Sunday, July 7, 2013

পঞ্চায়েত ভোট ও ‘রমজান’ নিয়ে সরকার যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করলো তার নিন্দা করার ভাষা নেই


২৮ শে জুন ও রা জুলাই , মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দু দুবার সুপ্রীম কোর্টে গলা ধাক্কা খেলো রাজ্য সরকার । এই সরকার মানতেই চায় নি যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সংগঠিত ও  পরিচালনা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও অধিকার সংবিধান ন্যাস্ত করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাঁধে রাজ্য সরকার তাই নির্বাচন কমিশনারের সমস্ত প্রস্তাব উপেক্ষা করে নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছিল । এমন কি উপযুক্ত নিরাপত্তার জন্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন, রাজ্য তা অগ্রাহ্য করেছিলফলে নির্বাচন কমিশন গিয়েছিল আদালতে । সেই মামলায় সুপ্রীম কোর্ট মাত্র এক ঘন্টারও কম সময়ের শুনানি শেষে ২৮ শে জুন জানিয়ে দেয় যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে শেষ কথা বলবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনই এবং নির্বাচনের দফা, তারিখ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশ্নে কমিশন যা যা বলেছে সুপ্রীম কোর্ট তার সবগুলোই মেনে নিয়ে নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করে দিয়েছে ।  এই রায়কে সরকারের গলা ধাক্কা খাওয়া বললেও কম বলা হয় । কিন্তু তাতে কি ! সরকার আর একটা গলা ধাক্কা খাওয়ার জন্যে চার দিনের মাথায় রা জুলাই আবার সুপ্রীম কোর্টে গেল । এবার আবদার  – রমজান মাসে ভোট করা যাবে না , নতুন করে ভোটের নির্ঘন্ট তৈরী করতে হবে । পরের দিনই  সুপ্রীম কোর্ট এক কলমের খাঁচায় সে আবদা্রো নাকচ করে দেয়  এবার আর শুধু গলা ধাক্কাই নয়, তার সঙ্গে দেয় প্রচন্ড একটা ধমকও । ধমকের সুরেই বিচারপতি  বলেন - ধর্মীয় আবেগ নয়, সবার উপরে থাকবে সংবিধানইবিচারপতি রাজ্যের আইনজীবিকে আরো বলেন - কেন্দ্রীয় বাহিনী দিতে আপনারা  গড়িমসি না করলে আগেই তো ভোট হয়ে যেত । রোজার মাসে ভোটের জন্যে তো দায়ী আপনারাই   
রাজ্য সরকার অপদস্থ হলে রাজ্যের মানুষ হিসেবে আমরা লজ্জায় অবনত হইকারণ, তাতে মাথা হেঁট হয় গোটা রাজ্যেরই, শুধু শাসক দলের মাথা হেঁট হয় না । কিন্তু আমাদের সরকারটা এমন একটা সরকার যারা তাদের নিজেদের মান-সম্মান নিয়ে মোটেই ভাবিত নয় , রাজ্যের মান-সম্মান তো পরের কথা ।  নিজেদের মান-সম্মান জলাঞ্জলি দেওয়ার অধিকার যে কারও আছে, কিন্তু কোনো সরকারের যে তার রাজ্যের মানুষের মান-সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার নেই এমন ন্যায়সংগত চিন্তা-ভাবনা এই সরকারের কাছে একেবারেই মূল্যহীন ও অর্থহীন । এই সরকার যা যা করেছে  সব জেনে বুঝেই করেছে । আদালতে যে সরকারকে গলাধাক্কা খেতে হবে তা সরকার বিলক্ষণ জানতো । কারণ, পঞ্চায়েত আইনে এত সুস্পষ্ট ভাষায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার সার্বভৌম দায়িত্ব দিয়েছে যা বুঝবার জন্যে আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার লাগে না । সরকার এও জানতো যে নভেম্বর মাসে ভোট করানোর সুযোগ নেই । তবুও নির্বাচন কমিশনকে ঐ সময়ে ভোট করার প্রস্তাব দিয়েছিল , এটা জেনেই যে কমিশন তা প্রত্যাখান করবে । মোটের উপর মোদ্দা কথা হলো সরকার সচেতনভাবে এবং পরিকল্পনা মাফিকই সমস্ত বেআইনী পদক্ষেপগুলি নিয়েছে একের পর এক নিয়েছে  বারবার নিজের মুখ পুড়িয়েছে । 
     সরকার যে বারবার নিজের মুখ পোড়াচ্ছে  তার পশ্চাতে সরকারের একটা কুমতলব কাজ ছে । সরকার মতলব করেছিল – লোকসভা ভোটের আগে  পঞ্চায়েত ভোট করবে না । আর যদি করতেই হয় , তবে ভোটের নামে এমন প্রহসন করবে যাতে পুলিশি প্রহরায় শাসক দল সহজেই ভোট লুট করে পঞ্চায়েতের দখল নিতে পারে । এটা যে ফালতু কোনো অভিযোগ নয় তার সাক্ষী এখন গোটা রাজ্যরাজ্যবাসী দেখেছে  মনোনয়ন পর্বে কীভাবে শাসক দল বিরোধীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে । এবং দেখেছে কীভাবে পুলিশ শাসক দলের ভৈরববাহিনীকে প্রহরা ও সুরক্ষা দেওয়ার কাজে কত নগ্ন ভূমিকা পালন করেছে । সরকার যথা সময়ে পঞ্চায়েত ভোট করাতে চায় নি,  কারণ তারা আশঙ্কা করেছিল যে পঞ্চায়েত ভোটে আশানুরূপ ফল হবে না এবং তেমন যদি হয় তবে  লোকসভা ভোটে তাদের বিপর্যয় বা ভরাডুবি অনিবার্য হয়ে উঠবে ।
 এই জন্যেই  জনগণের ভোটাধিকার তথা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার পরিকল্পনা সরকার করেছিল । পাশাপাশি এই ছকও কষেছিল তাদের কীভাবে ভোট বাঞ্চাল করার হীন ষড়যন্ত্র মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে চাপিয়ে দেবে নির্বাচন কমিশনার ও বিরোধী দলগুলোর ঘাড়ে । আর যদি ভোট করতেই হয় তাহলে তারজন্যে কী পরিকল্পনা ছিল সেটা উপরে আলোচনা করা হয়েছে ।  
এই হীন পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র আড়াল করার জন্যে অনর্গল মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের বিরুদ্ধে । তিনি নাকি শাসক দলকে হারানোর জন্যে সিপিএম ও কংগ্রেসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শীতকালে ভোট করলেন না তিনি নাকি ভোট বিরোধীদের সঙ্গে যোগসাজস করে ভোট বাঞ্চাল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন । তারজন্যেই নাকি ভরা বর্ষায় ভোট  হচ্ছে তিনিই নাকি মুসলমানদের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করে রমজানে ভোটের ব্যবস্থা করলেন । এ ছাড়াও আরো অন্যভাবে অত্যন্ত কুৎসিত ভাষায় ও কদাকার ঢঙে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হচ্ছে । যেভাবে অনর্গল মিথ্যা প্রচারণার মধ্য দিয়ে নিজদের অন্যায় ও অপকর্মকে আড়াল করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে এই সরকার তা দেখলে নির্ঘাতগোয়েবলসও লজ্জা পেত ।  
 যেহেতু ঘটনাচক্রে ভোটের নির্ঘন্ট পড়ে গেছে রমজান মাসেআর যায় কোথা ?  ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসলিম সমাজের ধর্মীয় সংগঠনগুলি এবং ধর্ম-ব্যবসায়ী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ শুরু করলো এমনভাবে হৈ চৈ যেন রমজান মাসে ভোট মানেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের উপর একটা ঘোর বিপর্যয় নেমে আসা । রাস্তায় তাঁরা শুরু করলেন দাপাদাপি । না , রমজান মাসে ভোট কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না । মুসলমানপদের বিরুদ্ধে এটা এক গভীর ষড়যন্ত্র । রমজান মাস পবিত্রতম মাস, এবাদতের মাস , আত্মশুদ্ধির মাস, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে আল্লহর দয়া-দাক্ষিণ্য লাভের মাস- মুসলমানদের এই মাসের অপরিসীম করুণা ও কর্মফল থেকে বঞ্চিত করার জন্যে ষড়যন্ত্র করেই রমজান মাসে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে । রমজান মাসে ভোট করা উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের  পঞ্চায়েত ভোট থেকে দূরে সরিয়ে রাখা ।  ষড়যন্ত্রষড়যন্ত্রনিশ্চিতভাবেই এ এক গভীর ষড়যন্ত্রবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুসলিম বিরোধী ব্রাহ্মণ নারী মীরা পান্ডে এক ভঙ্কর ষড়যন্ত্র করেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে । এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হবে । ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের সংগঠনগুলি বিক্ষোভের ডাক দিলেন মীরা পান্ডের বিরুদ্ধে ।
তৃণমূলের প্রধান ও সরকার তো বেজায় খুশী । মীরা পান্ডে ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ব্যবহৃত মিথ্যা কথাগুলি বহু ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে আসছিল । নতুন অস্ত্রের সন্ধানে ছিলেন ঠিক এই সময়েই তাঁর বিশ্বস্ত মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও তাদের সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো তাঁর হাতে তুলে দিলেন একটা ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক ধারালো অস্ত্র, মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার এক মোক্ষম অস্ত্র । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চুলোয় যাক, সেই অস্ত্র নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে একদিকে নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন মাঠ-ময়দানে, আর একদিকে ছুটলেন সুপ্রীম কোর্টে ভোট পিছানোর নাম করে ভোট বাঞ্চাল করতে । দারুণ অস্ত্র ! দু দিকেই কাটবে । ভোট পিছলে খুব ভালো, না পিছলেও ভালো ।   
ভোট পিছতে পিছতে রমজানে এসে গেলো, তারজন্যে যে সরকারই দায়ী তা বলা বাহুল্য । আর সে কথা তো বলেছেন স্বয়ং সুপ্রীম কোর্টের  বিচারপতি । কিন্তু গোটা দেশজুড়ে শাসক দল , সরকার ও মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দগণ তোলপাড় করছেন এই মিথ্যা কথা প্রচার করে যে,  বিরোধী দলগুলি ও নির্বাচন কমিশনার যোগসাজসের ফলেই রমজান মাসে ভোট হচ্ছে  যারফলে মুসলমানরা পড়েছে গভীর বিপাকে    
 মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দগণ এমনভাবে বিষ ছড়ানোর ঢঙে প্রচার করছেন যেন রমজান মাসে এর আগে পৃথিবীতে কোথাও ভোট হয় নি । ব্যাপারটি কি সত্যি তাই ? আমাদের ভারতেই তো ভোট হয়েছে যার বহু উদাহরণ আছে । বিহারে সাত দফায় ভোট হয়েছে ২০০৫ সালে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে, আর ঈদ ছিল ৫ ই নভেম্বর । ২০০৮ সালে বিহারে ও দিল্লীতে রমজানে মাসে ভোট হয়েছে । এছাড়া অনেক উপনির্বাচন হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রমজান মাসে । কই তখন তো কলকাতার মুসলিম ধর্মীয় নেতা ও সংগঠনগুলিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র বলে চিৎকার করতে শুনি নি । আগামী ২৭ শে জুলাই অর্থাৎ সামনের রমজানেই কোয়েথে অনুষ্ঠিত হবে সংসদের নির্বাচন । কোয়েথতো শুধু মুসলিম প্রধান দেশ নয়, ইসলামি রাষ্ট্রও । তাহলে কি কোয়েথের সরকার সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে ?  কী বলেন মোল্লা-মুফতিগণ ?
 রমজান মাসে কেন ভোট করা যাবে না  এই প্রশ্নে যে সব যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে  তার বেশীরভাগই অতিশয় শিশুসুলভ ও হাস্যকর এবং কিছু আছে যা স্ববিরোধীতায় পরিপূর্ণ । তাঁদের সেই যুক্তিগুলি অপযুক্তি বৈ নয় । সেগুলির সবটার জবাব দিলে তা একটা গ্রন্থের আকার নেবে । তাই প্রধান কয়েকটি যুক্তির উপরে দৃষ্টিপাত করা যাক ।
একটি যুক্তি হলো – সারাদিন উপোষ রাখলে শরীর দুর্বল, ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে । এই অবস্থায় লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়া খুব কষ্টকর ব্যাপার । আর ভোট কর্মীদের পক্ষে ভোট নেওয়া কিংবা রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষে ভোটের প্রচার করা তো কার্যত অসম্ভব । এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নিতে চায় যে রোজা রেখে ভোট করা বা ভোট নেওয়া নিশ্চয় শক্ত কাজ । কিন্তু অসম্ভব - এ কথা বলা অতিশয়োক্তি বৈ নয় । মুসলমানদের যাঁরা শ্রমজীবী ও গরীব মানুষ তাদের জন্যে কি আল্লাহ্‌ রোজা ছাড় দিয়েছে ? তাঁদের তো দিনে হাড়ভাঙা খাটনি খাটতে হয় দিনে ৮/১০ ঘন্টা । আবার তাদের রোজা রাখাও ফরজ ( আবশ্যিক কর্তব্য ) । ব্যবসায়ীরা তো দিনে ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করেন । মুসলমানরা একমাস রোজা রেখেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে পারবেন , কিন্তু ভোট করতে পারবেন না – এটা কী রকম যুক্তি  ?
দ্বিতীয় যুক্তি হলো – রোজার মাস শুধু উপবাস করা নয়, এবাদতের( আল্লাহ্‌কে বিশেষভাবে ডাকা ) মাসও বটে । এই মাসে ভোট হলে মুসলমানদের এবাদত করায় বিঘ্ন ঘটে । কিন্তু এবাদত বলতে যা কিছু বোঝায় তাতো সবই হয় রাত্রি বেলায় । একটা অতিরিক্ত নামায ( তারাবির নামায ) পড়তে হয় রাতের নামাযের পর । আর মাসের শেষের দিকে ৫/৭ টা রাত্রি রাত জেগে এবাদত করার রীতি আছে যা বাধ্যতামূলক নয় । অর্থাৎ এবাদত যা করার তাতো রাত্রিতে, সুতরাং রোজার মাসে ভোট হলে এবাদত করায় বিঘ্ন ঘটে এ কথা আসে কী করে ? আর তাই যদি হয়, তবে শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ী মুসলমানরা কি এবাদত করেন না ? নাকি ইসলাম ধর্মে তাঁদের এবাদতের জন্যে কাজকর্ম বা বাণিজ্য করা বন্ধ রাখতে হয় ?
তৃতীয় যুক্তি হলো – রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস । এ সময় মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, গুজব করা, কুৎসা করা ইত্যাদি খারাপ কাজ করা নিষেধ । সুতরাং রোজার মাসে ভোট হলে আত্মশুদ্ধির মত মহৎ কাজে বিঘ্ন ঘটে , কারণ ভোটে তো এই খারাপ কাজগুলো করতেই হয় । সুতরাং রোজার মাসে ভোট মেনে নেওয়া যায় না । এ ক্ষেত্রে তাহলে কয়েকটা প্রশ্নের উদ্রেক না হয়ে পারে না ? রমজান মাস বাদে সারা বছর কি তবে ইসলাম ধর্মে খারাপ কাজগুলি করার অনুমতি আছে ? কিংবা, ভোটে এইসব খারাপ কাজগুলি করতেই হবে কেন ? নাকি ইসলাম ধর্ম বলেছে ভোটের সময় মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অপপ্রচার করা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা প্রভৃতি খারাপ কজগুলি খুব একটা দোষের নয় ? নাকি ভোটে ধর্মীয় নেতারাও ব্যাপক মিথ্যা কথা বলেন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন এবং অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পড়েন ?  তাই কি তাঁরা ভাবছেন যে ভোটে তাঁদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে ? নাকি নির্বাচন কমিশন বলেছে ভোটে  খারাপ কাজ করতে ? এই সব প্রশ্ন যদি অবান্তর হয়,  তবে রোজার মাসে ভোট হলে আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া ব্যহত হবে কেন ?
রমজান মাসে ভোট হলে মুসলমানদের সমস্যা হবে, তাদের ধর্মাচরণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি – চারিদিকে শুধু এই একটাই প্রচার । পশ্চিম বঙ্গে যেন আর কোনো সমস্যা নেই । মোল্লা-মুফতি-ইমামদের সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করছে সবাই , সব রাজনৈতিক দল , এ ক্ষেত্রে ডান বাম কোনো পক্ষই কম যায় না । কিন্তু ভোট যদি রমজানের জন্যে আরো পিছিয়ে যায় তবে কি কি সমস্যা হতে পারে সে কথা কেউ বলছে না । আমরা একবার সে দিকে লক্ষ্য করি । বিস্তারিত আলোচনা করা অবকাশ নেই , প্রধান ২/৩ টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই । ইতিমধ্যেই বিগত সমস্ত পঞ্চায়েত বডিগুলির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে । ফলে গ্রামে উন্নয়নের কাজ স্তব্ধ । এর ফলে কারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ? ১০০ দিনের কাজ বন্ধ , কর্ম দিবস তৈরী হয় এমন সব কাজ বন্ধ । ফলে গরীব মানুষ পঞ্চায়েতের কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন । নলকূপ খারাপ হলে , হচ্ছেও, ভালো করার কেউ নেই । কোথাও যদি বাঁধ কেটে যায় এই বর্ষায় এবং বন্যার সৃষ্টি হয়, তবে সেই বাঁধ মেরামত করে বন্যতা প্রতিরোধ করার কেউ নেই । মানুষের এখনই প্রধানের একটা ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট প্রয়োজন, তাঁরা পাবেন না । এখনই একটা রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট প্রয়োজন , মানুষ সেটা পাবেন না । আরও অন্যান্য বহু প্রয়োজন হতে পারে যা পঞ্চায়েত ছাড়া মিটবে না । পঞ্চায়েত নির্বাচন ঠিক সময়ে না হওয়ার জন্যে ইতিমধ্যেই এরূপ বহুবিধ সংকট তৈরী হয়েছে । যত ভোট পিছবে, এই সঙ্কট ততো গভীরতর হবে, প্রসারিত হবে ।
রমজান মাসে ভোট হলে কি সমস্যা,  ভোট আরো পিছিয়ে গেলে কি সমস্যা – এই দুটো জিনিষ তুলনামূলকভাবে আলোচনা করলে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, রমজানের অজুহাতে ভোট পিছিয়ে দিলে অনেক বেশী সমস্যা ও ক্ষতি হবে জনগণের যাঁদের মধ্যে ২৭% মুসলমানও আছেন । কিন্তু এ কথা বলবার লোক নেই, দল নেই । কিন্তু মোল্লা সমাজকে তোষণ করার লোক ও দলের অভাব নেই ।
মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা ও সাম্প্রদায়িক মুসলিম সংগঠনগুলি সাধারণ মুসলমানদের কথা কোনোদিনই ভাবেন না। মুসলিম সমাজ যত ধর্মীয় ভাবাবেগে ভাসবে তাঁদের তত লাভ । কারণ,ধর্মই তাঁদের একমাত্র পুঁজি, এই পুঁজিকে রক্ষা করার জন্যে মুসলমানদের ধর্মীয় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি না দিয়ে তাঁদের উপায় কী ।  জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ যত বৃদ্ধি পাবে ওঁদের ব্যবসা তত বাড়বে, পসার তত বাড়বে । দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, সাধারণ মুসলমানদের জীবন-জীবিকার কথা ওঁরা ভাববেন কেন ? রমজান মাস কে হাতিয়ার করে ওঁরা যে ধরনের সংকীর্ণ তারফলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির হাতই শক্তিশালী হবে । এসব কারণে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক ও বিশ্বাসের জায়গাটা কিছুটা হলেও যে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা অনস্বীকার্য । খুবই পরিতাপের কথা হলো , এত বড়ো ক্ষতি যাতে না হয় সে কথা কোনো দল ভাবলো না । সংখ্যালঘুদের ভোটগুলি পেতে হবে,
তারজন্যে মোল্লাতন্ত্রকে তোষণ ( মুসলিম তোষণ নয়) করতে হবে , দেশটা গোল্লায় যায় যাক – এটাই এখন সব দলের নীতি , সব রাজনীতির শেষ কথা । এখানে সবাই সমান । মোল্লাদের তোষণ করতে মমতার সরকার ভোট পিছানোর আর্জি নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে পড়িমরি করে সুপ্রীম কোর্টের চৌকাঠে গিয়ে হত্যে দিলেন । তার পিছন পিছন ছুটলো কংগ্রেস দলও । ছুটলেন সিপিএমের বিপ্লবী নেতা রেজ্জাক মোল্লাও । তিনি আবার মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার ‘নয়া জামানা’ নামের সংগঠন না অফিস খুলে বসে আছেন । মোল্লাতন্ত্র তোষণের কী নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা চলছে চারিদিকে !
মমতা ব্যানার্জ্জীর তোল্লা পেয়ে রমজান ইস্যুতে মোল্লা-মুফতি-ঈমাম সমাজ নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে এবং সুপ্রীম কোর্টের ঘাড়ে চেপেও প্রলয় নৃত্য শুরু করতে চেয়েছিল । সুপ্রীম কোর্টকে ধন্যবাদ যে এক মূহুর্ত দেরী না করে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে । অজস্র ধন্যবাদ যে মীরা পান্ডেকেও যে,  তিনি সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নে কোনো আপোষ করেন নি ,  সরকার, শাসক দল এবং মোল্লাতন্ত্রের কাছে মাথা নত করেন নি । সাবাশ মীরা পান্ডে ! আপনাকে কুর্ণিশ জানাই । 
written on 03.07.2013

সেক্যুলার তুরস্কের ইসলামায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তরুণ তুর্কিদের বিক্ষোভে সমগ্র তুরস্ক উত্তাল


মাত্র ৭.৬ কোটি মানুষের একটি ছোট্ট দেশ তুরস্ক ।  এক যুগের কিছু অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন রয়েছে ইসলামপন্থী দল Justice and Development Party(AKP) মুসলিম মোল্লা সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অন্তহীন গর্ব এই দেশটিকে নিয়ে । তুরস্ক নাকি প্রকৃতই একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠেছে । ইসলামিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ? ইসলামিক এবং গণতান্ত্রিক ? এ রকম আবার হয় নাকি ? কী হাস্যকর ! তা যাই হোক,  সেই তুরস্কের  মানুষ এখন প্রধান মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীতে উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল একটা নিরীহ ইস্যুতে । দাবী ছিল একটি পার্ক বাঁচানোর  সেই আন্দোলন দমন করতে পুলিশ অমানবিক ও হিংস্র পদক্ষেপ নেয়   তার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশেপুলিশ দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়াতে থাকে । পুলিশের আক্রমণে ( ১৩জুন পর্যন্ত) মারা গেছে  ৪(চার) জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ বিক্ষুব্ধ  মানুষ তাই এখন  প্রধান মন্ত্রী রিসেপ তায়িপ এরদোগানের পদত্যাগ চায়ছে
তথাকথিত ইসলামি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের  শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের সে কি বীভৎস রূপ ! তা দেখলে হিটলার-মুসোলিনিরাও লজ্জা পেত । কয়েক শ’ নিরীহ পরিবেশবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা ইস্তানবুলের বিখ্যাত গেজী পার্কটি বাঁচানোর জন্যে গত ২৯শে মে সন্ধ্যায় জড়ো হয়েছিলেন সেখানেকারণ পরের দিন শুরু হবে পার্কের সমস্ত গাছপালা নিধন করার কর্মকাণ্ড । বিশাল সে পার্কে আছে ৬০০টি বৃক্ষ যার মধ্যে অসংখ্য শতাব্দী প্রাচীন । স্বভাবতঃই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে পার্কটির গুরুত্ত্ব অপরিসীম । সেটা ধ্বংস করে  নির্মাণ করা হবে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সেনা ছাওনির আদলে একটা স্থাপনা, এবং এক বিশাল শপিং মল সেই পার্কটিকে বাঁচাতে সেদিন সেখানে জড়ো হয়েছিলেন । তাঁরা এসেছিলেন  পতি-পত্নীপুত্র-কন্যা  সহ সপরিবারে ভেবেছিলেন হয়তো , সঙ্গে শিশু ও নারীরা থাকলে অন্ততঃ মানবতার খাতিরেও প্রশাসন কঠোর মনোভাব নেওয়া থেকে বিরত থাকবে । কিন্তু সরকার তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে একটু দ্বিধা করে নি । পর দিন ভোরবেলা তাঁরা  সবকটা বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে মানব প্রাচীর তৈরী করেছিলেন । সেই মানব প্রাচীরগুলো নির্মমভাবে ভেঙে দিয়েছিল পুলিশ  নির্দয়ভাবে জল-কামান, রবার বুলেট , টিয়ার গ্যাসে সেল এবং লঙ্কার গুড়ো স্প্রে করার মেসিন চালিয়েবলা বাহুল্য যে নারী-শিশু সহ আন্দোলনকারীদের ঐ নিরীহ জমায়েতকে ওখান থেকে সরানোর জন্যে এত নৃশংসভাবে বলপ্রয়োগ করা আবশ্যক ছিল না । কিন্তু সরকার বোধহয় একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল সমগ্র দেশবাশীকে যে সরকারের কোনো কর্মসূচী ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা বিরোধিতা বরদাস্ত করা হবে না ।  
     এত বড় একটা খবর সংগ্রহ করার জন্যে সেদিন কোনো সংবাদ মাধ্যম সেখানে উপস্থিত ছিল না  কোনও  মাধ্যমকে ঢুকতে দেয় নি   আদর্শ ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই হলো নমুনা !  তবুও নৃশংস পুলিশি অভিযানের দৃশ্য ও খবর চাপা থাকে নি । স্থানীয় মানুষ দেখেছেন, মোবাইলে ছবি তুলেছেন –  মুখে মুখে, মোবাইলে মোবাইলে এবং ইন্টারনেটে খবর রাষ্ট্র হয়েছে হাওয়ার বেগে । পরের দিন,  ৩১শে মে তাই সন্ধ্যাবেলায় হাজার হাজাড় মানুষ ওই ঘটনার প্রতিবাদে জড়ো হয়ে যায়  ট্যাক্সিম স্কোয়ারে যেখানে গেজী পার্ক অবস্থিত । মানুষকে আটকানোর জন্য ট্যাক্সিম স্কোয়ার অভিমুখে ইস্তানবুলের সব কটা রাস্তা এবং মেট্রো ও ফেরী সার্ভিসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলতবুও বিক্ষুব্ধ মানুষদের আসা বন্ধ করা যায় নি । তাঁরা ইস্তানবুলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে এসে জড়ো হন এবং শুরু করেন বিক্ষোভ অবস্থানে । মানুষের প্রতিবাদের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে কোনো স্বৈরশাসকই উপলব্ধি করতে পারে না । পারেনি তুরস্কের  আদর্শ গণতান্ত্রিক সরকারও । বরং সরকার আরও অধিক শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উচিত(!) শিক্ষা দিতে প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করে । এবার লেলিয়ে দেয় দাঙ্গা পুলিশকে । গভীর রাতে অতর্কিতে তারা উন্মাদের ন্যায় জল-কামান, রবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের সেল ও লঙ্কার গুড়ো স্প্রে করা মেসিন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের উপর । মানুষের মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় টিয়ার গ্যাসের সেল, ফলে বহু মানুষের মাথা ফেটে যায় । লঙ্কার গুঁড়ো এত এত স্প্রে করা হয় যার ফলে অনেকের চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং কয়েকটা রাস্তার কুকুর ও বিড়াল মারা গেছেদুজন যুবকের উপর দিয়ে পুলিশ গাড়ি চালিয়ে তাদের পিষে দেয় ও তাঁরা ঘটনাস্থলেই মারা যান । এই বর্বরোচিত পুলিশি অভিযানে অসংখ্য মানুষ আহত হন ।
সরকারের এই নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন তারপর ছড়িয়ে যায় অন্যান্য শহরেও । রাজধানী শহরে আঙ্কারাতেওতথাপি সরকার নমনীয় না হয়ে দমন-পীড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করে আন্দোলনকে দমন করার জন্যেতখন বিক্ষোভকারীরা আত্মরক্ষার জন্যে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে ও নানা উপায়ে মারমুখী পুলিশের আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু করেন । ফলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিসের সংঘর্ষের ক্রমশঃ বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে ক্রমাগত আহত মানুষের সংখ্যাও । এই অবস্থায়  ৯ই জুন রবিবার প্রধান মন্ত্রী আন্দোলন তুলে নেওয়ার জন্যে আরও কঠোর মনোভাব নেন । অত্যন্ত কড়া ভাষায় হুমকি দেন । বলেন - পার্ক বাঁচানোর নামে তুরস্কের ভাবমূর্তি কলুষিত করার চেষ্টা হচ্ছে । এই আন্দোলনের পেছনে বিদেশী শক্তির হাত আছে । এটা বরদাস্ত করা হবে না । ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে । আপনারা ঘরে ফিরে যান , না হলে আরও অনেক চড়া মাশুল দিতে হবে ।
প্রধান মন্ত্রীর এ হেন মিথ্যা দোষারোপ ও হুমকি মানুষের অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল । তাঁরা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন । ফলে বিক্ষোভ-আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলো । ইস্তানবুল শহরের ট্যাক্সিম স্কোয়ারে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা দশ হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছেন এখন । সেখানে রাতভোর অবস্থান করছেন, বিক্ষোভ করছেন । তাঁদের এখন একটাই দাবী -  প্রধান মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে । সমাজের সর্বস্তরের মানুষে এই আন্দোলনে  সামিল হয়েছেনসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসেছেন অবস্থানকারীদের জন্যে পানীয় জল ও খাবার নিয়ে । আহত মানুষদের চিকিৎসার জন্যে এগিয়ে এসেছেন ডাক্তার ,উকিল,  ব্যবসায়ী , হোটেল মালিক , শ্রমিক-কর্মচারী, প্রভৃতি সব শ্রেণি , পেশা ও ধর্মের মানুষ । আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছে সমস্ত সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষদের নিয়ে ‘ ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ । এ যেন শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি । এদিকে আবার  অনেক পুলিশ অফিসার ও সাধারণ পুলিশ নিরীহ জনতার উপর টিয়ারগ্যাসের সেল ফাটাতে, রবার বুলেট দিয়ে আঘাত করতে এবং লঙ্কার গুঁড়ো স্প্রে করতে রাজী নয় তাঁরা চাকরী ছেড়ে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়ে গেছেন ।
 অবস্থা এমনই যেন গোটা দেশ প্রধান মন্ত্রী এবং তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধে ও ক্ষোভে ফুঁসছে । শাহবাগীদের মতই আন্দোলনকারীরা বলছেন – প্রধান মন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা কেউ আন্দোলন ছেড়ে যাবো না । ‘ ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ – এর মুখপত্র জানিয়েছেন যতদিন না তাঁদের দাবী আদায় হয় ততদিন এই স্কোয়ার ছাড়বেন না । তিনি বলেছেন – "We will stay in Gezi Park with all our demands and sleeping bags," একজন মার্কেটিং ম্যানেজারের দৃপ্ত ঘোষণা - - We will come here every day after work until he goes,"   আমরা সারাদিন কাজ করে প্রতিদিন সন্ধ্যায়  এখানে আসবো    যতদিন না এই প্রধান মন্ত্রী বিদায় নিচ্ছেন ।  
অবস্থা বেগতিক বুঝে মি. এরদোগান সুর নরম করেছেন । সে কথায় পরে আসছি । এখন প্রশ্ন হলো প্রধান মন্ত্রি এবং তাঁর দল ও সরকারের উপর গোটা দেশ এভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়লো কেন ? সে কি শুধু একটা পার্কের জন্য ? নাকি শুধু নিষ্ঠুর পুলিশি দমন-পীড়নের জন্যে ? না, ব্যাপারটা মোটেই তা নয় । মানুষের মনে নানা ঘটনায় অনেক অসন্তোষ ও ক্ষোভ জমে ছিল । পার্ক ধ্বংস করে সৌধ ও শপিং মল নির্মাণ করা এবং পুলিশের নৃশংস  দমন-পীড়নের ঘটনা অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র ।  গেজী পার্কে পুলিশের নৃশংস আক্রমণের ঘটনা যে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দিয়েছিল তা দাবানলের মত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে
কেন এই দাবানলের সৃষ্টি হলো ? উত্তর শোনা যাক ওদের মুখেই । একজন ফেসবুকে লিখেছেন-  all gathered to prevent the demolition of something bigger than the park: পার্কের থেকেও বড়ো কিছু ধ্বংস হওয়া প্রতিহত করতে সকলে জড়ো হয়েছে । কী বড়ো কিছু ? The right to live as honorable citizens of this countryএই কথার বাখ্যা দিতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, গোটা দেশটাই বিক্রী করে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে শপিং মল, বিলাসবহুল বহুতল আবাসন, পাঁচতারা হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, নিউক্লিয়ার প্লান্ট প্রভৃতি নির্মাণ করার জন্যে । আর এসব করা হচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের নামে । আমরা এ দেশের সম্মানীয় নাগরিক, কিন্তু আমাদের কোন কথা শোনা হয় না । আমাদের দেশ, আমাদের শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার কোনও অধিকার নেই । এভাবে চলতে পারে না । গোটা দেশ চলে যাবে মুনাফাখোর বহুজাতিক পুঁজিপতিদের হাতে, এটা আমরা দর্শকের মতো চুপচাপ বসে বসে দেখতে পারি না । সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করেছে , সরকারের জনবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সমালোচনা করার অধিকারও নেই । সমস্ত মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ  আরোপ করেছে । সরকারের সমালোচনা করার জন্যে নানা অজুহাতে বহু কবি,লেখক, শিল্পী-সাহিত্যক, প্রভৃতি বিশিষ্টজনদের সরকার গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী করে রেখেছে ।
এ সবের চেয়েও অনেক তীব্র জ্বালা বুকে তাঁদের জমে রয়েছে । ভয়ঙ্কর অভিযোগ হল সরকারের বিরুদ্ধে যে, সরকার জনগণের ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে শুরু করেছে । পরিস্থিত এমন পর্যায়ে গিয়েছে যা সহ্যের অতীত । মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, গণতন্ত্রের কথা বলছে , আর ধীরে ধীরে শরিয়তি আইন ও বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে । গর্ভপাত করা, সিজার করে সন্তান প্রসব করা, বিমান সেবিকাদের ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া, অ্যালকহল পান করা, অ্যালকহল বিক্রী করা প্রভৃতির উপর ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে । নারী কী পোশাক পরবে তা বলে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের  আবার বোরকা-বন্দী করার চেষ্টা হচ্ছে । নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের উপর মাত্রাহীন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে । এভাবেই  দেশটাকে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ ও অন্ধকার যুগের শরিয়ত শাসনের   দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের দেশের মানুষ তাঁদের উপর এসব অন্ধকার যুগের পশ্চাদপদ আইন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে চাপিয়ে দিলে তা মানবে কেন ? প্রায় এক’শ বছর পূর্বে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের বুক থেকে প্রথম খলিফাতন্ত্রের জগদ্দল পাথরটাকে তুলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে গঠন করেন একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।  তিনিই প্রথম নারীকে রক্ষণশীল শরিয়তি কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন । তুরস্কে আরবী অক্ষর তুলে দিয়ে ল্যাটিন অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তুর্কি অক্ষর প্রবর্তন করেন । শরিয়তি আইন ও  আদালতের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক আইন নির্ভর আদালত গঠন ও স্থাপন করেন । আরবীয় পোশাক ও আরবীয় সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে ইউরোপীয়ান পোশাক ও সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন । এবং সর্বোপরি তুরস্ককে মধ্য প্রাচ্য সংস্কৃতির অন্ধকার গুহা থেকে বের করে ইউরোপিয়ান উন্নত ও উজ্জ্বল সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করেন । ফলে তুরস্ক ধীরে ধীরে পশ্চাদপদ ও সংরক্ষণশীল ধ্যান-ধারণা বর্জন করে ইউরোপিয় উন্নত, উদার, প্রগতিশীল ও আধুনিক সাংস্কৃতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সেই তুরস্কের বুকে পুনরায় শরিয়তি শাসন প্রবর্তন করলে মানুষ তা মানবে কেন ?
ফলে, তুরস্কের মাটিতে ৩০শে মে গেজি পার্ক বাঁচানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার অভিমুখ অতি দ্রুতই প্রধান মন্ত্রী তথা একেপি পার্টির সরকারের দিকে ঘুরে যায় । গেজি পার্কে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরী হয়েছিল তা প্রধান মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাবানলে পরিণত হয় । তাই অগত্যা তিনি সুর নরম করেন । ১৩ই জুন বুধবার গেজি পার্কের প্রকল্প নিয়ে গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব দেন । আন্দোলনকারীরা তা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখান করেন । পরের দিন আরও একটু পশ্চাদপসারণ করেন । প্রকল্পটির রূপায়ণ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত তিনি কাজ শুরু করবেন না । এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার করার আবেদন জানান । আন্দোলনকারীরা সরকারের এই ঘোষণাকে তাঁদের আংশিক জয় বলে মনে করেন । কিন্তু তাঁরা তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নি ।
এর্দোয়ানের একেপি ( জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ) পার্টি তুরস্কের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলতারা বলেছিল কামাল আতাতুর্ক প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই তারা তুরস্কের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় । তাদের আসল কর্মসূচী গোপণ করে রেখেছিল । এখন ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তুরস্কের ইসলামায়ন ঘটানোর কাজ শুরু করেছে । তারই বিরুদ্ধে আধুনিক সংস্কৃতিমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ তুর্কিরা পথে নেমে উত্তাল গণআন্দোলন গড়ে তুলেছেন । এই আন্দোলন কোথায় এবং কীভাবে শেষ হয় তা বলা মুস্কিল । তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আর যাই হোক তুরস্ককে আর কোনোদিন আধুনিক ও প্রগতিশীল জীবন-সংস্কৃতির আলোকোজ্জ্বল জগৎ থেকে মধ্যযুগীয় শরিয়তি জীবন-সংস্কৃতির গাঢ় অন্ধকার গুহায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব   । 
written on 16.06.2013

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...