Monday, December 9, 2013

রোকেয়ার মুসলিমায়ন – এক ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার

রোকেয়া ছিলেন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম আমূল নারীবাদী এক মহান নারী ব্যক্তিত্ব । তাঁর সময়ে (১৮৮০-১৯৩২ ) নারীর এত করুণ দশা ছিল যে তিনি নারীকে নিকৃষ্ট জীবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন – “আপনারা শুনিয়া হয়ত আশ্চর্য হইবেন যে আমি আজ বাইশ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা জীবের জন্য রোদন করিতেছি । ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন ? সে জীব ভারত-নারী । এই জীবগুলির জন্য কখনো কাহারো প্রাণ কাঁদে নাই । পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে তাই যত্র-তত্র পশুক্লেশ-নিবারণী সমিতি দেখিতে পাই । কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ-বন্দিনী নারী জাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূভারতে নাই ।  ( রোকেয়া জীবনী, শামসুন নাহার মাহমুদ, পৃ ৭৯ )   তখন নারীর জন্যে শিক্ষার্জন নিষিদ্ধ ছিল এবং অবরোধ-বন্দি নারীকে গৃহের মধ্যেও  অপর নারীর সামনে পর্দা করতে হতো । সেই বীভৎস অবরোধ-প্রথার ভয়ঙ্কর রূপের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা তিনি এভাবে করেন – “ ... জমিদার বাড়িতে দুপুর বেলা এক জমিদার-কন্যা আঙ্গিনায় মুখ ধুইতেছিলেন । আলতার মা পাশে দাঁড়াইয়া জল ঢালিয়া দিতেছিল । ঠিক এই সময়ে এক মস্ত লম্বা চৌড়া কাবুলী স্ত্রীলোক আঙ্গিনায় আসিয়া উপস্থিত । হায় হায় সে কি বিপদ ! আলতার মা চেঁচাইয়া উঠিল বাড়ির ভিতর পুরুষ মানুষ ! স্ত্রীলোকটি হাসিয়া জানাইল সে পুরুষ নয় । জমিদার-কন্যা প্রাণপণে ঊধর্ধশ্বাসে গৃহাভ্যন্তরে ছুটিয়া গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন পাজামা-পরা একটা মেয়ে মানুষ আসিয়াছে । গৃহকর্ত্রী ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন সে তোমাকে দেখিয়া ফেলে নাই তো ? কন্যা সরোদনে বলিলেন হ্যাঁ, দেখিয়াছে । অপর মেয়েরা শশব্যস্তভাবে দ্বারে অর্গল দিলেন । কেহ বাগ ভাল্লুকের ভয়েও বোধ হয় এমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না ।” (দ্রঃ- প্রাগুক্ত পৃ-১৪ ) এরূপ গভীর তমসায় নিমজ্জিত ছিল রোকেয়ার ভারতবর্ষ । সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে তিনি নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের দীপশিখাটি প্রজ্বলিত করেছিলেন । তিনি দাবী জানিয়েছিলেন যে, নারীকে দিতে হবে শিক্ষার্জনের অধিকার ও অর্থোপার্জনের অধিকার । তিনি পুরুষজাতির চোখে চোখ রেখে ঘোষণা করেছিলেন পুরুষের ঘর-সংসার করাই কেবল নারীর সারধর্ম নয়, নারী তার বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা ও শ্রম দিয়ে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে এবং দেশকে নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার দায়িত্ব পালনে সক্ষম । তিনি দাবি করেছিলেন পুরুষের সমকক্ষতা এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের তিনি স্বামীশব্দেই তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, নারী পুরুষকে তার স্বামী (প্রভু) মানবে কেন, স্বামী আর বলবে না, ‘স্বামীর পরিবর্তে পুরুষকে পুরুষকে অর্ধাঙ্গ বলবে ।
এই ছিল রোকেয়ার নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের আসল রূপ, যা ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ । তিনি কার্যত বিদ্রোহ করেছিলেন নারীর প্রধান শত্রু ধর্মের বিরুদ্ধেও । সকল ধর্মগ্রন্থই পুরুষ দ্বারা রচিত বলে পৃথিবীর সকল ধর্মকেই নস্যাত ও অস্বীকার করেছিলেন তিনি । তিনি তাই প্রাতঃস্মরণীয় এক ভারতীয় মনীষী, আমাদের বাঙালি জাতির গর্ব
রোকেয়া কিন্ত ভারতে, এবং এই পশ্চিমবঙ্গেও ভীষণ উপেক্ষিত ও অবহেলিত । তিনি তাঁর যোগ্য সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত । তাঁকে নিয়ে যথার্থ চর্চা নেই, গবেষণা তো নেই-ই । কেন তা’ – তা নিয়েও দৃষ্টিগোচর হয় না কোনো আলোচনা-সমালোচনা পর্যন্ত । একজন বাঙালি মনীষীর প্রতি এরূপ বিষ্ময়কর উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অনাদর যেমন ভীষণ পীড়াদায়ক, তেমনই লজ্জাকরও ।  
যথাস্থানে প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি না পেলেও মুসলিম সমাজ সেটা তাঁকে দুহাতে ঢেলে দিয়েছে । তিনি এী সমাজে মর্যাদা ও সম্মানের অতি উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত আজ । প্রথাসিদ্ধ একজন মুসলিম নারীর নিকট এ সম্মান খুবই আনন্দদায়ক ও গর্বের ধন , কিন্তু রোকেয়ার নিকট এটা বড়োই অগৌরবের এবং এ স্বীকৃতি বড়োই অস্বস্তির । মুসলিম সমাজ তাঁকে বন্দনা করে একজন খ্যাতনামা মুসলিম নারী হিসেবে । তিনি কিন্তু নারীর পরাধীনতার জন্যে সকল ধর্মকেই দায়ী করেছিলেন কঠোর ভাষায় ইসলাম ধর্মের প্রতি আলাদা কোনো আবেগ বা শ্রদ্ধা তাঁর ছিল নাতিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ধর্মই যে নারীর দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করেছে । তিনি সে কথা মহিলা পত্রিকায় অলঙ্কার না Badge of Slavery’  প্রবন্ধে বলিষ্ঠ ভাষায় লিখেছিলেন । মুসলিম সমাজ ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ভূকম্পন সৃষ্টিকারী তাঁর সেই  দুঃসাহসিক কথাটি এরূপঃ “ ‘ধর্মই আমাদের দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ‘ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ রমণীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন ।” (সূত্রঃ রোকেয়া/কালে ও কালোত্তরে, মোরশেদ শফিউল হাসান, পৃ ৪৯)  নারীর দুর্দশার জন্যে রোকেয়া যে ধর্মের বিরুদ্ধে নারীকে সচেতন ও  সরব করার কাজ অকুতোভয়ে করে গেছেন সেই ধর্মের কারবারী তথা ঠিকাদারদের হাতেই আজ রোকেয়া বন্দি । রোকেয়ার বিদ্রোহীভাবমূর্তি ও আসল পরিচয় আড়াল করে তাঁকে মুসলিম নারীহিসেবে তুলে ধরতে মুসলিম সমাজ রোকেয়ার নামের আগে বেগমতকমা জুড়ে দিয়েছে । ফলে রোকেয়া আজ পরিচিত বেগম রোকেয়ানামে, যদিও তিনি নিজে কোনো দিন তাঁর নামের আগে বেগমলিখতেন না ।  রোকেয়াকে বেগম রোকেয়ানামে প্রচারণা হলো মুসলিম সমাজের একটি ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার যার  পশ্চাতে রয়েছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও হীন উদ্দেশ্য । সেই মিথ্যাচারের মুখোশ খোলা এবং কেন এরূপ জঘন্য মিথ্যাচার তার রহস্য উন্মোচন করার নিমিত্ত এই নিবন্ধের অবতারণা ।  
এ যুগের মুসলিম সমাজের চোখে রোকেয়া
এ কথা এর পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এপার বঙ্গের বৃহত্তর অমুসলিম বাঙালি জাতির নিকট রোকেয়া যতখানি উপেক্ষিত ও অনাদৃত, বাঙালি জাতির মুসলি সমাজের নিকট ততখানিই সম্মানিত ও সমাদৃত । এ বঙ্গের মুসলিমরা অবশ্য নিজেদের বাঙালি জাতি হিসেবে ভাবেন না, ভাবেন ও পরিচয় জ্ঞাপন করেন মুসলিম জাতি হিসেবে । আত্মপরিচয়ে এই মহাভ্রান্তির পশ্চাতে দুটি প্রধান কারণ সম্ভবতঃ বিদ্যমান । তা হলো এরূপঃ এক) ইসলাম ধর্মের অতি সংকীর্ণ ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গী ও মতাদর্শ । দুই) সংখ্যালঘু হীনমন্যতা । শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ভাবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে তাদের নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ও পতাকের নীচে ঐক্যবদ্ধ থাকা একান্ত আবশ্যক । আর সেজন্যে একান্তই আবশ্যক হলো মুসলমান জাতিহিসেবে স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়টি সযত্নে রক্ষা করে চলা । দ্বিতীয় এ ভাবনাটি অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মুসলিম সমাজের মধ্যে । প্রধানতঃ এই অংশের মানুষদের মধ্যেই রোকেয়া-চর্চার প্রবল উপস্থিতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় । এবং তাঁদের চর্চা ও প্রচেষ্টার ফলেই রোকেয়া আজ মুসলিম সমাজে মর্যাদার অনেক উঁচু পঙক্তিতে অধিষ্ঠিত । তাঁদের রোকেয়া-চর্চায় রোকেয়ার প্রবল স্তুতি পরিলক্ষিত হয় । নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় তাঁরা অতিশয় উদার এবং অক্লান্ত ও অকুন্ঠ । তাঁরা তাঁকে সমাজ সংস্কারক, নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃত, নারী-মুক্তি সংগ্রামের অগ্রণী সেনাপতি ও জননী, নারী জাগরণের অগ্রদূত প্রভূত বহু অভিধায় ভূষিত করে সমাজের সবচেয়ে অগ্রগণ্য মনীষীদের পঙক্তিতে বসিয়েছেন । মানব সমাজের সবচেয়ে উঁচু পঙক্তিতেই  একটি আসন রোকেয়ার প্রাপ্য তা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই । যে মহৎ গুণ ও মনন এবং মেধা, সাহস ও দুর্লভ অবদানের জন্যে রোকেয়ার উক্ত মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্য ঠিক সে কারণে কিন্তু মুসলিম সমাজের চোখে তিনি একজন অগ্রগণ্য মনীষী নন । রোকেয়ার যথার্থ মূল্যায়ন করে তাঁর জন্যে তাঁরা তাঁদের সমাজের বহু উঁচু পঙক্তিতে আসন পেতে তাঁকে বরণ করেছেন তা নয়রোকেয়াকে একজন মনীষীর আসনে বসানোর পশ্চাতে তাঁদের নিজেদের স্বার্থ রয়েছে । তাঁরা নিজেদের গৌরব জাহির করার জন্যে রোকেয়ার নামটা ব্যবহার করে থাকেন । রোকেয়ার প্রশংসা উপলক্ষ্য মাত্র, আসল লক্ষ্য হলো  মুহাম্মদ ও মুসলমান সমাজের ঢাক পেটানো । রোকেয়ার নামের আড়ালে ইসলাম ধর্মের গুণকীর্তন করা । মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবীদের রোকেয়া-বন্দনার প্রধান দিকটিই  হলো এটা প্রমাণ করা যে রোকেয়া ছিলেন প্রধানতঃ ও প্রথমতঃ একজন ধর্মপরায়ণা নারী এবং তিনি ইসলাম প্রদত্ত ও প্রদর্শিত নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারগুলি অর্জনের জন্যেই আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন । রোকেয়া একজন পরহেজগার (ধর্মনিষ্ঠ) মুসলিম রমণী ছিলেন এটা বোঝাবার জন্যে তাঁর নামের আগে বেগমতকমাটি তাঁরা জুড়ে দিয়েছেন, যদিও রোকেয়া কোনোদিন তাঁর নাম বেগম রোকেয়ালিখতেন না । রোকেয়া নারীর মুক্তি, স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে যা যা বলেছেন ও যা যা দাবী করেছেন তা মুসলমানদের কাছে খুবই অস্বস্তিকর, অগ্রহণযোগ্য ও অসহনযোগ্য কারণ, তাঁর প্রতিটি কথাই ইসলাম ধর্মের মূল নীতির সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক । মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তাই সর্বদা রোকেয়ার আসল কথাগুলি মিথ্যা কথা ও অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় ব্যাপৃত থাকেন ।  তাঁরা এ প্রসঙ্গে কী ধরণের প্রচার করেন তার কয়েকটি নমুনা দেওয়া যাক । সাপ্তাহিক কলম পত্রিকায় ১৭/১২/২০০৫ তারিখ একজন বুদ্ধিজীবী লিখেছেন নারীর পক্ষে যতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার কোনোটিই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল নাঐ পত্রিকায় সেই সংখ্যাতেই আর একজন লিখেছেন বেগম রোকেয়া ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীর স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন । ঐ পত্রিকার ২০০৩ সালের ৪ঠা জানুয়ারীর সংখ্যায় একজন প্রাবন্ধিক লিখেছেন ইসলাম নির্ধারিত পর্দার প্রতি তিনি গভীর অনুরাগীনী । জীবনে সর্বক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর ।  শুধু মুসলিমদের প্রকাশিত কাগজেই নয়, সমস্ত কাগজেই রোকেয়া সম্পর্কে এই একই ধরণের কথা প্রচার করা হয় । কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খবরের কাগজ প্রতিদিন’-এর অতিথিকলমে একজন জনৈক শেখ ইবাদুল ইসলাম মহাশয়ের  লেখায় পড়েছিলাম সেই একই সুর, একই ভাষা । সেই লেখাটির অংশ বিশেষ এরূপ -  ইসলাম ধর্মের চিরন্তন ঘোষণাকে মর্যাদা দিয়েই তিনি মেয়েদের শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন । অন্যত্র আর একজন মুসলিম লেখক লিখেছেন - ইসলাম নির্ধারিত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রোকেয়া ১৯১৬ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলামনামে মুসলিম সমিতি গঠন করেছিলেন ।  কী উদ্দেশ্যে এমন ধারার প্রচার তার একটি কারণ ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে । এ ছাড়াও রয়েছে আর একটি কারণ । রোকেয়া জন্মসূত্রে মুসলিম হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে আস্থা রাখেন নি । সমস্ত ধর্মের (religions) প্রতিই তাঁর অনাস্থা ছিল অত্যন্ত প্রকট । তিনি একেশ্বরবাদের পয়গম্বর তত্ত্বকেও (theory of prophet) বাতিল করে দিয়েছেন নির্মমভাবে । তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজ চেতনায় সমৃদ্ধ একজন প্রখর যুক্তিবাদী, প্রগতিবাদী, বাস্তববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমীহ জাগানো বিশাল এক ব্যক্তিত্ব । রোকেয়ার এই আসল পরিচয় মুছে ফেলা এবং রোকেয়ার মুসলিমায়ন ঘটানোই হলো এ যুগের শিক্ষিত মুসলিম সমাজের রোকেয়া-স্তুতির প্রধান কারণ ।
 তৎকালীন যুগে  মুসলিম সমাজের চোখে রোকেয়া কেমন ছিলেন
 রোকেয়ার জীবদ্দশায় মুসলিম সমাজ রোকেয়ার প্রতি কঠোর বিরূপ মনোভাব পোষণ করতো এবং প্রতি পদে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতো । তখনকার মুসলিম সমাজে শ্রেণী হিসেবে বুদ্ধিজীবীদের তখনো আত্মপ্রকাশ ঘটেনি । তখন  সমাজে একতরফা কতৃত্ব ও মাতব্বরি করতো মোল্লা সমাজ । তাঁরা যে পদে পদে রোকেয়াকে বিব্রত করতো সে কথা তিনি স্বয়ং সখেদে ও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন । তিনি এক জায়গায় লিখছেন – “ আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর, সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি ; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের, বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি । আর জীবনের পঁচিশ বৎসর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি ।”(দ্রঃ রোকেয়া জীবনী, শামসুন নাহার, পৃ-৭৯ )  না কেবল কাঠমোল্লারা নন, রোকেয়ার প্রতি বেজায় রূষ্ট ছিলেন ইসলামি জ্ঞানসমৃদ্ধ আলেম সমাজ এবং মুসলিম সমাজে যাঁরা কতিপয় শিক্ষিত ও মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন তাঁরাও । তাঁরা কতটা রুষ্ট ছিলেন তাঁর পরিচয় পাওয়া যায় তৎকালীন সাহিত্য পত্র-পত্রিকায় । রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ মতিচুর’ – এর প্রথম খন্ডের প্রথম সমালোচনা বের করেছিল নবনুরপত্রিকা  ১৩১২ সনের ভাদ্র সংখ্যায় গ্রন্থটির সমালোচনায় আলোচক লেখেন যে রোকেয়া খ্রীষ্টান ধর্মের যাজকদের দ্বারা প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত হয়েছেন । তিনি ঠিক কি লিখেছেন তা দেখা যাক – “ খৃষ্টধর্ম প্রচার করিতে আসিয়া আমাদের সম্বন্ধে পাদরী সাহেবগণ যাহা বলেন বা বলিয়াছেন, লেখিকার নিকট তাহা অভ্রান্ত সত্যরূপেই পরিগণিত হইয়াছে  ”  এবং তাঁহার মতে, আমাদের সবই কু, আর ইউরোপ-আমেরিকার সবই সু ।”  (সূত্রঃ রোকেয়া/কালে ও কালোত্তরে, মোরশেদ শফিউল হাসান, পৃ ৩৪)  এই সমালোচনাটা প্রমাণ করে যে ইসলাম ধর্মের প্রতি রোকেয়ার লেখায় শ্রদ্ধা ও সমর্থন কোনোটাই ছিল না । শুধু কি তাই ? সকল ধর্মের ( ইসলাম সহ ) প্রতি রোকেয়ার সমালোচনা ছিল এত চড়া ও কড়া যে শিক্ষিত মুসলমান সহ  মুসলিম মোল্লা সমাজের পক্ষে তা ছিল দুঃসহ । তাঁদের সে মনোভাবের কথা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল গ্রন্থটির সেই সমালোচনাতেই । গ্রন্থ সমালোচক লিখেছেন – “ সমাজ সংস্কার করা এক কথা, আর সমাজকে বেদম চাবুক মারা আর এক কথা । চাবুকের চোটে সমাজ দেহ হইতে ক্ষত হইতে পারে, কিন্তু তদ্বারা সমাজের কোন ক্ষতি বা অভাব পূরণ হয় না । মতিচুর রচয়িত্রি কেবল সমাজকে চাবকাইতেছেন, ইহাতে যে কোন সুফল ফলিবে এমত আশা করিতে পারি না ।মোরশেদ শফিউল হাসান জানিয়েছেন যে এই তীব্র সমালোচনাটি একজন না দুজন ব্যক্তি করেছেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে, তবে সংশয় নেই যেটা নিয়ে তা হলো তিনি বা তাঁরা ছিলেন ধর্ম পরায়ণ মুসলমান । তিনি লিখেছেন – “ আলোচক ছিলেন আব্দুল করিম ও সৈয়দ এমদাদ আলী (সম্পাদক) । অথবা দুজনের যে কোনো একজন । যেহেতু রচনার নীচে কারো নাম স্বাক্ষরিত হয় নি । পত্রিকার বার্ষিক সূচীতে গ্রন্থ-সমালোচক হিসেবে এ দুজনেরই উল্লেখ আছে ।এ সমালোচনাটি দুটি জিনিষ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে এক) রোকেয়ার লেখনি ছিল ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজের বিশ্বাস ও রীতিনীতির পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক । এবং দুই) রোকেয়া ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন বলে যে দাবী করা হচ্ছে  তা এক নির্জলা মিথ্যাচার । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এই মিথ্যা প্রচারণায় শামিল জেনে হোক না জেনে হোক অমুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও । এখানে আর একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে তা হলো রোকেয়ার কথায় তৎকালীন হিন্দু সমাজের পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি ও পৃষ্ঠপোষকরাও কম অপ্রসন্ন ও রুষ্ট ছিল না । এটার সপক্ষে আলোচনা করছি না কারণ এটা এ নিবন্ধের বিষয়-বহির্ভূত ।
রোকেয়া ছিলেন ধর্মদ্রোহী
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত বিধানই পুরুষকেন্দ্রিক এবং নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী । এ সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কটি অতিশয় বৈষম্যমূলক ও পীড়নমূলক । নারীর প্রতি বৈষম্য ও পীড়ন এতটাই প্রকট ও তীব্র যা বর্ণনা করা মানুষের অসাধ্য । তবু এ সম্পর্কটি এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে পুরুষ শাসক নারী শাসিত, পুরুষ শোষক নারী শোষিত, পুরুষ প্রভু নারী দাসী,  পুরুষ ভোক্তা নারী ভোগ্যপণ্য, পুরুষ কাদক নারী কাদ্য, পুরুষ পূজ্য নারী পূজারী, পুরুষ স্বাধীন নারী পরাধীন ও পদানত, পুরুষ আত্মনির্ভর নারী পুরুষরনির্ভর, পুরুষ দাতা নারী গ্রহীতা, পুরুষ মুক্ত নারী বন্দি, পুরুষ কারাপাল নারী কয়েদি, পুরুষ উৎপীড়ক নারী উৎপীড়িত, নারী সম্পত্তি বিশেষ আর পুরুষ তার মালিকপুরুষ দেশ চালাবে নারী পুরুষের সংসার সামলাবে, পুরুষ নেতৃত্ব করবে নারী তাকে সহায়তা দেবে, পুরুষ হুকুম করবে নারী তামিল করবে, পুরুষ কর্তৃত্ব করবে নারী আনুগত্য করবে, পুরুষ চোখ রাঙাবে নারী চোখ নত করবে । পুরুষ তার শিশ্নের ( যৌনাঙ্গ) মালিক নারীর জরায়ুরও মালিক, নারী গর্ভে ধারণ করবে যাকে তার মালিকও পুরুষ, নারী্ তার গর্ভে সন্তান ধারণ করবে কিনা কিংবা কখন করবে তা নারী নয় ঠিক করবে পুরুষ, নারী তার গর্ভের সন্তানকে লালনপালন করবে না নষ্ট করবে তা নারী নয় সিদ্ধান্ত নিবে পুরুষ । নারী ও পুরুষের মধ্যে এরূপ কতশত অস্বাভাবিক, অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও কুৎসিত সম্পর্ক ধারণ করে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ । এ সমাজে শুধুই পুরুষের জয়জয়কার আর নারীর হাহাকার । এ হেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও তার বিধি-বিধানকে অক্সিজেন, জল আর যাবতীয় পুষ্টি দিয়ে লালন-পালন করে চলেছে সকল ধর্ম (religion) ও ধর্মগ্রন্থগুলি আল্লাহ্‌ বা  ঈশ্বরের নামে ।
পুরুষগণ কর্ত্তৃক রচিত বলে এসব ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলি নির্মমভাবে বাতিল করে দিয়েছেন রোকেয়া । আধুনিক যুগের সভ্য সমাজের মানুষরা  এসব কুৎসিত ধর্মীয় বিধানগুলি বিশ্বাস করে ও অনুসরণ করে দেখে রোকেয়া যারপর নাই অবাক হয়েছিলেন । কিন্তু অবাক হয়ে কেবল আক্ষেপ করে বসে থাকেন নি । বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ধর্মের নামে  নারীর উপর পুরুষের প্রভুত্ব কায়েম করার বিরুদ্ধে অলঙ্কার না Badge of Slavery’  প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন – “  ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিত না । ... যে কথা পুরাকালে অসভ্য বর্বরগণ বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহা বর্তমান কালের সুসভ্যগণ যদি বিশ্বাস করেন, তবে সভ্যতা ও অসভ্যতায় প্রভেদ কি ? যাহা হউক আমরা আর ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না ।
মহামতি এঙ্গেলস সমাজ বিকাশ ও বিবর্তনের উপর গভীর বিশ্লেষণ ও আলোকপাত করেছেন । তিনি লিখেছেন মানব সমাজের ইতিহাসে নারীর স্থান ছিল পুরুষের ওপরে এবং পরিবারে নারীই আধিপত্য করতো । তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে বিশ্ববিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী মর্গানের গ্রন্থ থেকে তিনি একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন । সেটা হলো – “সচরাচর মেয়েরাই বাড়ীর মধ্যে আধিপত্য করত; বাড়ীর ভান্ডার ছিল সাধারণের সম্পত্তি; কিন্তু রসদ যোগানোর ব্যাপারে নিজ দায়িত্ব পালনে অক্ষম বা অলস স্বামী বা প্রেমিকের কপালে দুঃখ জুটত । বাড়ীতে তার সন্তান সন্ততির সংখ্যা অথবা  জিনিষপত্র যতই থাক না কেন, যে কোন সময় তাকে তলপি গুটিয়ে চলে যাবার হুকুম দেওয়া যেত; এবং এই ধরণের আদেশ অমান্য করার চেষ্টাও তার পক্ষে শুভ হত না; ... ” (দ্রঃ পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, পৃ- ৫৬) এঙ্গেলস এই কালজয়ী গ্রন্থটি রচনা করেন ১৮৮৪ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ রোকেয়ার জন্মের চার বছর পরে । এঙ্গেলসের এই রচনা তিনি পড়েন নি বলেই মনে হয় কারণকাল মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা ভারতবর্ষে তখন অত অল্প সময়ে আসা সম্ভব ছিল না এবং তাঁর কোনো লেখাতেও এঙ্গেলসের উল্লেখ পাওয়া যায় না । তবুও রোকেয়ার লেখায় যেন এঙ্গেলসের কথারী প্রতিধ্বনি শুনতে পাই ।  নারী নরের অধীন থাকবে কারণ, নরের বুকের পাঁজরের হাড় থেকে নরের আরাম ও সুখের জন্যে নারীর সৃষ্টি কোরান সহ সকল ধর্মগ্রন্থের এই তত্ত্বকে রোকেয়া পুরুষের নিজেদের তৈরী তত্ত্ব বলে খারিজ করে দিয়েছেন । তিনি অলঙ্কার না Badge of Slavery’  প্রবন্ধে লিখেছেন – “দিদিমাদের মুখে শুনি যে, নারী নরের অধীন থাকিবে, ইহা ঈশ্বরের অভিপ্রেত তিনি প্রথমে পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছেন, পরে তাহার সেবা ও শুশ্রুষার নিমিত্ত রমণীর সৃষ্টি হয় । কিন্তু একথায় আমার সন্দেহ আছে । কারণ দিদিমাদের এ জ্ঞান পুরুষের নিকট হইতে গৃহীত । তাঁহারা ত বলিবেনই যে, রমণী কেবল পুরুষের সুখ শান্তিদাত্রীরূপে জন্মগ্রহণ করে ।”  রোকেয়া বিশ্বাস করতেন যে নারী সুদূর অতীতে স্বাধীন ও মুক্ত ছিল, তখন নারী এখনকার মত পুরুষের দাসী ছিল না ।  উক্ত প্রবন্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি সে কথাই জানিয়ে দিয়েছেন ।   কী বলেছেন তা তাঁর মুখ থেকে শোনা যাক – “আমি আদিমকালের ইতিহাস জানি না বটে, তবু বিশ্বাস করি, পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমরা এরূপ দাসী ছিলাম না
গৃহাভ্যন্তরে নারীর অবস্থা আওক্ষরিক অর্থেই দাসীর মতো । প্রতি পদক্ষেপেই নারীকে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে হয়, নারীর সকল স্বাধীনতা, সকল ইচ্ছা-আকাঙ্খা-অভিলাষ বিসর্জন দিতে হয় পুরুষের পদতলে, নারী তাই দাসী বৈ কি? রোকেয়া যথার্থই বলেছেন নারী দাসীতে পরিণত হয়েছে । নারীর এই শোচনীয় ও করুণ পরিণতির জন্যে ধর্মেরও যে একটা বড়ো ভূমিকা আছে সে কথা তিনি স্পষ্ট ভাষা ঘোষণা করেছেন এ কথা বলে যে, ধর্মই নারীর দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করেছে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করছে । তিনি বলেছেন নারীর উপর প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব ও অত্যাচার-নিপীড়ন চালানোর জন্যে পুরুষ ধর্মকে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী অস্ত্ররূপে । নারী তার মাথা তুলবার চেষ্টা করলেই পুরুষ ঐ অস্ত্রটি মুগুরের মতো তার মাথায় আঘাত করে তাকে নতমস্তকে থাকতে নির্দেশ প্রদান করে ও বাধ্য করে । কী বলেছেন রোকেয়া তা শুনি তাঁর কলম থেকেই – “আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পার নাই ; ... যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে । ... আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি । এখন ত অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই শুনিতে পাইঃ প্যাট ! তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম !সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায় ।
নারীমুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে যখন এভাবে রোকেয়া সকল ধর্মকে তীব্র ও তীক্ষ্ণ আক্রমণে ফালাফালা করে চলেছেন ভারতের বুকে, তখন ইউরোপের নারীবাদী নেত্রী এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন একইভাবে খৃষ্টান ধর্মকে আক্রমণে আক্রমণে বিধ্বস্ত করে চলেছেন । কারণ খৃষ্টান যাজকতন্ত্রও তখনই বাইবেল উঁচিয়ে ধরে নারীর সামনে যখনী সে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে । স্ট্যান্টন তাই বাইবেলকেই নস্যাত করে দিয়ে লিখেছেন, “সাপটি, ফলগাছটি এবং নারীটিকে সরিয়ে নাও ; তারপর আর থাকে না কোনো পতন, কোনো ক্রুদ্ধ বিচারক, কোনো নরক, কোনো চিরশাস্তি ; - সুতরাং দরকার পরে না কোনো ত্রাতার । এভাবে খসে পড়ে সমগ্র খৃীষ্টান ধর্মতত্ত্বের তলদেশ । এ-কারণেই সমস্ত বাইবেলি গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পন্ডিতেরা কখনো নারীর অবস্থানটি ছুঁইয়ে দেখে না । ” (দ্রঃ নারী, হুমায়ুন আযাদ, পৃ- ২৮৬) এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন এটা লেখেন ১৮৯৫ সালে । এর মাত্র ৯ (নয়) বছর পর ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে (বাং - ১৩১০ সনে) রোকেয়ার কালোত্তীর্ণ ঐ প্রবন্ধটি - অলঙ্কার না Badge of Slavery  - প্রকাশিত হয় ধারাবাহিকভাবে মহিলাপত্রিকায় পরপর তিনটি সংখ্যায় । প্রবন্ধটি এক বছর পর পুনঃমুদ্রিত হয় নবনূরপত্রিকায় আমাদের অবনতিশিরোনামে । প্রবন্ধটিতে কি দুঃসাহসিকাতায় সকল ধর্মকে ও ধর্মগ্রন্থকে পুরুষ-রচিত বলে নস্যাত ও প্রত্যাখান করে দিয়েছেন !
রোকেয়া ধর্মগ্রন্থগুলিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করার পাশাপাশি একই সাথে আক্রমণ করেছেন কড়া ভাষায় পুরুষজাতিকেও স্ট্যান্টন সরাসর আক্রমণ করে লিখেছেন একটি ধর্ম তথা খৃস্টান ধর্মকে, কিন্তু রোকেয়া কোনো একটা ধর্মকে নয়, আক্রমণ করেন সকল ধর্মকে । এটাকে কেউ কেউ স্ট্যান্টনের চেয়েও অধিক কৃতিত্ব প্রদান করেছেন । কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে আক্রমণ করা, কিংবা সকল ধর্মকে আক্রমণ করা, বিশেষ করে আজ থেকে এক শতাব্দী কাল সময়েরও আগে, খুবই কঠিন ও দুঃসাহসিক কাজ । এ কাজে জীবনের ঝুঁকি থাকেই, আর তার জন্যে অসাধারণ সাহস ও মনোবল ব্যতীত এমন কাজে ব্রতী হওয়া যায় না । এতদসত্বেও একটা প্রশ্ন মনে উঁকি মারে খৃস্টানদের সমাজে বাস করেও  স্ট্যান্টন সরাসরি আক্রমণ করেছেন খৃস্টান ধর্মকে, কিন্তু রোকেয়া নির্দষ্টভাবে ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করেন নি কে ? মানুষ সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে বাইবেলের আদম-ইভের উপাখ্যানকে মনুষ্য রচিত গল্প বলে স্ট্যান্টন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন । ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় আবেগ থেকে মানুষকে বের করে আনার জন্যে এরূপ প্রত্যক্ষ আক্রমণ খুবই কার্যকরী হোয় । রোকেয়া কেন কোরানেরআদম-হাওয়ার অধ্যায়টি মানব রচিত একটি হাস্যকর গল্প বলে সরাসরি উড়িয়ে দেন নি ? শুধু মুসলমান নারীর জন্যে নয়, তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলন ছিল সকল নারীর জন্যে বলে কি তিনি সরাসরি কোরানকে আক্রমণ না করে সকল ধর্মগ্রন্থকে আক্রমণ করেছিলেন ? নাকি মুসলিম সমাজের কাছ থেকে ভয়ঙ্কর আক্রমণের আশঙ্কা থেকে কোরানকে সরাসরি আক্রমণ ও নস্যাত না করার কৌশল ছিল তাঁর ? এর উত্তর রোকেয়ার রচনাবলী থেকে পাওয়া যায় না ।  তবে তিনি যখন ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত নয় বলে সমস্ত ধর্মগ্রন্থকেই বাতিল করে দিয়েছেন, তখন সমস্ত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে যে কোরানকে রেখেছেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রাখেন নি । তবে সরাসরি কোরানকে আক্রমণ না করলেও কোরানের তথা হযরত মুহাম্মদের আল্লাহ্‌র দূত পাঠানোর তত্ত্ব তথা পয়গম্বরতত্ত্বকে পরোক্ষভাবে হলেও নস্যাত করতে ভুল ও দ্বিধা করেন নি । তিনি লিখেছেন ঈশ্বর কাউকে দূত হিসেবে পাঠালে তা নিশ্চয় এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না । মুহাম্মদের পয়গম্বরতত্ত্বকে শুধু নস্যাত করাই নয়, স্বঘোষিত শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর মুহাম্মদকে তিনি পরোক্ষভাবে তীক্ষ্ণ ও তির্যক ভাষায় কটক্ষ করতেও দ্বিধা বা ভয় করেন নি । মুহাম্মদের এক শিশু কন্যাকে বিয়ে করার ঘটনাকে যে ভাবে আক্রমণ করেছেন তাতে বোঝা যায় তিনই কি পরিমাণ মুহাম্মদ ও ইসলামের ধর্মের প্রতি বিরূপ ছিলেন । মুহাম্মদের সেই ঘটনাটি এ রকম । তিনি তাঁর সমবয়সী ও সর্বাধিক বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকরের ৬ (ছ’ ) বছরের শিশু  কন্যাকে বিয়ে করেন । আবু বকরের ইচ্ছা ও মত ছিল না এ বিয়েতে । মুহাম্মদ তখন তাঁকে বলেন যে, এটা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা । আবু বকর তখন অনিচ্ছা সত্বেও ভয়ে সম্মত হয় এবং মুহাম্মদের সঙ্গে ঐ শিশু কন্যার (আয়েশা) বিয়ে হয়ে যায় । মুহাম্মদ আয়েষা যখন ৯ (ন’) বছরের তখন তাঁকে শয্যাসঙ্গিনী করেন । মুহাম্মদের এ ঘটনাটির ফলে সে সময় সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল । আজও সে সমালোচনা অব্যাহত আছে যা মুসলিমদের যথেষ্ট অস্বস্তিকর । সেই ঘটনাটিকে রোকেয়া ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করেন তীক্ষ্ণভাষায় অবরোধ-বাসিনীতে এভাবে – “ হযরতা আয়শা সিদ্দিকা নাকি ৯ বৎসর বয়সে বয়প্রাপ্তা হইয়াছিলেন; সেই জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের বালিকার বয়স আট বৎসর পার হইলেই তাহাদের উচ্চহাস্য করা নিষেধ, উচ্চৈস্বরে কথা বলা নিষেধ, দৌড়ান লাফান ইত্যাদি সবই নিষেধ । ...” (সূত্রঃ রোকেয়া/কালে ও কালোত্তরে, মোরশেদ শফিউল হাসান, পৃ ৩৪)  প্রসঙ্গতঃ একটা কথা উল্লেজখ্য যে, এ লেখাটি রোকেয়াএ জীবনের শেষদিকের রচনা । এটা উল্লেখ করলাম এজন্যে যে রোকেয়া তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী সমাজ চিন্তায় আস্থাবান ছিলেন এবং তিনি কখনোই ইসলাম ধর্মের অনুরাগী বা  মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী ছিলেন না । তাঁর রচনাগুলি সংশয়াতীতএটা প্রভাবে প্রমাণ করে যে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বা আরোপিত মুসলিমপরিচয়টি তিনি অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করে ইসলাম ধর্ম সহ সকল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ।
ধর্মের সাথে ছিঁটেফোটা আপোষ
এ কথা অবশ্যই সত্যি যে নারীর মুক্তি, স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে পুরুষতন্ত্র ও ঈশ্বরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রোকেয়া আজীবন অক্লান্ত, নির্ভিক ও সেনাপতি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত ও  শাসিত মুসলিম সমাজের সাথে আপোষ করেছিলেন । এ আপোষগুলি ছিল যেমন কিছুটা লেখনীতে, তেমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণের ক্ষেত্রেও ।  এ ধরণের আপোষগুলিকে মুসলিম মোল্লা ও বুদ্ধিজীবী সমাজ রোকেয়াকে ইসলামের অনুসারী ও অনুগামী ধর্মপরায়ণ নারী বানানোর কাজ তথা রোকেয়ার মুসলিমায়নপ্রকল্প ও প্রক্রিয়াকে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ব্যবহার করেন । রোকেয়ার সম্পর্কে  মিথ্যাপ্রচারের যে সৌধটি ইতিমধ্যেই তাঁরা নির্মান করতে সক্ষম হয়েছেন তার একটা শক্তিশালী উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এী আপোষগুলি ।  আপোষের মধ্যে একটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য একটি হলো, তিনি বোরখা পরতেন । এমন কি তিনি এও বলেন যে বোরখা পরায় কোনো দোষের কিছু নেই ।  তাঁর লেখাতে এটাও দেখা যায় যে তিনি বলছেন যে, তিনি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে নন । ব্যক্তিগত চিঠিপত্রেও তাঁর আপোষের কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে । তিনি একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘খোদা তোমার মঙ্গল করুন খোথাও লিখেছেন, ‘খোদা আমাকে টাকা দেন নাই তাঁর লেখা গল্পেও এ রকম কথা কিছু দেখতে পাওয়া যায় । কিন্তু তাঁর যে মূল রচনা অর্থাৎ যে সব রচনায় তিনি নারীর পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন বজ্র নির্ঘোষে সে সব রচনায় এই আপোষগুলি দৃষ্টিগোচর হয় না । তাই এটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না যে, তিনি যে আপোষগুলি করেছিলেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলি ছিল তাঁর সংগ্রামের একটা রণকৌশল মাত্র । তাঁর প্রতি মুসলিম পুরুষতন্ত্র ও মুসলিম মোল্লাতন্ত্রের যে ভয়ঙ্কর ক্ষোভ ক্রোধ হয়েছিল তার কিছুটা উপশম করার জন্যে কিছু কিছু আপোষ করেছিলেন বলে অনুমিত হয় । তিনি যে দুঃসাহসিক সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন সেটাকে অব্যাহত যাতে  রাখা যায় তার জন্যেই সম্ভবত এটা ছিল তাঁর একটি কৌশল মাত্র । নারীশিক্ষার জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি বালিকা বিদ্যালয় (সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল) । স্কুলটি আজও কলকাতার বুকে রোকেয়ার স্মৃতি বহন করে চলেছে । তিনি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্যে গড়ে তুলেছিলেন একটি নারী সমিতি (আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলাম) এ সব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাঁকে সাহায্য নিতে হয়েছিল মুসলমান পুরুষদের । বোরখা না পরলে তাঁরা তাঁর কাজে যে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতেন না সে কথা নিশ্চয় করেই বলা যায় । সেজন্যেই তিনি বোরখা পরেছিলেন এবং সরাসরি বোরখার বিরুদ্ধে নীরব ছিলেন তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না । তবে তিনি সুকৌশোলে বোরখাকে আক্রমণ করতে ভোলেন নি । অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থে তিনি একটি ভয়ঙ্কর দুঃখজনক ঘটনাবর্ণনা করেছেন । ‘ ... কিউল ষ্টেশনে ট্রেণ বদল করিতে হয় । মামানী সাহেবা অপর ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকান্ড বোর্কায় জড়াইয়া ট্রেণ ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন । ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কেউ ছিল না । কুলিরা তাঁহাকে তাড়াতাড়ি ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল – “ খবরদার ! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না ।সে একা টানাটানি করিয়া কিছুতেই তুলিতে পারিল না । প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করার পড় ট্রেণ ছাড়িয়া দিল । ট্রেণের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন, - কোথায় তাঁহার বোর্কা” – আর কোথায় তিনি !” ( দ্রঃ আবদুল কাদির রচিত রোকেয়া রচনাবলী, পৃ ৩৯১-৩৯২)  রোকেয়া অন্যত্র লিখেছেন  – “ রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয় । সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকদের ঘৃণা উদ্রেক করিলে ক্ষতি নাই ।পুরুষের দৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে যখন রোকেয়া নারীকে বোরকার আশ্রয় নিতে বলেন তা আমাদেরকে অবাক ও আশাহত করে । কিন্তু বোরকা পরলে নারীকে যে কুৎসিত দেখায় সে কথা তিনি বলতে দ্বিধা করেন নি এবং এই কথার মধ্য দিয়েই বোরকা সম্পর্কে তিনি কী মনোভাব পোষণ করতেন  বুঝতে অসুবিধা হয় না  বোরখা অপেক্ষা অনেক বড়ো বিষয় হলো অবরোধ যা পুরুষ সমাজ ও সকল ধর্মই নারীর উপর আরোপ করেছে তাকে পদানত করার জন্যে । অবরোধহলো নীতি, আর বোরকা হলো একটা অস্ত্র বা উপায় যা ঐনীতিকে  (অবরোধ) কার্যকর করে । অবরোধনীতিটি ভয়ঙ্করভাবে রয়েছে ইসলাম ধর্মে । একবার কৈফয়তের সুরে আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নিবললেও রোকেয়া কিন্তু অবরোধনীতিকে তাঁর মূল লেখায় তীব্র ভাষায় কশাঘাত করেছেন – “ তিনি বলিতেন, প্রাণঘাতক কার্ব্বনিক এসিড গ্যাসের সহিত অবরোধপ্রথার তুলনা হয় । বিনাযন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোকে কার্ব্বনিক গ্যাসের সতুরকতা অবলম্বন করিবার অবকাশ পায় না । অন্তঃপুরবাসিনীও শত শত নারীও এই অবরোধ-গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া মরিতেছে ।’ ( রোকেয়া জীবনী, শামসুন নাহার মাহমুদ, পৃ ৬৯) ।  শুধু প্রতিবাদই নয়, রোকেয়া এই কুৎসিত ও ভয়ঙ্কর প্রথার মূলোচ্ছেদ করতেও চেয়েছিলেন ।  পদ্মরাগউপন্যাসে সিদ্দিকার কন্ঠে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন, - “আমি আজীবন নারীজাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব  ” 
রোকেয়া মুসলিম সমাজের আর পাঁচটা শিক্ষিত নারীর মতো তথাকথিত নারীবাদী মুসলিম নারী ছিলেন না । নারীমুক্তির সংগ্রামে কেন তিনি দু-একটি আপোষ করেছিলেন তা মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অজানা নয় । তবু তাঁরা তাঁকে তাঁকে মুসলিম নারী হিসেবে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিরবচ্ছিন্ন মিথ্যা প্রচারণায় প্রমত্ত । এঁদের মতো  জ্ঞানপাপী জগৎসংসারে খুবই বিরল ।  এই জঘন্য মিথ্যা প্রচারণার পশ্চাতে নিহিত দুটি কারণ ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে । তাছাড়াও রয়েছে আর একটি কারণ মুসলিমরা দাবী করে যে তাঁরা এই পৃথিবী ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র ধর্ম ইসলামও আল্লাহ্‌র পেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ দূত (নবী ) ও চির মানবশ্রেষ্ঠ  মুহাম্মদের গৌরাবান্বিত উত্তরাধিকার । অথচ এদেশে  কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী,কলাকুশলী, সমাজকর্মী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, ব্যারিষ্টার, বিচারপতি, এসপি-ডিম-সচিব, সমাজবিজ্ঞানী, বিজ্ঞানী, গবেষক প্রভৃতি খ্যাতনামা স্বনামধন্য মানুষ যাঁরা দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে  বা দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মুল্যবান অবদান রাখেন তাঁদের মধ্যে মুসলিমদের উপস্থিতি বা প্রতিনিধিত্ব এত নগণ্য যে তাঁদের অস্তিত্ব খালিচোখে প্রায় ধরাই পড়ে না । এটা মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে যথেষ্ট অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর । এটা নিশ্চয় লজ্জাকরও । মুসলিম সমাজের এই শোচনীয় বন্ধ্যাত্ব দশা কেন তা জানার জন্যে গভীর আত্মানুসন্ধান করা ও অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত কারণসমূহ নিরসন করার সদিচ্ছা ও সাহসি উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য । কিন্তু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সে উদ্যোগ নেবার সৎ-সাহস ও সদিচ্ছার বড়ো অভাবতাঁ এই তাঁরা মুসলিম নামধারী প্রয়াত মনীষীদের যাঁরা তাঁদের জীবদ্দশায় মুসলিম সমাজের হাতে লাঞ্ছিত ও আক্রান্ত হয়েছেন আজীবন তাঁদের নিয়ে টানাটানি করেন । এভাবে তাঁরা নিজেদের অস্বস্তি ও লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ অপচেষ্টা করে থাকেন । বিদ্রোহী কবি নজরুলকে তাঁর সময়ে মুসলিম সমাজ কাফের ও ইসলামের শত্রু ও মুসলমা সমাজের কুলাঙ্গার বলে অরুচিকর ভাষায় গালাগাল দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল । আজ সেই নজরুলকে একজন মুসলিম কবি ও মুসলিম সমাজের গর্ব ও সম্পদ বলে দিনরাত প্রচারণা চালাচ্ছে । নজরুলকে নিয়ে তাঁরা অহঙ্কার করছেন । ঐ একই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে আবু সঈদ, কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ মজতুবা আলী প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের নিয়েও ।  ঐ একই মিথ্যা প্রচারণার সড়ক ধরেই তাঁরা নিরন্তর রোকেয়ার মুসলিমায়নঘটিয়ে চলেছেন ।




KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...