Monday, April 15, 2013

যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশ যখন উত্তাল বিএনপি-জামাত তখন হিংসা ও অপপ্রচারে মাতাল

যুদ্ধাপরাধী রাজাকার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় বাংলাদেশের জনগণ মেনে নিতে পারেন নি । পারা সম্ভবও ছিল না । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যাঁরা কিঞ্চিত পরিমাণেও ওয়াকিবহাল তাঁরা নিশ্চয় এটা বোঝেন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম মৌলবাদীরা পাকিস্তানের সেনাদের সহকারীর ভূমিকা পালন করেছিল মুক্তিযুদ্ধকে নৃশংসভাবে দমন করার জন্যে । গড়ে তুলেছিল রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস নামে তিনটি সশস্ত্রবাহিনী । যত বর্বর ও পিশাচের দল ছিল এই সব বাহিনীর সদস্য ও নেতা । তারা পাক সেনাদের সঙ্গে যৌথভাবে যে পৈশাচিক ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিল বাঙালি জাতির উপর তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা । হত্যা করেছিল ৩০ লক্ষ বাঙালিকে, আর ধর্ষণ করেছিল তিন লক্ষাধিক বঙ্গনারীকে । এত মানুষকে হত্যা ও এত নারীকে ধর্ষণ ? ভাবাই যায় না । শুধু তাই নয় । এর বাইরে আরও কত মানুষকে পঙ্গু ও ক্ষত-বিক্ষত করেছিল , কত বাড়ি-ঘর লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল, কতশত হিন্দুদের ধর্মান্তরিত এবং কত মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেছিল তার ইয়ত্তা নেই । এত বীভৎস ও ভয়াবহ যাদের অপরাধের মাত্রা তাদের মৃত্যুদন্ড ব্যতীত উপযুক্ত শাস্তি আর কিছু হতেই পারে না । তাই গত ৫ ই ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল যেদিন জামাত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী রাজাকার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি ঘোষণা করে সেদিনই থেকেই বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন, যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শাহবাগ চত্বরে তরুণদের হাত ধরে । আন্দোলনের দাবী একটাই- অন্য কোনো রায় নয়, কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসী চাই । এই আন্দোলন প্রথম থেকেই পথ চলা শুরু করেছে গণতান্ত্রিক পথ ধরে এবং অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পথে । এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই এক মাস অতিক্রম করেছে এবং গোটা দেশ তাতে সামিল হয়েছে তবুও আন্দোলনের সেই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে । আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন দাবী আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না, কিন্তু কখনই ধৈর্য হারিয়ে অহিংস হয়ে ওঠেননি বা হয়ে ওঠার হুমকি দেন নি । গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রীতি-নীতি মেনে তাঁরা তাঁদের দাবী পেশ করেছেন সরকারের কাছে সংসদের অধ্যক্ষের মাধ্যমে । শাহবাগের আন্দোলনে গোটা দেশের সর্বস্তরের লক্ষ লক্ষ মানুষের সক্রিয় অংশ গ্রহণ দেখে বিএনপি প্রথমে এর বিরোধিতা করার সাহস সাহস পায় নি, যদিও এই দলের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতার ঐ একই অপরাধে বিচার চলছে । জামাত-ই-ইসলাম প্রথম থেকেই বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে । সেটাই স্বাভাবিক । কারণ যুদ্ধাপরাধীরা অধিকাংশই জামাতের নেতা-কর্মী । তারা শাহবাগে আন্দোলন রত তরুণদের ইসলামের দুষমণ বলে অভিহিত করেছে যাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই আন্দোলন থেকে সরে যায় । কিন্তু জামাতের এই মিথ্যা দোষারোপ বাংলাদেশের মানুষকে খুব বেশী বিভ্রান্ত করতে পারে নি । ফলে আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী ও বেগবান হয়েছে ও হয়ে চলেছে । এটা জামাতের পক্ষে প্রবল হতাশা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এটা খুবই স্বাভাবিক । কারণ তারা জানে যে যুদ্ধাপরাধীদের যদি রক্ষা করা না যায় তবে তারা অস্তিত্বের সংকটের মুখে পড়বে । তাই তারা মরিয়া হয়ে একদিকে তাদের অপপ্রচারের মাত্রা বাড়ায়, অপরদিকে হিংসা ও সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করতে শুরু করে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হিংসা ও খুন-সত্রাসই হলো জামাত-ই-ইসলাম তথা মুসলিম মৌলবাদীদের প্রধান হাতিয়ার । মধ্যযুগীয়, পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শরিয়তি আইনের সমালোচনা ও বিরোধিতা করলেই ওরা ইসলামের অবমাননা মানব না বলে কিরূপ ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং হত্যা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটে মত্ত হয়ে ওঠে তা তো সর্বজন সুবিদিত । এভাবেই ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিরোধী ও ভিন্ন স্বর স্তব্ধ করাটা ওদের একটা রণনীতি । ঐ পথেই ওরা দেলু রাজাকারকে বাঁচাতে পরপর দুদিন হরতাল ডেকেছিল যদিন তার সাজা ঘোষণার দিন ধার্য ছিল । উদ্দেশ্য ছিল বিচারকমন্ডলীকে আতঙ্কগ্রস্ত করা যাতে তাঁরা দেলু রাজাকারকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে ভয় করেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সর্বস্তরে আতঙ্ক সৃস্টি করার জন্যে ইতিমধ্যেই বারবার হুমকি দিয়েছে যে জামাতি ইসলামের নেতা-কর্মীদের মুক্তি না দিলে তারা গৃহযুদ্ধ বাধাবে । এদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দেশবাসীর কাছে জামাতের ডাকা হরতাল ব্যর্থ করার ডাক দেওয়া হয় । গোটা দেশে টানটান উত্তেজনার মধ্যে ২৮ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী তথা দেলু রাজাকার তথা দ্যেইলা রাজাকারের ফাঁসীর সাজা ঘোষণা করে । এই রায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল গোটা দেশ এবং তারজন্যেই জামাতের ডাকা হরতাল ব্যর্থ করতে রাস্তায় নেমেছিল সেদিন । দেলু রাজাকারের মৃত্যুদন্ডের রায়ে সমগ্র দেশে তাই খুশীর লহর বয়ে যায় । উল্টোদিকে জামাত শিবিরে নেমে আসে প্রবল হতাশা ও বিপন্নতার কালো মেঘ । ফলে তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে এবং মরণ কামর দিতে বল্গাহীন খুন-সন্ত্রাস ও অগ্নিসংযোগে মত্ত হয়ে ওঠে । ফাঁসীর রায় কী আনন্দ বয়ে নিয়ে এসেছিল সে প্রসঙ্গে ১ লা মার্চ প্রথম আলো (বাংলাদেশের কাগজ) লিখেছে, “সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর সারা দেশে জনতা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, মিষ্টি বিতরণ করে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে রায়ের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং জাগরণ মঞ্চের যেসব কর্মী ২৪ দিন ধরে রাজপথে অহিংস আন্দোলন করছেন, তাঁদের অনেকে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।” সেদিন মানুষ কত স্বতঃস্ফুর্তভাবে জামাতের হরতাল ভাঙতে পথে নেমেছিল এবং হতাশাগ্রস্ত জামাত কত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছিল তার ছবি এঁকেছিল সে দেশেরই আর একটি কাগজ, জনকন্ঠ, এভাবেঃ “রাজপথে নামতেই পারেনি জামায়াত শিবির ॥ ফ্লপ হরতাল০ প্রতিহত করল জনতা০ রীতিমতো যানজট০ কয়েক স্থানে ঝটিকা মিছিল, ককটেল, বোমা বিস্ফোরণ ওভাংচুর০ কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের বগিতে আগুন০ আটক ৩০।” জনকন্ঠের প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়, “রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে যানজটের দৃশ্য নতুন কিছু নয়। তবে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী জামায়াতের ডাকা হরতালেও যদি নগরীর বিভিন্ন রাজপথে এ দৃশ্য দেখা যায়, তাহলে সহজেই বোঝা যায় হরতালের ন্যূনতম প্রভাবও পড়েনি রাজধানীতে। অর্থাৎ আরও একটি ফ্লপ হরতালের কর্মসূচী শেষ করল দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াত।” জামাতিদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এবং অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায় । হিন্দু সম্প্রদায় তো সব সময়ই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য যার ফলে সে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা ২২% থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ৯.৫%-এ , এবার হিন্দুদের ওপর আক্রোশ অনেকগুণ তীব্র , কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তাঁদের সাক্ষী প্রদান ফাঁসীর রায়ের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । দেলওয়ার হোসেনের ফাঁসীর রায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে জামাতিরা পাগলা হাতির মত উন্মত্ত হয়ে যে বীভৎস আক্রমণ সংঘটিত করেছে হিন্দুদের ওপর তা বিশদে উল্লেখ করার অবকাশ এখানে নেই । তবুও সেই পৈশাচিক আক্রমণের ছবিটার দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক । সমকাল লিখেছে ৭ই মার্চ, “ চার স্থানে প্রতিমা ভাংচুর আনন্দ আশ্রমে আগুন এবার জয়পুরহাটের কালাইয়ে শিব এবং ভোলার বোরহানউদ্দিনসহ চার স্থানে কালী প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ফরিদপুরের সালথায় পুড়িয়ে দিয়েছে আনন্দ আশ্রম মন্দির।... ভোলার বোরহানউদ্দিনে রাতের আঁধারে পক্ষিয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের রায়মোহন ডাক্তার বাড়ির কালীমন্দিরের একটি প্রতিমা ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া কাচিয়া ইউনিয়নের বোরহানগঞ্জ এলাকায় একই সময়ে ২৬টি বাড়ির খড়ের গাদা, গোয়ালঘর ও রান্নাঘরে অগি্নসংযোগ করে সংখ্যালঘু এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়েছে। অগি্নসংযোগ করা বাড়ির মধ্যে ৬ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি রয়েছে”। সংখ্যালঘুদের ওপর যে বীভৎস আক্রমণের ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে তা লিখলে একটা গ্রন্থ হয়ে যাবে । আক্রমণ এমন মাত্রায় সংগঠিত হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকেও উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে সরকারকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ জানাতে হয়েছে । তারা বিবৃতিতে বলেছে, “ ... বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা, বিশেষত বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি খুবই বেদনাদায়ক যে দৃশ্যত কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এমন হামলার শিকার হচ্ছে তারা। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।” (প্রথম আলো, ৮.৩.১৩) । জামাতিরা যখন ক্রমশঃ হিংস্র হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই বিএনপি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সরাসরি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায় । ফলে পুলিশ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধিলাভ করে । বিএনপি প্রকাশ্যেই হিংসার মাধ্যমে সরকার পতনের ডাক দেয় । ফলে গোটা দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী হয় । বিএনপি-জামাত জোট গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে সাধারণ জনতা ও পুলিশের উপর লাঠি-বোমা-গুলি চালিয়ে পরিকল্পনামাফিক সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে । এদের এই অপতৎপরতা তথা হিংসার বলি হয়েছে ইতিমধ্যেই প্রায় একশ মানুষ । অথচ এই জোটই অভিযোগ যে, সরকার শান্তিপূর্ণ মিছিল ও আন্দোলনে গুলি চালিয়ে গণহত্যা চালাচ্ছে । এই মিথ্যাচার চলছে বল্গাহীনভাবে । মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে আর এক ধরণেরও যা আরও মারাত্মক । বিএনপি-জামাতের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামাতি ইসলামের যে সব নেতার বিচার হচ্ছে তারা সবাই নির্দোষ । হাসিনা সরকার এই বিচারের নামে জামাতি ইসলাম ও মুসলিম সমাজের ধুর্মীয় পুরো নেতৃবৃন্দকে ফাঁসীতে ঝুলানোর নীল নক্সা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালাচ্ছে । আসলে এই সরকার বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে মুছে দেওয়ার এক গভীর ও ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । এই জঘন্য মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার দাবীতে যে উত্তাল গণজাগরণ ও গণআন্দোলন তৈরী হোয়েছে তা ব্যর্থ করে দিতে এবং পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্যে । এই ভয়ঙ্কর কুৎসিত অপপ্রচার ও মিথ্যাচার শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না , এটা চলছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে । এই অপপ্রাচারে সামিল পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মৌলবাদীরাও । এখানকার একটি বাংলা খবরের কাগজ ও দুটি সাপ্তাহিক কাগজ জামাতি ইসলাম ও বিএনপির মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হোয়েছে । জামাতিরা, বিএনপির অনেকেও, হিন্দুদের ওপর নৃশংস অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাচ্ছে অথচ বিএনপি তার দোষ আওয়ামি লিগের ঘাড়ে চাপিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করছে । আর সেই কথাটা এখানকার মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের খবরের কাগজে ফলাও করে প্রচার করছে । ওদের পরিচালিত বাংলা দৈনিক ১০ই মার্চ তিন কলম জুড়ে সে খবরটি হেড লাইন করেছে এভাবে, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাঃ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী বিএনপির’ । শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতা আহমেদ রাজীব হায়দারকে কারা এবং কেন হত্যা করেছে তা দিবালোকের মতই স্পষ্ট । কিন্তু তার দোষ চাপিয়েছে বিএনপি সরকারের ঘাড়ে । সেই ঘৃণ্য মিথ্যা সংবাদটিরও তিন কলাম জুড়ে শিরনাম করেছে ঐ দৈনিকটি গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী । শিরনামটি এরূপঃ ‘ শাহবাগঃ বিএনপির মতে রাজীব খুনের দায় সরকারের’ । হত্যার রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে বিএনপি-জামাত জোট, অথচ ঘুরিয়ে ওরাই দোষারোপ করছে সরকার ও আওয়ামি লিগের । সেটাও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচার করছে ঐ দৈনিকটি পশ্চিমবঙ্গে । ঐ তারিখেই ‘বাংলাদেশ তীব্র হচ্ছে হত্যার রাজনীতি’ এই শিরনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয় প্রথম পাতায় । ঐ প্রতিবেদনে ছত্রে ছত্রে অভিযোগ করা হয় যে, নিরীহ আন্দোলনকারীদের পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করছে । প্রতিবেদনে এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘ অন্যদিকে, কক্সবাজারে ‘জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ’ মাওলানা সাঈদীর মুক্তির দাবীতে হাশেমিয়া আলিয়া মাদ্রাসা জামে মসজিদে জুম্মার নামায শেষে মিছিলের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছিল, সেই সময় পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় বলে অভিযোগ । গুলিতে এক মহিলা সহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ।’ জামাতি ইসলামের মিছিল থেকে ইট, পাথর,বোমা,গুলি প্রভৃতি ছোঁড়া হয়েছিল এবং মারমুখী সশস্ত্র ও হিংস্র জমায়েতকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে কঠোর ভূমিকা নিতে হয়েছিল তা অবলীলায় চেপে যাওয়া হয়েছে । শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে অবিরাম কুৎসা প্রচার । তার একটি নমুনা এরূপঃ ঐ কাগজটি লন্ডনের একটি দৈনিককে উদ্ধৃত করে ১০ ই মার্চ একটি প্রতিবেদন ছাপায় ‘শাহবাগ বিভক্ত করেছে দেশকে’ এই শিরনামে । কিভাবে বিভক্ত করেছে ? প্রতিবেদনে বলে হয়েছে, ইসলাম বিরোধী ও ইসলামপন্থী- এই দুই শিবিরে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়েছে । এ এক নজিরবিহীন মিথ্যাচার । হ্যাঁ, দেশ এখন বিভক্ত দুটো শিবিরে । একদিকে রয়েছে যারা যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তি চায়, স্বাধীন বাংলাদেশ চায়, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায় । আর একটা শিবিরে রয়েছে যারা এর বিপ্রতীপ অবস্থানে রয়েছে । দ্বিতীয় শিবির ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে ইসলামের দোহায় দিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করছে । প্রতারণা করছে এমন কথা বলেও যে , বাংলাদেশের জনমত দেলওয়ার হোসেনের ফাঁসীর সাজার বিরুদ্ধে । একটি কষ্টকল্পিত সমীক্ষা রিপোর্ট তুলে ধরে বলছে ৮৭% মানুষ দেলওয়ার হোসেনের মুক্তি চায় । এই অবাস্তব ও সম্পূর্ণ মিথ্যা সংবাদটি এ রাজ্যেও মুসলিম মৌলবাদীরা কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাদের একটি সাপ্তাহিক কাগজে গত ৩রা মার্চের সংখ্যায় ছেপেছে । এই সাপ্তাহিকটি আরও জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষ জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধের বিরুদ্ধেও । জামাত শিবির সবচেয়ে বেশী অপপ্রচার চালাচ্ছে ও মিথ্যাচার করছে দেলওয়ার হোসেন সংক্রান্ত বিষয়ে । সেই মিথ্যা প্রচারণাও এ রাজ্যে বল্গাহীনভাবে মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের কাগগজ করে যাচ্ছে নির্দ্বিধায় ও অনায়াসভঙ্গীতে । উক্ত সাপ্তাহিকটি ৩রা মার্চের সংখ্যাতে একটি বিশাল প্রতিবেদন ছেপেছে যার শিরনাম হলো- সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা শতাব্দীর নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার । দেলওয়ার হোসেন নির্দোষ এই দাবীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তার পরিচয় ও পরিচিতি নিয়ে নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার করা হচ্ছে । দেলওয়ার হোসেনের তিনটি পরিচয় রয়েছে । একধারে তিনি জামাতি ইসলামের আমীর, অন্যদিকে তিনি একজন বিখ্যাত মাওলানা । তার আর একটা পরিচয় হলো তিনি একজন রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী । তৃতীয় পরিচয়টাকে অস্বীকার ও আড়াল করার জন্যে তার দ্বিতীয় পরিচয়টাকে অতিমাত্রায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা হচ্ছে । কারণ মুসলিমদের হৃদয়ে সর্বদা বিরাজ করে মাওলানাদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা,সহানুভূতি, সম্মান ও বিশ্বাস । মাওলানারা খুন-খারাবি করতে পারে বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করতে চায় না । মাওলানা দেলওয়ার হোসেনের প্রতি সেই শ্রদ্ধা ও আস্থার পারদ রয়েছে আরও অনেক উঁচুতে, কারণ তিনি একজন সাধারণ মাওলানা নয়, একজন জগদ্বিখ্যাত মাওলানা । তার এই পরিচয়টাকেই নানাভাবে সামনে রাখা হচ্ছে । তাকে তুলে ধরা হচ্ছে ‘ আন্তর্জাতিক মুফাসসিরে কুরআন, খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন, কুরআনের পাখী, কুরআন প্রচারক, জনগণের কন্ঠস্বর, সুবক্তা আল্লামা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী’ এই পরিচয়ে । তকে ‘মুসলিম উম্মাহর অহংকার’ বলে সম্পাদকীয় লিখেছে উক্ত সাপ্তাহিকটি ৩রা মার্চের সংখ্যায় । ঐ কাগজটি ১৭ই ফেব্রুয়ারির সংখ্যায় অতিরঞ্জনের সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে দেলওয়ার হোসেনকে তুলনা করেছে মুসা নবী, ইব্রাহীম নবী এবং খলিফা আবু বকর ও খলিফা ওমর ফারুকের সঙ্গেও । কাগজটি লিখেছে, যেখানেই ফেরাউন হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে , সেখানেই মুসা গর্জন করে উঠেছেন । নমরুদ যেখানে কথা বলার চেষ্টা করেছে ইব্রাহীম সেখানে আবির্ভূত হয়ে তার বাকরুদ্ধ করেছে । যেখানেই আবু জেহেল ফণা বিস্তার করার চেষ্টা করেছে সেখানেই ওমর, আবু বকর সে ফণা দলিত-মথিত করেছে । এসব অপপ্রচার, মিথ্যা প্রচার ও অতিশয় রঙ লাগানো প্রচারের উদ্দেশ্য একটায় । তা হলো, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার দেলওয়ার হোসেনকে বাঁচানো এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত ও ভন্ডুল করা । ঘটনাচক্রে রাজাকার দেলওয়ার হোসেন ও মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী একই ব্যক্তি । বিচার ও শাস্তি হয়েছে প্রথম ব্যক্তির , দ্বিতীইয় ব্যক্তির নয় । সে কথাটা বিচারকরা খুব স্পষ্ট করে রায় দেওয়ার পূর্বেই ব্যক্ত করেছেন । সে কথাটা মানুষের সামনে আমাদের তুলে ধরতে হবে । কী সে কথা ? তা হলো- আসন গ্রহণ করার পর বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর বলেন, ‘আমরা আজ (বৃহস্পতিবার) যে রায় দিতে যাচ্ছি, তার আগে দুটো কথা বলতে চাই। এই মামলার আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, তাঁর পরিচয় বলার কোনো দরকার নাই। ওনার ওয়াজ শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ যান। তিনি শুধু প্রখ্যাত মওলানা নন, তিনি দুইবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির। প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা কি জামায়াতের নায়েবে আমির বা সাংসদ হিসেবে তাঁর বিচার করছি? উত্তর, না। আসুন, আমরা ফিরে যাই ৪০ বছর আগে। তখন সাঈদী ৩০ বছরের যুবক ছিলেন। পিরোজপুরের সাউথখালি গ্রামে তাঁর বাড়ি, বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। তখন তিনি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, সাধারণ মানুষ ছিলেন। গ্রামের লোকেরা তাঁকে দেলু বলে ডাকত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পিরোজপুরের শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আলিম পাস, উর্দুতে ভালো কথা বলতে পারতেন। তাই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়।’হ্যাঁ, বিচার ও শাস্তি হয়েছে ঐ কুখ্যাত দেলু রাজাকারের যে লোকটা নির্মম ও নৃশংসভাবে বহু লোককে হত্যা করেছে, বহু হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করেছে, বহু হিন্দু বাড়ি লুটপাট করেছে এবং বহু হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে মুসলমান বানিয়েছে এবং জোর করে নামায ও রোযা রাখতে বাধ্য করেছে । ( বিঃদ্রঃ- প্রবন্ধে যে দৈনিক খবরের কাগজ ও সাপ্তাহিক কাগজটির উল্লেখ রয়েছে তাদের নাম হলো যথাক্রমে ‘কলম’ ও ‘মীযান’ । It was written on 20.03.13 for 'Dainik Statesman' and that paper published it on 31.03.13)

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...