা যায় রমজান মাসে বড়ো বড়ো ইফতার পার্টিতে এলাহি ভুরিভোজের অনুষ্ঠানে এবং ঈদের দিন মুসলিম মহল্লা ও শহরগুলিকে চোখ ধাঁধানো সাজে সাজিয়ে তোলার আয়োজনে । স্বভাবতই রমজান ও ঈদের উৎসবে অন্তর্নিহিত ভালো কিছু থাকলেও তা গৌণ হতে হতে এখন একেবারে চলে যাচ্ছে বাতিলের খাতায় । তাই রমজান ও ঈদের পরব হয়ে উঠেছে শুধুই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । তাই ঈদে উৎসবে মুসলমানদের কোনো কল্যাণ হয় না ।  কল্যাণ হয় না সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজেরও । বরং যা হয় তা সমগ্র মানব সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর । ঈদের উৎসব আসে, যায়; কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদটাকে আর একটু বাড়িয়েই দিয়ে যায় ।  তাতে  ক্ষতি হয়   ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সদ্ভাব এবং জাতীয় সংহতির । শুধু ঈদের উৎসবেই হয় তা নয়, এমনটা হয় সকল ধর্মীয় উৎসবেই । মুখে আমরা যতই বলি কোনো ধর্মীয় উৎসবই সবার হয়ে ওঠে না, সার্বজনীন হয়ে ওঠে না ।
 রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর কেন কেবল অনুষ্ঠানসর্বস্ব তার পেছনে সব চেয়ে বড়ো যে কারণটি নিহিত আছে তা লুকিয়ে আছে এর ইতিহাসের মধ্যে । প্রথমত রমজানের উপবাস আল্লাহর দেওয়া কোনো ধর্মীয় বিধান নয় যেমনটা মুহাম্মদ বলে গেছেন ও মুসলমানরা যা বিশ্বাস করে অন্ধভাবে । রমজানের উপবাস ইহুদিদেরই ধর্মীয় উৎসব যা মুহাম্মদ নিজেই পালন করতেন ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সন্তুষ্ট  করতে । কারণ মুহাম্মদ আশাবাদী ছিলেন যে অচিরেই ইহুদিরা তাঁর ধর্মে চলে আসবে । যখন ইহুদিরা স্বধর্ম ত্যাগ না করে মুহাম্মদের  আশায় জল ঢেলে দিলো, তখন তিনি সেই ধর্মীয় আচারের কিছু সংস্কার করে সেটাই আল্লাহর নামে ইসলামে প্রবর্তন করেন । যেমন বলা হয় ‘নতুন বোতলে পুরানো মদ’ - ঠিক সে রকম ।  এ তো হলো রমজানের উপবাসের ইতিহাস । ঈদ-উল-ফিতরের ইতিহাস আরো মজার । সে ইতিহাস তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন তাঁর ইংরাজী ব্লগে  ‘ঈদ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে । নিবন্ধটি লেখা  হয়েছে ২০১২ সালে সেখানে  তিনি একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেছেন যে ইহুদিরা  ধর্মীয় উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে প্রচুর আনন্দভোগ করতো যা মুসলমানরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো এবং মনে মনে ভাবতো এতো সুন্দর আনন্দোৎসব যদি আমাদেরও থাকতো তা দেখেই মুহাম্মদ ভাবলেন তাঁকেও কিছু উপায় উদ্ভাবন করা দরকার যা মুসলমানদের আনন্দ দিতে পারে এবং মনে না করে যে আল্লাহ তাদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে  তিনি তখন  প্রবর্তন করলেন ঈদ-উল-ফিতর এবং  ঈদ-উল-আযহা  ৬২৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম পালন করা শুরু হয়েছিল ঈদ-উল-ফিতর । এই ইতিহাসটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তসলিমার নিবন্ধে । সেই নিবন্ধ থেকে  কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক । তিনি লিখেছেন - Jews lived in Medina. Most probably Muhammad liked the way Jews celebrated their Yom Kippur or Rosh Hashanah. He wanted to create something for his followers so they would not feel that they were deprived of fun and recreation. Anas bin Malik says, ‘When the Prophet arrived in Medina, he found people celebrating two specific days in which they used to entertain themselves with recreation and merriment. He asked them about the nature of these festivities at which they replied that these days were occasions of fun and recreation. At this, the Prophet remarked that the Almighty has fixed two days [of festivity] instead of these for you which are better than these: Eid al-fitr and Eid al-adha.’ (From Tirmidhi Hadith)
Muhammad celebrated the first Eid in 624 with his friends and followers just after the victory at the battle of Ghazwa -e-Badar. Not many people celebrated Eid when Muhammad was alive.(নিম্নরেখা ও বাঁকানো টাইপ এই নিবন্ধকারের)  
এই হলো ঈদ-উল-ফিতরের পশ্চাতে থাকা প্রকৃত ইতিহাস যেখানে আছে কেবল মুসলমানদের জন্যে আনন্দদানের অভিপ্রায় যাতে তাদের মনে না হয় যে তারা আনন্দলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । রমজান ও ঈদ নিয়ে যে সব বড়ো বড়ো আদর্শ ও নীতির কথা বলা হয় তা সবই গল্প ।  তাই গল্পগুলো গল্পই থাকে, বাস্তবায়িত হয় না, বাস্তবায়িত করার গরজও থাকে না ।



KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...