Wednesday, July 30, 2014

ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ


 যে কথাগুলি বলা একান্ত জরুরী, কিন্তু কেউ বলে না, আমরা বলতে চাইআমরা কিছু করতে চাই
একটি আবেদন
বন্ধুগণ,
আমরা কাজ করছি  মুর্শিদাবাদ জেলার  একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে পশ্চাদপদতার শ্রীহীন ছাপ  চোখে পড়ে সর্বত্রমুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা সারা পৃথিবী ও সারা দেশজুড়েই , কিন্তু  মুর্শিদাবাদে পশ্চাদপদতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী প্রকট । এ অঞ্চলে যে হিন্দুরা বাস করেন তাঁদের সিংহভাগই তফশীলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । বলা বাহুল্য, তাঁরাও  পশ্চাদপদ ।  ফলতঃ সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলটি  পশ্চাদপদতম অঞ্চলগুলির একটি 
পশ্চাদপদ অঞ্চলের সমাজ  আষ্ঠেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত থাকে নানা পশ্চাদপদ চিন্তা, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের শিকলে  ফলে জন্ম নেয় নানারকম সামাজিক ব্যাধি যা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রন করে ফলে  উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথ প্রবলভাবে ব্যাহত হয়আমরা যে অঞ্চলে  কাজ করছি   সেখানে এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই,  হয়ও নি ।
এ অঞ্চলে যে সামাজিক ব্যধিগুলি এখানকার জনজীবনকে প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ও তার প্রাণশক্তিকে ক্রমাগত শুঁষে নেয়  সেগুলি হলো বহুবিবাহ,  বাল্যবিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ (তালাক), অনিয়ন্ত্রিত পরিবার, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি  ইত্যাদি ।  এছাড়াও জুয়া, মদ ও মাতলামির মত ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিগুলিও রয়েছে জুয়া ও মদ যে  এক সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধি তা  বলা বাহুল্য । জুয়া ও  মদের কবলে পড়ে কত পরিবার যে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । জুয়া ও মদের কারণে মাঝেমধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়, কখনো কখনো বিশৃঙ্খলা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ।   
ধর্মান্ধতা মানুষের  চিন্তাভাবনাকে  যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও  পশ্চাদমুখী করে   মানুষকে করে তোলে প্রবলভাবে   অদৃষ্টবাদী । অদৃষ্টবাদ  শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা  অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে       এবং  সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই  মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া  দারিদ্রের সঙ্গে এই অজ্ঞতা যুক্ত  হওয়ার ফলে দারিদ্রকেই মানুষ জীবনের ভবিতব্য বলে ভেবে নিয়ে নিজেদের  ভবিষ্যতকে অদৃষ্টের উপর সঁপে  দেয় তাঁদের উপলব্ধির মধ্যে এটা থাকে না যে নিজেদের প্রচেষ্টাতেও  আর্থিক দৈন্যতা অনেকটা লাঘব করা যায়  পরিবার ছোট হলে ও  শিক্ষার্জন করতে পারলে যে দারিদ্রতাকে অনেকাংশে জয় করতে পারে এটা  তাঁদের জ্ঞান ও বোধের মধ্যে নেই
অকাল মৃত্যুর করুণ ছবি  এখানকার সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এ ছবি অবশ্য শুধু এখানকারই নয়, গোটা দেশেরই । অকাল মৃত্যুর বড়ো কারণ নিশ্চয় দারিদ্রতা  সরকারের জনস্বার্থের বিপরীত ভাবনা ও পরিকল্পনাও একটা বড়ো কারণ কিন্তু আরো কারণ  আছে  একটি অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার প্রচন্ড অভাবএখনও  ঝাড়-ফুঁক, মাদুলি-কবজ, ইমাম-পুরোহিত  এবং কালি-পীরের উপর মানুষের আস্থা  এত প্রবলভাবে ক্রীয়াশীল  যা  না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত (অপ)চিকিৎসার এই প্রাচীন পন্থাগুলি  আসলে এক একটা মরণফাঁদ ছাড়া কিছু নয় যা বহুমানুষের অকাল মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে আত্মীয়-স্বজনের অকাল মৃত্যুর  ব্যাথা ও যন্ত্রণা  কত দুঃসহ হতে পারে তা কল্পনাতীত । সেই যন্ত্রণা ও কষ্ট ভুলতে মানুষ অদৃষ্টের কোলে আশ্রয় নেয়এটা বিধিলিপি,  ঈশ্বরের ধন ঈশ্বর তুলে নিয়েছে বলে মৃতের আত্মীয়-স্বজন শান্তি ও সান্ত্বনা খোঁজেন এবং  তারপর অতি দ্রুত মৃতের আত্মার শান্তির জন্যে ধর্মীয় পারলৌকিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েনএসব কাজে মানুষ যে অর্থ অনর্থক ব্যয় বা অপচয় করে থাকেন তা  সঠিক চিকিৎসায় ব্যয় করলে নিশ্চিতভাবেই অকাল মৃত্যু অনেকটাই রোধ করা সম্ভব
দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় সাত দশক, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন বিশেষ হয় নি । দারিদ্রতা কমার চিহ্ন নেই, অপরদিকে সমাজের গুণগত অবস্থার অবনতি ক্রমবর্ধমান । জাতিগত,ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ও  ভাষাগত পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ ও ভালোবাসার জায়গাগুলি ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে । এসব ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গতভাবে ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করছে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, অনৈক্য, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি ।  মুখে আমরা নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের কথা বলছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে  লিঙ্গবৈষম্য । কী ঘরে কী বাইরে নারীর প্রতি অবিচার, বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং  অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েই চলেছে ।
দারিদ্রতা বিমোচনে সরকার কিছুই করছেনা তা নয় । কিন্তু যা করছে তা নগণ্য । একাজে শুধু আর্থিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচী  গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয় । সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক প্রয়োজন মানুষের চিন্তাভাবনার জগতের সকল বন্ধ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেওয়া । সহস্র বছর ধরে মানুষের চিন্তাজগতে  যে অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদ চিন্তা  এবং সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে সেই পাথরটার অপসারণ সব আগে জরুরী  এই কাজটি করাই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বকিন্তু কোনো সরকারই  সেটা করতে চায় না, বরং উল্টে ধর্মাশ্রিত  পশ্চাদপদ চিন্তা ও প্রথাগুলিকেই উৎসাহ দেয় ।  শুধু সরকার নয়, এ কথা প্রযোজ্য শাসকদল ও বিরোধী  রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেও ।  রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদা সর্বক্ষেত্রেই নিজের দলের স্বার্থকে জনগণের  স্বার্থের উপরে প্রাধান্য দেয় এ দেশে অসংখ্য বেসরকারী সমাজসেবী স্বেচ্ছাসেবা  সংগঠন কাজ করে চলেছে , কিন্তু তাদের ভূমিকাও তদ্রূপ ।  
 দারিদ্রতার অবসান  করতে হলে আগে  মানুষের চিন্তার দৈন্যতার অবসান ঘটানো জরুরী অথচ সেই কাজটি  হচ্ছে অবহেলিত । সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলি কেউ এ কাজটি করছে না, আর করবে বলে মনে হয় নাওঁরা যদি না করে, আমরা, অরাজনীতিক মানুষরা, শুধু সরকারের সমালোচনা করে চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমরা আমাদের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারি না বা এড়িয়ে যেতে পারি না । এ বোধের দ্বারা চালিত হয়ে  আমরা পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চাই  কাজ আমরা অতীতেও করেছি ‘মিঠিপুরের স্পন্দন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে । সেই কাজের ধারাবাহিকতায় আমরা এবার নতুন করে গড়ে তুলেছি একটি নতুন মঞ্চ – ‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ’
পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে কেন দাঁড়াতে চাই তা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি সে কাজে সাফল্য পেতে সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার । শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করার কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র । সেই  শিক্ষাই স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে আজো রয়ে গেছে গরীব মানুষের কাছে কার্যতঃ অধরা, কারণ শিক্ষাও একটি পণ্য । সব চেয়ে মহার্ঘ্য পণ্য । ফলে শিক্ষা আজো বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত  শ্রেণীর মানুষদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে । আর অতি দ্রুত লয়ে উচ্চ শিক্ষাও চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে চলে গেছে । 
আমরা তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্যে দরিদ্র পরিবারের পাশে তাদের বন্ধু হয়ে দাঁড়াবো বলে স্থির করেছি শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা অপরিসীম ।  অথচ পরিবার ও সমাজ গঠনে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অধিক জরুরী । আমরা তাই প্রথম পর্যায়ে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথে যে আর্থিক ও মানসিক বাধা রয়েছে তা দূর করতে সর্বাধিক প্রয়াস চালাতে চাই । মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বহু ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি করে দেওয়া হয় । যারা মাধ্যমিক পাশ করে তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনার হার আরো বেশী । তার উপরে এ হার আরো অনেক বেশী । ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম মেয়েদের প্রায় চোখেই পড়ে না । তফশীলি হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও অবস্থাটা হতাশাজনক । আমরা এ অবস্থাটার উন্নতির লক্ষ্যে নারীশিক্ষায় অভিবাবকদের অনীহা ও অর্থাভাবের কারণে  সাধারণ পরিবারের মেয়েদের যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয় তারজন্যে আর্থিক সাহায্যের ক্ষুদ্র ডালি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাই ।
এখানকার সমাজে আর্থিক ক্ষেত্রে দৈন্যাবস্থা এত প্রকট যে সবাই আধুনিক চিকিৎসা নিতে সক্ষম নয় । তার উপরে আছে চিন্তা-ভাবনার জগতেপ্রবল বন্ধ্যা দশা । তাই মানুষকে হয় ঝাড়-ফুঁক-কবিরাজী-পীড়ান-ওঝা, না হয়  হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয় ।  আমরা তাই বছরে তিন-চারটি মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাছে বিনামুল্যে চিকিৎসা পরিষেবা কিছুটা হলেও পৌঁছে দিতে চাই । এ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় সভা করে স্বাস্থ্য চেতনাও গড়ে তুলতে চাই । ইতিমধ্যেই আমরা দুটি মেডিকেল ক্যাম্প করে এ কাজটি শুরু করেছি ।  
আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো – একদিকে, এক). বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠন, দুই). ধর্মনিরিপেক্ষ সমাজ গঠন এবং  তিন). লিঙ্গনিরপেক্ষ সমাজ গঠন । অপরদিকে আমরা চাই, এক). নারীর স্বাধীনতা, দুই). নারীশিক্ষা, তিন). নারীর সমানাধিকার
আমরা যে কাজ করছি তা রূপায়ণে বিস্তর বাধা । ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মতান্ধতার বাধাতো আছেই, তার থেকেও  বড় বাধা অর্থের বাধা ।  এ কাজে অনেক অর্থ প্রয়োজন । যেখানে ও যাঁদের জন্যে কাজ করছি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব । দূরের বন্ধুদেরও সহযোগীতা তাই আমাদের একান্ত প্রয়োজন ।  আশা করি আমাদের নিকট ও দূরের  শুভাকাঙ্খী  বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক ও নৈতিক - সমস্ত প্রকার সহযোগিতা পাবো ।   

[বিঃদ্রঃ  সরকারী রেজিষ্ট্রেশন আইনে আটকে যাওয়ায় আমাদের সংগঠনের নামের পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নাম হয়েছে - 'মিঠিপুরের ভিন্ন স্বর ভিন্ন সমিতি']  







Tuesday, July 29, 2014

ঈদের উৎসবে নেই রমজানের তথাকথিত শুদ্ধাচার,আছে অন্য সুর


 গত কাল ঈদ হয়ে গেছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিশর, সিরিয়া, জর্ডন, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া প্রভ্রিতি দেশগুলিতে । একই সঙ্গে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডীয় মুসলমানরাও গতকাল ঈদ উদযপন করেছে । আর আজ (২৯.০৭.২০১৪) যথারীতি পৃথিবীর বহু দেশের সাথা এদেশের মুসলমানরাও  সাড়ম্বরে ও মহা ধূমধামে উদযাপন  করছে  ঈদ-উল-ফিতর ।  উদযাপন করছে  এই বঙ্গের মুসলমানরাও । ঈদের তথাকথিত অন্তর্নিহিত অর্থ যাই হোক, আমরা বুঝে গেছি ঈদ মানে খুশীঈদ মুসলমানদের  সব চেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব  । কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি – পার্ক সার্কাস, ,মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরীচ, রাজাবাজার, চিৎপুর, খিদিরপুর প্রভৃতি – কী সাজে সেজেছে, কতটা সেজেছে এবং কী বিপুল অর্থের অপব্যয় হয়েছে এই সাজসজ্জায়,  কার সাধ্য তার বর্ণনা দেয়, হিসেব দেয় । এ সব অঞ্চলগুলি ঘুরলে কে বলবে যে এ পোড়ার দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাস্তুহীন, গৃহহীন কোটী কোটী মানুষ  মানবেতর জীবনযাপন করে; লক্ষ লক্ষ শিশু অনাহারে,অপুষ্টিতে, অচিকিৎসায় অকালে ঝরে যায় মায়ের কোল খালি করে;  অন্ধ হয়ে যায় প্রতিদিন শত শত শিশু ভিটামিনের অভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে জীবনের মতো  এবং রক্তাল্পতায় ভুগতে ভুগতে প্রতিদিন শত শত জননী সন্তান প্রসব করতে গিয়ে শেষ শয্যা নেয় ফুটপাতে কিংবা হাসপাতালের বেডে    এ অপরূপ সাজসজ্জা শুধু কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেই নয়, বাংলার মফঃস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই এই ছবি দৃশ্যমান, সবখানেই যে যার সাধ্য মতো সাজিয়েছে নিজ নিজ অঞ্চলকে । হোর্ডিং, ব্যানার, ফ্লেক্স, চেইনফ্লাগ, আলোর বর্ণচ্ছটায় বাংলা জুড়ে সর্বত্রই ঈদের ঘোষণা । চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ, উৎসবের মেজাজ ।  বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঈদ উপলক্ষ্যে এই যে চারিদিকে খুশীর ফোয়ারা, উৎসবের জয়ধ্বনি – এসব  গরীব-গুর্বা মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকেই শুধু যে উৎসারিত হয় তা কিন্তু নয় ।   এর পেছনে আছে অবশ্যই  ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় স্তর থেকে নেওয়া সুনির্দিষ্ট ও সুগভীর পরিকল্পনা । অন্যান্য সব ধর্মীয় উৎসবে, বিশেষ করে হিন্দুদের দূর্গাপূজা, কালিপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন করে হয় ঠিক তেমন করেই ঈদ উদযাপন করতে হবে – এমন পরিকল্পনা বা নির্দেশ উপর থেকেই আসে । না হলে, ঈদ (রমযানের ঈদ) উপলক্ষ্যে কেন বাজিপটকা ফাটিয়ে, আলোর রোশনায় ছড়িয়ে এতো চোখ ধাঁধানো,  মন রাঙানো খুশীর বন্যা বয়ে যাবে রাজধানী শহরের চওড়া রাজপথ থেকে শুরু করে এঁদো গ্রামের সরুগলি রাস্তায়, মহল্লায় মহল্লায় ?
ঈদ-উল-ফিতর আসে রমজান মাস শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন । আর এই রমজান মাসের কঠিনতম উপবাস পর্ব শেষ হয় ঈদ-উল-ফিতরের মাত্র দু রেকাত নামাজের মধ্যে দিয়ে । রমজানের মাসের দুটি দিক আছে বলে শোনা যায় । একটা নাকি কঠোর সংযম তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ, আর একটা     কৃচ্ছসাধন । এর পিছনে নাকি এক বিশেষ ও বিশাল তাৎপর্য রয়েছে । এসব নিয়ে বিশোদ আলোচনা করার অবকাশ নেই এ নিবন্ধে । তবু প্রাসঙ্গিকতা হেতু কিছু কথা বলতেই হয় । সংযম মানে বলা হয় চরিত্র গঠন করা, নিজের মনে ও ভাবনায় যে মানুষের সহজাত যে কুপ্রবৃত্তিগুলি রয়েছে সেগুলিকে কঠোরভাবে  দমন করা, পরাস্ত করা এবং এ ভাবে নিজেকে রমজানের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করা । এসব কথার কী অর্থ তা শোনা যাক ।  মিথ্যে বলা যাবে না, চুরি ও দুর্নীতি করা যাবে না, পরনিন্দা-পরচর্চা করা যাবে না, দুর্বলের উপর অত্যাচার করা যাবে না । লোক ঠকানো যাবে না, লোককে শোষণ করা যাবে না, পরনারীর প্রতি কুনজরে দৃষ্টীপাত করা যাবে নাইসলাম এসব কাজে নিষেধাজ্ঞা করেছে এ কথা শুনে ইসলামের ইতিহাসি ও কোরান-হাদিস সম্পর্কে  যাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে সব মানুষের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে । সে কথা থাক । ইসলাম নাকি বলছে যে রমজান মাসে মুসলমানদের সম্পূর্ণ সৎভাবে এবং সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে জীবিনযাপন করতে হবে । শুধু কি তাই ? ইসলাম না কি বলে যে বছরের পরবর্তী এগারো মাসও সেই সততা ও নিষ্কলুষ মন ও চরিত্র নিয়ে জীবনযাপনের অঙ্গীকারও গ্রহণ করতে হবে রোজার মাসে । ধরে নেওয়া যাক, ইসলাম সত্যি এই শিক্ষাই দেয় । অধিকাংশ মুসলিমই কিন্তু সরল চিত্তে বিশ্বাস করে রমজান মাসের এই বিশেষ গুরুত্বের কথা ।
কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি ? আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলিই বা কী ? কেউ কি দাবী করতে পারেন, যাঁরা রোজা রাখেন, কিংবা প্রবল ইচ্ছা থাকলেও শারীরিক কারণে রোজা রাখেন না, তাঁরা ইসলামের  এই তথাকথিত নির্দেশগুলি পালন করেন ?  কিংবা অন্তত পালন করার চেষ্টা করেন ? না, কেউ করেন না । রমজানের আগুনে পুড়িয়ে নিজের আত্মশুদ্ধি ঘটানোই হলো রোজা রাখার উদ্দেশ্য বলে নিরন্তর  যে প্রচার শুনতে পাওয়া যায় তার ন্যূনতম প্রতিফলন দেখা যায় না মুসলমানদের মধ্যে সমগ্র রমজান মাসে । দেখা যায় বরং উল্টো ছবি । প্রতি পদে উপবাস মুখে সে নির্দেশগুলি নির্বিকার চিত্তে লঙ্ঘন করার হাজারো দৃষ্টান্ত নজরীভূত হয় রমজান মাসে । এই লঙ্ঘন করে মুসলিম সমাজ সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে । আর এই যে সজ্ঞানে রোজামুখে রমজানের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করা হয়,  তারজন্যে কি কোনো মানসিক যন্ত্রণা বা অনুতাপের ছাপ  চোখে পড়ে মুসলমানদের শরীরী ভাষায় ?  মোটেই না ।  তাহলে  ঈদের দিনে বা ঈদের উৎসবে খুশীতে মেতে ওঠার কী  মানে হথাকতে পারে  ?
রমজান মাস না কি কৃচ্ছতা সাধনের মাস । যারা খেতে পায় না, কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন যাপন করে তাদের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করা, তাদের ক্ষুধার ভাগীদার হওয়া নাকি  এ মাসের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য । সারাদিন উপবাস থেকে অনাহারক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মহান তাৎপর্য ও নির্দেশ নিয়ে নাকি রমজান মাস মুসলমানদের দরবারে এসে হাজির হয় । কিন্ত পবিত্র (!) এই রমজানের  ত্রিশ বা ঊনত্রিশ দিনের  প্রাত্যহিক জীবনের ছবিটা আমরা কীরূপ দেখি ?   কৃচ্ছতা সাধনের লেশ মাত্র আমরা দেখি না কোথাও । বরং  ঠিক এর বিপরীতটাই  দেখা যায় সর্বত্র । সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে দৃষ্টীগোচর হয় উপবাস ভাঙার বিশাল আয়োজন । হর কসিমের ফলমূল, উপাদেয় নানা প্রকার তেলের খাবার ও মিষ্টান্ন সহযোগে রোজা ইফতার (উপবাস ভঙ্গ)  করা হয়, আর রাত্রে খাবার মেনুতে থাকে ভুরিভোজের বিপুল ব্যবস্থা । যারা বারোমাস অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকে, ক্ষুধার কামড়ে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না তাদের যন্ত্রণাল্কলিষ্ট মুখের কথা কি একবারও মনে পড়ে   রোজাদার ইমানদার মুসলমানদের ?   রোজা ইফতারের নামে বড়ো বড়ো পার্টি হয়, ইফতার পার্টি যার নাম । সেখানে আমন্ত্রিত হয় রোজা রাখা, না রাখা বিশিষ্ট  মুসলমানরা এমন কি হিন্দু সমাজের  বিশিষ্ট জনেরাও । এই বিশিষ্ট জনেরা সবাই ক্ষমতাবান শ্রেণির থেকে আসা মানুষ – কেউ পলিটিসিয়ান, কেউ শিল্পপতি, কেউ  বড়ো ব্যবসায়ী , কেউ আড়ৎদার, কেউ সুদখোর, কেউ মদখোর, কেউ জোতদার, কেউ প্রমোটার, কেউ খেলোয়ার, কেউ শিল্পী ইত্যাদি ইত্যাদি । কে না আমন্ত্রিত হয় সমাজের বিত্তবান ও  ক্ষমতাবান শ্রেণি থেকে ! শুধু আমন্ত্রিয় হয় না সে মানুষগুলো যারা সারা বছর খেতে পায় না তারা থেকে যায় অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত তবু তারা অনেকেই ছুটে যায় রবাহূত হয়ে । অসম্মানে, অনাদরে ও অবহেলায় তাদের পাতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু খাবার যা বানানো হয় তাদের জন্যেই, কেবল তাদের মতো হতদরিদ্র সর্বহারা শ্রেণির জন্যেই । 
হতদরিদ্র মানুষদের কষ্টগুলি ভাগ করে নেওয়ার, তাদের কষ্টগুলিকে কিছুটা উপলব্ধি করার মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করা যদি অন্যতম একটা প্রধান উদেশ্য নিয়ে যদি রমজানের  আগমন ঘটে তবে সেই রমজানের শেষে উৎসবের প্রশ্ন আসে কী করে ? তবু উৎসব হয়, আনন্দ হয় এবং  মহা ধূমধাম করেই হয় । এ বছর আগের বছরের চেয়ে বেশীই ধূমধাম হচ্ছে, সামনে বছর আরো বেশি হবে । ধর্মের কথিত নীতি ও আদর্শগুলো  গৌণই আছে, গৌণই থাকে, আর ক্রমশঃ  গৌণতর হতে থাকে ।   রমজান মাস ও রমজানের শেষে ঈদ-উল-ফিতর যে নিছকই একটা  ধর্মীয় উৎসব, শুধুই উৎসব, এখানে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই,  তার ছাপ সর্বত্রই দৃশ্যমান ।   ইসলাম সম্পর্কে যতই বড়ো বড়ো দাবি করা হোক না কেন, এসব দেখে এটা স্পষ্টতঃ প্রতিয়মান হয় যে ইসলাম একটা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম বৈ নয়আর পাঁচটা ধর্ম যেমন অনুষ্ঠানসর্বস্ব, ইসলামও তাই । কোনো প্রভেদ নেই এ ক্ষেত্রে । কেন  এই  অনুষ্ঠানসর্বস্বতা ? রমজান ও ঈদের কথিত ভালো ভালো গুণাবলি ও আদর্শগুলি কেন ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে কেবল অনুষ্ঠানটাগুলোই বড়ো হয়ে উঠছে তার উত্তর অন্বেষণ করা যাক ।  প্রথমতঃ  আর পাঁচটা ধর্মের মতোই ইসলামের রীতি-নীতি, আইন-কানুন, ও  বিধিনিষেধগুলি আধুনিক সমাজে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে । প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ছিলো তা নিয়েও প্রশ্ন ও বিতর্ক থেকে গেছে । বর্তমান সময়ে তো সেগুলি সম্পূর্ণরূপেই অপাঙ্কতেয় ও অচল হয়ে গেছে । মানুষ সুদ নেবে না সুদ দেবে না, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে না, কথায় কথায় বৌ পেটাবে, ইচ্ছে হলেই তালাক দেবে, চারটে স্ত্রী রাখবে, মেয়েরা বোরখা পরবে – এসব বিধিবিধান আধুনিক সভ্য সমাজের পরিপন্থী । সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের  কবলে পড়ে যখন শোষণের ক্ষেত্রগুলি  আরো প্রশস্ত ও অবাধ হয়েছে, এবং শিল্পের উদারনীতির কুপ্রভাবে  দেশের অভ্যন্তরে যখন চুরি-দুর্নীতির বাজার আরো হাট হয়ে খুলে গেছে এবং দুর্নীতি যখন এক ভয়ঙ্কর মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে তখন মুসলমানেরা নরকের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে রমজান মাসে একমাস উপবাস করে সবাই সৎ ও চরিত্রবান হয়ে উঠবে – এ এক অলীক কল্পনা ব্যতীত নয় । উপদেশ দিয়ে বা পরলোকে বেহেস্তের লোভ বা নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করা যায় না । শোষণের বিরুদ্ধে, দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, বৈষম্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে  ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই  কেবল সৎ ও সংবেদনশীল মানুষ তৈরী হতে পারে । ইসলামে সেই কর্মসূচী কোথায় ? কোন ধর্মেই বা আছে ? নেই, কোনো ধর্মেই নেই । তাই সকল ধর্মই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । দ্বিতীয়তঃ  পবিত্র রমাজান মাসে রমজানের কথিত ইতি-কর্তব্য কোথাও কেউ যে পালন করে না , তা নিয়ে উলামা (যারা ইসলামের ধারক ও বাহক) ও তাদের ধর্মীয় সংগঠনগুলির সামান্যতম মাথা-ব্যাথা দেখতে পাওয়া যায় না । বরং আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠাতেই তাদের আগ্রহ সর্বাধিক ।  কতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করছে সে বিষয়েই কেবল তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকেযতো বেশী আড়ম্বর ও আতিশয্যের মধ্যে ঈদ উদযাপিত হয় ততো বেশী তারা আনন্দিত হয়, পুলকিত হয় ও উল্লসিত হয় ঈদ যখন আসে তখন তাদের অন্তর যে ভাবনায় মসগুল হয়ে ওঠে তা  এ রকমঃ   ওদের  (অবিশ্বাসীদের) দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানদেরও বিত্ত আছে, বিত্তের প্রাচুর্য আছে । ইসলামের নামে ও  ইসলামের জন্যে ওদের মতো মুসলমানরাও পারে চোখ ধাঁধানো সাজে নিজ নিজ অঞ্চলকে সাজিয়ে তুলতে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে যে ইসলামের আহ্বানে মুসলমানরাও কাঁধে কাঁধ  মেলাতে পারে, সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, সবদিক দিয়ে সবাইকেই  টেক্কা দিতে পারে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানরাও  তোমাদের চেয়ে কম যায় না । রমজানের কথিত ভালো কাজগুলি নয়, মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঈদের উৎসবে এই দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতাটাই কেবল কাজ করে । এই হীন ও বিদ্বেষের মনোভাবটি কাজ করে অবশ্যই সুপ্তভাবে, যা বাহির থেকে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না । বোঝা যায় না মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা ও গোঁড়া মুসলমানদের সৌজন্যে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে  কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত বয়ে যায় ঈদ তথা খুশীর  উৎসবে     একই স্রোত অবশ্য বয়ে যায় অন্য সকল ধর্মীয় উৎসবেও । তাই রমজান ও ঈদ হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানসর্বস্ব ।  তৃতীয়তঃ ঈদের উৎসবের পশ্চাতে কাজ করে আর একটা ভয়ঙ্কর  মানসিকতা যাতে থাকে কেবলই অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যের মনোভাব ।  তাহলো – ইসলামের  শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব ও মানসিকতা  ইসলামই একমাত্র আল্লাহর ধর্ম এবং সব ধর্মের সেরা ধর্ম ; শুধু সেরাই নয়, একমাত্র সত্য ও সঠিক ধর্ম আর সব ধর্মই ভুল ও মানুষের মনগড়া । মুহাম্মদই ঈস্বরের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ দূত, ও শেষ দূত (নবী) । এ দাবী কোরানের । মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতা  ও বুদ্ধিজীবীরা মনে করে কোরান অভ্রান্ত ।   সারা বছর ধরে চলে এই সদম্ভ প্রচারণা ও চলে স্বাভাবিকভাবেই কোরান-হাদিসের প্ররোচনামূলক বাণী বিতরণ । স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুধু বাণী বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা হতে পারে না । তাই দুই ঈদ, নবীর জন্মদিন, মহরম প্রভৃতি পরবকে ঘিরে চেষ্ঠা চলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার লড়াই । এ এক অশুভ  লড়াই । তার প্রতিফলন দেখা যায় রমজান মাসে বড়ো বড়ো ইফতার পার্টিতে এলাহি ভুরিভোজের অনুষ্ঠানে এবং ঈদের দিন মুসলিম মহল্লা ও শহরগুলিকে চোখ ধাঁধানো সাজে সাজিয়ে তোলার আয়োজনে । স্বভাবতই রমজান ও ঈদের উৎসবে অন্তর্নিহিত ভালো কিছু থাকলেও তা গৌণ হতে হতে এখন একেবারে চলে যাচ্ছে বাতিলের খাতায় । তাই রমজান ও ঈদের পরব হয়ে উঠেছে শুধুই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । তাই ঈদে উৎসবে মুসলমানদের কোনো কল্যাণ হয় না ।  কল্যাণ হয় না সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজেরও । বরং যা হয় তা সমগ্র মানব সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর । ঈদের উৎসব আসে, যায়; কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদটাকে আর একটু বাড়িয়েই দিয়ে যায় ।  তাতে  ক্ষতি হয়   ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সদ্ভাব এবং জাতীয় সংহতির । শুধু ঈদের উৎসবেই হয় তা নয়, এমনটা হয় সকল ধর্মীয় উৎসবেই । মুখে আমরা যতই বলি কোনো ধর্মীয় উৎসবই সবার হয়ে ওঠে না, সার্বজনীন হয়ে ওঠে না ।
 রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর কেন কেবল অনুষ্ঠানসর্বস্ব তার পেছনে সব চেয়ে বড়ো যে কারণটি নিহিত আছে তা লুকিয়ে আছে এর ইতিহাসের মধ্যে । প্রথমত রমজানের উপবাস আল্লাহর দেওয়া কোনো ধর্মীয় বিধান নয় যেমনটা মুহাম্মদ বলে গেছেন ও মুসলমানরা যা বিশ্বাস করে অন্ধভাবে । রমজানের উপবাস ইহুদিদেরই ধর্মীয় উৎসব যা মুহাম্মদ নিজেই পালন করতেন ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সন্তুষ্ট  করতে । কারণ মুহাম্মদ আশাবাদী ছিলেন যে অচিরেই ইহুদিরা তাঁর ধর্মে চলে আসবে । যখন ইহুদিরা স্বধর্ম ত্যাগ না করে মুহাম্মদের  আশায় জল ঢেলে দিলো, তখন তিনি সেই ধর্মীয় আচারের কিছু সংস্কার করে সেটাই আল্লাহর নামে ইসলামে প্রবর্তন করেন । যেমন বলা হয় ‘নতুন বোতলে পুরানো মদ’ - ঠিক সে রকম ।  এ তো হলো রমজানের উপবাসের ইতিহাস । ঈদ-উল-ফিতরের ইতিহাস আরো মজার । সে ইতিহাস তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন তাঁর ইংরাজী ব্লগে  ‘ঈদ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে । নিবন্ধটি লেখা  হয়েছে ২০১২ সালে সেখানে  তিনি একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেছেন যে ইহুদিরা  ধর্মীয় উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে প্রচুর আনন্দভোগ করতো যা মুসলমানরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো এবং মনে মনে ভাবতো এতো সুন্দর আনন্দোৎসব যদি আমাদেরও থাকতো তা দেখেই মুহাম্মদ ভাবলেন তাঁকেও কিছু উপায় উদ্ভাবন করা দরকার যা মুসলমানদের আনন্দ দিতে পারে এবং মনে না করে যে আল্লাহ তাদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে  তিনি তখন  প্রবর্তন করলেন ঈদ-উল-ফিতর এবং  ঈদ-উল-আযহা  ৬২৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম পালন করা শুরু হয়েছিল ঈদ-উল-ফিতর । এই ইতিহাসটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তসলিমার নিবন্ধে । সেই নিবন্ধ থেকে  কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক । তিনি লিখেছেন - Jews lived in Medina. Most probably Muhammad liked the way Jews celebrated their Yom Kippur or Rosh Hashanah. He wanted to create something for his followers so they would not feel that they were deprived of fun and recreation. Anas bin Malik says, ‘When the Prophet arrived in Medina, he found people celebrating two specific days in which they used to entertain themselves with recreation and merriment. He asked them about the nature of these festivities at which they replied that these days were occasions of fun and recreation. At this, the Prophet remarked that the Almighty has fixed two days [of festivity] instead of these for you which are better than these: Eid al-fitr and Eid al-adha.’ (From Tirmidhi Hadith)
Muhammad celebrated the first Eid in 624 with his friends and followers just after the victory at the battle of Ghazwa -e-Badar. Not many people celebrated Eid when Muhammad was alive.(নিম্নরেখা ও বাঁকানো টাইপ এই নিবন্ধকারের)  
এই হলো ঈদ-উল-ফিতরের পশ্চাতে থাকা প্রকৃত ইতিহাস যেখানে আছে কেবল মুসলমানদের জন্যে আনন্দদানের অভিপ্রায় যাতে তাদের মনে না হয় যে তারা আনন্দলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । রমজান ও ঈদ নিয়ে যে সব বড়ো বড়ো আদর্শ ও নীতির কথা বলা হয় তা সবই গল্প ।  তাই গল্পগুলো গল্পই থাকে, বাস্তবায়িত হয় না, বাস্তবায়িত করার গরজও থাকে না ।



Friday, July 25, 2014

আধ্যাত্মিক সংগ্রাম নয়, ‘জিহাদ’ হলো ইসলামের সহিংস রাজনৈতিক আগ্রাসন



সন্ত্রাসবাদী চ্যালেঞ্জ

আজকের বিশ্বে অন্যতম একট প্রধান সমস্যা হলো সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবাদ প্রধানতঃ দু রকমের – রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ ও অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদই এ যুগের প্রধান সমস্যা এবং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা ও শান্তির কাছে সব চেয়ে বড়ো বিপদ ও চ্যালেঞ্জ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হলো এর প্রধান হোতা। সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদ ব্যতীতও প্রায় সকল রাষ্ট্রই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে এবং বুর্জোয়াশ্রেণির শোষণ ও মুনাফাকে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে বিরুদ্ধ শক্তিকে, মূলতঃ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুরমুশ করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তাই নিশ্চয় সর্বদাই আমাদের কাছে, যারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা ও শান্তির পক্ষের শক্তি, প্রধান বিপদ। কিন্তু আজকের বিশ্বে অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে যে চেহারায় আমরা প্রত্যহ দেখছি, তার প্রভাব ও ফলাফল প্রত্যক্ষ ও অনুভব করছি, তাতে আমরা কোনো ভাবেই তাকে  অপ্রধান বা ছোটো বিপদ বলে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারি না। অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ বিভক্ত নানা ভাগে, নানা রকম মতাদর্শ তার উৎস। তার মধ্যে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদই প্রধান বিপদ এবং সারা বিশ্ব জুড়ে এই বিপদের জাল বিস্তৃত ও এই সংগঠনগুলি সর্বদা সক্রিয়। হিন্দু সন্ত্রাসবাদ, খৃষ্টীয় সন্ত্রাসবাদ, ইহুদি সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি যত প্রকার ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ এখন ভয়ঙ্কর রকমের হিংসাত্মক কার্যকলাপে মত্ত তাদের শীর্ষে রয়েছে ইসলামি সন্ত্রাসবাদঅন্যান্য ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও শক্তিগুলিও নিশ্চয় মানব সমাজের পক্ষে বিপদের কারণ, কিন্তু সামগ্রিকতার বিচারে মারাত্মক বিপদ  হিসেবে তাদের কোনোভাবেই ইসলামি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে তুলনা করা যায় না। অন্যান্য ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি বিশ্বের এক একটি দেশে বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ এবং নিশ্চয় সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের কাছে তারা বড়ো বিপদ (যেমন ভারতে হিন্দু সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি), কিন্তু ইসলামী সন্ত্রাসবাদ ও তার অসংখ্য সংগঠন সারা বিশ্বজুড়ে প্রসারিত ও সক্রিয় এবং  আঘাত ও ক্ষতি  করার ক্ষেত্রে তারা প্রচন্ড শক্তিশালীতারা এত বিপুল শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও আঘাত ও চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে এবং একই সঙ্গে সারা বিশ্বকেও চ্যালেঞ্জ করছে। সেজন্যে একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের হোতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেমন আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, অপরদিকে তেমননি অরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে সমস্ত ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, বিশেষ করে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও আমাদের  প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ  গড়ে তোলা আবশ্যক
 
 
 

জিহাদ নিয়ে প্রবল বিতর্ক ও বিভ্রান্তি



বিশ্বজুড়ে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলির হিংসাত্মক কার্যকলাপ ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছেমুসলিম জঙ্গিরা যেমন নির্মমভাবে ব্যাপকহারে মানুষ হত্যা করছে তেমনি তারা আবার নিজেরাও দলে দলে নিহত হচ্ছে। এই নিষ্ঠুর হত্যালীলায় তাদের কোনো দুঃখ বা অনুতাপ নেই, বরং এর জন্যে তারা আনন্দ ও গর্বই বোধ করেওরা যেন মেরেও আনন্দ পায়, মরেও সেটা এজন্যে যে তারা বিশ্বাস করে বিধর্মীদের হত্যা করলে বা বিধর্মীদের হাতে নিহত হলে বেহেস্ত (স্বর্গ) লাভ করবে যেখানে অনন্তকাল স্বর্গীয়সুখ ভোগ করতে পারবে। কারণ,তারা বিশ্বাস করে যে, যে হত্যালীলা ও ধ্বংসলীলা তারা চালাচ্ছে সেটা একটা পবিত্র জিহাদ যা তারা করছে  বিশ্বের বুকে আল্লাহর শাসন তথা শরিয়তি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে  স্বর্গলাভ করার লোভে প্রলুব্ধ হয়ে তারা উত্তরোত্তর  হিংস্র  হয়ে উঠছে। শরিয়তি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা প্রধান বাধা মনে করছে আধুনিক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। তাই তারা এই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে মরিয়া। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিভিন্ন  দেশে দেশে  কত যে জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে ও ক্রমাগত গড়ে উঠছে তার ইয়ত্তা নেই। এই জঙ্গি সংগঠনগুলিতে দলে দলে তরতাজা ছেলেরা নামও লেখাচ্ছে। তারপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। তাই জিহাদি কর্মকান্ডকে হাল্কাভাবে নেওয়ার বিলাসিতা দেখানোর অবকাশ একেবারেই নেই আমাদের সামনে। জিহাদি কর্মকান্ড প্রকৃত অর্থেই আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সামনে এখন এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জিহাদ নিয়ে প্রবল মতভেদ রয়েছে মুসলিম সমাজে। মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশের দাবী হলো জঙ্গিরা জিহাদের নামে যা করছে তা ইসলাম অনুমোদন করে নাকারণ, ইসলাম হিংসায় বিশ্বাস  করে না এবং ইসলাম  শান্তি, দয়া ও ক্ষমার ধর্ম। মতভেদ রয়েছে বিশ্বব্যাপী অমুসলিম সমাজে অমুসলিমদেরও বৃহত্তর অংশ মনে করে যে, জিহাদের নামে যে হত্যালীলা চলছে  তা কোরান ইসলাম অনুমোদন করে নাইসলামের  শ্রেষ্ঠতম তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ পন্ডিত ইমাম গাজ্জালি যাঁর লক্ষ হাদিস মুখস্ত ছিলো তিনি  কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জিহাদকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন
 "প্রত্যেক মুসলিমকে বছরে অন্ততঃ একবার অবশ্যই জিহাদে যেতেই হবে ... দুর্গের ভিতর যদি নারী শিশুরা থাকে, তবুও তাদের  বিরুদ্ধে ভারী পাথর বা তীর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে" (দ্রঃ জিহাদ, এম..খান, পৃ )   
ইমাম গাজ্জালীকে মুহাম্মদের পর মুসলমানদের সর্বোচ্চ পন্ডিত সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক নেতা মেনেও উলামার (মুসলিমদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ) একাংশ  এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজ ইমাম গাজ্জালীর বক্তব্যকে সমর্থন করেন না তাঁরা মানতে রাজী নয় যে, জিহাদ মানে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র  যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মান্তর করে ইসলামের প্রসার বিস্তার ঘটানো তাঁদের দাবী হলো ইসলাম প্রতিষ্ঠিত প্রসারিত হয়েছে শান্তিও সাম্যের বাণী প্রচার করে, বলপ্রয়োগ করে নয়   প্রসঙ্গে .জাকির হোসেনের অভিমত শোনা যেতে পারে  যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন ইসলামি পন্ডিত ব্যক্তি ইসলাম সারা বিশ্বে শান্তির মাধ্যমেই প্রসারলাভ করেছে - এর সপক্ষে বলতে গিয়ে  তিনি যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন তা হলো এই যে,
 মুসলমান শাসকরা ভারত শাসন করেছেন  সাড়ে পাঁচশবছর তাঁরা ইচ্ছা করলেই সমস্ত অমুসলিমদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করতে পারতেন, সে ক্ষমতা তাঁদের ছিল কিন্তু তা তাঁরা করেন নি বলেই আজ ভারতে ৮০ ভাগেরও বেশি  অমুসলিম এটাই প্রমাণ করছে যে ইসলাম তরবারির দ্বারা বিস্তৃত হয় নি 
 ইসলাম শান্তি, সাম্য ন্যায়বিচারের ধর্ম - এই মতের প্রবক্তারা বলেন যে  ইসলাম অবশ্যই জিহাদের কথা বলেছে, সে জিহাদ হলো মানুষের মধ্যে যে অশুভ রিপুগুলি আছে সেগুলির বিরুদ্ধে জিহাদ, যাতে মুসলমানরা তাদের সৎ, উদার দয়াশীল আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে জিহাদকে তাঁরা একটা আধ্যাত্মিক শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম বলে মনে করেন যার সংগে সহিংসতা বলপ্রয়োগের লেশমাত্র সম্পর্ক নেই জিহাদ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের একজন খ্যাতনামা ইসলামি পন্ডিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রাক্তন অধ্যাপক .ওসমান গণি লিখেছেন,- 
 "যখন যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে,  ইসলাম সেখানে ওই ঘৃণিত কাজটিকে কেবল দোষারোপ করেই হাত গুটিয়ে নেয় নি বরং তাকে রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, পরিশেষে পরিবর্তন এনেছে ইসলামের এই প্রক্রিয়াটার নামই তো জিহাদ যা অন্যায়, অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এই সংগ্রাম হবে আপোষহীন আমরণ ইসলামের মানবাধিকারের মূলকথা – ‘ আমর বিল মারুফএবং  'নাহি আনিল মুনকারঅর্থাৎ ভালো কাজের জন্য আদেশ এবং মন্দ কাজের ন্য নিষেধ (দ্রঃ ইসলামে চিন্তা চেতনার ক্রমবিকাশ,  পৃ ১১৭)   
জিহাদ  প্রসঙ্গে ইরাকি ইসলামি পন্ডিত সেখ মুহাম্মাদ আলী কী বলেছেন তা শোনা যাক ব্রাসেলসে ২০০৮  সালে  একটি সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নিজ আত্মার ভিতরের  সকল অশুভ প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই হলো জিহাদঃ ইসলামে কোনো জিহাদি সন্ত্রাসবাদ নেই’ (সূত্রঃ জিহাদ, এম..খান, পৃ , ) জিহাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজনের অভিমতের প্রতি চোখ বুলানো যাক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জায়েদ ইয়াসিন, হাভার্ড ইসলামিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রদান অনুষ্ঠানেমাই আমেরিকান জিহাদশিরোনামে একটি বক্তৃতায় বলেন,  -
 জিহাদের সত্য বিশুদ্ধ রূপ, যা সকল মুসলিম কামনা করে, তা হল নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলেও যা সঠিক, যা ন্যায়সঙ্গত, তা- করা নিজস্ব নৈতিক আচরণের জন্য এটা একটা ব্যক্তিগত সংগ্রাম 
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ ইসেক মনে করেন, জিহাদের অর্থ বর্ণবাদ প্রতিরোধ নারীর অধিকারের পক্ষে কাজ করা(সূত্রঃ ) বিশ্বের অমুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের অভিমতও একই রকম ইসলাম ধর্মে জিহাদ মানে জঙ্গি কার্যকলাপ নয়, জিহাদ মানে নিজের নৈতিক, চারিত্রিক মানসিক উৎকর্ষতার  ক্রমাগত উন্নতি করার প্রয়াস করা ওয়েলেসলি কলেজের অধ্যাপক রোক্সেন ইউবেন মনে করেন ইসলামি জিহাদের মানে হলো – ‘আবেগ প্রতিহত করা  একজন শ্রেয়তর মানুষ হওয়া জর্জিয়া-সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পার্সেল জিহাদকে বোঝেননিজের ইচ্ছা প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রাম রূপে আর্মস্ট্রং আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নেড রিনাল্ডুক্সির কাছে  জিহাদের লক্ষ্য হলো
 ভিতরে  ভালো মুসলিম হওয়া এবং বাইরে একটি ন্যায় সমাজ সৃষ্টি করা।'
উলামার একাংশ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই মতকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন মুসলিম সমাজের সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কী শাসক দলের নেতৃবৃন্দ, কী বিরোধী দলের - সবাই। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী সেখ হাসিনা, সাবেক প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া, পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, সাবেক রাষ্ট্রপতি মোশারাফ হোসেন প্রমুখ সমস্ত শীর্ষস্থানীয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ওই একই সুরে  নিরন্তর দাবী করে থাকেন যে, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম এবং ইসলামে হিংসার স্থান নেই, যারা হিংসাত্মক কাজ করছে তারা ইসলামবিরোধী কাজ করছে ও ইসলামের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছে। শুধু পাকিস্তান ও বাংলাদেশই নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশের শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গলাতেও এই একই সুর আমরা শুনতে পাই। একই সুর অহরহ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে অমুসলিম সমাজের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কন্ঠেওঅধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেই আমরা বারবার এ দাবী করতে শুনি যে মুসলিমদের জঙ্গি ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই; যারা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে তারা ইসলামি নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত  ও বিপথগামী। এই সব রাষ্ট্রপ্রধানরা যখনই সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কোনো কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তখনই (কৈফিয়তের ঢঙে) বারবার এই কথাগুলি উচ্চারণ করেন; বারবার বলতে থাকেন ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম দয়া ও ক্ষমার ধর্ম, ইসলাম সাম্যের ধর্ম এবং ইসলাম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। আমেরিকার বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানগণ যেমন ওবামা, জর্জ বুশ, বিল ক্লিন্টন,ও  হিলারি ক্লিন্টন  থেকে শুরু করে ইংলন্ডের  প্রাক্তন ও বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান টনি ব্লেয়ার ও ক্যামেরুন সবার কন্ঠেই ওই একই সুরের প্রতিধ্বনি  শোনা যায়তাঁরা কিন্তু সকলেই মুসলিম জিহাদি কার্যকলাপ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন। তাঁরা মনে করেন যে এই মূহূর্তে সারা বিশ্বে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শান্তির সামনে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও শক্তিগুলি অন্যতম প্রধান বিপদ তাই তাঁরা একযোগে বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে মোকাবিলা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু একই সাথে বারবার তাঁরা এ কথাও উচ্চারণ করছেন যে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদী শক্তি ও তাদের কার্যকলাপ এবং ইসলাম  এক নয়, ইসলামি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে ইসলামের কোনো যোগ নেই। ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে একবার নিন্দায় সরব হলে দশবার ইসলামের প্রশংসায় মুখর হন তাঁরা। ইসলাম ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে  ইংলন্ডের সাবেক প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়ার খুব সম্প্রতি কী বলেছেন তা শোনা যাক। তিনি ইসলামি মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো হুমকি বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, Islamism to be a major threat everywhere in  the world, including increasingly within Western nations. The “challenge” of Islamism is “growing” and “spreading across the world” and it is “the biggest threat to global security of the early 21st Century.” এই হুমকি ও বিপদকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করার জন্যে তিনি সকল পাশ্চাত্য জাতি ও দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন মিশরের রাষ্ট্রপতি আল ফাত্তাহ সিসি থেকে শুরু করে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন পর্যন্ত যাঁরাই ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছেন তাদের সকলের পাশে জোরালোভাবে দাঁড়ানো আবশ্যকএ প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন তা হলো - the West should vigorously support just about anybody whose interests lie in opposing Islamists, from General Sisi in Egypt to President Putin in  Russia.”  টনি ব্লেয়ার কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এটাও জানিয়েছেন যে ইসলাম ও ইসলামিত্ববাদ (ইসলামি মৌলবাদ) এক নয়। তিনি বলেছেন, Islamism is not “the proper teaching of Islam”. ব্লেয়ার মনে করেন ইসলামি মৌলবাদ একটি  মিথ্যা ও বিকৃত তত্ত্ব । তিনি যা বলেছেন,     “but it is a false one, a “perversion” of the religion, which “distorts and warps  Islam’s true message.”  

ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রধানতঃ তিনটি ধারায় বিভক্ত প্রথম দুটি সুন্নী  শিয়া, এবং তৃতীয়টি  আহমদীয়া মুসলিম জামাত প্রথম দুটি আবার আরো বহুধা বিভক্ত  কিন্তু তৃতীয় ধারাটি তথা আহমদীয়া জামাত এখন পর্যন্ত অবিভক্ত রয়েছে এই অখন্ড জামাত পরিচালিত হয় একটি কেন্দ্র থেকে একজন নেতার নির্দেশেই তাদের নেতাকে খলিফা বলা হয় এই জামাত মনে করে ইসলামে হিংসার স্থান নেই এবং  বিশ্বের বুকে ইসলামের আগমন হয়েছিল ন্যায়, সাম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এই জামাতের  বক্তব্য হলো -  ইসলাম যে শান্তির বাণী পথের সন্ধান দিয়েছে সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মুসলমানরা আজ পরষ্পরের সঙ্গে হানাহানি করছে, একমাত্র আহমদীয়া  জামাতই ইসলামের পথ অনুসরণ করে বিশ্বের বুকে শান্তি স্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে জামাতের বর্তমান পঞ্চম খলিফা হযরত মির্যা মাসরূর আহমদ (আইঃ) ২০১২ সালের ২৭শে জুন ওয়াসিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিল তথা কংগ্রেস ভবনে  একটি বিশেষ সভায়বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায়শীর্ষক আলোচ্য বিষয়ে বলেন,  
 সকল জাতি সকল বর্ণের মানুষ সমানএটাই ইসলামের সুস্পষ্ট শিক্ষা আর কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সকল মানুষকে বৈষম্য পক্ষপাতমুক্তভাবে সম-অধিকার প্রদান করা উচিত  এটাই হলো বিভিন্ন দল জাতির মাঝে শান্তি সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূল পন্থা অপরিহার্য  শর্ত 


 ইসলাম শান্তি, মানবতা ও গণতন্ত্রের ধর্ম - হাস্যকর দাবি 

জিহাদি সংগঠন, জিহাদি মুসলমান জিহাদি আক্রমণের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি লাভ করছেঅপরদিকে হিংসা, হত্যা ধ্বংসলীলা ইসলামবিরোধী প্রচারও সমানে চলছে দুটই সমান তালে চলছে দ্বিতীয় পক্ষে যাঁরা আছেন তাঁরা অধিকাংশই তাঁদের দাবীর পক্ষে তেমন কোনো যুক্তি, তথ্য বা প্রমাণ  উপস্থাপিত করেন না এঁরা যুক্তি, তথ্য বা প্রমাণ ছাড়াই নিজেদের দাবীর পক্ষে জোরালো প্রচার করে থাকেন যা কখনই করা উচিত নয়  কেউ কেউ কখনো এমন কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেন যা খুবই দুর্বল  নির্ভরযোগ্য সে রকম একটি যুক্তি হলো মুসলমানদের অধিকাংশই সরল, সাদা-সিধে ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলাম জিহাদি ধর্ম হলে এটা সম্ভব হতো না ব্লেয়ার যেমন বলেছেন,    
“Many of those totally opposed to the Islamist ideology are absolutely devout Muslims.” 
বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান জিহাদি তত্ত্বের বিরোধিতা করছে, অতএব ইসলাম শান্তির ধর্ম জিহাদের বিরুদ্ধে  - এটা নির্ভরযোগ্য গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি বলে গ্রাহ্য হতে পারে না তবে উদারপন্থী উলামা মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রচারে তাঁদের দাবির সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ একেবারে থাকে না  তা বলা যাবে না। কিন্তু যা থাকে তা সংখ্যার নিরিখে মুজাহাদিদের (যারা জিহাদ করে) উপস্থাপিত যুক্তি, তথ্য প্রমাণের তুলনায় একেবারেই নগণ্য শুধু তাই নয়, উলামা বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দাবির সপক্ষে যুক্তি, তথ্য প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে নীতি সততা বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না কোরানের যে আয়াতগুলি তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন সেগুলিকে যথাযথরূপে পেশ করেন না  দেখা যায় যে হয় তাঁরা কোনো আয়াতকে আংশিক উদ্ধৃত করেছেন যার ফলে আয়াতটির অর্থই পাল্টে গেছে, নয়তো বিকৃত করেছেন , নয়তো  ইচ্ছেমতো ভুল বা বিকৃত অনুবাদ  করেছেন তাছাড়া বেশ কিছু আয়াত তাঁরা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত করেন যে আয়াতগুলি মুহাম্মাদ মদিনায় গিয়ে  পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁরা কীভাবে কপটতা, ছলচাতুরী মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয় তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক
নাইজিরিয়ার বোকো হারাম এখন সারা বিশ্বে সংবাদের শিরোনামে এই জিহাদি সংগঠনটি গত ১৭ই এপ্রিল ২৭৭ জন ছাত্রী অপহরণ করে তারপর সরকারকে বলে যে তাদের সংগঠনের ধৃত নেতাদের মুক্তি না দিলে ওরা মেয়েদের বাজারে বিক্রি করে দেবে বলা বাহুল্য যে সংগঠনটি নাইজিরিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের জন্যে জিহাদ করছে বোকো হারাম যা করছে তা ইসলাম সমর্থন করে না - এরূপ  প্রচার এখন চারিদিকে কান পাতলেই শোনা যাবে সম্প্রতি (২৯//১৪) মিযান (সাপ্তাহিক, মুসলিম সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে বলে পত্রিকাটির দাবি) পত্রিকায় জনৈক ইকবাল হোসেন লিখেছেন সে রকম একটি নিবন্ধ সেখানে  তিনি কোরানের একটি  আয়াত উদ্ধৃতি করে দেখিয়েছেন ইসলাম হত্যার বিরুদ্ধে কত সরব/৩২ নং আয়াত থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, নিরপরাধ কোন মানুষকে হত্যা করা সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমান’ উদ্ধৃত অংশটি উক্ত আয়াতের একটি বাক্যাংশের সম্পূর্ণ অংশও নয় লেখক বাক্যাংশটি ইচ্ছাকৃতভাবেই  সম্পূর্ণ  করেন নি লোককে বিভ্রান্ত করার জন্যে সম্পূর্ণ বাক্যাংশটি হলো – ‘জন্য আমি ইস্রাইল বংশীয়দের প্রতি নির্দেশ দিলাম যে, যদি একজন অন্যজনকে হত্যা করে, অথবা পৃথিবীতে অশান্তি উৎপাদন করে, তবে সে যেন সমস্ত লোককে হত্যা করলো।’  অর্থাৎ আয়াতটি মুসলমানদের জন্যে নয়, অতীতে কোনো এক সময়ে ইহুদিদের জন্যে এই নির্দেশ ছিলো। কোরান এই পাঁচ নম্বর সুরা ‘মায়দাতে’ই বেশ কয়েকটি আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছে অমুসলিমদের হত্যা করার  কথা, যেটা তিনি চেপে গেছেন সচেতনভাবে। কোন কোন আয়াতে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা পরে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। ইকবাল ১০/৪৭ নং আয়াতের কিছু অংশ তুলে দেখিয়েছেন ইসলাম সর্বদা মানুষকে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ প্রদান করেছে। তিনি যে অংশটি উদ্ধৃত করেছেন -  
 ‘ইসলাম তার বিশ্বাসীদের নির্দেশ দেয় সবসময় সুবিচার কর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়, কথা বলা কাজ করার সময়  
লেখক যে কথাটা গোপন করেছেন তা হলো এই আয়াতটি মক্কা পর্বের যখন মুহাম্মদ সবদিক থেকেই ছিলেন হীনবল। তিনি আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলেন মদিনায় আসার পর। মক্কা পর্বে যে সব কথা তিনি বলেছিলেন তা তিনি মদিনায় আসার পর নির্মমভাবে বর্জন করেছিলেন। তাঁর মক্কায় বলা কথাগুলো(আয়াতগুলো) ইসলামের কথা বলে চালানো ভয়ঙ্কর এক মিথ্যাচার ও প্রতারণা। নিবন্ধে লেখক ৪১/৩৪ নং আয়াত উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন কীভাবে ইসলাম ভালোকাজকে উৎসাহিত করেছে। তিনি উদ্ধৃত করেছেন - 
ইসলাম শিক্ষা দেয় মন্দ কাজের জবাব ভালো কাজের দ্বারা দিতে হবে   
এই আয়াতটিও মুহাম্মদের মক্কা পর্বের। ক্রোধ প্রসঙ্গে ইসলাম কত উচ্চমানের শিক্ষা দেয় তা  দেখাতে গিয়ে লেখক  ৫/২ নং আয়াতকে কিছুটা উদ্ধৃত করেছেন। সেটা হলো –    
‘অন্যায়কারীর  বিরুদ্ধে কোন মুসলিমের ক্রোধ এতদূর যেন না গড়ায় যে সে তার পাল্টা জবাবে আর একটা অন্যায় করে বসে 
 আপাতদৃষ্টিতে দেখলে এটা মনে হবে যে ক্রোধ সম্পর্কে ইসলাম  এটা একটা সাধারণ নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছে সমস্ত মুসলিম বা মানুষের জন্যে। কিন্তু মোটেই তা নয়। প্রথমতঃ একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে এই আয়াতটির পশ্চাতে। দ্বিতীয়তঃ লেখক যে অংশটি  অনুবাদটি করেছেন তা সঠিক অনুবাদ নয়। সঠিক অনুবাদটি এ রকমঃ  
 ‘যারা তোমাকে পবিত্র মসজিদে যেতে বাধা দিয়েছে সেই সম্প্রদায়ের দুশমনি যেন তোমাদেরকে সীমা ছাড়িয়ে যেতে উৎসাহিত করে (দ্রঃ – তফসির, ইবনে কাথির, ৪র্থ-৭ম খন্ড, পৃ- ৬৮৩) 
ইবনে কাথির এই নির্দেশটি কোন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছিলো সে প্রসঙ্গটি তাঁর তফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে – 
আয়াতটি হাতিম ইবনে হিন্দ আল বকরীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় একদা সে মদিনার একটি চারণভূমি লুন্ঠন করে এবং পরবর্তী বছর সে বায়তুল্লাহ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সময় কোন কোন সাহাবী পথিমধ্যে  তাকে বাধা দেয়ার মনস্থ করলে আল্লাহ পাক আয়াত নাযিল করেন  (ঐ, পৃ–৬৯১)  
এই তফসির থেকে এটা স্পষ্ট যে এটা কোনো সাধারণ নির্দেশ বা নীতি নয় যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধাচারণ সত্ত্বেও যেন মুসলিমরা তাদের সংযম রক্ষা করে অথচ লেখক এটাকে ইসলামের একটি অন্যতম প্রধান নীতি বলে তুলে ধরলেন। এটা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, মুসলমানদের কাছে (বিশ্ববাসীর কাছে), এক ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার ও প্রতারণা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মুহাম্মদ মক্কার দখল নেওয়ার পর পরই সমস্ত বিধর্মীদের মক্কায় হজ্ব করতে যাওয়া তথা কাবাগৃহে তীর্থ করতে যাওয়া নিষদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এ নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত আদেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ৯/২৮ নং আয়াতে। এই আয়াতে বলা হয়েছে, - ‘অংশিবাদীরা অপবিত্র। অতএব এই বছরের পরে তারা আর পবিত্র মসজিদের (কাবা) নিকটবর্তী হতে পারবে না।’ 
 ইকবাল আর একটি আয়াতকে  উদ্ধৃত করে দেখাতে চেয়েছেন যে ইসলাম ভালো কাজের জন্যে আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজে বাধা দান করে। ৩/১০৪ নং আয়াত থেকে করা তাঁর উদ্ধৃতি হলো -  
ইসলাম নির্দেশ দেয় ভালো কাজের ক্ষেত্রে আদেশ দানের এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার।  
এই আয়াতটি বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে নিশ্চয় খুব ভালো ও সকলের জন্যে অনুসরণযোগ্য বলে প্রতিভাত হয় এবং মনে হয় সত্যিই ইসলাম ধর্ম কতো মহান ধর্ম। কিন্তু এভাবে কিছু কিছু আয়াতকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যে চাতুর্যতা, ধূর্ততা ও কপটতা থাকেএর সঙ্গে প্রসঙ্গিক অন্যান্য আয়াতগুলি এক সঙ্গে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে এই চালাকি ও প্রতারণাগুলি স্পষ্ট বোঝা যায়। ভালো বা সৎ কাজ এবং মন্দ বা অসৎ কাজ এই কথাগুলি ভীষণ আপেক্ষিক। রামের কাছে যে কাজটা ভালো রহিমের কাছে সে কাজটি মন্দ। সুতরাং জানতে হবে ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বা সৎ কাজ এবং তার উল্টো কাজের সংজ্ঞা কী, কিংবা কোন কোন  কাজটা ইসলামের চোখে ভালো বা সৎ কাজ এবং কোন কোনটা তার বিপরীত। ৩ নং সুরার ১১৮ নং আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ মুসলমানদের তারা যেন কিছুতেই মুসলমান ব্যতীত অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব না করে। কোরানের ভাষ্যটি এরূপঃ 
‘হে বিশ্বাসীগণ! আপনার লোক ব্যতীত অন্যকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করিবে না।’(অনুবাদ গিরিশ সেন) 
‘অন্যকে’ বলতে কাদেরকে বোঝানো হয়েছে তফসিরকাররা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।  গিরিশ সেন লিখেছেন,  
‘ধর্মদ্রোহী লোকের সঙ্গে বিশ্বাসীদের বন্ধুত্ব করা উচিত নহে, তাহারা সর্বদা শত্রু।' কারা ধর্মদ্রোহী? 
ইবনে কাথিরের তফসিরে সে ধোঁয়াশাও নেই। তিনি লিখেছেন,  
‘এখানে আল্লহ তা’আলা মুমিনদেরকে কাফির ও মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন।’  (দ্রঃ ইবনে কাথিরের তফসির, ৪র্থ–৭ম খন্ড, পৃ - ১৫২) 
 সৎকাজ ও অসৎ কাজ প্রসঙ্গে ঐ সুরার ১১৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলছে, 
‘তারা আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজে নিষেধ করে, এবং সৎ কাজে প্রতিযোগিতা করে, তারাই সৎশীলদের অন্তর্গত।’ (অনুবাদ – ড.ওসমান গণি) 
 আগের আয়াতটিতে স্পষ্ট ঘোষণা হলো যে বিধর্মীদের সাথে বন্ধত্ব স্থাপন করা অসৎ বা মন্দ কাজ  কারণ তারা আল্লাহ ও মুসলমান শত্রু। পরের আয়াতটিতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে সৎশীলদের অন্তর্গত হতে হলে অবশ্যই আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
উপরের নিবন্ধে যে কথাগুলি লেখা হয়েছে তা একটি বিশেষ জিহাদি সংগঠনের একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং ইসলামের স্বরূপ উন্মোচিত করে দিয়েছে।
কিন্তু এরূপ বিশেষ বিশেষ নিবন্ধের বাইরেও সাধারণভাবে নানা লেখা ও আলোচনায় উদারপন্থী উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ ধারাবাহিকভাবে কোরান ও হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁদের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণ করার নিরন্তর চেষ্টা করে থাকেন যে ইসলাম একটি শান্তিবাদী ধর্মএসব লেখা বা আলোচনায় প্রধানতঃ তিন-চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী সমাদৃত দুটি নীতি হলো গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি এখন মানবাধিকারের দাবিটিও ক্রমশঃ জোরদার হচ্ছে। তাই তাঁরা যে কোনোভাবে প্রমাণ করতে চান যে ইসলাম ধর্ম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে এবং ইসলাম ন্যায় ও মানবাধিকারকে সমর্থন করে।প্রসঙ্গতঃ একটা কথা এখানে বলে রাখা অত্যন্ত আবশ্যক, তা হলো এই  যে, তাঁদের কিন্তু কস্মিনকালেও সৌদি আরব, ইরান, জর্ডন, কাতার, ইয়েমেন, আলজিরিয়া প্রভৃতি ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যযুগীয় ইসলামিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করতে শোনা যায় না। সেই তাঁরা শুধু  ইসলাম গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে বলেই ক্ষান্ত হন না বা তৃপ্ত হন না, তাঁরা সগর্বে দাবি করেন যে মানুষের তৈরী করা গণতন্ত্র,  ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের  বিধান অপেক্ষা আল্লাহর তৈরী করা ইসলামি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের বিধানগুলি অনেক বেশি উন্নত ও বিকশিত। তাঁদের দাবি - এটাই তো স্বাভাবিক, কারণ মানবীয় জ্ঞান ও মেধা কখনোই ত্রুটিমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়  এবং তা সর্বদা সীমাবদ্ধ। তাই মানুষের তৈরী করা আইনে থাকে নানা রকম ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু স্বয়ং জ্ঞান, মেধা প্রতিভার স্রষ্টা, তাই তার তৈরী আইন হয় একেবারে নির্ভুল ও নিঁখুত; তাতে কোনো পক্ষের প্রতি যেমন পক্ষপাতিত্ব থাকেনা, তেমনই থাকেনা কোনো ত্রুটি, ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা; সে জন্যেই মানুষের তৈরী করা সংবিধান বারবার সংস্কার করতে হয়, বদলাতে হয় বা বাতিল করতে হয়, কিন্তু আল্লাহর আইনে তার দরকার পড়ে না, আল্লাহর আইন চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। এ  সব দাবি যে ভীষণ  হাস্যকর ও শিশুসুলভ তা বলা বাহুল্যসে কথা থাক, এখন দেখা যাক  কিসের ভিত্তিতে  তাঁরা  এ সব  বাগাড়ম্বরপূর্ন অযৌক্তিক   দাবীগুলি নিরন্তর করে থাকেন।ইসলাম গণতন্ত্রকে সমুন্নত করেছে - দাবির পক্ষে তাঁরা কোরানের সুরা বাকারা অর্থাৎ  নং সুরার ২৫৬ নং আয়াতটির অংশ বিশেষ প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে থাকেন সেই অংশটি রকমঃ 
‘ধর্ম সম্বন্ধে বল প্রয়োগ নেই, বল ভ্রান্তপথ সত্যপথ হতে সুস্পষ্ট হয়েছে।’ তাঁদের দাবি হলো, গণতন্ত্রে জবরদস্তির স্থান নেইএই কথাটা ইসলামই প্রথম ঘোষণা করে এবং  এটা মামুলি কোনো কথা  নয় বলে কোরান  একাধিকবার এই নীতির কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে  প্রসঙ্গে অন্যান্য আয়াতের মধ্যে  তাঁরা উল্লেখ করে থাকেন ৮৮/২০,২১ আয়াত দুটি আয়াত দুটির ভাষ্যগুলি  হলো যথাক্রমে অনন্তর তুমি উপদেশ দান করো, তুমি উপদেশ-দাতা এতদ্ভিন্ন নহে এবং ‘তুমি তাহাদের সম্বন্ধে অধ্যক্ষ (দারোগা) নও।’  ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকেও  সমুন্নত রেখেছে এই দাবির পক্ষে তাঁরা প্রমাণ হিসেবে কোরানের কাফেরুনসুরা তথা ১০৯ সুরার নং আয়াতটিকে উদ্ধৃত করে  থাকেন এই আয়াতের কথাগুলি হলো “তোমাদের  জন্য তোমাদের ধর্ম, এবং আমার জন্য আমার ধর্ম  এই আয়াতটির বাখ্যায় তাঁদের বক্তব্য হলো,  বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবে  - এই নীতিটি আল্লাহ এই আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায়  ঘোষণা করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে কোরানেরহুজুরাতসুরা তথা ৪৯ নং সুরার ১১ নং আয়াতটিকেও অব্যর্থ অকাট্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয় এই আয়াতে কোরান বলছে, “হে বিশ্বাসীগণ ! কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে ...”   
ইসলাম ন্যায় ও মানবতার পক্ষে – এই দাবির পক্ষে উদারপন্থী উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যে সব যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপিত করে থাকেন  সেগুলি নিয়ে একটু পরে আলোচনা করা হবে।  তার আগে ইসলাম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা এবং ধারক ও বাহক – এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপরে যে আয়াতগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই আয়াতগুলির উপর কিছু  কথা বলে নেওয়া  যাক।  উক্ত আয়াতগুলি যে সুরার (অধ্যায়) অংশ সেই চারটি সুরার (সুরা নম্বর ২, ৪৯, ৮৮ এবং ১০৯ )  শেষের তিনটিই মক্কী সুরা, শুধু ২ নং  ‘বাকারা’ সুরাটি মদিনী সুরা। ‘মক্কী’ সুরা মানে সুরাগুলি মুহাম্মদ ওহি বলে বিবৃত করেছিলেন মক্কায় থাকাকালীন, আর ‘মদিনী’ সুরা মানে মুহাম্মদ মদিনায় যে সুরাগুলি বর্ণনা করেছিলেন ওহি বলেনং সুরাটি যদিও মাদিনী সুরা হিসেবে গণ্য হয়, কিন্তু একমাত্র এই সুরাটিতেই যে আয়াতগুলি আছে সেগুলির কিছু মক্কা পর্বের ও কিছু মদিনা পর্বের। এবং ২৫৬ নং আয়াতটি মুহাম্মদ বিবৃত করেছিলেন মক্কায় থাকাকালীন। ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে যে মুহাম্মদ মক্কায় যে আয়াতগুলি আল্লাহর বাণী হিসেবে প্রচার করেছিলেন সেগুলির  নীতি ও বিধি সংক্রান্ত আয়াতগুলি  মদিনায় এসে  সম্পূর্ণই বর্জন করেন এবং সেই আয়াতগুলির স্থলে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অনেক নতুন আয়াত হাজির করেন। বলা বাহুল্য যে একই বিষয়ে দুটি বিপরীত ধর্মী আয়াত বা আদেশ যদি দেওয়া হয় তবে প্রথম আয়াত বা আদেশটি দ্বিতীয় আয়াত বা আদেশটি আসার সঙ্গে সঙ্গেই রহিত হয়ে যায়। সুতরাং মক্কার সেই আয়াতগুলি তৎক্ষণাৎ রহিত হয়ে গিয়েছে যেগুলির বিপরীত আয়াত মদিনায় জারি করা হয়েছে। উল্লেখিত চারটি আয়াত কোন কোন আয়াত দ্বারা রহিত বা বাতিল হয়ে গিয়েছে তা পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে যাবে এই কথাগুলি  (মক্কার  উক্ত আয়াতগুলি রহিত হয়ে গেছে)  উদারপন্থী উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ  জেনেশুনেই  গোপন করে থাকেন। এটা তাঁরা সচেতনভাবেই করেন, এবং এটা যে  প্রতারণা তা বলা  বাহুল্য।
উক্ত উলামা ও বুদ্ধিজীবীগণ সগর্বে ও সদর্পে দাবি করেন যে ইসলাম ন্যায় ও মানবতার ধর্ম, অন্যায়-অবিচার ও হিংসার কোনো স্থান ইসলামে নেই। এই দাবির সপক্ষে তাঁরা কোরানের যে আয়াতগুলিকে প্রমাণ হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি আয়াত হলো  ৪/২৯ এবং ৪/১৩৫প্রথম আয়াতটির কোরানের ভাষ্য হল –   
“হে  বিশ্বাসীগণ, তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না কিন্তু তোমাদের  পরষ্পর রাজী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ এবং নিজেদের হত্যা করো না, আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়াময় (অনুবাদ – ড.ওসমান গণি) 
পরের আয়াতটির ভাষ্য হলো   
“হে বিশ্বাসীগণ!  তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় থাকবে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দেবে,  যদিও তা তোমাদের পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায় সে দরিদ্র হোক, আর ধনীই হোকআল্লাহ উভয়েরই যোগ্যতর অভিভাবক সুতরাং তোমরা ন্যায় বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যদি তোমরা পেচালো কথা বলো পাশ কাটাও,  তবে তোমরা যা করছ,  আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত (অনুবাদ – ঐ)   
৪/২৯ –এর দ্বিতীয় অংশটি বলছে -  
‘নিজেদের হত্যা করো না’ – 
অর্থাৎ ইসলাম মুসলমানদের সুস্পষ্টভাবে বলছে যেন কোনো মুসলমান অন্য  মুসলমানকে হত্যা না করে। কোরানে এই উপদেশ বা আদেশ পুনঃ পুনঃ দেওয়া হয়েছে। এ রকম আরো দুটি আয়াত হলো –  
“কোনো বিশ্বাসীকে হত্যা করা  কোনো বিশ্বাসীর উচিত নয়; এবং কেউ ভ্রমবশতঃ কোনো বিশ্বাসীকে হত্যা করলে স্বতন্ত্র।” (৪/৯২) 
 আর একটি আয়াত এ রকম – “যে কেউ স্বেচ্ছায় কোনো বিশ্বাসীকে হত্যা করলে – তবে তার শাস্তি নরক, তার মধ্যে যে সর্বদা অবস্থান করবে।” (৪/৯৩)  
 এই আয়াতগুলি থেকে পরোক্ষে অমুসলিমদের হত্যা করাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। শুধু পরোক্ষে নয়, ইসলাম সরাসরি অমুসলিমদের হত্যা করার আদেশ দিয়েছে যদি তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্মকে স্বীকার ও গ্রহণ না করে। এ রকম অসংখ্য আয়াত কোরানে রয়েছে যার ফলশ্রুতিতে ধর্মান্ধ মুসলিমরা উগ্র ও হিংস্র হয়ে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে জিহাদের নামে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত। সেই আয়াতগুলির কয়েকটি সম্পর্কে পরে আলোচনা করা  হয়েছে।  ৪/২৯ – এর প্রথম অংশে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস না করার যে বাণী বা উপদেশ আছে তা আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে ইসলাম সত্যিই একটা ন্যায়পরায়ণ ধর্ম। কিন্তু এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় অন্যান্য আয়াতগুলি থেকে যে আয়াতগুলিই আসলে ইসলাম ধর্মের  মূল নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।  ‘অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না’ – এটা মোটেই ইসলামের সাধারণ নীতি নয়। এটাও কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও সীমাবদ্ধ। ইসলাম অমুসলমানদের সম্পত্তির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত নীতিতে বিশ্বাসী। ইসলাম সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে আল্লাহর নামে অমুসলিমদের উপর আক্রমণ করা, তাদের সম্পত্তি লুঠ করা, তাদের হত্যা করা, তাদের বন্দি ও ক্রীতদাস করা এবং তাদের নারীদের স্ত্রী রূপে যথেচ্ছ ভোগ করা বৈধ। অমানবিক ও ঘৃণ্য এসব জঘন্য কাজের বৈধতার পক্ষে অসংখ্য আয়াত রয়েছে কোরানে। স্বয়ং হজরত মুহাম্মদ ও তাঁর অনুগামী খলিফাগণণের নেতৃত্বে এরূপ পৈশাচিক কাজের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। মুহাম্মদকৃত এরূপ অনেক ঘটনার মধ্যে থেকে দু-একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিকভাবে পরে আলোচনায় এসে যাবে। এখানে প্রাসঙ্গিক দুটি আয়াত উদ্ধৃত করা হলো –  
“হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীগণকে যাদের তুমি দেনমোহর দান করেছ, এবং বৈধ করেছি – তোমার অধিকারভুক্ত দাসীগণকে, যাদের আমি দান করেছি(আয়াত নং ৩৩/৫০)  
 
কারা এই অধিকারভুক্ত দাসী? দাসী মানে ক্রীতদাসী। আল্লাহর পথে পবিত্র যুদ্ধে কাফেরদের পরাস্ত করে তাদের শুধু ধন-সম্পত্তি লুঠ করা হতো না, তাদের নারী ও শিশু সহ  সকলকে বন্দি করে এনে  ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী বানানো হতো যাদেরকে বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা হতো। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের পরিভাষায় লুঠ করা এসব ধন-সম্পত্তি ও যুদ্ধবন্দিদের বলা হয় ‘গণিমত’। এই গণিমতের মাল বা লুন্ঠীত দ্রব্য মুসলমানদের জন্যে বৈধ। মুসলমানরা কিন্তু অধিকাংশই এহেন জঘন্য লুন্ঠিতদ্রব্য  গ্রহণ করতে, বিশেষ করে কন্যাশিশু, পরস্ত্রী ও অন্যান্য নারীদের দাসী বানাতে এবং ভোগ করতে অসম্মত ছিল, তাদের বিবেকবোধ ও মানবিকবোধ সায় দিতে প্রস্তুত ছিলো না। মুহাম্মদ তখন আল্লাহর নাম করে তাদের নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে ধ্বংস করেন। মহান আল্লাহর সেই মহান বাণীগুলির মধ্যে দুটি বাণী এ রকমঃ
 “যুদ্ধে যা তোমরা লাভ করেছ, তা বৈধ ও উত্তম বলে ভোগ করো।” (৮/৬৯)  
এই হচ্ছে ইসলামের মানবতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টান্ত। আর এই হলো মুসলমানদের কাছে ইসলাম নির্দেশিত ‘সৎ কাজ’ বা ‘ভালো কাজ’ – এর নমুনা। ৪/১৩৫ নং আয়াতে  মুসলমানদের  সাক্ষী প্রদানের সময় ন্যায় বিচারের পক্ষে দৃঢ় থাকার যে কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু শর্তাধীন। শর্ত হলো আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখা। উপরের আলোচনা থেকে ইতিমধ্যেই বোঝা গেছে কোন কোন কাজে আল্লাহর পছন্দ, আর কোন কোন কাজ আল্লাহর অপছন্দ এবং আল্লাহর চোখে কোনটা ন্যায় বিচার,  আর কোনটা অন্যায় বিচার। আল্লাহ তো বলেছে যে, অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা তিনি পছন্দ করেন না; এবং আল্লাহ তো এটাও বলে দিয়েছে যে, বিধর্মীদের ধন-সম্পদ লুন্ঠন করা, এবং তাদের  কন্যা ও স্ত্রীদের বন্দি করা ও ভোগ করা  তার কাছে বৈধ, অন্যায়  নয়

ইসলাম অরাজনৈতিক ধর্ম নয়      @@@@@@@

ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের (Religion)  মতো  কেবল আধ্যাত্মিক ধর্ম মোটেই  নয়। এর আধ্যাত্মিক দিক যেমন আছে তার পাশাপাশি এর রাজনৈতিক দিকও আছে। ইসলাম ধর্ম সব ধর্মের সেরা ধর্ম এবং একমাত্র সত্য ধর্ম বলেই আল্লাহ বা মুহাম্মদ থেমে যান নি। তুমি ইচ্ছা হলে আল্লাহর এই ধর্মকে গ্রহণ করতে পারো, তাতে তোমার মঙ্গল হবে, ইচ্ছা না হলে গ্রহণ না করতেও পারো –  মক্কা পর্বের  ইসলামের এই নীতি মদিনা পর্বের ইসলাম  নির্মমভাবে বর্জন করে একদম তার বিপরীত নীতি গ্রহণ করে। সে নীতি হলো – আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টিকর্তা, সুতরাং সৃষ্টিকর্তার ধর্ম তোমাদের স্বীকার  ও গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টি করা পৃথিবীতে শুধু আল্লাহর ধর্মই থাকবে,অন্য কোনো ধর্ম থাকবে না। কোরানে এ কথা ৪৮/২৮ নং আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে – “আল্লাহ তার নবীকে সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য ধর্ম সহ পাঠিয়েছে যাতে তাকে সকল ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করা যায়।”  কোরান আরো ঘোষণা করেছে যে আল্লাহর পৃথিবীতে শুধু আল্লাহর বান্দারাই বসবাস করার অধিকারী, অন্যরা নয়। আল্লাহর এক নবী, নূহ, আল্লাহর কাছে দাবী জানাচ্ছে – “পৃথিবীতে কোনো অবিশ্বাসীকে তুমি অব্যাহতি দিও না।” (৭১/২৬)  নূহ নবী যে আর্জি জানিয়েছিল আল্লাহ  যে  তাকে অনুমোদন করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। অবিশ্বাসীরা আল্লাহর পৃথিবীতে বাস করার যোগ্য নয় তা আল্লাহ নিজেই জানিয়ে দিচ্ছে অনেক জায়গায়। কোরানের ৮/৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলছে –“ওরা শুধু অপবিত্র নয়, অবিশ্বাসীরা হলো নিকৃষ্ট জীব।”  আল্লাহ অবিশ্বাসীদের বলছে পৃথিবীর বুকে তাদের বাস করা কোনো অধিকারই নেই, কেননা পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক একমাত্র তিনিই (আল্লাহ) এবং আকাশ ও পৃথিবীর উপর সার্বভৌমত্ব একমাত্র তারই । ৩/১০৯ আয়াতে কোরান বলছে – “আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর ।”  ২/১০৭ আয়াতে সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে কোরানের ভাষ্য –“তোমরা কি জান নাই যে, দ্যুলোক ও ভূলোকের রাজত্ব ঈশ্বরেরই, এবং ঈশ্বর ব্যতীত তোমাদের বন্ধু ও সহায় নাই? (অনুবাদ – গিরিশ সেন)  তার আগের আয়াতে (২/১০৬) আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছে – “তুমি কি জ্ঞাত হও নাই যে ঈশ্বর সর্বোপরি ক্ষমতাশালী?”  এই হলো ইসলামের নীতি। ৭১/২৬ নং আয়াতটি মক্কি আয়াত। অর্থাৎ মুহাম্মদের অভিলাষ(বল প্রয়োগ করে ইসলাম গ্রহণ করানো) প্রকাশ পেয়েছিলো মক্কাতেই। কারণ সেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা আশাব্যঞ্জক ও সুখকর ছিলো না। ইসলাম আল্লাহর একমাত্র ধর্ম এবং তিনি (মুহাম্মদ) আল্লার প্রেরিত দূত – এ কথা মক্কার মানুষজন (কোরেশগণ যারা পৌত্তলিক ছিলো) বিশ্বাস করে নি এবং তাদের স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে নি। মদিনায় গিয়ে তাই তিনি আল্লাহর নামে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্তিপূর্ণ পথে ইসলামের প্রচার করার নীতি ত্যাগ করেন।  তিনি মক্কার নবী জীবনের এগারো-বারো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন যে অহিংস পথে ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় সাফল্য আসবে না। তাই তিনি বল প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার নীতি গ্রহণ করেন। সেই নীতিই হলো ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর পথে ‘পবিত্র জিহাদ’এই জিহাদের উদ্দেশ্য হলো যেমন করেই হোক মুসলমানদের ক্ষমতাশালী করা ও বিধর্মীদের উপর তাদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্থাপন করা। মদিনা পর্বে মুহাম্মদ সে লক্ষ্যেই ইসলামকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। ফলে মক্কা পর্বের যে ইসলাম ছিলো শুধুই আধ্যাত্মিক ধর্ম, মদিনায় তা বিলকুল পাল্টে যেতে থাকলো এবং ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠলো আপাদ-মস্তক রাজনৈতিক ইসলাম যার লক্ষ্য হলো যে ভাবেই হোক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা ও  বিধর্মীদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা। বলা বাহুল্য যে, মুহাম্মদ এই জিহাদের নীতিতে আশাতীত সাফল্য পেয়েছিলেন। যে মুহাম্মদ মক্কায় ১১-১২ বছর আপ্রাণ চেষ্টা করেও  ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন,  সেই মুহাম্মদই মাত্র ৮ বছরেই  চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন। ৬৩০ খৃষ্টাব্দে মক্কা জয় করে তিনি স্থাপন করেন ইসলামি রাষ্ট্রতারপর আর মুহাম্মদকে পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। তরতর করে, বলা যায়,  উল্কার বেগে এগিয়ে গেছে তাঁর বিজয় রথ। মক্কা ও তার আশপাশের যে পৌত্তলিকরা তাঁকে একজন ভন্ড নবী বলে নির্মমভাবে উপেক্ষা ও প্রত্যাখান করেছিল তারা সুড়সুড় করে ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। যারা আত্মসমর্পণ করলো না তারা মুসলমানদের তলোয়ারের নীচে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো মক্কা জয়ের মধ্যে দিয়ে ইসলামের যে বিজয় যাত্রা শুরু হয়েছিল তা অব্যাহত ছিল আরো কয়েকশ’ বছর তাঁর অনুগামীরা প্রায় অর্ধেক বিশ্বকে পদানত করে ফেলেছিলেন।

জিহাদ হলো একটি তত্ত্ব এবং ইসলামের মূল নীতি  

৬২২ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ মক্কা ছেড়ে মদিনায় এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্যে। মুসলিম ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকদের দাবী হলো এই যে,  মক্কার কোরেশরা যখন তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো তখন  তিনি আত্মরক্ষা করার জন্যে রাতের অন্ধকার মক্কা ছেড়ে পালিয়ে আসেন। এ দাবী বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ তার কোনো প্রামাণ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাবরং সে সময়ের অনেক ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তিনি মক্কায় সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েই স্বেচ্ছায় মক্কা থেকে মদিনায় পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই ঘটনাগুলি বিবৃত করার অবকাশ এখানে নেই।
মদিনায় এসেই মুহাম্মদ তাঁর কথিত আল্লাহর ধর্ম প্রচারের মক্কায় অনুসৃত পথ ও কৌশল পরিবর্তন করে যে সম্পূর্ণ নতুন পথ ও কৌশল অবলম্বন করেন সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সে পথই ইসলামের পরিভাষায় ‘জিহাদ’। এই ‘জিহাদ’কে আল্লাহর পথে অত্যন্ত পবিত্র কাজ বলে ইসলাম আখ্যায়িত করেছে  ইসলামের পূর্বে পৃথিবীতে অনেক ধর্ম (Religion) এসেছে, কিন্তু কোনো ধর্মেই বল প্রয়োগের কথা বলা হয় নি যেটা কেবল ইসলাম বলেছে। সেদিক থেকে বিচার করলে এটা ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মের ইতিহাসে একটা নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার ও সংযোজন। অর্থাৎ জিহাদ একটি  ‘তত্ত্ব’ এবং এই তও্ব্বটিই ইসলামের প্রধান অস্ত্রএই তত্ত্বকে মুহাম্মদ ইসলামের রণনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আলাহর নামে   করার নির্দেশ দেনইসলামের নীতিগুলির মধ্যে তাই ‘জিহাদ’ই হলো মূলনীতি এবং যে ইসলাম সব স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার প্রধান স্তম্ভটিই হলো জিহাদ। জিহাদকে ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) করেছে।  এটা কারো মনগড়া কথা নয়, বা কিছু কট্টরপন্থী মুসলিম নেতার কোরানীয় অপব্যাখ্যা নয়জিহাদ যে মুসলিমদের জন্যে বাধ্যতামূলক তার অসংখ্য অকাট্য প্রমাণ রয়েছ কোরান, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ও মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবনে বিষয়টি পরের অধ্যায়গুলিতে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হয়েছে। এখন জিহাদ কোন  কোন  নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে  সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক
জিহাদি তত্ত্বের মূলনীতি হলো চারটি - এক) অবিশ্বাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার (পত্রদ্বারা) দাওয়াত (আহ্বান) (দাওয়াত তো নয়, আসলে নির্দেশ)দুই) দাওয়াত কবু(স্বীকার) না করলে সশস্ত্র আক্রমণ তথা জিহাদ শুরুতিন)  যুদ্ধবন্দিদের দাসত্বকরণ এবং চার) ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তার করা যার লক্ষ্য হলো গোটা বিশ্বকে পদানত করা।

জিহাদ সম্পর্কে কোরান

মুসলমানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ দুটি হলো – কোরান ও হাদিস। জিহাদ সম্পর্কে উদারপন্থী ধর্মগুরু তথা উলামাদের একাংশ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কী অভিমত  তা উপরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই উলামা ও বুদ্ধিজীবীগণের দাবি হলো, যারা জিহাদকে মুসলমানদের একটি প্রধান করণীয় কাজ বলে ফতোয়া দেয় এবং জিহাদের নামে মানুষের জীবন নিয়ে রক্তের হোলিখেলায় মত্ত হয়, তারা হয় কোরানের  অপব্যাখ্য করে, না হয় কোরান বোঝে না মুহাম্মদের পরে ইমাম গাজ্জালির মতো ইসলামি পন্ডিত পৃথিবীতে আজো জন্মগ্রহণ করে নি বলে মুসলিমদের বিশ্বাস । জিহাদ প্রসঙ্গে তিনি কী বলেছেন তা উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এবার এ যুগের প্রধান শীর্ষস্থানীয় ইসলামি পন্ডিত ওসামা বিন লাদেন(সম্প্রতি যাকে আমেরিকা হত্যা করেছে নিষ্ঠুরভাবে) জিহাদ সম্পর্কে কী বলেছেন তা শোনা যাক - “মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহর সংক্ষিপ্ত ভাষ্যঃ ‘আমরা তোমাদেরকে  অস্বীকার করি। এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অনন্তকাল ঘৃণা ও শত্রুতা বিরাজ করবে। সুতরাং মুসলিমদের অন্তরে অমুসলিমদের প্রতি একটা প্রচন্ড বিদ্বেষমূলক শত্রুতা রয়েছে। আর এ প্রচন্ড শত্রুতা বা  লড়াই নিবৃত্ত হবে যদি অবিশ্বাসীরা ইসলামের কর্তৃত্বের কাছে  নত হয়,  অথবা যদি তাদের শরীর থেকে রক্তঝরা বন্ধ হয়ে যায়, অথবা সে সময় যদি মুসলমানরা দুর্বল অথবা অসমর্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো সময় যদি (মুসলমানদের) হৃদয় থেকে এ ঘৃণা অন্তর্হিত হয়, তবে সেটা হবে স্বধর্ম ত্যাগের শামিল। অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে  নবীর উপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর বাণীর সত্যিকার মর্মকথা হচ্ছেঃ ‘ও নবী! অবিশ্বাসী ও ভন্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; তাদের প্রতি নির্মম হও। তারা দুর্ভাগা, তাদের স্থান নরকে।’ অতএব এটাই হচ্ছে অবিশ্বাসী ও  মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কের মূল ভিত্তি। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে মুসলিম পরিচালিত যুদ্ধ, বিদ্বেষ ও ঘৃণাই  আমাদের  ধর্মের ভিত্তি। আমরা একে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার ও দয়া বলেই মনে করি।” (সূত্রঃ ইব্রাহিম রেমন্ডের ‘ The Toe Faces of Al-Qaeda ‘ শিরোনামাঙ্কিত একটি পর্যালোচনা থেকে উদ্ধৃতি;   দ্রঃ  জিহাদ/এম.এ.খান,  পৃ – ২,৩)  আর একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শীর্ষস্থানীয় ইসলামি পন্ডিত হলেন তালিবান নেতা মোল্লা ওমর। তিনি হাড় হিম করা জিহাদি বিপ্লবের মাধ্যমে  আফগানিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন মাত্র কয়েক বছর আগে। তিনি কি বলেছেন তা এবার শোনা  যাক – “মনে রাখবে জিততে আমাদের হবেই হবে। তা না হলে  পৃথিবী থেকে  মুছে যাবে ইসলামের নাম। ইসলামকে প্রসারিত করতে হবে। ইসলামই হবে একদিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একমাত্র ধর্ম। আর এই ইসলামকে প্রসারিত করার জন্যে আমাদের নবী তার জীবিত অবস্থায় কম করেও তিরিশ অথবা চল্লিশবার যুদ্ধে অবতীর্ণ  হয়েছিলেন। তার একমাত্র ইচ্ছা রেখে মারা গেছেন। ... কী ইচ্ছা ছিলো জানো? সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ধর্মের বীজ রোপণ করা এবং পৃথিবী থেকে কাফের নির্মূল করা। অন্য কোন কিতাব পৃথিবীতে থাকবে না, কেবল কোরাণ ছাড়া। ... যারা কোরাণ ছাড়া অন্য কিতাব পড়ে তারা সত্য অস্বীকার করে,  তাদের বর্জন কর।”  (সূত্রঃ মোল্লা ওমর তালিবান ও আমি, সুস্মিতা মুখার্জী, পৃ – ১০)
আন্তর্জাতিক স্তরের এসব ইসলামি পন্ডিতরা কোরানের অর্থ ও মর্ম বুঝতে পারেন নি? উক্ত উলামা ও বুদ্ধিজীবীদের জবাব হলো – হ্যাঁ। মুহাম্মদ নিজে  জিহাদ করেছেন, জিহাদে স্বয়ং তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেছেন – ইতিহাসের এই সত্যকে অস্বীকার করার কারো সাধ্য নেই। এ ক্ষেত্রে তাঁদের উত্তর হলো, কাফেররা যখন আক্রমণ করেছে মুসলমানদের উপর তখন মুসলমানরা নিরুপায় হয়ে  অস্ত্র হাতে তুলেছেন ও প্রতিরোধ করেছেন আত্মরক্ষার্থে। কখনই মুহাম্মাদ ও তাঁর অনুগামী খলিফারা বিনা প্ররোচনায় কাফেরদের উপর আক্রমণ করেন নি। এই দাবি কী কোরান, কী হাদিস,  কি ইসলামের ইতিহাস,  কেউই সমর্থন করে না। কোরান জিহাদ সম্বন্ধে ঠিক কী  সাক্ষ্য প্রদান করে  তা  দেখা যাক। 
কোরানে মোট ১৪৪টি অধ্যায় (সুরা) আছে যেগুলি ভীষণ বিশৃঙ্খলভাবে সংকলিত  ততোধিক বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আয়াতগুলি (বাক্য বা বাণীসমূহ)। তাই জিহাদ সম্পর্কে ঠিক কতকগুলি আয়াত আছে এবং কোন কোন অধ্যায়ে (সুরায়) সেগুলি সন্নেবেশিত করা হয়েছে তা নির্ভুলভাবে বলা খুব শক্ততবে সাধারণভাবে একটা হিসেব হলো জিহাদ সম্পর্কে কমবেশি ২০০টি আয়াত আছে। এই আয়াতগুলি সবই মদিনা পর্বের। অর্থাৎ এটা সংশয়াতীত যে মুহাম্মদ জিহাদের কথা মক্কায় থাকাকালীন বলেন নি।  প্রথম যে আয়াতটি যুদ্ধের জন্যে আল্লাহর নির্দেশ বা অনুমতি যাই বলা হোক না কেন, সেটা হলো ২/১৯০ নং আয়াত। আয়াতটি এরূপঃ  “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, কিন্তু সীমা লঙ্ঘণ করো না।” (এটাকেই প্রথম আয়াত বলে উল্লেখ করেছেন ইবনে কাথির তাঁর তফসির গ্রন্থে) এই আয়াতটিকে উদারপন্থী উলামা ও বুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ হিসেবে দেখান যে ইসলাম আগ বাড়িয়ে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বা যুদ্ধের কথা বলে নি। এ রকম আরো কয়েকটি  আয়াত আছে কোরানে, সেগুলিকে তাঁরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উপস্থাপিত করেন। সে রকম আর একটি আয়াত হলো –“অনুমতি দেওয়া হলো তাদের যারা আক্রান্ত হয়েছে, কারণ তাদের  প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে পূর্ণ সক্ষম(২২/৩৯) এই সুরাটিও মদিনা পর্বের।কিন্তু জিহাদ সম্পর্কে আরো অনেক আয়াত আছে যেখানে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কোনো শর্তই আরোপ করা নেই, বিনা প্ররোচনাতেই বিধর্মীদের উপর আক্রমণ করার কথা, তাদের প্রতি কঠোর হওয়ার কথা, তাদের হত্যা করার কথা বলা হয়েছে।  সে আয়াতগুলির কথা উল্লেখ করার পূর্বে অন্য একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা বলে নেওয়া আবশ্যকউপরে উল্লেখিত  দুটি আয়াত থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম একটি শান্তি ও মানবতাবাদী ধর্ম এই দাবী ভিত্তিহীন। কারণ আক্রমণকারীকে আক্রমণ করো – এই নীতি শান্তি এবং মানবতার পরিপন্থী। আমরা জানি বাইবেল কথিত যীশুর বাণী হলো, যারা অত্যাচার করছে তারা জানে না তারা কী ভুল করছে, প্রভু ওদের ক্ষমা করে দাও। যীশু আদৌ জন্মেছিলেন কী না সে বিতর্ক সরিয়ে রেখে যে কথা বলতে চাই তা হলো, যীশুর এই কথাটা যদি মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের বলতেন তা হলে মেনে নেওয়া যেত যেত যে মুহাম্মদ বা ইসলামের আগমন হয়েছিলো সত্যিই পৃথিবীতে শান্তি ও মানবতা  প্রতিষ্ঠার জন্যে   
বিনা প্ররোচনাতেই এবং শুধু বিধর্মী হওয়ার জন্যেই কোরান বিধর্মীদের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছে এমন আয়াতও রয়েছে ভুরিভুরি। সে রকম আয়াতগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো – ২/১৯১, ১৯৩, ২১৬-২১৮; ৪/৭৬;  ৮/১২,১৩, ৩৯;  ৯/২৮,২৯, ৩৬, ৪১,৭৩, ১২৩; ৬৬/৯; ৭১/২৬,২৭। এই আয়াতগুলির দুটির ভাষ্য উল্লেখ করা যাক এটা বুঝে নেওয়ার জন্যে যে কোরান বিনা প্ররোচনাতেই বিধর্মীদের উপর   মুসলমানদের আক্রমণ করার নির্দেশ সত্যি সত্যিই দিয়েছে কী না ।  ৯/১২৩ আয়াতটিতে কোরান বলছে   “হে বিশ্বাসীগণ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখুক, জেনে রেখো আল্লাহ মুত্তাকী (সংযমী)- দের সঙ্গী।”  ৯/৭৩ নং আয়াতটি বলছে – “হে নবী! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, তাদের প্রতি কঠর হও; তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম, তা কতো নিকৃষ্ট পরিণাম।” ইসলামি কঠোরতার রূপ কী ভয়ঙ্কর তা কোরান বিবৃত করেছে ৮/১২ নং আয়াতে এখন প্রশ্ন হলো, কারা মুনাফিক? যে মুসলমানগণ  কোরানের কিছু  নেই, কিছু বিকৃত করে, আর কিছু বর্জন করে তারা মুনাফিক।  এই কথাগুলি কাদের জন্যে প্রযোজ্য তা মন্তব্য করা নিশ্চয় বাহুল্য মাত্র।  আর কারা খাঁটি মুসলমান তা বিচারের প্রধান  মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে জিহাদকেই। সে কথা বলা হয়েছে ২/২১৮ নং আয়াতটিতে। আয়াতটি  হলো – “যারা বিশ্বাস করে ও আল্লার পথে স্বদেশ ত্যাগ (হিজরত) করে এবং  ধর্মযুদ্ধ  করে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশী।”
আত্মরক্ষার জন্যে যুদ্ধ বা জিহাদ নয়, কোরান বলছে জিহাদ জারি থাকবে অনন্তকাল যতদিন পৃথিবীতে ফিৎনা (ফিৎনা মানে আল্লার বিরোধিতা করা, আল্লাহর ধর্ম প্রচারে বাধা সৃষ্টি করা ইত্যাদি) থাকবে এবং পৃথিবীর বুকে যতদিন না সম্পূর্ণ রূপে ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে অথবা যে পর্যন্ত না অবিশ্বাসীগণ অধীনতা স্বীকার করে ও স্বহস্তে জিজিয়া দান করে। সে রকম অনেকগুলি আয়াতের মধ্যে দুটি আয়াত হলো ৮/৩৯ ও ৯/২৯। ৮/৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ মুসলমানদের উদ্দেশ্য বলছে – “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, যতক্ষণ না অশান্তি দূর হয় ও আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।”  ৯/২৯ নং আয়াতে যে  বাণীগুলি হলো – “যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না, এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল যা বৈধ করেছেন, তা বৈধ জ্ঞান করে না, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, যে পর্যন্ত তারা অধীনতা স্বীকার করে স্বহস্তে জিজিয়া দান না করা
কোরানে ও হাদিসে প্রাক ইসলাম যুগের মক্কার মানুষদের অসভ্য, বর্বর, লুন্ঠনকারী ইত্যাদি ভীষণ খারাপ খারাপ বিশেষণে ভূষিত করে তাদের পৃথিবীর মানুষের সামনে  অতিশয় ছোট করে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে কিন্তু তারা তেমন মোটেই ছিলেন না। বরং তাদের নৈতিক মূল্যবোধ ছিলো অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত উঁচু মানের যা মুহাম্মদ ধ্বংস করে দেন আল্লাহর নামে। আরবের উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষরা অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত ছিলো, তার ফলে তাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দও ছিলো, কিন্তু তদসত্ত্বেও তাদের মধ্যে কখনই সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছিলো না, তারা সবাই যে যার দেব-দেবীর উপাসনা করতো নির্বিঘ্নে এবং তারা কখনো  কারো ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করতো না, বরং একে অপরের দেব-দেবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল থাকতো। এই উচ্চ মূল্যবোধের কারণে মুসলমানরা প্রথমে কিছুতেই কোরেশ বা অন্য বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সম্মত ছিলো না। মুহাম্মদ তাদের সেই মূল্যবোধ আল্লাহর দোহায় দিয়ে ধ্বংস করে দেন এবং সবাইকে নির্মম, নিষ্ঠুর ও নরপিশাচ বানিয়ে তোলেন। তা করতে গিয়ে কখনো পরকালে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে, কখনো পরকালে বেহেস্তের প্রলোভন  এবং কখনো ধন-দৌলতের দেখানো হয়েছে। মুসলমানরা যে প্রথমে জিহাদে যেতে সম্মত ছিলো  না তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় কোরানের বিভিন্ন আয়াতে। সে রকম একটি   আয়াত হলো – “হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমাদের কী হয়েছে যে, যখন তোমাদের আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যমিনে ঝুঁকে পড়ো।”  এর পরের আয়াতে (৯/৩৯) আল্লাহ যুদ্ধে যেতে অনিচ্ছুক মুসলমানদের ভয় দেখানো হচ্ছে এভাবে – “যদি তোমরা অভিযানে বের  না হও, তবে তিন তোমাদের যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি দেবেন।” আবার ৬১/১১ ও ১২ নং আয়াতে আল্লাহ  জিহাদে অনিচ্ছুক মুসলমানদের জিহাদে যাওয়ার জন্যে মহা পুরষ্কার দেবার প্রলোভন দেখাচ্ছে আল্লাহ বলছে  -   “তোমরা আল্লাহ ও রসুলে বিশ্বাস স্থাপন করবে, এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে। ... আল্লাহ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন, এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।”  কোরানে কখনো আবার মুসলমানদের যুদ্ধে যেতে বাধ্য করার জন্যে প্রবল মানসিক চাপ তৈরী করা হয়েছে । ৯/৪৫ নং আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে – যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না – তারাই কেবল তোমার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে, তাদের অন্তর সংশয়যুক্ত, ওরা স্বীয় সংশয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।” এবার দেখা যাক কোরানে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে কীরূপ কঠোর হতে বলছে /১২ নং আয়াতে  কোরান বলছে, “আমি অচিরেই অবিশ্বাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করছি। অতএব তাদের কন্ঠ (স্কন্ধ) সমূহের উপর আঘাত করো, তাদের আঙুলের গিটে গিটে আঘাত করো।” কঠোরতার বীভৎস রূপ কী রকম হতে পারে তা মুহাম্মদ নিজেই দেখিয়ে গিয়েছেন বিভিন্ন ঘটনায় যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর জীবনচরিতে।
সামগ্রিকভাবে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ তো আছেই। তাছাড়া   তিনটি সম্প্রদায়ের  বিরুদ্ধে নাম করে আলাদাভাবে  যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে তিনটি সম্প্রদায় হলো কোরেশ, ইহুদি ও খৃস্টান। খৃষ্টানরা তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম প্রত্যাখান ও  সমালোচনা করায় মুহাম্মদ শুধু তাঁদের ধর্মের নিন্দাবাদই করেই শুধু ক্ষান্ত থাকেন নি। খৃষ্টান যাজকদের, যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে সাধারণ খৃষ্টানদের  নিরুৎসাহিত করেছিলেন তাঁদের লোভী ও জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী বলে নিন্দা করে তাঁদের বিরুদ্ধে মুসমানদের মধ্যে ব্যাপক ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। ইসলামকে অস্বীকার করার জন্যে তারা  ধ্বংস  হবে বলে তাদের ভয় দেখিয়ে  কোরান  বলছে  “খৃষ্টান যাজক বা সন্ন্যাসীরা বেপরোয়াভাবে মানবজাতির সম্পদ লুট ও গ্রাস করে ও আল্লাহ’র পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আল্লাহর পথে ব্যয় না করে যারা সোনা-রূপা জমায়, তাদেরকে হে মুহাম্মদ যন্ত্রণাময় ধ্বংসের খবর দাও। (৯/৩৪) শুধু মুখে ভয় দেখানোই নয়, তাদের সত্যি সত্যি ধ্বংস করার জন্যে মুহাম্মদ যে কত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তা  বোঝা যায়  ৯/৩০ নং আয়াতে   আয়াতটি এরূপঃ  “ইহুদিরা বলে ওজায়ের আল্লাহর পুত্র, খৃষ্টানরা বলে মসিহ আল্লাহর পুত্র। ...  আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন, তারা কেমন করে সত্য বিমুখ হয়।” মুহাম্মদ ক্রমশঃ ওঁদের প্রতি  বিদ্বেষীভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন এবং একের পর এক ওহি নিয়ে এসে মুসলমানদের মাঝে এভাবে বিষাক্ত বিদ্বেষ ও  ঘৃণা ছড়াতে শুরু করেন।  মুহাম্মদ ওঁদের প্রতি কত অসহিষ্ণু ও কী ভয়ঙ্কর রকমের ক্রুদ্ধ  হয়ে উঠেছিলেন তার প্রকাশ পাওয়া যায় ৯৮/৬ ও ৫/৬৪ নং আয়াতে সেখানে  কোরানে আল্লাহ বলেছে – “কেতাবী ও অংশীবাদীদের মধ্যে যারা অবিশ্বাস করে তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, ওরাই তো নিকৃষ্ট জীব (৯৮/৬)   ইহুদি ও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা যাতে চিরজাগরূক থাকে সে ব্যবস্থাও কোরানে করে দেওয়া হয়েছে। ৫/৬৪ নং আয়াতে কোরান বলছে, “তাদের হস্তসমূহ শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে এবং তারা যা বলছে, তার জন্য অভিশপ্ত হবে। ... আমি তাদের বিরুদ্ধে উত্থানদিবস (কিয়ামত) পর্যন্ত শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করেছি।”মুহাম্মদ  ক্রমশঃ  ওঁদের প্রতি কী ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর মৃত্যুশয্যার উক্তি থেকেওমৃত্যুশয্যায় ক্রোধোন্মাদের ন্যায় তিনি বলছেন, “হে প্রভু! ইহুদি ও খৃষ্টানদের ধ্বংস  করো। প্রভুর ক্রোধ তাদের উপর প্রজ্বলিত হয়ে উঠূক। সমগ্র আরব ভূখন্ডে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম না থাকুক।” (উদ্ধৃতিঃ জিহাদ/এম.এ.খান, পৃ – ৩৭, ৩৮; মূল  সূত্রঃ Walker, p – 119, also Ibn Ishaq , p -  523)এ তো তাঁর ইচ্ছা ছিলো না, ছিলো সাহাবীদের প্রতি আদেশ। সাহাবীদের তা হৃদয়ঙ্গম করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি। তাই ২য় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব আরব থেকে ইহুদি, খৃষ্টান সহ সমস্ত মুশরিকদের বিতাড়িত করেছিলেন।
হাদিসে জিহাদ

কোরান অপেক্ষা হাদিসে জিহাদ সম্পর্কে অধিক বক্তব্য রয়েছে এবং জিহাদের উপর অধিক জোরও দেওয়া হয়েছে। হাদিস ও  কোরানের  গুরুত্ব মুসলমানদের কাছে প্রায় সমান সমানকোরানের কথাগুলি, মুহাম্মদ বলেছেন‌ আল্লাহর কথা যা জিব্রাইল ফেরেস্তার মাধ্যমে তাঁর কাছে এসেছিলো। মুহাম্মদ যা বলেছেন ও করেছেন তা হলো ইসলামের পরিভাষায় হাদিস। মুহাম্মদ বলেছেন তিনি যা বলেছেন ও করেছেন তার কোনোটাই তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও মস্তিষ্ক প্রসূত নয়, সবটার পেছনেই রয়েছে আল্লাহর ইচ্ছা। তাছাড়া কোরানের অনেক কথা বা কাহিনীর অর্থ ভীষণ অস্পষ্ট, কিছু কথা দ্ব্যর্থবোধক,  মুহাম্মদ সেগুলির অধিকাংশই তাঁর সাহাবীদের নিকট সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে যান,  সেগুলিও  হাদিসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং কোনোভাবেই হাদিসের কথা বা  বিধি-নিষেধগুলি মুসলমানদের পক্ষে অস্বীকার, অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা করার মতো নয়।
জিহাদ সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদের বিষয়ে ইসলাম কী বলছে এবং মুহাম্মদ স্বয়ং জিহাদে কী ভূমিকা পালন করেছেন তা নিয়ে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। ইসলামে জিহাদের স্থান ও  গুরুত্ব  কী অপরিসীম তা বোঝাতে সেগুলি আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু অতো বিস্তৃত আলোচনা করা  একটা নিবন্ধে  সম্ভব নয়। তাই মাত্র কয়েকটি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো। সেগুলির  একটি হলো -  বিন ওমর বর্ণিত এক হাদিসে মুহাম্মদের জিহাদের পক্ষে অকপট উক্তি। তিনি বলেন, “আমি আল্লাহ কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ প্রাপ্ত, যতক্ষণ না তারা ঘোষণা করছে যে আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করার অধিকার নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর নবী। এবং সঠিকভাবে নামাজ আদায় করে এবং বাধ্যতামূলক বা দাতব্য প্রদান করে। যদি তা তারা পালন করে, তবে আমার নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ হবে এবংতারপর আল্লাহ তাদের হিসেব নেবেন।”(বুখারী শরীফ, ১/২৪) মুজাহিদদের   বেহেস্তের প্রলোভন দেওয়া হয়েছে এ রকম একটি  হাদিস হলো  - “আল্লাহ মুমিনদের নিকট তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন,  এর বিনিময়ে তাদের জন্য জান্নাত আছে। তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, হত্যা করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরানে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিশ্রুতি পূরণে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে?” (বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পরিচ্ছেদ – ১৭৪২) অন্য  একটি হাদিসে মুহাম্মদ বলছেন মুজাহাদিরাই শ্রেষ্ঠ মানুষ – “মানুষের মধ্যে সে মুমিন মুজাহিদই উত্তম, যে স্বীয় জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে।” (বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পরিচ্ছেদ – ১৭৪৩)
ইহুদিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য মুহাম্মদ পৃথকভাবে তাঁর সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে রকম একটি হাদিসের বয়ান হলো -  রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,  তোমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এমনকি তাদের কেউ যদি পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে তাহলে পাথরও বলবে, ‘হে আল্লাহর  বান্দা, আমার পিছনে ইয়াহুদী আছে, তাকে হত্যা করো।”(বোখারী, ৫ম খন্ড, হাঃ নং-  ২৭২৪)  অনুরূপ আর একটি হাদিস হলো – রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত না তোমরা ইয়াহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এমনকি তাদের কেউ যদি পাথরের  আড়ালে আত্মগোপন করে  তাহলে পাথরও বলবে, ‘হে মুসলিম, আমার পিছনে  য়াহুদি আছে, তাকে হত্যা করো (বোখারী, ৫ম খন্ড, হাঃ নং- ২৭২৫)
তুর্কিদের বিরুদ্ধেও আলাদাভাবে জিহাদ করার  নির্দেশ রয়েছে। সে রকম একটি হাদিস হলোঃ বী (সাঃ) বলেছেন, ‘কিয়ামতের আলামতসমূহের একটি একটি এই যে তোমরা এমন এক জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যারা পশমের জুতা পরিধান করবে। কিয়ামতের আর একটি আলামত এই যে, তোমরা এমন এক জাতির বিরুদ্ধে যুধ করবে, যাদের মুখ  হবে চওড়া, যেন তাদের মুখমন্ডল পিটানো চামড়ার ঢাল। (বোখারী, ৫ম খন্ড, হাঃ নং- ২৭২৬) এরূপ আর একটি হাদিস হলো –“নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘ততদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত না তোমরা তুর্ক জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যাদের চোখ ছোট, চেহারা লাল, মুখমন্ডল পিটানো চামড়ার মতো ঢাল।’  (৫ম খন্ড, হাঃ নং- ২৭২৭ )   
  
মুহাম্মদ ও জিহাদ

ইসলামি জিহাদ মানে যে বিধর্মীদের উপর বিনা প্ররোচনায় সহিংস আক্রমণরা, তাদের লুন্ঠন করা, তাদের হত্যা করা, তাদের ধর্ষণ করা  তার প্রমাণ স্বয়ং মুহাম্মদ। ৬২২ সাল থেকে মৃত্যুকাল (৬৩২ খৃঃ) অবধি তিনি অবিশ্বাসীদের নিকেশ করার জন্যে সমস্ত রকমের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সংগঠিত করেছিলেন। এসব বর্বর হিংসাত্মক কর্মকান্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়  তাঁর জীবনী থেকেতথাকথিত  উদারপন্থীরাও অন্ততঃ এটুকু স্বীকার করতে বাধ্য হন যে মুহাম্মদকে আত্মরক্ষার জন্যে  অনেকগুলি জিহাদ করতে হয়েছিলোএটা স্বীকার করার অর্থ এটা মেনে নেওয়া যে মুহাম্মদ স্বয়ং বিধর্মীদের হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব করেছিলেন। কিন্তু পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে উদারপন্থী মুসলিমদের এরূপ দাবির(আত্মরক্ষার জন্যে জিহাদ) কোনো ভিত্তি নেই। দাবিগুলি যে ভিত্তিহীন সে কথা উপরে কোরান ও হাদিস থেকে যে আলোচনা করা হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরো  অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায় মুহাম্মদের জীবনী থেকেও। তারই কয়েকটি এবার উল্লেখ করা যাক।
ইসলামি চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক ড.ওসমান গণি লিখেছেন ‘মহানবী’(প্রকাশনা – মল্লিক ব্রাদার্স) গ্রন্থে যে মুহাম্মদকে তাঁর জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে  মোট ৪৩ টি জিহাদে অংশ নিতে হয়েছিলো(দ্রঃ পৃ–৩৯৫) এই যুদ্ধগুলির অধিকাংশই তিনি বিনা প্ররোচনাতেই অবিশ্বাসীদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় যে যুদ্ধগুলি মুহাম্মদ করেছিলেন সেগুলির মধ্যে  উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যুদ্ধ হলো - নাখালার যুদ্ধ, বদর যুদ্ধ, মদিনায় বনি কাইনুকাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বনি নাজির গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বনি কুরাইজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, খায়বার যুদ্ধ, মক্কা অভিযান প্রভৃতি। বদর যুদ্ধ ছিলো মুহাম্মদ কর্তৃক প্রথম বড়ো আক্রমণ (যুদ্ধ) মক্কার কোরেশদের বিরুদ্ধেকোরেশদের একজন বড়ো মাপের নেতা আবু সুফিয়ান সেবার একটি বৃহৎ বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে  সিরিয়া গিয়েছিলেনসে কাফেলায় প্রচুর বাণিজ্যিক জিনিষপত্র ও ধনসম্পদ ছিলো। মক্কা ও সিরিয়ার রাস্তায় মধ্যে  মদিনার অবস্থি সুফিয়ানের সিরিয়া যাওয়ার খবর পৌঁছে গিয়েছিলো মুহাম্মদের নিকট। সে খবর পেয়ে তিনি আনন্দে ভীষণ উল্লসিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তখন তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত নিলেন সুফিয়ানের কাফেলাকে আক্রমণ করবেন  সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার পথে এবং তাদের সর্বস্ব লুঠ করে তাদের  চিরিদিনের জন্যে বাণিজ্য করার সাধ মিটিয়ে দেবেন। সেই পরিকল্পনা মাফিক তিনি ৩১৩ জন সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মদিনা থকে অনতি দূরে  বদর নামক একটি যায়গায় গিয়ে তাঁবু খাটিয়ে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন  সুফিয়ানের বাণীজ্য কাফেলার জন্যে। এই খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান মক্কায় কোরেশদের কাছে খবর পাঠালেন তারা যেন তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। মক্কার লোকজন এসে পৌঁছানোর আগেই সুফিয়ান মদিনার পথ পরিহার করে অন্য পথ ধরে মক্কায় ফিরে যান। কিন্তু ইতিমধ্যেই মক্কা থেকে কোরেশদের একটি দল আবু সুফিয়ানকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে এসে পড়লে বদর প্রান্তে  উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। সেই যুদ্ধই বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত।
মদিনায় ইহুদিদের  তিনটি  গোষ্ঠী বাস করতো বহুকাল আগে থেকেই। তাদের উপর বানানো অভিযোগের ভিত্তিতে তিন দফায়   মুহাম্মদ একতরফা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মদিনা থেকে তাদের নির্বাসিত করেছিলেন। তাদের অপরাধ ছিলো একটাই - তা হলো,  তারা স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে নিতার প্রমাণ পাওয়া যায়  এমনকি বিশ্বাসী মুসলিম ঐতিহাসিকদের  বই থেকেও। ড. ওসমান গণির বই থেকে একটা উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। বনি নাজির গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে লেখা মুহাম্মদের একটি চিঠি উদ্ধৃত করে গণি লিখেছেন, “হে বনু নাজির তোমরা আমার সীমানা ছেড়ে দাও। আমার জীবননাশের চক্রান্ত দ্বারা তোমরা আমার সঙ্গে সন্ধি ভঙ্গ করেছোআমি তোমাদের দশদিন সময় দিলাম। যদি তোমাদের কাউকে এরপর আমার সীমানায় দেখি তাহলে তার শিরোচ্ছেদ করা হবে।(মহানবী, পৃ – ২৭২) মুহাম্মদের প্রতি অন্ধানুগত্যশীল ড. গণি ইহুদিদের স্বদেশভূমি ত্যাগ করে যেতে মুহাম্মদ কর্তৃক প্রেরিত  হত্যার হুমকি সম্বলিত চিঠিকে অতি সোৎসাহে করেছেনতিনি লিখেছেন ‘এর উত্তরে ইহুদিদের কিছুই বলার ছিলো না।’ (সূত্রঃ – ঐ) প্রাণনাশের অভিযোগ যে বানানো তা ড. কিন্তু গণির লেখাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রাণনাশের চক্রান্তের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘তারা জিয়াদ বিন কাবকে (মতান্তরে আমর বিন জাহাশ) ঠিক করলো ঐ উচ্চ দেওয়াল হতে অতর্কিতে পাথর নিক্ষেপ করে হযরতকে বধ করার জন্যে।’ চক্রান্তের খবর কোথায় পেয়েছিলেন মুহাম্মদ? এর উত্তরে তিনি যা লিখেছেন তাতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে ইহুদিদের তাড়ানোর জন্যে ওটা ছিলো মুহাম্মদের মিথ্যে অজুহাত। গণি লিখেছেন যে মুহাম্মদকে সেই চক্রান্তের কথা নাকি আল্লাহ স্বয়ং  জানিয়েছিলো। ইহুদিদের বাকি দুটি  গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও মুহাম্মদের  তোলা অভিযোগগুলি  ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যে  ও বানোয়াট।  
শুধু ইসলামের বিস্তারের জন্যেই বিনা প্ররোচনাতেই অবিশ্বাসীদের উপর আক্রমণ করা যে মুহাম্মদের জিহাদি নীতির অঙ্গ ছিল তার প্রমাণ রয়েছে খৃস্টান রাজা-সম্রাটদের কাছে তাঁর প্রেরণ করা দাওয়াতের(ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ বা আহ্বান) পত্রাবলীতে। মুহাম্মদ বিধর্মী শাসকদের আক্রমণ করার আগে পত্র মারফৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দাওয়াত পাঠাতেন। যে রাজা বা সম্রাট সে দাওয়াত প্রত্যাখান করতেন  তাঁর বিরুদ্ধে মুহাম্মদ যুদ্ধাভিযান সংগঠিত করতেন। মক্কা বিজয়ের পূর্বে সে সব দাওয়াত-পত্রের বয়ান থাকতো  যথেষ্ট পরিশীলিত ও মার্জিত। কিন্তু মক্কা জয়ের পর সে ভাবগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়তখন দাওয়াত তথা আমন্ত্রণ-পত্র হুমকির  পত্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়।  ওমানের দুই খৃস্টান রাজা আলজুলান্দার পুত্র জাফর ও আবদের উদ্দেশ্যে পাঠানো  একটি  চিঠিতে সেই হুমকির প্রমাণ পাওয়া যায়।  সেই  চিঠিটির  বয়ান ছিলো  -  ‘পরম দয়ালু ও করুণাময় ঈশ্বরের নামে, মোহম্মদ বিন আবদুল্লাহর কাছ  থেকে আলজুলান্দার পুত্রদ্বয় জাফর ও আবদ’-এর নিকটে এ পত্র। তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, যারা সঠিক পথ বেছে নেয়। ইসলাম গ্রহণ করো, তাতে তোমরা নিরাপদে থাকবে। আমি ঈশ্বরের বার্তাবাহক সমগ্র মানবজাতির কাছে।  এতদ্বারা সব জীবিতদের আমি সতর্ক করছি যে, অবিশ্বাসীরা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। ইসলাম গ্রহণ করলে তোমরা রাজা হিসেবে বহাল থাকবে, কিন্তু ইসলাম থেকে বিরত থাকলে তোমরা রাজত্ব হারাবে এবং আমার ঘোড়াগুলো তোমাদের এলাকায় প্রবেশ করবে আমার নবীত্ব প্রমাণের নিমিত্তেওমান সরকারের কাছে মুহাম্মদের পাঠানো সেই চিঠির একটা কপি এখনো  সংরক্ষিত আছে।  সম্প্রতি  ওমান সরকার  অবশ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে চিঠিটি সরিয়ে দিয়েছে। (দ্রঃ জিহাদ/এম.এ.খান, পৃ – ৪১) 
খৃস্টান শাসকদের লেখা আর একটি চিঠির বয়ান থেকেও  প্রমাণ পাওয়া যায়  ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যে তিনি কতোটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলেন। এই চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন ৬৩০ খৃস্টাব্দে আয়লা গোত্রের এক যুবরাজকে সে চিঠিতেও সরাসরি হত্যার হুমকি ছিলো। চিঠিতে মুহাম্মদ  লিখেছিলেন, ‘‘হয় (ইসলামে) বিশ্বাস করো, নতুবা জিজিয়া কর দাওতোমরা জান জিজিয়া কী জিনিষ? যদি তোমরা ভূমি ও নদী পথে নিরাপত্তা চাও, তবে আল্লাহ ও তার নবীকে মেনে নাও। কিন্তু তাদেরকে বিরোধিতা ও অসন্তুষ্ট করলেই, আমি তোমাদেরকাছ থেকে কিছুই নেব না, যতক্ষণ না তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদর যুদ্ধ হবে এবং ছোটদের বন্দী ও বড়োদের হত্যা করবো। কারণ আমি আল্লাহর সত্যিকার নবী।’ (উদ্ধৃতি - জিহাদ/এম.এ.খান, পৃ – ৪১; মূল তথ্য সুত্রঃ মূর, পৃ – ৪০২) 
ইহুদিদের প্রতি কী ভয়ানক হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন তার কিছুটা আভাষ উপরের আলোচনার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে তিনি ইহুদিদের তাড়ানোর কাজটা সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি বলে আল্লাহর কাছে কত ব্যাকুল হয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আর্জি জানিয়েছিলেন মৃত্যুশয্যায় তার বর্ণনাও উপরে করা হয়েছে। কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেও  তার (আল্লাহ) উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন নি। তাই মৃত্যুর আগে তাঁর সাহাবীদের নিকট ওসিয়ত করে যান (নির্দেশ দিয়ে যান) আরব উপদ্বীপ থেকে যেন তাদের সকলকে বিতাড়িত করা হয়। সেই আদেশের বয়ান হাদিস থেকে পাওয়া যায়। হাদিসটি হলো “ওমর বিন আল- খাত্তাব কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর নবীকে বলতে শুনেছেন, আমি আরব উপদ্বীপ থেকে সমস্ত ইহুদি ও খৃষ্টানদের বিতারণ করবো এবং সেখানে মুসলিম ছাড়া আর কেউ থাকবে না  (বোখারী শরীফ ১৯/৪৩৬৬)   সেই আদেশ অক্ষর অক্ষরে পালন করে ছিলেন ২য় খলিফা ওমর বিন খাত্তাবএই ঘৃণ্য ও পৈশাচিক বর্বর ঘটনার  প্রমাণও  হাদিস থেকে পাওয়া যায়  “সে মোতাবেক ২য় খলিফা ওমর আরব উপদ্বীপকে ইহুদি-খৃষ্টান মুক্ত করেন।” (বুখারী শরীফ, ৩/৩৯/৫৩)।   

ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তার, ক্রীতদাসত্বকরণ ও  ধর্মান্তর  

মক্কা জয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের পর মুহাম্মদ দু বছরের বেশী বাঁচেন নি। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি তাঁর সাহাবীদের গোটা বিশ্বকে জয় করার জন্যে এতটাই উদ্বুদ্ধ ও উৎসর্গকৃত করে যান যে, তাঁর মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে তাঁর জিহাদী সাহাবীরা প্রবল শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। এবং প্রচন্ড ক্ষমতাধর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও তাঁরা ঢুকে যেতে সক্ষোম হয়। আর মুহাম্মদের মৃত্যুর এক শতাব্দীর মধ্যে ইসলামি সাম্রাজ্য বা খেলাফত হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম সাম্রাজ্য। ঝড়ের গতিতে আরব দেশ থেকে বেড়িয়ে পূর্বে ট্রান্সিক্সিয়ান ও সিন্ধু থেকে শুরু করে মিশর ও উত্তর আফ্রিকার সবটুকু জয় করে পশ্চিমে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে যায়। মুহাম্মদের ভয়ঙ্কর আবিষ্কার এই জিহাদি তত্ত্ব কীভাবে ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল তা বাখ্যার অতীত মুসলিম খলিফাগণ এবং মুসলিম শাসকগণ (ইসলামের খেলাফতি শাসনব্যবস্থা টিকে ছিল বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যে ১২৫৭ সাল পর্যন্ত, তারপর বিচ্ছিন্নভাবে আরো কোথাও কোথাও যেমন তুরস্কে, খেলাফতি শাসন ছিল তারপরেও অনেক কাল) যখন যে দেশ দখল করেছে সেখানে তাঁরা যে  কাজগুলি করেছেন সেগুলি হলো – ব্যাপক ধন-সম্পদ লুঠ, অবিশ্বাসীদের উপর সীমাহী অত্যাচার, অবিশ্বাসীদের গণহত্যা, বিধর্মীদের ব্যাপকহারে ক্রীতদাসত্বকরণ, ব্যাপক ধর্মান্তরকরণ এবং ইসলামি শাসনের প্রবর্তন। এই কাজগুলি করাই তো জিহাদের প্রধান লক্ষ্য। মুহাম্মদ স্বহস্তে অত্যন্ত নির্মমভাবে এই কাজগুলির বাস্তবায়ন করেছিলেন প্রথমে মদিনা ও পরে মক্কায়। মুসলিমরা সর্ব প্রথম কাফির তথা কোরেশদের হত্যা করে তাদের মালামাল লুঠ করে এবং কয়েকজনকে  বন্দি করে সহিংস জিহাদি কর্মকান্ডের সূচনা করেছিলো ‘নাখালা’ নামক মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থানে। সেটা ছিলো আবার এমন এক সময়ে যখন আরবের মানুষ কোনো বিষয়েই পরষ্পররের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতো না। আরবরা বছরে চার মাস হাতে অস্ত্র ধারণ করতো না কোনো অবস্থাতেই। ওটা ছিলো আরবের বহুকালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সেই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রথম লঙ্ঘণ করেছিলো মুসলমানরা। তা নিয়ে প্রবল সমালোচনা হয়েছিলো মুহাম্মদের বিরুদ্ধেমুহাম্মদ সে সমালোচনা অগ্রাহ্য করে স্বৈরাচারী শাসকের মতো তাঁর শিষ্যদের করা নিষিদ্ধ মাসের লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ডকে ঔদ্ধত্যভরে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আল্লাহর দোহায় দিয়ে তিনি বলেছিলেন আল্লাহ বলেছে, নিষিদ্ধ মাসে হত্যা করার চেয়ে ফিৎনা (আল্লাহ্ব আল্লাহর নবীর বিরোধিতা করা) বেশী গুরুতর। তার কিছুদিন পরেই হয়ছিলো বদর যুদ্ধ, যার কথা একটু পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, যেটা ছিলো ইসলামি  জিহাদের ইতিহাসে প্রথম বড়ো ধরণের লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ড। এই যুদ্ধে মুহাম্মদে নেতৃত্বে মুসলমানরা  কোরেশদের ৭০ জনকে হত্যা  ও ৭০ জনকে বন্দি করেছিলোতাদের কাছ থেকে পরে মুহাম্মদ মুক্তিপণ হিসেবে মোটা টাকা আদায় করেছিলেন। সেই লুঠের মাল ও মুক্তিপণের টাকার ভাগ নিতে মুসলমানদের অনেকের আপত্তি ছিলো। মুহাম্মদ আল্লাহর ওহি নিয়ে এসে বুঝিয়ে ছিলেন যে এ সবই আল্লাহর দান, তোমারা হৃষ্ট চিত্তে গ্রহণ করো। সেটাই ইসলামের নীতি হিসেবে মুহাম্মদ চালু  করেছিলেন আল্লাহর দোহায় দিয়ে ডাকাতি, লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ড ছাড়াও জিহাদের আর একটি কর্মসূচী ছিলো বিধর্মীদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তর করা। এর সূচনা করেছিলেন  স্বয়ং মুহাম্মদ মক্কা জয়ের মধ্যে দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের পর।
উলামা ও মুসলিম ঐতিহাসিকরা  দাবি করেন মক্কার কোরেশরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে দলে মুসলমান হয়েছিল ইসলামের মতাদর্শ ও ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। এ এক জঘন্য ও ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার। কোরেশদের বিরুদ্ধে তাঁদেরই অভিযোগ যে তারা মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের উপর  নির্মম অত্যাচার করতো ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্যে এবং এক সময় তারা মুহাম্মদকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও  করেছিলো, ফলে তাঁকে মদিনা পালিয়ে আসতে হয়েছিলো। প্রায় ১২-১৩ বছর মুহাম্মদ মক্কায়  ধর্ম প্রচার করেছিলেন এত দীর্ঘ সময়ে মক্কায় কতজন মুসলমান হয়েছিলো? ড.গণি জানাচ্ছেন প্রথম পাঁচ  বছরে ১০০ জনেরো কম,  আর দশ বছরে ৪০০ জনের কাছাকাছি।(মহানবী, পৃ – ১৭১ ও ১৮২)  তাঁকে যাঁরা  প্রাণাধিক ভালোবাসতেন সেই পিতামহ (মোত্তালিব) ও চাচা (আবু তালিব) পর্যন্ত ইসলাম কবুল করেন নি, যদিও মুহাম্মদ তাদের কাছে বারবার কাতর কন্ঠে অনুরোধ  করেছিলেন যে কোরেশরা মুহাম্মদ ও ইসলামকে প্রত্যাখান করেছিলো এবং যারা মুহাম্মদকে হত্যা করতে চেয়েছিলো (এই অভিযোগটি মোটেই সত্য নয়), সেই কোরাশরা রাতারাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করে নিয়েছিলো – এ ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য হওয়া সম্ভব? এ এক নির্লজ্জ দ্বিচারিতা ও মিথ্যাচার বৈ নয়।  
ড.গণির মতো ঐতিহাসিকগণ মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁদের লেখা ইতিহাস থেকেও এই প্রমাণ  পাওয়া যায়ে যে কোরেশদের ইসলাম গ্রহণকরতে বাধ্য করা হয়েছিলো এবং প্রাণ রক্ষার তাগিদেই সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্বেও তারা স্বধর্ম ত্যগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গণির বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, তাহলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবেকোরেশদের অন্যতম প্রধান নেতা আবু সুফিয়ানের  মুহাম্মদের নিকট আত্মসমর্পণের ঘটনার বিবরণ দিয়ে  তিনি লিখেছেন - “তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে আবু সুফিয়ানকে বললেন – ‘আপনি আপনার বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দিয়ে বলুন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি – আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। এবং মহম্মদ (দঃ) আল্লাহর দূত। নতুবা আপনার মাথা শরীর থেকে পৃথক হয়ে যাবে।’ আবু সুফিয়ান তাই করলেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় আবু সুফিয়ান তাঁর দেহ ধড় ও মাথাকে একত্রে রাখার জন্যই ইসলাম গ্রহণ করলেন।” (পৃ – ৩৩০) গণির ঐ পুস্তকে এ রকম আরো কিছু বর্ণনা আছে যা প্রমাণ করে মুহাম্মদ তাদেরকে ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেছিলেন। স্থানাভাবে সেগুলি উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।
ধরা যাক ইরানের কথা। ইরানের মানুষরা ছিলেন পারসিক। ইরান দখল করার পর সবাই ইসলামে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান হয়ে গেলোএমনি এমনি মানুষ যুগ যুগ ধরে যে ধর্মকে বিশ্বাস করে এসেছে সে ধর্মকে ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে? তারপর আবার ইসলামের মতো ধর্মকে, যে ধর্ম অন্য ধর্মাবলম্বীদের লুঠ-তরাজ ও হত্যায় সিদ্ধহস্ত? এটা একেবারেই অবিশাস্য। প্রকৃত ঘটনা হলো যেখানেই মুসলিমরা ক্ষমতা দখল করেছে সেখানেই  জোর করে ধর্মান্তর করিয়েছে এবং ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে মুসলিম জনসংখ্যারও সমান তালে বিস্তার ঘটিয়েছে। আমাদের ভারতও তার থেকে বাদ যায় নি
মুসলিমরা দাবি করে যে ভারতে ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে নি। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা জাত-পাত প্রথার কারণে উচ্চ বর্ণের মানুষদের অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে সাম্যবাদী ধর্ম ইসলামে দলে দলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়েছিলো . জাকির নায়েক এই দাবির সমর্থনে কী বলেছেন তা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দাবিকে সত্য বলে মনে করে হিন্দুদের মধ্যেকার একটা বড় অংশও এবং তারা তাদের এই কথা অবিরাম  প্রচার করেনকিন্তু এ দাবি সত্যের উপর একেবারেই প্রতিষ্ঠিত নয়। এ কথা ঠিক যে কিছু হিন্দু নিছক ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্যে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো, কিন্তু মূল ঘটনা হলো, ভারতে মুসলিম শাসকদের অধীনে ও তত্ত্বাবধানে  ব্যাপক অত্যাচার ও বল প্রয়োগের মাধ্যমেই  ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া  সংগঠিত হতো ও দীর্ঘকাল তা অব্যাহতো ছিলোভারতের অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে বিদেশী মুসলিমদের ভারত আক্রমণের সঙ্গে ইসলামের বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই। এমনকি তাঁরা ভয়াবহ আক্রমণ সংগঠিত করে অসংখ্য মন্দির, গীর্জা ও গুরুদ্বারগুলিকে লুঠ ও ধ্বংস করে সেসব স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন তার সঙ্গেও ইসলামের কোনো যোগ নেই বনলে দাবি করেছেন ভারতের ঐ ঐতিহাসিকগণ।  ঐ মুসলিম শাসকরা যা করেছিলেন তা শুধু ভারতের ধন-ভান্ডার লুঠ করা এবং  ও তাঁদের রাজ্য বা সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিপ্রায়েই । কিন্তু এসব দাবি সত্য ও সঠিক তথ্যের উপর মোটেই প্রতিষ্ঠিত নয়।  সত্যি যা তা হলো, বিদেশি মুসলিমরা প্রত্যেকে ভারত আক্রমণ করেছিলেন ইমানদার মুসলমান হিসেবে, যাঁরা মকে করতেন প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে জিহাদ করা ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক কর্তব্য) তাঁরা সেই ‘পবিত্র জিহাদ’  করার মানসেই ভারত আক্রমণ করেছিলেন। সেই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তার করা এবং ভারতের অবিশ্বাসীদের ইসলাম ধর্মগ্রহণে  বাধ্য করা। এ সব কথা  তাঁরা  তাঁদের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। সেই বিদেশী মুসলিম শাসকগণের সবার লেখা কথাগুলি উল্লেখ করার অবকাশ এখানে নাই। তাই মাত্র দুজন শাসকের কিছু কথা এখানে উদ্ধৃত করা হলো মাত্র। এ প্রসঙ্গে তৈমুর লং  যে কথাগুলি লিখে গেছেন তা হলো – “My principle object in coming to Hindustan (India) and in undergoing all this toil and hardship has been to accomplish two things. The first was to war with the infidels, the enemies of Islam; and by this religious warfare to acquire some claim to reward in the life to come. The other was a worldly object; that the army of Islam might gain something by plundering the wealth and valuables of the infidels; plunder in war is lawful as their mothers’ milk to Muslims who war for their faith, and the consuming of that which is lawful is a means of grace.”  (vide: Understanding Muhammad, Ali Sina, p-21, 22)  সুলতান মাহমুদের মন্ত্রী আবু নাসের আল উতবির লেখা থেকে সুলতান মাহমুদ কেন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তার কারণ জানা যায়। আবু নাসে আল-উৎবি  লিখেছেন,  মাহমুদের কনৌজ বিজয় কালে ‘নাগরিকরা হয় ইসলাম গ্রহণ করে বা তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে তরকারির খাবারে পরিণত হয়।’ (জিহাদ, এম.এ.খান, পৃ–১২১)  উৎবি আরও লিখেছেন, বারান দখলের সময়  ‘আল্লহর তরবারি খাপমুক্ত করে শাস্তির চাবুক তোলা হলে ১০ হাজার মানুষ ধর্মান্তরিত হতে ও মূর্তিপূজা প্রত্যাখান করতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠে।’ (সূত্রঃ – ঐ)  সুলতান মাহমুদের ভারতের উত্তম পশ্চিম অঞ্চলে অভিযান (১০০১-০২) সম্পর্কে আল-উতবি লিখেছেন, “মেঘের অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মত  ঝলসে উঠলো তলোয়ার এবং ধাবমান তারকার ন্যায় রক্তের বন্যা বয়ে গেলো। আল্লাহর বন্ধুরা পরাজিত করলো তাদের প্রতিপক্ষকে। মুসলমানরা অবিশ্বাসী আল্লাহর শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহুণ করতঃ তাদের ১৫০০০ লোককে হত্যা করলো ... তাদের বন্যজন্তু ও শিকারী পাখিদের খাদ্যে পরিণত করলো ... আল্লাহ তাঁর বন্ধুদেরকে এত পরিমাণ লুন্ঠনদ্রব্য প্রদান করলেন, যা পরিমাপ ও গণনার অতীত। এবং তৎসঙ্গে পাঁচ লক্ষ ক্রীতদাস, সুন্দর সুন্দর নর ও নারী।’ (সূত্রঃ পৃ – ২৪১) এরূপ আরো অজস্র দৃষ্টান্ত আছে যা থেকে মুসলমানদের ভারত আক্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ফলাফলের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়।

জিহাদের শিকার সর্বাধিক মুসলিমরাই 

ইসলামি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের প্রাবল্য পরিলক্ষিত হয় অমুসলিম দেশগুলি অপেক্ষা মুসলিম দেশগুলিতে অনেক অনেক বেশী। একবিংশ শতাব্দীর কথা যদি আমরা বিচার করি তবে দেখতে পাব ইসলামি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্যে প্রায়ই সংবাদের শিরোনামে থেকেছে যে দেশগুলি সেগুলির অধিকাংশই মুসলিম দেশ। সেই দেশগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ হলো লিবিয়া, তিউনসিয়া, তুরস্ক, মিশর, নাইজিরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি। আর এখন তো কয়েকমাস যাবৎ প্রতিদিনই সংবাদের শিরোনামে ইরাক ও সিরিয়া যেখানে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রত্যেকটি দেশেই যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলছে তা জিহাদই। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে  যারা জিহাদি কার্যকলাপে মত্ত হয়ে হত্যাকান্ড চালাচ্ছে তাতে হাজার হাজার মানুষ যারা মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে তারা বলা বাহুল্য যে সবাই মুসলমান। মুসলমান যদি মুসলমানকে মারে তা কি কখনও জিহাদ হতে পারে? ইসলামি বিধানে হতে পারে না। কারণ, ইসলাম অবিশ্বাসীদের হত্যা করার নির্মম ও ঘৃণ্য আদেশ দিয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের নয়। সেক্ষেত্রে বরং উল্টোটা বলেছে । বলেছে,  মুসলমান যেন কিছুতেই মুসলমানকে হত্যা না করে। কোরানে কোথায় এই সংকীর্ণ আয়াতগুলি  আছে তা উপরের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং  মুসলিম দেশগুলিতে মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা যে হিংসাত্মক ধ্বংসকান্ড পরিচালনা করছে এবং গণহত্যালীলা চালাচ্ছে  সেগুলি জিহাদের শ্রেণীতে পড়ার কথা নয়। তবুও যারা এসব হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কাজে প্রবলভাবে পাগলের ন্যায় মত্ত  তারা  নিজেদের মুজাহিদ বলে দাবি করছে। কিন্তু কেন? কী তাদের যুক্তি? তারা তাদের দাবির পেছনে যে যুক্তিগুলি প্রদর্শন করছে  তা কিন্তু এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া  মতো নয়।  ধরা যাক বাংলাদেশ, পাকিস্তান,আফগানিস্তান, নাইজিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলির কথা। এই দেশগুলিতে সম্পূর্ণ শরিয়তি আইন মেনে কোনো সরকার পরিচালিত হয় না। এই দেশগুলি কোরানকে তাদের সংবিধান হিসেবে পুরূপুরি গ্রহণ করে নি। কোরানের কিছু নিয়েছে এবং কিছু নিজেরা আধুনিক গণতান্ত্রিক আইন নিয়ে নিজস্ব সংবিধান তৈরী করেছে। কিন্তু ইসলামি নির্দেশ হলো, আল্লাহ যে সংবিধান (কোরান) দিয়েছে তার বাইরে গিয়ে মুসলমানরা নিজেরা কোনো আইন তৈরী করতে পারবে  না। দেশ, সমাজ ও পরিবার চলবে আল্লাহর আইনে, মানুষের তৈরী করা আইনে নয়। কারণ, আল্লাহর আইন নির্ভুল, নিঁখুত, পক্ষপাতিত্বহীন ও চিরন্তন। কোরানের আইন যে চিরন্তন ও তাতে সামান্য পরিবর্তন করা যাবে না তার উল্লেখ কোরানের মধ্যেই আছে। ১০/১৫ নং আয়াতে কোরান বলছে সে প্রসঙ্গে – “যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াত (নিদর্শনসমূহ) তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন যারা আমার সাক্ষাতের আশা করে না, তারা বলে – এটি ব্যতীত অন্য কোরআন আনো, অথবা একে বদলাও। তুমি বলো – আমার পক্ষে এটি বদলানো সম্ভব নয়। আমার প্রতি যা ওহি (প্রত্যাদেশ) হয় – আমি তাই-ই অনুসরণ করি, যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি, নিশ্চয় মহাদিবসে আমার শাস্তির আশঙ্কা আছে।” তাই ইসলামি আইনে যারা আল্লাহর আইনকে আংশিক গ্রহণ করেছে, আর আংশিক বর্জন করেছে তারা ইসলাম থেকে বিচ্যুত ও বিপথগামী। কোরান তাদেরকে মুনাফিক বলে আখ্যায়িত করেছে। আর আল্লাহ তো বলেছে মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও বড়ো শত্রু। তাই তো  মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে এবং জিহাদ করতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছে  মুসলইমদের। সেই আদেশই পালন করছে মুজাহাদিরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজিরিয়া,ইন্দোনেশিয়া পভৃতি মুসলিম দেশগুলিতে যাদের লক্ষ্য হলো মুনাফিকদের ক্ষমতাচ্যুত করে প্রকৃত আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্য গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠী বিদ্যমান যারা প্রতিনয়ত সংঘর্ষ করছে। অসংখ্য গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠী থাকলেও  মুসলমানরা  প্রধানতঃ মুসলমানরা তিনটি ধারায় সমান্তরাল সরল রেখায় দিক-বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটে চলেছে আল্লাহর পথে।  তারা পরষ্পরকে ইসলামের শত্রু বলে দোষারোপ করছে  এবং  নিধন করছে। এরা হলো শিয়া, সুন্নি ও আহমদীয়া মুসলিম জামাত। প্রত্যেকটি  গ্রুপ মনে করে তারাই প্রকৃত মুসলমান এবং মুহাম্মদের উম্মত ও আল্লাহর বান্দা। তাই তারা অন্যদের কাফিরদের থেকেও বড়ো ও জঘন্য শত্রু ভাবে। তাই তারা বিশেষ করে শিয়া ও সুন্নিরা পরষ্পরকে আল্লাহর শত্রু জ্ঞানে নির্মূল করতে পরষ্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধ ও নিধনকাণ্ড তাদের নিজেদের চোখে পবিত্র জিহাদ সেজন্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলিতে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে  সেই জিহাদ তথা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা  ঘটে চলেছে।  এখন ইরাক ও সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ চলছে সেখানেও দুটি প্রধান প্রতিপক্ষের একটি পক্ষ সুন্নি আর অপর পক্ষ শিয়া। বিদ্রোহীরা সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত, তাদের (ISIS বা ISIL) দাবি যে তারা প্রকৃত শরিয়তি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে  জিহাদ করছে। তারা ইতিমধ্যেই  ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অংশ দখল করে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে যেখানে তারা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে এবং একজনকে খলিফা মনোনীত করে খেলাফতের দায়িত্ব (ক্ষমতা) তার হাতে তুলে দিয়েছে। এভাবে মুসলিম দেশগুলিতে যে জিহাদ চলছে সেই জিহাদের বলি হচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে মুসলিমরা, আর জিহাদের নামে  হত্যালীলা  চলছে তো চলছেই, এর শেষ যে কোথায় কেউ জানে না।
উপসংহার 

ইসলামি জিহাদ নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে বিতর্ক চলছে তার মূল কথা হলো হলো – এক পক্ষ বলছে,  ইসলামি জিহাদ মানে আধ্যাত্মিক যুদ্ধ, নিজের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ, নিজের মধ্যে যে অমানুষটা আছে তাকে হত্যা করে সৎ ও সুন্দর মানুষ হওয়ার যুদ্ধ। অপর পক্ষ বলছে,  ইসলামি জিহাদ মানে অমুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আক্রমণাত্মক ও হিংসাত্মক যুদ্ধ যার লক্ষ্য হলো দেশে দেশে এবং সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর শাসন কায়েম (প্রতিষ্ঠিত) করা। কোন পক্ষ সত্য কথা বলছে তা আমরা কেউ আমাদের পছন্দ-অপছন্দের ভাবনা থেকে, কিংবা কোনটা ইসলামের প্রবর্তক ও প্রধান ধর্মগুরু মুহাম্মদ বলতে পারেন, কোনটা বলতে পারেন না এমনতর অনুমান থেকে সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। সত্যতা নিরূপণ করতে হবে প্রামাণ্য নথিপত্র থেকে। আর সে নথিপত্র যে কোরান, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ও স্বয়ং মুহাম্মদের ঘটনাবহুল  জীবন তা বলা বাহুল্য। এসব প্রামাণ্য নথিপত্রগুলি আমাদের কাছে সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করে যে, ইমাম আল – গাজ্জালী থেকে শুরু করে মোল্লা ওমর ও ওসামা বিন লাদেন পর্যন্ত,   অর্থাৎ মধ্য যুগের শীর্ষস্থানীয় ইসলামি পন্ডিত থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের শীর্ষস্থানীয় ইসলামি পন্ডিতগণ ইসলামি জিহাদের যে ফতোয়া (ইসলামি বিধান) দিয়েছেন সেটাই  ইসলামসম্মত। অপরদিকে তথাকথিত  উদারপন্থী উলামা ও বুদ্ধিজীবীরা ইসলামি জিহাদকে একটা আধ্যাত্মিক যুদ্ধ বলে অবিরাম যে প্রচারণা সংগঠিত করে চলেছেন তা নিশ্চিতভাবেই অবাস্তব, মনগড়া এবং  পরিকল্পিত এক  মিথ্যাচারের বেনজির দৃষ্টান্ত  বৈ নয়।       

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...